মহুলডিহির পোড়ো বাড়িতে | পলক ফেলা নিষেধ | Bengali Thriller Story
0 (0)

                                                      [১]

“পৃথিবীতে এরকম কত অলৌকিক রহস্য আছে জানিস?শুধু পৃথিবী কেন,আমাদের ভারতবর্ষের কথায় ধর্ না!!!”-চা এর কাপটা নামিয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরালো প্রণব,”সিপাহী বিদ্রোহের সময় এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে সিপাহীরা কিভাবে খবর পাঠাত জানিস?রুটির মাধ্যমে।”

   আমি অবাক হয়ে তাকালাম,”রুটির মাধ্যমে? মানে?”

 প্রণব বললো,”রুটি মানে হাতে করা রুটি বা যেটাকে অবাঙালিরা চাপাতি বলে।তখন তো আর মোবাইলের চল ছিল না,খবর পাঠাতে হলে হয় চিঠি অথবা টেলিগ্রাম।বিদ্রোহের সময় গোরা সৈন্যদের কড়া নজরদারির মধ্যে চিঠি পাঠানো সম্ভব ছিল না আর টেলিগ্রাম ত ছিল শুধু ব্রিটিশ অফিসিয়ালদের জন্য।তাই খবর পাঠানোর জন্য এই রাস্তায় বেছে নিয়েছিল বিদ্রোহীরা।কিন্তু রুটির মাধ্যমে কিভাবে খবরাখবর আদান প্রদান হতো সেটা এখনো রহস্যই হয়ে আছে।”

আমি বললাম,”সে তো বুঝলাম,কিন্তু তার সঙ্গে তোর এই ট্রিপ এর কি সম্পর্ক?”

প্রণব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললো,”আছে আছে সম্পর্ক আছে,আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানেও এরকমই রহস্যের সন্ধান পেয়েছি,তবে সেটাকে অলৌকিক না বলে ভৌতিক বলাই ভালো।”

“শুধু হেয়ালিই করবি না খুলে বলবি কি ব্যাপার!!!”

“শোন তাহলে,তুই তো জানিস আমাদের পত্রিকা প্রতি বছর একটা করে বিশেষ ভৌতিক সংখ্যা প্রকাশ করে।তাতে নামিদামি লেখকের গল্প – উপন্যাস – প্রবন্ধ সবরকম লেখাই থাকে।এমনকি অনেক অখ্যাত লেখকের লেখাও এই সংখ্যায় ছাপা হয়। তো এইবার আমার ওপরে ভার পড়েছে আমাদের আশেপাশে যে বাড়িগুলো ভূতের বাড়ি বলে পরিচিত সেইগুলোর ওপরে একটা ফিচারস লিখতে হবে।তবে শর্ত আছে,এমনি এমনি লেখা যাবে না।প্রথমত,জায়গাটা জেনুইন হতে হবে।নাহলে এমন অনেক বাড়ি আছে যেগুলো আদতে অ্যান্টিসোশ্যাল দের ডেরা,নির্বিঘ্নে কাজ করার জন্য ভূতের গল্প তারাই রটিয়ে রাখে।আর দ্বিতীয় শর্ত হলো,লোকের মুখের কথা শুনে লেখা যাবে না,রীতিমত সেখানে একরাত কাটিয়ে এসে তারপর লিখতে হবে।”

আমি বললাম,”কিন্তু তুই তো আর লেখক নস,তুই তো ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার,তাহলে তোর ওপরে লেখার ভার দিল কেন?”

-“আসলে এই পুরো আইডিয়া টাই আমার দেওয়া,তাই সম্পাদক বললেন আমাকেই শুরু করতে।যদি টপিকটা ক্লিক করে যায় তাহলে প্রতি সংখ্যাতেই একটা করে এরকম লেখা ছাপানো হবে।আর এটার জন্য রীতিমত পারিশ্রমিক পাবো চাঁদু, হুঁ হুঁ এমনি এমনি কি আর করতে রাজি হয়েছি!!

-“সে তো বুঝলাম”- সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিয়ে বললাম,”কিন্তু সেরকম জেনুইন ভূতের বাড়ি পাবি কোথায়?”

প্রণব বাঁ দিকের ঠোঁটটা কুঁচকে অদ্ভুতভাবে হাসলো,”একটার খোঁজ পেয়েছি বটে,কিন্তু সেটা ঠিক বাড়ি নয়।”

-“বাড়ি নয় মানে?”

প্রণব বলে চললো,”জায়গাটা তমলুক থেকে ১২ কিমি দূরে,একদম অজ পাড়া গাঁ । নাম বোধহয় মহুলডিহি বা এরকম কিছু।প্রায় দেড়শো বছর আগে ওখানকার জমিদার ব্রিটিশদের সাহায্যে একটা বিশাল পাগলাগারদ তৈরি করে।বাইরে থেকে দেখে মনে হবে কোনো রাজবাড়ি,কিন্তু ভিতরে পুরো একটা গ্রামের সেটআপ পাবি।কি ছিল না সেখানে?বাজার হাট,মুদির দোকান, জামা কাপড়ের দোকান,সেলুন থেকে শুরু করে বেশ্যাখানা পর্যন্ত ছিল।সারা দেশ থেকে পাগলদের ধরে আনা হতো চিকিৎসার জন্য।তখনকার দিনের চারজন নাম করা ডাক্তার এই সমস্ত ব্যাপারটার পরিচালনা করতেন।গ্রামের অনেক মানুষের রুজিরুটি এই পাগলাগারদ কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।”

-“তারপর!”

-“তারপর?জমিদার দর্পনারায়ন সিংহরায় বুঝতে পারেননি তার তৈরী করা পাগলাগারদ ব্রিটিশদের টর্চার সেল এ পরিনত হবে।চারিদিকে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে,ব্রিটিশরা বিপ্লবীদের ধরে এনে এখানে টর্চার করা শুরু করে।অমানুষিক সেই অত্যাচার।জমিদার তখনও বেঁচে,গ্রামেরই কয়েকটা ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ব্রিটিশরা অত্যাচার করে মেরে ফেলে।তারপর সেই পাগলাগারদের বাইরে একটা আমগাছে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেয়।গ্রামে রটিয়ে দেয় এরা রাত্রিবেলায় পালিয়ে এসে আত্মহত্যা করেছে।দর্পনারায়ন এতবড় মিথ্যাচার সহ্য করতে পারেননি।লোকে বলে,তার কিছুদিন পরেই রাতের অন্ধকারে সেই পাগলাগারদে তিনি আগুন লাগিয়ে দেন।রাতারাতি পুড়ে ছাই হয়ে যায় সেই বাড়ি।”

-“আর সেই বাড়িতে থাকা লোকজন?”

-“একটা লোকও বেঁচে বেরোতে পারেনি ওখান থেকে।দর্পনারায়ন নিজে বন্দুক হাতে বাইরে দাড়িয়ে ছিলেন,সঙ্গে পাঁচজন বিশ্বস্ত অনুচর।যারাই বেরিয়ে পালাতে গেছিলো সবাইকে গুলি করে মারেন।তবে লোকে বলে,তার আগে নাকি বেশ কিছু বিপ্লবীকে ওখান থেকে সরিয়ে আনতে পেরেছিলেন দর্পনারায়ন।”

-“সে তো বুঝলাম,কিন্তু ওই বাড়িটা ভূতের বাড়ি সেখবর তোকে কে দিল?”

-“আছে আছে খবর দেওয়ার লোক আছে।গত দেরশো বছরে গ্রামের মানুষ ওই বাড়িতে পা রাখেনি।বাইরে থেকে প্রায়ই নাকি কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়।পূর্ণিমার রাত্রে দেখা যায় ছাদের আলসে ধরে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে।রাতের বেলা দূরে থাক,দিনের বেলাতেও কুকুর বিড়াল ওই বাড়ির ছায়া মারায়না।অথচ মাঝে মাঝেই এক বিশাল কুকুরকে দেখা যায় বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

আমি হেসে বললাম,”ব্যাপারটা অনেকটা হাউন্ড ওফ বাস্কর্ভিলের মতন শোনাচ্ছে না?”

-“আরে সেইজন্যই তো সরেজমিনে তদন্ত করতে যাওয়া।ভাগ্য ভালো থাকলে দেড়শো বছরের পুরনো ভূতের দেখাও মিলে যেতে পারে।আর তা নাহলে অন্তত দেড়শো বছরের  পুরনো এক ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ তো দেখতে পাবো।সেটাই বা কম কি বল!ও হ্যাঁ ভালো কথা,তুইও যাচ্ছিস আমার সঙ্গে।কোনো চিন্তা করিস না আমি সব ব্যবস্থা করে রাখছি।আসছে শনিবার নাগাদ বেরিয়ে পড়বো।ট্রেন বোধহয় সকাল নটায়।সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে বিকালের আগেই পৌঁছে যাবো।”

 [২]

ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি রাখেনি প্রণব।সবার আগে জায়গাটার একটা ম্যাপ বানিয়ে ফেলেছিল,যাতে ওখানে পৌঁছাতে কোনো অসুবিধা না হয়।কোন ট্রেন কটার সময়,তারপর বাসে করে কতদূর যাওয়া যাবে,বাস না পেলে লোকাল ট্রান্সপোর্ট এর কি ব্যবস্থা,সব কিছু নিজের ডায়রীতে লিখে রেখেছিল।যেহেতু রাত্রে ওই বাড়িতেই রাত কাটাতে হবে তারও সরঞ্জাম সব জোগাড় করে ফেললো।কোন এক বন্ধুকে ধরে জোগাড় করলো দুটো তাবু যাতে অন্তত সাতজন আরামে রাত কাটাতে পারবে।এছাড়া শতরঞ্চি,দুটো পাম্প বালিশ,চার্জার লাইট,রান্না করে যদি খেতে হয় তারজন্য স্টোভ,সামান্য কিছু বাসন — কোনো কিছুই বাদ রাখলো না।এগুলো ছাড়াও সাইড ব্যাগ এ ভরে নিলো ক্যামেরা,ল্যাপটপ,দুটো বড় টর্চ,দুটো আলাদা সাইজের ছুরি,নিজের রিভলভার আর কিছু টুকটাক জিনিস।দুদিনের মতন জামা কাপড়ও ভরে নিলো।স্টেসন এ ওর লটবহর দেখে বলেই ফেললাম,”হ্যাঁ রে কদিন থাকবি ঠিক করেছিস ওখানে?আমি তো এক্সট্রা এক সেট জামা প্যান্ট,টর্চ আর ছাতা ছাড়া বিশেষ কিছুই নিইনি।”

প্রণব বললো,”বেশ একটা পিকনিক পিকনিক মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা?”

-“হ্যাঁ দুজনে মিলে পিকনিক না আরো কিছু!”

ট্রেন স্টেশনেই দাঁড়িয়ে ছিল।ব্যাগ গুলো তুলে সিটের তলায় ভরে দিল প্রণব।তারপর সিটের ওপর পা তুলে বসে বললো,”ওহ তোকে বলতে ভুলে গেছিলাম।শুধু আমরা নয়,আমাদের সঙ্গে আরও দুজন ভদ্রলোক যাচ্ছেন।এই তো আপনাদের কথায় হচ্ছিল…”

বলতে বলতে দেখি দুজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসে আমাদের পাশে বসলেন।প্রণব পরিচয় করিয়ে দিল,”ইনি হলেন শুভময় সামন্ত। মহুলডিহির বাড়িটার খোঁজ ইনিই দিয়েছিলেন।ওই গ্রামেই ওনার আদি বাড়ি।আমরা যাচ্ছি শুনেই আমাদের সাথে যাওয়া ঠিক করেন।আর ইনি হলেন ফাল্গুনীবাবু।এনার পরিচয় পরে বিশদে দেওয়া যাবে।আপাতত শুধু এইটুকু জেনে রাখ উনি হচ্ছে নাম করা ভুত বিশেষজ্ঞ।”

আমি একটু অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম।ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, বেঁটে খাট গোলগোল চেহারা,টকটকে ফরসা গায়ের রং,চোখে পুরু লেন্সের চশমা, গালে ট্রিম করা দাড়ি,পরনে হাফহাতা জামা,কাঁধে ঝোলানো অফিস ব্যাগ।এইরকম একটা লোক সরকারি অফিসের চাকুরে হতে পারে,ভূতের ওঝা কোনো মতেই নয়।

প্রণব বললো,”মুখে যতই সাহস দেখায়না কেনো,আমি বাপু ভূতে রীতিমত ভয় করি,তাই ওনাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম।উনি যথেষ্ট ব্যস্ত মানুষ কিন্তু আমার অনুরোধ ফেলতে পারেননি।এক কথাতেই রাজি হয়ে গেছেন।”

ট্রেনে বেশ জাঁকিয়ে বসলাম।তমলুক প্রায় চারঘন্টার ধাক্কা,দুপুরের আগে পৌঁছানো যাবে না।তারপর ওখানে নেমে আবার বাস অথবা অটো।তবে আমাদের সঙ্গে যা লটবহর আছে বাসে চাপা প্রায় অসম্ভব। শুভময়বাবু বললেন ওনার চেনা অটো ওয়ালা আছে,স্টেশনে নেমে ফোন করে দেবেন।

        আমরা গল্প করতে লাগলাম।গল্পের বিষয়বস্তু অবশ্যই ভৌতিক ছিল,কিন্তু দিনের আলোয় দশটা লোকের ভীড়ে ভূতের গল্প ঠিক জমে না।আর সব থেকে বেশি যার বলার কথা সেই ভূত বিশেষজ্ঞ ফাল্গুনীবাবু কিন্তু চুপ করে আমাদের কথা শুনছিলেন আর মিটি মিটি হাসছিলেন।প্রণব অবশ্য দুয়েকবার তাকে তাতানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ফাল্গুনীবাবু মুচকি হেসে অ্যাভয়েড করে গেলেন।

        তমলুক পৌছালাম দেড়টা নাগাদ।স্টেশনে নেমেই শুভময়বাবু অটোওয়ালা কে ফোন করে দিলেন।তারপর হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা মহুলডিহির উদ্দেশে রওনা দিলাম।

      অটোচালককে শুভময়বাবু বলে দিয়েছিলেন আমরা কোথায় যাবো।শুনে সে বেশ কিছুটা অবাক হয়ে গেলো।ওই বাড়ি তো বহুকাল ফাঁকাই পড়ে আছে,কেউ যায়না ওখানে।লোকে বলে ওই বাড়িটা নাকি অপদেবতার ডেরা।প্রণব শুনেই বেশ উচ্ছসিত হয়ে উঠলো।ওই বাড়িটায় কি কি দেখা যায় ড্রাইভারকে বার বার সেটাই শুধাতে লাগলো।

[৩]

মহুলডিহির সেই ধ্বংসপ্রায় রাজবাড়ী (নাকি পাগলাগারদ বলবো) র সামনে দাড়িয়ে গা টা ছমছম করে উঠলো। এ কোথায় নিয়ে এলো প্রণব!বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলায় ভালো।আমাদের ঠিক সামনে এক বিশাল লোহার গেট,তার ওপরে দুটো সিংহ একটা গোলকের ওপরে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।গেটের দুপাশে প্রায় দশ ফুট উঁচু পাঁচিল।গেটের ঠিক পিছনেই বিশাল বাগান,সেই বাগান এখন আগাছার জঙ্গলে ভর্তি আর তার পরেই মূর্তিমান অভিশাপের মতন দাঁড়িয়ে আছে সেই রাজপ্রাসাদ।।

প্রাসাদটি দোতলা।ওপরে নিচে লম্বা টানা বারান্দা।বারান্দার গায়ে সারি সারি দরজা,ওপর নিচ মিলিয়ে সামনের দিকে বারোটা দরজা।পিছনের দিকে আরও থাকলেও থাকতে পারে।নিচের মেন দরজার ঠিক আগে একটা পর্টিকো গোছের কিছু ছিল,কিন্তু এখন আর সেটা বোঝার উপায় নেই।মূল বিল্ডিং টা বাইরে থেকে দেখে মোটামুটি অক্ষত মনে হলেও ভিতরে গেলে হয়তো আসল ভাঙাচোরা রূপটা দেখতে পাবো।প্রাসাদের গায়ে এখানে সেখানে লতানে গাছ উঠতে দেখতে পাচ্ছি,তাছাড়া সমস্ত বাড়িতেই যেনো কালশিটে পরে গেছে।মনে পড়লো বহুবছর আগে নিজের হাতে তৈরি এই প্রাসাদকে নিজের হাতেই সৎকার করেছিলেন দর্পনারায়ন।

লোহার গেট খুলে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। চারিদিকে কেমন একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে।মনে হয় যেন অন্য কোনো জগতে পা রেখেছি।এই জগতে মানুষের প্রবেশাধিকার নেয়।বার বার মনে হতে লাগলো এখানে আসাটা ঠিক হয়নি,এখুনি আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।

ফাল্গুনীবাবু দেখলাম ঢুকেই নাক টেনে টেনে কি যেনো শুঁকতে লাগলেন।প্রণব ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে প্রাসাদ টার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে লাগলো।শুভময়বাবু কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা মূল বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন।

ফাল্গুনীবাবু পকেট থেকে একটা কম্পাস বের করে কিছু একটা দেখে নিলেন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”জায়গাটা বিশেষ ভালো ঠিকছে না, বুঝলেন।অশুভ একটা কিছু আড়াল থেকে আমাদের ওপর লক্ষ্য রাখছে।”

প্রণবের ফটো তোলা হয় গেছিল।এবার দেখলাম সেও মূল প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলো।আমরাও পিছন পিছন গেলাম।যা ভেবেছিলাম তাই,প্রাসাদের ভিতরটা ভেঙেচুরে একসা হয়ে আছে।ভিতরে ঢোকার কোনো রাস্তায় নেয়।প্রণব বাইরে থেকেই যতগুলো পারলো ছবি তুলে নিলো।

এবার শুভময়বাবু বললেন,”চলুন তাবু গুলো খাটিয়ে নেওয়া যাক।ওই দেখুন পশ্চিম দিক থেকে কেমন আকাশ কালো করে মেঘ আসছে।যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।তার আগে মাথা গোঁজার একটা ঠাই করতে হবে।”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম সত্যিই তাই।আকাশ কালো করে ক্ষ্যাপা মোষের মত গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ ঘনিয়ে আসছে,সেই সঙ্গে হালকা জলো হাওয়াও বইতে লেগেছে।যেকোনো মুহূর্তে ঝড় উঠবে।আমরা ধরাধরি করে তাড়াতাড়ি তাবু বিছাতে লাগলাম।শুভময়বাবু ব্যাগে কার্বলিক অ্যাসিড এনেছিলেন। তাবু বিছানো হলে চারপাশে ছড়িয়ে দিলেন।যাক,অন্তত সাপ খোপের হাত থেকে বাঁচা যাবে।

ঝড় শুরু হয়ে গেলো।সেই সঙ্গে বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা।আমরা তাবুর ভিতরে ঢুকে মালপত্র ব্যাগ থেকে বের করে রাখতে লাগলাম। হটাৎ ফাল্গুনীবাবু বললেন,”একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছেন?আমরা যে এতক্ষণ ধরে এখানে আছি একটাও পাখি বা পোকামাকড় দেখতে পেয়েছেন??? ঝড় ওঠার আগে পাখিরা চিৎকার করতে করতে নিজেদের বাসায় ফেরে,এরকম আগাছার জঙ্গলে থেকে থেকেই ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে ওঠে।কিন্তু এখানে এসে থেকে দেখা তো দূরে থাক একটা প্রাণীর ডাক পর্যন্ত শুনতে পায়নি।এইখানে এসে সমস্ত পৃথিবী যেন স্তব্ধ,বোবা হয়ে গেছে।”

শুভময়বাবু বললেন,”হ্যাঁ ব্যাপারটা কিন্তু আমিও লক্ষ্য করেছি।আমরা সাপের জন্য কার্বলিক অ্যাসিড ছড়ালাম বটে কিন্তু এসে অবধি কিন্তু কোনো সাপখোপ দেখতে পায়নি।অথচ এখানে যা জঙ্গল,তাতে একটা দুটো দেখতে পাওয়া কিন্তু অস্বাভাবিক নয়।”

ফাল্গুনীবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন,”আমরা এক অন্য জগতে এসে পড়েছি শুভময়বাবু।সাধারণ,স্বাভাবিক কোনো ঘটনা এখানে প্রবেশ করতে পারবে না।”

আমরা কিছুক্ষন থম মেরে বসে রইলাম তাবুর ভিতরে।বাইরে তখন প্রলয় শুরু হয়ে গেছে।দিকবিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নেমেছে,সেই সঙ্গে আকাশ বাতাস আলোকিত করে বিদ্যুৎ চমক।এইরকম বৃষ্টিকেই বোধহয় বলে মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি।

হাতঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে দেখলাম,সন্ধে হয় এসেছে।এরকম বৃষ্টি কতক্ষন চলবে কে জানে।আমরা ব্যাগ থেকে শুকনো খাবার বের করে চিবোতে লাগলাম।

হটাৎ কানে এলো কারা যেনো অত্যন্ত অসহায় ভাবে কাঁদছে।যেনো একদল লোককে বেঁধে রেখে প্রচন্ডভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে,আর সেই সমস্ত অসহায় মানুষ গুলো মুক্তির আশায় হা হুতাশ করে কাঁদছে। বড়ো করুন সে কান্না,যেনো কুড়িজন মানুষ একসঙ্গে কাঁদছে।প্রথমে মনে হলো ঝোড়ো হাওয়ায় বোধহয় এরকম শব্দের সৃষ্টি হয়েছে,কিন্তু ভালো করে কান পেতে শুনলাম,নাহ,এইটা কান্নার ই আওয়াজ।চারজন একসঙ্গে ভুল শুনবো না।

ফাল্গুনী বাবু ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে তাবু থেকে বেরোতে যাচ্ছিলেন,এমন সময় প্রণব তার কাঁধটা খামচে ধরলো।ফিসফিসিয়ে বললো,”বেরোবেন না।ভালো করে শুনুন,আওয়াজটা ওই পোড়ো প্রসাদটার থেকে আসছে।”

বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো।যে বাড়িতে গত দেড়শো বছর ধরে কেউ থাকে না,সেখান থেকে এতগুলো মানুষের কান্নার আওয়াজ আসে কি করে?

[৪]

ঘণ্টাদুয়েক বাদে বৃষ্টিটা থামলো।কিন্তু আকাশ বাতাস এখনও থমথমে হয়ে গেছে।আর থেকে থেকে সেই কান্নার আওয়াজটা এখনও ভেসে আসছে।আমরা ঠিক করলাম চারজনেই প্রাসাদের চারপাশটা ঘুরে দেখবো।সবাই হাতে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে এলাম।প্রণব রিভলবারটা বের করে জামার তলায় গুঁজে নিল।ফাল্গুনীবাবু কাঁধে তার ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিলেন।

আমরা যেখানে তাবু খাটিয়েছিলাম সেখান থেকে প্রাসাদের দূরত্ব প্রায় তিরিশ ফুট।ফাল্গুনীবাবু প্রাসাদের দরজার কাছে গিয়ে টর্চ জ্বেলে ভিতর দিকে উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলেন।আমি ওনার কাঁধে ওপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম।ভিতরে বেশ কিছু আসবাবপত্র ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে,চারিদিকে মাকড়শার ঝুল,মাটিতে কালো কালো ধুলোর পুরু আস্তরণ।দরজা পেরোলেই একটা বিশাল ঘর,যেটা বোধহয় রিসেপশন ছিল,সেই ঘরের দুপাশ দিয়ে দুটো সিড়ি উঠে গেছে দোতলায়।সিড়ির পাশে একটা ভাঙ্গা দরজা দেখা যাচ্ছে কিন্তু সেটার রাস্তা কোনদিকে গেছে বাইরে থেকে বোঝা দায়।

         উঁকি ঝুঁকি মারার সময় অসাবধানতা বশতঃ আমার হাত লেগে গেল প্রাসাদে ঢোকার দরজার হাতলে,আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শুনতে পেলাম এক অমানুষিক আর্তনাদ।যেনো মনে হলো নরক থেকে উঠে আসা কোনো শয়তানের গলা চিরে সেই চিৎকার বেরোচ্ছে।আর ঠিক সেই মুহূর্তে দরজাটাও বিকট আওয়াজ করে খুলে গেলো।

আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম।আওয়াজটা দোতলা থেকে যে এসেছে সেই ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত,কিন্তু এই নিশুতি রাত্রে দোতলায় যাওয়ার দুঃসাহস আমাদের কারোরই হলো না।কোনরকমে দরজাটা টেনে আবার বাইরে থেকে লাগিয়ে দিলাম।ফাল্গুনীবাবু ব্যাগ থেকে একটা লাল সুতো বের করে দরজার হাতলে ভালো করে পেঁচিয়ে দিলেন।শুধালাম,”কিসের সুতো,ফাল্গুনীবাবু?”

ফাল্গুনীবাবু মাথায় হাত ঠেকিয়ে বললেন,”মা তারার প্রসাদি সুতো।যদি ভিতরে কোনো অপশক্তি থেকে থাকে তবুও সে বাইরে আসতে পারবে না।আমি মন্ত্র দিয়ে বেঁধে দিলাম।”

জানিনা ফাল্গুনীবাবু ভন্ড কিনা কিন্তু তার এই কথা শোনার পর বুকের ভিতর থেকে যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।প্রাসাদের ভিতরে কিছু একটা যে আছে সে বিষয়ে এখন আর আমাদের কোনো সন্দেহই নেই।সেই অপশক্তি কি এতদিন ঘুমিয়ে ছিল?আজ তার রাজত্বে আমরা প্রবেশ করায় আবার সে জেগে উঠেছে?এই বাড়ির ওপরে কোন অভিশাপ তার করাল গ্রাস বিস্তৃত করেছে?

     শুভময়বাবু এতক্ষণ প্রাসাদের সামনের ফাঁকা বাগানটায় ঘোরাফেরা করছিলেন। হটাৎ তার গলা শুনতে পেলাম,”ও মশায় একবার এই দিকটা দেখে যান তো।”

     দূর থেকে দেখলাম শুভময়বাবু একটা আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন।আগে বোধহয় এই গাছের তলায়ও ছোট্ট একটা ঘরের মতন ছিল কারণ দুর থেকে ইঁট পাথর কাঠ এইসব দেখতে পাচ্ছিলাম।কিন্তু কাছে যেতেই ভুল ভেঙে গেলো।

     কয়েকটা কবর! কাদের জানিনা কারণ তার ওপরে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নেয়,কারোর নাম লেখা নেয়।ওপরের সিমেন্টের বেদিটা কবেই ভেঙে গেছে,তার ফাঁক দিয়ে মাটি বেরিয়ে এসেছে।আর সেই বেদীর চারপাশে অজস্র আগাছার জঙ্গল।গুনে দেখলাম, মোট এগারোটা কবর আছে।

     প্রণব ক্যামেরা বের করে একের পর এক ছবি তুলতে লেগে গেল।ফাল্গুনীবাবু মাথা নাড়তে লাগলেন।বুঝতে পারলাম কোনো একটা অজানা কারণে তার মনের মধ্যে অসস্তি লেগে রয়েছে।বেশ কিছুটা সময় এখানেই কেটে গেলো।হাতের ঘড়িতে তখন প্রায় আটটা বাজতে চললো।আমি প্রণবকে বললাম,”চল এবার তাবুতে ফেরা যাক।রাত্রের খাবার ব্যবস্থা করতে হবে।”

ফাল্গুনীবাবু বললেন,”হ্যাঁ চলুন।জায়গাটা খুব একটা ভালো না।আমাদের সাবধানে থাকতে হবে।একটা কথা আপনাদের বলে রাখি,যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন,একা একা কোথাও যাবেননা।আর রাত্রে হয়তো এমন অনেক কিছু দেখতে পাবেন যা আগে কখনো দেখেননি,কিন্তু সাহস হারালে চলবে না কিন্তু।তাহলেই প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।একটা কথা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিন,এখানে খারাফ শক্তির প্রভাব কিন্তু খুব বেশি।এরা চাইলেই আমাদের ক্ষতি করতে পারে।আমাদের যতটা সম্ভব নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হবে।আর এই নিন,এই লাল সুতো গুলো হতে বেঁধে নিন।এইগুলো যতক্ষণ আপনাদের হাতে থাকবে কোনো অশুভ শক্তি আপনাদের ক্ষতি করতে পারবে না।”

      আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে সুতো গুলো হতে জড়িয়ে নিলাম।প্রণব আগে আগে টর্চ দেখাতে দেখাতে যাচ্ছিল,তাবুর সামনে এসেই কেমন যেন থমকে গেল।

    শুধালাম,”কি হয়েছে রে??দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো?ভিতরে চল!”

প্রণব মুখে কিছু না বলে হাতের আঙ্গুল দিয়ে মাটির দিকে ইশারা করলো।

    দেখলাম আমাদের তাবুর চারপাশের মাটিতে অজস্র হাতের ছাপ,মানুষের হাতের ছাপ।কেউ যেন হাতের ভরে এসে আমাদের তাবুটা ভালো করে লক্ষ্য করে গেছে।কাছে এগিয়ে গিয়ে টর্চের আলো ফেলে ভালো করে ছাপ গুলো দেখলাম।একটা নয়,অনেকগুলো হাতের ছাপ,কিন্তু সবই ছোট ছোট হাতের চাপ।অর্থাৎ যে এসেছিল সে হামাগুড়ি দিয়ে এসেছিল।

   শুভময়বাবু কিছু একটা বলতে গেলেন,ঠিক সেই সময় শুনতে পেলাম আমাদের ঠিক পিছনেই একটা বাচ্চার খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ।আমরা ঝট করে পিছনে ঘুরলাম,আমার টর্চের আলো সোজা গিয়ে পড়লো একটা জবাগাছের ঝোপের ওপরে।চকিতের জন্য দেখতে পেলাম একটা বাচ্চা ছেলের পা ঝোপের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।আমরা দৌড়ে গেলাম ঝোপের দিকে,ফাল্গুনীবাবুর হাতে একটা আড়াই ফুটের লম্বা বাঁশের লাঠি ছিল,উনি সেটা দিয়েই ঝোঁপ গুলো সরাতে লাগলেন।কিছুক্ষণ এলোপাথাড়ি লাঠি চালানোর পরেই যা চোখে পড়লো,দেখে আমার পেটের ভিতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হতে লাগলো, হাত পা অবশ হয়ে এলো, জিভটাও কেমন যেন শুকনো মনে হলো।

    দেখলাম,ঝোঁপের ভিতরেও একটা কবর,তার ওপরে লেখা

                 নালক হেমব্রম

   ১৭ই জুলাই,১৮৮৯ – ২৩শে ফেব্রুয়ারি,১৮৯১

ঠিক সেই মুহূর্তে প্রাসাদের ভিতর থেকে কেউ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।

[৫]

সেদিন রাত্রে আর কিছু হয়নি,শুধু থেকে থেকে একটা চিৎকার আর মৃদু কান্নার শব্দ কানে আসছিলো।আর খালি মনে হচ্ছিলো ঝোঁপের আড়াল থেকে কারা যেনো আমাদের দিকে নজর রেখে যাচ্ছে।তারা অপেক্ষা করছে কখন আমরা অন্যমনস্ক হবো আর সেই মুহূর্তেই তারা আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের শেষ করে দেবে।

   সারাটা রাত ভালো করে ঘুমাতে পারিনি।অবশেষে কালরাত্রির অবসান হয় ভোরের আলো ফুটলো।প্রাসাদের বাইরের তেঁতুল গাছ থেকে অজস্র পাখির ডাক ভেসে এলো।এখানে আসার পরে এই প্রথম বোধহয় প্রাণীজগতের ডাক শুনতে পেলাম,যদিও প্রাসাদের ভিতরের বাগানের গাছগুলোতে কিন্তু একটাও পাখি ডাকছিল না।পশুপাখিদের ইন্দ্রিয় আমাদের তুলনায় অনেক প্রবল,সেই কারণেই বোধহয় এই অশুভ জায়গার ছায়াও তারা মাড়ায় না।

   আমরা তাবুর বাইরে বেরিয়ে এলাম।তখন সবে মাত্র সূর্য উঠেছে।তার লাল আভা চারিদিকে গলন্ত সোনার মতন ছড়িয়ে পড়ছে।থেকে থেকে একটা ঠান্ডা কনকনে হাওয়া শরীর কাপিয়ে দিচ্ছে।শুভময়বাবু সূর্যের দিকে মুখ করে হাত জোড় করে সূর্যমন্ত্র উচ্চারণ করলেন,”ওম জবাকুসুমো সংকাসং….”

   হটাৎ লোহার গেট ঠিলে একটা ছেলে এসে ঢুকলো,তার এক হাতে চায়ের কেটলি,অন্য হাতে কাঁচের গ্লাস।অদ্ভুতভাবে ছেলেটা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই একটা দোয়েল পাখি প্রাসাদের বাগানের ভিতরেই কোথাও যেন ডেকে উঠলো।প্রণব ভ্রু কুঁচকে একবার ছেলেটার দিকে তারপরেই প্রাসাদের দিকে তাকালো।কেমন যেন হতচকিত লাগছিল ওকে।

   ছেলেটা আমাদের কাছে এসে বললো,”বাবু চা।”

   শুধালাম,”কে রে তুই?কি নাম তোর?আমরা এখানে আছি জানলি কি করে?”

   ছেলেটার বয়স ষোলো সতেরো হবে,লম্বা দোহারা চেহারা,শ্যামলা গায়ের রং,মুখে অমলিন হাসি।কাঁচের গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে বললো,”আজ্ঞে আমার নাম গোবিন্দ।আমাকে গাঁয়ের মোড়ল মশাই পাঠিয়ে দিলেন।আপনারা যে এখানে এসেছেন তা আমরা জানি।কিন্তু গাঁয়ের কেউ এইবাড়িতে আসেনা,সেইজন্য আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।”

   “কেনো রে,আসেনা কেনো?”

   “আজ্ঞে ভয় পায় যে।এই বাড়িতে খারাফ কিছু আছে একটা।সবাই ভয় করে।”

   “তবে তুই এলি যে!তোর ভয় করেনা বুঝি?”

গোবিন্দ আবার মনভালো করা হাসি হাসলো।হাতের চা ভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিল ফাল্গুনীবাবুর দিকে।ফাল্গুনীবাবু দেখলাম অপলক দৃষ্টিতে গোবিন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।তার মুখে কেমন যেন একটা পরিতৃপ্তির হাসি।

চা টা সত্যিই ভালো ছিল।আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে গ্লাস গুলো গোবিন্দ কে দিয়ে দিলাম।গোবিন্দ মনের সুখে শিস দিতে দিতে চলে গেলো। ও চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেই হিমশীতল নিস্তব্ধতা ঘনিয়ে এলো।

   প্রণব বললো,”শিস টা কেমন অদ্ভুত তাই না!শুনলেই মনটা কেমন হয়ে যায়!”

   আমি ঘাড় নাড়লাম।প্রণব একটা সিগারেট ধরিয়ে শুভময়বাবুকে বললো,”ও মশাই,চলুন একটু ঘুরে আসি।আপনাদের এখানে কি একটা মন্দির আছে বলছিলেন না!চলুন সেটা দেখে আসি,তারপর বাজারে গিয়ে ভালো করে কচুরি আর জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো।আজ সারাদিন অনেক কাজ কিন্তু!”

    শুভময়বাবু বললেন,”তা তো বটেই আজ প্রাসাদের ভিতরে ঢুকবো তো আমরা!”

প্রণব বললো,”চলুন তাহলে ঘুরে আসা যাক তাপর কাজে লাগবো।ও ফাল্গুনীবাবু,চলুন চলুন দেব দর্শন করে আসি।”

   আমরা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম।লাল মাটির রাস্তা,সকালের মিঠে রোদ,মৃদুমন্দ বাতাস সারা রাতের ক্লান্তি যেনো ধুয়ে মুছে দিচ্ছিল।ফাল্গুনীবাবু শুধালেন,”কিসের মন্দির বললেন না তো!”

শুভময়বাবু বললেন,”গাঁয়ের লোক বলে দামোদর মন্দির।বহুবছর আগের তৈরি একটা দেউল।রাধা দামোদর দেউল।চলুন দেখবেন কি অপূর্ব টেরাকোটার কাজ আছে মন্দিরে।আগে এই মন্দিরে রোজ দুবেলা পুজো হতো,কিন্তু এখন গাঁয়ে নতুন মন্দির হওয়াতে এত দূরে লোক আসে না।বছরে দুতিনবার জমায়েত হয় তখন ধুমধাম করে পুজো হয়।”

প্রাসাদ থেকে মন্দিরের দূরত্ব মাইল খানেকের একটু বেশি।আমরা যখন মন্দিরের সামনে পৌছালাম তখন সূর্যের আলো তেরছা ভাবে মন্দিরের মাথায় পড়তে লেগেছে।প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু দেউলে র প্রায় পুরো দেওয়ালেই অপূর্ব কারুকার্যের ছোঁয়া।তবে এই মন্দিরে ওড়িশার মন্দিরের ন্যায় স্থাপত্যরীতি চোখে পড়ে।সমগ্র মন্দিরে টেরাকোটার কাজ নজরে পড়লো,তার মধ্যে গ্রাম বাংলার কিছু দৃশ্যের সঙ্গে মৈথুনরত নারী পুরুষ ও চোখে পড়লো।স্বীকার করতে বাধা নেয় এইরকম অপূর্ব মন্দির এর আগে দেখিনি।প্রণব প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে লাগলো।আমরা এগিয়ে গেলাম মন্দিরের ভিতরে।

     ভিতরে কোনো মূর্তি নেয়,বদলে দেওয়ালে খোদাই করা রয়েছে রাধাকৃষ্ণের এক অপূর্ব মূর্তি।সেই মূর্তি দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।কিছুক্ষণের জন্য তন্ময় হয়ে গেলাম।

  শুভময়বাবু বললেন,”ওই যে মন্দিরের দরজার ওপরে কুলুঙ্গি টা দেখছেন,ওখানে একটা পাথরের কৃষ্ণমূর্তি আছে।নিচে থেকে দেখতে পাবেন না।কিন্তু পূর্ণিমার রাত্রে চাঁদের আলো মন্দিরের ভিতরের কোনো এক অজানা জায়গা দিয়ে প্রবেশ করে ওই কুলুঙ্গি তে এসে পড়ে আর সেই মূর্তির ছায়া এই মন্দিরের উঠোনে এসে পড়ে।বেশ স্পষ্ট বোঝা যায় কৃষ্ণর আদল।আশেপাশের গ্রামের লোক ও দেখতে আসে।”

   নিজের অজান্তেই হাতটা কপালে চলে গেল।মন্দিরে প্রণাম করে বেরিয়ে এসে দেখলাম প্রণব তখনও ফটো তুলে যাচ্ছে আর ফাল্গুনীবাবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মন্দিরের কারুকার্য গুলো লক্ষ্য করে যাচ্ছেন।আমাদের বেরিয়ে আসতে দেখে বললেন,”চলুন, হাটের দিকে যাওয়া যাক,খিদে পেয়েছে। ফিরে গিয়ে অনেক কাজ আছে,প্রাসাদের ভিতরটা ঢুকে দেখতে হবে।”

  হাট থেকে জিলিপি আর কচুরি খেয়ে যখন আমরা প্রাসাদে ফিরলাম তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজছে।প্রাসাদের গেট খুলে ঢুকতেই কানে এলো শিসের শব্দ।গোবিন্দ আবার এসেছে।আমাদের দেখেই এগিয়ে এসে বলল,”মোড়ল বলে পাঠালো আজ দুপুরের খাবার এখানে পাঠিয়ে দেবে।তবে আজকের রাতটা এখানে থাকবেন না।বিকাল থাকতেই বেরিয়ে পড়ুন।আজ পূর্ণিমা,আজকের রাত টা ভালো না।এখানে পূর্ণিমার রাত্রে অলৌকিক সব ঘটনা ঘটে।আপনারা বাইরের লোক,এখানে থেকে কিছু হয়ে গেলে আমাদের দোষ হবে।”

কথা গুলো বলেই আর দাঁড়ালো না গোবিন্দ।মাথা দোলাতে দোলাতে শিস দিতে দিতে চলে গেলো।

    আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম।কি এমন ঘটনা ঘটে এখানে যার জন্য সাবধান করে গেলো গোবিন্দ।কাল এখানে নানারকম অশরীরী ঘটনার সম্মুখীন আমরা হয়েছি,কিন্তু কোনো বিপদ হয়নি।কিন্তু পূর্ণিমার রাত্রে এখানে কি এমন হয়,জার জন্য বিকালের মধ্যেই আমাদের এখন থেকে চলে যেতে বললো গোবিন্দ।কেমন একটা অজানা ভয় আমাদের বুকে চেপে বসতে লাগলো।

   আমরা আর সময় নষ্ট না করে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলাম।প্রাসাদের মেইন গেট মন্ত্রপূত সুতো দিয়ে বেঁধে রেখেছেন ফাল্গুনীবাবু,তাই আমরা সেদিক দিয়ে না ঢুকে দরজার পাশেই একটা ভাঙ্গা কাঁচের জানলার কাঠের পলকা পাল্লা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

  ভিতরটা এই দিনের বেলাতেও কেমন যেনো ঘুটঘুটে অন্ধকার।যেন কোনো জাদুশক্তি সূর্যরশ্মির আগমনকে রোধ করে দিচ্ছে।ভিতরে ঢুকেই আমাদের টর্চ জ্বালাতে হলো।বিশাল একটা হলঘর তার ঠিক মাঝখানে ওপরে ওঠার সিঁড়ি।আর সিড়ির ঠিক পাশেই একটা ভাঙ্গা চোরা বড় টেবিল।ঘরের দুদিকে দুটো লম্বা লম্বা থাম।এছাড়াও হয়তো আরো কিছু আসবাবপত্র ছিল কিন্তু এখন তাদের চেনা দুষ্কর।চারিদিকে শুধু ভাঙ্গা চোরা কাঠের টুকরো,ঝুল,কালো কালো ছাই এর মতন নোংরা ছড়িয়ে আছে।

ঘরের একদম ডানদিকে একটা দরজা,সেটা দিয়ে বোধহয় পিছন দিকের ঘর গুলোতে যাওয়া যায়।

আমরা ঠিক করলাম আমি আর প্রণব ওপরে দোতলায় যাবো,আর ফাল্গুনীবাবু ও শুভময়বাবু একতলার পিছন দিকটায় যাবেন।

সিঁড়ি টার অবস্থাও ভালো নয়,যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ে যেতে পারে।আমরা কোনরকমে ধরে ধরে ওপরে উঠলাম।সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই লম্বা টান বারান্দা,আর সেই বারান্দায় পাশাপাশি অনেক গুলো ঘর।প্রণব বললো,”এইঘর গুলোতেই বোধহয় পাগল দের রাখা হতো,বুঝলি।চল ঘর গুলোতে ঢুকে দেখি।”

দরজাগুলো বহুদিন না খোলায় জ্যাম হয়ে গেছিলো।বেশ কসরত করার পরে তবেই খোলা গেলো।তবে ভিতরে ঢুকেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো।

নাহ,ভিতরে ভয়ানক কিছু ছিল না।পুরো ঘরটায় ফাঁকা।শুধু দেওয়ালে কতগুলো লোহার শিকল লাগানো আছে।এমনকি সিলিং থেকেও কয়েকটা শিকল ঝুলছে।শূন্যতাও যে এরকম ভয় ধরাতে পারে তা প্রথম জানলাম।সমস্ত ঘরটায় কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ।প্রণব দেওয়ালের দিকে টর্চের আলো ফেললো,দেখলাম সমস্ত দেওয়াল জুড়ে শুধু আঁচড়ের দাগ।এত বছরেও সেই দাগ গুলো নষ্ট হয়নি।

বললাম,”এখানেই বোধহয় রুগীদের বেঁধে রাখা হতো।ওই শিকল দিয়ে।দেওয়ালের আঁচড় গুলো দেখছিস?একটা মানুষকে কতটা অত্যাচার করা হতো ভাব!”

প্রণব বললো,”বাইরে চল এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”

আমরা সবকটা ঘরই ঘুরে ঘুরে দেখলাম।সবকটাই প্রায় একই রকম।একটা ঘরে একটা লোহার বিছানা দেখলাম তার সঙ্গে একটা লোহার হেলমেট লাগানো।বোধহয় এখানে পেসেন্টদের শক থেরাপি চলত।সব কটা ঘর দেখে আমরা যখন নিচে নেমে এলাম ততক্ষণে ফাল্গুনীবাবুদের নিচটা ঘোরা হয়ে গেছে।ওনারা বললেন বাড়ির পিছন দিকে নাকি বেশ কিছু ঘর আছে যেগুলো আলো বাতাস কিছুই ঢোকে না।ঐগুলোতেই বোধহয় বিপ্লবীদের ঢুকিয়ে অত্যাচার করা হতো।

আমরা প্রাসাদ থেকে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম,তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় একটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে।সূর্যের আলো দেখে যে এত ভালো লাগতে পারে এই প্রথম বুঝতে পারলাম।

আমি ফাল্গুনীবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম,”কি করবেন?থাকবেন না দুপুরে খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়বেন?”

পাশ থেকে প্রণব বলে উঠলো,”না না থাকবো থাকবো।আমাদের সঙ্গে ফাল্গুনীবাবু আছেন তো তাহলে ভয় কিসের?”

ফাল্গুনীবাবু মুখ নামিয়ে বললেন,”এখানে যে শক্তি আছে তার মোকাবিলা বোধহয় আমিও করতে পারবো না।বহু বছর ধরে বহু অতৃপ্ত অশরীরীর হা হুতাশ এই প্রাসাদের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে।আজ পূর্ণিমার রাত্রে তারা তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে।সমস্ত রাত ধরে তাদের পৈশাচিক নৃত্য চলবে।সেখানে আমাদের থাকা যে নিতান্তই অবাঞ্চনিয়।আমিও আপনাদের বলব অযথা জিদ না করে দুপুরের খাওয়াটা সেরেই বেরিয়ে পড়তে।নাহলে আজকের রাতটা হয়তো…”

ফাল্গুনীবাবুর কথা শেষ হলো না তার আগেই গেটের কাছে গোবিন্দর শিসের শব্দ পাওয়া গেল।ছেলেটা চমৎকার শিস বাজাতে জানে।চেনা পরিচিত কোনো সুর নয়,কিন্তু বেশ লাগে শুনতে।ওকে আস্তে দেখেই প্রণব বললো,”চলুন চলুন খেয়ে নেওয়া যাক,আজ রাত্রে হয়তো জাগতে হতে পারে।”

স্পষ্ট দেখলাম,ফাল্গুনীবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

(৬)

বিকাল থেকে আজকেও আকাশ কালো করে মেঘ এসেছিল।সন্ধের পরেই শুরু হলো টিপ টিপ বৃষ্টি।আমরা তাবুর ভিতরেই বসে গল্প করছিলাম।প্রত্যেকেরই মনের মধ্যে একটা অজানা ভয় চেপে বসেছিল।কিন্তু মুখ ফুটে কেউ বলতে পারছিলাম না।

   চড়াৎ করে একটা বাজ পড়লো কোথাও।আর ঠিক সেই সময় সেই মৃত্যু শীতল নিরবতা ভেঙে কানে এলো সেই অমানুষিক কান্নার আওয়াজ।কিন্তু এবার আওয়াজ টা পিছনের প্রাসাদ থেকে না,আসছিল সামনের বাগানে থাকা তেঁতুল গাছের তলা থেকে,যেখানে কালকেই দেখে এসেছি সারি সারি কবর।প্রণব তাবু থেকে বাইরে বেরোতে যাচ্ছিল,ফাল্গুনীবাবু মাথা নেড়ে বারণ করলেন।আজ পাতাল থেকে সেই অশরীরীর দল পৃথিবীর বুকে উঠে আসবে,আমরা শুধু সেই সময়টার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।

  সময় যেন কাটছিলো ই না।প্রণব যে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল সেটা আমরা বুঝতে পারছিলাম।কান্নার আওয়াজ তাও থেমে গেছিলো।বৃষ্টির মধ্যেই আমরা তাবু থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো একটা বাচ্চা ছেলে খিল খিল করে হেসে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকালাম,কিন্তু তখুনি একটা কান্ড ঘটলো।শুভময়বাবু মুখে কেমন একটা গোঙানির আওয়াজ করে মাটিতে পড়ে গেলেন।তার মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোতে লাগলো।আমি দৌড়ে যেতে গেলাম কিন্তু তার আগেই ফাল্গুনীবাবু আমাকে আটকে দিলেন।

ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ঈশারা করলেন।তারপর ফিস ফিস করে বললেন,”ওই দেখুন।”

যা দেখলাম তাতে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো।দেখলাম আমাদের থেকে হাত দশেক দূরের একটা ঝোঁপ থেকে কয়েকটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল।দেখে মনে হলো তাদের শরীরগুলো যেনো ধোঁয়া দিয়ে তৈরি।এপার ওপার দেখা যাচ্ছিল তাদের শরীরের মধ্যে দিয়ে।তারা হাঁটছিলো না, হাওয়ায় উড়ছিল। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে তারা একবার শুভময়বাবুর পাশে দাঁড়ালো আর তারপরে এগিয়ে গেল প্রাসাদের দিকে।একটু যেতেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো যেন।

    আমরা দৌড়ে শুভময়বাবুর কাছে গেলাম।ভদ্রলোক অজ্ঞান হয়ে গেছেন আর মুখে অনবরত বির বির করে কি যেন বলে চলেছেন।ফাল্গুনীবাবু ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করলেন,তারপর তার ভিতর থেকে জলের মতন কি একটা বের করে শুভময় বাবুর চোখে মুখে ঝাপটা দিতে লাগলেন সেই সঙ্গে অস্ফুট স্বরে মন্ত্র পড়তে লাগলেন।

  জলের গুন না মন্ত্রের গুন জানিনা কিন্তু কিছুক্ষন পরেই শুভময়বাবু চোখ মেলে তাকালেন।ফাল্গুনীবাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,”গঙ্গা জলের ক্ষমতা দেখেছেন?যেকোনো অশুভ শক্তি দূর করার ক্ষমতা রাখে।জয় মা গঙ্গা।”বলে গঙ্গাজলের বোতলটা মাথায় ঠিকিয়ে ব্যাগ এ ভরে রাখলেন।আর ঠিক সেই মুহূর্তে অভূতপূর্ব একটা ঘটনা ঘটে গেলো।চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে দেখলাম প্রাসাদ টা দাউ দাউ করে জ্বলতে লেগেছে।ঠিক যেন কেউ পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।নিমেষে জায়গাটা পোড়া গন্ধে ভরে গেল,আর প্রাসাদের ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো সারি সারি মানুষের আর্তনাদ।আমাদের কানে যেন তালা লেগে গেল।

প্রণব দুহাতে কান চাপা দিয়ে বললো,”সেই রাতেও বোধহয় এইরকমই হয়েছিল।ভিতরে থাকা মানুষগুলো বেরোতে না পেরে এইরকম ই হাহাকার করছিল। ও ফাল্গুনীবাবু,আর সহ্য হচ্ছে না যে,আপনি কিছু একটা করুন।”

  ফাল্গুনী বাবু উত্তরে কিছু একটা বললেন কিন্তু সেটা আর শুনতে পেলাম না।বদলে যে দৃশ্য টা দেখলাম, তাতে বুকের রক্ত ছলকে উঠলো, হাতে পায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল।দেখলাম প্রাসাদের প্রতিটা জানলা দরজা ভেদ করে একদল অশরীরী বেরিয়ে আসছে,তাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য আমরা।সদর দরজায় ফাল্গুনীবাবুর লাগানো মন্ত্রপূত সূতো লাগানো আছে বলে দরজা খুলতে পারছে না,বদলে জানলা দরজা ভেদ করে সব বেরিয়ে আসছে। দোতলার বন্ধ দরজা গুলো সব খুলে গেছে,সেখান থেকেও বেরিয়ে এসেছে হাতে পায়ে শিকল বাঁধা কতগুলো ছায়াময় শরীর।এরা সবাই আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো,যেনো আমাদের জ্যান্ত ছিঁড়ে খাবে।ফাল্গুনীবাবু বললেন,”পালান,এখানে এক মুহুর্ত ও থাকবেন না।সবার আগে এই প্রাসাদ থেকে বেরোয় চলুন।”

আমরা দৌড়াতে শুরু করলাম।কিন্তু পালাবো কি,আমাদের মনে হতে লাগলো আশেপাশের ঝোপগুলো সব যেনো বিশাল বিশাল গাছের আকার ধারণ করেছে,আমরা যেনো কোনো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটছি।কোন দিকে বাইরে বেরোনোর রাস্তা কিছুই ঠাওর করতে পারছিলাম না। হটাৎ ফাল্গুনীবাবু পকেট থেকে কি একটা বের করে রাস্তায় ছুড়ে দিলেন,টর্চের আলোয় দেখলাম একটা ক্রিকেট বলের সাইজের রুদ্রাক্ষ।সেটা মাটিতে পড়েই গড়াতে লাগলো।ফাল্গুনীবাবু আমার হাত টা ধরে বললেন,”আমার পিছন পিছন আসুন সবাই।”আমরা সবাই তার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম আমরা প্রাসাদের লোহার গেট পেরিয়ে বাইরে চলে এসেছি।কিন্তু একি!গেটের বাইরে বড়ো আম গাছটায় গলায় দড়ি বাঁধা কয়েকটা লাশ ঝুলছে।আমরা আবার দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ালাম।আমাদের পিছনে তখনও সেই অশরীরীর দল ছুটে আসছে,তাদের গলা চিরে বেরিয়ে আসছে নারকীয় উল্লাস।

  প্রাসাদ থেকে বেরিয়েই রক্ষা নাই,সেই পিশাচের দল আমাদের লক্ষ্য করে এখনও আসতে লাগলো।আমরা ফাল্গুনীবাবুর পিছনে দৌড়াচ্ছি।ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় রাস্তা ঘাট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আর দেখা যাচ্ছে পিছু পিছু আসা সেই ছায়াময় পিশাচদের।তারা রক্তের গন্ধ পেয়েছে,সেই রক্তের স্বাদ না পাওয়া অবধি তারা থামবে না।

   দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা সকালের দেখা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালাম।ঠিক তক্ষুনি চোখে পড়লো অপূর্ব এক দৃশ্য।দেখলাম চাঁদের আলোয় গোটা মন্দিরের উঠোন ভেসে যাচ্ছে আর মন্দিরের উঠোনএর বিশাল অংশ জুড়ে এক বিশাল ছায়া পড়েছে,মন্দিরের দরজার ওপরে কুলুঙ্গিতে থাকা কৃষ্ণমূর্তির ছায়া।সমগ্র উঠন জুড়ে সেই ছায়া বিস্তৃত হয়ে আছে।

শুভময়বাবু বললেন,”চলুন মন্দিরের ওপরে উঠে দাড়ায়।পিশাচের ক্ষমতা নয় এই ছায়া অতিক্রম করে আমাদের নাগাল পায়।”

আমরা মন্দিরে উঠে দাঁড়ালাম।দেখলাম শুভময়বাবুর কথাই ঠিক।পিশাচের দল মন্দিরের উঠোনের কাছে এসে থেমে গেলো।সেই কৃষ্ণমূর্তি র ছায়া পেরিয়ে তারা আমাদের কাছ অব্দি আসতে পারছে না।বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত হা হুতাশ করে যাচ্ছিল।

আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইলাম।মনে হলো এই যাত্রা বোধহয় বেঁচে গেলাম।

  কিন্তু নাহ,আমাদের স্বস্তি বেশিক্ষণ রইলো না। কোথা থেকে এক রাশ কালো মেঘ এসে চাঁদ কে ঢেকে দিল,আর সেই সঙ্গে কৃষ্ণমূর্তি র ছায়াও উঠোন থেকে মিলিয়ে গেল।পিশাচ দলের মুখে আবার শোনা গেল নারকীয় উল্লাস ধ্বনি।তারা এক পা এক পা করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।প্রণবের মুখ একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো।এবার বোধহয় আর আমাদের বাঁচা সম্ভব নয়।আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে এক মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে লাগলাম।

   হটাৎ কানে এলো এক চেনা পরিচিত শিসের ধ্বনি।সঙ্গে সঙ্গে অশরীরী দের উল্লাস ও কেমন যেন থমকে গেল।চোখ খুলে দেখলাম,মন্দিরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে গোবিন্দ।মুখে শিস দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে পিশাচদের দিকে,দান হাতটা উঁচু করে যেনো তাদের থামতে নির্দেশ দিচ্ছে।পিশাচ গুলো ও কেমন যেন নিশ্চল হয়ে গেছে ,তাদের মুখের উল্লাস ধ্বনি মিলিয়ে গেছে,বদলে তাদের ছায়াময় মুখে দেখা দিচ্ছে ভয়ের ছাপ।গোবিন্দ এবার এক পা এক পা করে পিশাচ দের দিকে এগোতে লাগলো,আর পিশাচ গুলো এক পা এক পা করে পিছাতে লাগলো। হটাৎ কানে এলো ফাল্গুনীবাবুর উদাত্ত মন্ত্রচ্চারণ,”যদা যদা হি ধর্মস্য, গ্লানির্ভবতি ভারত,অভ্যুত্থানম অধর্মস্য…”

গোবিন্দ একবার হাসি মুখে আমাদের দিকে তাকালো,তারপর এগিয়ে যেতে লাগলো পিশাচ দের দিকে।স্পষ্ট দেখলাম,ভগবানের ছবিতে যেমন মাথার পিছনে আলোর বলয় দেখা যায়,গোবিন্দর মাথার পিছনেও সেরকম আলোর বলয় তৈরি হয়েছে।হটাত যেনো চাঁদের আলো টা অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।যেন মেঘ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে সেই আলো।সেই আলোতে দেখলাম,অশরীরী দল আস্তে আস্তে ধুলোয় পরিণত হচ্ছে।গোবিন্দর হাত কিন্তু একবারের জন্যও নামেনি,সে ক্রমাগত হাত উঁচু করে তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

  আকাশ বাতাস কিছুক্ষণের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিল।এবার জোর দমকা হাওয়া দিল আর সেই অশরীরী দের শরীরের ছায়া সেই হাওয়ার তোরেই যেন উড়ে গেল।

চাঁদের সামনে থেকে মেঘের টুকরো গুলো আস্তে আস্তে সরে গেল,আবার চারিদিক আলোয় ভরে উঠলো।কিন্তু গোবিন্দকে কিন্তু আর দেখা গেলো না।ফাল্গুনীবাবু উদভ্রান্তের মতন এদিক ওদিক কি যেন খুঁজলেন,তারপরে মন্দিরের সামনে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন,”ঠাকুর এইভাবে কি ছল করতে হয় গো? এতবার সামনে এলে তাও বুঝতে দিলে না ঠাকুর আর যখন বুঝতে পারলাম তখনই তোমাকে চলে যেতে হলো ঠাকুর?”

প্রণব এগিয়ে গেল,”ও মশাই,কি হয়েছে?কি বলছেন তখন থেকে?আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না! গোবিন্দই বা গেল কোথায়?”

ফাল্গুনী

বাবু মুখ তুললেন,দেখলাম তার চোখে জল।ধরা গলায় বললেন,”আপনারা এখনো গোবিন্দ কে চিনতে পারেননি? ও যে স্বয়ং রাধামাধব প্রণববাবু।এই বিপদের হাত থেকে স্বয়ং ঈশ্বর এসে আমাদের রক্ষা করে গেলেন।”

প্রণব অবিশ্বাসের সুরে বলল,”কি বলছেন কি আপনি? গোবিন্দ স্বয়ং ঈশ্বর? তা কি করে হয়?আমরা যে তাকে নিজের চোখে দেখলাম,সকালে কত গল্প করলাম।দুপুরে সে আমাদের খাবার এনে দিল…”

ফাল্গুনীবাবু বললেন,”স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের প্রসাদ দিয়ে গেছিলেন প্রণববাবু। ওই জন্যই ওই অভিশপ্ত প্রাসাদের পিশাচ গুলো আমাদের ক্ষতি করতে পারে নি।সকালেই গোবিন্দকে দেখে আমার কেমন একটা খটকা লেগেছিল,মনে হচ্ছিল এই অমলিন হাসি আগেও কোথাও দেখেছি!তাছাড়া তার চোখে এক দৈব দীপ্তি আমি দেখেছিলাম যা সাধারণ মানুষের চোখে থাকা সম্ভব নয়।আচ্ছা একটা কথা ভাবুন,মন্দিরের দরজা তো বন্ধ,বাইরে থেকে তালা মারা।তাহলে গোবিন্দ ওর ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো কিভাবে? তালা খুলে যে আসেনি সেটা তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, এখনো তালা মারাই আছে।সকালে প্রথম যখন ও এসেছিল,মনে আছে প্রাসাদের ভিতরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাখি ডাকতে লেগেছিল?এর পরেও আপনাদের বিশ্বাস হয় না?”

ফাল্গুনীবাবুর কথা গুলো শুনতে শুনতে বুকের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো।এও কি সম্ভব!স্বয়ং ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এসে আমাদের রক্ষা করলেন এই পিশাচ দের হাত থেকে?তাকে আমরা এক হাত দূর থেকে দেখেছি,তিনি নিজে হাতে আমাদের দুপুরে ভাত খাইয়েছেন। এখনো যেন কেমন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল সব।

শুভময়বাবু বললেন,”চলুন প্রাসাদ থেকে সব জিনিস পত্র বের করে নিয়ে আসি। ভোর হতে চললো তো প্রায়।আর ভগবানের দয়ায় পিশাচরা তো সব শেষ হয়ে গেছে।এখন আর ভয় কি?”

ফাল্গুনীবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন,”না শুভময়বাবু,যতই ভোর হোক না কেন,রাত আবার নামবেই।আর তখনি এই পিশাচের দল আবার জেগে উঠবে।এইটা তাদের জগৎ,এখানে আসাটা আমাদেরই ভুল হয়েছে।রক্তের গন্ধ পেলেই তারা আবার জেগে উঠবে,এই প্রাসাদের আনাচে কানাচে মুক্তির আশায় কেঁদে বেড়াবে।তবে ভগবান আমাদের সহায়।সব সময় জানবেন যেখানে আসুরিক শক্তি থাকবে,ঐশ্বরিক শক্তিও সেখানে থাকবে।কেউ না থাকুক ভগবান অবশ্যই থাকবেন আপনাকে রক্ষা করতে।শুধু তার স্মরণ নিতে হবে আপনাকে মন থেকে।এবার চলুন সব জিনিস পত্র গুছিয়ে ফেলি।বেরোতে হবে তো,কাল আবার আমাকে অন্য এক জায়গায় যেতে হবে।”

  ততক্ষণে পূর্ব দিকের আকাশ রাঙা হয়ে উঠতে লেগেছে।আমরা আবার ওই প্রাসাদের দিকে হাঁটা দিলাম।

                            ______________০______________

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post প্রপঞ্চ | পলক ফেলা নিষেধ | অরিত্র দ্বিবেদী | Bengali Thriller Story
Next post একজন মাহবুব মাইসুর | পলক ফেলা নিষেধ | মায়েশা ফারজানা | Bengali Thriller Story