হিয়ার মাঝে | পলক ফেলা নিষেধ | তন্ময় নন্দী | Bengali Thriller Story
0 (0)

 একটা দরকারি ইমেইল পাঠিয়ে ল্যাপটপ শাট-ডাউন করতে যাবে, ল্যাপটপের পাশে বিছানায় পড়ে থাকা দামি কোম্পানির মোবাইলটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। ঘাড়টা ঈষৎ ডান দিকে ঘুরিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের উপর চোখ বুলিয়ে ইনকামিং কলের ব্যক্তির নামটা এক ঝলক দেখে নিয়ে ল্যাপটপটা পুরোপুরি শাট-ডাউন করে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল শুভ। ততক্ষণে একবার পুরো মাত্রায় রিং হয়ে দ্বিতীয় বার কল ঢুকেছে। এই ব্যক্তির সাথে কথা বলতে শুভ বিরক্ত অনুভব করে। মুখে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে মোবাইল স্ক্রিনে সবুজ আইকন টাচ করে ফোন রিসিভ করতেই ওপার থেকে ঝড়ের মত ধেয়ে এল ঝাঁঝালো কণ্ঠ।

“কি করছিলে এতক্ষণ? ফোনটা রিসিভ করতে অসুবিধা হচ্ছে বুঝি? জবা ঠিক আছে তো? ওর মোবাইলে বেশ কয়েকবার রিং করলাম। রিসিভ করল না। এনি প্রবলেম?”

 জবার মোবাইল শুভর বাম পাশে পড়েছিল। শুভ দেখেছে, জবার বাবা বেশ কয়েকবার রিং করছে। কিন্তু ইচ্ছা করেই সে রিসিভ করেনি।

 ঢোক গিলল শুভ। “জবা ওয়াশরুমে।”

“আর তুমি…তুমি কী করছিলে? কোন রাজ কাজটা করছিলে শুনি?”

“আমি-” সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও বেমালুম চেপে গেল শুভ। শুভ জানে, এই লোকটার কাছে সত্যি বলা মানে বিপদ কাঁধে করে নিয়ে আসা। নানা ধরনের উল্টোপাল্টা কথা শোনাতে এই লোকটা ছাড়বে না। এমন কী যাচ্ছে তাই বলে অপমান করতে এক মুহূর্তের জন্য পিছুপা হন না। তাই আমতা আমতা করে বলল, “ম্যানেজারের সাথে বিশেষ প্রয়োজনে কথা বলতে রিসেপশনে রুমে গেছিলাম। ফোনটা রুমে ছিল।”

 অগ্নি সংযোগ পেয়ে ওপারের ঝাঁজালো গলাটা আরও তেতে উঠল যেন। “হঠাৎ ম্যানেজারের সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন পড়ল কেন? আমি তোমাদের ঘুরবার পুরো প্ল্যানটা করে রেখেছি, অসুবিধা হবার কথা নয়। কিছুর দরকার পড়লে ম্যানেজার তোমার কাছে আসবে, মিস্টার শিকদারের জামাতা হিসেবে এই সুযোগটা তুমি পাবে। কিন্তু তুমি তা না করে আমার প্রেস্টিজ ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছ। নোট মাই ওয়ার্ড। পরে আবার যেন এই ভুলটা রিপিট না হয়। রাখলাম। আর হ্যাঁ জবা বেরোলে রিং ব্যাক করতে বলো আমায়।”

 মিস্টার প্রদীপ্ত শিকদার লাইনটা কাটতে শ্বশুরের গিফট দেওয়া দামি মোবাইলটা হাতে নিয়ে শুভ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। আজ সকাল থেকেই মেঘের মন খারাপ। আর মন খারাপের দুঃখটুকু গলে বৃষ্টি হয়ে নামছে ধরিত্রীর বুকে। পুরীর সমুদ্রের সৈকতে সি ফেসিং ফাইভ স্টার হোটেলের রুমের বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুভ অনুভব করছে সমুদ্রের নীল জলরাশির উপর ভেঙেপড়া বৃষ্টির শব্দ। এখান থেকে মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রের উপর ঘন কুয়াশা বিরাজ করছে। সকাল থেকে বৃষ্টি নামায় বাইরে বেরোনোর সুযোগ হয়নি। সমুদ্রে কিছুক্ষণ জলকেলি করে জগন্নাথ ঠাকুরকে পুজো দেবে ওরা- এমন একটা প্ল্যান সাজিয়ে রেখেছিলো শ্বশুর মশাই। সে প্ল্যানটা ভেস্তে যেতে শুভ ভেবেছিল, বৃষ্টির মধ্যে সমুদ্রে নেমে সমুদ্রের উষ্ণ বারি অনুভব করতে কিন্তু শ্বশুর মশায়ের কথায় কথায় ‘আনকালচার্ড ফেলো’ অপমানসূচক মন্তব্য- শুভ তার ইচ্ছাকে অবদমন করে রেখেছিল মনের মধ্যে। এমনকি তার সহধর্মিণী জবাকেও সমুদ্রে বিশেষ মুহূর্ত কাটাবার কথা বলতে পারেনি।

 যদিও এটুকু সহ্য করতেই হবে, শ্বশুরের তাকে না পছন্দসই মনোভাবও গ্রহণ করতে হবে। স্ট্যাচুর মত নির্লিপ্ত থেকে হজম করতে হবে মিস্টার শিকদারের বাঁকা বাঁকা মন্তব্য। ভাগ্যের চাকা যে এভাবে ঘুরে যাবে সেকি ও নিজে জানতো। না কোনদিন স্বপ্নেও সে এমন একটা জীবন দেখেছিল! মাত্র ছ’ মাস আগে সে কীভাবে জীবন যাপন করত তা কী সে ভুলে গেছে! বেদুইনের মত টইটই করে ঘুরে বেড়ানো জীবন পাল্টে এখন সে রাজ্য এবং সুন্দরী রাজকন্যা দুই পেয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে সে এখন উপযুক্ত সম্মান না পেলেও শুভ ঠিক জানে, মিস্টার শিকদারের মৃত্যুর পর ওঁর বিশাল সম্পদের সম্পূর্ণ মালিকানা গিয়ে বর্তাবে এই শুভময় ব্যানার্জির হাতে। কথাটা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি এসে ভিড় করল। যে হাসি অনেক অর্থবহ হয়ে ফুটে উঠছে শুভর নিম্ন ওষ্ঠের নিচে।

 বৃষ্টির ছাঁট চোখে মুখে লাগায় শুভর ভবিষ্যৎ চিন্তায় ভাবনায় ছেদ পড়ল আর তখনই সে শুনতে পেল একটা মিষ্টি গানের সুর ভেসে আসছে। গানের সুরটা এতটাই মধুর যে, মুহূর্তে যাবতীয় সুখ দুঃখের হিসাব ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণ রূপে মোহিত হয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল শুভ। কিছুক্ষণ আগে শ্বশুরমশায়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠটা বুকের মধ্যে মিলিয়ে গেল। গান মানুষের জীবনে ওষুধের মত কাজ করে কিন্তু আজ যেন বৃষ্টির পাল্লার সাথে সাথে সুমধুর সুর তার মনকে পুলকিত করছে। বৃষ্টির ছাঁট তার চোখে-মুখে লাগলেও স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া তার চোখে মুখে সজোরে আঘাত করতেই সম্বিত ফিরে পেয়ে গানটার উৎস অনুসন্ধান করতে শুরু করল সে। শুভ খেয়াল করল সুরটা আর কোথা থেকে নয় তাদের রুম থেকে ভেসে আসছে। জবা ওয়াশরুমে শাওয়ার নিতে নিতে গাইছে কি? কই কোনদিন তো জবার সুমিষ্ট কণ্ঠের কোন গান সে শোনেনি। এমনকি তার সহধর্মিণীকে গুন গুন করে গাইতে শোনা যায়নি। এসব ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে রুমের ভেতরে ঢুকে শুভ বুঝলো গানটা তার সহধর্মিণীই গাইছে। কী সুমধুর কণ্ঠ তার। সারা দেহ-মন চনমন করে উঠল। কিন্তু তা কিছুক্ষণের জন্যই। গানের লিরিক্সটা স্পষ্ট হতেই ভিতরে ভিতরে এক তীব্র অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করল সে। একী গাইছে জবা? এ কোন গান? কেন এই গানটা সে গাইছে? ভালোলাগাটার আবেশ মুহূর্তে উবে গিয়ে মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা এসে ভিড় করল। মনে হচ্ছে কেউ যেন তার মাথার মধ্যে শিরা-উপশিরাগুলিকে ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দিচ্ছে। শুভ আর নিতে পারছে না গানটা। জাস্ট নিতে পারছে না। জবা এই মুহূর্তে বন্ধ করুক গানটা। নইলে শুভ যন্ত্রণায় একরকম মরেই যাবে। এতটাই অন্যরকম অস্বস্তি অনুভব করছে ভিতরে ভিতরে। ওয়াশরুম থেকে উড়ে উড়ে আসা গানের কলি গুলো আর আঘাত করছে শুভর বুকের বাম পাশটায়। শুভ আর থাকতে না পেরে দুই হাত দিয়ে কান ঢেকে তীব্র চিৎকার করে উঠল। “স্টপ। জবা স্টপ। প্লিজ বন্ধ করো তো তোমার এই গান।”

 কিন্তু শুভর যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিৎকার ওয়াশ রুমের দরজা ভেদ করে জবার কানে পৌঁচ্ছছে না। শাওয়ারের শব্দের তালে তালে জবা যেন আজ হৃদয় ভেঙে গেয়ে চলেছে। আজ বোধহয় সে গান থামবে না।

 গানটা যত ভেসে আসছে শুভর মাথার যন্ত্রণা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কপালে রগ ফেটে যাচ্ছে যেন। এখনই বুঝি সে অজ্ঞান হয়ে যাবে নতুবা মস্তিষ্কের প্রবল যন্ত্রণায় মারা যাবে। শুভ আবার চিৎকার করে ওঠে। “প্লিজ জবা তুমি এবার থাম। আমি মরে যাচ্ছি। তোমার হাজব্যান্ড মারা যাচ্ছে। প্লিজ বন্ধ করো তোমার এই করুণ গান।”

 যন্ত্রণাক্লিষ্ট ভাঙ্গা গলার চিৎকার ওয়াশরুমে পৌঁছচ্ছে না। শুভ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বিছানার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আর একটু হলেও বিছানার উপর না পড়ে মেঝের উপর পড়ে যেত। মাথা ফেটে রক্ত বের হত নিশ্চিত। বাইরে ঝুম ঝুম মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি- এমন একটা পরিবেশে যখন একজন বিছানার ওপরে যন্ত্রণায় এপাশ ওপাশ করছে তখন তার সহধর্মিণী গান গেয়ে যেন তার হাজব্যাবন্ডকে খুন করতে চাইছে। জলের মাছ ডাঙায় তুললে সে যেমন ছটফট করে কিছুক্ষণ তেমনি শুভ বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। কী আছে গানটার কলি গুলোর মধ্যে? আর কেনই বা শুভ এই গানটাকে নিতে পারে না? সমস্ত প্রশ্নের উত্তর অজানা রেখেই ওয়াশরুম থেকে নেচে নেচে ভেসে আসছে জবার কোকিল কণ্ঠে গান- একনাগাড়ে একটানা- “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…”

 “শুভ। অ্যাই শুভ। ওঠো। শুভ। আরে ওঠো না। বেলা হয়ে গেছে তো অনেক।”

“কে?” ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে শুভ। সকাল ন’টার সোনালী রোদ শুভর কোঁকড়ানো চুলের উপর আলতো ভাবে এসে পড়েছে।

“আমি গো, হিয়া। তোমার হিয়া। তোমার হিয়ার স্বর শুনে তুমি বুঝতে পারছ না! এ বাবা এই তুমি আমায় ভালোবাসো?”

 “এখানে তুমি এলে কীভাবে? বাড়িওয়ালা কিছু বলেনি?” বালিশ মুখের মধ্যে চেপে ধরে শুভ কথাগুলো বলে।

 উত্তর কলকাতার এক দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ছোট্ট একটা রুমে ভাড়া থাকে শুভ। শুভরে ছোট্ট ভাড়া ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা চৌকি আরেকটা পড়ার কাঠের টেবিল। চৌকির নিচে যেন গুদাম ঘরের মত অপরিচ্ছন্ন যদিও একটা টিনের ট্যাংক, মুড়ির ড্রাম এবং বেশ কিছু পুরানো বইপত্তর ছাড়া আর কিছু নেই।

 শুভ বেকার; তাই এখনো চাকরি বাকরি জুটিয়ে উঠতে পারেনি। সেজন্য ঠিকমত বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় বাড়িওয়ালা জেঠিমা মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে থাকে। কিন্তু বিনা পয়সায় ওদের ছোট্ট ছেলেকে পড়ানোর জন্য এত সহজে শুভকে বের করে দিতেও পারে না। ভালো গৃহ শিক্ষক পাওয়াও চাপের ব্যাপার।

 শুভর কথার জবাবে হিয়া মৃদু হেসে বলে, “বাবা কী সাংঘাতিক মহিলা গো তোমার ওই বাড়িওয়ালা। বাপরে বাপ! এমন দজ্জাল মহিলা আমি জন্মে দেখিনি। হাইকোর্টের উকিলকেও হার মানিয়ে দেবেন উনি। আমার পথ আটকে কত প্রশ্নই না করলেন, যেন ডব্লিউবিসিএস এর ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউ নিয়ে নিলেন। শেষে আমি না পেরে বললাম, ‘আমার হবু হাজব্যান্ডের কাছে যাচ্ছি, পথ ছাড়ুন।’ কথায় কথায় দেরি হয়ে যাচ্ছে সোনা। নাও এবার ওঠো তো। বারোটার সময় ইন্টারভিউ মনে আছে তো। উঠে স্নান-টান সেরে নাও তাড়াতাড়ি। আমাকে এতটা পথ ভেঙে আসতে হত না যদি তোমার ফোনটা সুইচড অফ না জানাত। রিচার্জটা অন্তত করে রাখতে পারো তো।”

 হিয়া যখন ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বলছে তখন বিছানায় উঠে বসে শুভ। মাথার চুল উসকোখুসকো। চোখের তলায় কালি। মুখে ক্লান্তির সুস্পষ্ট ছাপ। সরু দৃষ্টি হেনে হিয়ার দিকে তাকিয়ে ম্রিয়মাণ গলায় বলল, “আমার অবস্থা কেমন তুমি জানো হিয়া। কেমন ভাবে দিন কাটাচ্ছি তার কোনটাই তোমার অজানা নয়। এভাবে জীবন চলতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা কে…”

 শুভকে অলুক্ষণে কথা শেষ করতে না দিয়ে বিছানার উপর উঠে এসে শুভর মুখ চেপে ধরে হিয়া।

“আবার শুভ। কতবার তোমায় অলুক্ষণে কথা উচ্চারণ করতে নিষেধ করেছি। আমি আছি তো প্রিয়। বিপদে-আপদে সর্বদা তোমার সাথে আছি আর সর্বদায় থাকব। দেখবে তোমার এই দূরাবস্থা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে আর তুমি মস্ত বড় অফিসার হবে। তখন কিন্তু এই হিয়াকে ছুড়ে ফেলে দিও না শুভ। তুমি ছাড়া আর যে কেউ নেই আমার।” শেষ কথাগুলো বলতে বলতে হিয়ার চোখ ছল ছল করে ওঠে।

 হিয়ার কান্না জড়ানো কণ্ঠে শুনে শুভর বুকের ভেতরটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। “এই দেখো, আবার কাঁদতে শুরু করে। আরে আমি আছি তো।” বলেই জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয় হিয়াকে।

 শুভর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে হিয়া নিজেকে ছাড়ানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করছে। “এই ছাড়, ছাড়ো। দরজা খোলা আছে তো। তোমার ওই দজ্জাল বাড়িওয়ালা আমাদের এমন ভাবে দেখে ফেললে সর্বনাশ। ছাড়ো।”   ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও হালকা একটা মদত আছে তার কথাবার্তায় মধ্যে। আসলে হিয়া চায়, এমন ভাবে সারাজীবন শুভ তাকে ভালোবাসায় সিক্ত করুক।

 শুভর চব্বিশ বছরের যৌবন কুসুমের ন্যায় পবিত্র হিয়াকে কাছে পেয়ে বাঁধা মানে না। দুজনের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। শুভর পুরুষালি ঠোঁট ডুবে যায় হিয়ার রসসিক্ত ঠোঁটে। কিছুক্ষণ উষ্ণতা বিনিময়ের পর হিয়া দুষ্টুমি করে কামড়ে দেয় শুভর ঠোঁটে।

 ‘আহ’ শব্দ করে উঠে বসে বিছানায়। বিড়বিড় করে অস্পষ্ট উচ্চারণ করতে থাকে হিয়ার নাম। তারপরে বিড়বিড় থামিয়ে চোখ খুলে দেখে সামনে দুজন বসে আছে; একজনের গলায় টেথোস্কোপ ঝোলানো আর একজনকে সে চেনে। এই হোটেলের ম্যানেজার না?

 শুভর কিছু বুঝে ওঠার আগেই গলায় স্টেথস্কোপ ঝোলানো ব্যক্তিটি শুভর বাম পাশে বসে থাকা জবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ম্যাডাম আপনার হাজব্যান্ডের জ্ঞান ফিরে এসেছে। আপনাকে বলেছিলাম না অযথা চিন্তার কোন কারণ নেই। মনে হচ্ছে, সাডেন কোন কিছু চিন্তা করতে করতে আপনার হাজব্যান্ড অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।”

 স্বামীর জ্ঞান ফেরায় জবার চোখের কোনে জমে থাকা বাষ্প আনন্দে চিকচিক করে ওঠে। চিকচিক করে ওঠাই স্বাভাবিক। কেননা দু’ঘণ্টা ধরে শুভ প্রায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল। সেন্সলেস হবার কারণ অবশ্য অজানা। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে জবা দেখে, শুভ বিছানার উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের এমন ভয়ানক অবস্থা দেখে অনেকটা ঘাবড়ে গেছিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজারকে ডেকে ডাক্তারের ব্যবস্থা করে। এখন তাই শুভর জ্ঞান ফিরে আসায় তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছিল তোমার?”

 কি হয়েছিল? শুভ তো কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে স্টেথস্কোপ ঝোলানো লোকটা এবার শুভর বাঁহাতের নারী টিপে টিপে পরীক্ষা করাই বুঝতে পারল লোকটা ডাক্তার। কিছুক্ষণ নাড়ি টিপে স্পন্দন পরীক্ষা করার পর ডাক্তারবাবু জবাকে বললেন, “এখন আর আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই ম্যাডাম। আপনার হাজব্যান্ড এখন অনেকটাই সুস্থ। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, হোটেলের সামনে বেশ কিছু ওষুধের দোকান আছে সেখান থেকে পেয়ে যাবেন।” কথাগুলো বলেই ডাক্তারবাবু ডায়েরির পাতায় খচখচ করে কয়েক বেশ কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে পাতা ছিঁড়ে এগিয়ে দিল জবার দিকে। জবা হাতে নেবার আগেই ম্যানেজার এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলেন এবং বললেন, “আমাকে দিন ডাক্তারবাবু। যাবতীয় ওষুধপত্র আমি এনে দিচ্ছি।”

 সামনে মানুষজনের কথোপকথন ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে শুনছে শুভ। কী হয়েছিল তার? ডাক্তার কেন?

 ডাক্তারবাবু জবাকে বললেন, “ম্যাডাম এবার উঠি। পেশেন্টের তেমন কোন অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করবেন। চেম্বার ছেড়ে এসেছি, এখনো চেম্বারের সামনে লম্বা লাইন।” ডাক্তারবাবু উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন কিন্তু থমকে দাঁড়ালেন জবার কথায়।

“আপনার ফিজটা-”

“ওসব কথা বলে আমায় লজ্জা দেবেন না ম্যাডাম। আপনার বাবার সাথে আমার বহুদিনের পরিচিতি। ওঁকে আমার কথা বলবেন। আসি।”

 ডাক্তারবাবু রুম থেকে বেরিয়ে যেতে হোটেল ম্যানেজার জবার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার পর জবার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। ডাক্তারবাবু তো বললেন, স্যার এখন ঠিক আছেন। আমি ওষুধ গুলো কিনে আপনার রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি। একটা কথা বলছি কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম।”

“হ্যাঁ বলুন।”

“আপনাদের সেবায় আমি সর্বদাই আছি কিন্তু এত বড় হোটেলের সবটাই আমাকে সামলাতে হয়। যদি কিছু মনে না করেন আমি রিসেপশন রুমে আছি। স্যারের কোন প্রবলেম হলে বা কিছু দরকার পড়লে আমায় জানাবেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসব।”

“আরে না না। কোন সমস্যা নাই। ওর জ্ঞান ফিরেছে, আশাকরি তেমন কোন অসুবিধা হবে না। আপনি নিজের কাজে যান।”

 ম্যানেজার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই জবা শুভর হাত ধরে শক্ত করে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে, “এখন ঠিক আছে তো শুভ?”

 ঘাড় কাত করে সদর্থক মাথা নাড়তে জবা এবার জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছিল তোমার?”

 জবাবে জবার দিকে কাতর চোখে তাকায় শুভ। হ্যাঁ ওর মনে পড়েছে, মনে পড়েছে, একটা গান ওর মস্তিষ্কে শিরা-উপ শিরাগুলিকে ছিড়েখুঁড়ে একাকার করে দিচ্ছিল। গানটা আবার মনে পড়তেই মাথার যন্ত্রণা আবার শুরু হল শুভর।

 জবার কোলে মাথা রেখে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল তারপর জবার হাত ধরে বাচ্চা ছেলের মত প্রায় কাতর কণ্ঠে শুভ বলল, “জবা।”

“হুম বল।”

“তুমি ওই গানটা কোনদিন আর গাইবে না। ওই গানটা শুনে আমার খুব কষ্ট হয়।”

“কোন গানটা?” জবা জিজ্ঞেস করে। “যেটা আমি স্নান করতে করতে গাইছিলাম।”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু… কিন্তু ওই গানে তোমার সমস্যা কিসের? কি আছে ঐ গানটার মধ্যে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে জবা।

শুভর কিছু বলার আগেই একজন হোটেল বয় অনুমতি না নিয়ে তাদের রুমে প্রবেশ করে বলল, “ম্যানেজার স্যার পাঠালেন। ওষুধগুলো-”

“টেবিলের ওপর রাখো।” আঙুল দেখিয়ে সামনে টেবিল নির্দেশ করে জবা।

হোটেল বয় এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর ওষুধপত্রের প্যাকেট রাখতে যাচ্ছিল তখনই তার পকেটে স্থিত মোবাইল ফোনটা একটা রবীন্দ্র সংগীতের রিংটনে ঝনঝন করে বেজে উঠল। মোবাইলটা রিসিভ না করে হোটেল বয় টেবিলের উপর থেকে চায়ের ট্রে নামিয়ে ওষুধপত্র রাখার জায়গা করছে। গানের আওয়াজ কানে যেতে শুভর মেজাজ খিটখিটে করে উঠল। শুধু খিটখিটে করল না তীব্র মাথার যন্ত্রণা শুরু হল তার। দুহাত কানে চেপে রক্তচক্ষু করে হোটেল বয়কে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই শুয়োরের বাচ্চা, ফোনটা কেটে এখান থেকে বের হও। বের হ, বের হ বলছি।”

 শুভর এমন কথাবার্তায় হোটেল বয় শুধু ভয় পল না, জবাও অবাক হয়ে পড়ল। শুভর চোখমুখে বিরক্তিসূচক প্রতিচ্ছবি। হঠাৎ এমন করে উঠল কেন শুভ? এই রবীন্দ্র সংগীতটায় কী আছে? এটা কি কোন গানের থেকে ফোবিয়া নাকি এর সাথে কোন অন্ধকার অতীত মিশে আছে শুভর জীবনে।

 বাঙালি ছোকরা হোটেল বয় ভয় পেয়ে দরজা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল কিন্তু তার পকেটে ভরা মোবাইলটা আবারো বেজে উঠল, “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…”

 “কেমন হল ইন্টারভিউ? এবারে নিশ্চয়ই হয়ে যাবে তাই না? কিন্তু তোমার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ? দেখি। এ মা এ ত পুরো ঘেমে গেছ।” হিয়া তার ওড়নার অগ্রভাগে দিয়ে শুভর কপাল মুছিয়ে দেয় এবং তারপর কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা পরীক্ষা করে।

 বেলা এখন তিনটে। ধুম ধুমে রোদ। পার্কে এই মুহূর্তে লোক সংখ্যা কম। বেলা গড়ালে অবশ্য অসংখ্য রঙিন কপোত কপোতী ভিড় করবে। শুভ ও হিয়ার প্রিয় জায়গা হল এই পার্কটি। কত মধুর সময় কাটিয়েছে এখানে দু’জনে। কত সুখ দুঃখ কথার সঙ্গে থেকেছে ছাতিম গাছের নিচে এই সবুজ বেঞ্চিটা। কিন্তু আজ শুভর বড় মন খারাপ। আর হবেই বা না কেন, স্বপ্নগুলো যে আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে।

 “হিয়া ক্ষমা করো আমায়। আমি তোমার স্বপ্নকে কোনদিন বাস্তবায়িত করে তুলতে পারব না। কেউ দেবে না আমায় চাকরি।”

 আক্ষেপ এবং ভেজা গলার স্বর শুনে হিয়া বুঝল এবারও শুভর চাকরিটা হয়নি। প্রত্যেকবার শুভর ইন্টারভিউয়ের ডাক আসার আগে কত স্বপ্ন দেখে সে। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে হিয়ার বুকের মাঝখান থেকে। তবুও প্রিয়জনকে ভরসা জোগাতে ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে, “এবারে না হয়েছে তো কি। পরেরবার নিশ্চয়ই হবে। এভাবে ভেঙে পড়লে চলে বাবু।” শুভর মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে টেনে নেয় হিয়া।

 এ জগতে যেমন হিয়ার কেউ নেই তেমনই শুভও একা। ছোটবেলায় একটা কার অ্যাক্সিডেন্টে হিয়া তার বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েছে। তারপর থেকেই ছোট পিসির কাছে মানুষ আর শুভর গ্রামে বিধবা মা আছে। পড়াশুনায় মেধাবী শুভ কলকাতার নামী কলেজ থেকে মাস্টার ডিগ্রী পাস করলেও এখনো একটা চাকরি জুটিয়ে উঠতে পারেনি।

 হিয়ার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শুভ বলে ওঠে, “স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্ন দেখাটাই ভুলে গেছি হিয়া। বর্তমানে মেধার কোনো দামই নেই। আমাদের মত বেকারদের ছুঁড়ে ফেলতে এ সমাজ দুবার ভাবে না। এ শহরে টাকা ছাড়া চাকরি হবে না, আমি এখন সেটা ভালোভাবে অনুসন্ধান করতে পেরেছি।” কথাগুলো বলতে বলতে হিয়ার বুকের মাঝখান থেকে মুখ তুলে শুভ।

 “আরে এত সহজে ভাঙলে চলবে না ডিয়ার। দেখে নিও চাকরি তোমার নিশ্চয়ই হবে।”

 “চাকরি মাই ফুট।” শুভ তেতে ওঠে। “এক কথা কতবার বলব; টাকা ছাড়া চাকরি হবে না। তুমি আমার আশায় বসে থেক না। তোমার পিসেমশাই এর দেখা পাত্রকে বিয়ে করে নাও। সুখে থাকবে।” শুভর কন্ঠটা যেন হঠাৎই উষ্ণ হয়ে ওঠে।

 “আমার ভালোবাসা এখনো বোঝোনি শুভ। নিজের সুখের কথা কোনোদিন ভাবিনি এবং কোনদিন ভাবব না। কোন পরিস্থিতিতে তোমায় ছেড়ে যাব না আমি। ওরা কত টাকা চেয়েছে?”

 “টাকার অঙ্কটা এতটাই বেশি যে সেটার কথা নাই বা শুনলে। তবে জানো আমি যখন টাকা দিতে পারব না বলে সরাসরি জানাই, ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন বয়স্ক মেম্বার কি বলে জানো?”

 “কি বলে?”

 “ইন্টারভিউ বোর্ডের ওই ব্যক্তিটি বলে, কোম্পানির মালিকের একমাত্র মেয়ের দুটো কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি একটা কিডনির ব্যবস্থা না করতে পারলে নাকি তার মেয়ে মারা যাবে। উনি আমাকে অফার দেয়, যদি আমি কোনও ভাবে একটা কিডনির ব্যবস্থা করতে পারি তবে আমায় চাকরিটা দেবে। শুধু চাকরিটা দেবে না সরাসরি প্রমোশন দিয়ে উচ্চ পদে নিয়োগ করবে কিন্তু আমি কিডনি কোথায় পাবো বলো তো? কিডনি কী গাছে ফলে!”

 এরপর পার হয়েছে অনেকটা সময়। কত ঘটনা, কত অঘটনা ঘটে গেছে এই সময়ের মধ্যে।

 “এই হিয়া হিয়া। সরি গো। আমায় ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমি জানি আমার ক্ষমার অযোগ্য তবুও।”

 “এই করছেন কী? কে আপনি? আর হিয়া কে? পাগল নাকি?” এক বছর তিরিশের মহিলা শুভর হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে। শুভ তবুও শক্ত করে ধরে থাকে তার হাত।

 “কী হল ছাড়ুন। না হলে লোক ডাকব বলে দিলাম। মেয়ে দেখলে ছোড়া নড়ে ওঠে তাই না? ছাড়ুন।”

শুভ তবুও তার হাত না ছেড়ে বলে, “প্লিজ হিয়া তুমি রাগ কোরো না। আমি তখন নিরুপায় হয়ে…”

 রুমের বাইরে ঝামেলা শুনে জবা বাইরে বেরিয়ে আসে। বেশ কয়েকজন লোকজন জড়ো হয়ে শুভর পাগলামি দেখছে। জবা দেখে, শুভ এক মহিলার হাত ধরে কাকুতি-মিনতি করছে। তাড়াতাড়ি শুভর হাত ভদ্রমহিলা হাত থেকে ছাড়িয়ে বলে, “কী হচ্ছে কি শুভ? ওঁর হাত ধরেছিলে কেন?”

 শুভ সম্বিত ফিরে পেয়ে লজ্জায় জবার পাশে এসে দাঁড়ায়। ভদ্রমহিলার মুখ তখনো টকটকে লাল। জবাকে উষ্ণ মেজাজে বলে, “ও আপনি হিয়া? ওঁর কি মানসিক প্রবলেম আছে? নিজের হাজব্যান্ডকে সামলে রাখুন? নইলে…”

 জবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভদ্রমহিলা গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়।

 ভদ্রমহিলা চলে যেতে জবা শুভকে প্রায় এক রকম জোর পূর্বক রুমের মধ্যে নিয়ে আসে এবং তারপর চোখ গোল গোল করে পাকিয়ে বলে, “তুমি ভদ্র মহিলার সাথে মিস বিহেভ করছিলে কেন? আর কেনই বা ওঁকে হিয়া বলে সম্বোধন করছিলে?”

 জবার কথার উত্তর দেওয়ার বদলে শুভ স্থির ভাবে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর জবাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মত কাঁদতে শুরু করে।

 কান্না! কান্না জিনিসটা একদম সহ্য করতে পারে না জবা। তখন জবা অনেকটাই সুস্থ। প্রায় দেড় বছর পর কলেজ গিয়েছিল। কলেজের রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফেরার পথে শুভকে রাস্তায় কান্না-কাটি করতে দেখে নিজে গাড়ি থেকে নেমে এসে শুভকে গাড়িতে তুলেছিল জবা। শুধু গাড়িতে তোলেনি চারদিনের অভুক্ত শুভময় ব্যানার্জীকে রেস্টুরেন্টে খাইয়ে-দাইয়ে নিজের বাড়িতে এনেছিল। শুভর মিথ্যা বানিয়ে বলা দুঃখের কাহিনী শুনে ছিল। একরকম দয়া থেকেই শুভর প্রতি আকর্ষণ জন্মেছিল। আকর্ষণ থেকেই জন্ম নিয়েছিল ভালোবাসার। জবার বাবা, বিখ্যাত শিল্পপতি প্রদীপ্ত শিকদার তখন ব্যবসার কাজে এক মাসের জন্য আমারিকার ব্রাজিলে ছিলেন। বাবার ফিরে আসার আগেই জবা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে নেয় শুভকে। বিদেশ থেকে ফিরে নিজের বাড়িতে শুভকে দেখে অবাক হয়ে যায়। পরে অবশ্য কিছু করতে পারেনি দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত শিল্পপতি। একপ্রকার মেয়ের জেদের কাছে হেরে গিয়ে শুভকে জামাই হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

 মাঝরাতে হঠাৎ কিসের যেন খট করে শব্দ হাওয়াই ঘুম ভেঙে যায় শুভর। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে এক অদ্ভুত আবেশ টের পায়। কে যেন তার মাথাকে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত আদরে আবার চোখ বন্ধ করে নেয় শুভ। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই টের পায় ঘরের মধ্যে একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে। শ্বাস টেনে বুকের মধ্যে গন্ধ পুরে নিলো সে। এই গন্ধটা সে খুব চেনে। একটা দীর্ঘকালীন সম্পর্ক জুড়ে আছে এই গন্ধটার সাথে। কিন্তু স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে শুভ কিছুতেই মনে করতে পারলো না গন্ধটা অ্যাকচুয়ালি কিসের। শুভ এবার সম্পূর্ণরূপে চোখ খুলল। হোটেলে রুমের মধ্যে দোয়াত উল্টানো অন্ধকার। জবা লাইট অন করে ঘুমোতে পারে না, তাই তার ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সেজন্য শুভ নাইট ল্যাম্পও অন করল না। মিষ্টি গন্ধটা যেন তাকে বেশি করে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। গন্ধটা উপভোগ করতে করতে শুভ যখন আবার চোখ বন্ধ করে ঠিক তখনই তার কানের কাছে ফিসফিস করে কেউ যেন বলে উঠল, “শুভ, অ্যাই শুভ, ঘুমিয়ে পড়লে আবার।”

 মাঝরাতে এমন অদ্ভুত ভৌতিক গলার আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বিছানায়। মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল “কে? জবা?”

একটা খিল খিল চাপা হাসি খেলে গেল তার মাথার কাছে। “নাগো, আমি হিয়া, তোমার হিয়া। তোমার হিয়ার স্বর শুনে তুমি বুঝতে পারছ না। এ বাবা, এই তুমি আমায় ভালোবাসো।”

“হিয়া? কোথায় তুমি?”

“এই যে, এই যে আমি তোমার পিছনে। এতক্ষণ পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম যে।”

 চট করে শুভ পিছন ফিরল কিন্তু নিকষ অন্ধকারে দৃষ্টি আটকে যাওয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হিয়ার অবস্থান বোঝার জন্য হাত বাড়াল কিন্তু কোথাও তার হাত বাধা প্রাপ্ত হল না।

“হিয়া, কই তুমি? আমি দেখতে পাচ্ছি না।”

“প্রিয়জনকে দেখতে না পেলেও অনুভব করো শুভ। চোখের দেখাটা শেষ কথা নয়। একটা সময় তুমি আমার সত্ত্বা ছিলে, এত সহজে সবকিছু ভুলে গেলে।”

শুভ আমতা আমতা করে, “আমি- আমি।”

“থাক আর আমি আমি করতে হবে না।” হিয়ার কণ্ঠটা বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছাকাছি এগিয়ে গেল। তারপরে ক্যাঁচ করে দরজা খোলার আওয়াজ হল। শুভ বুঝতে পারল হিয়া বারান্দার কাছে গেল। হিয়া সেখান থেকে ডাক দিল, “শুভ এখানে এসো। দেখো বৃষ্টি থামার পর পুরীর সামুদ্রিক হাওয়া কেমন মনোরম।”

 শুভ মন্ত্রমুগ্ধের মত বিছানা থেকে নেমে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। হোটেলের বাইরে লাগানো আলো আলোছায়া হয়ে বারান্দায় এসে পড়েছে। আবছা অন্ধকারে যেটুকু দেখা যায়, কিন্তু শুভ কাউকে দেখতে পেল না। হিয়াকে উদ্দেশ্য করে ডাক দিল “হিয়া কোথায় তুমি?”

“এই যে, এই যে আমি এখানে।” হিয়ার কণ্ঠস্বরটা এবার রুমের মধ্য থেকে ভেসে এল। “এই যে সোফার কাছে এসো।”

 শুভ তাই করে। কিন্তু হিয়ার উপস্থিতি সেখানেও টের পায় না। বারবার শুভ ‘হিয়া তুমি কোথায়, কোথায়’ করছে আর হিয়া যেন তার সাথে ‘আমি এখানে, আমি এখানে’ বলে লুকোচুরি খেলছে।

 কিছুক্ষণ এভাবে এখানে-ওখানে হাঁটাহাঁটির পর শুভ যখন প্রায় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল সোফার উপর তখন মিষ্টি কণ্ঠে গলায় আবেগ জড়িয়ে বিছানার ওপর থেকে হিয়া বলে উঠল, “এখানে এসো শুভ। আমার খুব শীত করছে।”

“শীত করছে?” অস্ফুটে কথাটা বলেই শুভ সোফায় ছেড়ে উঠে বিছানার কাছে গেল। বিছানায় উঠেই ‘হিয়া কোথায় তুমি’ বলতে কাঁপা কাঁপা গলায় হিয়া বলল, “আমার খুব শীত করছে শুভ। খুব শীত করছে। আমায় উত্তাপ দাও।”

হিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে শুভ। তারপর অন্ধকারেই ঠোঁট খুঁজে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ উষ্ণ চুম্বনের পর হিয়া ছটফট করতে থাকে, তার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। কারণ ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় হিয়াকে শুভ চেপে ধরেছে শুভ।

 শুভকে সরিয়ে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কাঁটা মুরগির মত যন্ত্রণায় ছটফট করছে, এখনই বুঝে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে সে মারা যাবে। হিয়া যখন আর নিতে পারছে না, আদর করার নামে শুভ রীতিমত অত্যাচার করছে। তখন প্রায় এক রকম জোর পূর্বক হিয়া শুভকে বিছানা থেকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিছানার পাশে নাইট ল্যাম্প অন করে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,  “তুমি পাগল হয়ে গেছ নাকি শুভ? আমাকে মেরে ফেলবে যে।”

 হঠাৎ আলোতে শুভ চমকে ওঠে। হিয়া কোথায়? এত জবা?

দুজনেই নিজেকে সামলে নিতে কিছুটা সময় নেয়। উত্তেজনায় জবার বুক হাপরের মত ওঠানামা করছে। এদিকে শুভ মেঝেতে বসে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জবার দিকে। সেকি তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? স্বপ্নগুলো এই ভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে কেন মাঝে মাঝে?

 রুমের মধ্যে থমথমে পরিবেশ। জবার দ্রুত শ্বাস ফেলার শব্দ হিস হিস শব্দ করে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রুমের মধ্যে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জবা প্রথম বলে ওঠে, “কে হিয়া? তুমি বারবার হিয়া হিয়া করছ কেন?”

 ড্রেসিং আয়নার সামনে নিথর হয়ে বসে আছে জবা। আয়নার প্রতিচ্ছবিতে প্রতীয়মান জবার টানা টানা চোখের কোন দিয়ে তার মাখনের মত গাল বরাবর টস টস করে নামছে অশ্রুধারা। এও কি সম্ভব? যে মানুষটাকে সে নিজের চেয়েও বিশ্বাস করে, নিজের প্রাণের থেকেও অধিক ভালোবাসে, সে কিনা একজন খুনি? কথাগুলো ভাবতে জবার বুকের ভেতরটা একরকম খালি হয়ে আসছে। রাস্তা থেকে তুলে এনে একজন খুনিকে বিয়ে করেছে শেষে, শুধু বিয়েই করেনি দীর্ঘ ছয় মাস এক ছাদের নিচে সংসার করেছে এবং আগামী জীবনটা একসঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। জবার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না কথাগুলো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে বলা বাবার কথাগুলো তো আর মিথ্যা নয়। গত রাত্রে যখন শুভ জবাকে হিয়া ভেবে হিংস্র ভাবে আদর করতে করতে শ্বাসরুদ্ধ করে মারতে চাইছিলো, তারপর মাঝরাতেই বাবাকে এস এম এস পাঠিয়ে হিয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলেছিল। মাত্র কয়েক মিনিট আগে ফোন করেছিলে জবার বাবা।

“জবা তোর কথা মত আমি হিয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি আর শুভর ব্যাপারে এমন সব তথ্য জানতে পেরেছি যা শুনলে তুই অবাক হয়ে যাবি। তুই ঠিক আছিস তো মা। শোন, আর দেরি করিস না মা। আমি ম্যানেজারকে বলে তোর বাড়ি ফিরবার ব্যবস্থা করছি। এক মুহূর্তের জন্যও তুই ওই পাষণ্ডটার সঙ্গে থাকিস না বাড়ি চলে আয়। ও বেটা এখন কোথায়?”

“ও এখন সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখতে গিয়েছে। তাছাড়া তুমি এমন কথা বলছ কেন? কী হয়েছে বাবা?”

“কী হয়নি তাই বল। তুই একজন খুনির সাথে সংসার করছিস জবা।”

“খুনির সাথে?” জবার মাথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। “কি বলছ তুমি বাবা? আমি জানি, তুমি শুভকে সহ্য করতে পারো না কিন্তু তাই বলে তুমি যা ইচ্ছে তাই বলবে ওকে।”

“না রে মা, আমি আমার মেয়েকে ভালো দেখতে চাই, সুখে দেখতে চাই, প্রত্যেক বাবার কাছে তার মেয়ে যে রাজকুমারী। হিয়া নামক মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিতে আমি উত্তর কলকাতার লোক পাঠিয়েছিলাম। শুভ আগে যে বাড়িতে ভাড়া থাকত ওই বাড়িওয়ালা জানায়, শুভর হিয়া নামে এক বান্ধবী ছিল। ওই বাড়িতে নাকি মাঝে মাঝে যেত। এর বেশি কিছু বাড়িওয়ালা জানাতে পারেনি, হিয়া এখন কোথায় তাও জানে না। তবে হিয়ার বাড়ির ঠিকানা দেওয়ায় আমার লোকজন সেখানে গিয়ে যা জানতে পারে সেটা শুনে গায়ে রীতিমত কাঁটা দেয়।”

“হিয়া কি তবে…”

“হ্যাঁ, পাষণ্ডটা তাকে মেরে ফেলছে। হিয়ার পিসি পিসেমশায় এবং লোকাল থানায় খোঁজ নিয়ে যা জানতে পারি তা হল, একটা দালাল কিডনি চক্রের সাথে যুক্ত হয়ে কিছু টাকার জন্য, স্রেফ কিছু টাকার জন্য শুভ তার গার্লফ্রেন্ডের কিডনি বিক্রি করে এবং তারপর তাকে খুন করে।”

 শুভ খুন করে? কিছু টাকার জন্য সে তার গার্লফ্রেন্ডের কিডনি বিক্রি করে? জবার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায় আর পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার সাথে লাইনটা কেটে যায়।

 মানুষ এতটা নিচে নামতে পারে। টাকায় কী মানুষের জীবনে সব? ভালোবাসা, প্রেম এসবের কী তবে কোন মূল্য নেই?

জবা যখন পাথর হয়ে বসে কথাগুলো ভাবছে তখনই দরজায় টোকা পড়ল। ম্যানেজারের উদ্বিগ্ন গলা।

“ম্যাডাম, ম্যাডাম, সর্বনাশ হয়ে গেছে। বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।”

সর্বনাশ হয়ে গেছে! এর থেকে তার আর কী সর্বনাশ হতে পারে? শুভর মুখোশ যে আজ সে জানতে পেরেছে।

 ম্যানেজার তখনও দরজার জোরে জোরে আঘাত করছে আর বলছে, “এইমাত্র খবর পেলাম আপনার সর্বনাশ হয়ে গেছে। স্যার সমুদ্রের জলে তলিয়ে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। উদ্ধারকারীরা উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে। আপনি আসুন। আমি ও দিকটায় দেখি।”

 ম্যানেজার দরদর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার শব্দ জবা ঠিকই শুনতে পেল কিন্তু তার কোন পরিবর্তন হল না। থম মেরে বসে থাকল আয়নার দিকে তাকিয়ে। প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শুনে তার ভেতরটা খালি হয়ে আসছে না। গলা কান্নায় বুঁজে আসছে না। কিন্তু বিছানার উপর থেকে একটা মেয়েলী গলার আওয়াজে সামান্য কেঁপে উঠল জবা।

“জবা, জবা।”

“কে?” পিছন ফিরে বিছানার দিকে জবা তাকিয়ে বলে।

“আমি হিয়া।”

“হিয়া? কোথায় তুমি? তোমায় আমি দেখতে পাচ্ছি না। প্লিজ, আমার সামনে এসো। তোমার সাথে অনেক কথা আছে। অনেক কিছু জানবার আছে।”

“আমায় তুমি দেখতে পাবে না, কিন্তু আমি জানি তুমি কীকথা বলবে। হ্যাঁ, আমি তোমার হাজব্যান্ডকে সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে মেরেছি। কি করার ছিল বল, পাপীদের যে সাজা পেতেই হবে।”

“এ প্রশ্ন তোমার কাছে আমার ছিল না হিয়া? আমি শুধু জানতে চাই, মানুষ কীভাবে ভালোবাসার মানুষকে হত্যা করতে পারে?”

“শোনো জবা, ভালোবাসা যেমন একটা গুণ লোভ-লালসা হিংস্রতা তেমনি অন্য গুন। দ্বিতীয় গুণটি প্রথমটির কাছে জিতে যায় তখন সব শেষ। জান জবা, শুভকে আমি অনেক অনেক ভালবাসতাম। ওকে আমার পৃথিবী ভাবতাম। বেড়াতে আসার নাম করে শুভ পুরীর এক নার্সিংহোমে আমাকে নিয়ে গিয়ে তোলে। কিছু বোঝার আগেই আমাকে অজ্ঞান করে কিডনি তুলে নেয় তারপর অজ্ঞান অবস্থাতে আমাকে মেরে ফেলে। আমি ওর ভালোর জন্য হাসতে হাসতে কিডনি বিক্রি করে দিতাম, শুধু ভালোবাসার নাম করে…। আমি চললাম, পারলে সব কিছু ভুলে গিয়ে নিজেকে ভালোবাসো। কোন দিন সবটুকু উজাড় করে কাউকে ভালোবেসো না। আর হ্যাঁ, আমি তোমার মধ্যে বেঁচে রইলাম। আমি চললাম।”

 জবা শুনতে পাচ্ছে, ধীরে ধীরে হিয়ার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বরে মিলিয়ে যেতে রিসেপশন রুম থেকে একটা মিষ্টি গান ভেসে আসছে। “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…”

 রিসেপশন রুমে ম্যানেজারের সামনে বসে আছে এক বছর কুড়ির মেয়ে। মেয়েটির মুখে তৃপ্তির হাসি। হাতে ধরা টাকার বান্ডিলটা ব্যাগে পুরতে পুরতে বলল, “ম্যানেজার সাব, মিস্টার শিকদারকে বলবেন বাকি টাকাটা কিছুটা বাড়িয়ে অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিতে।”

-সমাপ্ত-

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post ওরাও স্বাভাবিক | পলক ফেলা নিষেধ | অর্ণব বসাক | Bengali Thriller Story
Next post ❗️বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ ২০২৩❗️