১
অন্ধকার রাত্রের মাঝে বারান্দায় একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে নীলিমা। তার চোখের দৃষ্টি সোজা শূন্য আকাশের দিকে ,ঠোঁটের কোণে উঁকি দিচ্ছে সিগারেটের লালচে আগুনের আভা। পরনে একটা সাদা গেঞ্জি সেইসাথে একটা কালো ট্রাউজার ,হাতে কাঁচের গ্লাসে মদের মায়াবী হলদে রঙের ছোঁয়া। চোখের কোণে তার আলগা একটা জলের বিন্দু যেন সময়ের বেড়াজাল ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে তাই এখনো সে বাষ্পীভূত হয়ে উবে যায়নি। সেই জলবিন্দুর দিকে তাকিয়ে অরুনাংশু বলল “এখনো সেই পুরনো কথাগুলো নিয়ে পরে আছো!!?”
নীলিমা সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে নীরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিক চুপ করে থেকে অরুনাংশু আবার বলল “মদের নেশায় যদি জীবনের সব দুঃখ ভোলা যেত তবে মানুষের জীবনটা অনেক সোজা হয়ে যেত নীলিমা , তোমার শরীরটা ভালো নেই মদটা একটু কমালে বোধহয় ভালো হত।“
নীলিমা একটা ব্যাগাত্মক হাসি হেসে তার দিকে ফিরে মদের গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল “জীবনে আর ভালো খারাপ বলে আমার কিছু বাকি নেই যা আছে সেটা হল প্রাচীন পুরাতন দুঃখের পাহাড়।“
অরুনাংশু- “তাই বলে এই বয়েসে নিজের জীবনটাকে তুমি শেষ করে দেবে!!?”
নীলিমা- “শেষ করে দেব তো বলিনি। খালি বললাম আমার জীবনে ভালো খারাপ বলে আর কিছু নেই।“
“তোমার কথার মাঝের অপ্রকাশিত সত্য আমার বুঝতে বাকি নেই। ভেবেছিলাম আমার সাথে থাকলে বোধহয় তুমি খানিক সুস্থ হয়ে উঠবে কিন্তু কোথায় কি!!” অরুনাংশু কথাগুলো বলে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
নীলিমা সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে বারান্দার বাইরে সেটা ফেলে বলল “আমার আর বাঁচবার ইচ্ছা নেই তুমি কি তা বুঝতে পার না!!?”
অরুনাংশু- “তুমি না বাঁচতে চাইলেই হল!! আমি তোমাকে মরতে দেব না।“
নীলিমা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “একজন আমার জীবনের বাঁচার আশা শেষ করে দিল আর তুমি চাইছ আমাকে বাঁচিয়ে তুলতে।“ তারপর তার লম্বা একটা অট্টহাসি , সেই হাসির শব্দে চারিদিকের শান্ত পরিবেশটা মুহূর্তে বদলে গেল। চারিদিকে তার সেই বিকট অট্টহাসি যেন কোনো প্রেতপুরীর প্রেত্মাতার মত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। খানিক পরে দূরে পাড়ার কুকুরদের মধ্যে হট্টগোলের আওয়াজ শোনা গেল তারপর খানিকক্ষণ আবার সব চুপচাপ। আচমকা সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে অরুনাংশু বলল “তুমি সময় মত তোমার ওষুধগুলো খাচ্ছ!!?”
নীলিমা- “রাখালের মা তোমার আদেশ মেনে প্রতিদিন সময় করে রোজ আমাকে ওষুধগুলো দিয়ে যায় , তাই সেইদিক থেকে আমি বাধ্য মেয়ের মত সেইগুলো সেবন করি।“
অরুনাংশু- “তোমার ওষুধগুলো যদি বদলের প্রয়োজন হয় তবে শুভ্রর সাথে…“
অরুনাংশুর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই নীলিমা শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে গ্লাসের শেষ সিপটা সেবন করে বলল, “না তার আর প্রয়োজন হবে না। রাত অনেক হয়েছে তুমি বরং গিয়ে ঘুমিয়ে পর।“
অরুনাংশু কি একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই নীলিমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে কটকটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল “মাত্র পাঁচ বছর বয়েস তোমার ইন্দ্র এখনই মুখে মুখে তর্ক করছ যাও এখুনি গিয়ে ঘুমিয়ে পর।“
অরুনাংশু অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেখে সে আবারো বলল “বাপি বাড়ি ফিরলে কিন্তু আমি সব বলে দেব।“
অরুনাংশু বুঝল নীলিমার আবার তাকে বছর পাঁচেকের বাচ্চা ভাবছে তাই সে দ্রুত কোনো কথা না বলে পাশের ঘরে চলে গেল। খানিক পরে সে ফিরে এসে দেখল সোফার উপর নীলিমা ঘুমিয়ে পড়েছে। সময়টা শীতকাল তাই একটা গায়ের চাঁদর সে বিছানা থেকে নিয়ে এসে নীলিমার গায়ে মেলে দিল তারপর নিজে বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। খানিকক্ষণ সিগারেট সেবন শেষ করে সে নীলিমার পাশের সোফায় গিয়ে বসে পড়ল আচমকা কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল তার সেটা খেয়াল নেই। সকালে উঠে যখন তার ঘুম ভাঙ্গল তখন সে দেখল সে তার বিছানায় শুয়ে রয়েছে। খানিকক্ষণ নিজেকে তার সামলাতে সময় লাগল তারপর সে দ্রুত ছুটে গেল হলঘরের দিকে সেখানে গিয়ে দেখল রাখালের মা টেবিলে বসে সবজি কাটছে। সে তাকে দেখে প্রশ্ন করল “কি হয়েছে দাদাবাবু!!?”
সে নিজেকে একটু সামলে বলল “কিছু না একটা বাজে স্বপ্ন…“
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সে চুপ করে গেল তারপর বলল “একটু জল এনে দাও।“
রাখালের মা জল আনতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। অরুনাংশু নিজের চোখে মুখে জলের ছিটে দিল তারপর রাখালের মায়ের হাত থেকে জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে সবটা শেষ করে বলল “তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দাও আমি দশটার মধ্যে বেড়াব।“
রাখালের মা ঘাড় নেড়ে তাতে সম্মতি জানিয়ে আবার টেবিলে নিজের কাজে ফিরে গেল। দ্রুত স্নান খাওয়া সেরে অরুনাংশু নিজের গাড়িটা বার করল তারপর সোজা চলে গেল নিজের বন্ধু কাম ডাক্তার শুভ্রর কাছে। অরুনাংশু এবং শুভ্র বাল্যবন্ধু একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে তারপর অরুনাংশু হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার আর শুভ্র ডাক্তার। শুভ্রর চেম্বার অরুনাংশুর বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় তাই গাড়িতে করে পৌঁছাতে তার মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগল না। অ্যাপয়েনমেন্ট করা ছিল না তাই রিসেপনিস্টকে সে বলল, “বলুন ওনার স্কুল ফ্রেন্ড অরুনাংশু সান্যাল এসেছেন।“ রিসেপসনিস্ট মেয়েটি ফোনটা নামিয়ে বলল, “একটা পেশেন্টের পরে স্যার আপনাকে পাঠাতে বললেন ততক্ষণ অপেক্ষা করুন।“
অরুনাংশু সামনে বসা পেশেন্টদের মধ্যে একটা খালি সিটে গিয়ে বসল তারপর টেবিল থেকে আজকের খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে তাতে চোখ বোলাতে লাগল কিন্তু কিছুতেই যেন তার মন বসল না বারবার তার সেই মেয়েটির কথা মনে হল , বারবার তার মুখ ভেসে উঠল। সে মনে মনে ভাবল এই নিয়ে তিনবার সে সেই মেয়েটিকে তার স্বপ্নে দেখল কিন্তু কেন সে বারবার সেই মেয়েটিকে তার স্বপ্নে দেখছে!!? নীলিমা বলে কোনো মেয়েকে সে কোনদিন চেনেনা, স্কুল থেকে শুরু করে নিজের চাকরি জীবন অব্দি তার স্মরনে কোনো নীলিমা নেই তবে কে এই নীলিমা!!? তার স্বপ্নে সে কেন বারবার হানা দিচ্ছে!!? সে নিজে কেন সেই মেয়েটিকে তার স্বপ্নে বাঁচানোর চেষ্টা করছে!!? এমনই অনেক অনেক প্রশ্ন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কিন্তু কোনো কিনারা সে করতে পারছে না। কখনো কখনো তার নিজেকে পাগল বলে বোধ হচ্ছে তাই অগত্যা সে তার মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শ নিতে ছুটে এসেছে। খানিকক্ষণ এইসব ভাবতে ভাবতে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল আচমকা রিসেপসনিস্ট মেয়েটির ডাকে তার তন্দ্রা ফিরল তারপর সে ডাক্তারের চেম্বারের ভিতরে প্রবেশ করল। শুভ্র তাকে দেখে একগাল একটা হাসি টেনে বলল, “বোস বোস তা চা না কফি!!?”
অরুনাংশু খানিক ইতস্তত করে বলল “একটা চা বল।“ শুভ্র তার ফোনটা তুলে বলল “দুটো চা পাঠিয়ে দাও।“
তারপর দুজনের মধ্যে কথোপকথন এগিয়ে চলল দ্রুতগতিতে।