৪
বাড়িতে পৌঁছে অরুনাংশু সোজা ফোন লাগল শুভ্রকে। শুভ্র ফোন তুলল না। সে দু তিনবার চেষ্টা করে স্নান সারতে গেল। শাওয়ারের জলে মাথাটা রেখে সে ভাবল, “স্বপ্ন অবধি ঠিক ছিল কিন্তু আজ গাড়িতে যা হল,আমি কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেলাম নাকি!!? মনটা এমনিতেই ভালো নেই তার উপর আবার জেসিকাকে আনলিঙ্গন করে বসলাম, ইস ছি!! ছি!!” এইসব ভাবতে ভাবতেই সে শুনতে পেল রাখালের মায়ের কণ্ঠস্বর, “দাদাবাবু আমি চললাম খাওয়ার টেবিলে রাখা আছে গরম করে খেয়ে নিয়ো।“
অরুনাংশু কোনো সারা দিল না রাখালের মা দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
স্নান সেরে বাইরে বেড়িয়ে এসে অরুনাংশু একটা সিগারেট ধরাল তারপর ফোনটা তুলে নিয়ে শুভ্রকে ফোন লাগাল। এবার ফোনটা শুভ্র নিজেই তুলল।
শুভ্র- “হ্যালো হ্যাঁ বল…”
অরুনাংশু যতটা সম্ভব সবটা খুলে আজকের ঘটনাটা শুভ্রকে বলল। সব শুনে সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, “আমি এখন তোর বাড়ি এলে খুব কি সমস্যা হবে!!?”
অরুনাংশু – “না না এখুনি চলে আয়।“
শুভ্র- “আমি মিনিট পনেরোর মধ্যে আসছি।“ কথাটা বলে শুভ্র ফোনটা কেটে দিল।
মিনিট কুড়ি পরে দরজায় বেল বাজল। অরুনাংশু দরজা খুলতেই শুভ্র ভিতরে প্রবেশ করল। তারপর দুজনে বৈঠকখানায় গিয়ে বসল।
শুভ্র অরুনাংশুর মুখের ভাবটা লক্ষ্য করে একটু হেসে বলল, “স্ট্রেস!! তোর সমস্যাটা হচ্ছে স্রেফ স্ট্রেস নাথিং এলস।“
অরুনাংশু অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেখে সে আবার বলল, “আজকের ঘটনাটা তোর বেশি ভাবনার জন্য হয়েছে তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে তুই একটু বেশি স্ট্রেস নিয়ে ফেলছিস। আর আমার মনে হয় জেসিকা মেয়েটাকে মনে মনে তুই একটু হলেও পছন্দ করিস তাই সবটাই মিলেমিশে একেবারে ঘেঁটে গেছে।“
অরুনাংশু – “কিন্তু ব্যাপারটা এতটা গুরুতর সবটাই বাস্তব বলে মনে হয়, তুই বুঝতে পারছিস না।“
শুভ্র- “দেখ আমি বুঝেছি কিন্তু তাই বলে এখন শুধু তোকে আমি একটু কিছুদিন ছুটি নিতে সাজেস্ট করতে পারি তারপর যদি তাতেও ফল না নয় দেন ইউ মাস্ট কনসাল্ট কাউনসিলিং সেশন।“
অরুনাংশু – “তুই আমাকে কি বলতে চাইছিস আমি পাগল!!?”
শুভ্র- “আরে আরে একদমই নয় এটা জাস্ট একটা স্ট্রেস ডিসঅডার। আর কাউন্সিলিং কি শুধু পাগলদের হয় নাকি!! মানুষের স্ট্রেস রিলিফ করতেও কাউন্সিলিং কাজে লাগে।“
অরুনাংশু একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তাহলে বলছিস এমন কিছু গুরুতর নয়।“
শুভ্র- “আরে হ্যাঁ রে বাবা। তুই বড্ড বেশি বাজে ভাবিস।“
অরুনাংশু – “কিন্তু ওই মেয়েটি!!?”
শুভ্র- “মেয়েটি বাস্তবে নেই তার অস্তিত্ব তোর স্বপ্নে তোর অন্দরে। স্বপ্নটা পুরোটা একবার শেষ হলেই দেখবি আর কোনো চিন্তা থাকবে না।“
অরুনাংশু – “আমার কেন বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটিকে আমি…“
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই শুভ্র বলল, “ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবছিস বলে তোর এইরকম লাগছে একটু ক্যাসুয়াল হওয়ার চেষ্টা কর। আচ্ছা আমি এলাম তোর বাড়িতে একটা ড্রিঙ্কও অফার করলি না।“
অরুনাংশু ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কেটে বলল, “ইস একদম ভুলে গেছি। তা কি খাবি বল!!?” তারপর দুজনে কফির কাপে চুমুক দিয়ে গল্প করতে লাগল। ঘণ্টা দুয়েক আড্ডার পরে শুভ্র উঠে বলল, “আজ তবে আসি রে। তুই টেস্টগুলো কালকে করিয়ে আমার সাথে পরশু দেখা কর।“
অরুনাংশু মাথাটা নাড়িয়ে তাতে সম্মতি জানাল তারপর বলল, “সোমবারের সকালে আসছি তাহলে।“
শুভ্র- “হ্যাঁ চললাম রে।“
অরুনাংশু – “আবার আসিস। বাই গুড নাইট।“
শুভ্র- “গুড নাইট।“
শুভ্র লিফটে করে নীচে নেমে গেল। অরুনাংশু ঘরে ফিরে দেখল ঘড়িতে রাত ১১টা বাজে , সে বারান্দার ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সে দেখল শুভ্রর গাড়িটা ক্রমে দূরে চলে যাচ্ছে। আচমকা তার ফোনটা বাজল সে ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই শুনতে পেল জেসিকার কণ্ঠস্বর।
জেসিকা- “স্যার আপনার শরীর এখন ভালো আছে!!?”
অরুনাংশু – “হ্যাঁ। আর আজকের জন্য ধন্যবাদ তুমি না থাকলে…“
জেসিকা কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বলল, “আরে না না স্যার এটাতো আমার সৌভাগ্য আপনার কোনো উপকারে আমি লেগেছি।“
অরুনাংশু একটু চুপ করে থেকে বলল, “আজকের ওই ব্যাপারটার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।“
জেসিকা- “ইস স্যার আপনি যে কি বলছেন। আপনি জানেন আমি আপনাকে কতটা পছন্দ করি এটা আমার কাছে নিছকই একটা স্বপ্নের মত। আমাকে আপনি নিজের এতটা কাছের বলে মনে করেছেন সরি বলে আমাকে নিজের থেকে দূরে করে দেবেন না।“
অরুনাংশু চুপ করে রইল। ওপাশ থেকে আবার কথা ভেসে এলো, “সাবধানে থাকবেন স্যার। কাল বিশ্বাস স্যারের পার্টিতে দেখা হচ্ছে, টেক কেয়ার। গুড নাইট।“
জেসিকা ফোনটা কেটে দিল। তারপর অরুনাংশু একটা সিগারেট ধরিয়ে মনে মনে বলল, “আজকাল মানুষ বিশেষ করে মেয়েরা বড্ড বেশি স্ট্রেট ফরওয়ার্ড হয়ে গেছে তা না হলে এতোগুলো কথা সোজাসুজি বলার মত সাহস জেসিকার থাকতো না। আমার স্পর্শ যে তার ভালো লেগেছে তা সে কোনো রাখঢাক ছাড়াই অবিলম্বে বলে গেল।“ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর আবার ভাবল, জেসিকার স্পর্শ যে তার মনের অন্দরেও দোলা দিয়েছে সেটা সে তার সামনে কোনোদিনই প্রকাশ করতে পারব না। ইস জেসিকা যদি খ্রিস্টান না হয়ে বাঙালি হত এতদিনে একবার হলেও সে তার মনের কথা তাকে বলত কিন্তু উপায় নেই। ঘড়ির কাঁটায় তখন ১২টা বাজে সে টেবিলের খাওয়ারগুলোর দিকে একবার তাকাল কিন্তু খেতে ইচ্ছা করল না, তাই অবশেষে সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
সেদিন রাতে সে আবার সেই স্বপ্নের অন্দরে প্রবেশ করল। আজ নীলিমা পড়েছে কালো রেশমের কাপড় সেইসাথে একটা স্লিভ্লেস ব্লাউজ, মাথার চুলগুলো খোলা সেটা তার নগ্ন উন্মুক্ত পিঠে দোলা খাচ্ছে। তার সেই রূপের ঝলকানি যেন অরুনাংশুর অন্দরে অজানা এক অজানা সুনামির ঢেউ তুলে দিয়েছে, তার অন্তরের মন সমুদ্রে যেন ঢেউয়ের তোলপাড় দেখা যাচ্ছে। অরুনাংশুর হাতে একটা কাঁচের গ্লাস তাতে হলদে মদের শোভা দেখা যাচ্ছে। অনতিদূরে দাঁড়িয়ে নীলিমা একটা সিগারেটে টান দিচ্ছে আচমকা সে তার দিকে ফিরে বলল, “তোমার গ্লাসটা বড্ড খালি খালি লাগছে আরও একটু ড্রিঙ্কস নাও।“
অরুনাংশু তার গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিল। গ্লাসটা আবার ভর্তি করে নীলিমা তার দিকে এগিয়ে দিল। সে গ্লাসটা তার হাত থেকে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “আজ বোধ করি তোমার শরীরটা ভালো আছে!!?”
নীলিমা একটু হেসে বলল, “শরীর ভালো আছে কিনা আমার তাতে বয়েই গেল কিন্তু আজ আমার মনটা বড্ড শান্ত বোধ হচ্ছে।“
-“আচ্ছা বেশ ভালো।“ কথাটা বলে অরুনাংশু তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টি যেন ভোরের কুয়াশার সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে মহিত কোনো ব্যাক্তির প্রতিমূর্তি।
নীলিমা সেইদিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা হাসি টেনে বলল, “জানো অনির্বাণও আমাকে ঠিক তোমার মতই একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখত আর বলত, “তোমারেই ভালবাসিয়াছি শত রূপে শতবার , জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।“
অরুনাংশু – “রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত প্রেমের কবিতার খুব জনপ্রিয় দুটো লাইন।“
নীলিমা- “অনির্বাণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে খুব ভালবাসত সেইসাথে কবিতা গান আবৃতি সব দিকেই তার ঝোঁক ছিল।“
অরুনাংশু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নীলিমা একটা লম্বা টান দিয়ে সিগারেটটা নিভিয়ে বলল, “আমার পাপের কোনো প্রায়চিত্ত নেই তাই আমার জীবন থেকে বাঁচার আশা শেষ হয়ে গেছে কিন্তু আমি যেন যমেরও অরুচি তাই জীবন্ত প্রেতাত্মার মত বেঁচে আছি।“
কথাটা বলেই নীলিমার মুখের আদলটা মুহূর্তে পাল্টে গেল। তার চোখে সেই অম্লান হাসি বদলেছে দুঃখের লেলিহান স্পর্শের আগুনে। সেইদিকে তাকিয়ে অরুনাংশু বলল, “ভুল আমরা দুজনেই করেছি কিন্তু তাই বলে…“
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই নীলিমা আঁকড়ে ধরল অরুনাংশুকে তারপর ক্রমে তার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ কান্না থামার পরে সব চুপচাপ তারপর নীলিমা বলল, “ইন্দ্রকে কালকে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে তুমিও সকালে অফিস যাবে তো!!?”
নীলিমার মুখে এমন আজব কথা শুনে অরুনাংশু যেন থতমত খেয়ে গেল তারপর নিজেও আর নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলিমার হাতটা ধরে বলল, “কেন !! কেন!!! কেন!!! আমাদের জীবনটা এইরকম কেন হয়ে গেল নীলিমা !!?”
নীলিমা তার ঠোঁটের কোণে একটা আলতো চুমু খেয়ে বলল, “অনির্বাণ বাচ্চাদের মত ভেঙ্গে পড়লে চলবে নাকি ইস কাঁদে না কাঁদে না।“
অরুনাংশুর মুখের কাছে নীলিমার মুখটা তার শরীরের স্পর্শে যেন তার অন্তরে কীসের তীব্র দোলা লাগল ক্রমে তারা দুজনে একে অপরের বাহুজুগলের অন্দরে হারিয়ে গেল। খানিক পরে নীলিমা এক ধাক্কায় তাকে দূরে ঠেলে দিল তারপর এক তীব্র চিৎকার ধ্বনি। অরুনাংশু পাশের টেবিলের গায়ে ধাক্কা লেগে মাটিতে বসে পড়েছে সে ক্রমে শুনতে পেল “ইস ছি!! তুমি আমার কাছে আসার সাহস কীভাবে পেলে!!? শালা বেইমান নচ্ছার ছেলে। আমি আমি!! তোমাকে পুলিশে দেব।“ অরুনাংশু ক্রমে নিজেকে সামলে ওর দিকে টলমল পায়ে এগিয়ে যেতেই নীলিমা পাশে রাখা মদের বোতলটা দিয়ে তার মাথায় সজোরে আঘাত করল। সেইসাথে চারিদিকে রক্তের বন্যা , নীলিমার হাতে বোতলের ভাঙ্গা কাঁচের অংশ থেকে লাল রক্তের ধারা ঝড়ে নিচের সাদা মেঝেতে পরে যেন লালচে আল্পনা তৈরি করেছে। মাটিতে লুটিয়ে পরে আছে অরুনাংশুর নিথর দেহ, নীলিমার মুখে চোখে রক্তের ছিটে। সাদা মার্বেলের মেঝেতে তখন রক্তের লাভা গড়িয়ে পড়েছে, সেইসাথে নীলিমার মুখে এক বিকৃত হাসি।
সেই বিকৃত হাসির শব্দ ছাপিয়ে অরুনাংশুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে পড়ল। তার চোখেমুখে আতঙ্কের চিহ্ন স্পষ্ট, সারা দেহ ঘামে ভিজে গেছে। সে পাশর টেবিলে রাখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল ৮টা বাজে।