রাত ১১.২০ , আট চালা স্যাঁতস্যাতে ইটের ঘরটার ভিতর একখানা ভাঙা খাটিয়ার উপর আছাড় পাছার খাচ্ছে নয় মাসের গর্ভবতী একটা শীর্ণ দেহ। প্রসবের তীব্র যন্ত্রণায় ঘনঘন ঝাঁকুনি দিয়ে ঠেলে ঠেলে উঠছে সমগ্র শরীরটা, গলার নালীর তার ছিঁড়ে ঠিকড়ে বেরিয়ে আসছে বিভৎস আর্তনাদ। পৌষের কনকনে রাতেও দর দর সারা শরীর বেয়ে নেমে আসছে উষ্ণ ঘামের স্রোত। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসের দমকা হাওয়ায় বিছানার এক পাশে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পের আলো টুকুও হেলে দুলে আপত্তি জানাচ্ছে বারং বার।
– ওহ মা গো! আর পারছি না ! আহ!!
– এই তো বউ আর এট্টু , এই এই এট্টু খানি কষ্ট করো দেকিনি। আর এট্টু।
ক্লান্ত দুটো পায়ের ছটফটানি তে বিছানার চাদর কুচকে দলা পাকিয়ে সরে গেছে এক পাশে , মুঠো করা হাত দুটোর একের পর এক সজোরে কিলের আঘাতে ঘুন ধরা খাটিয়ার পায়া গুলোও বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছে।
টানা ১.৩০ ঘণ্টা যন্ত্রণার সাথে তীব্র লড়াই এর পর অবশেষে হার মানলো রত্না।
– মেয়ে হয়েছে ! মেয়ে হয়েছে!
– আহ দেখো দেখো কি চাঁদ পানা মুখ ।
নবজাত শিশুকন্যার রূপের বর্ণনা রত্নার কানের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করতে করতেও যেনো কোথাও একটা তলিয়ে গেলো । ঘুম জড়ানো ভারী চোখের পাতা দুটোর ফাঁকের ক্ষীণ দৃষ্টি দিয়ে তার রক্ত মাখা সদ্যোজাত কন্যা সন্তানের চাঁদ পানা মুখটা একবার দেখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় সে । নাহ ! খুব একটা ফল লাভ হয়না । ঘরের আবছা আলো আর ঘোলাটে দৃষ্টির স্বল্প কর্ম ক্ষমতার জেরে সমস্তটাই ব্যর্থ । প্রবল মনের জোড়কে কাজে লাগিয়েও কোথাও যেনো অন্ধকারের একরাশ নৈরাশ্য ঘিরে ধরে রত্নাকে, নিশ্বাসের বেগ কমতে কমতে একটা সময় থমকে যায় , শিথিল হয় দুরন্ত রক্ত কণিকার দল , মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে এক হতদরিদ্র মায়ের অফুরন্ত স্নেহ।
রত্নার শরীরটা আগুনে পুড়িয়ে যখন ওরা শ্মশান থেকে বস্তিতে ফেরে তখন সবে ভোরের আলো ফুটেছে । ঘরে ঢুকেই লক্ষ্মীর ভাঁড়টা আছড়ে মেঝেতে ফেলে ভেঙে ফেললো রমেশ । বেড়িয়ে এলো কতগুলো ২০-২৫ টা দু পাঁচ টাকার কয়েন। মেঝেতে পড়ে থাকা খুচরো পয়সা গুলোর উপর হামলে পড়লো রমেশ , খুঁটে খুঁটে তুলে নিতে লাগলো এক একটা পয়সা , লোভ মদের লোভে চক চক করছে তার দুটো চোখ। এমন সময় তার মেয়েকে কোলে করে নিয়ে ঘরে ঢুকলো মালতি মাসি , এই বস্তির সব চেয়ে পুরনো বাসিন্দা। রত্নাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন তার সুবাদেই রত্নার মেয়ের মেয়েটাও বুঝি ছাড়তে পারেন নি।
– এই যে রমেশ , আর কতদিন এই ভাবে চলবে বাবা , এবার অন্তত কিছু একটা ব্যবস্থা করো । বলি রত্না তো আমাদের মরেছে একন থেকে এই দুধের শিশু এ তো তোমার ভরসাতেই বাঁচবে নাকি! তা তুমি এবার অন্তত একটু শোধরাও । মা মরা মেয়ে তুমি না দেখলে তো একেবারে ভেসে যাবে বাবা।
– এ বুড়ি মেলা ফচ ফচ করিস না তো। আর কিসের মেয়ে এ্যা কিসের মেয়ে। ও আমার মেয়ে কে বলেছে তোকে । কার সাথে ওই শালী কি করে বেরিয়েছে ঠিক নেই এখন মেয়েটাকে আমার ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে কেটে পড়েছে। সর এখান থেকে সর……..
মালতি মাসিকে ধাক্কা মেরে দরজা থেকে সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় রমেশ । বাচ্চা টাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায় মালতি মাসি , তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা নোনা জল।
বাইরে টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোটার সাথে বড়ো বড়ো বিদুৎতের ঝলকানি, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার দাপটে টিনের চালটা সশব্দে ঝন ঝন করে কেঁপে উঠছে। এমন সময় টলতে টলতে ঘরে ঢুকলো রমেশ , মেঝেয় পাতা মাদুরের উপর শুয়ে শুয়ে এক নাগাড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে চলেছে ১৫ দিনের অবলা শিশুটা। একেই এই অসময়ে ঝড় বৃষ্টির চক্করে জুয়ার আসরটা সাত তাড়াতাড়ি গেলো ভেঙে তার উপর ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের কান জ্বালানো কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই যেনো দাউ দাউ করে মাথার ভিতর আগুন জ্বলে গেল রমেশের।
-” এই শালী চুপ কর , চুপ কর বলছি ! নইলে এখানেই মেরে পুতে দেবো।
– …………..!
– কি হলো চুপ করবি না তো তুই ! দারা দারা তবে ।
ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা ঝুল মাখা ময়লা ন্যাকরাটা এনে মুঠোয় ভরে বাচ্চাটার মুখের ভিতর পুরে দিল রমেশ, বুজে এলো কচি গলার নরম কান্নার শব্দ। রমেশের চিৎকার চেঁচমেচি শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে এলো মালতি মাসি, বাচ্চার মুখ থেকে কাপড়টা টেনে বের করে জল দিয়ে মুখটা ধুয়ে দিল তড়িঘড়ি। এ যাত্রায় অন্তত বেঁচে গেলো নিষ্পাপ একটা প্রাণ। মালতি মাসিকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করতে করতে ঘর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে গেলো রমেশ।
এই ভাবে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর , সেই ছোট্টো মিনুর বয়স এখন ১৬ । হ্যাঁ ! তার মালতি দিদার দেওয়া বড়ো সাধের নাম। মরে সে যায়নি, মালতি বুড়ির আদরে যত্নে আদিখ্যেতায় দিন দিন শশীকলার মত সে বেড়ে উঠেছে এতো গুলো বছর। মাতাল বাপের গাল শুনে আর গরম বিড়ির ছ্যাঁকা খেয়েও সে দিব্যি সুখেই ছিল তার মালতি দিদার ছত্রছায়ায় তবে এবার !! এবার তাকে কে বাঁচাবে ? কার কোলে মুখ গুজেই বা সে চোখের জলে দুঃখ ভাসাবে। মিনুর সেই খুব সখের মালতি দিদাই যে আর নেই। মিনুকে একা রেখে অনাথ করে ক্যান্সারের করাল থাবায় দিক ভুলেছে মালতি বুড়ি , ভুলেছে তার আদরের মিনুর সমস্ত মায়ার টান।
উনানের আগুন বেশ গনগনিয়ে জেগে উঠেছে , জল ভর্তি ভাতের হাঁড়িটা উনানে চড়িয়ে দিয়ে তাতে দু মুঠো চাল ফেলে দিল মিনু , এমন সময় রমেশ এসে পিছন থেকে চুলের মুঠিটা ধরে হির হির করে টেনে তুললো তাকে।
— বাবা ছারো! আহ লাগছে তো বাবা !
– ছাড়বো বলে কি ধরেছি নাকি অ্যা ! চল আমার সাথে ! অনেক জ্বালিয়েছিস । আজ তোর একটা ব্যাবস্থা করবো আমি চল।
ঘণ্টা তিনেক ট্রেনের ঝাঁকুনি আর বার চারেক অটো পাল্টে তবেই এখন মিনুর ক্লান্ত শরীরটা ঠাই পেয়েছে শোভাবাজার নিষিদ্ধপল্লীর সুবৃহৎ তেতালা বাড়ির ঝকঝকে ঘরের মেঝেতে। মাত্র ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে এই জীবন্ত যমপুরীর দোরগোড়ায় এসে আছড়ে ফেলে দিয়ে গেছে তার নিজের জন্মদাতা পিতা। মার্বেলের মেঝে ভিজে উঠেছে মিনুর চোখের জলে। কোথায় এসেছে কেনো এসেছে এখনও বুঝে উঠতে পারছে না কিছুই। হঠাৎ করে দরজাটা খুলে গেলো বাইরে থেকে , ঘরের ভিতর ঢুকে এলো দুটো মহিলা আর একটা মোটাসোটা লোক।
– এ রামু, এ বিটি নুতুন আছে বটে, প্যাহলি বার জারুর নাখরা দিখাবে বহুত । তু একে সামলে দে থোড়া। কাল হামার একটা বহত মাহেঙ্গা কাস্টমার আসবে দেখিস যেনো এই ফুলটাকেই হামি দিতে পারি ওর পূজায়।
– তুমি চিন্তা করো না মা জী! আমি তো ইয়ে সাব কাম বহুত আচ্ছা করি তুমি তো জানো। আভি সোজা করে দিচ্ছি।
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়লো মিনুর উপর , মিনু আতঙ্কে – ভয়ে শিউরে উঠে সরে গেলো কিছুটা । কিন্তু দূরে যেতে পারলো না হ্যাঁচকা টানে লোকটা মিনুকে এনে ফেললো তার বুকের উপর । মিনু চিৎকার করে করে কেঁদে উঠলো যন্ত্রণায়। আর এক দল পশুর মুখে ফুটে উঠলো ক্রুর হাসির ঢেউ। মিনুর নিরীহ শিশু শরীর নষ্ট হলো এক হিংস্র পশুর থাবায়।
কেটে গেছে ১৪ টা বছর। এই নিষিদ্ধ পল্লীতে মিনুর দর এখন বেজায় উচুঁ। এখানের সব চেয়ে দামী এসি বসানো ঘরটা এখন ওর , আলমারিতে ঠাসা দামি দামি পোশাক , শোকেস ভর্তি কাজল – আলতার শিশি। সন্ধ্যে হলেই ঝাঁঝালো আতরের গন্ধ আর রঙিন জলের ফোয়ারা সঙ্গে মিনুকে এক ঝলক পাওয়ার নেশায় গোটা নিষিদ্ধ পল্লী পাগল।
এই রকমই এক দিনে শোভাবাজারের তেতালা বাড়ির দোরগোড়ায় হাজির দুই বছর ৩৪ এর যুবক নিলয় আর সুজন । নতুন চাকরি, পকেটে দেদার টাকা। নিলয়ের এই পথে দেদার আনাগোনা থাকলেও সুজন কিন্তু এক্কেবারে নতুন বন্ধুর জোরাজুরিতে পরে ঢুকে পড়েছে আজ কোনক্রমে। এখন এখান থেকে পালাতে পারলেই তার স্বস্তি। কতবার যে পিছনের দিকে পা বাড়িয়েছে তার ঠিক নেই শুধু নিলয়কে ফাঁকি দিতে পারছে না এই যা।
সুজনকে নিয়ে নিলয় সোজা ঢুকে পড়ল মীরা আম্মার ঘরে , এখানেই সব টাকা পয়সা মিটিয়ে তবেই পাবে অন্দমহলের সুখ – সাগরের হদিস ।
– মীরা আম্মা ! খবর সব ভালো তো ?
– আরে এসো এসো। হাল চাল ক্যামন তুমার? ইত্ত দিন পরে মনে পড়লো হামার কতা?
– আরে না না তোমায় ভুলতে পারি । আসলে কাজের চাপে আর আসা হয়না এদিকটায়।
– তা বলো আজ আবার কোন পাখি চাই?
– আম্মা , এই যে আমার বন্ধু সুজন । ও আজ প্রথম বুঝলে তা তোমার এখানের সব চেয়ে ভালো মালটা আজ ওর জন্যই না হয় থাক।
– সে আমার কোনো অসুবিধা নেই , তবে হামার কিন্ত ১৫ হাজার চাই আর টাইম কিন্তু ফিক্সড দু ঘণ্টার এক মিনিট বেশিও না কমও না। ও পাখি আমার সব চেয়ে ভালো মাল আছে , ওর কিন্তু বহুত ডিমান্ড।
– হ্যাঁ সে ঠিক আছে । সে আমি দিয়ে দিচ্ছি , তবে দেখো আমার বন্ধুর খাতির যত্নের কোনো খামতি যেনো না হয়।
কথা গুলো বলতে বলতে পকেট থেকে গোছা খানেক ৫০০ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল মীরা আম্মার দিকে। মীরা আম্মার পান চিবনো লাল ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক টুকরো লালসা মিশ্রিত হাসি। মীরা আম্মার নির্দেশে সুজনকে একটা ঘরের সামনে নিয়ে গেলো একটা মেয়ে। দু বার খট খট করে কড়া নাড়লো দরজায়, ওপার থেকে বিরক্তি মাখা গলায় উত্তর এলো।
– কে রে হারামজাদা । এতো তাড়া কিসে । তর সয়না বুঝি কুত্তার দল গুলো সব জ্বালিয়ে মারলো।
কথা গুলো শুনে থর থর করে কেঁপে উঠলো সুজনের পা। এখান থেকে বেরোনোর উপায় খোঁজার আশায় মরিয়া হয়ে ওঠে সে । প্রায় মিনিট সাতেক পর , ঘরের দরজা খুলে যায় । ভিতর থেকে বেরিয়ে চলে গেলো একটা রোগা পাতলা লোক। পাশে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটা ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলো সুজনকে সেই ঘরের ভিতর। থত মত খেয়ে মেঝের উপর পড়ে গেলো সুজন। সেই দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মিনু। মিনুর হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে নিমেষেই যেনো কোথায় নিজেকে হারিয়ে ফেললো সুজন। কোথায় এসেছে কেনো এসেছে কোনো কিছুই আর তার মাথায় নেই সব যেনো এলোমেলো । এতক্ষণের সেই ভয় আতঙ্কের পরিবর্তে এখন মন জুড়ে শুধু এক নিষ্পাপ ভালোলাগা রেশ।
– কি ব্যাপার ? বাবু এই চত্বরে প্রথম বুঝি !
মিনুর কথায় হুস ফেরে সুজনের তড়িঘড়ি উঠে দাড়ায় , আপন মনেই হেসে ফেলে নিজের অবস্থার কথা ভেবে।
– আরে হয় হয় প্রথম প্রথম একটু হয়।
– তো নিন আর দেরি কিসের শুরু করুন আপনার কাজ।
– কাজ ? কিসের কাজ ?
– আহ !! ন্যাকা যেনো। এতো গুলো টাকা কি সাধে বিলিয়ে এসেছ। যা করার তাড়াতাড়ি করো আমার ওতো ন্যাকামো করার সময় নেই।
– আচ্ছা ওই সব কি করতেই হবে ? না মানে এই দু ঘন্টা আমরা গল্প করতে পারি না ?
– গল্প ? ও মা ( ভয়ংকর অট্টহাসিতে ফেটে পরে মিনু)
ওতো গুলো টাকা দিয়ে কি গল্প করতে আসা হয়েছে অ্যা! আর কি গল্প করবে তুমি একটা বাজারি মেয়ে মানুষের সাথে। আমাদের গল্প কে বা শুনবে, কেই বা লিখবে আমাদের গল্প !?
সোকেস থেকে সাদা খাম বের করে প্যারাসিটামলের পাতা খুলে একটা ওষুধের টুকরো খপ করে মুখে পুরে জল খেলো মিনু। তারপর কিছুক্ষন থেমে আবারও বলতে শুরু করলো –
– জন্ম দিয়েই মা মরেছে, বাপটাও মাতাল । একদিন মদের নেশায় শেষে আমাকেও বেচে দিলো এদের কাছে। ব্যাস আর কি! সেই থেকেই এই নরকের কিট আমি ।রোজ রোজ কতো পশু আসছে যাচ্ছে ।
মিনুর কথা গুলো শুনে বুকের বাম পাশটায় কেমন চিন চিন করে উঠলো সুজনের। বড়সড় একটা ধোক গিলে সে বললো –
– ওটা কিসের ওষুধ খেলে তুমি ? তোমার কি শরীর খারাপ ?
– আর শরীর। আমাদের আবার শরীর বলে কিছু আছে নাকি! হুহ কাল থেকে জ্বর মাথাটা বেজায় ভার । মাসি কে বললাম আজ পারবো না কাজ করতে , কথাটা শুনেই সে সজোরে দুটো চর বসিয়ে দিলো গালে। আর ওই শয়তান গুলো , ওরা তো এক একটা পশু…..ওই মাতাল গুলোর কি কোনো হুস থাকে নাকি ? নয়তো বাড়িতে বউ ফেলে কি এই নোংরা পল্লীতে ঢোকে?
– আজ আমি তবে উঠি । আবার না হয় পরে একদিন , তুমি একটু বিশ্রাম করো। এই দু ঘণ্টার টাকা দেওয়া আছে , এই দু ঘন্টা তোমায় কেউ জালাবে না।
সুজনের কথা শুনে অজান্তেই মীনুর চোখে জল এলো , এর আগে এতো জন এসেছে এই ঘরে কই কেউ তো কোনদিন এমন করে বলেনি!
– মিনু! এই নাও এই খাম টা রাখো , ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও।
কথা গুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সুজন , আর তার যাওয়ার দিকেই অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মিনু। খানিক বাদে খাম টা খুলে দেখে তাতে করকরে দুটো ৫০০ টাকার নোট , আর একটা ছোট্ট কাগজে লেখা ” ডাক্তার দেখিয়ে নিও ।”
খাটের এক পাশে ধপ করে বসে পড়ে মিনু ছোট্ট কাগজটা বুকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে হাউ হাউ করে । আপন মনেই বলে ওঠে –
– আমি জানতাম পুরুষ মানুষ মানেই পাষাণ , এক একটা জানোয়ার কিন্তু আজ বুঝলাম মালতি দিদার কথাই সত্যি , সত্যি কারের পুরুষ মানুষের বুকে এক আলাদাই মন্ত্র থাকে যার ছোঁয়ায় নারীর সব দুঃখ শীতল হয়। তোমায় একবার যদি জড়িয়ে ধরতে পারতাম বাবু। ……………… তোমায় আর একবার দেখার আশায় আমি সারা জীবন অপেক্ষা করবো বাবু।।
তা মিনুর সে আশা অপূর্ন রাখেন নি অন্তর্যামী ।সুজনের এখন নিষিদ্ধ পল্লীতে নিত্য আসা যাওয়া। সে এখন মিনুর ধরাবাঁধা কাস্টমার। প্রথম দিনের সেই দোনামণা আবেগ এখন উভয়ের সম্মতিতে বাঁধা পড়েছে এক মিষ্টি সম্পর্কে। তাদের এই আপন গতিতে সাবলীল ভাবে গজিয়ে ওঠা সম্পর্কের কথা অবশ্য এখন আর শুধু তাদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। খবর ছড়িয়ে পড়েছে গোটা নিষিদ্ধ পল্লীর কানায় কানায়। এর জন্য অবশ্য এখন লাথি ঝ্যাটা আর অকথ্য গালিগালাজ মিনুর নিত্য সঙ্গী। তবুও সে এসব কিছুকে তোয়াক্কা না করেই দিব্যি সুখের সংসার বাঁধার স্বপ্নের জাল বুনছে মনের কোনে। দিনের শেষে সুজনের থেকে পাওয়া ওই দুটো ঘন্টা যেনো মিনুর কাছে স্বর্গ সুখ।
– দেখ সুজন, তুই কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস , আরে ওইসব রাস্তার ময়লা তুলে কি আর ঘর সাজানো যায় নাকি অ্যা! তার চেয়ে শোন একটা ভালো কথা বলি , মালটাকে চল আমরা দুজন মিলে শেয়ারে ভাগ করেনি ও থাকবে ওর মতো । আর একটা ভালো মেয়ে টেয়ে দেখি বিয়ে টিয়ে করে সংসার টংসার কর।
সিগারেটের ধোঁয়ায় টান দিতে দিতে ভুরু কুচকে নিলয় বিরক্তি নিয়ে বলে কথা গুলো।
রাগে মাথাটা ঝন ঝন করে ওঠে সুজনের,অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয় সে ।
– দেখ নিলয় তুই তোর রাস্তা দেখ আমার জন্য ওতো ভাবতে হবে না তোকে।
কথা গুলো বলেই বড়ো বড়ো পা ফেলে ভুঁড়ি পুকুর লেকের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এসে বাড়ির পথ ধরে সুজন।
রাত ১০ টা সোফার উপর বসে এক মনে পা নাড়াচ্ছিল সুজন , হঠাৎ করেই তার বাবা অমল বাবু এসে গর্জে ওঠেন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে
– এসব কি শুনছি আমি সুজন ? তুমি নাকি আজকাল নোংরা পল্লীতে আসা যাওয়া করছো, আবার ওখান কার কোনো মেয়েকে নাকি বিয়ে টিয়ে করবে বলে ঠিক করেছো! এসব কি শুরু করেছ তুমি । আমাদের মান সম্মান আর রাখবে না নাকি । এই দিন দেখার জন্য এত কষ্ট করে বড়ো করেছি তোমায় ?
স্বামীর চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে নিচ থেকে ছেলের ঘরে ছুটে আসেন সুজনের মা ।
– আরে কি করছো কি তুমি এত চিৎকার করো না, শরীর খারাপ করবে যে ।
– আর শরীর ! তোমার ছেলে শরীর ভালো রাখার জায়গা রাখলে তো । জিজ্ঞেস করো তোমার ছেলেকে কি নোংরামো শুরু করেছে দেখো। একটা কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছো তুমি দেখো।
হঠাৎ অমল বাবুর বুকের যন্ত্রণা শুরু হয় , হাপাতে হাপাতে বসে পড়েন মেঝের উপর । ওনাকে ধরে ধরে অনেক কষ্টে নিজের ঘরে নিয়ে যান সুজনের মা । এক জায়গায় থ হয়ে দাড়িয়ে থাকে সুজন , দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে দেওয়ালে একটা ঘুষি মারে সজোড়ে ।
সকাল ৭ টা মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে সুজনের।
– সুজন তাড়াতাড়ি আয় বাবা তোর বাবা কেমন করছে । তাড়াতাড়ি আয় ।
মায়ের চোখের জল চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গলায়। ছুটটে নিচে যায় সুজন মায়ের সাথে । গিয়ে দেখে অমল বাবু মেঝেতে পরে রয়েছেন আর ওনার ঠোঁটের কোনা থেকে উপচে পড়ছে সাদা সাদা ফ্যানা।
আজ প্রায় দিন পনেরো পড়ে দুজনের পা পড়লো নিষিদ্ধ পল্লীর দোরগোড়ায়। যতই হোক পিতৃ শোক ভুলতে তো একটু হলেও সময় লাগবেই। যাই হোক , বাইরে সব টাকা পয়সা মিটিয়ে মিনুর ঘরের সামনে এসে দাড়াতেই সুজন দেখলো নিলয় হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলো মিনুর ঘর থেকে। নিলয়কে দেখামাত্র চোখ মুখ ঠিকড়ে আগুন বেরিয়ে এলো দুজনের। তড়িৎ বেগে মিনুর ঘরে ঢুকে হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে কাছে টেনে দাঁত কিরমির করে মিনুকে বলে
– নিলয় তোমার ঘরে কি করছিল ?
– কি আবার করবে টাকা দিয়ে ঢুকেছিল। কিন্তু…
– ওহ এই কদিনেই নিজের ভোল বদলে ফেলেছো তাই না , এই কদিনেই আবার নতুন একটা…
– সুজন এসব কি বলছো তুমি! তুমি ভুল বুঝছো আমায়।
– এখন আর কিছু বোঝার সময় নেই । আমার সাথে এসো
– কোথায় যাবো আমি তোমার সাথে?
– পালিয়ে যাবে। আমার সাথে ।
– মানে?
– বলেছিলে না ভালোবাসো?
– হ্যাঁ কিন্তু..
– কোনো কিন্তু না , চলো আমার সাথে।
গভীর রাত , থমথমে শহর । কলকল করে বয়ে চলে গঙ্গার শান্ত জল আর সুজনের কাধে মাথা রেখে বসে মিনু , হাতের উপর হাত। ফুরফুর করে উড়ে মিনুর চোখে মুখে লেপ্টে যাচ্ছে উন্মুক্ত অবাধ্য কেশরাশি। মনের ভিতর দুরন্ত যৌবনের উশৃঙ্খল অনুভূতিরা ছোটাছুটি খেলায় পাগল করে দিচ্ছে তার শান্ত কোমল মন টাকে।
– মিনু !
– উম বলো।
– ভালোবাসো ?
– খুব বাসি।
– তবে চলো আজ থেকে আমরা নতুন জীবন শুরু করি….!
– যে হাত ধরে বিশ্বাস করে বেরিয়ে আসতে পেরেছি ওই পাষাণ পুরী থেকে সেই হাত ধরে মৃত্যুপুরীর দোরগোড়ায় ও যেতে রাজি।
মুচকি হেসে আলতো করে সুযোগ ঠোঁট ছোঁয়ালো মিনুর কপালে। তারপর উঠে দাঁড়ালো দুজন। পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট কুড়ির মধ্যে যখন তারা এসে পৌঁছাল স্টেশন চত্বরে , তখন ভোরের প্রথম ট্রেনটা আলো জ্বেলে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো যেনো তেরে আসছে রেল লাইনের পাত ধরে সাথে বিভীষিকাময় কানে তালা লাগানো প্রচণ্ড শব্দ। মিনুর হাত থেকে নিজের হাত টা খুব আলতো ভাবে ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে এক পা দুপা করে পিছিয়ে আসতে লাগলো সুজন তারপর হঠাৎ করেই মিনুর পিঠে সজোরে ধাক্কা দিয়ে রেল লাইনের উপর আছড়ে ফেলে দিল তাকে । ছিটকে গিয়ে পড়লো মিনু ছোট বড় পাথরের টুকরো গুলোর উপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুটন্ত রেলের চাকা গুলো এগিয়ে গেলো মিনুর শরীর ভেদ করে। চলে গেলো ট্রেনটা , পুরো রেল লাইনটা এখন রক্তে মাখামাখি । মিনুর দুখন্ড শরীরের দুটো টুকরো পরে আছে দুদিকে। চোখ দুটো ঠিকড়ে বেরিয়ে আছে , মিনুর সেই ঠিকরানো চোখের দিকে তাকিয়ে সুজন হিংস্র ভাবে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো –
– তুমি শুধু আমার মিনু , তুমি শুধুই আমার। তোমায় নিয়ে তো আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম কিন্তু তুমিই তো।। নিলয়কে নিজের ঘরে ঢুকতে দিয়ে খুব ভুল করেছো তুমি মিনু। আমার সিধান্তই শেষ আমার কাছে সুজন না কারোর কথা শোনে আর না কখনো ভাবে , ঠিক যেমন তোমার আমার সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি তুলেছিল বলে সকালে চায়ের কাপে ইঁদুর মারার বিষ মিশিয়ে বাবাকে মেরেছি তেমন ভাবেই নিলয়ের কাছে যাওয়ার জন্য তোমায়ও। এবার তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নেওয়ার শাস্তি আমি নিলয়কে দেবো। তুমি চিন্তা করোনা সোনা তোমায় আমি যার জন্য হারিয়ে ফেলেছি তাকে আমি ছাড়বো না।।
স্টেশনে একটা দুটো করে লোকের সমাগম এরই ফাঁকে কপালের ঘাম মুঝে অন্ধকার গলির বাঁকে মিলিয়ে গেল এক মানব রুপী ছায়া মূর্তি।।
বিষয় মৌলিকত্ব | |
ভাষা সাবলীলতা | |
কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা প্রবাহ | |
শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ | |
অডিও/ভিডিও রূপান্তর যোগ্য | |
Average
|
|
![]() |