গণৎকার চুপ।
তোতন : এবার বলুন, উনি যার ঘরে এসেছিলেন, তার সম্বন্ধে কী জানেন। তাকে কতটুকু চেনেন?
গণৎকার : আমি সারদা মায়ের দিব্যি কেটে বলছি, আমি তাকে দেখিইনি। রাকেশজি একাই ছিলেন। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে নীচে। হোটেল কম্পাউণ্ডে। ওনার সঙ্গে কেউই ছিল না। আমাকে বললেন— আমার পরিচয় গোপন রাখুন। আমি একটা ইনভেস্টিগেশনে এসেছি।
এবার তোতন গণৎকারকে ছেড়ে পরবর্তী রুমে যাবার কথা বললো। যাওয়ায় পথে ম্যানেজারকে ব’লে দিলো, এদেরকে আটকে রেখে কোনো লাভ নেই। এরা ইন্নোসেন্ট। পরবর্তী রুম ৩৬/ডি।
কলিংবেল দিতেই এক বয়স্কা মহিলা দরজা খুললেন। সবিনয়ে বললেন, ‘পুলিশের লোক তো? আসুন। ম্যানেজার আমাদের বলেছেন সব।‘
তারপরেই তোতনকে দেখে বললেন, ‘কালকে আপনি জয়রামবাটিতে গিয়েছিলেন না? আমার পাশে বসেই তো প্রসাদ খেলেন। আপনার সঙ্গে একজন আমারই বয়সী মহিলা আর একজন কম বয়সী মহিলা ছিলেন না?’
তোতন কোনো উত্তর দিলো না।শুধু ভেতরে ঢুকেই প্রশ্ন করলো, ‘আপনারা কতদিন থাকছেন এখানে?’
— আমি তো জানি না, স্যার। আমার ছেলে আমাকে বেড়াতে নিয়ে এসেছে। খালি বায়না করতাম, ঠাকুরের জন্মস্থানে যাবো। তাই বাধ্য হয়েই এসেছে। ওদের কি ধর্মকর্মে মন আছে! খালি চাকরী চাকরী আর চাকরী। ওদের বাবা থাকতে কত জায়গা আমাকে ঘুরিয়েছেন! এইখানে, এই ঘরের কাছেই আসা হয়নি।‘
— কোথায় বাড়ি আপনাদের?
তোতনের প্রশ্নে উত্তর দিলেন মহিলা, ‘আমরা পুরুলিয়া থেকে এসেছি। ছেলে চাকরী করে কলকাতায়। ছুটি পায় না।‘
— কোথায় আপনার ছেলে?
— ওদের কি ঘরে মন টেকে? গ্যাছে টহল দিতে। নীচে গিয়ে সিগারেট-বিড়ি খায়। হয়তো তাই গ্যাছে। পরশু সবে এসেছি আমরা।
তোতন বললো, ‘আপনি দরজা বন্ধ করতে পারেন। আমরা চ’লে যাচ্ছি।‘
মহিলা আবার বললেন, ‘আপনাকে দেখে কিন্তু পুলিশ মনে হয় না। একদম আমার ছেলের মতো।
তোতন গম্ভীর হয়ে আবার রসিকতা করে, ‘আমি যে পুলিশের লোক, একথা কে বললো?’
— ঐ যে ম্যানেজার সাহেব।
— আমি পুলিশ নই। আমি গোয়েন্দা। আর পুলিশ হোক, বা গোয়েন্দা… তারাও তো কারোর না কারোর ছেলে। আলাদা জীব তো নয়।
তারপর নিচু গলায় ম্যানেজারকে উদ্দেশ ক’রে ব’লে দিলো যে, বোর্ডারদের ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। ওদের আটকে রেখে লাভ নেই।
তারপর রিসেপশন।
রিসেপশনে দু’জন ব’সে আছে। একজন কাজ করছে, আর একজন আইডল ব’সে আছে। ম্যানেজার জানালেন যে, ব’সে থাকা ছেলেটি মিস্ রাখী রায় যেদিন চেকইন করে, সেদিন ডেস্কে ছিল।
তোতন একনজরে রিসেপশনটি পর্যবেক্ষণ ক’রে নিলো। বেশ ঝকঝকে সুসজ্জিত একটা বড় কাউন্টার। দুটো ডেস্কটপ কম্পিউটার রয়েছে, রয়েছে দুটো গদি মোড়া রিভভিং চেয়ার। দেওয়ালে একটি সুদৃশ বোর্ড আর তাতেই লেখা “ময়ুরী”। অর্থাৎ তিনটি ব্লকের আলাদা আলাদা তিনটি রিসেপশন। তোতনরা ছিল কাজরী’র ফার্স্ট ফ্লোরে। দেওয়ালে একটি ক্যাবিনেট রয়েছে, হ্যাঙ্গিং। সম্ভবতঃ সেটি বিভিন্ন চাবি’র ক্যাবিনেট। ডেস্কে দুটো লাল আর হলুদ রংএর ল্যাণ্ড লাইন ফোনের রিসিভার রয়েছে। দেওয়ালে নানা রংয়ের গোটা চারেক ইন্টারকমের রিসিভার ঝুলছে।
যে ছেলেটিকে ম্যানেজার দেখালেন, সেও বেশ ওয়েল ড্রেসড। তোতন ওকে বললো, ‘আমাকে বলুন, মিস্ রাখী রায় যখন বোর্ডিং করেন, তখন কী ডক্যুমেন্ট দিয়েছিলেন?’
ছেলেটি সহাস্যে জানালো, ‘ভোটার আইডি।‘
— নিশ্চয়ই তার ফোটোকপি মেশিনে রয়েছে?
— অবশ্যই আছে, স্যার।
— দেখান।
ছেলেটি অন্য কম্পিউটারে মাউস দিয়ে খুটখাট ক’রে বোর্ডিং ডিটেইলস বের করলো আর মনিটরটা ঘুরিয়ে দিলো তোতনের দিকে। তোতন এক ঝলক দেখে নিয়ে হুকুম করলো,
— ছবিটা আর গোটা ডক্যুমেন্ট আমাকে স্ক্রীনশট নিয়ে এই নম্বরে সেণ্ড করুন।
ব’লে নিজের ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিলো ছেলেটির দিকে।
মেশিনে খুটখাট ক’রে মুচকি হেসে ছেলেটি জানালো, ‘দিয়েছি, স্যার।‘
তোতন ভালো ক’রে ছবিটি দেখলো। লক্ষ্য করলো, যার ছবি, তার বয়েস ২০, কি ২১। বেশ কায়দা করা সাজপোশাক। সন্দেহ নেই, মেয়েটি সুন্দরী। তোতন জানতে চাইলো, ‘এই ছবির সাথে বোর্ডার মহিলার মুখের সিমিলারিটি পেয়েছিলেন কি?’
ছেলেটি বললো, ‘না, ঠিকঠাক মিল ছিল না। আমি মেনশন করেছিলাম। তিনি বললেন যে, দশ-বারো বছর আগের ভোটার আইডি. আর এইসব কার্ডে যে ছবি থাকে, তা থেকে প্র্যাক্টিক্যালি মানুষের মুখ চেনা মুশকিল, স্যার। আমরা বহুবার এমনটা দেখেছি।‘
এবার ছেলেটিকে বাইরে ডেকে এনে গেস্টদের সোফায় বসিয়ে বেশ কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করলো তোতন যেমন,
(১) যখন এসপি. সাহেব আসেন, সেদিন কার ডিউটি ছিল?
উত্তর এলো, আনফরচুনেটলি আমারই, স্যার।
(২) আপনি বলতে পারবেন, সঙ্গে ঐ মহিলা ছিল কিনা?
উত্তর এলো, আমি কিন্তু লক্ষ্য করিনি, স্যার। আসলে এমন তো অনেকেই আসে। আর আমি তো এসপি. সাহেবকে চিনি না। পরে জানলাম, তিনি এসপি. সাহেব। আমাদেরকে কোয়ারি করা হয় আর আমরা ইন্টারকমে বোর্ডারের সাথে কথা ব’লে কনসেন্ট পেলে ভিজিটরস’কে পাঠিয়ে দিই।
(৪) ঐ রুমের রুম সার্ভিস কে ছিল? তার সাথে কথা বলতে হবে।
ম্যানেজার ছেলেটিকে বললেন, ‘কে ছিল?’
ছেলেটি মেশিন দেখে জানালো, ‘স্যার, ও হলো ‘নীতিশ। নীতিশ আদক।‘
— চলো। ডেকে পাঠাও।
গোটা এনকোয়ারি সেরে তোতনদের হোটেল থেকে বেরোতে বেরোতে বেজে গ্যালো রাত ১০টা। তোতন রুমে ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই ইন্সপেক্টর ওর হাতে ধরিয়ে দিলেন হোটেলের আর হোটেলের বাইরে থাকা সিসি ক্যামেরার রেকর্ডের দুটো পেনড্রাইভ।
— স্যার, রেকর্ড চেয়েছিলেন।
তোতন এক গাল হেসে বললো, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, মিঃ দত্ত।‘
ইন্সপেক্টর হেসে জানালো, ‘এনি টাইম, স্যার।‘
— কিন্তু দুটো কেন?
— আমি, স্যার, ঐ সিটি কনফেকশনার্সের বাইরেও সিসি ক্যামেরা পেয়েছি। তাই ওটাও দিলাম।
তোতন করমর্দন ক’রে জানালো, ‘আবার থ্যাঙ্ক ইউ।‘
— ওয়েলকাম মিঃ চ্যাটার্জ্জী।
———-