(৬)
রাত ক’রে রুমে ফিরতেই মায়ের অভিযোগ,
— এলাম ছেলে-বৌ’কে নিয়ে ঘুরতে। আর ছেলে সেই আসামী ঠেঙ্গিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার বেড়ানোটাই মাটি হলো। তোকে নিয়ে কোথাও গিয়ে আমার শান্তি নেই।
তোতন হেসে দ্যায়, ‘তবু তো মালিনী তোমার সঙ্গে আছে, মা। তুমি জানো তো, অপরাধ আমার পেছনে ধাওয়া করে। এ আমার ভবিতব্য, মা। আর এই কেসটা আমার জীবনে একটা মাইলস্টোন হলেও হতে পারে। গভর্নমেন্টের ঘরে তোমার ছেলের একটা রেকর্ড থাকবে, যদি জাল ছিঁড়তে পারি। আশীর্বাদ করো। আর রাতে বিছানায় গিয়ে মালিনীকে পুরো কেস ব্রিফ করতে হয়েছিলো। এটা ওকে করতেই হয়।
মা বেশ চিন্তিত হয়েই বললো, ‘কী বুঝছিস, তুই পারবি কেসটা?’
— তোমার আশীর্বাদে তো তোমার ছেলে আজও ব্যর্থ হয়নি। তবে ঘুঘু তো রোজ ধান খায় না। বলা যায় না, ফসকে যাবে কিনা। আসলে কেসটা ততটা জটিল নয় ব’লে মনে হচ্ছে। তবে আমায় বোধহয় রণে ভঙ্গ দিতে হবে।
তোতনের এমন কথা শুনে এবার মালিনী বলে, ‘বোলছো, জটিল না। আবার বোলছো রণে ভঙ্গ দিতে হবে! এ আবার কি কথা?’
— আছে, মালিনী, আছে। আমি যা সন্দেহ করছি, তা যদি ঘ’টেই থাকে, তবে রণে ভঙ্গ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
— কেন? তুমি কি প্রাণহানির ভয় করছো? মালিনী ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে।
— এটা যে জগতের সঙ্গে জড়িত, তাতে প্রাণহানি ঘটতেই পারে। কিন্তু তুমি তো জানো, তোমার বেটারহাফ্ শুধু বেটার নয়। দ্য বেস্ট। ওসব পরোয়া সে করে না। কিন্তু কেসটায় টুইস্ট আছে। রাস্তা খুঁজছি। একটা রাস্তা। একটা চওড়া রাস্তা। অন্ততঃ একটা গলিপথ। দেখি, কী হয়।
তোতন বিড়বিড় করতে থাকে ও।
বহু রাত অবধি সিসি ক্যামেরার পেনড্রাইভদুটো দেখে তোতন বেশ জোরেই হেসে দিলো।
আমি জানি, তোতন একটু বেশি রাত জাগবেই। তাই একটু বেশি রাতেই আমি ওকে ফোন করলাম। ঠিক ফোন ধরলো।
বললাম, ‘কী রে? ওদিকে কী খবর? তোদের তো ফিরতে হবে রে। এর মধ্যে কিছু হবে?‘
— তুমি কি খুব চিন্তিত?
— চিন্তার ব্যাপার না? এইভাবে একজন এসপি. মার্ডার! তুই আগে কখনও শুনেছিস? না এমন কেস হাতে নিয়েছিস!
তোতন এবারে আমায় অবাক ক’রে প্রশ্ন করলো, ‘আমায় একটা কথা বলো তো, মধুদা। অপরাধ ঘটলে অপরাধীকে কি ধরতেই হবে?
— সে কী! এতদিন পরে এ কী প্রশ্ন রে! অপরাধ ইজ অপরাধ। আইন তো অপরাধীকে কোনো রেহাই দেওয়ার কথা বলে না!
— বলে তো, মধুদা। বলে। সেল্ফ ডিফেন্স? সেক্ষেত্রে তো পানিশমেন্ট হয় না।
আমি বলি, ‘সে তো অপরাধ থেকে বাঁচবার জন্য অপরাধ।‘
— আমি তো সেটাই বলছি। এটা তো একটা মানবিক দিক। আর রিটালিয়েশন সম্বন্ধে তোমার কী মত? তাৎক্ষণিক রি-এ্যাকশনে যদি অপরাধ হয়? অথবা একটা অপরাধকে স্তব্ধ করতে যদি আর একটা অপরাধ ঘ’টে যায়?
তোতন জীবনে এইসব প্রশ্ন আমাকে করেনি। আমি একটু ঘাবড়েই যাই। ভাবি, ছেলেটার হলোটা কী! এইসব প্রশ্ন কেন করছে! ও কি এই কেস নিয়ে কনফিউজড? আমি ওকে আশ্বস্ত করতে বললাম, ‘ঘাবড়াস না, তোতন। যা-ই করবি, সকলের ওপরে স্থান দিবি মনুষ্যত্বের। মানবতা শেষ কথা। মানুষের জন্যই কিন্তু আইন। আইনের জন্য মানুষ না।‘
আমার এই কথায় ও যেন প্রাণ ফিরে পেলো। একটু হতভম্ব হতভম্ব লাগছিল ওকে। এবার আমাকে ফোনেই একটা হামি দিয়ে বললো, ‘আমার মনের সব অন্ধকার তুমি দূর ক’রে দিলে, গুরুদেব। এইজন্যই তুমি আমার গুরুদেব। আমার অলটাইম পাথফাইণ্ডার। থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। মেনি মেনি থ্যাঙ্কস।
আমি কিছুই বুঝলাম না। আমাকে বলতেই হলো, ‘তাহলে বল্, কেসটা কতদূর।‘
জানতাম, ও মুখ ফাঁক করবে না। আমি তো ওকে চিনি। ও এখন অনেক কম্বিনেশন আর পালমুটেশন করবে। তবু প্রশ্ন করলাম।
— একটু দূর আছে। তবে জাল আমি অলমোস্ট গ্রিপ ক’রে ফেলেছি। শুধু মাছ টেনে তোলা বাকি। তবে যদি খোকা ইলিশ হয়, তবে জলেই ছেড়ে দেবো। তোমার কথাই ঠিক। মানুষের জন্য আইন। আইনের জন্য মানুষ নয়। তোমাকে সব জানাবোখন। ডোন্ট ওয়ারি।
আমি বললাম, ‘আমাকে একটা কথা শুধু বল্, কেসটা তো ডিপার্টমেন্ট নিজেরা চেষ্টা করতে পারতো। সোজা তোকে ঢুকিয়ে নিলো কেন? তুই একজন সিভিলিয়ান!’
তোতন আমাকে অবাক ক’রে দিয়ে বললো, ‘লিমিটেশন আর প্রটোকল, মধুদা। জণ্ডিস আছে। ডিপার্টমেন্ট পারবে না এ কেস।‘
আমি ঠিক বুঝলাম না ওর কথা। এও বুঝলাম, এখনও ও কোনোভাবে মুখটি ফাঁক করবে না। এখন ওর মাথায় হাজার মেশিন চলছে। তবে এটাও বুঝলাম, ও কাজ প্রায় গুটিয়ে এনেছে।
———-