বিষাক্ত রক্তাহুতি | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | পার্থিব ঘোষ | Bengali Thriller Story | 9F10
0 (0)

ভদ্রলোক বললেন, ‘কিন্তু বৌমা তো এখানে আসেনি। আমাদেরকেও সে ক্রিমেটোরিয়ামের পর এতদিন বিষ্ণুপুরের ধারেকাছে ঘেঁষতে দ্যায়নি।

— তাই নাকি! তাহলে?

— আপনি দেখুন, সে তার বাপের বাড়ি গ্যাছে কিনা। আর তো কোথাও…!

— কিন্তু আমি তো চিনি না ওঁর বাপের বাড়ি। আপনি হেল্প করুন প্লীজ। ভীষণ জরুরী।

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি লিখে দিচ্ছি। ওদের বাড়ি এখানেই। বেলদা।‘

তোতন বললো, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি? খুব অদ্ভুত শোনালেও করি। আপনার ছেলেকে আপনি কী চোখে দ্যাখেন? একমাত্র বাবা-মা’ই তো পারেন পুত্র সম্পর্কে সঠিক কথা বলতে।‘

ভদ্রলোক বলেন, ‘আমার ছেলে? আমাদের পরিবার কয়েক জেনারেশন ধ’রে বামপন্থী। আমরা ক্যাডার নই বা কমরেড নই। কিন্তু বাম আদর্শেই চলেছি। আর আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এবার বুঝুন, আমার ছেলে কেমন হতে পারে। সে সৎ, আদর্শবান। এই কারণে তাকে পুলিশ সার্ভিসে যেতে আমরা সকলেই বারণ করেছিলাম। কিন্তু ভবিতব্য কে খণ্ডাবে!‘

এইকথা ব’লে তিনি চোখের জল মুছতে মুছতে একটা কাগজে ঠিকানা আর লোকেশন লিখে দিলেন। আর বললেন, ‘ওকে ওদের কোয়াটার্সে যখন পেলেন না, তবে বাপের বাড়িতে পাবেন। জিজ্ঞেস করবেন “রাখী পার্লারের বাড়ি”। সকলেই দেখিয়ে দেবে। ওর পার্লার ওখানকার বিখ্যাত পার্লার। এখন ওর বোন ব্যবসাটি চালায়।‘

তোতন ভদ্রলোকের পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকালো। ভদ্রলোক বললেন— জয়স্তু।

এবার ঐ গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা বেলদা। বাড়ি খুঁজে পেতে কোনো সমস্যাই হলো না। ড্রাইভার সবটাই চেনে।

ছিমছাম ছোট্ট বাড়ি। একতলা। কাঠা তিনেক জমির ওপর এক নিম্ন মধ্যবিত্তের বাড়ী যেমনটা হয়, তেমনই।

দরজায় কলিংবেল টিপতেই যে দরজা খুললো, সে স্বয়ং রাখী রায়। কিন্তু হোটেলে মিস্ রাখী রায়ের চেকইন করার সিসি ক্যামেরার ছবি থেকে এই মহিলার মুখ অনেকটাই আলাদা। এই মহিলার বয়কাট চুল, পরনে সাদা কাপড়, প্রসাধনহীন মুখ। না, নাকের নীচে কোনো আঁচিল তো নেই! কিন্তু ছবিতে মহিলার চুল ঘাড় অবধি এবং কার্ল করা, নাকের নীচে একটা আঁচিল, জোড়া ভুরু। বেশ আলাদা। কিন্তু কোথায় যেন একটা অদ্ভূত মিলও রয়েছে। তবে সিসি রেকর্ডের সেকেণ্ড পার্টে অনেকটা এই মহিলাকেই হোটেল থেকে বের হওয়ার ফুটেজ রয়েছে। ইনি ওখানে কী করতে গেছিলেন! কবেই বা গেছিলেন? এঁর ঢোকার তো কোনো ফুটেজ নেই!

জট। জট। আর জট। সব ধোঁয়া ধোঁয়া।

— কাকে চাই, বলুন। মহিলা প্রশ্ন করলেন।

তোতন চমকে ওঠে। মহিলার অদ্ভূত সুন্দর কন্ঠ। তোতন গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মহিলার দিকে।

মহিলা আবার প্রশ্ন করে, ‘বলুন, কাকে চাইছেন।‘

— আপনাকে। মিস রাখী রায়কে।

একটু অসন্তুষ্ট হয়ে মহিলা বলেন, ‘মিস্ নই। মিসেস রাখী রায়।‘

— ওকে ওকে। সরি। আমারই ভুল। আপনার তো একটা বিউটি পার্লার আছে, না?’ মহিলা “হ্যাঁ” বোধক ইশারা দিতেই তোতন বললো, ‘ভেতরে যেতে পারি?

— আগে তো বলুন, কোথা থেকে আসছেন? কেনই বা আমাকে চাইছেন? আপনাকে তো চিনি না!

তোতন অস্বীকার করে না। ব’লে দ্যায়, ‘আমি বিষ্ণুপুর থেকে আসছি। বিষ্ণুপুর পোলিস স্টেশন।‘

তোতন ওর ভিজিটিং কার্ড দেখাতেই এবারে মহিলা দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন আর বললেন, ‘আসুন ভেতরে। বসুন।‘

তোতন ঢুকে দেখলো, সুসজ্জিত ড্রয়িং রুম, সোফা পাতা রয়েছে, একটা টি-টেবল, একটা বুকশেলফ, তাতে বই ঠাসা। রুচিশীল বাড়ি।

— জল দেবো? রাখীদেবী বলেন।

— প্লীজ। তোতন অনুরোধের সুরে বলে।

মহিলা পেছন ঘুরতেই তোতন বলে, ‘দেখবেন, প্রদ্যূৎবাবু’র মতো কাণ্ড ঘটাবেন না।‘

গম্ভীর মুখে মহিলা তোতনের আপাদমস্তক দ্যাখেন একবার। তারপর চ’লে যান। আর একটা প্লেটে কিছু গুজিয়া আর এক গেলাস জল নিয়ে ঢোকেন। সোফার সামনে টেবিলের ওপর রাখেন জল আর প্লেট।

তোতন প্রশ্ন করে, ‘ক’দিন আগেই তো আপনি মিস্ রাখী রায় ছিলেন। আবার মিসেস হলেন কবে?’

— আপনার কথা আমি বুঝলাম না।

তোতন মোবাইলে রাখীর ভোটার আইকার্ডের ছবি দ্যাখায় আর বলে, ‘এটা আপনার ছবি তো?’

— কেন, কোনো সন্দেহ লাগছে?

— লাগছে না ব’লেই তো মুশকিল, ম্যাম্। এই আইকার্ড নিয়ে এই মহিলা মিস্ রাখী রায় নামে হোটেল সারদায় উঠেছিলেন। ইনি কে?’

ব’লে তোতন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখায়। সেখানে চড়আ  মেকওভার করা রাখীদেবী একটা বিরাট প্যাকেট নিয়ে হোটেলে ঢুকছেন। চেনাই যাচ্ছে না।

— এটাই তো আপনার সেক্সডল যেটা হোটেলে রেখে এসেছেন? এই তো মিস্ রাখী রায়। আপনার ভোটার কার্ড নিয়ে, আপনারই নাম নিয়ে, শুধু ‘মিসেস’কে ‘মিস্’ ক’রে হোটেল সারদায় চেকইন করলেন। এই যে মহিলা, তিনি কে? এবার বলুন, ম্যাডাম। কী বলবেন?

শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে মহিলা বললেন, ‘ও, এই কথা? একটু দাঁড়ান।‘ ব’লে মহিলা তার ব্যাগ খুলে একটা থানায় করা ডায়রির রেজিস্ট্রেশন নম্বর তোতনকে দেখালেন আর বললেন,

— আমার ব্যাগশুদ্ধ ট্রেনে চুরি হয়ে যায় দিন সাত-আট আগে। থানায় ডায়রি করি। ব্যাগে ভোটার কার্ড আর আধার কার্ড ছিল। এই সিসি ক্যামেরার মহিলা তো আমি নই। মেকওভার ক’রে অন্য কেউ “আমি” হয়েছে।

তোতন সিরিয়াস হয়ে যায় আর দ্বিতীয়  সিসি ফুটেজ দ্যাখায়। বলে, ‘এটা কে ম্যাডাম? এবার তো ‘আপনি’ নিশ্চয়ই?’

ভিডিওতে রাখীদেবী হোটেল সারদা থেকে রাত এগারোটা-বারোটার সময় বেরিয়ে যাচ্ছেন। এই সময়টাই এসপি.’র মৃত্যুর সময়। আর এই ফুটেজের সাথে এই মিসেস রাখী রায়ের হুবহু মিল।

রাখীদেবী চুপ। সোজা তাকিয়ে থাকেন তোতনের দিকে।

তোতন বলে, ‘মেকওভার তুলে রিসেপশনকে দেখালেন, মিসেস রাখী রায় নন, ভিন্ন মহিলা বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই তো? কিন্তু এই  মেদিনীপুর থেকে বিষ্ণুপুরে সকলের অলক্ষ্যে কবে গেলেন আর কবেই বা ফিরে এলেন? হোটেল সারদায় অত রাত্তিরে কার কাছে গিয়েছিলেন, এসব বলতে পারেন?’

— এত প্রশ্ন কেন? আপনার কথাটা আপনি বলুন না।

তোতন চার্জ করে, ‘যেখানেই হত্যাকাণ্ড, সেখানেই আপনাকে পাওয়া যাচ্ছে কেন, ম্যাডাম? আপনি যদি বলেন, কোইন্সিডেন্স, তবে প্রশ্ন করবো, নিশ্চয়ই হোটেলে কারোর সাথে মীট করতে গিয়েছিলেন। আমি জানতে চাই, কার সাথে? কী তার নাম, কী তার হোয়ার এ্যাবাউটস। আপনি এর উত্তর দিতে পারবেন কি? সিটি কনফেকশনার্সে যে মালিক মৃদুল পোদ্দার খুন হয়েছে, সেখানেও আপনার এই হুলিয়ার উপস্থিতি। সিসি ক্যামেরা রেকর্ড দ্যাখাবো? হোটেলের সিসি ক্যামেরা আপনি কোনোভাবে নিষ্ক্রিয় করিয়েছেন, কিন্তু জানতে পারেননি, হোটেলের বাইরেই সরকারী দুটি সিসি ক্যামেরা আছে। আপনি জানতেন না, সিটি কনফেকশনার্সের বাইরেও একটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেখানেও আপনাকে একাধিক দিন ঢুকতে বেরোতে দ্যাখা গ্যাছে। অস্বীকার করার কোনো পথ আপনার নেই, মিসেস রায়। নাউ ইউ আর কট্।

কড়া ভাষায় মহিলা বললেন, ‘কোনো অপরাধ করতে দেখা গ্যাছে কি?’

— না, তা যায়নি। তবে সারকাম্সট্যানশিয়াল এভিডেন্স তো বলছে।  সাক্ষী দিচ্ছে।

এরপরে যা ঘটলো, তার জন্য তোতন একেবারেই তৈরী ছিল না। ওর পেছন দিকে একজন মহিলার উত্তেজিত কন্ঠ শুনলো ও,

— আবারো পুলিশ! এরা বাড়ি অবধি ধাওয়া করেছে…!

আর সঙ্গে সঙ্গে রাখী রায় “না না, মা।…” ব’লে তোতনের গায়ের ওপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তোতন ঘাড় ঘুরিয়ে যা দেখলো, তাতে ওর গায়ের রক্ত হিম হয়ে গ্যালো।

একটি মহিলা, সম্ভবতঃ রাখীদেবী’র মা, একটা আঁশবটি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তোতনের ওপর। রাখীদেবী ঝাঁপিয়ে না পড়লে হয়তো তোতনের গলা নেমে যেতো। আর এক ভদ্রলোক, মনে হয়, রাখীদেবী’র বাবা, জাপ্টে ধরেছেন মহিলাকে। কিন্তু ধ’রে রাখতে পারছেন না। উভয়েই বয়স্ক। কিন্তু মহিলা একেবারে এ্যাবনর্মালি ভায়োলেন্ট। তখনও চেঁচিয়ে চলেছেন,

— আমার জামাইকে খেয়েছে এই পুলিশ। আমার মেয়ের সংসার নষ্ট করেছে এই পুলিশ। এবার বাড়ি অবধি ধাওয়া করেছে! খুন ক’রে দেবো। সব শেষ ক’রে দেবো।

তোতন দেখলো, মহিলা এতটাই ভায়োলেন্ট যেন সত্যিই তোতনকে খুন ক’রে দেবেন। চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে, বিস্রস্ত কাপড়-চোপড়। তোতন বুঝলো, মহিলা আড়াল থেকে নিশ্চয়ই ওদের কথাবার্তা শুনেছেন আর তোতনকেই পুলিশের লোক ভেবেছেন।

তোতন চেঁচিয়ে বললো, ‘ওঁকে ধ’রে রাখুন। আর একটা চামচ আর জল রেডি রাখুন। উনি ফেন্ট হয়ে যাবেন। দাঁতে দাঁত লেগে যাবে।‘

তোতন যেটা শুনে অবাক হলো, রাখীদেবী মা’কে সমানে চেঁচিয়ে ব’লে চলেছেন,

— উনি পুলিশের লোক নন, মা। আমি ওঁকে চিনি। উনি একজন ডিটেক্টিভ। তুমি শান্ত হও, মা। শান্ত হও।

ভদ্রলোক মহিলাকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যান। আর তোতন ঘাড় ঘুরিয়ে আর একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখলো। রাখীদেবী যে মায়ের বটি’র কোপ হাত দিয়ে ধ’রে ফেলেছেন, তাতে তাঁর ডানহাতের তালু কেটে ফালা হয়ে গ্যাছে। দরদর ক’রে রক্ত গড়াচ্ছে। তোতন চেঁচিয়ে উঠলো,

— আপনি শক্ত ক’রে হাত চেপে ধরুন। আমি আসছি।

ব’লে ও লাফ্ দিয়ে উঠে টেবিলে যে, এমব্রয়ডারির কাজ করা সুতির কভারটা রয়েছে, তা চকিতে ছিঁড়ে ফালা করলো। আর লাফ্ দিয়ে বেরিয়ে গ্যালো।

ঢুকবার সময়ই ও দেখেছে, ঘরের সামনে একটুখানি উঠুনে তুলসী, টগর ইত্যাদি গাছ  পোঁতা। সেখানে দিব্যি ঘাস আর আগাছা জন্মেছে। সেখান থেকে এক গোছা দূর্বাঘাস ছিঁড়ে এনে হাতে ড’লে ড’লে রস বের ক’রে “এক্সকিউজ মি” ব’লে  রাখীদেবী’র হাতে চেপে ধরলো তোতন আর ছেঁড়া ক্লথ দিয়ে সজোরে ব্যাণ্ডেজ বাঁধলো রাখীদেবী’র হাতে।

মহিলা যেন একটুও যন্ত্রণা অনুভব করছিলেন না, এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন তোতনের দিকে। ব্যাণ্ডেজ বাঁধা শেষ হলে তোতন জানতে চাইলো, ‘বেসিন কোথায়?’

মহিলা হাত তুলে দ্যাখালেন। তোতন হাত ধুয়ে এসে বললো, ‘আমি কি একবার দেখবো, আপনার মায়ের কী হলো? যাবো ভেতরে?’

মহিলা চোখের ইঙ্গিতে ‘হ্যাঁ’ জানাতেই তোতন ভেতরে ঢুকে দেখলো, রাখীদেবী’র মা’কে বাবা একটা ইজিচেয়ারে শুইয়েছেন। চোখেমুখে জলের ঝাঁপটা দিচ্ছেন। তোতনকে দেখে বললেন,

— জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দাঁত লাগেনি। আসলে প্রদ্যূৎ চ’লে যাওয়ায় আর একমাত্র মেয়ের জীবনের এই পরিণামে ট্রমাটাইজড হয়ে আছেন। তাই এতটা ভায়োলেন্স। “পুলিশ” শব্দটা শুনতে পারে না। আপনি কিছু মনে করবেন না। আস্তে আস্তে সামলে যাবেন। প্রদ্যূতের মায়ের তো একটা হার্ট এ্যাটাকও হয়েছে খবরটা শুনে। বেঁচে আছেন, কিন্তু নির্বাক, অস্বাভাবিক। মানসিক চোটটা এরা কেউই নিতে পারেননি। তাদের একমাত্র সন্তান ছিল প্রদ্যুৎ।‘

তোতন বললো না, ও ঐ বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু ও বাড়ির এমন খবর ও জানতেই পারেনি। ভদ্রলোকটি উব্জে কিছুই বলেননি। আবার ড্রইংরুমে এসে বসে ও। রাখীদেবী তখনও চুপ ক’রে ব’সে আছেন।

তোতনই বললো, ‘বাইরে কোথাও বসা যায়? এ বাড়িতে নয়। আমার কিছু কথা তো আছে।‘

রাখীদেবী বললেন, ‘চা খাবেন?’

তোতন জানালো ‘না’।

তখন তোতনকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলেন মহিলা। বললেন, ‘ছাদে আসুন। বাইরে গেলেই নানা দৃষ্টি, নানা কথা, নানা কৈফিয়ত। ছাদে কেউ আসবে না।‘

ছাদে উঠতে উঠতে তোতন বললো, ‘আপনি কি আমাকে চেনেন?’

— কেন চিনবো না! নিউজপেপারের দৌলতে আপনাকে কে না চেনে! আর আই-কার্ড তো দেখালেন। আমি শুধু মায়ের এই আচরণের জন্য ক্ষমা চাইছি। মা স্বাভাবিক নেই। আসলে মায়ের তো মেয়ে-জামাই ছাড়া আর কোনো অবলম্বন ছিলো না। প্রদ্যুতের এমন মৃত্যু মা মেনে নিতে পারেনি। একটা ছোট সেরিব্রাল এ্যাটাকও মায়ের হয়েছে। আর আমার শাশুড়িমা তো হার্টএ্যাটাকে শয্যাশায়ী। কিন্তু আমাদের  বাড়ির খবর আপনি জানলেন কোথায়?

— আমি গরবেতা গিয়েছিলাম।

— ও মাই গড! আপনি ওখানেও গ্যাছেন! বেশ। বেশ করেছেন। এবার বলুন, আপনি কী করতে চান। আমাকে নিয়ে আপনার সন্দেহের বিষয়টা তাহলে ডিপার্টমেন্টে জানাচ্ছেন তো?

তোতন মাথা নীচু ক’রে বলে, ‘গোড়ায় এমন টার্গেট ছিল বটে, ম্যাম। কিন্তু এখানে আসার পর যা ঘটলো, তাতে আমি কনফিউজড এ্যাণ্ড পাজল্ড। আমি জানি না, আমার কী করা উচিত। তবে আপনার ছকটা কিন্তু ফুলপ্রুফ ছিল। কিন্তু এখানে যে পাকেচক্রে আমি এসে পড়বো, তা না জানতেন আপনি, না জানতাম আমি। বিষ্ণুপুরে ফ্যামিলি ট্যুরে এসে জড়িয়ে পড়লাম। ট্যুরও গ্যালো, আর আজ প্রাণটাও যেতে বসেছিল।

রাখীদেবী মাথা নীচু ক’রে বসেছিলেন। বিড়বিড় ক’রে বললেন, ‘এরা, এই এসপি. রাকেশ যাদব প্রদ্যুতের মতো একজন সৎ আর কর্মঠ অফিসারকে চক্রান্ত ক’রে আত্মহত্যা করালো, আর তার নীরিহ স্ত্রীকে, একটি নিষ্পাপ মহিলাকে হত্যাকারী বানিয়ে ছাড়লো। আমাকে এইজন্য একজন ড্রাগ পেডলার আর এসকর্টও সাজতে হলো। ও যে এই ড্রাগ কারবারিদের পেছনে লেগেছিলো, সেটা এই নেক্সাসের পাণ্ডা এসপি. বরদাস্ত করেনি।

— এই কাজে আপনার বিউটিশিয়ান কোর্স আর পার্লার মোক্ষম কাজ করলো। বলুন। প্রফেশনাল মেকআপ আর মেকওভার।

— আমাকে ওদের অস্ত্রেই ওদেরকে পানিশ করতে হলো।

— তাহলে আজ নিশ্চয়ই আপনি রিগ্রেট করছেন?

ক্রুদ্ধ রাখীদেবী বললেন, ‘নো। আই ডোন্ট। এটা আমার পারিবারিক দায়িত্ব ছিল। আমাকে হাতে খড়্গ নিতেই হতো। এইসব এলিমেন্টদের বেঁচে থাকার কোনো রাইট নেই। আমি যদি প্রদ্যুতের গোপন ডায়রিটা না পেতাম, বা ও যদি আদৌ ডায়রি না লিখতো, তবে আমাকে ভালো মেয়ের মতো  চোখের জল ফেলেই স্ত্রী’র কর্তব্যটুকু করতে হতো আর সারা জীবন ওকে সন্দেহ করতাম। আপনি ভাবতে পারেন, তার পারলৌকিক কাজ আমি নিজে হাতে করেছি, শতদলবাবু। মন্ত্র তো বলিনি। শুধু আমি ওঁর আত্মা’র কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এর জবাব আমি দেবো। আমি ভালো মেয়ে হয়ে ঘরে ব’সে থাকবো না। ঐ নোংরা ডিপার্টমেন্টের দেওয়া পেনশনের টাকায় ভাত খাবো না। তখন আমি জানতাম না, এত বড় শক্তির সাথে কীভাবে যুদ্ধে নামবো। কিন্তু প্রতি রাতে প্রদ্যুতের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কমিট করেছি, আমি পারবো‌। আমাকে পারতেই হবে। আমি রিটালিয়েট করবো। ভয়ংকর রিটালিয়েশন।

— কিন্তু এতসব কাজ তো আপনি একা করতে পারেননি নিশ্চয়ই! আপনাকে কেউ বা কারা ব্যাকআপ তো দিয়েছে। তারা কারা?

মুচকি হেসে রাখীদেবী জানায়, ‘আপনি আমাকে গিলোটিনে তুললেও তাদের নাম জানতে পারবেন না। তাদের নাম অন্ধকারেই থাকবে, মিঃ চ্যাটার্জ্জী।‘

তোতন এবারে বলে, ‘ওকে। এবার, ম্যাডাম, এক কাপ চা খাবো।‘

— দাঁড়ান। চা ফ্লাস্কে করাই আছে। আনছি।

মহিলা পেছন ঘুরতেই তোতন ব’লে উঠলো,

— দেখবেন, ফিফথ হোমিসাইড ঘটাবেন না আবার।

— ফিফথ?

— প্রদ্যুৎবাবুর মৃত্যু তো একটা প্ল্যাণ্ড মার্ডার ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই নাটকের ফার্স্ট মার্ডার। আসলে আমি মনে করি, প্রায় প্রতিটা সুইসাইড এক একটা মার্ডার। তার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কেউ না কেউ থাকে, ম্যাম। আজকে আমি তো আপনার মায়ের হাতে একেবারে মার্ডার থেকে বেঁচেছি। আবার আপনার হাতে… যদি…

এই প্রথম রাখীদেবী ঝরঝর ক’রে কেঁদে ফ্যালেন। হাউমাউ ক’রে বলেন, আজ এমটাও আমাকে শুনতে হচ্ছে! যন্ত্রণাটা বোঝেন? এদের লোভ, এদের অসততা কীভাবে আমার জীবনটা, আমাদের দু’দুটো পরিবারের জীবন শেষ ক’রে দিলো!’

তোতন রাখীদেবী’র মাথায় হাত রেখে বলে, ‘মে আই কল ইউ সিস্টার, ম্যাম। আই হ্যাভ নান। উড ইউ পারমিট?’

চোখটোখ মুছে রাখীদেবী বললেন, ‘একজন খুনী আসামীকে “সিস্টার”!’

— আই এ্যাম প্রাউড অফ্ ইউ, সিস্টার। নারীশক্তি কী করতে পারে, তা আপনি দেখিয়ে দিলেন। নারীকে রাণী হয়ে উঠতে হবে, সিস্টার। নয়তো তাদের মুক্তি নেই। ইউ হ্যাভ ডান দ্যাট এ কোর্ট ক্যানট।

— বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি।

Pages ( 16 of 18 ): « এর আগে1 ... 1415 16 1718তারপর »

About Post Author

9F10 DA

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post বিষ্ণুপুরে হত্যাকাণ্ড | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় | Bengali Murder Mystery Story | 9F10
Next post বেকারত্ব জীবন | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | করিমুল ইসলাম | Bengali Social Story | 9F10