Getting your Trinity Audio player ready...
|
মহিলা নীচে গেলেন আর চা নিয়ে এসে তোতনকে দিয়ে বললেন, ‘এতে ড্রাগ নেই। খেতে পারেন।‘
চা খেতে খেতে তোতন বললো, ‘আমি তো গোয়েন্দা। সব উত্তর না পেলে তো আমাদের শান্তি নেই, সিস্টার। আমাকে শুধু জানান, সুবোধ পাণ্ডেকে পানিশ করলেন কী ক’রে। সে-ই তো আপনার হিটলিস্টের ফার্স্ট।‘
— সকলকেই পেছন থেকে জাপ্টে ধ’রে হেরোইন নাকেমুখে ঠেসে ওভারডোজ করিয়েছি। আমার গায়ে মা কালীর শক্তি ভর করেছিল। আসলে এই সুবোধ, কনস্টেবল সুবোধ পাণ্ডে ইলেক্ট্রিকের কাজ জানে।
— আমি ওগুলো জানি। আমাকে পুলিশ ডিপার্টমেন্টই এ্যাপয়েন্ট করেছে। বলুন।
— এই সুবোধ আমার ঘরে ইলেক্ট্রিকের কাজে আসে। আর তখনই আমার ঘরে ড্রাগ প্ল্যান্ট করে এসপি’র আদেশে। আমরা ওকে ভালোবাসতাম। প্রদ্যুৎ ওদের অনেককে অনেক সময় অনেক সাহায্যও করেছে। ও সব ভুলে গ্যালো। আমাদের সর্বনাশ করতে একটু কাঁপলো না! আমাকে তো অন্ততঃ ব’লে দিয়ে যেতে পারতো, এসপি.কে তো ভুলভাল ব’লে বোঝাতে পারতো। করেনি। তাই ওকে মরতে হতোই।
রাখীদেবী এইটুকু ব’লেই হাঁফাতে থাকেন। আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘সরি। আই গট ইমোশনাল।‘ নিজেকে আবার সামলে নিয়ে তারপর বলেন, ‘আসলে এসপি.র সাথে ড্রাগ মাফিয়াদের লেনদেন ছিল। প্রদ্যুৎ ডিপার্টমেন্টে নতুন। এতটা ও জানতো না। এ্যাগ্রেসিভলি ও ড্রাগ ডিলারদের পেছনে ধাওয়া শুরু করলো। রেইডের পর রেইড করেছে। ফলতঃ মাফিয়ারা এসপি.’র ওপর চাপ সৃষ্টি করলো। এসব প্রদ্যুৎ জেনেছে একেবারে শেষের দিকে যখন আর ও সময় পায়নি সাবধান হওয়ার। আমি ওর ডায়রি পাই ও চ’লে যাওয়ার পর। ডিপার্টমেন্টের কথা ও আমাকে শেয়ার করতো না। এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কথা সিভিলিয়ানদের না বলাই দস্তুর। হঠাৎই আমাদের কোয়াটার্সে রেইড হলো। ব্যস্। সব শেষ। আমি বারবার তদন্তের জন্য তদ্বির করেছি, লেখালেখি করেছি ওপর মহলে। কিন্তু ওরা কেস ক্লোজ ক’রে দ্যায়। প্রদ্যুৎ সুইসাইড ক’রে নাকি ওর অপরাধ কনফেস ক’রে দিলো! প্রদ্যুৎ এই অপমান নিতে পারেনি আর তাই ডিপার্টমেন্ট ওকে এ্যারেস্টও করতে পারেনি। প্রদ্যুৎ হ্যাঙ্গ ক’রে গ্যালো। এত দ্রুত সব ঘ’টে গ্যালো…!’
তোতন বললো, ‘আপনি একটু সামলে নিন, সিস্টার। আমি ততক্ষনে একটা সিগারেট খেয়ে নিই।‘
আমি জানি, তোতন বরাবর একটু উত্তেজনা হলেই সিগারেট টানে। সাধারণতঃ ও স্মোক করে না। নিজেকে কন্ট্রোল করবার এটা ওর পদ্ধতি।
ছাদের আলসের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে আড়চোখে তোতন দেখে নিলো, রাখীদেবী চোখ মুছে নিজেকে প্রস্তুত করছেন। তোতন আবার এসে পাশে বসলো। বললো,
— আমি কি আপনার ওপর প্রেশার দিচ্ছি?
রাখীদেবী জানালো, ‘না। নো প্রেশার। কাউকে তো বলতে হবে। আমি তো পেশাদার নই। আমার বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই এসব জানে না। একা হাতে এতসব করেছি। হালকা হতে হবে তো।‘
— আমি যদি সব রেকর্ড করি? যদি এই রেকর্ড আপনার কনফেশন হিসেবে কোর্টে প্রডিউস করি?
— আমার আর কিছুতেই কিছু আসে-যায় না। একজন সাধারণ মহিলা হয়ে তিনটে মানুষকে নিজ হাতে মেরেছি। ভাবতে পারেন, আমার ওপর দিয়ে কী ঝড় গিয়েছে! এখন আমার কমিটমেন্ট শেষ। এবার ফাঁসিতেও আমার কিছু আসে যায় না। আমার বেঁচে থেকে আর কী হবে! কী নিয়ে বাঁচবো!
— ছি ছি! আপনাকে এতটা সেলফিশ ভাবিনি আমি।
— সেলফিশ!
— সেলফিশ নন? প্রদ্যুৎবাবু কি একাই আপনার জীবনে সব? আর এই বুড়োবুড়ি? ঐ বাড়ির বুড়োবুড়ি? এরা কি আপনার জীবনে কেউ নন? এঁদের কোনো অবদান নেই আপনার জীবনে!
তোতনের দিকে রাখীদেবী অবাক চোখে তাকান আর বলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক। ঠিকই বলেছেন। সত্যিই আমি ভুল করছিলাম। ভুল ভাবছিলাম। থ্যাঙ্ক ইউ। আমার অন্ধ হয়ে যাওয়া চোখ আপনি খুলে দিলেন। অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে। আমাকে তো বাঁচতে হবেই।
তোতন খেই ধরালো, ‘অবশ্য এর জন্যে আমাকে মারার দরকার নেই। আমি তো “সিস্টার” ডেকেছি। এবার বলুন। তারপর? এই ড্রাগ আপনার ঘরে প্ল্যান্ট হলো কী ক’রে?’
— সুবোধ ইলেক্ট্রিকের কাজ করতে এসে আমার চোখ এড়িয়ে এটা ঘটিয়েছে, এমন সন্দেহ আমার মনে দানা বাঁধছিল। নিশ্চয়ই এসপি.র আদেশ ও-ই পালন করেছে। আমার দোতলায় সুবোধ ছাড়া আর কেউ ওঠেনি। ওঠে না। আমি কণফার্মড হচ্ছিলাম। তাই যে কাজ করতে এসে সুবোধ আমাদের সর্বনাশ করেছে, সেই ফাঁদেই ওকে ফেললাম। ইলেকট্রিকের কাজের জন্য আবার ডেকে পাঠালাম। ও-ও ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হচ্ছিলো। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গ্যাছে। ওর প্রায়শ্চিত্য করার আর পথ নেই।
ও ঢুকতেই আমি দরজা লক্ ক’রে দিলাম। তারপর ওকে ধরলাম,
“সুবোধ, তুমি আমার এই সর্বনাশ কেন করলে?” ও স্বীকার করছিল না। আকাশ থেকে পড়ছিল আমার কথা শুনে। এবার আমি নিজমূর্তি ধরলাম। দরজার চাবি ব্লাউজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। বললাম, “সত্য স্বীকার করো, সুবোধ। এ কাজ তোমার। তুমি কোথা থেকে ড্রাগ এনেছো, কে তোমাকে আমার ঘরে প্ল্যান্ট করতে বলেছে, কেন ডিএসপি. সাহেবের এমন সর্বনাশ করতে বলেছে।“
ও চোখ উল্টিয়ে অস্বীকার করছিল। আমাকে এসপি.র ভয় দেখাচ্ছিল। আমার ঘরের জানলা-দরজা আমি আগেই বন্ধ ক’রে দিয়েছিলাম। এবার কিচেনে গিয়ে আমি গ্যাস সিলিন্ডার ওপেন ক’রে দিলাম। ও শব্দ শুনছিলো যে, গ্যাস বেরোচ্ছে। ও চিৎকার করলো, “ম্যাডাম, কী করছেন!”
আমি হাতে দেশলাই নিলাম। বললাম, “তুমি স্বীকার না করলে আমি দেশলাই জ্বালবো। আমার জীবন তুমি কার কথায় এভাবে শেষ ক’রে দিলে? আজ আমার বাঁচার সাধ নেই। তোমাকেও মরতে হবে। আর যদি আমার ওপর জোর খাটাও, তবে চেঁচাবো, তুমি আমায় একা পেয়ে আমার সর্বনাশ করতে চেয়েছো। তোমাকে আমি ছাড়বো না। যদি সত্যকথা বলো, তবে তোমাকে ছেড়ে দেবো।“
আসলে আমি আরও নিশ্চিত হতে চাইছিলাম, সত্যি আমি যা ভেবেছি, তা সঠিক কিনা। ও আমার হাত-পা ধরছিলো। বুঝেছিলো, ও ফাঁদে পা দিয়েছে। ও বলছিলো,
“ম্যাডাম, আমার বৌ-বাচ্চা আছে। আমার এই সব্বোনাশ করবেন না। ওরা ম’রে যাবে। আমি গরিব মানুষ।“
আমি তখন ফিউরিয়াস। পরিণাম নিয়ে ভাবার মানসিকতা নেই আমার। প্রদ্যুতের মৃত্যু থেকে আমার কাছে বড় হয়ে উঠেছিল ওর নামে স্ক্যাণ্ডাল, কাগজে খবর, আমার বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, আমার বেইজ্জৎ… এই সমস্ত। অবশেষে এসপি.র নাম, সিটি কনফেকশনার্সের নাম, ওদের ড্রাগ ডিলারশিপ, চোরা কারবার… সব একে একে কনফেস করে সুবোধ। আমি ওকে বলি, “তোমায় ছেড়ে দেবো আমি। তুমি হুকুমের গোলাম। দোষ তো তোমার নয়, সুবোধ। কিন্তু এসপি.কে তো মরতে হবে। সে আমার ঘর পুড়িয়েছে।“
ও ভেবেছিল, ওকে ছেড়েই দেবো। তাই সব বলেছিল আমাকে। আমি মোবাইলে রেকর্ড করেছিলাম। আর তারপর ওকে চা খেতে দিয়ে পেছন থেকে চেপে ধ’রে হেরোইন ঠেসে ধরলাম নাকে। যতই ও বাঁচার চেষ্টা করছিল, ততই ড্রাগ ওর নাক-মুখ দিয়ে শরীরে ঢুকছিল। তারপর রাত হতে ওর বডি একটা পুকুরে ফেলে দিলাম। এই একইভাবে সবগুলোকে মেরেছি। এসপি.কে মারতে আমায় এসকর্ট অবধি সাজতে হয়েছে, নীচে নামতে হয়েছে। আর এই এত হেরোইন কিনতে আমাকে প্রায় সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে। এবার আপনার যা করবার করুন। আমি সবকিছুর জন্য রেডি।‘
— আমার আর কাজ কি! হোটেলে ফিরবো। খেয়েদেয়ে ঘুম দেবো। লম্বা ঘুম। আগামীকাল আমাদের ফেরার দিন। ফিরে যাবো আর ভুলে যাবো সব। আমরা বিষ্ণুপুর ঘুরতে এসেছিলাম। আর তাতেই এই ঘটনায় জড়িয়ে গেলাম। ভালো হয়েছে। এই সুযোগে আপনার মতো একজন বীরাঙ্গনার দ্যাখা পেলাম।
— ভুলে যাবেন? আমাকেও?
— অসম্ভব। আপনাকে ভোলা যায়! সিস্টার ডেকেছি যে। আমার জীবনে এই ইনভেস্টিগেশন একটা মাইলস্টোন, সিস্টার। এই তদন্ত কাহিনী আমার গুরু লিখবেন, প্রকাশও পাবে। কিন্তু নাম বদলে দিতে বলবো। আপনার নাম হবে “রাখী রায়”। আপনার হাজব্যাণ্ডের নাম হবে “প্রদ্যুৎ”। প্রদ্যুৎ রায়। পদবীও চেঞ্জ। কেউ জানবে না। আজকে তাহলে বিদায় নিচ্ছি। আর কারোর সাথে, মানে আপনার বাবা’র সাথে দেখা করছি না। সোজা বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা আমার ভাড়া করা গাড়ি, আর স্টেশন।
———-