(৮)
হোটেলে ফিরতেই জ্যেঠিমা তোতনকে ধমকে একসা করেছেন। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরেছে, খেয়েছে কিনা নানা অভিযোগ। আর রাতে মালিনী ধরেছে ওকে।
— কী হলো সারাদিন? আমাকে বলো। কাল তো ফিরতে হবে। কেস সল্ভ হলো?
— ফিরতে হবে, ফিরবো। এ বছর তো পারলাম না মাকে খুশি করতে। সামনের বছর আবার আসবো। মা তাতে খুশিই হবে।
— কিন্তু তোমার তদন্ত?
তোতন ফিক ক’রে হেসে জানালো, ‘হয়ে গ্যাছে।‘
— আসামী ধ’রে ফেলেছো?
— আসামী এই কেসে আগেই ধরা পড়েছে আর শাস্তিও পেয়েছে।
— আগে মানে? তোমারও আগে!
— আমারও আগে।
— তাহলে তুমি কী ক’রে বেড়াচ্ছিলে?
— আমি? যে শাস্তি দিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করছিলাম।
— এর জন্যে তোমায় পয়সা দিয়েছে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট!
— কখনও কখনও তা-ও দ্যায়। তোতন মালিনী’র মন জানবার জন্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আমায় একটা কথা বলো তো। মনে করো, কেউ আমাকে ষড়যন্ত্র ক’রে মেরে ফেললো।‘
— কেন! খামোকা তোমাকে মারতে যাবে কেন? তুমি কার পাকা ধানে মই দিয়েছো!
— দিয়েছি না? এই যে এত আসামীকে ধ’রে দিয়েছি, তাদের কিন্তু ফাঁসি-টাসি হয়নি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হয়নি। তারা তো আমার ওপর রেগে আছে, না! যদি তারা কেউ আমাকে মেরে দ্যায়, তুমি কী করবে? কান্নাকাটি করবে তো?
ভয়ংকর রেগে যায় মালিনী। ক্ষেপে গিয়ে বলে, ‘আর কোনোদিন এসব কথা মুখেও আনবে না। ব’লে দিলাম। এইসব তামাশা আমার ভালো লাগে না। আমি কিন্তু মায়ের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়বো।
— নো, আই এ্যাম সিরিয়াস। আমি সিরিয়াসলি জানতে চাইছি।
উত্তেজিত হয়ে যায় মালিনী। বলে, ‘ভুলে যেও না, আমি তোমার মা নই। সার্কাসের রিং থেকে আমায় নিয়ে এসেছো। কাঁদবো কিনা পরে ভাববো। আগে তাকে এমন মৃত্যু দেবো যে, ডিপার্টমেন্ট অবধি দেখে কেঁপে উঠবে।‘
তোতন আনন্দের হাসি হাসে। হাসতে হাসতেই বলে, ‘সাবাশ মেরি সার্কাসিনী। এখানে তেমনটাই ঘটেছে। আসামীকে ভয়ংকর মৃত্যু দিয়েছে আর এক সার্কাস লেডি।‘
— আমাকে গল্পটা বলো। তুমি সব ইনভেস্টিগেশনের গল্প তো বলো বাড়িতে।
— নো। নো বায়না। এখন এই গল্প নয়। সময় হয়নি। পরে বেশ জমিয়ে বোলবো। আগে বাড়ি ফিরি।
— তাহলে কাল বাড়ি ফিরছি তো?
— কেন! একটু ঘোরো, আনন্দ করো।
— আমাদের তো কালকের টিকিট কাটা!
— ক্যানসেল করবো। কেন, বেড়াতে ভালো লাগছে না?
— তুমি নেই। তুমি ছুটে বেড়াচ্ছো। আনন্দ হয়! আর আমার বাড়ি ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না।
— আর মা?
— মা তো ভক্তিরসে ভাসছে। যাবে, নাকি এখানেই থেকে যাবে, ঠিক নেই।
কথা বলতে বলতেই ইন্সপেক্টর পরিক্ষিৎ’এর ফোন ঢুকলো,
— আপনি কোথায়?
তোতন রসিকতা করে, ‘কেন, এত রাতে কোথায় থাকা উচিত? বেডরুম। হোটেলে। নিজের রুমে।‘
— থ্যাঙ্ক গড! আমি তো ফোনে আপনাকে পাচ্ছিই না। শুধু নেটওয়ার্কের বাইরে, বলছে।
তোতন ব’লে ওঠে, ‘এবার আপনি তো আমার নেটওয়ার্কের মধ্যে এসে গ্যাছেন। আর চিন্তা কি?
ইন্সপেক্টর যেন একটু কেঁপে গ্যালো। বললো, ‘নেটওয়ার্কের মধ্যে… মানে! বুঝলাম না।‘
— বাঃ! এই তো বললেন, আমি নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম। তাই তো বললাম।
ভীত ইন্সপেক্টর থমকে গিয়ে বললেন, ‘এমন সব রহস্য করেন যে, মাথা ঝনঝন করে। কাল সকালে মীট করছি।‘
— ওক্কে। কাল কিন্তু আমরা ফিরে যাবো। সেই বুঝে সকাল সকাল আসবেন।
— একটা দিন আমাকে দেবেন না! একটু বন্ধুভাবে চড়ুইভাতি করতাম। একটু খাওয়া দাওয়া।
তোতন স্ট্রেট জানালো, ‘নো চান্স। আমার মিসেস আর একটা দিন বিষ্ণুপুরে থাকতে রাজি নয়। ওঁ বলছেন, এটা হত্যাপুরী বিষ্ণুপুর। গুড নাইট।
— গুড নাইট। কাল সকালেই মীট করছি।
সকালেই এসে হাজির আইসি. পরিক্ষিৎ দত্ত। তখনও ৭টা বাজেনি। সবে এক কাপ কফি নিয়ে তোতন বসেছে ব্যালকনিতে। একটা মোটরসাইকেলের শব্দ পেয়ে তোতন ঝুঁকে দ্যাখে, পরিক্ষিৎ দত্ত উপস্থিত। রিসেপশনে আরও এক কাপ কফির অর্ডার ক’রে দরজা খুলে দ্যায়। মা আর মালিনী তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। তোতন ওর ব্যায়াম সেরে আয়েশ করতে বসেছে। বরাবর ওর ঘুম কম। ওর মাথার মধ্যে তো সর্বক্ষণ চিন্তার চাকা ঘুরছে। ঘুমোবে কী! শান্তিতে চোখটাও বোজে না।
পরিক্ষিৎকে নিয়ে ব্যালকনিতে বসতে বসতেই কফি হাজির। ইন্সপেক্টরকে কফি খেতে দিয়ে যে টাকার এনভেলপটা পরিক্ষিৎ দত্তকে থ্রু ক’রে ডিপার্টমেন্ট পাঠিয়েছিলো, সেটা তাঁকে আগে ফেরৎ দিলো।
বিস্মিত ইন্সপেক্টর বললেন, ‘এ কি! আপনি কি ফেইল করলেন?’
— আমার কাজে আমি সাসেক্স। কিন্তু ডিপার্টমেন্টের কাজটা আমি পারলাম না।
— এ কী রকম হেঁয়ালি, মিঃ চ্যাটার্জ্জী! আপনার এ্যাডভান্স ফেরৎ দিচ্ছেন। আবার বলছেন, আপনি সাক্সেস কিন্তু ডিপার্টমেন্টের কাজ পারলেন না। আমি তো কিছুই বুঝছি না। রহস্য ভেদ করতে গিয়ে রহস্য বানিয়ে দিচ্ছেন!
— এ্যাকচুয়ালি আমি যে সত্য খুঁজছিলাম, তা পেয়ে গেছি। এটা ডিপার্টমেন্ট চাইছে না। আপনারা যা চাইছেন, সেটা আমি চাইছি না। তাই টাকা ফেরৎ।
— সত্য পেয়ে গ্যাছেন! তাহলে আলোকপাত করুন। শুনি তো। আমার তো কিউরিওসিটিতে মাথা ফেটে যাচ্ছে। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। আপনাকে ফোনে পাচ্ছি না। দ্যাখাও পাচ্ছি না। ম্যাডাম কখন হোটেলে থাকছেন, কখন থাকছেন না, বুঝতেই পারছি না। আমার অবস্থাটা বুঝুন।
তোতন কফি শেষ ক’রে কাপটা নামিয়ে রেখে বললো, ‘মিঃ দত্ত, আমাকে বলুন তো। কখনো বেড়াল মেরেছেন?’
— বেড়াল! সে হয়তো ছোটবেলায় ঢিলটা পাটকেলটা ছুঁড়েছি। মনে তো নেই।
— না, ওভাবে নয়। বেড়ালকে ঘরে বন্দী ক’রে মেরেছেন কখনো?
— না না। তেমন ক’রে না। কেন, বলুন তো?
— এক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। এমন অবস্থায় বেড়াল যদি বোঝে, তার পালাবার পথ নেই। তখন বুঝবেন, কেন ওকে “বাঘের মাসি” বলে।
— কেন বলে?
সে বাঘেরই কপি, মিঃ দত্ত। তাকে ঘরে বন্দী ক’রে পেটালে সে একসময় সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে আপনার ওপর। হয়তো আপনার মৃত্যুও হতে পারে। আপনি হয়তো বাঁচার জন্য দরজা খুলে বের হলেন আর বন্দী বেড়াল পালিয়ে গ্যালো। কোনো প্রমাণ রইলো না, আপনি কার হাতে খুন হলেন। ব্যস্। প্রমাণ ভ্যানিশ, খুনী ভ্যানিশ। প’ড়ে রইলো শুধু পারিপার্শ্বিক প্রমাণ। সারকাম্সট্যানশিয়াল এভিডেন্স। তাতে তো আর ঐ বেড়ালটিকে শাস্তি দেওয়া যাবে না! এবারে বাঘে মারলো, নাকি বাঘরোল! হুলো মারলো, নাকি মেনি… কিছুই জানতে পারবেন না। শুধু “তুই বেড়াল, না মুই বেড়াল” চলবে।
বিস্মিত ইন্সপেক্টর বলেন, ‘রিয়েলি! বেড়াল এত হিংস্র হতে পারে!’
— পারে, মিঃ দত্ত। পারে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নিতান্ত শান্তশিষ্টও ভয়ংকর হতে পারে।
— কিন্তু এর সাথে এই এসপি. হত্যা রহস্যের কী সম্পর্ক!
— বাকিটা আপনাকে বুঝে নিতে হবে। ভাবুন। জেনারেল ভাবনা ছেড়ে অন্যভাবে ভাবুন। সেটাই অভ্যেস করুন। তা নয়তো সবকিছু দেখতে পাবেন না। আর হ্যাঁ, এই কেসে আপনি আর ঢুকবেন না। ওকে? টাকাটা মনে ক’রে রিটার্ন করবেন।
— তা এতে আপনার নিন্দা হবে না? আপনার তো ক্ষতি হয়ে যাবে।
তোতন অট্টহাসি হাসে আর বলে, ‘ক্ষতি লাভ… এসব দিয়ে কি জীবন চলে, ইন্সপেক্টর! জীবন কি কোনো জীবিকা? ওকে? এবার গুডবাই। আমাদেরকে বেরোতে হবে। ফিরতে হবে। ঘরে ফিরতে হবে। সকলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। ভালো থাকবেন।‘
ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যেতেই তোতন আমাকে ফোন করলো,
— গুরুদেব, এবার ট্রেন ধরবো। বাড়ি ফিরছি। এখন সময় নেই। একেবারে ঘরে ঢুকে আপডেট দেবো। তবে এ কাহিনী হয় লিখবে না, নতুবা সমস্ত নাম, ডেজিগনেশন, স্থান বদলে দিতে হবে।
ততক্ষণে হতভম্ব ইন্সপেক্টর পরিক্ষিৎ দত্ত চুপচাপ হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যান। অবশেষে তাঁর বুলেট গর্জন ক’রে ওঠে।
বিষয় মৌলিকত্ব | |
ভাষা সাবলীলতা | |
কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা প্রবাহ | |
শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ | |
অডিও/ভিডিও রূপান্তর যোগ্য | |
Average
|
|
![]() |