মিহির কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করল,
” আর সেই জন্য তৃষাণকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে ওকে ডাইমিথাইলমার্কুরি নামক পয়জন খাইয়ে দিতে, তাইতো? “
এই কথার উত্তরে সৌমিলি তার গলার স্বর একটু বাড়িয়ে বলল,
” না… , না। এরকম কোনো পয়জন আমি ওকে দিতাম না। বিশ্বাস করুন।”
তার কথায় চমকে গিয়ে মিহির বলল,
” ওটা তুমি দিতে না?”
সৌমিলি বলল,
” একজন…… একজন মৃত্যু পথযাত্রী জীবনের শেষ লগ্নে এসে মিথ্যা কথা কেনো বলবে বলতে পারেন? আমরা দুজন ঠিক করেছিলাম দূরে কোথাও পালিয়ে যাবো। সবকিছু আরও পাকাপোক্তভাবে ব্যবস্থা করার জন্য গগন ওখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে এখানে এসেছিল। ও.. , ও জানতো ব্যাপারটা সহজ হবে না। তাই , তাই ও আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল। তৃষাণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল।
একদিন সন্ধাবেলায় মা মন্দিরে গিয়েছিলেন, তৃষাণ অফিসে ছিল, বাড়িতে আমি একা ছিলাম। এমন সময় ও এসে বলল, বলল তৃষাণকে মারতে হবে। “
মিহির বলল,
” আর তুমিও রাজি হয়ে গেলে? “
সৌমিলি বলল,
” না…… । বিশ্বাস করুন আমি….. আমি প্রথমে রাজি হয়নি। আমি ওকে মারতে চাইনি। কিন্তু ও আমাকে বলেছিল এটা না করলে ও আত্মহত্যা করবে। বিশ্বাস করুন আমি, আমি ওকে হারাতে চাইনি। তাই বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছিলাম। ও আমাকে একটা শিশি দেয়। বলল ওতে আর্সেনিক আছে। রোজ কিছুর সাথে মিশিয়ে খাইয়ে দিতে বলেছিল, একেবারে অল্প অল্প করে। আমি ওকে রোজ খাওয়াতাম না ওটা। মাঝে মাঝে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দিতাম।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরেও তৃষাণ মরছে না দেখে ও আমাকে হুমকি দেখাতো তৃষাণের মাকে খুন করার। এইসব ঘটনার মধ্যেই একদিন আমি জানতে পারি আমি তৃষাণের সন্তানের মা হতে চলেছি। বিশ্বাস করুন মিহির দা আমি…… আমি এটা শোনার পর সত্যিই আর একদিনও তৃষাণকে ওটা দিইনি। আমি ওকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। একটা… , একটা নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু , কিন্তু ততদিনে সবকিছু হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। আমি তার আগে অনেকদিন তৃষাণকে ওটা দুধে মিশিয়ে খাইয়ে ফেলেছিলাম। আর একদিন তৃষাণ সত্যিই মারা গেল। আমি… , আমি নিজের হাতে প্রেমের মোহ কাটাতে না পেরে তৃষাণকে খুন করে ফেল্লাম। খুন করে ফেল্লাম।”
বলেই সে হাউহাউ করে কান্নায় ফেটে পড়ল।
মিহিরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লেডি অফিসারটি সবকিছু শুনে বলল ,
” নিজের প্রেমিক কে বাঁচাতে গিয়ে তুমি তাকেই মেরে ফেললে যার সন্তান তোমার গর্ভে। একটা জীবন শেষ করে ফেললে। ছিঃ…..! নরকেও তোমার ঠাঁই হবে কিনা সন্দেহ। “
সৌমিলি তখনও কেঁদে চলেছে জীবনের শেষ কান্না কাঁদছে সে। মিহির তাকে জিজ্ঞাসা করল,
” তাহলে…. , তৃষাণকে মেরেই যখন ফেলেছিলে তখন আবার গগনকে মারতে গেলে কেনো?”
সৌমিলি আস্তে আস্তে চোখের জল মুছে বলল,
” আমি ভেবেছিলাম তৃষাণ মরে গেলেও , ওর সন্তানকে আমরা মানুষ করব। গগনকে সেই কথা আমি জানিয়েওছিলাম। কিন্তু , ও কোনোভাবেই তৃষাণের সন্তানকে মানুষ করতে চায়নি। ও আমাকে বলেছিল তৃষাণের সন্তানকে গর্ভেই মেরে ফেলতে। ও আরও বলেছিল যে আমাদের শুধু শারীরিক সম্পর্ক থাকবে কোনোরকম বিয়ে বা সন্তান হবে না। আমি সেদিন বুঝেছিলাম ওর আসল রুপ চিনেছিলাম। ও যে কতো বড়ো একটা বিকৃত মনের মানুষ, একটা জানোয়ার… , তার প্রমাণ সেদিন পেয়েছিলাম। ও আসলেই যে আমার শরীরটাকেই ভালোবেসেছিল। “
মিহির জিজ্ঞাসা করল,
” তারপর?”
সৌমিলি বলল,
” তারপর সেই ভয়ানক সন্ধে। সেদিন দুপুরে সঙ্গে ওর আমার অনেক কথা কাটাকাটি হয়। আমি ভেবেছিলাম আর সম্পর্ক রাখবো না। সেদিন সন্ধ্যায় আমি আমার ঘরেই ছিলাম। মা রান্নাঘরে ছিল। ও হঠাৎ সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা আমার ঘরে চলে আসে। ও…র, ওর ওইরকম ভয়ানক রুপ আমি আগে কখনও দেখিনি। যেন একটা উন্মাদ পিশাচ।”
এরপরের ঘটনাটা বলতে গিয়ে সৌমিলি হঠাৎ থেমে গেল। তার চোখ আবার অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। মিহিরের পাশে থাকা লেডি অফিসারটি তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে যাবে এমন সময় মিহির বাঁধা দিয়ে বলল,
” ডোন্ট ডু দিস।”
তারপর মিহির সৌমিলির উদ্দেশ্যে বলল,
” পরের ঘটনাটা? “
সৌমিলি ধীরকন্ঠে বলল,
” পরের ঘটনাটা যেকোনো মেয়ের জীবনে পাওয়া সবথেকে নির্মম শাস্তি। ও আমার দিকে এগিয়ে এসে দরজার পাসে থাকা খিলটা দিয়ে আমার পেটে সজোরে আঘাত করে। আমি যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে মেঝের ওপর কাতরাতে থাকি। তারপরেই ও ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পর আমি রান্নাঘর থেকে শুনতে পাই মায়ের তীব্র চিৎকার। সেই চিৎকার এখনও আমার কানে ভাসে। আমি মেঝে থেকে উঠে কোনোরকমে দেওয়াল ধরে রান্নঘরে গিয়ে দেখি,
দেখি ও মায়ের বুকের অংশটা চিরে দিয়েছে। একটা পা অর্ধেক কাটা। সে কী ভয়ানক দৃশ্য। আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরেই ও হিংস্র জন্তুর মতো আমার দিকে ফিরে.. , ওই হাতে থাকা ছুঁড়িটা সজোরে আমার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। আমি , যন্ত্রনায় আমি তীব্র চিৎকার করে ওকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে পরে যাই। ততক্ষণে আমার সমগ্ৰ শরীর যন্ত্রনায় ছিঁড়ে খাচ্ছিল। আমার দুটো পা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন দেখতে পাই আমার পাশে থাকা বঁটিটা। রাগে, ক্ষোভে ঘৃণায় আমি ওই বঁটিটা তুলে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর গলায় এক কোপ দিই। আর তারপর হাতে। তারপর আর একটা ছুঁড়ি নিয়ে ওর পেটে ঢুকিয়ে দিই। দেখি ওর, ওর মাথাটা মাটিতে পড়ে আছে আর শরীরটা তার পরমূহুর্তেই মাটিতে পরে গেল।
তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। “
মিহির এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসার সমস্ত কিছু শুনে তাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না। লেডি অফিসারটি তাকে বলল,
” যে প্রেমকে সাথে নিয়ে বাঁচার জন্য এতকিছু করলে, সেই প্রেমই তোমাকে মারলো।”
সৌমিলি আর কথা বলতে না পারলেও জড়ানো জড়ানো ভাষায় বলল,
” আমি , আমি নিজেই নিজেকে মেরেছি…। মিহির দা………… , পারলে আ…. আ…. আমা….. আমাকে ক্ষ ক্ষমা করবেন। “
এই বলে সে দুটো হাত ধীরে ধীরে তুল হাতজোড় করতে যাবে তার আগেই দুটো হাত তার শরীরের দুপাশে পড়ে গেল। মিহির চোখ বুজে ফিসফিস করে বলল,
” ফাইনালি…. , লাভ অ্যান্ড ওয়ার এন্ডস।”
একজন নার্স এসে গায়ে তার নাকের নীচে একবার হাত রেখে গায়ে ঢাকা দেওয়া কাপড়টা তার মুখ পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে দিল। তার ফর্সা দীপ্তিময় মুখটা অবশেষে অন্ধ ভালোবাসার সাদা চাদরে ঢাকা পড়ল।
মিহির এবং লেডি অফিসারটি বাইরে চলে এল। মিহির চোখ মুছতে মুছতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লেডি অফিসারটিকে জিজ্ঞাসা করল,
” কোনোদিন প্রেম করেছেন? “
অফিসার বলল,
” হ্যাঁ… , কলেজ প্রেম ছিল একটা।
আচ্ছা স্যার প্রেম জিনিসটাই কী এইরকম অন্ধ হয়?”
মিহির বলল,
” না প্রেম জিনিসটা অন্ধ হয়না। প্রেম হয় আলোময়। অন্ধ হয় প্রেমের আবেগ, মোহ এইগুলো। আসলে কী জানেন, আমরা যখনই কারো মোহতে আবদ্ধ হয়ে যাই তখন সেটা কাটিয়ে ওঠা আমাদের কাছে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে ওঠে। তখন সেই মোহ ধ্বংসের পথে নিয়ে গেলে আমরা সেখানেই যাই।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারটি মিহির কথার প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বলল না। শুধুই হাসলো। কিছুক্ষণ পর মিহির বলল,
” কিন্তু……… , এক্ষেত্রে খুনির তো ধ্বংস হলো না।”
লেডি অফিসারটি বলল,
” মানে?”
মিহির বলল,
” মানে সৌমিলি যদি ওই পয়জনটা তৃষাণকে নাই দিত, তাহলে কে দিত? আসল খুনি তাহলে কে……? “
সৌমিলির দেওয়া বয়ানে কেসটা একটা নতুন মোড় পেল। মিহির যেখানে ভেবেছিল কেসটা শেষ, তারা খুনিকে ধরে ফেলেছে, কেসটা সেখানে শেষ হলো না। সেখান থেকেই ঘুরে গেল। অর্থাৎ তাকে এবং তার সমগ্ৰ টিমকে পুনরায় নতুন করে সমস্ত কিছু শুরু করতে হবে। কিন্তু এবার লড়াইটা আরও কঠিন। কারণ এবার খুনি কে ধরার জন্য এবার তাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। তাদের আবার নতুন করে সব প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। খুনি যে আসলে কে , সেটা খুঁজতে হবে। মিহির প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল যে এইবার খুনিকে চিহ্নিত করা অত সহজ হবেনা। তাই সে তার টিমে আরও কিছু জুনিয়র সিআইডি অফিসারকে নিযুক্ত করেছে। এছাড়া আনঅফিসিয়ালি বিভিন্ন খবর জোগাড়ের জন্য সে তার বন্ধু রাকেশকেও নিযুক্ত করল। একটা নতুন ছক তৈরি হল। কারণ এতদিন তদন্ত চলেছিল গোপনে । কিন্তু তৃষাণদের বাড়িতে সেই ঘটে যাওয়া সেই ভয়ানক ঘটনার পর ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এই মর্মান্তিক ঘটনা জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। তার সঙ্গে সিআইডি যে সমস্ত ঘটনাটার তদন্ত শুরু করেছে সেটাও তুলে ধরেছে। এই সমস্ত খবরের মাধ্যমে খুনিও যে সতর্ক হয়ে যাবে সেটা সে ভালো মতোই জানে। তাই সে তার টিমের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন একটা ছক তৈরি করেছে। তারা সবাই সবাই মিলে ঠিক করেছে যে তারা সেই খবরটাই সংবাদমাধ্যমকে জানাবে যেটা বাস্তবে ঘটেনি। অর্থাৎ যা ঘটবে তার উল্টো ঘটনা তারা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করবে। তারা এটা এইজন্যই করবে যাতে খুনি তাদের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে না পারে। অন্যদিকে রাকেশকে নিযুক্ত করে মিহিরের বেশ লাভই হয়েছে। আনঅফিসিয়ালি অনেক খবর রাকেশ তাকে এনে দেয়। রাকেশ নিজেও এই ঘটনার আসল খুনিকে ধরতে চায়। সেও চায় তার প্রিয় বন্ধুকে যে বা যারা হত্যা করেছে তাদের শাস্তি হোক। তাই সেও মিহিরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। তাকে সাহায্য করছে।
কাজকর্মের ফাঁকে একদিন রাকেশ ফোন করে মিহিরকে বলল তাদের পুরোনো আড্ডায় আসার জন্য। একটু সময় কাটানো যাবে, গল্পগুজব হবে, চা সিগারেট খাওয়া হবে , তারপর আবার কাজে মন দেওয়া যাবে। তৃষাণকে মৃত্যুর পর তাদের আড্ডা একদমই বসে না। অনেকদিন পর আবার বিকাশদার চায়ের দোকানে আড্ডা হবে জেনে সেও হ্যাঁ বলে দিল। সময় ঠিক হলো সন্ধে সাড়ে সাতটা।
কিন্তু প্রায় পৌনে আটটার সময় ওখানে পৌঁছে তারা দেখলো বিকাশের চায়ের দোকান বন্ধ। তারা আজব বনে গেল। ঝড়-ঝাপটা , মেঘ-বৃষ্টি যাই হোক বিকাশের চায়ের দোকান কোনোদিন বন্ধ হয়না। ওই চায়ের দোকানটাই তার উপার্জনের একমাত্র পথ। অথচ ভরা সন্ধেয় তাদের বিকাশদার চায়ের দোকান কেন বন্ধ সেটাই তারা ভেবে পাচ্ছেনা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তারা এটা নিয়েই আলোচনা করছে এমন সময় পাশের দর্জির দোকান থেকে বয়স্ক একজন ভদ্রলোক বলল,
” সে… তো আজ প্রায় একহপ্তা হয়ে গেল ঝাঁপ খুলচে না। তা তোমরা বাপু এতদিন দেখোনি?”
লোকটার বেশভূষা দেখে বোঝাই যায় যে সেও বেশ গরীব। আর কথাবার্তায় এটা পরিস্কার যে পেটে বিদ্যাও খুব অল্প।
তার কথা শুনে মিহির জিজ্ঞাসা করল ,
” একহপ্তা…? কিন্তু কেন? কোনো শরীর টরীর খারাপ নাকি?”
ভদ্রলোক বলল,
” তা কেমনে বলি বলো বাপু। আমার… সঙ্গে তো সেরকম কথা কইত না…। আমি জানি না। দেখো ওর বাড়ি টাড়ি গিয়ে , তার কোনো পাত্তা পাও কিনা। তবে…… “
রাকেশ জিজ্ঞাসা করল,
” তবে কী?”
ভদ্রলোক বলল,
” তোমরা একানে রোজ আসতে ত….. , তাই তোমাদের কইছি। শেষদিন দোকানে তালা লাগিয়ে যাবার সময় ওকে কেমন একটা অস্তির অস্তির লাগচিল। তারপর ত …. আর ওকে এমুকে দেখিনি।”
রাকেশের একটু সন্দেহ হল। সে মিহিরকে বলল,
” কী রে? যাবি নাকি একবার বিকাশদার বাড়ি?
ব্যাপারটা কেমন একটা গোলমেলে লাগছে না? বিকাশদার এই দোকান ছাড়া পেট চলেনা… , অথচ এই ঘটনার পর একসপ্তাহ দোকান খোলেনি!”
মিহির বলল,
” হ্যাঁ… , ঠিকই বলেছিস। ব্যাপারটা কিন্তু একটু অন্যরকম লাগছে। চল তো, এখন আটটা বাজছে। যাই একবার বিকাশদার বাড়িতে। তারা যখন বিকাশের বাড়িতে পৌঁছায় তখন সে বাড়িতে ছিল না। তার স্ত্রী জানাল যে সে নাকি বাজার গেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। তাদের ঘরে বসতে বলে তার স্ত্রী নিজের কাজে মনোনিবেশ করল। তারা ঘরে ঢুকে বসল। বিকাশের একতলা বাড়ি তার মধ্যে একটাই ঘর। মিহির রাকেশ দুজনেরই এই ঘরটা চেনা। তারা আগেও এই ঘরে এসেছে। মাঝে মাঝে এই ঘরেও তাদের আড্ডা হতো। কিন্তু আজকে তাদের সেখানে যাওয়ার একটা অন্য কারণ ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে এমন সময় হঠাৎ মিহিরের চোখ যায় দরজার পাল্লায় ঝুলতে থাকা জামাটার ওপর। তার চিনতে কোনো অসুবিধা হয়না যে সেটা বিকাশের জামা। মিহির আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে জামাটার কাছে গিয়ে সেটার বুকপকেট থেকে বার করে নিয়ে এল একটা ছোট্ট শিশি। যার ওপর পরিস্কার অক্ষরে লেখা আছে ডাইমিথাইলমার্কারি। আশ্চর্যরকম ভাবে তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোন সমীকরণে এটা সম্ভব সেটাই তারা বুঝতে পারছেন না। মিহির শিশিটা পুনরায় জামার পকেটে রেখে নিজের জায়গায় এসে বসল।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর বিকাশ বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকে মিহির এবং রাকেশকে দেখেই কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করল,
” তো তোরা…. এইসময়? কিছু হয়েছে?”
মিহির বলল,
“না…… , তুমি দোকান খুলছো না তাই ভাবলাম শরীর টরীর খারাপ নাকি। তাই দেখতে এলাম। “
বিকাশ কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলো। তারপর হেসে বলল,
” না না। কী… আবার হবে। আসলে ভাবছি কদিন গ্ৰামের বাড়ি ঘুরে আসবো। কালকেই বেরোবো।” মিহির দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সেই জামাটার পকেট থেকে শিশিটা বের করে টেবিলের ওপর রেখে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
” কিন্তু….. , তোমাকে গ্ৰামের বাড়ি যেতে দিলে তবেই তো যাবে তাই না? “
বিকাশের চোখ বড়োবড়ো হয়ে গেছে, তার হাঁটু কাঁপছে। সে বুঝে গেছে , পালানোর কোনো উপায় নেই। আর ঠেলাঠেলিতেও মিহির এবং রাকেশের চেহারার কাছে সে পারবে না। জীবন বাঁচাতে নতি স্বীকার করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।রাকেশ হাতটা মুঠো করে তার কাছে গিয়ে তাকে আস্তে আস্তে বলল,
” বিকা….. শ দা, গল্পটা তুমিই বলবে নাকি……. “
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিকাশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” না না.. , আমি বলছি, বলছি। “
রাকেশ তখনও ক্রুদ্ধ অবতারে বিকাশের পাশে দাঁড়িয়ে। তাকে মিহির বলল,
” আ….. , রাকেশ…। সরে আয়, দেখছি ভয় পাচ্ছে। বলো বিকাশদা। তুমি বলো। তুমি যত বলবে তোমারই লাভ। কারণ তোমার না বলা বাকি অংশটা যদি আমাদের তৈরী করে নিতে হয়…. , সেক্ষেত্রে কপালে প্রচুর দুঃখ। “
বিকাশ বিছানার ওপর বসে বলল,
” প্রায় একমাস আগের কথা। একদিন দুপুরে সুদীপ্ত আমার বাড়িতে এসে আমাকে ওই শিশিটা দিয়ে বলে, বলে যে রোজ যখন আমি তৃষাণকে চা দেবো তখন চায়ে অল্প করে মিশিয়ে দিতে। আমি প্রথমে শুনতে চাইনি। কিন্তু তারপর ও একজনকে ফোন করে ফোনটা আমাকে ধরিয়ে দেয়। ফোনের ওপার থেকে একজন ভারী গলায় বলে, যদি আমি কাজটা না করি তাহলে ও আমার বউকে মেরে দেবে। আর কাজটা করলে অনেক টাকা দেবে। সেইমতো সুদীপ্ত আমাকে কুড়ি হাজার টাকা দিয়েও যায়। আর বাকি টাকা কাল দেবে বলেছে।”
মিহির বলল,
” কাল নয়, আজই। আজকেই টাকা চাইবে তুমি। এখুনি ফোন করো আজকেই টাকা নিয়ে আসতে বলবে।”
রাকেশ বিকাশের গলায় হাত দিয়ে তাকে দেওয়ালে সেঁটে দিয়ে দাঁতে দাত ঠেকিয়ে বলল,
” মনে রেখো বিকাশদা। বাঁচার এই একমাত্র উপায়। যেমন বলা হচ্ছে তেমন করো।”
তাদের কথা অনুযায়ী বিকাশ ফোনে কথা বলে রাতেই টাকা দিয়ে যাওয়ার কথা বলে। ফোনের ওদিক থেকে সুদীপ্ত প্রথমে টাকা দিতে না না করলেও, বিকাশ মিহিরকে সবকিছু বলে দেওয়ার ভয় দেখানোয় তারা টাকা দিতে রাজি হয়। রাত একটার সময় বিকাশকে সুদীপ্তর বাড়িতে গিয়ে বাকি টাকা নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। বিকাশ খুনির সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করতে চায় জানালে তাকে শুধু বাড়িতে আসতে বলা হয়।সেখানেই সবাই থাকবে, তার সঙ্গে সেখানেই কে তাকে কাজটা করতে বলেছিল সেটাও দেখতে পাবে সে, এমনটাই আশ্বাস দেওয়া হয় তাকে। তাদের কথামতো বিকাশ রাজিও হয়ে যায়। মিহির সমস্ত ঘটনাটা শুনে বলল,
” ওকে। আজ রাতেই এই নারকীয় ঘটনার যবনিকা টানবো আমি। “
তারা বিকাশকে কী করতে হবে সেসব বুঝিয়ে তাদের গাড়িতে করে মিহিরের বাড়ি নিয়ে গেল। রাকেশ নিজের বাড়ি পৌঁছে তার টি-শার্ট এবং পায়জামাটা চেঞ্জ করে ডিনার করে পুনরায় রণসজ্জা সজ্জিত হয়ে মিহিরের বাড়ি পৌঁছে গেল। সেখানে পৌঁছৌতেই সে দেখল তার টিম তখন এসে পৌঁছেছে । সে ডিনার টেবিলে বসে আছে। রাকেশকে দেখেই সে বলল,
” আয়… , তোর জন্যই ওয়েট করছিলাম। বস খেয়ে নেওয়া যাক। তারপর প্ল্যানটা বলবো।”
রাকেশ অল্প হেসে বলল,
” এইরে একদম ভুলে গিয়েছিলাম। খেয়ে এলাম তো।”
এই কথা শোনার পর মিহিরের বউ বলল,
” এটা কিন্তু ঠিক নয় রাকেশ দা। আপনি এখানেই আসবেন, অথচ খেয়ে এলেন। “
রাকেশ জিভ কেটে বলল,
” একদম সরি। আচ্ছা ঠিক আছে… , আজকে তো খাওয়ার দিন নয়। অন্য একদিন এসে খাওয়া যাবে।”
মিহির বলল,
” হুম….. , ওকে মাই ফ্রেন্ড। ঠিক আছে তুই একটু ওয়েট কর আমি খেয়ে নিই।”
রাত তখন একটা বাজে। মিহির রাকেশের সঙ্গে তার টিমকে নিয়ে এবং কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে সুদীপ্তর বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। পাছে খুনি কিছু বুঝতে পারে তাই সে তার টিমকে আগেভাগেই সবকিছু বুঝিয়ে রেখেছে। যাতে কোনোরকম কথাবার্তার আওয়াজে বা কোনো অসুবিধায় খুনি বিব্রত না হয়ে যায়। তার যেন মনে হয় সবকিছু নরমাল আছে, এমন পরিবেশ বজায় রাখতে হবে বলেই সে নির্দেশ দিয়েছে। এমনকী রাতের অন্ধকারে কোনোরকম আলো পর্যন্ত ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক যখন একটা দশ তখন বিকাশ আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল। সুদীপ্ত বাইরে বেড়িয়ে এসে তাকে ঘরের ভিতর ডেকে নিয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ সবকিছু চুপচাপ। প্রায় মিনিট দশেক পর বিকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগিয়েছে, হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। মিহির দেখলো বিকাশের শরীরটা ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই সে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল। কেউ একজন দরজার সামনে থেকে ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। নিজের চোখের সামনে বিকাশের শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দেখেও সে অসহায়। কারণ আসল খুনিকে তাকে ধরতেই হবে। সে তার টিমকে ফিসফিসিয়ে বলল,
” কাম অন। লেটস মুভ।”
তার সঙ্গে ছিল রাকেশ তার অ্যাসিস্ট্যান্ট শেখর এবং একজন লেডি অফিসার প্রণতি। তার টিমের বাকি সবাই পুলিশের সঙ্গে বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে আছে। মিহির এগিয়ে গিয়ে একটা জানালার সামনে দাঁড়াল। জানলার দুটো পাল্লার মাঝে একটু ফাঁক ছিল। সেখান দিয়ে সে যা দেখল। তা অবিশ্বাস্য। ঘরের ভিতর চেয়ারে বসে আছে একজন পুরুষ, তার অত্যন্ত পরিচিত। সৌমিক। তার কোলের ওপর বসে আছে সুদীপ্তর বউ সুনয়না। আর সুদীপ্ত বসে আছে চেয়ারের নীচে। সৌমিকের একটা পা সুদীপ্তর কাঁধের ওপর। তার কোলে বসে থাকা সুনয়না সুদীপ্তর সামনেই সৌমিকের ঠোঁটে গভীর চুমু খাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। শুধু তাই নয়। এরপর কিছু কথাবার্তাও শুনতে পেল মিহির। কিন্তু অনেকটা দূরে থাকায় সে ঠিকভাবে ঠাহর করতে পারলো না। কিন্তু সে বুঝতে পারলো যে সৌমিক আর সুনয়না সুদীপ্তকে নিয়ে ঠাট্টাতামাসা করছে। রাকেশ সেই ঘটনা অল্প কিছুটা উঁকি মেরে দেখে মিহিরকে বলল,
” কিছু বুঝলি? “
মিহিরের শরীর তখন টগবগ করে ফুটছে। সে নিজের শরীরটাকে শক্ত করে বলল,
” সব দেখলাম। সব বুঝলাম। নষ্ট মেয়ে কীরকম হয় সেটা আজ সুনয়না কে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আর সৌমিক , আমার ভাবতেও ঘৃণা করছে , এইরকম ছেলের সঙ্গে আমরা মিশেছি। ছিঃ… ! “
তার পরক্ষণেই সে বলল,
” অনেক হয়েছে, আর নয় । এবার আর কোনো ক্ষমা নেই। শোন রাকেশ তোর কাছে কোনো বন্দুক নেই। তোর ভিতরে যাওয়টা সেফ হবেনা। তুই বাইরে দরজার কাছে দাঁড়া যেন কেউ বেরোতে না পারে। প্রণতি, শেখর কাম অন। “
এরপর এক ধাক্কায় ঘরের দরজা খুলেই সৌমিক, সুনয়না, সুদীপ্তর দিকে বন্দুক তাক করে মিহির দৃড়কন্ঠে বলে ওঠে,
” হ্যান্ডস আপ। “
তাদের দেখামাত্রই সুনয়না এক পলকে সরে গিয়ে বিছানার পরে থাকা ছুঁড়িটা নিয়ে সুদীপ্তর গলায় চেপে ধরে বলে,
” এই….. , একদম এগোবেন না, মিহির দা। আমি কিন্তু খুন করে দেবো আপনার বন্ধুকে বলে দিলাম। “
সৌমিক তখনও চেয়ারে বসে। সে ওঠার সুযোগ পায়নি। দু – দুটো বন্দুকের নল তার দিকে তাক করা। সুনয়নার কথায় মিহির হেসে উঠে বলল,
” খুন.. , আর কী করতে বাকি রেখেছ। নিজের স্বামীর সামনে পরপুরুষের কোলে বসে তাকে কিস করছো, জড়িয়ে ধরছো। এরপরেও কিছু বাকি থাকে? আর যদিও বা বাকি থাকে সেটা আমি তোমাকে করতে দেবোনা। দেখো পাগলামো কোরোনা। ছুঁড়িটা দিয়ে দাও আমাকে। “
সুনয়ষা পাগলের মতো চিৎকার করে বলল,
” হ্যাঁ করেছি করেছি। আমি সৌমিককে কিস করেছি। কি আছে আপনার মাষ্টারমশাই বন্ধুর? না আছে টাকা, না আছে বড়ো বাড়ি, এমনকি নিজের স্ত্রীকে বিছানায় সুখী করার ক্ষমতা টুকুও নেই। শুধু জ্ঞানের কথা। আমার টাকা দরকার, গাড়ি দরকার, বাড়ি দরকার, শারীরিক সুখ দরকার। এই সবকিছু ……. , আমি সৌমিকের কাছে পেয়েছি। টাকা… , পয়সা, বাড়ি , গাড়ি এমনকি বিছানায় সুখটাও। তাই আমি সৌমিকের সাথেই বিছানায় শুয়েছি। তাতে যদি আমি বেশ্যাও হই আমার কোনো আক্ষেপ নেই। তাই ভালো কথা বলছি , একদম কাছে আসবেন না। নইলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।”
তাদের এইরকম কথা কাটাকাটির মধ্যেই হঠাৎ একটা সময় দেখা গেল। সুদীপ্তর গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। মিহির দেখলো সুনয়নার হাতের ছুঁড়িটা সুদীপ্তর গলায় ঢুকে গেছে। তার শরীরটা উপুড় হয়ে মাটির ওপর পড়ল। সুনয়না হঠাৎ সুদীপ্তর গলা থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে তার রক্তমাখা হাতটা তার মুখে চাপা দিয়ে অঝোরে কাঁদছে।
সিআইডি টিমের সবাই যখন সুদীপ্তর মৃতদেহের দিকে এক পলক চোখ ঘুড়িয়েছে সৌমিক একলাফে উঠে গিয়ে তার বন্দুকটা নিয়ে সুনয়নার মাথায় তাক করে তার গলাটা টিপে ধরে বলল,
” খবরদার….. , একদম এগোনোর চেষ্টা করবি না। একটা খুন করেছি, আর একটা করতে সময় লাগবে না।”
সুনয়না অবাক হয়ে গিয় বলল,
” সৌমিক… , এটা কী করছো। আমরা……. , আমরা ভালোবাসি একে অপরকে।”
সৌমিক চেঁচিয়ে বলল,
” চু…….. প.. , একদম চুপ। একটাও কথা নয়।একটা নষ্ট মেয়েছেলে , ভালোবাসবে। থুতু দেবো তোর গায়ে। একটা বেশ্যা। টাকার জন্য পরপুরুষের সঙ্গে শোয়। তাকে আবার ভালোবাসবে।”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সৌমিক। তারপর বলল,
” শোন তোর সঙ্গে শোয়াই যায়। তোকে ভালোবাসা যায়না। বুঝলি? তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক । বেশি কথা বললে এখানেই খুন করে দেবো। “
সুনয়নার আর কোনো উপায় নেই। যার জন্য সে এসব কিছু করেছে এতদিন। সে সবকিছু খুইয়ে একটা নষ্টায় পরিণত হয়েছে, আজ সেই তাকে খুন করতে উদ্যত হয়েছে। এর থেকে করুন হয়তো আর কিছু হয়না। পৃথিবীতে। সৌমিক তার গলা টিপে ধরে রেখেছে। তবুও সে বলল,
” ইউ চিটার…….. , বিশ্বাসঘাতক……। “
সৌমিক তার কথায় হা হা করে অট্টহআসিতে ফেটে পড়ল।
মিহির বলল,
” না দেখ সৌমিক। তো…. , তোর সবকথা শুনবো। সুনয়নাকে ছেড়ে দে। “
প্রণতি একটু মিহিরের পাশ দিয়ে সৌমিকের দিকে এগোতেই সৌমিক প্রণতির হাঁটুতে গুলি করে বসে। তারপর আবার সুনয়নার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলল,
” আমি কিন্তু সবকিছু করতে পারি। তোরা চিনিস না আমাকে। আ…. , আমাকে যেতে দে।”
মিহির এরপর ধীরে ধীরে বন্দুক নামিয়ে তাকে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিলে সে ঘুরে যেই দরজা দিয়ে বেরোতে যাবে অমনি রাকেশ পিছন থেকে তার হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে তার পিঠে সজোরে এক লাথি মারে। এতোটাই জোরে সে লাথিটা মারে যে সৌমিক একেবারে ঘরের মাঝখানে এসে পড়ে। শেখর তাকে ধরে চেয়ারে বসায়। মিহির বলল,
” শেখর , ট্রিট হিম অ্যাজ এ ক্রিমিনাল। আই অ্যাম কামিং। “
এই বলে সে বাইরে চলে গেল। ততক্ষণে অন্যান্য পুলিশেরা এসে সুনয়নাকে পাকড়াও করেছে।
মিহির পাঁচ মিনিট পর এসে দেখলো সৌমিকের ভখন আধমরা অবস্থা। সে শেখরকে বলল,
” হুম.. , নাইস ট্রিটমেন্ট। “
প্রণতি কোনোরকমে উঠে ফাস্ট এইড নিয়ে বিছানার ওপর বসেছে।
এরপর সে সৌমিকের সামনে বসে নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করল,
” একবারও ভাবলি না? মেরে ফেললি তৃষাণকে। কেন? “
সৌমিক বলল,
” না ভাবলাম না। আমার জন্য কে ভাবে? যে আমি ভাবতে যাবো?”
কিছুক্ষণ সমস্তকিছু চুপচাপ। হঠাৎ মিহির সৌমিকের গালে সজোরে একটা চড় মেড়ে তার চুলের মুটিটা ধরে বলল,
” সবকিছু পরিস্কার করে বলবি? নাকি…… “
কিছুক্ষণ কেউ উত্তর দিচ্ছেনা দেখে মিহিরের নির্দেশে শেখর সৌমিককে ইলেকট্রিক এর তার দিয়ে জড়িয়ে দিয়ে তার সুইচটা মিহিরের হাতে দিল। তখনও সৌমিকের মুখ থেকে কোনো শব্দ আসছেনা দেখে মিহির একবার সুইচটা টিপতেই সৌমিক পশুর মতো তীব্র চিৎকার করে কাঁপতে লাগলো। প্রায় একমিনিট ওইভাবে কাঁপার পর সে বলল,
” বলছি…… , বলছি।”
তার সে মাথা নীচু করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে শুরু করল,
” গগনদা…. , আর আমি দুজনেই ব্যাঙ্ক জালিয়াতি করেছিলাম। অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলাম আমরা দুজনে। তৃষাণ সেটা জানতে পেরে যায়। ও , ও আমাদের ব্ল্যাকমেল করতো। সবকিছু পুলিশকে , পুলিশকে বলে দেওয়ার ভয় দেখাতো। আমাদের আর সহ্য হচ্ছিলো না। তাই আমরা ঠিক করি তৃষাণকে সরিয়ে ফেলবো। কিন্তু কীভাবে কাজটা করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সেই সময় সুনয়নার সঙ্গে….. , আমার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ও সুদীপ্তর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল, কারণ, কারণ সুনয়না আর সুদীপ্তর শারীরিক সম্পর্ক সুখের ছিল না। আমি সেই সুযোগটাই কাজে লাগাই। সুনয়না আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আমরা একসাথে রাতও কাটিয়েছি। একদিন আমি সুনয়নাকে আমাদের প্ল্যানের ব্যাপারে জানাই। প্ল্যানটা এমন ছিল যে, যে ধরা পড়লে সুদীপ্ত পড়বে আমরা পড়বো না। তাই আমরা সমস্ত লেনদেন সুদীপ্তর হাত দিয়ে করাতাম। আমি , আমি আর গগনদা মিলে তৃষাণকে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলতেই এই কাজটা করেছি। “
রাকেশ সবকিছু শুনে বলল,
” আমার…. , আমার ভাবতেও অবাক লাগছে তোর মতো একটা জানোয়ারের সঙ্গে আমরা মিশেছি। এর থেকে মরে গেলে বরং শান্তি পেতাম।”
মিহির সবকিছু শুনে বলল,
” একটা বন্ধু, কতটা নীচ আর বিকৃত মনোভাবের হলে আর একজন বন্ধুকে খুন করতে পারে।”
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তোরা যা করেছিস, সেটা ক্ষমার অযোগ্য। একজনকে খুন করতে গিয়ে কতগুলো প্রাণের আলো নিভিয়ে দিলি। নরকেও ঠাঁই হবে কিনা সন্দেহ।
শেখর নিয়ে যাও এদের। “
তার নির্দেশে তার টিমের সকলে সৌমিক আর সুনয়নাকে গাড়িতে তুলে বাকি পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো অর্থাৎ সুদীপ্ত আর বিকাশের বডিটা তারা সেই রাতেই সৎকারের ব্যাবস্থা করলো।
রাত তখন অনেকটা অতিবাহিত। মিহির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পৌনে তিনটে বাজে। পূর্ণিমার আকাশে চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। মিহির ধীরে ধীরে বাড়ির ছাদে গিয়ে হঠাৎ হাঁটুর ওপর ভর করে বসে অঝোরে কাঁদছে। চাঁদের আলোয় তার চোখের কোণে জমে থাকা জলটা হীরক কণার মতো জ্বলে উঠল। রাকেশ তার পাশে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
” সবকিছু শেষ হয়ে গেল রে।”
মিহির চোখের জল মুছে বলল,
” অন্ধ ভালোবাসা এর জন্য দায়ী। আসল কথাটা কী জানিস… , আমরা যদি ভুল মানুষকে ভালোবাসি তাহলে প্রচুর প্রভাব প্রতিপত্তি দেখিয়েও মানুষ অতি নগন্য হয়ে থেকে যায়। কিন্তু যদি সঠিক মানুষকে ভালোবাসা যায়, তাহলে একজন ভিক্ষারীও সমাজে অগ্ৰগণ্য রুপে রয়ে যায়।
এটা এমনই একটা অনুভূতি…. , যেটা সঠিক হৃদয়ের সঙ্গে, সঠিক সময়ে ,সঠিকভাবে যদি ভাগ করে নেওয়া যায়, তাহলে আমাদের শরীর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরেও আমরা থেকে যাই, অন্য সকলের হৃদয়ে, অন্য সকলের স্মরণে। আর যখন আমরা অন্য সকলের সুখময় স্মরণে চিরকালীন ভাবে থেকে যেতে পারি তখনই আমরা আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে থাকি। সেখানেই জীবনের মহত্ব থেকে মাহাত্ম্য সবকিছুই । সবাই সেটা পায় না। হয়তো একশোর মধ্যে একজন পায়। কিন্তু যারা পায়, সবশেষে তারাই অমর হয়ে রয়।”
কিছুক্ষণ সবকিছু চুপচাপ। মিহির ও রাকেশ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো আকাশের চাঁদ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নেই কোনো অন্ধকার। বিষাক্ত মনের বিষাক্ত রক্তের রক্তাহুতির সঙ্গেই পূর্ণিমা তিথিতে চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতা ক্রমশ ক্রমবর্ধমান। তৃষাণ যেন উপহার দিয়েছে সেই রাত, সেও আজ প্রাণখুলে হাসছে অন্য কোনো আলয়ে। আঁধারহীন তমসায় তার হাসি যেন ছড়িয়ে পড়েছে সৌরজগতের মাঝে বিরাজমান পৃথিবী নামক নির্মল,পবিত্র গ্ৰহবলয়ে।।
বিষয় মৌলিকত্ব | |
ভাষা সাবলীলতা | |
কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা প্রবাহ | |
শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ | |
অডিও/ভিডিও রূপান্তর যোগ্য | |
Average
|
|
![]() |