ছায়া শরীর | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | কেয়া চ্যাটার্জী | Bengali Thriller Story | 9F10
0 (0)

 ঘুম ভেঙ্গে গেল অভিজিতের। সারা শরীর দরদর করে ঘামছে। সেই স্বপ্নটা ফিরে আসছে আবার। ছোটবেলার স্মৃতি, নাকি দুঃস্বপ্ন? অভিজিৎ বুঝতে পারে না, তবে এই স্বপ্নের কথা সে কাউকে বলতেও পারে না। প্রতি রাতে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা, ভয় তাকে ঘিরে ধরে। দমবন্ধ হয়ে আসে। ছটফট করতে থাকে কুড়ি বছরের তাজা প্রাণ। অবশ হয়ে আসে শরীর। গলা থেকে আওয়াজ বেরোয় না। যেন কেউ সজোরে চেপে ধরে রেখেছে। একটা ডাক ক্রমাগত তার কানে ভেসে আসে। ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ে মস্তিস্কের প্রতিটি রন্ধ্রে। তারপর… এক সময় সবকিছু থেমে যায়। সব ঝড় থেমে যায়। শান্ত হয়ে আসে চারিদিক। শরীর হালকা হয়ে যায় অভিজিতের। চোখের পাতা ভারি হতে হতে কখন যেন ঘুম নেমে আসে।

   রাত্রি এলেই একটা ভয় চেপে ধরে অভিজিৎকে। তবে সেকথা সে কাউকে জানায় না। বাবার বয়স পঞ্চান্ন। এখনই হৃদ রোগের তাড়নায় বুকে পেসমেকার বসেছে। মায়ের হাই ব্লাডপ্রেসার আর সুগার। ছোটবেলা থেকেই বাবা মা-কে অসুস্থ দেখে বড় হয়েছে সে। নিজেও যে খুব সুস্থ, স্বাভাবিক তা নয়। নয় বছর বয়স থেকে হুইল চেয়ার সঙ্গী। ডাক্তার, বদ্যি দেখিয়েও কোনও লাভ হয়নি। শেষবারের মতো একজন নিউরো সার্জেন নিদান দিয়েই দিয়েছেন যে অভিজিতের পায়ের নার্ভগুলি শুকিয়ে গেছে। কোনওভাবেই সেগুলিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। কীভাবে বা কেন অভিজিতের এই অবস্থা সেই বৃত্তান্ত মিত্র পরিবার কাউকে জানান না। অভিজিৎও প্রায় ভুলেই গেছে ঘটনাটা। বৃথা চেষ্টা বন্ধ করে দিয়েছেন মিত্র দম্পতি। এখন ছেলেকে কীভাবে এই অবস্থার মধ্যে দিয়েই একটি সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন দেওয়া যায় সেই চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন। অভিজিতের বয়স কুড়ি। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে শহরের একটি বেসরকারি কলেজে। লেখাপড়ায় মেধার সুবাদে কলেজে সে নানানভাবে সুবিধা লাভ করে থাকে। অসিত মিত্র কেন্দ্রীয় সরকারের একজন ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক। ছেলের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে নিজের পদের প্রভাব যে তিনি দেখিয়েছেন সেই ব্যাপারটা উনি অস্বীকার করলেও, একেবারে মিথ্যে নয়। পারমিতা মিত্র একটি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা।

    কলেজের জন্য রেডি হয়ে ঘর থেকে লিভিং রুমে এসেই কপালে ভাঁজ পড়ল অভিজিতের। কথা এসেছে। সোফায় বসে অসিতের সাথে খোশমেজাজে গল্প শুরু করেছে। কথা ইকনমিক্স নিয়ে পড়ছে। ওদের প্রতিবেশিনী। প্রতিদিন কলেজ বেরোনোর সময় কথা সময়ের আগেই এসে হাজির হয়। অসিত অভিজিৎকে কলেজে নামিয়ে দেন নিজের গাড়িতে। কথার কলেজ সেই পথেই পড়ে। সেই সুবাদেই ওর অবাধ আসা যাওয়া এই বাড়িতে। তবে অভিজিতের বিরক্তি অন্য ব্যাপারে। মেয়েটি ভীষণ কথা বলে। যতক্ষণ গাড়িতে থাকে ততক্ষণ অভিজিৎ দা, অভিজিৎ দা করে মাথা খেয়ে নেয় সে। অভিজিতের সব ব্যাপারে ওর আগ্রহ। লেখাপড়ার পাশাপাশি গান-বাজনা বা কবিতা লেখায় অভিজিতের হাত যশ রয়েছে। কথাও ভালো গান গায়। অভিজিৎ এমনিতে স্বল্পভাষী। কথার সামনে পড়লে ওর বকবকের ঠ্যালায় বোবা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওর। অথচ একেবারে অবজ্ঞা করার উপায় নেই। বাবার বসের শালার মেয়ে। নতুন ফ্ল্যাট কিনে এসেছে ওদের পাশের এপার্টমেন্টেই। অসিতের প্রস্তাবেই কথা ওদের গাড়িতে যাতায়াত করে। তবে কথার যে তার প্রতি একটু ব্যথা আছে সেটা খুব ভালো করেই বোঝে অভিজিৎ। আর সেখানেই যত অস্বস্তি ওর।

মোবাইলটা টেবিলে রেখে কথা ওয়াশরুমে গেল। কলেজ থেকে ফিরে স্নান করা তার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। তারপর এক কাপ গরম ব্ল্যাক কফি আর মায়ের হাতের মুড়ি মাখা খেয়ে সে পড়তে বসে। ওয়াশরুম থেকেই শুনতে পেল ওর মোবাইল বাজছে। চিৎকার করে বলল, “মা দেখো না, কে ফোন করেছে?” ফোনের রিং থামল। বুঝল যে নয়না ফোনটা তুলেছে এবং কারুর সাথে গল্পে মেতেছে। বেরিয়ে এসেই কথার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে নয়না হাসি মুখে বলল, “দেখ, কে ফোন করেছে?” উৎসুক হয়ে কানে ফোন লাগাতেই কথা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। ওপাশে যার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল সে কথার খুবই প্রিয় মানুষ, মৃত্তিকা।

“আরে মৃত্তিকা দি, তুমি?”

“কেমন আছিস কথা?”

“ভালো। তুমি? ভুলেই তো গেছ আমাদের? খুব রেগে আছি কিন্তু তোমার উপর।”

“বেশ। তোর রাগ ভাঙ্গানোর ওষুধ আছে আমার কাছে।”

“কী গো?”

“আমি পরের সপ্তাহে আসছি তোদের বাড়িতে, একটা কেসের ব্যাপারে। দিন কয়েক থাকব। জ্বালাব খুব। রাজি তো?”

“রাজি মানে? এই দিনটার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। এবার কিন্তু আমায় কাটাতে পারবে না বলে দিলাম। তোমার সাথে ওয়াটসনের মতো লেগে থাকব।”

“আরে বাবা! সেসব দেখা যাবে। আগে কেসটার ব্যাপারে জেনে নিই। ক্রিমিনাল যদি সাংঘাতিক কেউ হয় তাহলে তোকে আমার লেজুড় বানানোর শখ ওপর মহল থেকেই খারিজ করে দেবে।”

কথা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৃত্তিকা হেসে বলল, “মন খারাপ করিস না। আমি আগে যাই। তারপর একদিন তোকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট করবই। ওকে?”

“বেশ। অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু।”

   মৃত্তিকা ফোন কেটে দিল। হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। নয়না মাসি, পরিমল মেসো আর কথা, এতটাই আন্তরিক যে কলকাতা গেলে ওদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থাকার কথা ভাবতেই পারে না মৃত্তিকা। বাড়িতেও জানিয়ে দিয়েছে মুম্বাই থেকে সে কলকাতার ফ্লাইটে উঠবে আগামী শনিবার। তারপর এয়ারপোর্টে নেমে ক্যাব ধরে সোজা তারাতলা। বারাসাত যাবে কেস মিটে গেলে। তার আগে মা যেন একবারের জন্যও দেখা করার কথা না তোলে। একটা জটিল কেসের জন্য তাকে ওপর মহল থেকে কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে। ইন্ডিয়ান ক্রাইম ব্রাঞ্চের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার মৃত্তিকা রুদ্র। প্রথমে রাজ্য স্তরে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এই স্তরে পৌঁছেছে সে। কিন্তু পথটা সোজা ছিল না মোটেই। চাকরির পরীক্ষায় বসার আগে থেকেই সেই লড়াই শুরু হয়েছিল মৃত্তিকার। শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক যোগ্যতা সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও ফর্মের জেন্ডার কলামে  আদার অপশনে টিক দেওয়ার মাধ্যমেই মৃত্তিকার মানসিক ও সামাজিক লড়াইয়ের শুরু। প্রথম দিকে প্যানেলে নাম থাকা সত্ত্বেও তাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। মামলা, মোকদ্দমার কঠিন পথ পেরিয়ে সেই চাকরি হস্তগত করলেও অফিসে সে পেয়েছে বিমাতৃ সুলভ ব্যবহার। যেন মানুষই নয় মৃত্তিকা রুদ্র। তবে নিয়তির চাকা একসময় এমন ঘুরল যে মৃত্তিকাকে এড়িয়ে যাওয়া, ছোটখাটো কেসে ঠেলে দেওয়া, জটিল কেস সমাধানের মুখে থাকাকালীন তাকে সরিয়ে দেওয়া বা জোর করে কেস বন্ধ করে দেওয়া বড় বড় অফিসারদের নাকের ডগা দিয়ে মৃত্তিকা প্রমোশন ছিনিয়ে পাড়ি দিল মুম্বাইয়ের পথে।

একটা সাদা রঙের ক্যাব এসে থামল কথাদের এপার্টমেন্টের সামনে। সন্ধে পেরিয়ে রাত নামছে শহরে। গাড়ির মিছিল এখন বাড়িমুখী। ঝিমিয়ে পড়ছে সমস্ত প্রাণ। সারাদিনের রেষারেষি, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদের দৌড়, ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার স্বপ্ন বুকে আগলে রাখা মানুষগুলোর শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হচ্ছে। আবার পরেরদিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে দৌড় শুরু করবে জীবনের ট্র্যাকে। মৃত্তিকা গাড়ি থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। ক্যাবটা চলে যেতেই সিকিউরিটির কাছে নিজের পরিচয় পত্র দেখিয়ে বলল, “পরিমল সেন। নর্থ উইং। থার্ড ফ্লোর। বলুন মৃত্তিকা এসেছে।” হৈহৈ করে নেমে এলো কথা। একপ্রকার কোলে তুলেই নিয়ে গেল মৃত্তিকাকে। এই উষ্ণতাটুকুই ঘিরে রাখে মানুষের আত্মাকে।

চা আর মুড়ি খেতে খেতে পরিমল জিজ্ঞেস করল, “তাহলে অফিসার রুদ্র, আমাদের এই যানজটপূর্ণ, রাজনীতি মোড়া শহরে আপনার পায়ের ধুলো পড়ার হেতু জানা যেতে পারে? নাকি একেবারে কনফিডেন্সিয়াল ব্যাপার?” মৃত্তিকা হেসে ফেলল। পরিমল এভাবেই কথা বলে বরাবর। শব্দরাজি সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করা পরিমলের বরাবরের অভ্যেস। সেইজন্যই হয়তো কর্পোরেট কর্তা হয়েও আজও তাঁর ডাক পড়ে নাটকের মঞ্চে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মৃত্তিকা বলল, “কনফিডেন্সিয়াল তো বটেই। তবে একেবারে বলা যাবে না এমন নয়।” মুড়ির বাটির অনেকটাই সাফ হয়ে এসেছে। এবার বাকিটা শেষ করে সে বলল, “আসলে একটা সিরিয়াল কিলিংএর ইনভেস্টিগেশন করতেই আমার ডাক পড়েছে কলকাতায়।” “সিরিয়াল কিলিং!” লাফিয়ে উঠল কথা। মৃত্তিকা প্রমাদ গুনল। কথা এবার কিছুতেই ওর পিছন ছাড়বে না। কথা এদিকে কলকল করে বলতে লাগল, “মানে সেই সাইকো কিলার? একের পর এক খুন করে চলেছে। পাশে কবিতা বা ধাঁধা লিখে চলে যাচ্ছে? কী ধাঁধা লিখেছে গো মৃত্তিকা দি?” মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল, “না ব্যাপারটা এতটাও নাটকীয় নয়। প্রথমে তো বোঝাও যায়নি যে এটা সিরিয়াল কিলিঙের কেস।”

“তাই? কীভাবে বুঝলি?” বললেন নয়না।

“বুঝলাম খুনের প্যাটার্ন দেখে।” মৃত্তিকা দেখল সকলেই তার দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সে এবার বলতে শুরু করল, “খবরগুলো আসলে নিউজ চ্যানেল বা খবরের কাগজগুলি সেভাবে হাইলাইট করেনি। একে ভোটের মরশুম। এইসব ছোটখাটো মৃত্যুর দিকে নজর দিতে গেলে ওদের টিআরপি কমে যেত। তাছাড়া, দাঙ্গা হাঙ্গামা, বোমা আর দলাদলি সামলাতে গিয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্টেরও অবস্থা নাজেহাল। কিন্তু ব্যাপারটা নজরে এলো তখন যখন খুন হল আমাদের এক পুলিশ কর্মীর ভগ্নীপতি। একটি ওইও রুমে অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। টাকা পয়সা, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড, হাতের আংটি বা গলার চেন সব অক্ষত।”

“তাহলে কেন খুন করা হল? কিভাবেই বা খুন করা হল?” বলে ফেলল কথা।

মৃত্তিকা একরাশ দ্বিধা নিয়ে বলল, “আমার বলতে সংকোচ হচ্ছে আসলে।” পরিমল ও নয়না আশ্বাস দিলে সে বলল, “ভিকটিমকে ধর্ষণ করে ভোজালি দিয়ে তার গোপনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়।” একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে ঘরের মধ্যে। সকলে চুপ করে যায়। তবু কথা চুপ করে না। জিজ্ঞেস করে, “তারপর থেকেই এই ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত শুরু হল?”

“একদম তাই। তখনই ডিপার্টমেন্টের টনক নড়ে। ফাইল খুলে দেখা যায় এই ধরনের খুন এর আগেও হয়েছে এবং ঠিক একইভাবে হয়েছে। একটি সস্তার হোটেলে, রাত্রিবেলা এবং কোনও ছিনতাইয়ের হিস্ট্রি নেই বরং…”

  বাকিটা আর বলার প্রয়োজন মনে করল না মৃত্তিকা। সব কিছু এখনই বলার সময়ও হয়নি। আগামীকাল লালবাজারে গিয়ে অফিসার মোদকের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত বাকিটা ক্লিয়ার করা যাবে না।

হেড কোয়ার্টারে প্রবেশ করেই মৃত্তিকা প্রথমেই নিজের পরিচয় ও দেখা করার উদ্দেশ্যসহ একটি চিরকুট পাঠিয়ে দিল ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনারের উদ্দেশ্যে। মৃত্তিকাকে অনেকেই চেনে এখানে। আসলে কাজের থেকেও বেশি চেনে ওর লিঙ্গ বিভাজনের কারণে। মৃত্তিকা অবশ্য রূপে বেশ আকর্ষণীয়। ছিপছিপে গড়ন, শ্যামলা রং, ছোট করে ছাঁটা চুল, আয়ত অথচ বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। মুখশ্রীতে লাবন্য থাকলেও গাম্ভীর্য ধারণ করে চলে সে। শার্টের হাতা ঠেলে উঠে আসা পেশি জানিয়ে দেয় প্রতিদিন শরীর চর্চা তার অভ্যেস। প্রয়োজন ছাড়া মৃত্তিকার ধারে কাছে আসা সম্ভব হয় না কারুর পক্ষেই। মৃত্তিকার শরীরের ভাষা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় সময় অপচয় তার একেবারে অপছন্দ।

  বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একজন পিওন এসে সসম্মানে ওকে নিয়ে গেল ভেতরে। কেবিনে ঢুকেই অফিসার অনিন্দ্য মোদক উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন মৃত্তিকাকে।

“আরে মিস রুদ্র আসুন আসুন। বসুন। বলুন কী খাবেন? চা, কফি, সরবত?”

মৃত্তিকা অল্প হেসে জানালো, “না স্যার। কিছুই লাগবে না। আপনি আমায় কেসের ব্যাপারে বলুন।”

“বুঝতে পারছি মৃত্তিকা। তোমার মতন একজন দুঁদে অফিসারের পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। সেই জন্যই আমি সবকিছু রেডি করে রেখেছি। এই নাও এই ফাইলটায় চোখ বোলাও আর যা যা প্রশ্ন আছে করে ফেল।”

অফিসার মোদক একটি লাল রঙের ফাইল এগিয়ে দিল। মৃত্তিকা ফাইলটি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল চিন্তিত মুখে। তারপর বলল, “স্ট্রেঞ্জ! প্রত্যেকটি  রেজিস্টারে এক নাম – শিবানী। প্রত্যেকটির চেক ইন রাতে। চেক ইন করছে মহিলা অথচ খুন করছে একজন পুরুষ!”

 অফিসার মোদক খুশি হয়ে বললেন, “এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই মৃত্তিকা। ব্যাপারটা খুবই সহজ। চেক ইন করছে একজন পুরুষ কিন্তু মহিলার বেশে।”

“রাইট স্যার। এই সহজ কথাটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার। শুধু বুঝতে পারছি না খুনের উদ্দেশ্য কী?” বলল মৃত্তিকা।

মোদক বললেন, “প্রথমত, হতে পারে ব্যক্তিগত ক্ষোভ। দ্বিতীয়ত, টাকা আদায় করা। তৃতীয়ত, কোনওরকম সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে মৃত ব্যাক্তিরা। তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলতে পাঠানো হয়েছে এই খুনিকে। চতুর্থত, ব্যক্তিটি মানসিকভাবে অসুস্থ। কী করছে, কেন করছে কোনও হুঁশ নেই। বিশেষত, কোনও উদ্দেশ্য নেই।”

মৃত্তিকা চুপ করে বসে রইল। একদৃষ্টে চেয়ে রইল ফাইলটার দিকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ফাইলটা আমি নিয়ে যেতে পারি স্যার? আরও ভালো করে পড়তে হবে।”

“অবশ্যই। অল ইওরস অফিসার রুদ্র।”

মৃত্তিকা ফাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। অনেকগুলো জটিল অঙ্ক ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার মধ্যে। সহজে জট ছাড়বে না।

“গুড মর্নিং আঙ্কেল।” কথা হাসি মুখে অভিবাদন জানালো অসিতকে। অসিত গাড়িতে অফিস যাওয়ার জন্য ব্যাগপত্র তুলছিলেন আর তার সাথে অভিজিৎকে সাহায্য করছিলেন গাড়িতে উঠে বসার জন্য। অবাক হয়ে বললেন, “আরে গুড মর্নিং। কী ব্যাপার আজ কলেজে যাবে না?” কথা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “হ্যাঁ আঙ্কেল যাব তবে দিদি এসেছে। ওর সাথেই যাব। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।” অসিত হেসে বললেন, “না, না এতে মনে করার কিছু নেই। তা তোমার দিদি কি গাড়ি নিয়ে এসেছেন?”

“অফিস থেকে দিদির জন্য গাড়ি পাঠাবে। রেডি হচ্ছে একটু পরেই নেমে আসবে। ঐ তো চলে এসেছে। মৃত্তিকাদি উনি আমাদের প্রতিবেশি অসিত আঙ্কেল। আর ওঁর ছেলে অভিজিৎ দা। আঙ্কেল আমার পিসেমশাইয়ের কলিগ।“ কথা এক নাগাড়ে বলে গেল। খেয়াল করল না যে মৃত্তিকাকে দেখে অসিত একটু অবাক ও  তার সাথে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। মৃত্তিকা সাবলীলভাবে হাত জড়ো করে নমস্কার জানালো। অসিতও জড়তা ভেঙ্গে প্রতি নমস্কার জানালেন। হেসে বললেন, “আজ একবার আমাদের বাড়ি আসবেন। সন্ধেবেলা চায়ের নিমন্ত্রণ রইল।” মৃত্তিকা বলল, “অবশ্যই। আমার কাজ যদি সময়মতো মিটে যায় তবে নিশ্চয়ই যাব। এখন আসি। চল কথা গাড়ি এসে গেছে।” অসিত মিত্র দেখলেন ভারত সরকারের লোগো লাগানো একটি সাদা রঙের মারুতি দাঁড়িয়ে রয়েছে কথাদের ফ্ল্যাটের সামনে। মৃত্তিকা আর কথা তাতে চড়ে বসল।

  সন্ধ্যাবেলা অসিতের পিড়াপিড়িতে মৃত্তিকাকে যেতেই হল ওদের বাড়িতে। নিজের থেকে উঁচু দরের কাউকে তৈলমর্দন করতে অসিত একমুহূর্ত সময় নষ্ট করেন না। সেটা মৃত্তিকা অসিতের বাড়িতে পা রেখেই বুঝে গেছিল। চায়ের নিমন্ত্রণ থাকলেও খাবার দাবারের যে আয়োজন করে বসেছিলেন অসিত বাবু তাতে রাতের খাবারও হয়ে যায়। একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারকে হাতে রাখার এমন সুবর্ণ সুযোগ কীভাবে হাত ছাড়া করতে পারেন অসিত মিত্র? কখন, কাকে কাজে লেগে যায়, বলা তো যায় না। তবে পারমিতার মুখ দেখে মৃত্তিকা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিল যে এই আয়োজনে সে খুশি নয়। একপ্রকার স্বামীর ইচ্ছেতেই তাকে তালে তাল মেলাতে হচ্ছিল। মৃত্তিকার বেশ মজা লাগল ব্যাপারটায়। পুলিশের জীবিকায় এসে কত মানুষের সাথেই না পরিচয় হল তার। তাদের মধ্যে নব্বই শতাংশই ধান্দাবাজ। আজ অসিতও সেই তালিকায় নাম লেখালেন।

  চিকেন কাটলেটে কামড় বসিয়ে কথা কলকল করে উঠল, “আরে মৃত্তিকাদি। খাও তাড়াতাড়ি। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো। জানো তো, আমাদের এখানকার কাটলেট কিন্তু খুব ফেমাস। একবার খেলে মুখে লেগে থাকবে।” মৃত্তিকা হেসে বলল, “তাই নাকি? বেশ খাই তবে।” তারপর বলল, “আচ্ছা সকালে আপনার ছেলেকে দেখলাম। ও নেই বাড়িতে?” অসিত একটু আমতা আমতা করে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ আছে তো। পারমিতা ডাকো না অভিকে।” পারমিতা এই প্রস্তাবে একেবারে নারাজ। সে বলে উঠল, “আসলে আমার ছেলে সবার সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলে না। মিশতেও চায় না।”

“আহা, তাই বলে কি ওকে ঘর বন্দী করে রাখবে? বলো একবার এসে দেখা করতে।” বললেন অসিত। পারমিতা দুপ দাপ পা ফেলে এগিয়ে গেল ছেলের ঘরের দিকে। অসিত সামাল দেওয়ার জন্য দেঁতো হেসে বললেন, “আসলে খুবই introvert, বুঝলেন তো। শুধু লেখাপড়া আর নিজের জগৎ নিয়েই থাকে। কতবার বলি একটু বাইরের মানুষদের সাথে কথা বল, মেলামেশা কর। শুনবেই না। পায়ের সমস্যাটা হওয়ার পর থেকে এত মনমরা হয়ে গেছে যে…” অসিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই ড্রইং রুমে হুইল চেয়ারে বসে থাকা অভিজিৎকে নিয়ে প্রবেশ করলেন পারমিতা। চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। মৃত্তিকা অভিজিতের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আর কথা না বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ওকে হাসি মুখে অভিবাদন জানিয়ে বলল, “গুড ইভনিং অভিজিৎ। সকালে তোমার সাথে সেভাবে কথা হয়নি। হ্যালো আমি মৃত্তিকা রুদ্র।” অভিজিতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মৃত্তিকা। অভিজিতের মধ্যে কোনও উষ্ণতা নেই। সে নিঃস্পৃহের মতো হাত মিলিয়ে বলল, “স্বাভাবিক। সকালবেলাটা কাজের সময়। গল্প করার নয়।“ মৃত্তিকা খুশি হল। ছেলেটি বেশ সোজাসাপটা কথা বলতে ভালোবাসে। আনাড়ি গপ্পো ফেঁদে সময় নষ্ট করার পাত্র নয়। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে মৃত্তিকা বলল, “একদম ঠিক কথা বলেছ। সময় খুবই মূল্যবান। সময়কে মূল্য না দিলে সময় তোমাকে মূল্য দেবে না।” অসিত বলে উঠলেন, “বাহ! দারুন কথা বললেন তো ম্যাডাম।” তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অভি, ম্যাডাম কিন্তু ক্রাইম ব্রাঞ্চের বড় অফিসার। এখানে একটা জটিল কেসের জন্য এসেছেন।” অভিজিতের এসব ব্যাপারে কোনও উৎসাহ দেখা গেল না। সে ঘাড় কাৎ করে মৃত্তিকাকে একদৃষ্টে দেখছিল। তার নিস্পন্দ দৃষ্টিতে আর কেউ কিছু দেখতে না পাক মৃত্তিকা খুব ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল অভিজিতের তার প্রতি চরম ঘৃণা, অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য।

  কথা বলে উঠল, “অভিজিৎ দা যেমন লেখাপড়ায় ভালো। তেমনই ভালো গান গায় আর কবিতা লেখে। কয়েকটা কবিতা তো বড় বড় পত্রিকাতেও ছেপেছে। তাই না অভিজিৎ দা?”

 অভিজিৎ সামান্য ঘাড় দুলিয়ে আবার চুপচাপ বসে রইল। কোনও উত্তর দিল না। অসিত বাবু ছেলে আর স্ত্রীয়ের এহেন আচরণে খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য সাজানো গোছানো ঘরটিতে অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো। মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “বেশ মিস্টার মিত্র। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর ইনভাইটিং মি। আবার দেখা হবে।” অসিত বাবুও যেন ধরে প্রাণ ফিরে পেলেন। হাসিমুখে তড়িঘড়ি বিদায় জানালেন অতিথিকে।

  “অভিজিৎ দা’কে কি সুন্দর দেখতে না?” রাস্তায় নেমে কথাটা বলে ফেলেই থমকে গেল কথা। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল গাল। মৃত্তিকা হাসি চেপে বলল, “অভিজিৎকে তো দেখলাম। কিন্তু আমি আরও ভালো করে দেখতে পাচ্ছি অন্য কিছু।”

“অন্য কিছু? কী গো?”

“এই যে অভিজিৎ মিত্রের জন্য কথা দেবীর ব্যথা। চব্বিশ ঘণ্টা, কেউ ভগবানের নামও জপে না যতবার তুই অভিজিতের নাম জপছিস।”

কথা প্রতিবাদ করে ছদ্মরাগ দেখিয়ে বলল, “মোটেও না। তোমার শুধু বাড়াবাড়ি। চলো চলো বাড়ি চলো।”

কলিং বেলে চাপ দিয়ে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। পরনে একটি সাধারণ সালোয়ার-কামিজ, খোপা করা অবিন্যস্ত চুল, ঘামে ভেজা মুখ, গৌর বর্ণ চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মৃত্তিকাকে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল মহিলার। সুললিত কণ্ঠে বললেন, “কাকে চাই?” মৃত্তিকা অল্প হেসে বলল, “এটা কি সুহৃদ সান্যালের বাড়ি?” মহিলা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তারপর বললেন, “কিন্তু উনি তো দিন কয়েকদিন আগে…”

“হ্যাঁ জানি। আমি ওঁর মৃত্যুর তদন্তের খাতিরেই এসেছি। আমি এসিপি মৃত্তিকা রুদ্র। ক্রাইম ব্রাঞ্চ।” মৃত্তিকার কথা শুনে মুহূর্তেই মহিলার চেহারার রং উড়ে গেল। ফ্যাকাশে মুখে বললেন, “কিন্তু আমরা তো কোনওরকম কমপ্লেইন করিনি। তাহলে কেন…?”

“সব বলছি। আগে ভেতরে গিয়ে বসি।”

মহিলা লজ্জিত হয়ে বললেন, “ছি ছি। সত্যিই তো। আসুন ভেতরে আসুন।”

মৃত্তিকা ভেতরে ঢুকে দেখল পরিপাটি সাজানো লিভিং রুম। স্বল্প আসবাবপত্রের মাঝে একটি সুদৃশ্য বইয়ের তাক। সংগ্রহগুলি অত্যন্ত লোভনীয়। দেওয়ালের এক পাশে টাটকা গাঁদার মালায় সজ্জিত সুহৃদ বাবুর ছবি টাঙ্গানো। মৃত্তিকা সেদিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। ফাইল অনুযায়ী ভদ্রলোকের বয়স বিয়াল্লিশ। একটি আইটি কোম্পানিতে ফিনান্স ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। দশ বছরের ছেলে ও গৃহবধূ স্ত্রী সহ সুখের সংসার। বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছিলেন। মা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। মৃত্তিকা একটা সোফায় বসে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার নাম?”

“রুমেলা সান্যাল।”

“কী করেন?”

“হাউজ ওয়াইফ।”

“সন্তান?”

“একটি ছেলে আছে। দশ বছর বয়স। ফাইভে পড়ে। ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে।”

“আপনাদের বিবাহিত জীবন কত বছরের?”

“বারো বছর। “

“আপনার বাবার বাড়ি কোথায়?”

“বর্ধমানে।”

“আর শ্বশুরবাড়ি?”

“একই বর্ধমান।”

“আপনাদের লাভ ম্যারেজ?”

“না, না। একদমই না। আপনি চা খাবেন?”

“নো থ্যাঙ্ক ইউ। আমি অন ডিউটি। আচ্ছা সুহৃদ বাবু যে ইদানিং কারুর সাথে ইনভল্ভ হয়েছিলেন সেটা কি আপনি কোনওভাবেই জানতে পারেননি?”

রুমেলা সামান্য হাসলেন। তার হাসিতে ব্যাঙ্গ এবং শোক সমানুপাতিকভাবে মিশে আছে। বললেন, “জানলে কি ওকে আটকাতাম না?”

“আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?”

“সেভাবে কোনও মহিলার সাথে যে ওঁর আলাদা করে সম্পর্ক আছে সেটাই তো জানতাম না। কাকে সন্দেহ করব বলুন?”

“কোনও কলিগ বা বন্ধু, কাউকেই আপনি চেনেন না?”

“হ্যাঁ চিনি। তবে ও খুবই নির্বিবাদী মানুষ ছিল। ঝামেলা এড়িয়ে চলত। ওকে যে কেউ এভাবে খুন করবে ভাবতে পারিনি।” রুমেলা ফুঁপিয়ে উঠলেন। তারপর নিজেকে সামাল দিয়ে বললেন, “ছেলেটা খুব শকড। বাবা ছাড়া তো কিছু বুঝত না। এখন খুব চুপচাপ হয়ে গেছে।”

“আপনাদের দুজনের সম্পর্ক কেমন ছিল? মানে কোনওরকম রাগারাগি বা মান অভিমান?”

“কোন সম্পর্কে হয় না বলুন? বিবাহিত জীবনে ঝগড়া ঝাটি, রাগারাগি তো হয়েই থাকে। কিন্তু ও যে আমায় ঠকাচ্ছে একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি, বিশ্বাস করুন।”

“আপনার স্বামীর সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে উনি খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলেন। কর্মক্ষেত্রেও যথেষ্ট নাম ছিল। তবে ওঁর মৃতদেহ যেখানে পাওয়া গেছে, জায়গাটা ওঁর ব্যাক্তিত্বের সাথে কোনওভাবেই খাপ খায় না। তাই আমাদের সন্দেহ ওঁকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে এবং তারপর অভীষ্ট সিদ্ধি করে খুন করা হয়েছে। তাই বলব এখনি মানুষটাকে এতটা ঘৃণা করবেন না প্লিজ।” মৃত্তিকা উঠে দাঁড়াল। বলল, “আজ আসি। তবে তদন্তের খাতিরে আবার আসতে হতে পারে। আশা করি আপনার সাহায্য পাবো। বলে রাখি যে সুহৃদ বাবুর খুনি কিন্তু শুধুমাত্র একজন মানুষের খুনি নয় আরও তিনজনকে খুন করেছে। তাই আপনি কেস ফাইল করুন আর না করুন আইন তাকে খুঁজে বের করবেই। আসি।”

   সুহৃদ সান্যালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মৃত্তিকা চলে এলো বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটি হাউসিং কমপ্লেক্সে। ফাইল অনুযায়ী সুহৃদের আগে যে মৃত ব্যাক্তিটিকে একইভাবে উদ্ধার করা হয়েছে তার বাড়ি এখানেই। ঠিকানা খুঁজতে একটু বেগ পেতে হল ওকে। চারতলার একটি ফ্ল্যাটে কলিং বেল বাজানোর কিচ্ছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন একজন বৃদ্ধ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও শরীরে তার কোনও ছাপ নেই। মৃত্তিকাকে দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,” ইয়েস?” মৃত্তিকা নিজের কার্ড দেখিয়ে বলল, “কৌশিক ঘোষের মৃত্যু সম্পর্কে তদন্ত করতে এসেছি।” বৃদ্ধ একটু যেন থমকালেন। তারপর দরজা থেকে সরে এসে মৃত্তিকাকে ভেতরে ঢোকার রাস্তা বানিয়ে দিলেন। দু’কামরার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটের অপরিসর ডাইনিং কাম ড্রইং রুমের একটি চেয়ার দখল করে মৃত্তিকা জিজ্ঞাসা করল, “আপনার নাম?” লোকটি গম্ভীরভাবে দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “নেমপ্লেট টাঙ্গানো আছে। লক্ষ্য করেননি? অনিমেষ হালদার।” মৃত্তিকা ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, “আপনি একা থাকেন?” বৃদ্ধ মাথা নেড়ে জানালেন, তিনি একাই থাকেন।

“আপনার পরিবার?”

“নেই।”

“নেই মানে?”

“নেই মানে নেই। আমি একা থাকি।”

“কৌশিক তো আপনার সাথেই থাকত।”

“হ্যাঁ। থাকত। তবে ও আমার পরিবারের কেউ নয়।”

“তাহলে কে?”

“আমার কলিগের ভাইপো। মেদিনিপুরে থাকত। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে বিএসসি পড়ছিল। পেইং গেস্ট হিসেবে থাকত আমার কাছে। সরল সাদা গাঁয়ের ছেলে বলেই তো জানতাম। সে ছেলের পেটে পেটে যে এসব কীভাবে জানব বলুন?”

“এসব মানে কিসব?”

“গাঁজা খেয়ে বাড়ি ফিরত। ভাবত বুঝতে পারছি না। সব বুঝতাম। আমি চল্লিশ বছর মেডিক্যাল লাইনে ছিলাম। আমি বুঝব না? তারপর ওর মৃত্যুর পরে ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে খাটের তলা থেকে ডজন ডজন মদের বোতল, সিগারেটের প্যাকেট, ড্রাগের সিরিঞ্জ। একেবারে বখাটে হয়ে গেছিল। নিজে তো মরলই আমাকেও মারছে।”

“বুঝতে পারছি আপনার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। তবে ওর ঘরটা এখনই হাত না দিলেই পারতেন। আপনাকে পুলিশ এসে কিছু বলেনি?”

“না কিছুই বলেনি। তবে ওর কোনও জিনিস ফেলে দিইনি। ফেলব কীভাবে বলুন? কাজের মেয়েটা এত জিনিস দেখে ক্ষেপে লাল। জমাদারকে বললাম ওপরে এসে নিয়ে যাও। সে বলে দুশ’ টাকা দিলে তবে আসব। আমি কেন ফালতু খরচ করব বলুন তো? ভাড়াটাও তো পেলাম না লাস্ট মাসের। আপনাদের প্রয়োজন হলে আপনারা নিয়ে যান। আমি রেহাই পাই।” ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে মৃত্তিকার হাসি পেল। সে নিজেকে সামলে বলল, “আপাতত মালগুলো দেখে যাই। তারপর যা যা প্রয়োজন হবে আমাদের লোক এসে নিয়ে যাবে। আমি খবর দিয়ে দেব।”

“আর বাকিগুলো?”

“সময় লাগবে। বুঝতেই পারছেন সরকারি ব্যাপার। আঠারো মাসে বছর।”

অনিমেষ বাবু নিমের পাঁচন গেলা মুখ নিয়ে কৌশিকের ঘর খুলে দিলেন। দরজা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে ঠেকল। অনেকদিন বন্ধ পড়ে থাকায় বাসি তামাকের গন্ধ মিশে একটা উদ্ভট গন্ধের সৃষ্টি করেছে। মৃত্তিকা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাল। জানলা খুলে দিল পশ্চিম দিকের। দুপুরের কড়া রোদ এসে পড়ল কৌশিকের স্যাঁতস্যাঁতে বিছানায়। ঘরের এক কোণে জড়ো করা আছে একুশ বছর বয়সী ছেলেটির সব দরকারি জিনিসপত্র। বোটানি অনার্সের বইগুলোয় ধুলোর আস্তরণ জমেছে। নোটসের খাতা, বাসের টিকিট, ক্যান্টিনের বিল, জেরক্স কপির ভিড়ে ভীষণ অস্বস্তিকরভাবে উঁকি মারছে খানকতক সিরিঞ্জ, সিগারেটের প্যাকেট, মদের বোতল। একদিকে আলো, আরেকদিকে অতলান্ত আঁধার। সবকিছু খুঁজে যখন আশা ব্যঞ্জক কিছুই পেল না মৃত্তিকা ঠিক তখনই চোখে পড়ল একটি খাতার পেছন দিকে লেখা ইংরেজি হরফে লেখা একটি ওয়েবসাইটের নাম, “findyourlove.com”। মৃত্তিকা হাতে তুলে নিল খাতাটি। ব্যাগের মধ্যে সেটিকে চালান করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “এই ঘরটি যেমন আছে তেমন থাক। আমরা না বলা অবধি কোনও জিনিস যেন মিসিং না হয়। আর কৌশিকের বাড়ির ঠিকানা এবং নম্বর আমায় দিন। আমাদের প্রয়োজন।”

  রাস্তায় নেমে এসে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে মানিকতলা যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে একটি নম্বরে ফোন লাগাল মৃত্তিকা। ওপাশ থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল, “আরে মৃত্তিকা ম্যাম! এতদিন পরে মনে পড়ল এই অধমকে? বলুন কী সেবা করতে পারি।” মৃত্তিকা হেসে বলল, “এভাবে বলও না প্রিয়ম। এখানে এসে যেকোনো কেসে আমি তোমাকেই মনে করি। আই নো ইউ আর দ্য বেস্ট।“ প্রিয়ম কম্পিউটার সফটওয়্যার ডেভলপার। ফ্রিল্যান্স কাজ করে। একটি কেসের সূত্রে মৃত্তিকার সাথে আলাপ হওয়ার পর থেকে মৃত্তিকা টেকনিক্যাল যেকোনো সমস্যায় প্রিয়মকেই মনে করে। প্রিয়ম খুশি হয়ে বলল, “বেশ। অনেক হল। এবার বলুন কী করতে হবে?” মৃত্তিকা প্রিয়মকে একটি ছবি পাঠিয়ে দিয়ে বলল, “এই ওয়েবসাইটটার নাড়ি নক্ষত্র আমার চাই।” প্রিয়ম একবার চোখ বুলিয়ে বলল, “ব্যস? হয়ে গেছে ভেবে নিন। এক ঘণ্টার মধ্যে সব ইনফরমেশন পাঠাচ্ছি।” মৃত্তিকা খুশি হয়ে ফোন রাখতেই আবার বেজে উঠল ওর ফোন।

অফিসার মোদকের ফোন পেয়েই হাসাপাতালে ছুটে এলো মৃত্তিকা। মৃত্তিকাকে দেখে এগিয়ে এলো নিলয়। কলকাতায় কাজ করার সময় নিলয় ছিল মৃত্তিকার জুনিয়র। অনেক কেসে ওকে সাহায্য করেছে। নিলয়কে দেখে মৃত্তিকা আশ্বস্ত হল। নিলয়ের সাথে তার কাজের প্যাটার্ন মিলে যায় আশ্চর্যজনকভাবে। তাই এই কেসে নিলয়কে পাওয়ায় মৃত্তিকার সুবিধাই হল। কাছে গিয়ে হাত মিলিয়ে মৃত্তিকা জিজ্ঞাসা করল, “মোদক স্যারের কাছে খবরটা পেয়েই চলে এলাম এখানে। তুমি কতটা জানতে পারলে নিলয়?” নিলয় চিন্তিত মুখে বলল, “আগের ঘটনাগুলোর মতো এটাও মার্ডার কেস হয়ে যেত ম্যাডাম তবে ছেলেটির কপাল ভালো এবং আমি তো বলব বেশ সাহসী। নাহলে যে পরিমাণ অত্যাচার ওর শরীরের ওপর করা হয়েছে তারপরেও নিজেকে ডিফেন্ড করার সাহস দেখানো ছোটখাটো ব্যাপার নয়।” মৃত্তিকা জিজ্ঞেস করল, “ওর জ্ঞান ফিরেছে? ওর কাছে তো তাহলে অনেক ইনফরমেশন পাওয়া যাবে।” নিলয় শুকনো মুখে বলল, “এখানেই তো সমস্যা ম্যাম। ছেলেটির কখন যে সেন্স ফিরবে ডাক্তার বলতে পারছেন না। তবে ছেলেটির মানিব্যাগ থেকে পাওয়া আইডি কার্ড অনুযায়ী এটুকু জানা গেছে যে ছেলেটি বিহারের বাসিন্দা। নাম বিলাস সাধু। এখানে কেন এসেছে জানা যায়নি।” নিলয়ের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল মৃত্তিকার ফোন। প্রিয়ম ফোন করেছে। ফোন কানে দিতেই ওদিক থেকে প্রিয়ম বলে উঠল, “সমস্ত তথ্য জোগাড় হয়ে গেছে ম্যাম। আপনাকে ফাইলটা মেইলও করে দিয়েছি। যে ওয়েবসাইটটার নাম পাঠিয়েছেন সেটি একটি ডেটিং ওয়েবসাইট। দেশের ও বিদেশের লক্ষ্য লক্ষ্য ছেলেমেয়ে, এমনকি মাঝবয়সিরাও এতে অ্যাকাউন্ট খুলে বসে আছে পার্টনার খুঁজে পাওয়ার জন্য। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে একটা মধুচক্রও গড়ে উঠেছে। তাছাড়া, এর বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে এটি সম্পূর্ণ ফ্রি। ফলে যে কেউ বিনা ব্যয়ে খাতা খুলে বসে আছে। বছর দুয়েক হল ওয়েবসাইটটা চালু হয়েছে এবং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র ডেটিংই নয়, সেক্স চ্যাট, ভিডিও চ্যাট এসবের রমরমাও বেড়েছে এখানে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে সবই ঘটছে আইনের নাকের ডগায়। আচ্ছা আপনার আবার এসবের দরকার পড়ছে কেন?”

প্রিয়মের শেষ কথাটি গুরুত্ব না দিয়ে মৃত্তিকা বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ প্রিয়ম। এতকিছু যখন জানিয়েই দিলে, তখন কয়েকটা নাম পাঠাচ্ছি তাদের অ্যাকাউন্ট ডিটেলসটাও জানিয়ে দাও। আশা করি সেইসব অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা তোমার পক্ষে খুব একটা কঠিন হবে না?”

প্রিয়ম হালকা হেসে বলল, “ইউ আর উইকেড ম্যাম।”

প্রিয়মের সাথে কথা শেষ করে মৃত্তিকা আহত ছেলেটির কেবিনে ঢুকল নিলয়ের সাথে। প্রায় সারা গায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কপাল ফেটে গেছে। ঘাড়ে চোট লেগেছে। পেটের কাছেও রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ বাঁধা। ডাক্তারকে কাছকাছি না পেয়ে নার্সের কাছে সমস্ত কেস হিস্ট্রি জানল মৃত্তিকা। ছেলেটিকে যৌন নির্যাতন করার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু সফল হয়নি দুষ্কৃতি। তার আগেই কোনওভাবে মুক্তি পায় ছেলেটি। মৃত্তিকা ভালো করে দেখল ছেলেটিকে। বয়স চব্বিশ পঁচিশ বছরের কাছাকাছি। সুন্দর, সুঠাম এবং আকর্ষণীয়। এরকম ছেলে যেকোনো মেয়ের কাছে লোভনীয়। সমকামি ছেলেদের কাছেও। তাহলে কেন কেউ খুন করতে চাইবে একে?

নিলয়ের দিকে তাকিয়ে মৃত্তিকা বলল, “নিলয় আমার হয়ে একটা কাজ করতে হবে তোমায়।” নিলয় সোৎসাহে বলল, “বলুন ম্যাম।”

“কয়েকটা ঠিকানা দিচ্ছি। সেখানে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আসতে হবে। আমার পক্ষে এখন কলকাতা ছাড়া সম্ভব হবে না।”

নিলয় আশ্বস্ত করল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাম। আপনি ঠিক যেভাবে চাইছেন, সেভাবেই কাজ হয়ে যাবে।”

“আমি কিন্তু খুব রেগে আছি তোমার উপর।” বলল কথা। মৃত্তিকা ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, “কেন বল তো?”

কথা ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানার ওপর, “কেন মানে? আমি যে তোমায় বলেছিলাম তোমার সাথে ইনভেস্টিগেশনে যাব। ভুলে গেছ তো? দু’দিন ধরে ঘুরে বেরাচ্ছ। এদিকে আমায় নিচ্ছ না।”

মৃত্তিকা এবার সোজা হয়ে বসল। আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, “ভেবলি রানী, আমি ফেলুদার মতো শখের গোয়েন্দা নই। সরকারি প্রত্যেকটা কাজের একটা ডেকোরাম আছে। তোকে আমি লেজুড় বানিয়ে ঘুরলে যদি তোর উপর হামলা হয়, আমাকেই তো জবাবদিহি করতে হবে নাকি?” কথা এদিকে নাছোড়বান্দা, “আমি জানি না সেসব। আমায় একদিন নিয়ে যেতে হবে ব্যস। কে বলতে পারে আমিই তোমার কাজে লেগে গেলাম।” মৃত্তিকা বুঝল এই মেয়েকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আপাতত মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য বলল, “বেশ আজ রাতটা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নে, কাল সকালে তোকে নিয়ে বেরোব।”

“প্রমিস করলে তো?”

“তিন সত্যি।”

“ওকে গুড নাইট।”

মৃত্তিকা হেসে আবার শুয়ে পড়ল বিছানায়। বেশ কয়েকটা হিসেব মেলাতে হবে। একে একে দুই হলেই অনেক ধোঁয়াশা কেটে যাবে। পরপর সাজিয়ে নিল ঘটনাগুলো সে।

১. আহত এবং নিহত ব্যাক্তিদের সাথে দুষ্কৃতি বা বলা চলে শিবানী নামের মেয়েটি ডেটিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছে।

২. ওয়েবসাইটে ছবি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও শিবানীর কোনও ছবি নেই।

৩. সুহৃদ সান্যাল বাদে প্রত্যেকটি ছেলের বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে।

৪. প্রত্যেকটি খুন হয়েছে রাত্রিবেলা, একটি সস্তার হোটেলে।

৫. শিবানী নিজেই যোগাযোগ করেছে ছেলেদের সাথে। একমাস যাবৎ চ্যাট চলার পরে নিজেই প্রস্তাব দিয়েছে দেখা করার।

৬. প্রত্যেকটি খুনের ক্ষেত্রে শিবানী নিজেই স্থান ও সময় ঠিক করেছে কিন্তু রুম বুকিং হয়েছে ছেলেটির নামে।

৭. বেছে বেছে এমন হোটেল বুক করা হয়েছে যেখানে কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা নেই।

৮. শিবানীর কোনও পরিচয়পত্র পাওয়া যায়নি।

৯. প্রত্যেকটি খুনের লোকেশন আলাদা আলাদা।

১০. তৃতীয় ব্যাক্তিটি কে বা আদৌ কোনও তৃতীয় ব্যাক্তি আছে কিনা সেই ব্যাপারে এখনও একটা ধোঁয়াশা রয়েছে।

মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপ করে আবার মাথা রাখল বালিশে। সারাদিন ধরে ঘুরে ঘুরে এই কয়েকটি তথ্য জোগাড় হয়েছে। নিলয় ফিরলে আরও তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু তাতেও কি হিসেব মিলবে? যে বা যারা এই কাজটি করছে সে অত্যন্ত ধূর্ত। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতের অন্ধকারে কাজটি করে যাচ্ছে তারা। কিন্তু একজন পুরুষকে ধর্ষণ করে কিই বা পাচ্ছে তারা? কী লাভ হচ্ছে এই কাজে? খুন করার কোনও মোটিভই কি নেই?

 নাহ আর পারছে না মৃত্তিকা। প্রচণ্ড চাপ পড়ছে মাথায়। ফ্লাস্ক থেকে এক কাপ কড়া গরম কফি ঢেলে ঘর লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল সে। সিগারেট, চা বা অন্য কোনও নেশার তুলনায় এই কফিই মৃত্তিকার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে। মাথা ছেড়ে যায় নিমেষে। নতুন ভাবনা ভাবতে ইচ্ছে করে। রাত নেমে এসেছে অতি সন্তর্পণে। রাতের অন্ধকারে চেনা মানুষ, চেনা শহর সবকিছুই কেমন অন্যরকম লাগে। অচেনা মনে হয়। শুধু মানুষ নয়, জড়বস্তু, প্রাণী সবকিছুরই আলাদা একটা অচেনা দিক থাকে। একটা রহস্যময় কোণ। সবাই যদি সবকিছু বুঝে যেত তাহলে জীবনটা বড় পানশে মনে হত।

  রাস্তার দিকেই তাকিয়েছিল মৃত্তিকা। ভাবছিল নানান হাবিজাবি কথা। হঠাৎ একটা দৃশ্য চোখে পড়তেই ওর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো সেদিকে চেয়ে রইল সে। তারপর কাপটা ব্যালকনিতে ফেলেই দৌড় লাগাল দরজার দিকে।

লিফটের জন্য অপেক্ষা করার সময় ছিল না। সিঁড়ি বেয়ে দুর্বার গতিতে গেটের সামনে এসে আটকে গেল মৃত্তিকা। তালা ঝোলানো। নাইট গার্ড আশেপাশে নেই। শূন্যে একটা ঘুষি ছুঁড়ে মৃত্তিকা বসে পড়ল সিঁড়ির ল্যান্ডিঙে। পেছন থেকে একজনের কণ্ঠস্বরে চকিতে ফিরে তাকাল সে। কথা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার পেছনেই। হতবাক এবং একটু ভয় পেয়েছে। কাঁপা গলায় বলল, “কী হয়েছে মৃত্তিকা দি? তুমি এভাবে ছুটে এলে কেন?” মৃত্তিকা নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়াল তারপর চারিদিক দেখে নিয়ে বলল, “ঘরে চল। বলছি।”

  “কী বলছ? এই এলাকায় তো চোর ছ্যাঁচড় তেমন নেই। সিরিয়াস কিছু হলে তো ওদের একবার কল করে বলা উচিত।” বলল কথা। পরিমল বলল, “রাত একটা বাজে। এখন ফোন করা কি ঠিক হবে?” নয়না কিছুই বলল না। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। মৃত্তিকার চোখে এখনও ভাসছে একটু আগে দেখা দৃশ্যটা। জমাট অন্ধকারে সে দেখতে পেল অসিত মিত্রের বাড়ির পাইপ বেয়ে একটা ছায়া শরীর নেমে এলো সন্তর্পণে। তারপর হাঁটা লাগাল বড় রাস্তার দিকে। যে গতিতে সে হাঁটছিল তাতে তাকে ধরতে পারার আশা রাখেনি মৃত্তিকা। তবু শেষ চেষ্টা করেছিল। পরিমল ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “নাহ, বলেই দিই। যদি এরপর আরও বড় কোনও ক্ষতি হয়ে যায় ওদের?” মৃত্তিকা মাথা নেড়ে সায় দিল।

   ফোনের রিংটোনে সদ্য আসা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল অসিতের। ধড়ফড় করে উঠে বসে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই অবাক হলেন। এত রাতে পরিমল কেন ফোন করেছে? কল রিসিভ করে উদ্বিগ্ন স্বরে কিছু বলার আগেই পরিমল বলে উঠল, “অসিত দা, আপনাদের বাড়িতে সবকিছু ঠিক আছে তো?” অসিত অবাক হলেন, “ঠিক আছে মানে? বুঝলাম না।” পরিমল ধীরে ধীরে সময় নিয়ে মৃত্তিকার দেখা দৃশ্যের বর্ণনা করল। অসিত ধৈর্য নিয়ে সবটা শুনলেন। এসিতে বসেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। গলা শুকিয়ে এলো। অতর্কিতে হৃদপিণ্ডটা লাফাতে চেয়েও লাফালো না। পরিমলকে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ পরিমল। আমি দেখছি চারিদিক। যদিও কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা কম। আমাদের মেন গেট থেকে ছাদের গেট সবই তালা বন্ধ থাকে। তবু আজ রাতটা আমি সজাগ থাকব।”

  ফোনটা টেবিলে রেখে অসিত বালিশে হেলান দিলেন। পারমিতা সজাগ হয়ে শুনছিলেন সবকিছু। পাশের টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে জল খেলেন অনেকটা। তারপর স্বামীর মুখের দিকে নিরুপায় হয়ে চেয়ে রইলেন। অসিত গম্ভীরভাবে বললেন, “ও আজ আবার বেরিয়েছে? কতবার বারণ করেছি। কী করো তুমি? বোঝাতে পারছ না? এবার জানাজানি হয়ে গেলে আমি সামলাতে পারব না।” পারমিতা আত্মপক্ষ সমর্থনের বৃথা চেষ্টা করলেন। অসিত শুনলেন না। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।

১০

গত রাতের কথা ক্রমে ফিকে হয়ে এলো। অফিস, কলেজ, কাজের তাড়নায় ব্যস্ত হয়ে গেল সকলে। নিলয়ের ফোন পেয়েই মৃত্তিকা ছুটল অফিসে। নিলয় মেদিনীপুর সহ আরও কয়েকটি জেলা ঘুরে মৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য নিয়ে এসেছে। বিহার থেকে আনা হয়েছে আহত বিলাসের পরিবারকে। কেবিনে ঢুকেই নিলয়ের সাথে বসে পড়ল মৃত্তিকা। একে একে নোট করল সমস্ত তথ্য।

“বলো নিলয় কী কী ইনফরমেশন জোগাড় করেছ?” চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল মৃত্তিকা। নিলয় ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে বলতে শুরু করল, “প্রথমে গিয়েছিলাম মেদিনীপুরে। কৌশিক ঘোষের বাড়িতে। দরিদ্র ঘরের ছেলে তবে মেধাবী। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে সেরা দশের তালিকায় নাম ছিল। কলকাতায় আসে উচ্চ শিক্ষার জন্য। বাবা নিজস্ব জমিতে চাষ করেন, মা সেই কাজে হাত লাগান। কাকার সাহায্যে কলকাতায় একটি মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছে। তবে নিজের কাকা নয় বাবার মাসতুতো ভাই। এবার এখানে এসে বড় শহর, স্বাধীনতা পেয়ে ডানা গজায়। বিপথে চলে যায় কৌশিক। ইংরাজি বলতে না পারা ডিপ্রেশনের একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হতাশা মেটানোর পথ সে খুঁজে পায় নেশার মধ্যে। বাড়িতে পাঠানো টাকা উড়ে যায় নেশার জিনিস কিনতেই। আর তারপর…” নিলয় থামে। বাকিটা উহ্য থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। মৃত্তিকা বলে, “হতাশা কাটানোর আরেকটি পথও সে বেছে নেয়। পার্টনার খোঁজার মাধ্যমে। ডেটিং ওয়েবসাইটে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে সেক্স চ্যাট, ভিডিও চ্যাট করতে শুরু করে এবং অবশেষে সে পায় শিবানী নামক এই মেয়েটিকে যে তাকে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডের অফার দেয়। কৌশিক প্রস্তাব লুফে নেয়। নিজেকে শহুরে দেখানোর এর থেকে বড় উপায় আর কী হতে পারে?” নিলয় মাথা নাড়ে।

মৃত্তিকা বলে, “বেশ এরপর?”

“এরপর গেলাম হাওড়া। শুভজিৎ সেনের বাড়ি। গত মাসের পাঁচ তারিখে পার্ক স্ট্রিটের কাছের একটি হোটেলে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছিল। খুনের প্যাটার্ন এক। হাওড়া কলেজের কৃতী ছাত্র। কলকাতায় চাকরি করে একটি কলেজের ইংরাজির পার্ট টাইম লেকচারার হিসেবে। চাকরির চেষ্টা চালিয়েছে বহুদিন ধরেই তবে রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি কলেজ থেকে অফার এলেও সেগুলি পার্মানেন্ট নয়। আর রাজ্যে সে অবহেলিত। পাঁচ বছরের প্রেম ভেঙ্গে যায়।  হতাশা এমন পর্যায়ে নেমে যায় যে মানসিক ডাক্তার দেখাতে হয়। কোনও এক বন্ধু এই ডেটিং ওয়েবসাইটে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেয়। বাড়ির লোকও সাত পাঁচ না ভেবে শুভজিৎকে উৎসাহ দিতে থাকে এই ভেবে যে ছেলে একটা নতুন সঙ্গী পেলে আবার স্বাভাবিক হবে। কিন্তু হল তার উল্টো।”

“এরপর পৌঁছলাম বিশাল আদকের বাড়ি। ডায়মন্ড হারবারে বাড়ি। কলকাতার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। ওখানেই লেখাপড়া, পারিবারিক মাছের ব্যবসা চালায়। বিয়ে হয়েছে দু’বছর হল। কলকাতা আসা যাওয়া কর্মসূত্রেই। বাবা নেই। মা এবং স্ত্রী উভয়েই গৃহবধূ। ছেলে বা স্বামী কী করছে, কেন করছে, কোথায় যাচ্ছে – সেসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তারা এখনও পর্যন্ত একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। পাড়া প্রতিবেশিদের থাকা পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হি ওয়াজ এ ক্লিন পারসোনালিটি। বন্ধু, বান্ধব খুব সীমিত। নেশা করে বলে কেউ শোনেনি বা দেখেনি। কেন  এবং কিভাবে এই চক্করে পড়ে গেছিল এখনও ক্লিয়ার হচ্ছে না।“

“বেশ। নেক্সট?”

“লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট সুহৃদ সান্যাল। বাড়ির বড় ছেলে। ছোট ভাই সরকারি চাকুরে। বোন বিবাহিতা এবং স্কুল শিক্ষিকা। বাবা মায়ের বয়স হয়েছে। কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকলেও পরিবারের দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করতে কোনও কার্পণ্য দেখাতেন না। কলকাতার বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সংসার। সুখের সংসারই বলা যায়। কর্মক্ষেত্রেও সুনাম ছিল। তবে প্রিয়মের দেওয়া চ্যাটের স্ক্রিনশট অনুযায়ী বোঝা যায় উনি ভেতরে ভেতরে একাকীত্বে ভুগছিলেন। ফলে সংসার, পরিবার, চাকরির বাইরেও একটা জীবন খোঁজার তাগিদে এই চক্রে পা রাখেন।”

নিলয় থামল। তারপর বলল, “এদের মধ্যে একমাত্র বিশালের ওয়েবসাইটে কোনও অ্যাকাউন্ট ছিল না। তাছাড়া, হোটেলেও বিশালের নামে কোনও বুকিং ছিল না। খটকাটা এখানেই।” মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে, চুপ করে সবকিছু শুনল। তারপর বলল, “একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ নিলয়? প্রত্যেকটি ভিকটিম কিন্তু কোনও না কোনওভাবে মানসিকভাবে অবসাদে ভুগছিল বা হতাশাগ্রস্ত ছিল। একমাত্র বিশাল আদকের ব্যাপারটাই ক্লিয়ার হচ্ছে না। আচ্ছা এই বিহারের ব্যাক্তিটি মানে মিস্টার সাধু, ওর কী খবর?” নিলয় বলল, “ওর বাড়ির লোক এখনও এসে পৌঁছয়নি ম্যাডাম। তবে বিলাসের সাথেও শিবানীর যোগাযোগের সূত্র ওয়েবসাইটের হিস্ট্রিতে নেই। বরং ওর কললিস্ট চেক করে তথ্য পাওয়া গেছে। সেই রাত্রে একটি নম্বর থেকে প্রায় চারবার ফোন এসেছিল। নম্বরটি বর্তমানে সুইচড অফ বলছে। তবে ট্র্যাক করে জানা গেছে বালিগঞ্জের কাছাকাছি একটি দোকান থেকে সিম কেনা হয়। ক্রেতার নাম অনিকেত সাহা। হতে পারে খুন করার পরে খুনি সিমটা নষ্ট করে দিয়েছে।“ মৃত্তিকা অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে বলল, “এই অনিকেত সাহার ডিটেলস আমার চাই। আর বিলাস সাধুর বাড়ির লোক এলেই আমার কাছে যেন পাঠানো হয়।” ইতোমধ্যে একজন কনস্টেব্ল এসে জানালো দু’জন দেখা করতে এসেছেন। মৃত্তিকা তাদের ভেতরে আসতে বলল। একজন সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তি এবং মহিলা মৃত্তিকার কেবিনে ঢুকলেন। উদ্ভ্রান্ত চেহারা, বিধ্বস্ত শরীর। চেয়ারে বসেই কেঁদে ফেললেন দু’জনেই। বিলাস সাধুর বাবা মা। তাঁরা জানালেন এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছিল বিলাস বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে। তারপর কী থেকে কী যে হয়ে গেল কিচ্ছু জানেন না তাঁরা। বিলাসের একটি মেয়ের সাথে বিয়ের কথাও পাকাপাকি হয়ে গেছে। তারপরেও কার মন্ত্রণায় এই চক্রে সে ঢুকে পড়ল বুঝতে পারছেন না তাঁরা। মৃত্তিকা তাঁদের আশ্বস্ত করে। তদন্ত চলছে এবং খুব তাড়াতাড়িই অপরাধী ধরা পড়বে। বিলাসের বন্ধুর ফোন নম্বর ও ঠিকানা লিখে নিয়ে সাধু পরিবারকে ছেড়ে দেয় মৃত্তিকা। তবে কেস চলা কালীন তাঁরা কলকাতা ছাড়তে পারবেন না এই মুচলেকা লিখে দিতে হল দু’জনেই।

বিলাসের বাবা মা চলে গেলে মৃত্তিকা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল। ধীরে ধীরে আরও জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। তবে মেয়েটি যে বেশ ধূর্ত সেকথা মানতেই হবে। গতকাল প্রিয়ম নিহতদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তাদের সমস্ত তথ্য, চ্যাটের স্ক্রিনশট দিলেও জানিয়ে দেয় অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও শিবানীর অ্যাকাউন্ট সে হ্যাক করতে পারছে না কিছুতেই। সফটওয়্যারে বারবার টেকনিক্যাল গ্লিচ দেখা দিচ্ছে। এমনকি ওর নিজের কম্পিউটার ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। মৃত্তিকা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে। মৃদু মৃদু ঘুষি মারে টেবিলে। আজ পর্যন্ত কোনও কেস তার হাতে সমাধান না হয়ে যায়নি। এই শিবানী যতই ধূর্ত হোক, যতই টেকনিক্যালি শক্তিশালী হোক আইনের হাতে ধরা তাকে পড়তেই হবে।

১১

“কতবার বোঝাতে হবে তোকে অভি? কাল কথাদের বাড়ির লোকেরা দেখেছে। আজ অন্য কেউ দেখবে। আমরা কত সামলাবো? আর পারছি না যে আমি!” চোখের জলে গাল ভাসিয়ে ছেলের কাছে অনুনয় করলেন পারমিতা। অভিজিতের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কঠোর চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার খুব ভালোলাগে বলো? যে যন্ত্রণা রোজ রাত্রে আমি সহ্য করি তার ছিটেফোঁটার আভাসও তোমরা পাও না। একা ফেলে যাও এই নরক যন্ত্রণায়। আর এখন এসে বড় বড় কথা বলছ! কেন চলে এসেছিলে কল্যাণীর বাড়ি ছেড়ে। ছেড়ে তো আসনি পালিয়ে এসেছিলে তোমরা সমাজের ভয়ে। যে পাপ তোমরা করেছ তার ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে আমাকে। আমি ঘেন্না করি তোমাদের। ঘেন্না করি মা।”

“অভি!” আর্তনাদ করে কেঁদে ফেললেন পারমিতা। কিন্তু অভিজিতের কাছে এসব ফাঁকা অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। দুটি ভীতু, কুয়োর ব্যাঙ মানসিকতার মানুষের জন্য ওর শৈশব, যৌবন শেষ হয়ে গেল। হুইল চেয়ারে জীবন যাপন করতে হয় ওকে। এর প্রতিশোধ তো তাকে নিতেই হবে। যে কোনওভাবে, যে কোনও পদ্ধতিতে।

১২

             “তোমার সাথে খুব দেখা করতে ইচ্ছে করে শিবানী। কবে আমাদের দেখা হবে? আমি যে আর পারছি না।”

“হবে ডার্লিং। হবে। সময় এলেই দেখা হবে। তারপর তুমি আর আমি আজীবন একসাথে থাকব।”

“প্রমিস?”

“প্রমিস, প্রমিস।”

“আমি কিন্তু অপেক্ষা করছি সেই দিনের জন্য।”

“বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।”

“আচ্ছা তোমার তো একটা ছবি রাখতে পার। তাহলে সেটা দেখেই মনের জ্বালা জুড়াতাম।”

“সে তো রাখতেই পারি। তবে রাখলে যে তোমার মনে জ্বালা ধরাতে পারতাম না।”

“তুমি কত সুন্দর কথা বলো শিবানী। আর আমার বৌটা সারাক্ষণ আমার পিছনে খিটখিট করে চলেছে। আমি আর পারছি না ওর সাথে থাকতে। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর তোমার অনুমতি নিয়ে কোর্টে যাব। ওকে আমি ডিভোর্স দেব। তোমায় করব আমার জীবন সঙ্গিনী। তুমিই একমাত্র বুঝেছ আমার কষ্টগুলো। খুব তাড়াতাড়ি দেখা করো সোনা প্লিজ।”

“করব, করব। জানো না, সবুরে মেওয়া ফলে?”

“জানি তাই তো অপেক্ষা করছি শিবানী।”

“বেশ অনেক রাত হল। এবার ঘুমিয়ে পড়ো।”

“তোমার সাথে ঘুমাব।”

“ঘুমাতে দেবে?”

“নাহ, সারা রাত তোমায়…”

“যত্তসব পাগলামি! গুড নাইট হানি।”

“গুড নাইট সুইট হার্ট।”

লগ আউট হয়ে মনে মনে হাসল শিবানী। আবার একটা শিকার পাওয়া গেছে। ছেলেটা জানেই না যে এতক্ষণ সে তার যমের সাথে কথা বলছিল। আর কিছুদিনের মধ্যেই তার মৃত্যুর দিন ক্ষণ ঠিক করে দেবে শিবানী নিজেই। হুহ! ভালোবাসা, প্রেম। শব্দগুলো এই স্বার্থপর দুনিয়ায় বড়ই ঠুনকো। সব শঠ, প্রতারকদের শেষ করে দেবে শিবানী। যে জ্বালা তার বুকের মধ্যে আজও দাউদাউ করে জ্বলছে সেই আহুনে ছাই করে দেবে গোটা পুরুষ সমাজকে।

  আজ সুন্দর করে সাজল শিবানী। আরও একটা পুরুষ, আজ আরেকটা প্রেমিক, মানে আরও একটা শিকার। চোখে কাজল, মাশাকারা, আই ল্যাশ, আই শ্যাডো, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, মুখে ফাউন্ডেশন, পাউডার, সুগন্ধি পারফিউম। আজ ছেলেটা পাগল হয়ে যাবে তাকে দেখে। শরীরী আবেদনে মাতাল করে দেবে ছেলেটিকে। তারপর ঠিক সময়ে কাজ হাসিল করে খেল খতম। নিজের মনেই খিলখিল করে হেসে উঠল শিবানী। কি বোকা ছেলেগুলো! এতজন মরে গেল তাও যে কিসের টানে আসে এরা? আচ্ছা এখনও কি মিডিয়া জানে না খবরটা? নাকি ওদের জানতে দেওয়া হচ্ছে না? পুলিশ কি এতটাই চালাক হয়ে গেল আজকাল? একটা চোরা স্রোত বয়ে গেল শিবানীর শরীর বেয়ে। পর মুহূর্তেই সেইসব আবেগকে পাশে সরিয়ে রেখে সে ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢেকে নিল একটি টাইট টপে। আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিল নিজেকে। বুঝে নিতে চাইল ঠিক কতটা আবেদনময়ী লাগছে নিজেকে। আবার খিলখিল করে হেসে উঠল শিবানী। এই হাসির মধ্যে অনেকটা কান্না মিশে আছে। মিডিয়া জানুক আর না জানুক পুলিশ যে এই ব্যাপারটা টের পেয়েছে সেটা মৃত্তিকা রুদ্রের কলকাতায় পদার্পণেই বোঝা গেছে। কিন্তু পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কেউ শিবানীর সাথে পাল্লা দিতে পারবে না। শিবানীর হাত থেকে মুক্তি নেই কোনও প্রতারকের।

   আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখল একজোড়া চোখ তার দিকে একতাল ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে। শিবানী হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে?” কোনও উত্তর এলো না। চোখ দুটো অন্ধকারে মিশে গেল। শিবানী আর অপেক্ষা করল না। বেরিয়ে এলো বাড়ির বাইরে। ঘড়িতে রাত বারোটা। অনুপমকে সময় দেওয়া আছে সাড়ে বারোটার। হোটেলটা তাদের বাড়ি থেকে কুড়ি মিনিটের দুরত্বে। নিজের ইলেকট্রিক স্কুটিতে চেপে নিঃশব্দে গরগরিয়ে চলল শিবানী। রাতের কলকাতার একটা আলাদা চরিত্র আছে। আর কেউ জানুক আর না জানুক সে দেখেছে এই চেহারাটি। দিনের আলোয় যেন ঘরের মেয়েটি আর রাত নামলেই ছলনাময়ী, রহস্যময়ী এক নারী। শিবানী এই রূপটিকেই বেশি পছন্দ করে। ঘোমটা টানা নকল ছায়া নয়, এটাই কলকাতার আসল রূপ।

  সময়ের আগেই পৌঁছে গেল সে হোটেলের সামনে। অনুপম দাঁড়িয়ে আছে। পরনে রিপড জিন্স, সাদা ঢলা টি শার্ট, ফর্সা গালে হালকা, অবিন্যস্ত দাড়ি, এলোমেলো চুল, মোটা ঠোঁট, রোগা চেহারা, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এক ঝলকেই মনে হয় ব্রাইট স্টুডেন্ট। কিন্তু শিবানী জানে এই ব্রাইটনেসের পিছনের ডার্ক চেহারাটির কথা। বাবা মায়ের প্রত্যাশার চাপে পিষ্ট, প্রেমিকার থেকে বিচ্ছেদ পাওয়া ছেলেটা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। তার কাছে এসেছে দু’দণ্ড শান্তি পেতে। মনে মনে হাসল শিবানী। আজ সে অনুপমের বনলতা সেন। অনুপমের সামনে দাঁড়াল শিবানী। হাত বাড়িয়ে বলল, “হাই অনুপম। আই এম শিবানী।” অনুপম এক মুহূর্তের জন্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে দিতে ভুলে গেল। অনুপমের মুখ দেখে শিবানী হেসে উঠল খিলখিলিয়ে। অনুপম যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। লজ্জিত হয়ে হাত মিলিয়ে বলল, “হাই, আমি অনুপম। যত সুন্দর কথা বলো, তার থেকেও বেশি সুন্দর তুমি।” শিবানী বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট নয় আর। ভেতরে চলো। তোমার নামে রুম বুক করা আছে।” অনুপম আর শিবানী হাত ধরাধরি করে ভেতরে চলে গেল। রুমে ঢুকেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল অনুপম। জাপটে ধরল শিবানীকে। চুম্বনে চুম্বনে অস্থির করে দিল প্রেমিকাকে। শিবানী বাধা দিল না। বরং আরও প্রশ্রয় দিতে শুরু করল। সঠিক মুহূর্তের অপেক্ষা করছে সে। যে মুহূর্তে অনুপম তাকে দেখে ছিটকে যাবে। ঘেন্নায় নাক মুখ কুঁচকে ফেলবে। ঠিক সেই মুহূর্তে আগের হিপোক্রিটগুলোর মতো একেও ধ্বংস করে ফেলবে শিবানী।

 কিন্তু আজ প্ল্যান মাফিক হল না সবকিছু। একটা বিশেষ শব্দে ফিরে তাকাল অনুপম। দরজায় কান পেতে শুনল বাইরে থেকে ভেসে আসা শব্দ। তারপর বিস্ফারিত নেত্রে বলল, “পুলিশ! পুলিশ এসেছে। আমাদের পালাতে হবে।” মুহূর্তে শিবানীর মুখের রং পাল্টে গেল। সব প্ল্যান ভেস্তে গেল আজ। অনুপম পালিয়ে যাবে। তার আগে পালাতে হবে তাকে। এভাবে ধরা দেবে না সে। করিডোর ধরে ভারি বুটের আওয়াজ ঝড়ের বেগে ছুটোছুটি করতে শুরু করল। অনুপম দরদর করে ঘামছে। রাগে গা রিরি করছে শিবানীর। এই ছেলে নাকি তাকে নিয়ে সংসার করবে? জানলা খুলে দু’পাশে দেখল অনুপম তারপর এক লাফে নেমে গেল হোটেলের পিছন দিকের পাঁচিলের উপর। পিছন ফিরে তাকাল না। ছুটতে ছুটতে মিশে গেল অন্ধকারে। শূন্যে একটা ঘুষি ছুঁড়ে মারল শিবানী। আস্ফালন করতে চেয়েও পারল না। কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না এখানে আছে সে। অনুপমের মতো সেও উঠে বসল জানলার উপর। সাবধানে কার্নিশের উপর নামল। ঠিক তখনই পিছন দিকের দরজা খুলে গেল। একজন বলে উঠল, “এই কে ওখানে? একদম পালানোর চেষ্টা করবে না।” অন্ধকার ভেদ করে টর্চের আলো পড়ল শিবানীর মুখের উপর। এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে লাফ দিল সে পাঁচিলের উপর। কিন্তু পাঁচিলের গায়ে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ল পেছনের জঙ্গলে। হাত পা ছড়ে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড। কানে এলো কেউ একজন তল্লাসি চালাচ্ছে, হয়তো তাকেই খুঁজছে। আর দেরি নয়, শিবানী সন্তর্পণে এগিয়ে চলল মেন রোডের দিকে।

১৩

             মৃত্তিকা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। হিংস্র দুটি চোখ যেন প্রতিহিংসায় জ্বলজ্বল করছে। অন্ধকারে ছবিটা ভালো আসেনি। যতটুকু এসেছে তাতেই বোঝা যাচ্ছে এই শিবানী নামক ব্যাক্তিটি আসলে সবকিছু শেষ করে দেওয়ার পণ নিয়ে মাঠে নেমেছে। প্রিয়ম বলল, “ম্যাম এই মেয়েটার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে যে কি খাটনিটাই না খাটতে হল! ভীষণ ধুরন্ধর আর একইসাথে জিনিয়াস। এই কোডিং ইন্ডাস্ট্রিতে এলে পুরো দুনিয়া কেঁপে যাবে ম্যাম।” মৃত্তিকা হেসে বলল, “বেশিরভাগ অপরাধীই জিনিয়াস হয় প্রিয়ম। তাই তাদের হাতে পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। বাট ইউ আর মোর দ্যান জিনিয়াস ডার্লিং। তুমি হ্যাক করতে পারলে বলেই কাল শিবানীর মুভমেন্ট জানতে পারলাম। কিন্তু এরপর ও হয়তো একই পদ্ধতিতে এগোবে না। অথবা বুঝতে পেরে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে পারে। আমাদের কিন্তু সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।” প্রিয়ম মাথা নাড়ল। ইতস্তত করে বলল, “তবে ম্যাম একটা গুড নিউজ আছে।” মৃত্তিকা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম বলল, “শিবানীর আইপি এড্রেস আপনার মাসির বাড়ির এরিয়াতেই। তাই আপনার পক্ষে…” প্রিয়মকে কথা শেষ করতে না দিয়ে একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মৃত্তিকা। তিরতির করে কাঁপছে তার চোখের তারা। কিছুটা চিৎকার করেই বলে উঠল, “কী বলছ? আর ইউ শিওর? এতক্ষণ বলনি কেন আমায়?” প্রিয়ম কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। মৃত্তিকা আরেকবার তাকাল ছবিটার দিকে। দুয়ে দুয়ে চার হতে এখনও অনেকটা সময় বাকি। তবে সূত্র সে পেয়ে গেছে।

  “অভিজিৎ দা একটা হেল্প লাগবে গো?” কথার কণ্ঠস্বরে খাতার মধ্যে থেকে মুখ তুলে তাকায় অভিজিৎ। একটা কবিতার শেষ দুটি লাইন বাকি। খাতা বন্ধ করে বলে, “বলে ফেল।” কথা আজ অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক নেই। অভিজিতের কথায় একটু আহত হয়েই বলল, “জানি তোমায় ডিস্টার্ব করছি বাট সত্যিই খুব দরকার। আমার প্রিন্টারটা কাজ করছে না। কাল কলেজে ফর্মটা ফিলাপ করে দিতেই হবে। তাই একটু… তোমার কী খরচ পড়ছে বলো আমি দিয়ে দিচ্ছি।” কথার এমন অস্বাভাবিক আচরণে অভিজিৎ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “না, না সেরকম কিছু না। কী প্রিন্ট করব বল?” কথা কম্পিউটারে ইউনিভারসিটির ওয়েবসাইট থেকে একটা ফর্ম বের করে দিল। অভিজিৎ সেটি হার্ড কপিতে পরিবর্তন করে কথার হাতে দিতে সে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যেতে উদ্যত হল। অভিজিৎ এবার সব সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে বলল, “কথা, কিছু হয়েছে?” কথা মাথা নেড়ে বলে, “না। কী হবে?” অভিজিৎ বোঝাতে পারে না তার মনের ভাষা। কথা আজ কেন উত্তাল ঝরনা নয়, কেন আজ সে নির্বিকার, উদাসীন নদী জানতে যে তার খুব ইচ্ছে করছে সেকথা বলতে পারছে না। চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “বসবি না?” কথা উল্টোদিকে তাকিয়ে বলল, “না আজ না।” অভিজিৎ এবার মিনতির স্বরে বলে উঠল, “প্লিজ, একবার বস।” কথা নিজের বিস্ময় এবার চাপতে পারল না। বাধ্য মেয়ের মতো বসল অভিজিতের সামনে রাখা চেয়ারে। অভিজিৎ একটা খাতা এগিয়ে দিল তার দিকে। এর আগে কথা কতবার পড়তে চেয়েছে অভিজিতের কবিতা। অভিজিৎ নিদারুন উদাসীনতায় সেই প্রস্তাব খারিজ করেছে। আর আজ সেই ছেলেটিই তাকে কবিতা পড়তে বলছে। কথা একের পর এক পাতা উল্টে যায়। অভিজিৎ যেন আজ ভিন্ন কেউ। কথার দিকে তাকিয়ে রয়েছে একভাবে। একসময় বলে উঠল, “আমার ব্যবহারে খারাপ লাগে তোর, তাই না?” কথা বুঝতে পারে না কী বলবে। কণ্ঠ যে রোধ হয়ে এসেছে সেটাও বলতে পারছে না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে অভিমানে। অভিজিৎ আবার বলে, “আমার কাছে আসতে তোর ভালোলাগে?” কথা এখনও চুপ। উত্তর না পেয়ে এবার হাসে ছেলেটি। কথার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, “একদিন তোকে সব কথা বলব। আমার একটা মানুষ চাই রে যে আমার সব কথা শুনবে, আমায় বুঝবে। আমি পাই না তেমন মানুষ। আমারও ইচ্ছে করে গল্প করতে, আড্ডা দিতে, আনন্দ করতে কিন্তু আমি, আমার জীবন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো নয়। কী করব বল? ভীষণ অসহায় লাগে রে আমার।” অভিজিতের গলা যেন কেঁপে উঠল। কথা হতবাক হয়ে গেল। এ কোন মানুষ তার সামনে আজ! পারমিতার গলা পেয়ে কথার হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল অভিজিৎ। পারমিতা ঘরে ঢুকতেই কথা উঠে দাঁড়াল। কাগজগুলো হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। পারমিতার সাথে কুশল বিনিময় করে চলে এলো নিজের ঘরে।

             পারমিতা অভিজিতের কাছে বসলেন। হাঁটুতে হাত ছোঁয়াতেই ব্যথায় নীল হয়ে এলো ওর মুখ। পারমিতা কান্না ভেজা গলায় বললেন, “বারণ করতে পারিস তো। আমি যে আর পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেকেই শেষ করে দিই।” অভিজিৎ উদাসীনভাবে বলল, “সেটা তোমার প্রব্লেম। আমি সময় মতো আমার কাজ করব। তোমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকো আর লোকলজ্জার দোহাই দিয়ে পালিয়ে বেড়াও।” পারমিতা বোধহয় এতটা আশা করেননি। আহত চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। তারপর চোখ চলে গেল ব্যাল্কনি ঘেঁষা ঘরটার দিকে। দরজা বন্ধ। দরজাটা বেশিরভাগ সময় বন্ধই থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো পারমিতার। অভিজিতের হাতে ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

   অভিজিৎ আবার নিজের খাতায় মুখ ডোবাল। এক মুহূর্তের জন্য হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। কথার মুখটা দেখার মতো হয়েছিল। যথার্থ ডাকনাম ভেবলি। চুলের মধ্যে নিজের হাত চালিয়ে আবার সেটি নিজের নাকে ছোঁয়াল অভি। এবার সময় এসেছে মনের ভার লাঘব করার। কথাকে অনেকদিন অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু তার আগে আসল কাজটা বাকি। বন্ধ দরজাটার দিকে তাকাল অভিজিৎ। আর কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।

             কথা হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো ফ্ল্যাটে। মৃত্তিকা ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। কথাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আপাদমস্তক দেখে নিল কথাকে। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে ওর কপালে। বুকটা ওঠানামা করছে একটু বেশি করে। মৃত্তিকা বুঝল ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। একটু সময় দেওয়া দরকার। বোনের পাশে কিছুক্ষণ বসে রইল মৃত্তিকা চুপচাপ। কথা এবার একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তোমার কথা অনুযায়ী ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়ে এসেছি। কম্পিউটার টেবিলের নিচের দিকে। একবার দেখে নিও তুমি। ড্রেসিংটেবিলের দিকেও খেয়াল করলাম। একটা লিপস্টিক পড়ে ছিল আর আয়নায় একটা টিপ লাগানো ছিল। কালো রঙের। তবে সেগুলো ওর মায়েরও হতে পারে। অভিজিতদা আজ অদ্ভুত বিহেভ করছিল জানো? আমার হাত ধরে বলছিল নাকি অনেক কিছু বলার আছে আমাকে। বাই দ্য ওয়ে হাতে কিছু একটা দিয়েছিল। ওর মা ঘরে চলে আসায় তখন দেখতে পারিনি। দেখো তো এটা কী?” কথা একটানা বলে থামল। মৃত্তিকার হাতে ধরিয়ে দিল একটা ছোট্ট চিপ। মৃত্তিকা হাসি মুখে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে বলল, “ভাবছি তোকে আমার আনঅফিশিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট করেই নেব। ক্যামেরাটা দুর্দান্ত আঙ্গেলে লাগিয়েছিস। অ্যান্ড ভেরি গুড অব্জারভেশন। এটা কী দেখছি। তবে তার আগে তোর পুরনো ল্যাপটপটা দে। আমার ডিভাইস হ্যাক হয়ে গেলে সাংঘাতিক কাণ্ড হবে।” কথা অবাক হয়ে বলল, “অভিজিতদা হ্যাকার?” মৃত্তিকা কথার মনের অবস্থা বুঝতে পারল। হেসে বলল, “জানি না। তবে আমি দেশের ইনফরমেশন নিয়ে কোনও রিস্ক নিতে পারি না। আয় দেখি।” তারপর ল্যাপটপে চিপটা ইন্সার্ট করতে সে বলল, “আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই কেসটা সল্ভ হয়ে যাবে। আর অভিজিৎ অনেক কিছুই জানে কেসটার ব্যাপারে কিন্তু বলতে পারছে না।” কথা বিড়বিড় করে বলল, “এতগুলো মানুষের খুনের সাথে অভিজিতদা জড়িত! আমি ভাবতে পারছি না। ওকে দেখলে তো…”

“দেখে অনেকের ব্যাপারেই কিছু বোঝা যায় না কথা। উপরের চাকচিক্যে কখনও ভুলিস না। তবে অভিজিৎ একটা চক্রে পড়ে আছে। ও ছাড়া পেতে চায় বলেই এই চিপ আমায় পাঠিয়েছে।” মৃত্তিকার কথা শেষ হওয়ার আগেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠল প্যান্ডোরার রহস্যময় বাক্স। মৃত্তিকার ঠোঁটে ফুটে উঠল বিশ্বজয়ের হাসি। মনে মনে অভিজিতকে ধন্যবাদ না দিয়ে সে পারল না।

১৪

             অভিজিৎ যখন কাজে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় কথা মৃত্তিকার নির্দেশ অনুযায়ী কম্পিউটার টেবিলে লাগিয়ে দেয় ছোট্ট একটি ক্যামেরা। অভিজিৎ খেয়াল করেনি ঘটনাটা। না করাটাই স্বাভাবিক। এত ছোট ক্যামেরা সাধারণত চোখেই পড়ে না। ঠিক যেন একটা কালো রঙের টিপ। তবে অভিজিতের ঘরে মেয়েদের সাজের সরঞ্জাম আগেও দেখেছে কথা। অস্বাভাবিক লাগেনি কখনও। মৃত্তিকার যে কেন সন্দেহ হচ্ছে বুঝতে পারছে না ও। এদিকে অভিজিৎকে সন্দেহ করতেও ওর মন সায় দিচ্ছে না। তবে যেদিন থেকে ওদের বাড়ি থেকে একটা ছায়া মূর্তির আনাগোনা নজর করেছে ও সেদিন থেকেই পরিচিত বাড়ি, পরিচিত মানুষগুলোকে কেমন রহস্যময় লাগছে কথার। রাত বারোটা বাজে। কথা এখনও মৃত্তিকার ঘরেই বসে আছে। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে বসে রয়েছে মৃত্তিকা। হঠাৎ কথার হাত খামচে ধরল সে। কথা চমকে তাকাল মৃত্তিকার দিকে। মৃত্তিকা ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় কাছে আসতে বলল। কথা ধীরে ধীরে সরে এলো মৃত্তিকার দিকে। উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছে ওর শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। কিন্তু মৃত্তিকাকে সেইকথা জানতে দিলে চলবে না। মোবাইলের দিকে তাকিয়েই বুকটা ধড়াস করে উঠল কথার। অভিজিতের ঘর ফুটে উঠেছে স্ক্রিনের ওপর। আলো জ্বলছে তবে ম্লান। সেই আলোয় দেখা গেল অভিজিৎ চুপচাপ শুয়ে রয়েছে বিছানায় আর ঘরের মধ্যে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে আরেকজন মানুষ। তবে সে পারমিতা বা অসিত নয়। বরং অন্য কেউ। অন্য একজন মহিলা। তার পরনে সালোয়ার কামিজ, খোলা চুল। পিছন ফিরে থাকায় মুখটা স্পষ্ট নয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে নিজেকে। কথা অবাক হয়ে তাকাল মৃত্তিকার দিকে। মৃত্তিকার চোখ দুটো যেন নব্য আবিষ্কারের উত্তেজনায় দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঠোঁটে ফুটে উঠেছে বিশ্বজয়ী হাসি। মেয়েটি এবার আলমারি খুলে একটি ব্যাগ বের করল। মৃত্তিকাও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে কথাকে বলল, “আজ নাটক শেষ হবে। যাবি নাকি দেখতে?” কথা এক কথায় রাজি। সন্তর্পণে খুলে ফেলল ফ্ল্যাটের দরজা। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বাইরে থেকে লক করে এপার্টমেন্টের মেন গেটও খুলে দিল। মৃত্তিকা পরিমলের স্কুটি নিয়ে তৈরি ছিল। ওরা দুজন বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগল একটি অন্ধকার জায়গায়। তারপর কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা। অভিজিতের ঘরের ব্যাল্কনির দরজা গেল খুলে। একটি নারীর ছায়া মূর্তি অবতীর্ণ হল দৃশ্যপটে। মেয়েটি এবার ব্যাল্কনির রেলিং ধরে ঝুলে পড়ল। তারপর অসাধারণ দক্ষতায় পাইপ বেয়ে নেমে এলো নীচে। একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল কিছুটা দূরেই। মেয়েটিকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এলো। মেয়েটি সাবলীলভাবে উঠে পড়ল সেই গাড়িতে। খুব দ্রুত বেগে গাড়িটি চোখের আড়াল হয়ে গেল মৃত্তিকার।

    কথা চাপা গলায় বলল, “এই মৃত্তিকা দি, পালিয়ে গেল তো! চলো?” মৃত্তিকা হেসে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ, বেশিদূর পালাতে পারবে না। ও আমার হাতের মুঠোর মধ্যেই আছে।” মৃত্তিকা স্কুটিতে স্টার্ট দিল। ওর মোবাইলে ভেসে উঠেছে জিপিএস ট্র্যাক। সেই পথ ধরেই এগোচ্ছে মৃত্তিকা। কথা অবাক হয়ে বলল, “এটা কীভাবে পেলে?” মৃত্তিকা বলল, “তুইই তো এনে দিলি সকালবেলা।” কথা আরও অবাক হল, “আমি?” তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই বলল, “মানে, অভিজিতদা যে চিপটা দিয়েছিল ওটা আসলে জিপিএস ট্র্যাকার!” কথার যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে তার পরিচিত, উদাসীন ছেলেটা শহরে ঘটে যাওয়া নৃশংস সিরিয়াল কিলিঙের একটি অংশ। মৃত্তিকা ওর কানে লাগানো ছোট্ট হেড ফোনের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়ে চলেছে ওর টিমকে। দীর্ঘদিনের নারকীয় ঘটনার শেষ হবে আজ। সব রহস্যের সমাধান হবে। তার সাথে অনেকের মুখোশ খসে যাবে। মৃত্তিকা চোখ রেখেছে স্ক্রিনের ওপর। মনে শুধু একটাই আশা, অভিজিৎ যেন তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখে।

১৫

  গাড়ি থেকে নেমেই শিবানী হোটেলের রিসেপশনের দিকে হেঁটে গেল। পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে রক্তিম চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে হাসি মুখে এগিয়ে এলো শিবানীর দিকে। তারপর রিসেপশনিস্টের কাছে ঘরের চাবি নিয়ে শিবানীর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে শুরু করল করিডোর ধরে। শিবানীর আজ একটু অস্বস্তি হচ্ছে। অন্য পুরুষদের মতো রক্তিমকে সে ওয়েব সাইটের গণ্ডী থেকে পায়নি। পেয়েছে একটি সোশ্যাল মিডিয়া সাইট থেকে। ওয়েব সাইট থেকে পাওয়া সবকটা অ্যাকাউন্ট তার নখ দর্পণে। কারণ ওয়েব সাইটটা তৈরি করেছে অভিজিৎ নিজে। তার জন্যই বা তার চাপেই তৈরি করে দিয়েছে। ভাইকে মানসিক, শারীরিক চাপ দেওয়া তার ছোটবেলার অভ্যেস। অভিজিৎ বারবার নতিস্বীকার করে তার জেদের সামনে। ছেলেটার মনটাও খুব নরম। ওয়েবসাইটের সব কার্যকলাপ শিবানী নিজে দেখভাল করে। আয়ও নেহাত কম হয় না। সেখান থেকেই খুঁজে পায় হতাশায় ভোগা, অবসাদগ্রস্ত পুরুষদের। এই পুরুষরাই তার শিকার। দুশ্চরিত্র, খল, শঠ পুরুষদের এভাবেই সে সরিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী থেকে একের পর এক। তবে কয়েকদিন হল কেউ বা কারা সাইটটা হ্যাক করেছে। তার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে দিচ্ছে। এর পেছনে মৃত্তিকাকেই সন্দেহ হচ্ছে শিবানীর। কিন্তু তাই বলে থেমে থাকতেও তো পারছে না সে। পুরুষসঙ্গ যেন একটা নেশার মতো হয়ে গেছে। নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। অভিজিতের পরামর্শ মতোই সোশ্যাল মিডিয়ায় পা রাখা তার। আর সেখানেই পেয়ে যায় রক্তিমকে। সদ্য প্রেম ভেঙ্গেছে ছেলেটির। সেই ক্ষত তাকে এনেছে শিবানীর কাছাকাছি।

  সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রক্তিমের সাথে কখন যে রুমে চলে এসেছে শিবানী বুঝতে পারেনি। দরজা বন্ধ করে শিবানীর শরীরের উপর প্রেম বর্ষণ শুরু করে দিয়েছে রক্তিম। শিবানীর চোখ খুঁজে চলেছে কাজ হাসিল করে সুচারুরূপে পালাবার পথ। জানলার দিকে চোখ আটকে গেল তার। গ্রিলবিহীন খোলা জানলা থেকে এক লাফে পৌঁছে যাওয়া যায় পাশের বাড়ির ছাদে। রক্তিমের ডাকে এবার নিশ্চিন্তে সারা দিল সে। বিছানায় এলিয়ে গেল দুটি তরুন শরীর। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় যখন রক্তিম নিজেকে সমর্পণ করে ফেলেছে ঠিক সেই মুহূর্তে সে আবিষ্কার করল শিবানী আসল রূপ। শিবানী নারী নয় পুরুষ। রক্তিম ছিটকে উঠে দাঁড়াল। হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল, “একি? এসব কী? তুমি…তুমি মেয়ে নও?” শিবানীর ঠোঁটে এক হিংস্র হাসি ফুটে উঠল। পোশাক গায়ে চাপিয়ে সে বলল, “কেন? কী হল? সব প্রেম উবে গেল রক্তিম? দূরে কেন কাছে এসো, এসো না।” রক্তিম নিজেকে শিবানীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পোশাকের দিকে হাত বাড়াতেই এক ধাক্কায় বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ল। ওর ওপর চেপে বসল শিবানীর শরীর। রক্তিম এক ঝটকায় শিবানীকে মাটিতে ফেলে দিল। নম্রভাবে বলল, “দেখো শিবানী। আমি তোমার চয়েস কে সম্মান করি। কিন্তু আমি এরকম নই। সেকথাও তো তোমায় ভাবতে হবে।” কিন্তু শিবানী সেইসব কোথায় কান দিল না। তার ব্যাগ থেকে বেরিয়েছে একটি ধারালো ভোজালি। এগিয়ে আসছে সে রক্তিমের দিকে। অসীম শক্তিতে সেটি ছুঁড়ে মারল রক্তিমের দিকে। ঠিক এই সময় একটি মোক্ষম ঘুষিতে রক্তিম শিবানীকে ধরাশায়ী করে দিল। উঠে বসল ওর বুকের ওপর। আবার একটি ঘুষি বসাল শিবানীর মুখের উপর। ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্তের ধারা। অকস্মাৎ এমন আক্রমণে হতবাক শিবানী কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজায় দুমদাম আওয়াজ শুরু হল। রক্তিম এবার এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে শিবানীর দিকে জামাকাপড় ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “উঠে দাঁড়া। নাটক শেষ।” শিবানী পোশাক পরে উঠে দাঁড়ালে রক্তিম দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এক মুহূর্ত নষ্ট না করে শিবানী ছুটে গেল জানলার দিকে। কাঁচের জানলা খুলে উঠে দাঁড়াল একটা টুলের উপর। ঝাঁপ দিতে যাওয়ার ঠিক আগে একটা বিকট শব্দে যেন বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল ওর। পায়ের দিকে চেয়ে দেখল গুলি লেগে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ঝাপসা চোখে দেখল কেউ একজন তার হাত ধরে টেনে ফেলে দিল ঘরের মেঝেতে। তারপর সব অন্ধকার।

   যখন জ্ঞান ফিরল শিবানী নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল দাঁড়িয়ে আছে তার মা বাবা – পারমিতা ও অসিত। অদূরে একটি হুইল চেয়ারে বসে আছে অভিজিৎ। তার চোখে ঠিক আগের মতোই ঘৃণা। শিবানী উঠে বসতে চাইল কিন্তু পারল না। পিছন থেকে কেউ একজন বলল, “শুয়ে থাকো অনিকেত। এখন তোমার বিশ্রামের সময়। শুয়ে শুয়েই জবানবন্দি দিয়ে দাও নাহয়। কেন মহিলাবেশে এতগুলো খুন করলে তুমি? কী উদ্দেশ্য? কী পেলে এসব করে?” মৃত্তিকা সামনে এসে দাঁড়াল শিবানী বা অনিকেতের। জ্বলন্ত চোখ মেলে অনিকেত বলল, “আমি অনিকেত নই। আমি শিবানী।” মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল, “তুমি শিবানী তবে মনে। শারীরিকভাবে তুমি অনিকেত মিত্র। জাল আইডি কার্ডে মায়ের পদবী ব্যবহার করে অনিকেত সাহা। সেই কার্ড দেখিয়ে বেশ কয়েকটা সিম কার্ড তুলেছ শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে। কখনও ওয়েব সাইটের মাধ্যমে, কখনও কলের মাধ্যমে বহু পুরুষকে সিডিউস করে খুন করেছ। কী বলতো এসব করে? সেই তো ধরা পড়তে হল।” অনিকেতের ঠোঁটে একটা ক্রূর  হাসি খেলে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে সে বলল, “কী পেলাম? মনের জ্বালা মেটালাম। শরীরের খিদে মেটালাম আর সেই সমস্ত পুরুষদের শাস্তি দিয়েছি যারা নিজেদের দুনিয়ার সামনে মহান প্রমাণ করতে চায় অথচ তাদের ভেতরটা পচে গেছে।” মৃত্তিকা বলল, “তুমি কে শাস্তি দেওয়ার?”

“একজন হতভাগ্য প্রতারিত।”

“কে তোমায় প্রতারণা করেছে অনিকেত?” মৃত্তিকার গলা নরম হয়ে এলো। সেই কণ্ঠে ভিজে গেল অনিকেতের মন। মুহূর্তে আগুনঝরা চোখে বর্ষা নামল। বদ্ধ কণ্ঠে অনিকেত বলতে শুরু করল, “এই পুরুষ শরীরটা চাইনি আমি। নারী হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু আমার মা বাবা আমায় সম্পূর্ণ ভুল বুঝল। অপারেশন করাতে চাইল না। বরং তাদের মনে হল আমার এই চাহিদার জন্য তারা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। আমার চলাফেরা, আমার পোশাক সব কিছুই তাদের কাছে অপমানজনক হয়ে উঠল। কল্যাণীর বাড়ি ছেড়ে আমায় নিয়ে আসা হল কলকাতায়। এখানে নাকি আমার মানসিক চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। আমি কিছুতেই এদের বোঝাতে পারছিলাম না যে এটা কোনও মানসিক রোগ নয়। স্বাভাবিক, জৈবিক চাহিদা। ধীরে ধীরে আমার মধ্যে ফুটে উঠল নারী সুলভ সমস্ত গুণ আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেল মা বাবার আমার উপর অত্যাচার। হ্যাঁ, অত্যাচারই – শারীরিক, মানসিক অত্যাচার। কলেজে পা রাখলাম। বন্ধু ছিল না কখনওই। এখানেও তৈরি হল না। কিন্তু সবার মধ্যে একটা ছেলেকে ভীষণ পছন্দ করতাম। শুভজিৎ। শুভজিৎ তালুকদার। হিস্ট্রি অনার্স। কীভাবে যেন বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমাদের। জানতে পারলাম ও সমকামি। দুটি সমমনস্ক মানুষ কাছাকাছি আসায় কানাঘুষো শুরু হয়ে গেল কলেজে। প্রিন্সিপালের কাছেও খবরটা চলে গেল। আমাদের ডাকা হল অফিসে। যারপরনাই অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হল কলেজ থেকে। বাজ পড়ল বাবা মা’র মাথায়। মানসিক অত্যাচারের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। এদিকে আমার লেখাপড়া, আমার হবি সব শেষ হয়ে গেল। আমায় ঘরে বন্দী করে রাখা হল আর ধীরে ধীরে আমার জায়গা দখল করে নিল অভি, অভিজিৎ আমার ভাই। ওর ওপর খুব রাগ হত। ছোটবেলা থেকেই ও ব্রিলিয়ান্ট। আমার থেকে হাজার গুণে ভালো। বাবা মায়ের চোখের মণি। ওর মধ্যে পুরুষ সুলভ সমস্ত গুণ বর্তমান। মা বাবার প্রায়োরিটি হয়ে উঠল অভি আর আমি তলিয়ে যেতে শুরু করলাম অন্ধকারে। একদিন সুযোগ পেয়ে পালিয়ে এলাম শুভজিতের কাছে। ও তো আমায় কথা দিয়েছিল যেকোনো পরিস্থিতিতে আমার পাশে থাকবে, আগলে রাখবে আমায়। কিন্তু ওর বাড়ি গিয়ে বুঝলাম পুরোটাই আমার মনের ভুল। শুভজিতের ততদিনে নতুন কলেজের সাথে নতুন বান্ধবীও জুটে গেছে। ও নাকি আগের সব কথা ভুলে যেতে চায়। যা যা করেছে সবই ছিল ওর ভুল। আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। হাতের কাছে যা পেলাম এলোপাথারি ছুঁড়তে লাগলাম। শুভজিতের মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল। পালিয়ে এলাম সেখান থেকে। কোথায় আর ফিরব এই নরক ছাড়া?”

  অনিকেত থামল। একটু যেন দম নেওয়ার জন্যই থামল অথবা নিজেকে সামলাতে। সেই ফাঁকে অভিজিৎ বলতে শুরু করল, “দাদা বরাবরই আমার উপর হিংসা করত। রাগ মেটাতে আমায় শেষ করে দেওয়ার প্ল্যানও করেছিল। একদিন ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলাম। ছাদের কার্নিশে উঠে পড়েছিলাম ভুলবশত। সেই সুযোগে পিছন থেকে ধাক্কা দিল অনিকেত মিত্র। আমি পড়ে রইলাম নীচে। রক্তে ভেসে গেল উঠোন। বাড়িতে কেউ ছিল না। প্রতিবেশিরা না দেখলে হয়তো আজ বেঁচেই থাকতাম না। তবে বেঁচে গেলাম। পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকলাম। দাদার উপর রাগ করার বদলে রাগ বেড়ে গেল বাবা মায়ের উপর। কেন ওর কথা শুনছে না ওরা? কেন ওকে মারধোর করছে? কলকাতায় ওর মানসিক ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি চলল আমার পায়ের চিকিৎসা। কিন্তু কারুরই উন্নতি হল না। দাদাকে বন্দী করেই রাখা হল আমার পাশের ঘরে। প্রতি রাতে ওর কান্না আমায় ঘুমাতে দিত না। একদিন হুইল চেয়ারে উঠে তালাটা ভেঙ্গে দিলাম। কেউ জানতে পারল না। ওকে বের করে আনলাম অন্ধকার ঘর থেকে। দেখলাম পাগল হওয়ার ঠিক আগের পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে দাদা। ভীষণ কষ্ট হল। মনে হল ওকে কোনওভাবে যদি সাহায্য করতে পারতাম…” অভিজিৎ থামলে আবার শুরু করল অনিকেত।

   “আমার কথা অনুযায়ীই অভি আমার জন্য একটা ওয়েব সাইট ডিজাইন করে দিল। হাতে ধরে শিখিয়ে দিল সব কিছু। আমার একাকিত্ব দূর করতে ওর চেষ্টা আমায় খুব শান্তি দিল। মনে হল কেউ তো আছে যে আমার কথা ভাবে। এইভাবে চলতে লাগল। একের পর এক পরিচয় হল বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের সাথে। প্রোফাইলে আমার নাম ছিল শিবানী। প্রথমবার যার সাথে দেখা করতে গেলাম সে আমায় প্রায় জোর করেই শারীরিক মিলনে বাধ্য করল। তারপর যখন দেখল আমি পুরুষ, ওর ঘেন্নায় কুঁচকে যাওয়া মুখটা দেখে আর মাথার ঠিক রাখতে পারলাম না। হোটেলের রুমে ঝুলিয়ে রাখা একটা ঢাল তলোয়ারের শো পিস থেকে একটানে বের করে নিলাম একটা তলোয়ার। ভাবিনি ওটা ধারালো হবে। এক কোপে কেটে গেল ওর হাতের অনেকটা। রক্ত দেখে পালিয়ে এলাম। তারপর বাড়ি ফিরে মাথার মধ্যে কী যে হয়ে গেল? সমস্ত রাগ এসে পড়ল অভির উপর। বেল্টের আঘাতে আঘাতে ওর শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে গেল। পরের দিন সকালে বাড়ির বাদ বাকিরা জানতে পারল আমি রাতে বেরিয়েছিলাম। আরও কড়া পাহারা বসল। তালা পাল্টে ফেলা হল। কিন্তু আটকানো গেল না। অভির ঘরে প্রতি রাতেই আমি অবাধ যাতায়াত করতাম। কম্পিউটারে বসে চ্যাট করতাম আর নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে এসে দেখা করতাম তাদের সাথে। সেইসব রাতে শুভজিতের ওপর রাগ বেড়ে যেত। নিজের ওপর, বাবা মায়ের ওপর রাগ বেড়ে যেত। সব অত্যাচার এসে পড়ত অভির ওপর। ও চুপ করে সহ্য করত সব। যেন এটাই ওর ভবিতব্য।”

  অভিজিৎ বলল, “হ্যাঁ, এটাই আমার ভবিতব্য। ওর হিংসা, রাগ মেটানোর আধার আমি। আমার বাবা মা’র অশিক্ষা, কাপুরুষতার দায়ভার তো আমাকেই মেটাতে হবে। আমার পঙ্গু জীবনের জন্য যতটা দায়ী আমার দাদা তার থেকেও বেশি দায়ী এই দুটো মানুষ যাদের অবহেলা ওকে একটা ক্রিমিনালে পরিণত করেছে। আসলে আমিও ধীরে ধীরে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। চেয়েছিলাম ওর হাতেই মৃত্যু হোক। আজীবনের জন্য শাস্তি পাক এরা দু’জন। কিন্তু ও যে দেখা খুন করে আসতে পারে সেইকথা স্বপ্নেও ভাবিনি। বাবা মাও না। ব্যাপারটা যখন বুঝতে পারলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। দাদাকে অনেক করে বললাম পিছিয়ে আসতে। আমার কথা তো শুনলই নয়া বরং আমার উপর অত্যাচারের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। অবশেষে ঠিক করলাম এবার আমায় ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এই যন্ত্রণাময় দিনগুলোর শেষ দেখে ছাড়ব। বাধ্য হয়েই কথার হাত দিয়ে জিপিএস চিপটা ম্যামের কাছে পাঠালাম। আমার বিশ্বাস ছিল উনি এইটুকু সাহায্যেই সব বুঝে যাবেন। দাদা যে মোবাইলটা ব্যবহার করে সেটা আমারই পুরনো মোবাইল। শেষ খুনটা করতে না পেরে ও একটু ভয়ই পেয়ে গেছিল। তার সাথে এটাও বুঝে গেল যে ওর অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে আর পুলিশ সব তথ্য পেয়ে গেছে। আসলে আমিই ওর প্রোফাইলের সিকিউরিটি শিল্ড পাল্টে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেবারে ও পালিয়ে গেল। রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে এলো ঘরে। কয়েকদিন চুপচাপ। শরীরকে সারতে দিতে হবে তো। তারপর একদিন কথা এলো আমার ঘরে। বুঝে গেলাম এটাই সুযোগ।”

 মৃত্তিকা হুইল চেয়ারে বসে থাকা অভিজিতের কাঁধে হাত রেখে হাসি মুখে বলল, “আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ অভিজিৎ। তবে কথাকে আমিই পাঠিয়েছিলাম তোমার কাছে। আমার কম্পিউটার এক্সপার্ট প্রিয়ম যখন বলল যে শিবানীর আইপি এড্রেস আমার বাড়ির এলাকাতেই রয়েছে আমার কাছে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেল কারণ আমি প্রতিটি খুনের রাতে শিবানীকে তোমাদের বাড়ির পাইপ লাইন বেয়ে নামতে দেখেছি। হোটেলের রুমগুলিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পাইনি। শুধু মৃতদেহের শরীরে কয়েকটি আঁচড় আর কয়েকটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট বাদে। কথা তোমার কম্পিউটার টেবিল থেকে যে কাগজ ও কয়েকটি পেন এনে দিয়েছিল তাতে তোমার আর কথার হাতের ছাপ ছাড়াও ছিল আরেকজনের হাতের ছাপ। সেটা শিবানীর। বুঝতে কিছুই বাকি রইল না আমার কিন্তু হাতেনাতে ধরতে না পারলে অপরাধ প্রমাণ করতে পারব না। তাই অপেক্ষায় থাকলাম। তোমার বানানো ওয়েব সাইটে অ্যাকাউন্ট বানিয়ে চ্যাট শুরু করলাম শিবানীর সাথে। যেন আমি এক হতাশ, প্রতারিত পুরুষ। শিবানীকে পেয়ে আমি আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দেব প্রতিশ্রুতি দিলাম। শিবানী বিশ্বাসও করে ফেলল আমার কথা। কিন্তু ততদিনে শিবানীর সব তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। ও বুঝেও ফেলেছে সেটা। তাই নিজের প্রোফাইল বন্ধ করে দিল। তবে ও এটা জানল না যে ওয়েব সাইটের সাথে সাথে ওর কম্পিউটারও হ্যাক হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে শিবানীর অ্যাকাউন্ট খুঁজে পাওয়া গেল রিক্তা নামে। বুঝলাম নতুন ট্র্যাপ। এবার আর এগোতে দেওয়া ঠিক হবে না। প্ল্যান্ট করলাম আমার স্পেশ্যাল অফিসার রক্তিমকে। শিবানীর প্যাটার্ন অনুযায়ী পার্সোনাল চ্যাট থেকে শুরু করে সেক্স চ্যাটে পৌঁছন – সমস্ত ফাঁদে পা রাখল রক্তিম। তারপর একদিন হোটেল বুক করে দেখা করা। এই অবধি সব ঠিক ছিল। আমরা অনিকেত বা শিবানীকে অক্ষত অবস্থাতেই এরেস্ট করতে পারতাম যদি না ও পালানোর চেষ্টা করত।”

অনিকেত গর্জে উঠল আবার, “বেশ করেছি খুন করেছি। সবকটা মিথ্যেবাদীকে সরিয়ে ফেলব দুনিয়া থেকে। আমি যে যন্ত্রণা পেয়েছি সেই ব্যথার বিষে সবাইকে জ্বালাব। কী পাপ করেছিলাম আমি?”

“পুরুষ থেকে মহিলা হতে চাওয়ার ইচ্ছে পাপ নয় অনিকেত কিন্তু তুমি যে পদ্ধতি অবলম্বন করে নিজের কথা দুনিয়াকে জানাতে চেয়েছ সেই পদ্ধতিটা ভুল। অপরাধের আশ্রয় নিয়ে কেউ কখনও মহৎ হতে পারেনি। সত্যের সাহায্য নিলে তোমার লড়াই অন্য একটা মাত্রা পেত। আমি তোমার পাশে দাঁড়াতাম কারণ আমি জানি এই পথ কতটা কঠিন। তবে এই কাজে আমি তোমায় সাপোর্ট করতে পারলাম না অনিকেত। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।”

  পারমিতা আর অসিতের কান্না ভেজা চোখকে অগ্রাহ্য করে অনিকেতকে নিয়ে যাওয়া হল জেল হাসপাতালে। মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভিজিতের সামনে এসে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোমাকেও আমাদের সাথে যেতে হবে অভিজিৎ। এই কেসে তুমিও জড়িয়ে রয়েছ। তবে ইউ আর আ জিনিয়াস। এই বুদ্ধিমত্তা তুমি শুভ কাজে ব্যয় করলে অনেক দূর যেতে পারবে।” অভিজিৎ মুখ তুলে তাকাল। প্রথম দিনের মতো তার চোখে আজ ঘৃণা নেই। বরং আছে সম্ভ্রম। হাসি মুখে অভিজিৎ বলল, “আমি যাব ম্যাম। আজ থেকে আমার নতুন একটা জীবন শুরু হবে। আমি খুব খুশি কিন্তু দাদাদের মতো আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের যন্ত্রণা কবে শেষ হবে বলুন তো?” মৃত্তিকা একটু সময় নেয় উত্তর দিতে। এই যন্ত্রণায় সেও ক্লিষ্ট। থেমে থেমে বলে, “যেদিন সমাজ থেকে লিঙ্গ বিভেদ মুছে যাবে। যেদিন রুপান্তরকাম পুরুষ নারীকে নিয়ে হাঙ্গামা কমে গিয়ে সুন্দর আলোচনা শুরু হবে। বাহবা দেওয়া হবে সেদিন একটা সুস্থ জীবন পাব আমরা। তবে সেইদিন কবে আসবে সত্যিই জানি না।”

সমাপ্ত

বিষয় মৌলিকত্ব
0
ভাষা সাবলীলতা
0
কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা প্রবাহ
0
শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ
0
অডিও/ভিডিও রূপান্তর যোগ্য
0
Average
 yasr-loader

About Post Author

9F10 DA

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post চোখের বদলে চোখ | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | সুকান্ত দাস | Bengali Thriller Story | 9F10
Next post ডায়রির ভাঁজ থেকে | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | অয়ন সাঁতরা | Bengali Murder Mystery Story | 9F10