ডায়রির ভাঁজ থেকে | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | অয়ন সাঁতরা | Bengali Murder Mystery Story | 9F10
0 (0)

২৩শে জুন, ১৯৮৮,

এখনো পর্যন্ত ড.উইলস্টনের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যাপারটা কাউকে জানাইনি। তবে এবার জানানোর সময় এসেছে। কারণ আমি আর বেশিদিন নেই। তাই চলে যাওয়ার আগে উত্তরাধিকার রেখে যাওয়াটাই শ্রেয়।

‘প্রোফেসার সমীরণ বাগচি… মানে, কয়েক মাস আগে যার রহস্যজনক অন্তর্ধান নিয়ে বেশ কয়েকটা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা বেরিয়েছিল?’

‘ঠিক ধরেছেন’।

-‘কিন্তু আমি তো যতদূর জানি, ওঁর ব্যাপারে ড.দিব্যেন্দু দাস না কি যেন…’

-‘ঠিকই জানতেন। উনিই দেখছিলেন। কিন্তু এক মাস হল উনি মারা গেছেন। আর তার পরেই আমি দায়ীত্বপ্রাপ্ত হই।’

–‘বেশ। আপনি ব্যাপারটার গোড়া থেকে শুরু করুন মিস বসু’ বলে অংশু ওর মোবাইল রেকর্ডারটা অন করল। দিশা টেবিল থেকে একটা কাচের গ্লাস তুলে নিয়ে একটুখানি জল খেল, তারপর তার কথা শুরু করল –

‘আজ থেকে বছর তিনেক আগে দঃআমেরিকার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে একটা ইন্ডিয়ান সার্ভে-টিম সার্ভে করতে গিয়ে কোনো এক গ্রামবাসীর কাছ থেকে বাংলা ভাষায় লেখা তিনটে ডায়ারি পায়। স্বাভাবিকভাবেই ডায়ারিটা নিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে একটা চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল, যার কারন অবশ্য ওই টিমের মধ্যে একজন ছিলেন বাঙালি। সেই বাঙালি যুবকের হাত ধরেই ডায়ারিটা এসে পৌঁছয় আমাদের এখানে’।

-‘তা এই ডায়ারি নিয়ে গবেষণাতে ড.দাস এলেন কিভাবে?’

-‘ড.দাস ছিলেন সেই যুবকের কলেজের প্রাক্তন প্রোফেসার। এবার ড.দাসের হাতে ডায়ারিটা তুলে দেওয়ার কারন, ওই যুবক দেখেছিল যে ডায়ারিগুলো কোনো সাধারন মানুষের রোজ নামচা নয়। কাজেই এই ডায়ারির সঠিক মূল্যায়ন হওয়া একান্ত প্রয়োজোন। বলা বাহুল্য উনি এও উপলব্ধি করেছিলেন, এই ডায়ারির ভিতর রয়েছে কোনো গুঢ় গবেষণার খসরা বা খসরার চেয়েও বেশি। যাই হোক, ড.দাস কিছুদিনের মধ্যে আবিষ্কার করলেন ডায়ারির লেখক প্রোফেসার এস.বাগচি হলেন এক সময় সায়েন্স কলেজের মেধাবী ছাত্র  সমীরণ বাগচি। তারপর থেকে শুরু হল সমীরণ বাগচির উপর রিসার্চ। আর ঠিক এই সময়টা থেকে দু তিনটে জার্নালে ড.দাসের ইন্টারভিউ বেরোতে শুরু করল। এরপর কয়েকদিনের মধ্যেই খুঁজে বার করে দেখা গেল সমীরণ বাগচি ‘মিছরি পুর’ নামের কোনো এক অখ্যাত গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। কোলকাতায় পড়াশুনা করতে এসেছিলেন পাঁচের দশকে। পড়াশুনা শেষ করে আবার গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন, সেখানে বিয়েও করেছিলেন। তারপর নাকি উনি পাগল হয়ে রাঁচিতে কয়েক বছর ভর্তি ছিলেন। তবে রাঁচির পর যে উনি কোথায় গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। তবে ‘মিছরিপুর’ গ্রামে গিয়ে ওখানকার পুরোনো লোকেদের থেকে ড.দাস জানতে পারেন, ওঁর এক দাদা ছিলেন, যিনি ওঁকে রাঁচির পাগলা গারোদে পাঠান এবং তারপর সেই দাদা গ্রামের পাট চুকিয়ে পশ্চিম বাংলার বাইরে কোথাও চলে যান। মিছরিপুরের বাড়ি অবশ্য উনি বিক্রি করেননি। আসতেন মাঝে মাঝে সেখানে এবং ওনার থেকেই গ্রামের লোক জেনেছিল যে প্রোফেসর বাগচি নাকি পাগলাগারোদ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এর বেশি প্রোফেসারের  সম্পর্কে জানা আর কারুর পক্ষে সম্ভব হয়নি’।

-‘হ্যাঁ, এগুলো তো ড.দাস তাঁর ইন্টারভিউতেও বলেছিলেন। তাছাড়া এ তো সবই প্রোফেসার বাগচির সম্পর্কে কিছু বেসিক ইনফরমেশান। আপনার সাথে কি হয়েছে সেটা বলুন’।

-‘বলছি। আসলে যে বিষয়ে আপনার কাছে এসেছি সেটা প্রোফেসার বাগচির এই ডায়ারির উপর গবেষণার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে’।

-‘বেশ বলুন’।

‘ যে তিনটে ডায়ারি পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো মাসখানেক চর্চা করে ড.দাস বুঝেছিলেন এর বাইরেও আরো দুটো ডায়ারি থাকার কথা, যেগুলো কোনোভাবে এখানে মিসিং’।

-‘ হ্যাঁ। ওনার একটা ইন্টারভিউতে উনি বলেছিলেন সম্পূর্ণ ডায়ারি নেই। ওই সংখ্যার কভার স্টোরির হেডলানটাও ছিল এরকম –‘অসম্পূর্ণ এক উপাখ্যান’ বা ওই জাতীয় কিছু’।

-‘ কিন্তু সম্পূর্ণ ডায়ারি পরে পাওয়া গিয়েছিল। সেকথা অবশ্য আর কোনো জার্নালে ছাপা হয়নি। বিষয়টা প্রকাশ্যে আনা রিস্ক হয়ে যাবে এই ভেবেই উনি কোনো ম্যাগাজিনে মুখ খোলেননি’।

-‘কেন? এমন কি ছিল সেই ডায়ারিতে? তাছাড়া বাকি অংশটুকু উনি পেলেন কোথায়?’

-‘ডায়ারি যে অসম্পূর্ণ, এই কথাটা পাবলিকলি বলার পর উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মিছরিপুরগ্রামে প্রোফেসার বাগচির বাড়িতে গিয়ে রিসার্চ আরম্ভ করবেন। সেইমত উনি গ্রামে গিয়ে রিসার্চ আরম্ভ করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ঘরের মধ্যেই একটা বাক্স থেকে ডায়ারির বাকি অংশটা পান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ডায়ারি লেখার শুরু তো ওনার ভারতবর্ষ থেকে অন্তর্ধান হওয়ার অনেক পরে। আর যেগুলো মিসিং ছিল, মানে ড.দাস প্রোফেসারের ঘর থেকে যেগুলো পেলেন, সেগুলো সবই সাউথ আমেরিকাতে বসেই লেখা। ডায়ারির পাতার উপরে তারিখের সাথে জায়গার নামেরও উল্লেখ আছে’।

-‘স্ট্রেঞ্জ! তারমানে সমীরণবাবু মাঝে একবার দেশে ফিরে এসেছিলেন?’

-‘এখানেই তো গল্প। বাগচিবাবু ফিরে এসেছিলেন কিনা সেটা জানার জন্য ড.দাস গ্রামের লোকেদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই ব্যাপারে। কিন্তু প্রত্যেকেই বলেছে যে ওনার স্ত্রী ওনার নিরুদ্দেশের বছর পঁচিশ পরে একবার এসেছিলেন ঠিকই, তবে সমীরনবাবু আসেননি’।

-‘তাহলে হতে পারে ওনার স্ত্রীকে উনি ওই ডায়ারিগুলো কুরিয়ার করে পাঠিয়েছিলেন!’

-‘ঠিক এটাই ড.দাস ও ভেবেছিলেন। কিন্তু ওনার স্ত্রী বা তার সন্তানেরা এখন কে কোথায় আছে সেটা কেউই জানে না। প্রোফেসার ওনার স্ত্রীর সাথে সুস্থভাবে বছর দুয়েক সংসার করেছিলেন। মেয়েও নাকি ছিল একটা। প্রোফেসারের পাগলাগারোদে যাওয়ার পরই মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান ওঁর স্ত্রী। সেই থেকে উনি আর কখনো আসেননি। হয়তো অন্য কোথাও বিয়ে দিয়েছিল ঘরের লোক। কিন্তু গ্রামের লোকের কথা অনুযায়ী প্রোফেসারের স্ত্রী ওনার নিরুদ্দেশের অনেক বছর পর, ওই বছর পঁচিশ পরে আরকি… একদিনের জন্যে একবার এসেছিলেন। কিন্তু আসার কারন কেউ কিছু বলতে পারল না। কারুর সাথে যে সদ্ভাব ছিল না বোঝাই যাচ্ছে। খোঁজখবর কেউ করেনি তাই’।

-‘বুঝলাম। এই পার্টটা একটু ঝাপসা। ঠিক আছে। তারপর বলুন’।

-‘ প্রোফেসারের যে তিনটে ডায়ারি প্রথমে পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো স্টাডি করলেই বোঝা যায় উনি কোনো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া স্পিসিস এর উপর কাজ করছিলেন। ডায়ারির নানান জায়গায় সেই প্রানীর পৃথিবীর বুকে আবির্ভাবের ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশ্চর্য সব থিওরিও দিয়েছেন। তার সাথে এও দেখা যায় সেই স্পিসিসের সন্ধানে প্রোফেসার ঘুরেছেন পৃথিবীর নানান জায়গায়। খরচ যে জুগিয়েছেন ওনার ব্রিটিশ বন্ধু উইলস্টন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ও ভালো কথা, এই প্রসঙ্গে বলে রাখি প্রোফেসারের গবেষণার সহকারী ও বন্ধু ছিলেন এই ড.উইলস্টন। এই উইলস্টনের খোঁজও এখন পাওয়া যায় না। যদিও খোঁজ না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারন চিঠি আর ডায়ারি থেকে বোঝা যায় সেই ব্রিটিশ ভদ্রলোকও ছিলেন সংসার ত্যাগী। যাই হোক, আসল সমস্যার জায়গাতে আসি। আপনি জানেন যে প্রোফেসার দঃআমেরিকাতে তাঁর ঘাঁটি গেরেছিলেন, আর সেখানেই উনি ওনার রিসার্চের জন্য ঘুরেছেন অনেক গহিন অরন্যে। এরকমই কোনো এক এক অরন্যে উনি এমন কিছু পেয়েছিলেন যা ছিল দুর্মূল্য। সেটা যে কি তা স্পষ্ট করে বলা না থাকলেও সেই জিনিস যে উনি ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছেন সে কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে কার হাত দিয়ে কিভাবে পাঠিয়েছেন তা কিছুই জানা যায় না। আসলে ডায়ারির অনেক পাতাই ছেঁড়া। কাজেই উনি এই বিষয়ে কিছু লিখে থাকলেও সে বিষয়ে কিছুই জানার উপায় নেই’।

এতটা বলে কিছুক্ষন থামল দিশা।

অংশু নীরবতা ভঙ্গ করে প্রথম বলল –‘দেখুন বিষয়টা একেবারেই বাচ্চাদের জন্য লেখা পাতি কমিক থ্রিলারের মত শোনালেও আপনার কথা তো অবিশ্বাস করার কোনো স্কোপ নেই। এবার কথা হচ্ছে আপনি কি এই গুপ্তধনের হদিস পেতে …’

-‘একেবারেই না। আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি এসেছি অন্য কারনে। তবে সেই কারনটা প্রোফেসারের গুপ্তধনই বটে। আসলে কি জানেন, ড.দাস এই ব্যাপারে কাউকে কিছু না বললেও বাইরের কেউ ঠিক এর খোঁজ পেয়েছে। আর খোঁজ পেয়েছে বলেই যে ড.দাসকে মরতে হয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি’।

-‘তার মানে আপনি বলছেন ড.দাসকে কেউ…’

-‘খুন। রিপোর্ট যদিও বলছে উনি পাহাড় থেকে পরে মারা গিয়েছেন, কিন্তু এখন আমার স্থির বিশ্বাস জন্মেছে ওটা খুন। নিশ্চয়ই ওনাকে কেউ পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলেছিল’।

-‘আপনার এরকম মনে হওয়ার কারন?’

-‘কারন গতকাল রাতে গুলি চলেছিল অংশুমান বাবু’।

-‘আপনার উপর? আর আপনি সেটা এখন আমায় বলছেন?’

-‘ঠিক আমাকে লক্ষ্য করেই গুলি করা হয়েছিল, এমনটা জোর গলায় বলতে পারছিনা। তবে আমার… মানে প্রোফেসার বাগচির সেই বাড়ি, যেখানে এখন সপ্তাহে পাঁচদিন আমাকে থাকতে হয়, সেই বাড়ির সামনের বাগান মত জায়গাটায় গুলি চলেছিল। একবার নয় দুবার। সম্ভবত বাড়ির বাইরে থেকে জানালা তাক করে আমায়…’

-‘কিন্তু আমি যদি ধরে নিই কেউ প্রোফেসারের সেই গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে, তবুও সে ওনাকেই বা মারলেন কেন আর আপনার উপরেই বা…’

-‘অতসত ভাবতে পারিনা। তবে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে ড.দাসের মারা যাওয়াটা এর সঙ্গে রিলেটেড’ বলতে বলতে একটু যেন গলাটা কেঁপে গেল দিশার।

অংশু বলল –‘আপনি স্থানীয় পুলিশকে ইনফর্ম করেননি?’

-‘খেয়াল ছিল না। সকাল হতেই বেড়িয়ে পড়েছি। আপনার নাম আমি শুনেছি আমার এক স্কুল ফ্রেন্ডের কাছ থেকে… তাই আর কি…’

-‘হুম। কিন্তু আমার হিসেব বলছে পুলিশের কাছে খবর এর মধ্যে চলে গেছে। কারন গুলিটা আপনি বলছেন বাড়ির বাইরে চলেছিল। কাজেই কোনো না কোনো ভাবে…’ অংশুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মোবাইলটা বেজে উঠল।

-‘হ্যাঁ আঙ্কেল বলুন’। … ওপারের কথা শুনে অংশু আড় চোখে একবার দিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল –‘আমি অলরেডি এই কেসে ইনভল্ভড’।

Pages ( 1 of 10 ): 1 23 ... 10তারপর »

About Post Author

9F10 DA

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post ছায়া শরীর | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | কেয়া চ্যাটার্জী | Bengali Thriller Story | 9F10
Next post দক্ষিণ বাড়ির গুপ্তধন | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | মৌসুমী দাশ | Bengali Murder Mystery Story | 9F10