ল্যাম্প পোস্টের আলো ব্যালকনির দরজা দিয়ে ঢোকার জন্য সম্রাটের অন্ধকার ফ্ল্যাটের বেডরুমটা বেশ মায়াময় হয়ে আছে। অংশু সেই ঘরে ঢোকার পর সম্রাট আলো জ্বালিয়ে দিল।
-‘বলুন কি জন্যে এসেছেন?’
-‘সরাসরি কাজের কথাতে আসতে বলছেন?’
-‘সেটাই ভালো হবে। দেখুন, দিশা আপনাকে কি বলেছে আমি জানি না। তবে যদি বলে থাকে অরুনাভকে আমি খুন করেছি, তাহলে বলব তার সন্দেহ অমূলক নয়। তবে ‘ধারনা’ আর ‘বাস্তব’টা এক নয়’।
-‘তারমানে অরুনাভকে খুন করার মোটিভ আপনার ছিল?’
-‘ছিল’।
-‘আপনার স্পষ্ট উত্তর কিন্তু আমায় আপনাকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করছে। আমি আশা করব আপনি বাকি উত্তর গুলোও স্পষ্টই দেবেন’।
-‘বলুন’।
-‘কাল আপনি রাতে মিছরিপুর কি উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলেন?’
-‘অরুনাভকে খুন করতে নয়’।
-‘এটা আমার প্রশ্নের পুরো উত্তর নয়’।
-‘আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি? আহলে আপনার উত্তরগুলো দিতে আমার সুবিধে হয়’।
-‘করুন’।
-‘আপনি প্রোফেসার বাগচির ব্যাপারে কতটুকু জানেন?’
-‘যতটুকু মিস বসু আমাকে বলেছে আর ড.দাসের রিসার্চ থেকে যতটা জানতে পেরেছি’।
-‘ঘেঁচু জেনেছেন তাহলে। ওরা সবাই তো ওই গুপ্তধনের গপ্প দিয়ে বেড়াচ্ছে’।
-‘কেন? গুপ্তধন নেই?’
-‘থাকবে না কেন? তবে যেটা আছে, সেটা কোনো ক্যাশ মানি নয় বা সোনার দোকানে বিক্রি করার জিনিস নয়’।
-‘আপনি এত সব জানলেন কোত্থেকে?’
-‘আপনি প্রাইভেট ডিটেক্টিভ তো?’
-‘এ প্রশ্নের অর্থ?’
-‘আমার এক কাজিনের থেকে আপনার কথা আমি আগে শুনেছি। কাজেই আপনাকে বিশ্বাস করে সবটা বলাই যায়, তবে এই কেসে আপনি পুলিশের হয়ে কাজে নেমেছেন কিনা সেটা জানতে চাইছি’।
-‘আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারেন’।
-‘তাহলে শুনুন… প্রোফেসার বাগচির ডায়ারি দঃআমেরিকা থেকে যে সার্ভে টিমের হাত ধরে ভারতে এসেছে, সেই সার্ভে টিমে থাকা বাঙালি ছেলেটি আমার কলেজেরই এক বছরের সিনিয়ার। সিনিয়ার হলেও সে ছিল আমার বন্ধু মতো। কাজেই কোলকাতায় ফিরে প্রোফেসারের ডায়ারি প্রথম সে আমার কাছে নিয়ে আসে। আমিই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ডায়ারি ড.দাসের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারন সেই ডায়ারির আসল বিষয়বস্তু ছিল মিসিং লিঙ্ক’।
-‘মিসিং লিঙ্ক!’
-‘ইয়েস। আজও যা নিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো গবেষক পেপার সাবমিট করে চলেছেন।
ডায়রি থেকে আমরা জানতে পারি প্রোফেসার বাগচি তাঁর বন্ধু উইলস্টনের সঙ্গে দঃআমেরিকার প্রত্যন্ত গহীন জঙ্গলে ঘুরে মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক চাঞ্চল্যকর তথ্যর সন্ধান করেছিলেন। আর তাই জন্যে এই বিষয়ে দক্ষ একজন মানুষ, অর্থাৎ ড.দাসের স্মরনাপন্ন হই আমরা। আমাদের দুই বন্ধুর উদ্যোগেই কিছু জার্নালে সেই কথা প্রকাশ পায়। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যে ড.দাস বললেন পত্রিকায় এখনি কোনো কথা বলবার সময় আসেনি। ‘কেন সময় আসেনি’ জিজ্ঞেস করায় উনি আমদের বলেন এই ডায়ারির নাকি অন্য রহস্য আছে। বললেন এই ডায়ারির উপর এর আগেও কেউ রিসার্চ করেছিল, এবং সেই প্রথম গবেষকের কাছেই হিসেব মত আরো দুটো ডায়রি আছে। সে কথা অবশ্য সত্য। কিন্তু যা সত্য নয় তা হল ওই গুপ্তধনের কথা। ‘আসল গুপ্তধনের’ খোঁজ ড.দাস পেয়ে গিয়েছিলেন বলেই বাকিদের উপকথার গুপ্তধনের গপ্প শোনালেন’।
-‘আসল গুপ্তধন মানে?’
-‘আমার স্থির বিশ্বাস ড.দাস ওই পেপারগুলো নিয়ে কোনো বিদেশী সংস্থার সঙ্গে ডিল করেছিলেন। আর এই ব্যাপারে যাতে কেউ কিছু জানতে না পারে তাই সকলের অলোক্ষ্যে মিছরিপুর গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন দার্জিলিঙে। আর যাওয়ার আগে গল্প ফেঁদে গেলেন নকল গুপ্তধনের’।
-‘ইন্টারেস্টিং। এত সব কিছু মিস বসু জানেন না?’
-‘না। তাকে বলিনি, কারন সেও এখন আমার সন্দেহের আওতায় পরে’।
-‘মানে?’
-‘সেকি মশাই? মক্কেল বলে তার সাত খুন মাফ করে দিয়ে বসে আছেন যে! ড.দাসের সঙ্গে তারও যে হাত ছিল না আপনি জানছেন কি করে? দেখুন সত্যি কথা বলতে কি, দিশার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ওই ড.দাসের সূত্রেই। কাজেই ড.দাসের প্ল্যানের ব্যাপারে সে কছু জানে না …উঁহু, আমার বিশ্বাস হয় না। এমনকি আমার কি মনে হয় জানেন?’
-‘কী?’
-‘ড.দাসের মৃত্যুর পিছনেও দিশারই হাত আছে’।
-‘এটা আপনি কি করে বলছেন?’
-‘আপনি জানেন অরুনাভ কোথাকার ছেলে?’
-‘হ্যাঁ। শুনেছি। সে ভারতীয় বংশোদ্ভূত, কিন্তু ব্রিটিশ’।
-‘ইয়েস। আর সে যে ইউনভারসিটির হিস্ট্রির ছাত্র ছিল, সেই ইউনিভার্সিটিরই গবেষক বর্তমানে। ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষোনারত তার কোনও বন্ধু, যার কাছে হয়তো…’
-‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, মিস বসু উপর চালাকি করে ড.দাসকে রাস্তা থেকে সরিয়ে এখন গবেষণার নাম করে অরুনাভবাবুর সাথে নতুন করে ডিল করেছিলেন?’
সম্রাট একটা চেয়ার টেনে নিয়ে অংশুর মুখোমুখি বসে অবিকল কমল মিত্রর স্টাইলে বলল –‘বলতে চাইছি নয়, বলছি’।
এবার অংশুর একটু নড়ে চড়ে বসে বলল –‘ধরুন আমি আপনার সব কথাই বিশ্বাস করলাম। কিন্তু কাল রাতের ব্যাপারটা এখনো ধোঁয়াশায় থেকে গেল’।
-‘বলছি। ড. দাসের ভাবগতিক আমাদের অন্যরকম লাগতে শুরু করে যখন থেকে, তখন থেকেই আমরা আমাদের চেনা একটি ছেলেকে কেয়ার টেকার সাজিয়ে মিছরিপুরে পাঠাই টাইম টু টাইম ইনফরমেশান কালেক্টের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেও ক্রমশ আমাদের দল থেকে সরে যায়। কেয়ারটেকার হিসেবে সে থেকে যায় ঠিকই, তবে ব্যাক্তিগত কোনো মতলবে। ওর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারনা নেই। তবে ড.দাস মারা যাওয়ার পর থেকে আমি অরুনাভর উপর নজর রাখতে শুরু করি। অরুনাভকে কেন্দ্র করে অবশ্য আমার আর দিশার মধ্যে পারসনালি অন্য ব্যাপারেও ঝামেলা হয়েছে ইভেন কালকের ঘটনার সূত্রপাতের পিছনেও সেই ঝামেলাটাই ছিল। এবার আসি আসল কথায়, গতকাল রাতে আমি মিছরিপুরে গিয়েছিলাম প্রোফেসারের বাড়ি থেকে কাগজপত্র কিছু চুরি করতে। কারন দিশা ইতিমধ্যে যে পেপার নিজের কাছে এনে রেখেছিল, তা সবই জেরক্স। অরিজিনাল ডায়ারিগুলো ওখানেই ছিল। কিন্তু পোরশু আমি ওখানে পৌছানোর পরেই বৃষ্টির বেগ আরো বারে। ফলে দ্রূত বারান্দায় উঠে আগে রেনকোট খুলে সেটার জল ঝরানোর জন্য কোনো জায়গা খুঁজছিলাম, এমন সময় কারুর চাপা আর্তনাদ কানে আসে। আমি রেনকোট পরে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে বাইরে আসি। দেখি দুটো লাশ পরে আছে। স্বাভাবিক ভাবে প্রচন্ড ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসি’।
কিছুক্ষন চুপচাপ।
তারপর সম্রাটই আবার বলল –‘কিন্তু একটা জিনিস আমি দেখেছিলাম অংশু বাবু’।
-‘কী?’
-‘আমি বাইকে ওঠার সময় আর একটা বাইককে স্পিডে চলে যেতে দেখেছিলাম’।
-‘তারমানে অন্য কেউ ওদের দু জনকে… কিন্তু দুজনের হাতেই তো রিভলভার পাওয়া গেছে? দেন?’
-‘অত-শত জানি না। যা দেখেছি তাই বললাম’।
-‘আপনি কি মিস বসুকে পোরশুর সেই বাইক নিয়ে পলাতক হিসেবে সন্দেহ করতে বলেন?’
-‘আমি বলার কে?’
-‘আচ্ছা। অনেক ইনফরমেশান পেলাম। কথাগুলো মাথায় থাকবে’ বলে অংশু বেড়িয়ে যাচ্ছিল, দড়জার কাছে এসে আর একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল –‘আর হ্যাঁ। আপনার কথা গুলো সব সত্যি হলেও না, কোথাও যেন একটা ‘মিসিং লিঙ্ক’ থেকে যাচ্ছে। ওয়েল, সেটা আপনার দোষ নয়। ওটা আমার খুঁজে দেখার দায়িত্ব। গুড বাই’।