Getting your Trinity Audio player ready...
|
৭
‘শোন, আজ বিকেলে হেদোয়ায় আমার জন্য ওয়েট করিস কাজ আছে’।
-‘কেস কি শেষের পথে?’
-‘বলতে পারিস। আজ রাতের মধ্যেই একটা এসপার ওসপার হয়ে যাওয়া উচিত’ বলে ফোনটা রেখে দিল অংশু। তারপর আবার গাড়ি স্টার্ট করল। অংশু এখন সম্রাটকে নিয়ে চলেছে প্রোফাসার বাগচির শ্বশুরবাড়ির দিকে।
‘আমাকে প্রোফেসার বাগচির শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অর্থ কী? তাছাড়া আপনি পুলিশও নন। আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে যেতে বাধ্য নই’। ভুরু কুঁচকে কথাটা বলল পাশের সিটে বসে থাকা সম্রাট।
-‘আপনি আমার সঙ্গে যেতে বাধ্য। কেসের সুরাহা করার ব্যাপারে এখন আমি পুলিশের সাহায্যকারী বলতে পারেন। শুরুটা আপনার বান্ধবীর মক্কেল হসেবে করলেও আপনার বয়ান আর অরুনাভ বাবুর খুন সেই ট্র্যাক থেকে আমাকে বার করে এনেছে। কাজেই কেস যখন গুটিয়ে এসেছে, তখন তাড়াতাড়ি চ্যাপ্টার ক্লোস করার জন্য আপনার উপর এটুকু কর্তৃত্ব ফলাবার অধিকার আমার আছে সম্রাটবাবু’।
-‘কিন্তু আমার আপনার সঙ্গে এখন প্রোফেসারের শ্বশুরবাড়ি…’ সম্রাটকে কথা শেষ করতে না দিয়ে অংশুই বলে –‘যাওয়ার সম্পর্ক আছে সম্রাটবাবু। এমনি এমনি আমি আপনাকে হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছি না। তাছাড়া আমি এখন আপনার ব্যাপারে অনেকখানি জেনে গেছি সম্রাটবাবু। মিথ্যে বলে তো কোনো লাভ নেই আর’।
-‘কী জেনে গেছেন আপনি?’
….
‘এবার আমাকে কী করতে হবে?’
অংশু গত দু ঘন্টা ধরে এদিক ওদিক ফোন করে গেছে একধার থেকে। অংশু কাকে কাকে ফোন করেছে, সেসব কিছু জানে না মিতা। এমনকি মিতার বাবা কৌশিকবাবুও থানা থেকে বাড়ি ফেরা ইস্তক ছটফট ছটফট করছে আর মাঝে মাঝে অংশুর সঙ্গে গুজগুজ ফুসফুস করছে। গতকাল অংশু কৌশিকবাবুকে কিছু একটা খোঁজ নিতে বলেছিলেন আর আজ সকালে সেই খোঁজ নিয়ে আসার পর থেকে কৌশিকবাবু যথেষ্ট উত্তেজিত। এদিকে অংশুর কথামত আজ রাতে মিছরিপুরে প্রোফেসার বাগচির বাড়িতে নৈশ অভিযানের কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিতে হবে মিতাকে। অথচ কালপ্রিট সম্পর্কে মিতাকে কিছুই জানায়নি অংশু। মিতাকে নাকি সব বলে দিলে ও রোমাঞ্চিত হয়ে শেষমেশ সব ভুন্ডুল করে দেবে।
যাই হোক, অংশুর একমাথা থেকে সব ফোন করা শেষ হলে মিতা জিজ্ঞেস করল ‘এবার আমাকে কী করতে হবে?’
-‘কিচ্ছু না। স্রেফ মরা সৈনিকের অ্যাক্টিং করে যাবি। মানে নো ডায়লগ। যে আসবে, তার দিকে পিছন ফিরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি। বাকিটা তো আমরা দেখব’।
মিতাকে তার রোল বোঝানোর পরেই কৌশিকবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ‘এই অংশু, আমি তাহলে এয়ারপোর্টে চলে যাচ্ছি। আর তুমি ইন্সপেক্টার দত্তর সাথে…’
ইন্সপেক্টার দত্ত কৌশিকবাবুকে থামিয়ে বললেন –‘আরে আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না স্যার। আমার ওখানকার ফোর্স এত কাঁচা নয়। আপনার মেয়ে একদম সেফ থাকবে’।
-‘না না ঠিক আছে। ওসব নিয়ে আমি ভাবছি না। আপনারা সবাই তো আছেন’।
দত্তবাবু আর কৌশিকবাবুর কথা শুনে মিতা উত্তেজনা অনুভব করে –‘তারমানে গুলিগালা চলতে পারে?’
রাত গভীর হয়েছে। প্রোফেসারের ঘরের বারান্দায় চল্লিশ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে। মিতা বারান্দা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক দাঁড়িয়ে নেই, আস্তে আস্তে পায়চারি করছে আর মাঝে মাঝে হাতে থাকা পেল্লায় সাইজের টর্চ জ্বেলে গেটের দিকে তাকাচ্ছে।
অংশুরা দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। আড়ালে।
-‘এখনো তো আসছে না। আসবে আদৌ?’ ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলেন ইন্সপেক্টার দত্ত।
-‘আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে?’
-‘না মানে, ব্যাপারটা একটু অবাস্তব কিনা…’
-‘বাস্তব কি অবাস্তব সে তো এলেই বুঝতে পারবেন মশাই’।
-‘এখানে বসে বসে মশার কামড় খাওয়াটাই না শেষ পর্যন্ত বৃথা হয়!’
-‘আপনার প্রোমোশান দরকার আছে কি নেই? সারাজীবন এখানকার মশার কামড় খেতে না চাইলে এখন…’
অংশুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ইন্সপেক্টার দত্ত অংশুর শার্টের আস্তিনটা চেপে ধরল। অংশুও দেখল, একজন বাইক থেকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নেমে প্রথমে কিছুক্ষন রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করল। সম্ভবত অন্য কেউ তাকে দেখছে কিনা সেটা পরখ করবার জন্য। দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে ছেলে না মেয়ে? তারপর ধীরে ধীরে সেই আগন্তুক গেট খুলে ভিতরে ঢুকল। বারান্দায় কম পাওয়ারের বাল্ব ছাড়া আর কোনো আলো না থাকায় আগন্তুকের মুখ এখনো অস্পষ্ট। সে ধীরে ধীরে মিতার দিকে এগোতে শুরু করতেই ইন্সপেক্টার দত্ত উঠতে যাচ্ছিলেন, অংশু বাধা দিল। ‘কি করছেন টা কী? সব ভেস্তে দেবেন যে। একটা আধটা কথা বলতে দিন’।
কথা শোনা যাচ্ছে না ঠিকই, তবে অল্প সময়ের ব্যাবধানেই একটা দমবন্ধকর ঘটনা ঘটে গেল। আগন্তুক কথা বলতে বলতে হঠাতই মিতার ঘাড়ের কাছে বন্দুক ধরে বসে। দত্তবাবু এই দেখে তাঁর ফোর্স নিয়ে এগিয়ে যেতে গেলেই আগন্তুকও হুঙ্কার দেয় –‘কেউ এগোবেন না। নইলে…’ ব্যাস, এতটুকুই বলতে পারল সে। যে মুহূর্তে তার মনঃসংযোগ মিতার দিক থেকে ঘুরে গেছে, সেই মুহূর্তেই মিতা আগন্তুকের পেটে কনুয়িয়ের গুঁতো মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। তবে তার হাত থেকে বন্দুক ছিটকে না পরায় এলোপাথারি একটা গুলি সে চালিয়েছে। তারপর ছুট। অংশু আর দত্তবাবুও ছুট লাগিয়েছে। আগন্তুক বাইকে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তে দত্তবাবু ওর পায়ে গুলি করলেন। উলটে সেও তার বন্দুকের সদব্যাবহার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই অংশু লাথি মেরে তার হাত থেকে বন্দুক ফেলে দিয়েছে।
অবশেষে গুলিগালার আওয়াজ শুনে পাশাপাশি বাড়ি থেকেও লোকজনেরা বেড়িয়ে এসেছে। বাগচিবাবুর বাড়ির পিছন দিকে যেসব পুলিশের গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন ইন্সপেক্টার দত্ত, সেখান থেকে বাকি পুলিশেরাও এসে পড়েছেন।
মিতাও এসে দাঁড়িয়েছে। আগন্তুকটি কে, সেটা তার জানার আগ্রহ সব থেকে বেশি। কারন তাকেই টোপ হিসেবে দাঁড় করিয়ে কাজটা হল ঠিকই, কিন্তু তখন এতসবকিছু তাড়াতাড়ি হল যে, মিতার এটাই দেখা হয়ে ওঠেনি কার পেটে সে গুঁতোটা মেরেছিল। এবার অংশুর পাশে এসে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল। দুটো পুলিশ সেই আগন্তুকের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে।
ইন্সপেক্টার দত্তর হাতে রিভলভারটা তুলে দিয়ে অংশু বলল –‘তাহলে দত্তবাবু, আপনার অবাস্তব জিনিসটা এবার বাস্তব হল তো’।
-‘সত্যি, মানে আমি তো এখনো…’
ইন্সপেক্টার দত্তর কথা শেষ হওয়ার আগেই আরো দুটো গাড়ি এসে প্রোফেসারের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। গ্রামের লোকেরা স্বাভাবিক ভাবেই ভিড় করে আছে। একেকজনের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের ভয় ও কৌতুহল দুটোই একসাথে আছে। কারন বিগত কয়েকদিন ধরে রাতের দিকে গুলির আওয়াজটা তাদের কাছে একরকম অসহ্য ও অসহনীয় হয়ে উঠেছে। পুলিশদের দেখলেও তারা বিরক্তই হয় এখন। তবে আজ ব্যাপার স্যাপার দেখে তারাও অনুমান করতে পেরেছে, এবার বুঝি সমাধান কিছু হল।
কৌশিকবাবু গাড়ি থেকে নেমেই বললেন –‘তাহলে এদিকে সব ঠিক ঠাক তো? আমি সবাইকে নিয়ে এসেছি’।
-‘একদম। দত্তবাবুর এত তৎপরতা কি বিফলে যেতে পারে!’
লজ্জায় ও গর্বে দত্তবাবু কান অবধি হেসে ফেললেন।