কুয়াশা যখন কাটলো | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | ডাঃ দেবাশীষ কুন্ডু | Bengali Adult Thriller Story | 9F10
0 (0)

(১)

১৯৩২ এর বড়দিনের সন্ধ্যা ,গির্জায়  প্রার্থনার পর স্থানীয় এক সদ্য বিবাহিত কৃষক দম্পতি তাদের গৃহে ফিরে আসে । প্রতিদিন প্রার্থনার শেষে, তারা একাই হেঁটে বাসায় ফেরে । আজও তার ব্যতিক্রম হলো না, শুধু যোগ হলো আরো তিনজন! মানে যারা নিঃসাড়ে ওদের ফলো করতে করতে আসছিলো। কৃষকটি পরিবার বাড়িতে পৌঁছোবার পর , সেই তিনজন তাদের বাড়িতে ঢুকে কৃষক কে গুলিবিদ্ধ করে, তার স্ত্রীকে নিয়ে সারারাত ধরে মোচ্ছবের পর বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় মেরে চলে গেলো, আর ভোরের আলো  ফোটার আগেই তাদের ক্যাম্পে ফিরে গেলো ।

হতভাগ্য যুবতীর নাম ইরিন , মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ২৫  বছর এবং সে একজন স্থানীয় কৃষকের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী ছিল , তার হতভাগ্য স্বামীর  গুলিবিদ্ধ পাওয়া দেহ যায় পিছনের ঘর থেকে।

লেফটেন্যান্ট জন অটোয়ার  তার রেজিমেন্টের তিনজন সৈনিকের পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে এই পাশবিক নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাতে যুক্ত থাকার দৃঢ় সন্দেহ প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে একটি প্রদেশের রেসিডেন্ট কমিশনার পদে নিযুক্ত করে ইন্ডিয়া তে পাঠিয়ে দেয়, আর অভিযুক্ত তিন সৈনিককে সতর্ক করে ‘ নির্বাসনে’ পাঠিয়ে দেয়া হয় কেনিয়াতে । বিচার বিভাগ বিষয়টা কে সুচারু দক্ষতায় চাপা দিয়ে দেয়

তদন্ত ফাইলে যুবতীর শরীরের গুরুতর ক্ষত রেকর্ড করা হয়েছিল, কিন্তু  হত্যার জন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। “আদালত ঘোষণা করে ,  উল্লিখিত মৃত যুবতীর  মৃত্যুর কারণ ছিল যোনিপথ এবং আশেপাশে রক্তক্ষরণের সঙ্গে  মাথার খুলির ফ্র্যাকচার। আর মৃত কৃষকটির মৃত্যু হয়েছে গুলিতে । যা এক বা একাধিক ব্যক্তি বা অজ্ঞাত ব্যক্তি দ্বারা সৃষ্ট এবং এই ধরনের ব্যক্তি বা অজ্ঞাত ব্যক্তিরা হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী। এই মহিলার আর কৃষকটির মৃত্যুর সাথে কোন সৈনিকের সংযোগের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় নি  ।”

                                               (২)

ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বাড়ি থাকায় কাজে অকাজে আমি  গুয়াহাটি প্রায়ই যাই, বন্ধু মহলে সবাই জানে ।  অনেককেই বলেছি ওখানে কাছাকাছি দারুন সব টুরিস্ট স্পট আছে, মেঘালয়, মনিপুর , অরুণাচল, মিজোরাম,  ত্রিপুরা,  নাগাল্যান্ড, প্রতিটি রাজ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পর্যটকদের আকর্ষণের অসংখ্য  স্পট। আর গুয়াহাটির বিখ্যাত কামাখ্যা মন্দির তো আছেই, সকলে মিলে চল একবার বেরিয়ে পড়ি।   বন্ধুদের একসঙ্গে সময় বের করার অসুবিধা হোক অথবা  সময়াভাবে এতদিন অবধি তা আর হয়ে ওঠেনি ।   তাই যখন আমি গুয়াহাটিতে থাকাকালীন দিল্লি থেকে অজিতের ফোনটা এলো, ‘তুই এখন কি গুয়াহাটিতে?  আমি কাল আসছি আমার কিছু জরুরী কাজ আছে দিমাপুরে ওটা মিটিয়ে তারপর বেড়াবার প্ল্যান করব,’  তখন যৎপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম ।   নির্ধারিত সময়ের সামান্য পরে গোপীনাথ বরদোলুই বিমানবন্দরের টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে এলো অজিত ।   ফার্মা কোম্পানির উচুপদে থাকার কারণেই বোধ হয় চেহারার মধ্যে কর্পোরেট ছাপ পড়েছে, শুধু দৃষ্টিকটু মধ্যপ্রদেশ টা যার জন্য দামি শার্টের কয়েকটি বোতাম ছিঁড়বো ছিঁড়বো করছে ।  দুজনে হাই – হ্যালোর পর বিমানবন্দর থেকে ক্যাব বুক করলাম, গন্তব্য বেলতলা দেখে অজিত বলল, ‘মাত্র চার ঘন্টা সময় হাতে, তোর দাদার বাড়ি পৌঁছে চট করে জরুরী জিনিসপত্র গুছিয়ে নিবি, কারণ আমাদের গুয়াহাটি স্টেশনে যেতে হবে, তোর টিকিট আমার করাই আছে, সন্ধে ছটা পঞ্চাশের রাজধানী এক্সপ্রেস ।’   

শুনে রীতিমত মাথা গরম হয়ে গেল আমার,  ‘গুয়াহাটির ট্রাফিকের অভিজ্ঞতা তোর তো নেই তাই এরকম বোকামো করতে পারলি , এয়ারপোর্ট থেকে বেলতলা তারপর স্টেশন, রাস্তা নেহাত কম নয় আর বিশ্রী জ্যাম লেগে আছে সব সময় ’  

বেলতলায় বুড়ি ছোয়ার মত করে পৌঁছে , যেমন তেমন করে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে বৌদিকে ‘ফিরে এসে বলছি’ বলে দুর্গা নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, ভাগ্যক্রমে ট্রেনটা পেয়েও গেলাম । নামেই রাজধানী, ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর হলো না , কারণ আমাদের বগির বাতানুকূল যন্ত্রটি আলিপুরদুয়ার ছাড়ার পর থেকেই কাজ করছিল না, কোকরাঝাড়ে কাজ চালানোর মতো করে দেওয়া হয়  কিন্তু গুয়াহাটি ছাড়ার পরেই তা আবার বিগড়েছে ।

আগস্টের শেষ সপ্তাহের ভ্যাপসা গরমে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা ।

টিকিট পরিদর্শক অথবা গার্ড কেউই সুরাহা হবার আশ্বাস দিতে পারলেন না ।

যন্ত্রণার ট্রেন যাত্রা রাত ১১ টা ৫০ নাগাদ শেষ হলো ট্রেন ডিমাপুর পৌঁছাতে ।

স্টেশন থেকে হাঁটা পথে দূর্গা মন্দির ও সবজি মন্ডি  লাগোয়া একটি হোটেল দেখে অজিতের পছন্দ হলো । আমাকে বলল, ‘তুই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে , আমি একটু পরেই আসছি’ ।

বয়ের সাথে রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে কেবিল টিভির চ্যানেল সার্ফ করতে করতে অনুভব করলাম, খিদের চোটে পেটের নাড়িভুড়ি মোচড় দিতে শুরু করেছে ।

সেন্টার টেবিলে রাখা ছিল মেনু কার্ড যা দেখে আমার খিদে আরো বেড়ে গেছে ।

কিন্তু রিসেপশনে ফোন করতে বলল, সকালের আগে কিছুই পাওয়া যাবে না ।

দরজায় টোকা খুলতেই দেখি রিসেপশনের ছেলেটি একটা চাকা দেয়া  সার্ভিসিং টেবিল ঠেলতে ঠেলতে  নিয়ে এসেছে, সঙ্গে অজিত । কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট বোধহয় একেই বলে । লজিজ খাদ্য সঙ্গে পানীয় , সদগতি করে  শুয়ে পড়লাম । যখন ঘুম এলো তখন ঘড়ির কাটায় তিনটে ।

সকালে ঘুম ভাঙলো অজিতের ধাক্কায়,  ‘কিরে কুম্ভকর্ণের মত ঘুমালে চলবে? যেতে হবে সেই সিক্স মাইল। গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে’ । ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি, টপ ফ্লোরের রেস্তোরাতে । পর্ক আর মাশরুম দেওয়া হাককা নুডলস আর কফি । পর্ক আমার চলবেনা, তাই বেদানার জুস আর  ফ্রুট কেক অর্ডার করলাম ।

সিক্স মাইলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে জনৈক মিসেস নারোর খোঁজ পেতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হলো না,  কারণ যাকে খোঁজ করছি তিনি সাব রেজিস্টার,  আর রিসেপশনে হাজিরা খাতায় তিনি তখন সই করছিলেন । আমাদের ওনার রুমে ডেকে নিলেন । 

অজিতের কোন এক কাজিন এখানে ইতিহাস বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে মনোনীত হয়েছে,  তার জন্য ‘প্রি জয়েনিং রেকি’

মিসেস নারো বললেন, ইউনিভার্সিটি  সদ্য শুরু হচ্ছে আর মূল শহর থেকে অনেকটাই দূরে তাই ক্যাম্পাসের মধ্যে একোমোডেশন প্রোভাইড করা হচ্ছে ।

হোটেলে ফেরার পথে আমরা লাঞ্চ করলাম অজিতের পূর্ব পরিচিত মিজু সাংমার বাড়িতে । ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা খুব মিষ্টি স্বভাবের আর অতিথিবৎসল । মিজু সাংমা অজিতের সঙ্গে একই কোম্পানিতে আছেন ।

আমরা আজই কোহিমা যাবো শুনে মৃদু বাধা দিলেন, বললেন, ‘পাহাড়ি ভাঙাচোরা রাস্তা আর রয়েছে অতলস্পর্শী  খাদ , এছাড়া কিছু উপদ্রুত এলাকা  যাত্রাপথে পড়বে। এখনই তো পৌনে পাঁচটা বাজে, ক্যাব এই পথে সন্ধ্যার পর যেতে চাইবে না, আপনারা বরং কাল আর্লি মর্নিং রওনা দিন’ । কিন্তু একগুঁয়ে অজিতকে নিরস্ত করা গেল না । কারণ একটা আছে জুৎসই,  আজ থেকে চার দিনের মাথায় ফ্লাইটের টিকিট কেটে রেখেছে ডিমাপুর থেকে দিল্লি ভায়া কোলকাতা অর্থাৎ হাতে সময় মাত্র দুদিন ।

হোটেলে পৌঁছে দ্রুত বিল মিটিয়ে ব্যাকপ্যাক দুটো নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে স্ট্যান্ড যেখান থেকে পাওয়া যায়  কোহিমা যাবার ক্যাব।

                                                  (৩)

মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর কিন্তু ওই তিনজনের মন থেকে প্রতিশোধের আগুন নেভেনি । আফ্রিকার মতো জায়গায় পোস্টিং মানে যে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ সেটা  তারা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে । তাই ‘নির্বাসন পর্ব’ মিটতে ইংল্যান্ডে ফেরার পর খোঁজ নিয়ে যখন জানলো, লেফটেন্যান্ট জন অটোয়ার  কে  কর্তৃপক্ষ একটি প্রদেশের রেসিডেন্ট কমিশনার পদে নিযুক্ত করে ইন্ডিয়া তে পাঠিয়েছেন তখন তারা ইন্ডিয়াতে আসার সিদ্ধান্ত নেয় কলকাতায় পৌঁছোবার পর ‘সঠিক লোকেশনে’ পৌঁছতে তাদের খুব বেশি দেরি হয় না

ঘটনাচক্রে রেসিডেন্ট কমিশনারকে যেদিন বিশেষ সরকারি কাজে দিল্লিতে যেতে হলো সেদিন দুপুরে ওই তিনজন তার বাংলোয় পৌঁছলো । ইংল্যান্ড থেকে হঠাৎ আসা ‘হাজব্যান্ডের বন্ধুদের’ স্বাগত জানায় আমান্ডা । রূপসী, আঁটোসাঁটো যৌবনের স্বর্ণকেশীকে দেখে কার্লের আর সঙ্গীদের জান্তব ক্ষিধেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে

ওদের সামনে প্রথম বাধা আমান্ডার ডগি লিজা, কুকুরটা কে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘাড় মটকে দেয় ওয়ারেন । ওদের সামনে দ্বিতীয় ও অন্তিম বাধা খুংখার শিকারী রেংমা জনজাতির সর্দারের ছেলে মহালো যে বাংলোর পাহারায় রয়েছে । বিকালে আশপাশটা দেখানোর জন্য কার্ল আর সঙ্গীরা তাকে অনুরোধ করলো। বাংলো থেকে একটু দূরে এসে কার্ল তাকে অফার করলো সিগারেট আর কথা বলতে বলতে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে এক পোঁচে দুফাঁক করে দিল গলার শ্বাসনালীটা । এরপর চোখ পড়লো মহালোর মাথার রং বেরঙের পালক লাগানো সোনার মোটা তারের শিরোস্ত্রাণের ওপর।  কার্ল ওর  শিরোস্ত্রানটা খুলে নিজের মাথায় পরে নিলো। বাধা সরানোতে সফল হবার উত্তেজনায় কার্ল আর সঙ্গীরা ফিনকি দিয়ে বেরোনো রক্ত মেখে নিলো নিজেদের মুখে। 

সন্ধ্যায় তখন আমান্ডা পোশাক পরিবর্তন করছিলো, চুপিসারে তারা দোতলায় উঠে এলো আর পা টিপে টিপে ঢুকলো আমান্ডার বেডরুমে । 

একটানা তিনঘন্টা পাশবিক অত্যাচারের পর, যখন ওরা বুঝতে পারলো ওদের ‘প্রতিশোধ’ আর জৈবিক চাহিদা দুটোই মিটেছে! ঠিক তখনই ওরা চিন্তায় পড়ে গেলো, “এই মেয়েটাকে এখন কী করা যেতে পারে?”

সর্বপ্রথম ডেরেক মুখ খুললো, রাগের মাথায় তো এসব করে ফেললাম! এখন এর কি করবো?

এখানেই ফেলে চলে যাই।

কার্ল আর ওয়ারেন একসঙ্গে বলে উঠলো, ঠিক, একে দেখেই মনে হচ্ছে, ওর আর ওঠার শক্তি নেই। এখানেই মরে যাবে!

ডেরেক বললো, কিন্তু যদি কেউ এখানে আসে অথবা যদি কোনোরকমে বেঁচে যায়, তবে আমাদের কী হবে একবার ভেবে দেখেছিস?

কার্ল বললো, তাহলে কী করবো, তাড়াতাড়ি ঠিক কর।

ওয়ারেন তার মত জানালো, ওকে মেরে ফেল। কিন্তু, কে মারবি ওকে?

ওদের মধ্যে সবচেয়ে বদরাগী হলো কার্ল। কথায় কথায় খুনখারাপি করার অভ্যাস! বললো, কেন আমি তো আছি ।

একথা বলেই, কার্ল চলে গেল আমান্ডার কাছে, ততক্ষনে তার একটু একটু করে জ্ঞান ফিরছে, ওদের সমস্ত কথা তার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল!

আমান্ডা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে, কার্ল ওর দিকেই এগিয়ে আসছে! তখন সে মিনতি করে  বললো, প্লিজ আমাকে মারবেন না। আপনাদের কারো বিরুদ্ধে আমি কিছু করবো না। আমাকে ছেড়ে দিন, প্লিজ, প্লিজ ।

আমান্ডা কথা বলতে বলতে সমস্ত শক্তি দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না, কারণ ততক্ষণে কার্ল ওর কাছে এসে তলপেটে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আর বলে হ্রিংস-কৌতুক  মিশ্রিত কণ্ঠে , তুই যে আমাদের জন্য বড় বিপদ! তোকে তো মরতেই হবে!

কার্ল কথা বলতে বলতে গলা টিপে ধরলো, আমান্ডা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মরে গেলো

ডেরেক রিভলবার কপালে ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে চোখ টিপে বললো , এটা সিওর হওয়ার জন্য । গুলির শব্দ শুনে নিচতলা থেকে উঠে এসেছে বাংলোর নাগা গভর্নেস মারিয়া । সুন্দরী নাগা তরুণীটিকে দেখে ওদের জান্তব প্রবৃত্তি আবার চাগাড় দিতে, ওরা তিনজন মিলে, নাগা তরুণীটিকে পাশবিক নির্যাতন করে ,  তারপর, দোতলার উত্তরের জানলা থেকে দিয়ে ফেলে দিলো নিচের খাদে

ওয়ারেন শিস দিতে দিতে বললো, এখানকার দেশি মদের মতো, ছুঁড়িটাও দারুন ছিল, এখনই প্রাণে না মারলেই হতো, আর দুদিন না হয় এখানে থাকাটা এক্সটেন্ড করতাম । এরপর তারা বাংলো থেকে সব মূল্যবান জিনিস লুঠ করলো আর আকণ্ঠ সূরা পান করে, বাংলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলো ।

সেই ভয়াবহ দিনটি ছিল রবিবার, সন্ধ্যার পর  অন্যান্য সপ্তাহান্তিক  দিনের মতো স্থানীয় চার্চে  প্রার্থনাতে  নিকটতম জনবসতি থেকে সবাই এসেছে  শুধু অটোয়ার সাহেবের বাংলো থেকে কেউ আসেনি ।

মারিয়ার বাবা ও মা কে ফাদার জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, সন্ধ্যে পেরিয়ে যাবার পরেও সে বাড়িতে ফেরেনি । এমনটা তো হবার নয়, তবে কি মিসেস অটোয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ? চার্চের ড্রাইভার স্যামুয়েল জাখালু কে জীপ বার করতে বললেন ফাদার । মেন রাস্তা থেকে পাকদন্ডীর রাস্তায় গাড়ি বাঁকতেই একটি নগ্ন রক্তাক্ত নারীকে হেড লাইটের আলোয়  রাস্তায় দেখতে পেলো ড্রাইভার জাখালু । টলমল করতে করতে কোন রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে ,  গাড়ি থামিয়ে ফাদার এগিয়ে গেলেন । নারকীয় অত্যাচারের চিহ্ন সারা শরীরে , ফাদারের কোলে মাথা রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে কোন রকমে সব বলে , সে মারা গেলো । ফাদার আর একটু এগোতে দেখলেন, পুড়ে খাক হয়ে গেছে বিলাসবহুল কাঠের বাংলো, কোথাও কোথাও থেকে তখও  ধোঁয়া উঠছে , কটু পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে গেছে ।

ফাদার দ্রুততার সাথে চার্চে ফিরে পুলিশ কে ফোন করলেন , ওপর প্রান্ত থেকে ‘হ্যালো’ হয়ে লাইন কেটে গেলো , আর যোগাযোগ করা গেলো না।

ফাদারের জরুরী আহবানে সাড়া দিয়ে নাগা জনজাতির সর্দারেরা দ্রুত চার্চে জমায়েত হলো , আর তাদের ক্ষিপ্রতম শিকারিদের দুষ্কৃতীদের ধরতে পাহাড়ি পাকদন্ডীর দুর্গম পথ দিয়ে পাঠালো পাহাড়ি পথে গাড়ি ওঠা নামা করে অনেক ঘুরে ঘুরে, কিন্তু পার্বত্য জনজাতির লোকেরা পাকদন্ডী দিয়ে অনেকটা  দূরত্ব  খুব অল্প সময়ে যাতায়াত করে থাকে।

এদিকে জমাট কুয়াশার মধ্যে শুরু হয়েছে প্রবল ঝড় বৃষ্টি আর বজ্রপাত।  সন্তর্পনে  ড্রাইভ করে ফিরে চলেছে কার্লের দল, কিন্তু , খুব বেশিদূর যেতে পারলো না তারা,  খুব শিগগিরই বুঝতে পারলো, কেউ তাদের পিছু নিয়েছে । সেই সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসছে দু পাশের জঙ্গল  থেকে, যার একটি তীর এসে বিঁধলো ওয়ারেনের ডান চোখে , যে তখন ড্রাইভ করছিলো।  সে যন্ত্রনায় অসতর্ক হতেই গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ হারালো।   মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটি তলিয়ে গেলো আরোহীদের নিয়ে পাশের খাদের অতলে । সেখানে অতলস্পর্শী খাদে জমে রয়েছে  ঘন কুয়াশা এক রাশ ক্ষিদে নিয়ে  ।

                                                  (৪)

সন্ধ্যা ৬ টা ১৫, কোহিমার ক্যাব স্ট্যান্ড প্রায় ফাঁকা, যে দু তিনটি গাড়ি আছে তারা কেউ রাতে যেতে রাজি হল না বেশি ভাড়ার লোভেও । হতাশ হয়ে হোটেলে ফিরছি , একটি সাদা বোলেরো আমাদের পাশে ব্রেক কষে দাঁড়ালো । মুখ বাড়িয়ে এক তরুণ শিখ যুবক বলল, ‘উঠে আসুন, আপনাদের দুজনের কথা শুনলাম স্ট্যান্ডে’। কত টাকা ভাড়া দিতে হবে জানতে চাইলে বললেন, ‘আমি মনসুখ সিং এসবিআই কোহিমা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার  , এখানে কাজ সেরে ফিরছি,  আপনাদের সঙ্গ পেলে ভালোই লাগবে’। যেতে যেতে অনেক গল্প হলো , আমরা দুদিন থাকব শুনে পরশু আমাদের এসবিআই  এমপ্লয়িজ কালচারাল ক্লাবের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালেন । রাস্তায় দুই জায়গায় পারমিট চেকিং হলো, প্রথম চেকপোষ্টে আমাদের গাড়ি দেখেই ছেড়ে দিল কিন্তু দ্বিতীয় চেকপোষ্টে লাগেজ নিয়ে নেমে আসতে বলল । সরদারজী দেখলাম কাউকে ফোন করছেন , কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চেকপোষ্টের দায়িত্বে থাকা অফিসার এসে হাজির হলেন ও আমাদের অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন । বললেন, বুঝতেই পারছেন আমাদের খুবই ঝামেলার মধ্যে ডিউটি করতে হয়, তারপর খবর আছে দুজন নকশাল ডিব্রুগড় থেকে কোহিমা আসছে । কোহিমা যখন পৌঁছলাম তখন রাত এগারোটা কুড়ি । আলডের রিট্রিট  হোটেলের সামনে আমাদের নামিয়ে দিয়ে মনসুখ সিং বিদায় নিলেন । অজিত এখানেই আমাদের বুকিং করে রেখেছিল,  কিন্তু প্যারামিলিটারি আর স্থানীয় পুলিশ আমাদের হোটেলের সামনেই আটকে দিল । কারণ জানা গেল জরুরী মিটিং এর জন্য এবং ভিভিআইপি দের থাকার জন্য প্রশাসন থেকে সম্পূর্ণ হোটেলটিকে  নেয়া হয়েছে । বুকিংয়ের মেসেজ দেখাতে এক অফিসার বললেন, অ্যাডভান্স টাকা আপনার একাউন্টে ফেরত চলে গেছে , আর মেল গেছে অনিবার্য কারণবশত বুকিং বাতিল হয়েছে জানিয়ে।  আমাদের রীতিমতো বলপূর্বক ওখান থেকে সরিয়ে দিলেন প্যারামিলিটারি আর পুলিশের জওয়ানরা , অজিত ‘মানবিক অধিকার লঙ্ঘন’ ইত্যাদি, বলতে ।  

চারপাশের পরিবেশ ক্রমশ ভীষণ রকম ঠান্ডা হয়ে আসছে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির চেয়েও বোধ করি নিচে , দুজনে রীতিমত ঠকঠক করে কাঁপছি । মনসুখ সিং এর নাম্বারটা নিয়েছিলি ? বলল অজিত । নারে নেয়া হয়নি তবে এসবিআই এর লোকেশন গুগল এ দেখে নিয়েছি।   ১০-১১ মিনিট দূরত্বে দেখাচ্ছে ওখানে নিশ্চয়ই নাইটগার্ড থাকবে আর নাম্বারও মিলে যাবে, পা চালিয়ে চল । শুনে অজিত এমন ভাবে তাকালো যেন ভীষণ রকম গর্হিত কাজ করে ফেলেছি । 

১০-১১ মিনিটে জায়গায় কুড়ি মিনিটের বেশি হয়ে গেল এখনো ব্যাংকের এটিএম চোখে পড়লো না, মনে হল একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি । 

পাহাড়ী উপত্যকার হিমেল রাতের রাস্তা পুরোপুরি জনশূন্য । বাঁদিকের পাকদন্ডিতে ওঠার মুখে একটা আলো চোখে পড়তে এগিয়ে গেলাম; একটা চা দোকান, দোকানের ভেতর টিম টিমে আলো জ্বলছে ,কয়েকটি লোক একটা শুকনো কাঠের রঙের লম্বা লাউ থেকে কিছু পানীয় ক্লাসে ঢেলে খাচ্ছে । চা বা কফি পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে দোকানদার মহিলাটি ‘রাত ন’টার পরে শুধু এটাই পাবেন’ বলে একটি পানীয় ভর্তি শুকনো লাউ আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো  ৩০০ টাকা । অজিত দেখলাম ৫০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে, চাট কিছু পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করছে ধোঁয়া ওঠা মাংসের ঘুগনি জাতীয় যে দ্রব্যটি আমাদের পরিবেশন করা হলো, তাকে দেখে ভক্তি শ্রদ্ধা না এলেও, পেটে পড়তে কিছুটা চাঙ্গা বোধ করলাম । অজিত পানীয়ের গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরেছে । ওরে, এই ঠান্ডায় জমে যাবি, লোকাল মদ, ঝাঁজ টা একটু বেশি , প্রথমে সিপ কর তারপর চুমুক দে । পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে মানুষকে অনেক কিছুই করতে হয় । স্টেট ব্যাংকের ম্যানেজার মনসুখ সিং সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে একজন বললেন , সে তো অনেক আগের কথা, এখন ম্যানেজার সাহেব  লোকাল মহিলা নাম ওরেনতুং পল। আমি আর অজিত তো হতভম্ব! 

রাতে থাকার জায়গা কোথায় পাওয়া যেতে পারে জিজ্ঞাসা করতে চা দোকান কাম নিশীথ রাতের বারের মালকিন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘আমি এবার দোকান বন্ধ করব নিজেরা পথ দেখো’। 

একজন মাঝবয়সি লোক আমাদের কথাবার্তা শুনে উঠে এসেছে, ‘স্যার হোমস্টে চলবে? তবে কোহিমা সিটিতে নয়, কোহিমা ভিলেজে, একটু দূর হবে কিন্তু পরিবেশ অসাধারণ আর নিরিবিলি’ । কতটা দূর তোমার হোমস্টে? জিজ্ঞাসা করতে বলল, মাত্র ১৬ কিলোমিটার। অজিত শুনে বলল, ‘বুঝলি একেই বলে হাতে চাঁদ পাওয়া’ লোকটা আমাদের ওর পিছন পিছন যেতে ইশারা করল, সামান্য এগিয়ে দেখি একটা পুরনো মিলিটারি জিপ আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে । স্টার্ট দিয়ে ডাক দিল সে, ‘উঠে পড়ুন স্যার আপনাদের পৌঁছে দিয়ে তবে আমার ছুটি’ । অজিত বলল , দাঁড়াও ভাই , ‘আগে তোমাকে কত কি দিতে হবে বলো’,  বিনম্র আওয়াজে ড্রাইভার বলল, ‘স্যার আমার সঙ্গে হোমস্টের মালিকের বন্দোবস্ত আছে, আলাদা করে আপনাদের কিছু দিতে লাগবে না’ । হিমেল নিঝুম রাত রাস্তায় জন প্রাণীও নেই তার ওপর ঘন কুয়াশার চাদর যেন চারপাশটা মুড়ে ফেলেছে । আকাশে এক ফালি চাঁদ, আর মাঝে মাঝে আমাদের গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছে বরফের মত ঠান্ডা পেঁজা মেঘ । পুরনো জিপের ইঞ্জিনের আর বনেটের শব্দটাই যা এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে বেমানান । থেকে থেকে জিপের ইঞ্জিন যেন ককিয়ে কেঁদে কিছু বলতে চাইছে । সারাদিনের ক্লান্তিতে আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে । ঠেলা দিল অজিত,  কানে কানে বলল, ‘এক ঘন্টার উপর হয়ে গেল পথ যে আর শেষ হয় না, নাগারা শুনেছি নরবলি দেয় শেষটায় বেঘোরে মারা পড়বো না তোরে ?’ ড্রাইভার টা কি মনের কথা বুঝতে পারে! , ‘স্যার ,পথ ষোলো কিলোমিটার ঠিকই কিন্তু ঘন কুয়াশার রাত পাহাড়ি খাড়াই পথে গাড়িতে স্পিড তোলা যাবে না, এখনো কম করে পৌনে এক ঘন্টা লাগবে’। আপনারা  নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন , সঠিক সময় দেখবেন ঠিক পৌঁছে গেছেন । সকাল থেকে জার্নিতে ক্লান্ত তার ওপর দেশি মদের প্রভাব, সহজেই দুজনে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজত্বে । কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না , অপর দিক থেকে জোরালো আলো ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে জিপের উইন্ড স্ক্রিনের মধ্য দিয়ে এসে চোখে পড়তে দুজনেরই আতঙ্কে হাড় হিম হয়ে গেল । মূর্তিমান যমদূতের মতো উল্টো দিক থেকে প্রবল গতিতে ধেয়ে আসছে একটা ট্রাক আর আমাদের জিপের ড্রাইভারের সিটে কেউ নেই ! ,  অজিত অসম্ভব রিফ্লেক্সে লাফিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ট্রাকটাকে সাইড কাটিয়ে নিলো, কিন্তু জিপটা সজোরে ধাক্কা খেলো রাস্তার ধারের একটা বড় বোল্ডারে আর ঘুরে গিয়ে বিপজ্জনকভাবে পিছনের অংশ ঝুলতে লাগলো পাশের অতলস্পর্শী খাদে । কোনরকম প্রাণ হাতে করে জিপ থেকে বের হলাম দুজনে, বলা চলে নিজেদের টেনে বার করলাম । পরমুহূর্তেই জিপটা আছড়ে পড়ল খাদে । গোটা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা । অজিতের মাথা দেখেছি খুব বিপদের সময়ও কাজ করে, ওর মোবাইলে গুগল  দেখাচ্ছে কয়েক পা হেঁটে গেলেই সামনের বাঁকে পড়বে ‘আমান্ডা’জ হোম স্টে’ । গুগলের শতকোটি বছর সুস্বাস্থ্য কামনা করে কোনরকমে পৌঁছলাম কাঙ্খিত গন্তব্যে  

                                                      (৫)

রাত প্রায় শেষের দিকে মোবাইলে তিনটে ৪৫ সময় দেখাচ্ছে কুয়াশা টা আর নেই ।  হালকা জোছনায় অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে চা বাগানের মত ধাপ কেটে বানানো লন আর কেয়ারী করা ফুলের বাগান সমেত বাংলো টা। ঠিক যেন ইউরোপিয়ান সিনেমার সিন থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে । ইতস্তত করে কলিং বেলটা বাজিয়ে ফেললাম । ভেতরের লাইট জ্বললো, একটু পরেই এক সুন্দরী নাগা তরুণী দরজা খুলল । আপনারা কি টুরিস্ট ? অজিত এগিয়ে এসে বলল, ‘পাশের রাস্তায় আমাদের গাড়িটা ব্রেকডাউন হয়েছে আজ রাতটুকুর মতো যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়’

গুড হেভেনস, ‘আপনাদের চোট লাগেনি তো ? এনিওয়ে, আমি মারিয়া সালভিনো আমাদের হোমস্টেতে আপাতত ওপরতলাটা খালি আছে । আপনাদের পছন্দ হলে যতদিন খুশি এখানে থাকতে পারেন, আমাদের এখানে কিন্তু সব সেলফ সার্ভিস । আমাদের গার্ডেন রেস্তরা বাংলোর ঠিক পিছনে । স্টাডি থেকে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবেন, আবার রিসেপশনের পাশ দিয়েও নামতে পারবেন । সেন্টার প্লেসে সব খাবার সাজানো পাবেন, ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ আর ডিনারের সময় । ওপরতলা টা দেখে নিন যদি পছন্দ হয় তাহলে আমি ফায়ারপ্লেসের আগুনটা জ্বেলে দেবো’ । একটা মাস্টার বেডরুম, দুটো কমন বেডরুম, কিচেন, স্টাডি, কনফারেন্স রুম, সংলগ্ন বাথরুম নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ সুইট । স্টাডিতে বইয়ের র‌্যাকের পাশে এক অভিজাত ইউরোপীয় তরুণী আর তার পোষ্য সারমেয়র অয়েল পেইন্টিং দেখে জিজ্ঞাসা করতে মারিয়া বলল, ‘ওটা আমাদের বাংলোর মালিক জন সাহেবের স্ত্রী আমান্ডা আর ওনার ডগি লিজা । ১৯৪৬-এ ব্রিটিশরা যখন এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে , সেই সময় একদিন রাতে দুষ্কৃতীরা অতর্কিতে হামলা চালায়, সাহেব বাংলোয় ছিলেন না, কিন্তু এরা মারা পড়েন । তো আপনারা কি থাকছেন ?’ ‘হ্যাঁ অবশ্যই’ অজিত জবাব দিল । ‘পেমেন্ট ইউপিআই অথবা কার্ডে করা যাবে তো ? আসলে সঙ্গে বেশি টাকা ক্যাশ নেই, আর একটা ফেভার চাইছি , গাড়ির মধ্যেই আমাদের লাগেজ রয়ে গেছে আপাতত কাজ চালানোর মত কিছু পোশাক, মানে দেখতেই পাচ্ছেন পোশাকগুলি না পাল্টালেই নয়’ । ‘ওন্ট ওরি জেন্টলমেন,  মাস্টার বেডরুমের ওয়ার্ডরোবে পোশাক আছে , আপনাদের মনে হয় অসুবিধা হবে না। আর এখানে পেমেন্ট ইউপিআই অথবা কার্ডে নেয়া হয় না । আপনারা সুবিধামতো ক্যাশে দেবেন , নাহলে পরে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে’ । অজিত প্রশ্ন করলো, ‘এই সুবিধা নিয়ে তারপর আমরা যদি পেমেন্ট না করে চলে যাই ?’ তরুণী ম্লান হেসে বললো , ‘এই জগতে টাকার মূল্যই বা কতটুকু ?’ এরপর ফায়ার প্লেসের  আগুন জ্বেলে দিয়ে , শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেল । ঘুম আমাদের কারোর চোখেই নেই,  একে তো শরীরে যন্ত্রণা তারপরে জিপের ড্রাইভারের ওভাবে উধাও হয়ে যাওয়া।  হ্যাঁরে ড্রাইভারটার কি হলো বলতো , প্রশ্ন শুনে অস্ফুটে অজিত জবাব দিল, ‘সেটাই ভাবছি, কিন্তু অনেক ভেবেও বুঝতে পারছি না , ছেড়ে দে’ ।

এপাশ-ওপাশ করে রাত কেটে গেল । ভোরের আলো এত সুন্দর আর প্রাণবন্ত হতে পারে তা এই প্রথম অনুভব করলাম, যখন কাঁচের জানলা দিয়ে ভোরের পুবের আকাশ  দেখা দিল ।

বাংলোটি পূর্বমুখী , বাগান কাম গার্ডেন রেস্তোরা পশ্চিম দিকে , দক্ষিণ দিকে অনেকগুলি কটেজ আর উত্তর দিকে গভীর খাদ ।

স্টাডি রুমে কফি মেকার মেশিন কফি দুধ সুগার কিউব সব রাতেই দেখেছিলাম সময় নষ্ট না করে ফ্রেশ হয়ে দুজনে স্টাডি রুমে এসে কফি বানিয়ে খেতে খেতে বইয়ের র‌্যাকের বইগুলি দেখলাম; বেশিরভাগই বিদেশী বই, হর্টিকালচার আর ম্যাথমেটিক্স এর বইয়ের ভিড়ে অজিত আবিষ্কার করেছে বেশ কয়েকটি হরর ফিকশন । লেখকদের মধ্যে প্রত্যেকেই প্রথিতযশা , অ্যানে রাইস , ব্রায়ান লামলে,  ব্যারি পেইন, এলাইজা পারসনস, জেমস হারবার্ট, ফ্লাইভ বার্কার, ক্লারা রিভ, ফ্রেডরিক শিলার, ড্যানিয়েল ডিফো, হোরেস ওয়ালপোল। একমাত্র ভারতীয় বই রয়েছে শ্রী অরবিন্দের দ্য লাইফ ডিভাইন  প্রথম সংস্করণ । প্রায় প্রতিটি বই যথেষ্ট পুরনো এবং দুষ্প্রাপ্য ।

কিন্তু এগুলি যে নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় তা বেশ বোঝা যাচ্ছে । অয়েল পেইন্টিং টার দিকে চোখ পড়তে মনে হলো মহিলার দু চোখে টলটলে জল । হয়তো এই বইগুলি এনার ছিল । যা সব ঘটে চলেছে গতকাল থেকে, এখনো যে বেঁচে আছি এটাই আশ্চর্য । স্টাডি থেকে একটা দরজা খুললে সিঁড়ি নিচে বাংলোর পিছনে বাগানে নেমে গেছে । অজিত নিচে বাগান থেকে ডাক দিয়েছে ,  ‘চলে আয় ব্রেকফাস্ট টেবিলে রেডি’। দেখলাম মোট ছয়টি টেবিলের মধ্যে তিনটিতে অতিথিরা রয়েছেন । একটিতে এক রাশভারী চেহারার ইউরোপীয় যুবক সম্ভবত: তার সঙ্গিনীর সঙ্গে , দ্বিতীয়টিতে এক দম্পতি; চেহারা দেখে মনিপুরী মনে হয় , তৃতীয় টেবিলে এক পাঞ্জাবি পরিবার; মা বাবা আর তাদের কিশোরী কন্যা । ভদ্রলোক আমাদের দেখে হাসলেন , ‘কলকাতা , আমি তোমাকে ভালোবাসি , রসগুল্লা খুব ভালোবাসি , আমি ক্যাপ্টেন বলবির সিং নাড্ডা , শিখ রেজিমেন্ট,  আমার বেটার হাফ রনজিতা আর মেয়ে রসলিন কাউর ।’ মেয়েটি ‘নমস্তে আঙ্কেল’ বলে নমস্কার করল । 

অজিত প্রশ্ন করলো, ‘আপনারা বোধকরি নিচতলায় উঠেছেন?’ 

‘নো ব্রাদার, পাশের কটেজে। নিচতলায় কোনো গেস্ট থাকে না। বাংলোর মালিকের পরিবার অকেশনালি আসে, ওদের জন্য রিজার্ভ থাকে। আর দোতলার সুইট টা স্পেশাল গেস্ট দের জন্য রিজার্ভ থাকে’ ।

‘এবারের স্পেশাল গেষ্ট তাহলে আমরা? কিন্তু আমাদের তো কোনো আসার ঠিক ছিল না,’ বললো অজিত। 

‘এটা কি জানো ব্রাদার, কোনো একজনের ডাইরি তে আমাদের সাক্ষাত আগে থেকে ঠিক হয়ে থাকে, এটা একটা পুরোনো প্রবাদ’ বলে প্রাণখোলা হাসলেন বলবির সিং । 

আমার এখন কাল রাতের ঘটনাগুলোকে মনে হচ্ছে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন যা  বোধহয় ভুলে যেতে খুব বেশি দেরি হবে না ।

ব্রেকফাস্ট এ হালকা গোলাপী রঙের বড় সাইজের কলা, স্বাদে অনেকটা কাঁঠালী কলার মতো, মিক্সড ফ্রুট আর পরিজ দিয়ে তৈরি একটা নাম না জানা পদ, ডিমের পোচ আর অরেঞ্জ জুস। 

 এখানে আসার পর থেকে সমস্যা শুধু একটাই হয়েছে আমাদের দুজনের মোবাইলেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না । 

ব্রেকফাস্ট এর পর ক্যাপ্টেন নাড্ডা আমাদের সঙ্গে সাইট সিইং এ যোগ দিলেন । পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধাপে ধাপে আলু, ওলকপি, অন্যান্য সবজির সাথে অপরূপ সব নাম না জানা ফুলের গাছ। দিগন্ত রেখায় জুনিপার আর পাইন জাতীয় গাছের সারি। 

প্রকৃতি নিজেকে যেন সাজিয়েছে অকৃপণভাবে । আমাদের আগামীকালই ফেরার তারিখ শুনে ক্যাপ্টেন নাড্ডা দুঃখ করলেন , ‘এত অল্প সময়ের জন্য কেউ এই জায়গায় আসে?’ 

বাংলোর সামনের পাথুরে রাস্তাটা অনেকটা জেড আকৃতির মত এঁকে বেকে নেমে গেছে প্রধান সড়কে । কথা বলতে বলতে একটি সাদা বোলেরো গাড়ি বাংলোর সামনে এসে থামল,  নেমে এলেন আমাদের সেই পূর্ব পরিচিত মনসুখ সিং , আমাদের দেখে বললেন,’ আরে, আপনারা এই বাংলোর ঠিকানা পেলেন কোথা থেকে ?’ আমি বললাম,  ‘আপনি তো বলেননি আপনি এখানকার এসবিআই তে  ম্যানেজার ছিলেন অনেকদিন আগে ?’ 

‘তাই কি ? আপনারা শুনতে ভুল করে থাকবেন, আমি কিন্তু বাড়ী পৌছে আপনাদের মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, প্রতিবারই আউট অফ নেটওয়ার্ক এরিয়া’। 

অজিত প্রশ্ন করলো, ‘কিন্তু আপনি হঠাৎ এখানে ? কোনো বিশেষ কাজে বোধহয়’ ।

‘না ব্রাদার, কোহিমাতে বহুদিন থেকেছি , তো এসব  পুরানো জায়গার স্মৃতি সহজে ভোলা যায় না , তাই সময় পেলেই বেরিয়ে পড়ি’।

‘এনি ওয়ে, যতদূর মনে পড়ছে  ,  কালকে তো আপনাদের  ফেরার কথা,  গাড়ি বলে রেখেছেন তো ?’ 

জবাব  শোনার অপেক্ষা না করে,  নিজেই আমাদের সঙ্গে নিয়ে রিসেপশনে মারিয়াকে আমাদের ফেরার গাড়ির জন্য বললেন । মারিয়া ল্যান্ডলাইন থেকে কোহিমা সিটির নেহারলাগুন কার হায়ার এ কথা বলে আমাদের গাড়ির ড্রাইভারের নাম্বার দিল । আমাদের মোবাইলে নেটওয়ার্ক কাজ করছে না জেনে বললো, আসলে এখানে এখনো মোবাইল কভারেজ হয়নি । আপনারা প্রয়োজনে রিসেপশনের ফোন ব্যবহার করতে পারেন । 

ধন্যবাদ দেবার ভাষা নেই ! সামান্য ইতস্তত করে মারিয়ার সম্মতি নিয়ে দাদার মোবাইলে তারপর ল্যান্ডলাইনে ফোন করলাম , রিং হয়ে গেল, কেউ তুললো না । 

                                                  (৬)

আগস্টের শেষ সপ্তাহ, কলকাতায় হাঁসফাঁস অবস্থা হয়, এখানে দিনের বেলাতে ঠাণ্ডা সহনীয় থাকলেও রাতে বেজায় ঠান্ডা পড়ে ।  সন্ধ্যার পরই মারিয়া এসে ফায়ার প্লেসের আগুন জেলে দিয়ে গেছে ।   ডিনারের পর ক্যাপ্টেন নাড্ডা আমাদের রুমে এলেন, সঙ্গে প্রচুর ভাজা আমন্ড আর দামি স্কচ। বোতলটি হাতে নিয়ে দেখলাম, ১৯৩২ এ তৈরি আয়ারল্যান্ডে। ‘এই জিনিস কোথাও মিলবে না ব্রাদার , জেনুইন এজেড’, তিনজনে যে রঙিন সন্ধ্যা কাটালাম বলাই বাহুল্য । ক্যাপ্টেন নাড্ডা এগারোটা নাগাদ গুড নাইট জানিয়ে চলে যাওয়ার পর আমরাও শুয়ে পড়লাম । আজ বেজায় ঠান্ডা পড়েছে । ডাবল করে কম্বল গায়ে তার ওপর আগুন জ্বলছে ফায়ার প্লেসে, উপরন্ত পেটে দামি পানীয় তবুও ঠান্ডায় ভেতর অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে । রাত পৌনে দুটো নাগাদ গলাটা শুকনো মনে হতে মাথার পাশের টেবিলে হাত বাড়িয়ে জলের জাগটা নিতে চটচটে কি লেগে হাতটা ভিজে গেল । বেড সুইচ টা জ্বালিয়ে দেখি রক্ত , পাশের খাটে অজিতকে ডাকতে গিয়ে দেখি কোথায় অজিত সেখানে এক স্বর্ণকেশী ইউরোপিয়ান মহিলার মৃতদেহ, পোশাক অবিন্যস্ত আর কপালে গভীর বুলেটের ক্ষতচিহ্ন । মৃতা মহিলার মুখটা দেখতে অবিকল স্টাডির অয়েল পেইন্টিং এর মহিলার মত । 

স্বপ্ন দেখছি কি ? এই সময় অজিত দেখলাম  বেরিয়ে এলো টয়লেট থেকে , কিন্তূ এ কোন অজিত ? রংবেরঙের পালকের মুকুট মাথায়, খালি গা, গলায় ঝুলছে হাড়ের মালা , তাতে নরকোটির লকেট । মুখে- গলায় লেপা তাজা রক্ত । সারমেয় প্রিয় অজিত একটা কালো ডোবারম্যান কে গলা টিপে মারার চেষ্টা করছে আর ডোবারম্যান টাও অজিতকে আঁচড়ে কামড়ে ছাড়া পাবার চেষ্টা করছে । এই ডোবারম্যানটাই তো অয়েল পেইন্টিং এর মহিলার কোলে রয়েছে !

অনেকগুলো কালো কালো আবছায়া এসে ঢুকছে এই ঘরে , তাদের অশরীরী উপস্থিতিতে একটা চাপা অসন্তোষ , ঠিক ঝড়ের পূর্বেকার হঠাৎ শান্ত হয়ে আসা পরিবেশের মতো।   দেয়ালে টাঙানো চিতা , গন্ডার , অন্য  বন্য প্রাণীদের  মাথাগুলো যেন কোন নারকীয় ইশারায়  জীবন্ত হয়ে উঠেছে , ক্রূদ্ধ চোখে আমাকে দেখছে আর যেন দেয়াল থেকে নেমে আসতে চাইছে !

ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিল, বাঁচতে চাইলে এখুনি পালাও । স্টাডির বাগানে নামার সিঁড়ির দরজাটা খুলে নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়লাম, প্রচন্ড লেগেছে কনুই , হাঁটু আর কোমরে, কিন্তু পালাতে হবে , মনের জোরে উঠে দাঁড়িয়ে , পাহাড়ি চড়াই, উৎরাই  বেয়ে  উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াতে লাগলাম । চারপাশ কিছু দেখা যাচ্ছে না ঘন কুয়াশায় । পায়ে কাঁটা, কাঁকড় ফুটে চলেছে, গাছের ডালে গোটা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলেছে, কিন্তু দৌড়ানো থামালাম না । কখন যেন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছি, জানি না। যখন সম্বিত ফিরল তখন সকাল হয়ে গেছে, ঘন কুয়াশার চাদর গেছে সরে ।

খানিকটা দূরে পুলিশ ও কিছু লোকের জটলা দেখে এগিয়ে গেলাম । একটা দুমড়ানো মোচড়ানো জিপকে অনেক উঁচু থেকে ক্রেনে করে টেনে ওপরে তোলা হচ্ছে । দুটি ছিন্ন ভিন্ন মৃতদেহ পাশে রাখা রয়েছে । চিনতে ভুল হলো না , অজিতের আর আমা। 

বিষয় মৌলিকত্ব
0
ভাষা সাবলীলতা
0
কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা প্রবাহ
0
শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ
0
অডিও/ভিডিও রূপান্তর যোগ্য
0
Average
 yasr-loader

About Post Author

9F10 DA

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post ইজিপ্টের সভ্যতা রহস্য | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | মৌসম সামন্ত | Bengali Historical Thriller Story | 9F10
Next post চোখের বদলে চোখ | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | সুকান্ত দাস | Bengali Thriller Story | 9F10