লাল কম্বলের জ্বীন | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | মৌলী কুন্ডু | Bengali Thriller Story | 9F10
0 (0)

(১)

-“এই যে দাদা, ওই তাকের ওপরে যে লাল রঙের কম্বলটা আছে, ওটা দেখান তো।”

এক ফুটফুটে বছর বাইশের মেয়ে কম্বলের দোকানের সামনে এসে বলল কথাগুলো।

দোকানদার-” বো ওয়ালা, ওটা বিকনেকে লিয়ে না আছে ম্যাডাম।”

-“কেন দাদা দাম কতো ওটার ? কেউ বুক করে রেখে গেছে নাকি?”

-“হ্যাঁ ভাই দাও না মেয়ের এতো পছন্দ হয়েছে।”

পাশ থেকে বলে উঠলেন আর এক প্রৌঢ়া মহিলা।

-“ইয়ে ম্যাডাম আপনার বেটি আছে ? ইনকা নাম ক্যা আছে মাইজী?”

জুলজুলে চোখে একবার অল্প বয়সী মেয়েটির দিকে দেখে নেয় দোকানদারটি, তারপর মাঝ বয়সী মহিলাকে প্রশ্নটা করল সে।

-“কেন ভাই তোমার নাম জেনে কি হবে।”

-” ইনকা নাম মৌমিতা হে ক্যা মাইজী?”

-“হ্যাঁ, তুমি ওর নাম জানলে কি করে?”

মনে হলো দোকানদারটির মুখে একটু হাসি খেলে গেল। আসলে লোকটা এমনভাবে একটা হনুমান টুপি দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে যে মুখের ভাব বোঝা যায় না সহজে। আর তার গোটা শরীরটাও উলের সোয়েটার, হাত মোজা আর বুট জুতোয় ঢাকা। এমন কিছু ঠাণ্ডা এখনও পড়েনি। তাও এরকম অদ্ভুত সাজপোশাক দেখে তার ওপর সন্দেহ হবারই কথা। কিন্তু তার দোকানে এতো ভাল ভাল শীতপোশাক, চাদর, কম্বলের সম্ভার, আর সেগুলোর দাম এতো কম যে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।

অল্প বয়সী মেয়েটি আবার প্রশ্ন করল,

-“আপনি আমার নামটা জানলেন কি করে? আপনার দোকানটা তো নতুন। এই পাড়ায় আপনাকে আগে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।”

-“আসালমে ম্যাডাম জি কাল এক সাহেব আমার দুকানে এসে বলে গেলেন কি, তোমার দোকানে মৌমিতা নামে একটা মেয়ে আসবে, এই কম্বলটা তাকে দেবে। আমি হাফ দাম দিয়ে যাচ্ছি।”

প্রৌঢ়া মহিলা-“সাহেব? হাফ দাম দিয়ে গেছেন?”

-“জি মাইজী।”

মহিলাটি মেয়ের কানে ফিসফিস করে বললেন, 

-“হ্যাঁরে মৌ এই সাহেবটা আবার কে ? তোর বাবার তো এত বুদ্ধি কখনই হবে না, বল?”

-“হ্যাঁ মা। মনে হয় অন্য কোনো মৌমিতার জন্য কেউ টাকা দিয়ে গেছে। বেশী কথা বাড়াবার দরকার নেই, তাহলে ভাল জিনিসটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। সুযোগ যখন এসছে সদব্যবহার করো।” 

এই বলে একটু ফিক করে হেসে নিল মেয়েটি। দোকানদারকে মহিলাটি বললেন,

-“হ্যাঁ ভাই আমাদেরই লোক হাফ টাকা দিয়ে গেছে। তুমি এটা প্যাক করে দাও।”

-“ঠিক হে মাইজি।”

দোকান থেকে বেরিয়ে মহিলাটি তার মেয়েকে বললেন,

-“কম্বলটা বেশ হয়েছে বল মৌ?”

-“হ্যাঁ মা এতো কম দামে এরকম কম্বলটা যে হাতে এসে যাবে ভাবাই যায় না। যেমন নরম তেমন হাল্কা। ক্যারি করে নিয়ে যেতেও কোনো প্রবলেম হবে না।”

মৌ মানে মৌমিতা হালদার মালদার মেয়ে । বি টেক কমপ্লিট করে এখন চাকরী পেয়েছে সল্টলেকের একটা আই টি কোম্পানিতে। কলকাতার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে সে।  তার ছোট্ট সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা চলছে এখন। সামনেই ডিসেম্বর মাস, শীতের জন্য বেশ ভালরকম শীতবস্ত্র প্রয়োজন। বেশ একটা দাও মারা গেছে ভেবে পাড়ার অস্থায়ী কম্বলের দোকান থেকে কম্বল কিনে বাড়ি ফিরল মা ও মেয়ে।

  তারা বেরিয়ে যেতেই কদাকার চেহারার কম্বলওয়ালার মুখে একটা বাঁকা হাঁসি খেলে গেল।

*********

মৌমিতা কলকাতায় এসে পৌঁছেছে গতকাল।  নতুন পিজি, অফিস সামলাতেই একটা গোটা দিন হুশ করে কেটে যায় তার। আগের দিন রাতে ভাল ঘুম হয়নি ঠাণ্ডার জন্য । তাই পরেরদিন রাতে সে সুটকেস থেকে নতুন লাল কম্বলটা বার করে আনল। কি সুন্দর ডিজাইন, মখমলের মতো নরম। যেমন রং, তেমন গরম। কম্বলের ওপর হাত বুলিয়ে মৌমিতা সেটাকে পরম যত্নে মুখে গালে চেপে ধরল। বেশ মৃদু একটা সুগন্ধ আছে কম্বলটার। মোহাবিষ্টের মতো সেটাকে গায়ে জড়িয়ে নিল সে। তারপর বিছানায় পড়েই হারিয়ে গেল ঘুমের অতল সমুদ্রে। ঘন্টাখানেক সে বেশ নিশ্চিন্তেই ঘুমালো। যেন একটা গরম শরীরের ওম তাকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে রেখেছে আদরে, যত্নে। কিন্তু একি! হঠাৎই হাঁসফাঁস করতে করতে মৌমিতার ঘুমটা ভেঙে গেল। আর ঘুমটা ভাঙতেই তার মনে হল বুকের দুই নরম মাংসপিণ্ড যেন পিষে যাচ্ছে কোন এক হিংস্র পশুর প্রচন্ড থাবার, জলন্ত আঘাতে। মৌমিতার শরীর ঘামে ভিজে উঠল। একি হচ্ছে তার সঙ্গে, এটা কি সপ্ন! মৌমিতা ধড়ফড় করে উঠে বসল। একটু জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষন পরেই আবার সেই অনুভূতি। মৌমিতা দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ সহ্য করল। অনুভূতিটা ভয়ংকর ও স্পষ্ট, কোনো ভুল নেই। একটা পাহাড়ের মতো দৃঢ়, বজ্রের মতো শক্তিশালী দামাল ঝড় বারবার আছড়ে পড়ছে তার শরীর জুড়ে । মৌমিতা আর বিছানায় থাকতে পারল না। কম্বল সরিয়ে নেমে পড়ল বিছানা থেকে।  ঘরে পায়চারি করে কাটাল বাকি রাতটা। পরের দিন অফিসে গিয়েও তার মাথায় সারাক্ষণ ব্যাপারটা ঘুরতে লাগল। সে ভাবল নতুন জায়গা, তার জন্যই হয়তো ভালো ঘুম হয়নি। আর এরকম অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। ব্যাপারটা এতটাই অস্বস্তিকর যে কারোর সাথে আলোচনাও করা যায় না।

 পরপর  দুটো বিনিদ্র রাত এভাবেই কেটে গেল। এদিকে না ঘুমিয়ে তার শরীর খারাপ হয়ে যেতে লাগল। অফিসে কাজও ঠিকমতো করতে পারে না। মৌমিতার মা রোজই ফোন করে তার শরীরের খবর নেন। নানারকম উপদেশ দেন। তিনদিনের দিন দুপুরবেলা লাঞ্চ টাইমে মা ফোন করতে সে বলল,

-“মা যে দোকান থেকে ওই কম্বলটা কিনেছিলাম না, দোকানটা কি এখনও আছে?”

-“না রে সে দোকান তো তুই যেদিন গেলি, তারপরের দিনই উঠে গেল। কেন রে কম্বলটা ঠিক আছে তো?”

মৌমিতা একবার ভেবে নেয় এরকম একটা ব্যাপার কি মাকে বলা যাবে! তারপর মনে মনে বলল,

-“না আমাকে দূরে পাঠিয়ে মা এমনি টেনশনে আছে। তারওপর এই ধরনের কথা বলে মায়ের চিন্তা বাড়িয়ে আর কাজ নেই।”

মুখে বলল,

-“না না মা সব ঠিক আছে। আসলে এতো সুন্দর কম্বলটা দেখতে, আমার এখানে পাশের বাড়ির এক কাকিমা জিজ্ঞেস করছিলেন, এটা কোথা থেকে নিয়েছি। তাই তোমায় জিজ্ঞেস করলাম।”

-“ও আচ্ছা আচ্ছা। তা এখন তো আর দোকানটা নেই। থাকলে তো আমিই আরো দুটো চাদর নেব ভাবছিলাম। কি আর করা যাবে। আবার যদি আসে তখন দেখা যাবে।”

-“আবার যদি আসে তাহলে আমাকে একবার জানিও তো মা।”

-“ঠিক আছে রে। আর তোর শরীর টরির ঠিক আছে তো?”

-“হ্যাঁ মা। আচ্ছা শোনো না আমি ফোনটা রাখছি তাড়াতাড়ি খেয়ে আবার কাজ করতে হবে।”

এই বলে তড়িঘড়ি ফোনটা রেখে দেয় মৌমিতা।

মৌমিতার ভয়ংকর অনুভূতিটা যেন একটা কালো ধোঁয়াটে অবয়বের রুপ নিয়ে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর সেই অবয়ব তার কানে ফিসফিস করে বার বার বলতে লাগল,

-“বলো না, একথা কাউকে বলতে নেই।”

মৌমিতা কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমে গেল। সেখানে চোখে মুখে জল দিতে লাগল বেসিন থেকে। কিন্তু সেখানেও তার পাশে আবার সেই ধোঁয়াটে কালো মূর্তি দেখা দিল। মৌমিতা দেখল মূর্তিটা তার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে। মৌমিতা চিৎকার করে ওঠে। ঠিক সেই সময়েই তার অফিসের এক কলিগ পৌলমী এসে ঢুকল বাথরুমে। আর ঢুকে কয়েক ভোল্ট ইলেকট্রিকের শক পাওয়ার মতো চমকে উঠল। সে দেখল একটা মেয়ে সম্ভবত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাকে ঘিরে ধরে আছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। সেই কুণ্ডলী ধীরে ধীরে যেন আয়নার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। পৌলমী — “ও মাগো!” বলে চিৎকার করে উঠল। আর সাথে সাথেই সেই কালো ধোঁয়া যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল। আর তার সামনে ধপাস করে অজ্ঞান হয়ে পড়ল মৌমিতা। পৌলমী একটু ধাতস্থ হয়ে তার চোখে মুখে জলের ছিটে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৌমিতার জ্ঞান ফিরে এল। পৌলমী তাকে ধরে ধরে বাথরুমের বাইরে নিয়ে গেল। নিজের কিউবিকলে নিয়ে গিয়ে তাকে বসাল। মৌমিতা একটু সুস্থ হতেই পৌলমী বলে উঠল,

-“মৌমিতা তুমি কি এখন ঠিক আছো? ঠিক থাকলে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে তোমার সাথে কী হয়েছিল?”

-“কিছু না। আসলে এই প্রথম বাড়ি ছেড়ে একা একা থাকছি তো তাই একটু শরীরটা খারাপ হয়েছে।”

-“না মৌমিতা তোমার সাথে অন্য কিছু একটা ঘটছে । ওয়াসরুমে তোমার চারদিকে অদ্ভুত একটা কালো ধোঁয়ার..”

পৌলমী এই পর্যন্ত বলতেই মৌমিতা তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলল,

-“পৌলমীদি তোমার সাথে না পরে কথা হবে। স্যার একটা মেল করতে বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি সেটার পিচ রেডি করতে হবে। আমি আসি হ্যাঁ।”

এই বলে সে তড়িঘড়ি পৌলমীর কিউবিকল থেকে বেরিয়ে যায়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন অলক্ষ্যেই তার গলা চেপে ধরে রেখেছিল। কেউ ফিসফিস করে তার কানে কানে সমানে বলে যাচ্ছিল,

-“আমার কথা বলো না। বলো না।”

সেদিন রাতে মৌমিতার মনে হল এই কম্বলটাই অপয়া। সে আর কম্বল গায়ে দিল না। একটা চাদর জড়িয়ে কোনরকমে শুয়ে পড়ল। প্রথমে বেশ ঠান্ডা লাগছিল, তারপর তার দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল। 

কিন্তু মধ্যরাতে একি, আবার সেই অনুভূতি। এবার যেন অত্যাচারের মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। এক উতপ্ত অগ্নিধারা যেন তার সর্বঙ্গকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে চাইছে। তার নাভীর নিচে ঘটে চলেছে এক তীব্র বিস্ফোরণ। মৌমিতা সেই হাত, পিঠ, কাঁধের দৃঢ় মাংসপেশীর বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে আপ্রান চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। যতক্ষণ না সেই অদৃশ্য শক্তি, তৃপ্ত হয়ে নিজে থেকেই থেমে গেল, ততক্ষন মৌমিতার উপর অত্যাচারের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল। সব শান্ত হতেই উঠে সে দেখল , তার সারা শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। জামা কাপড় ছিঁড়ে কুটি কুটি হয়ে পড়ে আছে বিছানার চারদিকে, তলপেটে আর সারা শরীর জুড়ে অসহনীয় যন্ত্রনা। তার নিরাবরণ শরীরকে জড়িয়ে রেখেছে সেই লাল কম্বল । মৌমিতার হাত পা ভয়ে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এটা কি করে তার গায়ে এল । সে তো এটা সুটকেসে ভরে রেখেছিল। মৌমিতা কী করবে ঠিক করতে পারে না। তার মনে হয় যে করেই হোক এই অভিশপ্ত কম্বলটা দূর করতে হবে। 

পরের দিন অফিস যাওয়ার সময় কম্বলটা সে রাস্তায় ফেলে দিল। সেদিন সে যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু সেই রাতেও সে আবিষ্কার করল তার শরীরে আবার সেই কম্বল উঠে এসেছে। আবার সেটা তার গায়ে উঠে অত্যাচার চালাতে লাগল। মৌমিতা চিৎকার করে বলে উঠল,

-“ভগবান এর থেকে কি আমার মুক্তি নেই? তুমিই বলো আমি কি করব।” 

এই বলে সে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। সে যেন পাগলের মত হয়ে গেল। পরের দিন অফিসেও গেল না। কম্বলটা সে ছিঁড়ে কুটিকুটি করল। তারপর তার মধ্যে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল। কিন্তু একি! সেই আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা ঘর জুড়ে। মৌমিতা সেই অগ্নিশিখার মধ্যে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ছটফট করতে লাগল। 

ঘন্টাখানেক পরে আশপাশের লোক পোড়া গন্ধ পেয়ে ছুটে আসে। মৌমিতার ঘরের জানলা দিয়ে আগুনের শিখা দেখে, দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢোকে। আর আগুনে ঝলসানো মৌমিতার শরীরটা উদ্ধার করে।

(২)

মৌমিতার ঝলসানো শরীরটাকে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। শ্মশানে মৃতের জিনিসপত্রের সঙ্গে ফেলে দেওয়া হল আস্ত লাল কম্বল। একটু পরেই বাঁকা হেঁসে কম্বলটা তুলে নিল কম্বলওয়ালা। এদিকে মৌমিতার অফিস কলিগ পৌলমী কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছিল বেড়াতে যাবে বলে। সে অফিসে এসেই শুনল মৌমিতা নামের নতুন মেয়েটা নাকি যে বাড়িতে ভাড়া থাকতো সেখানেই ঘরের মধ্যে গায়ে আগুন লাগিয়ে সুইসাইড করেছে। সুইসাইড না অ্যাকসিডেন্ট সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। তবে অফিসের বাকি সবাই ফিসফাস করছে,

-“কেমন যেন ছিল মেয়েটা, একটা কাজ তো ঠিক করে করতে পারতো না । পিজিতে একা একা থাকতো। এখন যেরকম হয়, একাকিত্ব, ডিপ্রেসন, মানসিক চাপ এইসবের জন্যই বোধহয় ঘটনাটা ঘটাল।” 

কিন্তু পৌলমী মনে মনে ভাবল ,

-“তোমরা কিছুই জানো না মেয়েটার সাথে কি ঘটেছে। আমি নিজের চোখে অনেকটা দেখেছি সেই ভয়ংকর ঘটনা। মেয়েটা যদি আর একটু সময় দিত..” 

একটা আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস যেন বেরিয়ে এল তার বুকের ভেতর থেকে। আর তখনই ফোনটা বেজে উঠল। তার বোনের বন্ধু রিতিকার ফোন। মৌমিতার ব্যাপারটা জানতে পেরে সে রিতিকার সাথে যোগাযোগ করেছিল। রিতিকার চেনা একজন প্যারানরমাল এক্সপার্ট আছে।

-“হ্যাঁ পৌলমীদি শোনো না তোমার বলা সব ডিটেলস আমি আমার মাসতুতো দিদির উড বি হাসব্যান্ড রজতদাকে জানিয়েছিলাম। রজতদা ব্যাপারটায় বেশ ইন্টারেস্টেড। “

-“রিতু শোন তার আর দরকার হবে না রে।”

-“কেন পৌলমীদি? সব ঠিক হয়ে গেছে?”

-” না রে যার জন্য বলেছিলাম সে মারা গেছে।”

-“হোয়াট? এ বাবা কি করে?”

-“আরে আর বলিস না। বেচারী সম্ভবত গায়ে আগুন লাগিয়ে সুইসাইড করেছে কাল।”

-“কি বলছো গো?”

-“হ্যাঁ রে আমার বেড়াতে যাওয়াটাই কাল হলো। মেয়েটার পাশে যদি থাকতে পারতাম। এতো ডিস্টার্ব ছিল মেয়েটা। আসলে ওর নামও মৌমিতা। আর স্বভাবটাও একদম আমার বোন মৌমিতার মতোই ছিল। তাই দুদিনেই খুব মায়া পড়ে গেছিল মেয়েটার ওপর।”

-“হ্যাঁ সেতো হবেই। ঠিক আছে আমি রজতদাকে বলে দেব। আর তোমার বোনকে বলো আমি খুব রেগে আছি। বেড়িয়ে এসে আমার সাথে এখনও কথা বলেনি।”

-“হ্যাঁ রে বলে দেব। এখন ফোন রাখছি রে বাড়ি ফিরে আবার কথা হবে।”

তখনকার মতো কথা শেষ হলেও পৌলমী বাড়ি ফিরলে তার কাছে আবার রিতিকার ফোন এল। 

-“দিদি শোনো না রজতদা, গার্গীদির সাথে দেখা করতে এসেছিল। তোমার কলিগের মারা যাওয়ার খবরটা পেয়েই রজতদা তোমার সাথে কথা বলতে চাইল।”

তারপরেই রজতদার গলা।

-“হ্যাঁ ম্যাম শুনুন আপনার সাথে কি একটু সরাসরি কথা বলা যেতে পারে? আসলে আপনি যে ঘটনাটা রিতুকে বলেছেন আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। যদি একটু ব্রিফলি জানা যেত।”

-“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চই দেখা তো করা যেতেই পারে কিন্তু আমি তো খুব বেশী কিছু জানি না ঘটনাটা সম্পর্কে।”

-“যতটা জানেন ততটাই বলবেন। কাল তো শনিবার আপনার কি কাল সময় হবে?”

-“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চই আমি তাহলে কাল বিকালের দিকে রিতিকাদের বাড়ি যাব।”

-“বেশ বেশ। Thanks”

-“welcome…”

এরপর পৌলমী, প্রফেসর রজত সেনের সাথে দেখা করল রিতিকাদের বাড়িতে। রজত মানে, প্রফেসর রজতকান্তি সেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। দুবছর আগে বিদেশে আর মন না টেকায় ইন্ডিয়ায় ফিরেছেন। এখন প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের অধ্যাপনা করেন। প্রথমবার দেখেই পৌলমী বুঝতে পারে রিতিকা তার হবু জামাইবাবুটি সম্পর্কে একটুও বাড়িয়ে বলেনি। কী ব্যক্তিত্ব, চোখে মুখে একটা বুদ্ধিদীপ্ত হাঁসির ঝিলিক খেলা করছে। আর রজতকে দেখলে এককথায় হ্যান্ডসম সার্টিফিকেট দেওয়া যায়। উচ্চতায় ছ’ফুটের কাছাকাছি, গায়ের রং মাজা মাজা, মেদহীন পেটানো চেহারা। মাথা ভর্তি ঢেউ খেলানো চুল, মৈনাকের মতো নাক আর চোখে ঈষৎ বাদামি আভা। বয়সও বেশী না, এই তেত্রিশের কাছাকাছি।

রজত থাকেন নিউটাউনের একটা ফ্ল্যাটে। তার সাথেই থাকে ভাইজি সুনিতা, সুনিতার হাসবেন্ড সুমিত আর তাদের মেয়ে সুনেত্রা । রজত অধ্যাপনার সাথে সাথে প্যারানরমাল এক্টিভিটিস নিয়ে রিসার্চও করেন। 

নমস্কার প্রতিনমস্কারের পর পরিচয় পর্ব শেষ করে, বিকেলের চায়ে চুমুক দিয়ে রজত প্রশ্ন করলেন,

-“আপনি যা বলেছিলেন আমি তা আগেই রিতিকার কাছে শুনেছি। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো আপনি মৌমিতার চারপাশে যে ধোঁয়া দেখেছিলেন তা কিরকম ছিল। সাধারণ যেরকম ধোঁয়া হয় সেরকমই কি?

-“না খুব অদ্ভুত ধরনের ধোঁয়া ছিল। সাধারণত এতো কালো আর ঘন ধোঁয়া আমি কখনও দেখিনি। ধোঁয়াটা ধীরে ধীরে যেন একটা শরীর তৈরী করছিল।”

-“মাই গুডনেস। মনে হচ্ছে যা সন্দেহ করেছিলাম তাই।”

-“আচ্ছা, আপনি কি দেখেছিলেন, ওই কালো ধোঁয়া মৌমিতাকে আয়নার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে?”

 -“হ্যাঁ মৌমিতার মাথা বেশ কিছুটা যেন আয়নার ভেতরে চলে গেছিল। অথচ আয়নাটা কোথাও ভাঙেনি। একবারে ঠিকঠাক ছিল।”

-“কোনো গন্ধ পেয়েছিলেন?”

-“হ্যাঁ হ্যাঁ গন্ধ ছিল। তবে সেটা সুগন্ধ না দুর্গন্ধ জানি না। এরকম গন্ধ এই পৃথিবীতে থাকতে পারে না। তবে গন্ধটা খুব ভাল লাগছিল। অনেকটা নেশার মতো।”

-“নাঃ, যা ভাবছি তাই।”

-“কি সেটা?”

-” মনে হয় কোনো নেগেটিভ এনটিটি।”

-“কি বলছেন? এই সময় দাঁড়িয়ে আপনি কি সব আজগুবি গল্প শোনাচ্ছেন ? এখন এসব হয় নাকি?”

-“যে ঘটনা আপনি দেখেছিলেন, বা অনুভব করেছিলেন সেটা কি স্বাভাবিক বলে মনে হয়?”

-“না তা নয়।”

-“আচ্ছা আপনার ওই কলিগ যেখানে থাকতো সেখানকার ঠিকানা দিতে পারবেন?”

-” ঠিকানা তো আমার কাছে নেই । ও বলেছিল কেষ্টপুরের দিকে কোনো পিজিতে থাকে। তবে অফিসে আছে । আমি সোমবার অফিস গিয়ে আপনাকে টেক্সট করে দেব।”

-” বেশ । দেরী হয়ে যাবে অবশ্য। কিন্তু কিছু তো করার নেই।”

বাড়িতে সন্ধ্যার শংখধ্বনীর আওয়াজে কথা থামাতে হল। তারপর গার্গী এল হইচই করতে করতে, বাড়িতে তৈরী গরম গরম সিঙ্গারার প্লেট নিয়ে। 

-“গরমা গরম সমসা আ গায়া, খেয়ে নাও ।”

এরপর নানা কথায় মৌমিতার কথা সেখানেই চাপা পড়ে গেল ।

 পরের দিন রজত তার পুলিশ কমিশনার বন্ধু সৈকতকে ফোন করল। মৌমিতার সুইসাইড কেস সৈকতই দেখছিল। রজতের সাথে দেখা করে সে কেসের সব ডিটেলস জানাল। আসলে তার ব্যাপারটাকে সুইসাইড তকমা দিতে মন চাইছিল না। মেয়েটার সুইসাইড করার কোনো মটিভই ছিল না। না কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল। না অন্য কিছু। নতুন চাকরি পেয়েছিল, সেখানেও সবার সাথে সম্পর্ক ভালই ছিল। তবে কেন?

পরের দিন সৈকতই রজতকে ক্রাইমস্পটে নিয়ে গেল। সেই পিজিতে যেখানে মৌমিতা থাকতো। সিল খুলে মৌমিতার ঘরের মধ্যে ঢুকে রজত অবাক হয়ে গেল। সেখানে যে কোনো বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তার কোনো চিন্হ মাত্র নেই। অবাক হয়ে সৈকত বলে উঠল,

-“একি! ঘর তো সিল করা ছিল। বিছানার পোড়া চাদর, পর্দা সব পাল্টাল কি করে তবে?”

রজত তার ই.এম.এফ মিটার চালু করল। কিন্তু তাতে কোনো সিগন্যাল পাওয়া গেল না। রজত ক্ষীণ গলায় বলল,

-“তবে কি যা ভাবছি তাই? “

তারপর সৈকতকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“ভাই তোদের স্পটের ছবি তুলে রাখা হয় না? সেই ছবিগুলো কি আমি দেখতে পারি?”

-“হ্যাঁ রে ছবি আছে। থানায় গিয়ে আমি সেগুলো তোকে দেখাব। তার আগে আমাকে এই ব্যাপারটা দেখতে হবে, সিল করে রাখা সত্ত্বেও এখানে কী করে এসব বদলানো হল।”

সৈকত বাড়িওলা শ্যামলবাবুকে ডেকে আনলেন।

ভদ্রলোক তো সব দেখেশুনে অবাক। তিনি ঘর ঠিক করার ব্যাপারে কিছুই জানেন না। বললেন

-“এখানে ঢোকার আর কোনো রাস্তা নেই, বিশ্বাস করুন। আর কেই বা ঢুকবে! আমি আমার বুড়ো চাকরকে নিয়ে থাকি ওপরতলায়। আর কোনো ভাড়াটেও নেই এখন। এই ঘটনায় আমার যে কতো বড়ো ক্ষতি হল। এই খাট, আলমারি, জিনিসপত্র সব আমাদেরই ছিল। যা অবস্থা হয়েছিল তা তিনদিনের মধ্যে কি এরকম ঠিক করা সম্ভব?”

-“তাও ঠিক। ঠিক আছে আমি আবার সিল করে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে তদন্ত হবে। দেখবেন কেউ যেন না এখানে ঢোকার চেষ্টা করে।”

থানায় ফিরে সৈকত রজতকে ফটোগুলো দেখাল। সেখানে দেখা যাচ্ছে ঘরের সব কিছুই পুড়ে ছাড়খার। মৌমিতার পোড়া শরীরটা পড়ে আছে তার মধ্যে। আর তার পাশে লাল রঙের পোশাক বা অন্য কিছুর পোড়া টুকরো পড়ে আছে। 

রজত বলল,

-“এই টুকরোগুলো কিসের সৈকত?”

সৈকত ভাল করে ছবিটা দেখে বলল,

-“আরে এগুলো কী? আমরা ফরেনসিক টেস্টের জন্য যখন সবকিছু নিয়ে যাচ্ছিলাম এটা তো ছিল না।”

-“সেকী? আচ্ছা মৌমিতার জিনিসপত্র তো বাড়ির লোককে ফেরত দেওয়া হয়েছে? তার একটা লিস্ট আমাকে দিতে পারবি? আর মৌমিতার বাড়ির ঠিকানাটাও আমাকে দিস।”

-“ঠিক আছে আমি সব তোকে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।”

রজত সব নিয়ে বাড়ি ফিরল। সে ঠিক করল পরের সপ্তাহে ছুটির দিন দেখে মালদা রওনা দেবে। কিন্তু তার আগেই একটা ঘটনা ঘটল। তার ভাইজি সুনিতা পাশের ঘর থেকে ডেকে বলল,

-” রূপাইদা , দেখো হিরোইন মৌমিতা চ্যাটার্জি মিসিং।”

মৌমিতা চ্যাটার্জি রজতের খুব পছন্দের অভিনেত্রী। নিউজে দেখাচ্ছে, দুদিন আগে মৌমিতা চ্যাটার্জির মা নাকি লাস্ট তাকে নিজের বাড়ির বাথরুমে ঢুকতে দেখেছিলেন। তারপর আর বাথরুম থেকে বেরোতে দেখা যায়নি। অনেকক্ষণ বাথরুম থেকে না বেরোনোয় তার মা ও বাড়ির কাজের লোকেরা মিলে ডাকাডাকি করে। তারপর দরজা ভেঙে বাথরুমে কাউকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ গিয়ে সব খুঁটিয়ে দেখে। বাথরুমে অন্য কোনো বেরোনোর রাস্তা নেই।  আর কিছু ঘটার সম্ভাবনা আছে কিনা পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে। সুনিতা বলে উঠল,

-“রূপাইদা গার্গী বলছিল তুমি নাকি মৌমিতা নামের কোনো মেয়ের মারা যাওয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর করছো, তারমধ্যে আবার এই হিরোইন মৌমিতা নিখোঁজ কি অদ্ভুত ব্যাপার না। আচ্ছা, দুটো কি কোনোভাবে রিলেটেড হতে পারে?”

রজতের থেকে সুনিতার বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না হওয়ায় সে তাকে রূপাইদা বলেই ডাকে। সুনিতার কথার উত্তরে রজত বলল,

-“বুঝতে পারছি নারে। আচ্ছা তোর তো ইন্টারনেটে রিসার্চ টিসার্চের বেশ নলেজ আছে। তুই একটু খুঁজে বলতে পারবি এরমধ্যে মৌমিতা নামের আর কোনো মেয়ের সাথে কিছু ঘটেছে কিনা? মৌমিতা নামটা বাঙালি ছাড়া আর কারোর মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। আর আমার মনে হয় বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এইসব জায়গাগুলোর মধ্যে দেখলেই হবে। “

-“ঠিক আছে রূপাইদা আমি দেখছি।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই সব দেখে নিয়ে সুনিতা বলল,

-“জানি না ঘটনাগুলো রিলেটেড কিনা, তবে তিনটে ঘটনা আমার চোখে পড়েছে।”

-“বলে যা।”

-“প্রথম কেস বাংলাদেশের নেত্রকোনায় । বাইশ বছরের একটি মেয়ে , নাম মেহের রাশিদা মৌমিতা। হঠাৎ প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ে গত বছর ডিসেম্বর মাসে । তার কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। নেক্সট ঘটনা বীরভূমের। মৌমিতা সোম নামের সাতচল্লিশ বছরের এক মহিলা..”

সুনিতার কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে রজত বলল,

-“উঁহু.. এটা না। পরেরটায় যা।

-“পরের কেসটা আসামের করিমগঞ্জের। মৌমিতা বড়ুয়া নামের একটা আঠারো বছরের মেয়ে পুড়ে মারা যায়, গত বছর জানুয়ারিতে।”

-“মনে হচ্ছে যা ভাবছি তাই। কালই কলেজে ছুটি নিয়ে মালদা থেকে ঘুরে আসব।”

-“আমিও যাব তাহলে তোমার সাথে।”

-“তুই কি করে যাবি? সুনেত্রাকে কে দেখবে?”

-“আরে কমলাদি আছে তো। সব সামলে নেবে।”

-“ঠিক আছে চল তবে।”

পরের দিন সুনিতা আর রজত রওনা হয়ে গেল, মালদায় মৌমিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে। 

মৌমিতার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল মেয়ের শোকে পাগলপারা দুটি মানুষ যেন পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। মৌমিতার দাদা ওদের সামলাতে চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। সুনিতা যাওয়ায় রজতের বেশ সুবিধে হল। অনেক চেষ্টা করে , স্নেহ ভালবাসা দিয়ে অবশেষে সে মৌমিতার মাকে কথা বলাতে পারল।

-“কাকিমা আমিও তো আপনার মেয়ের মতো আমার সাথে কথা বলবেন না?”

-“হ্যাঁ বলব মা।”

-“আপনি কি বিশ্বাস করেন আপনার মেয়ে ঐভাবে আত্মঘাতী হতে পারে?”

-“না না কখনোই না। আর আগুনকে ও কতো ভয় পেতো। সেই আগুনে পুড়েই শেষে কিনা..”

এই বলে প্রৌঢ়া ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। সুনিতা তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু ধাতস্থ করল। তারপর বলল,

-“কাকিমা আপনার মেয়ের যে জিনিসগুলো পুলিশ ফেরত দিয়েছে একটু দেখাতে পারবেন?” 

-“ঠিক আছে মা।”

এই বলে তিনি মৌমিতার নিত্য ব্যবহার্য কিছু জিনিস এনে দেখালেন। তারমধ্যে কিছু জামাকাপড় আর প্রসাধন সামগ্রী ছিল। রজত বলে উঠল,

-“একটা লাল কম্বল ছিল না এরমধ্যে?”

মৌমিতার মা বলল,

-“হ্যাঁ আসলে মৃতের বিছানার জিনিস বলে ওটা তো শশ্মানে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।”

-“কম্বলটা পুরো আস্ত ছিল?”

-“হ্যাঁ আমি দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম বাবা। কম্বলটা একটুও পুড়ে যায়নি । “

-“কম্বলটা আপনারা কোথা থেকে কিনেছিলেন সেটা জানতে পারি?”

প্রৌঢ়া তখন কম্বল কেনার পুরো ইতিবৃত্ত খুলে বললেন। সব শুনে রজত বলল,

-“সেই লোকটার চেহারা আপনারা তাহলে দেখেননি। “

-“না। লোকটার চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না।”

-“কোন শশ্মানে কম্বলটা ফেলা হয়েছিল?আমরা একটু সেখানে যাব।”

তখন মৌমিতার ভাই এগিয়ে এসে বলল খুব একটা দূরে নয় আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।

রজত শশ্মানে গিয়ে আশপাশের কিছু ভিখারীগোছের মানুষের সাথে কথা বলল, তাদের মধ্যে একজন বলল,

-“হাঁ বাবু একটা হনুমান টুপি পড়া লোক, লাল রঙের একটা কম্বল তুলে নিয়ে গেল। লোকটার গোটা শরীরটা উলের সোয়েটার, হাত মোজা আর বুট জুতোয় ঢাকা। “

রজত সুনিতাকে বলল,

-“চল আমাদের ফিরতে হবে।”

রজত আর একটাও কথা বলল না এরপর। মালদা থেকে গাড়ি নিয়ে কলকাতায় পৌঁছেই সে ছুটল অভিনেত্রী মৌমিতা চ্যাটার্জির বাড়িতে। প্রথমে বাড়িতে ঢোকার পারমিশন পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু তিনি একজন প্রফেসর শুনে  সিকিউরিটি গার্ড আর বাধা দিল না। রজত সরাসরি মৌমিতা চ্যাটার্জির মায়ের সাথেই কথা বলল। 

তার কাছে জানা গেল অভিনেত্রী মৌমিতার কাছে ঠিক এক সপ্তাহ আগে একটা সুন্দর লাল কম্বল এসেছিল পার্সেলে। মৌমিতার কোনো ফ্যান তাকে উপহার পাঠিয়েছিল। তারপর থেকে মৌমিতার হাবভাব খানিকটা বদলে যায়। মেয়েটা এমনিতেই খেয়ালী ধরনের, কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে তার খামখেয়ালিপনা প্রচন্ড বেড়ে যায়। সে কতকগুলো ভালো ভালো ছবির কাজ ছেড়ে দেয়। এক সপ্তাহ ধরে শুটিংয়েও যায়নি। সারাক্ষণ নিজের ঘরেই থাকছিল।  ঘরের দরজা খুলে সে যখন বেরত , তখন দেখা যেত গোটা ঘর অদ্ভুত কাল ধোঁয়ায় পরিপূর্ন। সেই ধোঁয়া ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে যেত। তারপর বাথরুমের ভেতর থেকে অদ্ভুত এক সুগন্ধ আসত। বাথরুমের ভেতর থেকে মৌমিতা, আর কোনো এক পুরুষের গলার আওয়াজ পাওয়া যেত। মৌমিতার মা বললেন,

-“আমি ভেবেছিলাম সিজফ্রেমিয়া না কি যেন বলে, সেরকম কোনো রোগ হয়েছে। একাই দুটো গলায় কথা বলছে । এরকমই চলছিল। মেয়েটা কিছুই খায় না। এমন কি জল পর্যন্ত না। 

তারপর হঠাৎ করে একদিন বাথরুম থেকে অদৃশ্য হলো।”

রজত জিজ্ঞেস করল,

-“আপনি কোনো কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন মেয়ের সাথে?”

-“না ও অনেকদিন থেকেই আমার সাথে মাঝেমাঝে কথা  বন্ধ করে দিত । সেরকমই কিছুদিন কথা বলছিল না।”

-“সেই লাল কম্বলটা কি এখানে আছে?”

-“না আমি অনেক খুঁজেছি, কিন্তু সেই কম্বলটা মৌমি যেদিন গেল তারপর থেকে আর খুঁজে পাইনি। রজত এরপর মৌমিতা চ্যাটার্জির মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরল। 

রাত প্রায় ১০টা , বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সুনিতা 

রজতকে বলল,

-“তাহলে রূপাইদা মেইন কালপ্রিট ওই লাল কম্বলটা?”

-“হ্যাঁ রে তাইতো মনে হচ্ছে।”

-“ওই কম্বলটা তাহলে কিভাবে পাওয়া যাবে?”

-“বুঝতে পারছি নারে। কম্বল খোঁজার জন্য তো আর পুলিশে রিপোর্ট করা যায় না।”

এরপর তারা ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল। সুনিতার হাসবেন্ড সুমিতও তখন ফিরে এসেছে। কমলাদি খাবার পরিবেশন করছিল। হঠাৎ সুনিতার ফোনে একটা মেসেজ ঢুকল। সুনিতা মেসেজটা দেখে বলল,

-“রূপাইদা দেখো তুমি লাল কম্বল নিয়ে মাথা খারাপ করছিলে আর গার্গী আমাকে একটা কম্বলের ছবি পাঠিয়েছে। What a coincidence..”

রজত বলল,

-“কই দেখি।”

রজত ফোনটা দেখে বলল,

-“গার্গীকে কম্বলটার ডিটেলস জিজ্ঞেস কর তো।”

-“সেটা আর জিজ্ঞেস করতে হবে না, গার্গী খুব আগ্রহ নিয়ে তার আগেই সব পাঠিয়েছে। ওই যে পৌলমী আছে না, ওর মা গতকাল ওদের পাড়ার একটা দোকান থেকে কম্বলটা কিনেছে। এতো সুন্দর ডিজাইনের কম্বল , দাম মাত্র দুশো টাকা। তাই পৌলমি গার্গীকে কম্বলের ছবিটা পাঠিয়েছিল। আর গার্গী পাঠিয়েছে আমাকে। “

-“পৌলমী পাঠিয়েছে? পৌলমীর বোনের নাম মৌমিতা না?”

-“আরে হ্যাঁ তাইতো।”

-“নিতু শোন আমি পৌলমীদের বাড়িতে যাচ্ছি। তুই ইমিডিয়েট গার্গীর থেকে ওদের প্রপার অ্যাড্রেসটা জেনে আমাকে টেক্সট করিস। আর পৌলমীকে ফোন করে বল মৌমিতা যেন কোনোভাবেই কম্বলটা টাচ না করে।”

-“ঠিক আছে। তুমি সাবধানে যাও রূপাইদা।”

 একঘন্টার মধ্যেই রজত পৌলমীদের বাড়িতে পৌঁছে যায়। কিন্তু হায় পৌলমীদের বাড়িতে পৌঁছে সে দেখে লাল কম্বলটা একটা সাধারণ কম্বল। রজত নিজের সমস্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করে দেখে, কম্বলের মধ্যে কোনো অস্বভাকিকতা নেই। পৌলমীর বোন মৌমিতাও স্বাভাবিক। এতো রাতে পৌলমীদের বাড়ির লোককে বিরক্ত করার জন্য রজতকে বেশ লজ্জায় পড়তে হল। সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার পর রজত খুব হতাশ হয়ে পড়ে। এভাবে তো কোনো রাস্তাই পাওয়া যাবে না। 

(৩)

বেশ কয়েকটা দিন এভাবেই কাটল হতাশার মধ্যে। 

সপ্তাহখানেক পরে রজতের কাছে হঠাৎ সুমিতের ফোন। রজত তখন সেই সবে প্রেসিডেন্সি থেকে ছুটির পর বেরোচ্ছে। সুমিত বলল,

-“রজতদা তুমি কি একবার বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে ইমিডিয়েট আসতে পারবে?”

-“কি ব্যাপার বলোতো?”

-“আমার অফিসের এক কলিগ সুদীপদার মেয়ে খুব অসুস্থ। আসলে সুদীপদা মেয়ের শরীর খারাপ বলে এক মাসের ছুটি নিয়েছিলেন। তাই ভাবলাম একবার ওর মেয়েকে দেখে আসি। এসে দেখি ভয়ংকর অবস্থা। সুদীপদার মেয়ের নাম মৌমিতা। সুনিতা কদিন ধরে দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে যে সব কথা বলেছিল, একেবারে সেই অবস্থা । একটা লাল কম্বলও আছে।”

-“ওকে ওকে আমি যাচ্ছি। তুমি অ্যাড্রেসটা আমায় টেক্সট করে দাও।”

বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে সুমিতের কলিগের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল খুবই খারাপ অবস্থা। সুমিত, রজতকে জানাল দুদিন ধরে সুদীপদার একমাত্র মেয়ে মৌমিতা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে বসে আছে। অদ্ভুত স্বরে পুরুষ কণ্ঠে কি যেন বলে চলেছে সমানে। সুরেলা পুরুষকণ্ঠে গানও গাইছে। দুজন ডাক্তার বাড়িতে তাকে দেখেতে এসেছিল। তাদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিয়েছে আর তাদের পাস্ট লাইফের ইতিহাস গড়গড় করে বলে গেছে। সেসব কথা শুনে ডাক্তাররা পালাতে পথ পায়নি। গত এক সপ্তাহ ধরে সকালে দেখা গেছে মৌমিতার বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে । রাতে মৌমিতার প্রচন্ড চিৎকার শোনা যায়। মনে হয় কেউ যেন জোর করে তার রেপ করার চেষ্টা করছে। সপ্তাহ খানেক আগে মৌমিতা পাড়ার দোকান থেকে একটা সুন্দর লাল কম্বল কিনে এনেছিল। সেটা গায়ে দিয়ে রাতে শোবার পরই এসব ঘটনা শুরু হয়েছে।

মৌমিতার বাবা জানাল,

-“প্রথম দিন আমরা ভেবেছিলাম কম্বল থেকে কোনো অ্যালার্জি বা জীবানু লেগে যদি এসব ঘটে থাকে । তাই দ্বিতীয় দিন ওর মা কম্বলটা সরিয়ে রাখে। কিন্তু মাঝরাতে আবার মেয়ের চিৎকার। সেই একই কান্ড। তারপর আমরা নানাভাবে কম্বলটা সরানোর চেষ্টা করি। কম্বলটা নষ্ট করারও চেষ্টা করি। কিন্তু কি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ভাই..”

-“কিরকম অভিজ্ঞতা?”

-“কম্বলটা আমি কুঁচি কুঁচি করে কাটতে গেছিলাম। কিন্তু তখনই কাঁচিটা আপনা থেকেই আমার আঙ্গুলের ওপর চলে যায়।”

পকেট থেকে ডান হাতটা বার করে ভদ্রলোক দেখিয়ে বললেন,

-“দেখুন তো হাতের কি অবস্থা।”

ভদ্রলোকের হাতের মধ্যমা, তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা। পুরো আঙুল অবশ্য নেই । শুধু তালু থেকে কিছুটা উঁচু অংশ উঠে আছে। ভদ্রলোকের হাতটা দেখে বেশ অস্বস্তি হয়। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।

-“হাতটা যখন কেটে যাচ্ছিল তখন আমার কোনো অনুভূতিই ছিল না। সব ব্লাঙ্ক। কিন্তু তারপর, উফঃ সে কি ভীষন যন্ত্রণা। তারপরে আমরা কম্বলটা বাইরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু রাতে সেটা আবার নিজেই ফিরে আসে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হয়েছিল যখন কম্বলটা আমরা পোড়ানোর চেষ্টা করি। জানুয়ারি মাসের ঝকঝকে নীল আকাশ। তারমধ্যে কোথা থেকে যেন ঘন কালো মেঘ ছেয়ে গেল, মিনিট খানেকের মধ্যে তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। মেঘে সে কি ভীষন গর্জন। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি। হঠাৎ ভয়ংকর কান ফাটানো এক শব্দ। বাড়ির মধ্যে একটা আগুনের গোলা যেন এসে ঢুকল। বাড়িময় আগুন লেগে গেল। আর জ্বলতে থাকা লাল কম্বলের মধ্যে আগুনের গোলাটা যেন মিশে গেল। লাল কম্বলটা থেকে অদ্ভুত লাল আলোর ছটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আমরা কিভাবে বাড়ির আগুন নেভাব সেটা ভেবেই পাগল হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ মিতু এসে কম্বলটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল। আর সাথে সাথেই বাড়ির আগুন নিভে গেল। আকাশের মেঘ কেটে আবার ঝকঝকে আবহাওয়া। মিতু তারপর কম্বলটা নিয়ে সেই যে ঘরের দরজা দিল, আর খুলছে না। ওর মায়ের তখন থেকে মাথার ঠিক নেই। 

একটু দম নেবার জন্য সুদীপদা থামলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন,

-“এসব.. এসব কথা কেউ তো বিশ্বাস করবে না ভাই। ভাববে আমরা মেন্টালি ডিসব্যালেনস বা ড্রাগের নেশা করে ভুলভাল বকছি। জানি না আপনারা বিশ্বাস করছেন কিনা।”

সুমিত বলল,

-“রজতদা , মিনিট পনেরোর জন্য বালিগঞ্জের আকাশে হঠাৎ কালো মেঘ দেখা দেওয়ার ঘটনাটা নিউজেও দেখিয়েছিল। আচ্ছা এটা কি বল লাইটিং বা ওই জাতীয় কিছু হতে পারে?”

-“আর বাকি ঘটনাগুলোকে কি বলবে সুমিত? সেগুলোর তো কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাচ্ছে না।”

-“তাও ঠিক। আচ্ছা রজতদা ওই কম্বলের মধ্যেই কি শয়তানের বাস?কম্বলটা যে দোকান থেকে কেনা হয়েছিল, সেখানে খোঁজ নিলে তো এ ব্যাপারে কিছু জানা যেতে পারে।”

তখনই সুদীপবাবু বলে উঠলেন,

-“সেটা কি আর আমরা করিনি ভাবছো সুমিত? কিন্তু সেখানেও তো হতাশা। সেই কম্বলের দোকান আর সেখানে নেই। তার বদলে সেখানে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান হয়েছে। আমরা সেই দোকানে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম কম্বলের দোকানদারকে চেনে কিনা। কিন্তু তারা কিছুই বলতে পারল না।”

রজত বলল,

-“হুমম সব জায়গাতেই এই একই রকম কেস। আচ্ছা মৌমিতার সাথে কি একবার দেখা করা যেতে পারে?”

-“কিন্তু সেতো দরজাই খুলছে না। আপনি কি ভাবে দেখা করবেন তার সাথে? আর..”

ঠিক সেই সময়েই দুম করে দরজা খোলার শব্দ। আর সাথে সাথেই গোটা বাড়ির বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল এক সর্গীয় সুগন্ধ। সম্ভবত আতরের গন্ধ । কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপর সামনে যে এগিয়ে এল তার রূপের বর্ণনা পৃথিবীর কোনো মানুষ, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। না দেখলে এমন রূপ যে কোনো মনুষ্য কুলের নারীর হতে পারে তা বিশ্বাস করা কঠিন। মেয়েটির কোমর ছাপানো কালো খোলা চুল রেশমের মতো কুঞ্চিত। কপাল যেন আয়নার মতো ঝকঝলে। কালো চোখে আগুনের ঝলকানি। সেই আগুন যে কোনো পুরুষের হৃদয়কে পুড়িয়ে ফেলতে পারে। নাক বড়ো বেশী লম্বা নয় খুব খাটোও নয়। মুখখানি ছোটো। ওষ্ঠাধর যেন সিঁদুর মাখানো আছে এমনি লাল। দাঁতগুলো যেন একেকটি মুক্ত। কেউ যেন সযত্নে সেই মুক্ত গেঁথে মালা তৈরী করেছে। তরুনীর যৌবন পুষ্পিত দেহলতা, শঙ্খের মতো বক্ষ যুগল দেখে যেন শুভ্র কমল কুঞ্জ লজ্জাবনত হয়ে পড়বে। মেয়েটির পরনে পাতলা মসলিন কাপড়ের লাল পোশাক, অনেকটা টিভির আরব্য রজনী সিরিয়ালের রাজকুমারীদের মতো। মুখেও সেই মসলিন কাপড়ের একটা আবরণ। মাথায় উরুনি। এতে মেয়েটিকে আরও মোহময়ী লাগছে। এতো সুন্দর মেয়েটি এখানে কি করে এলো? এ কি সত্যিই সুমিতের অফিস কলিগ সুদীপদার মেয়ে! 

মেয়েটি ঝড়ের বেগে যেন একেবারে রজতের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর তার কুন্দকলির মতো ঠোঁট নড়ে উঠল । কিন্তু একি সেই মেয়ের গলা থেকে যে কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এলো তা কল্পনার বাইরে। গমগমে ভারী পুরুষালি গলায় সেই মেয়ে বলে উঠল..

-” আদাব! কি প্রফেসর সাহেব জ্বীন ধরতে আসছেন?”

ইসলাম ধর্মের মানুষেরা সে ধর্মের মানুষদের দেখলে বলে আস-সালাম আলাইকুম। কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষদের বলে আদাব। রজত বলল,

-“তুমি দেখছি ধার্মিক জ্বীন।”

-“আমি ধার্মিক কিনা জানি না সাব, কিন্তু তুমি যে চরম অধার্মিকের কাজ করসো সে খবর আমার কাছে আছে। কি করো নাই?”

-“কি কাজ?”

-“নিজের দাদার মেয়ে, সেতো নিজের মেয়ের মতোই তুমি তারে লইয়া সুখ স্বপ্ন দেখছ। তারে একসময় তুমি মনে মনে কামনা করতে ? কি প্রফেসর সাব আমি ভুল কিছু কইছি?”

রজতের মুখ শুকনো ঘাসের মতো বিবর্ণ হয়ে গেল। সেই সময় সুদীপদা বলে উঠলেন,

-“চুপ কর মিতু । এসব তুই কি বলছিস? আর এইসব জামা কাপড় তুই পেলি কোথা থেকে?”

-“আমারে দিয়াছে।”

-“কে দিয়েছে?”

-“তা তোমারে কমু কেন বদের বাচ্চা?”

-“ছি এসব কি ধরনের ভাষা বলছিস?”

তারপর নিজের স্ত্রীকে ডেকে বললেন,

-“উর্মি.. উর্মি ওকে ঘরে নিয়ে যাও।”

তখনই এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে মৌমিতাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলেন। মেয়েটি নিজেই অবশ্য চলে গেল। নাহলে ওই মহিলার কোনো ক্ষমতাই ছিল না মেয়েটিকে সরিয়ে নেওয়ার। মেয়েটি যেতেই রজত বলে উঠল,

-“সুদীপবাবু এটিই আপনার মেয়ে মৌমিতা?”

-“হ্যাঁ আমারই মেয়ে । কিন্তু বলতে পারেন ওই চেহারার মিলটুকু ছাড়া আর কোনো মিল নেই। তাও সেটাও তো বলতে গেলে একেবারে বদলে গেছে । “

-“বদলে গেছে, মানে?”

-“যাকে দেখলেন সে তো পরীর মতো সুন্দরী তাই না? কিন্তু আমার মেয়ের আগের ছবি দেখবেন?”

এই বলে ভদ্রলোক একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি এনে রজত আর সুমিতের সামনে ধরলেন। ছবিতে একটি মেয়ে কেক কাটছে। মেয়েটি যে মৌমিতা তা মুখের আদল দেখলে বোঝা যায়। বোধহয় ওর জন্মদিনের ছবি। কিন্তু মেয়েটিকে দেখতে আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই। একটু আগে যে অপরূপা সুন্দরীকে দেখা গিয়েছিল তার সাথে কোনো মিলই নেই। 

-“দেখলেন ছবিটা? এই রূপ পাল্টনোর ঘটনাটা ঘটেছে এক রাতের মধ্যে। ও এখন যে সব পোশাক পরছে সেগুলোও যে কোথা থেকে আসছে ভগবান জানে। যে দিন ওই কম্বলটা আনা হয়েছিল সেইদিন রাতে ওটা গায়ে দিয়ে শুতে গেল। তারপর রাতে ওর অদ্ভুত চিৎকার শুনতে পাই আর ওর ঘরে গিয়ে দেখি কম্বলটা জড়িয়ে যে শুয়ে আছে তার চেহারা অনেকটা বদলে গেছে। রূপের ছটায় ঘরটা যেন আলো হয়ে আছে। তবে বিছানা জুড়ে রক্তের স্রোত। “

এই কথা বলেই ভদ্রলোকের গলা ভারী হয়ে এলো। কোনো রকমে তিনি কান্না আটকালেন

রজত আর সুমিত সুদীপদাকে কাঁধে হাত দিয়ে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল।

তারপর রজত বলল,

-“আমি কিছু একটা সন্দেহ করছি। সেটা ঠিক কিনা বোঝার জন্য আমি যদি একটা এক্সপেরিমেন্ট করি .. আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?”

-“কি এক্সপেরিমেন্ট? কি সন্দেহ করছেন আপনি? “

-“বেশী কিছু নয় আমি কোরান থেকে কিছু আয়াত পড়ব।”

-“কোরান পড়বেন? তাতে কি হবে?”

-“সেটা দেখতেই পাবেন। আপনি মৌমিতার ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে ভালো করে বন্ধ করে দিন।”

দরজা বন্ধ করার পর পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে রজত আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করল।

-“আল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম। লা তা’খুযুহু সিনাতুঁ ওয়ালা নাঊম। লাহূ মা ফিস্ সামা-ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্বি। মান যাল্লাযী ইয়াশফাউ’ ই’ন্দাহূ ইল্লা বিইজনিহি।”

কিন্তু এই পর্যন্ত পড়া হতেই গোটা বাড়ি জুড়ে যেন ভূমিকম্প শুরু হল। নীল আকাশ জুড়ে ঘন কালো কুন্ডলিকৃত মেঘ ঘনিয়ে এল। মেঘের কোলে ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছে নীল বিদুৎ। হঠাৎই সেই বিদ্যুতের লকলকে শিখা একের পর এক জানলা দরজা দিয়ে, আরও না জানি বাড়ির কোন ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে আঘাত হানতে চেষ্টা করল রজতের ওপর। প্রথমে এই ঘটনায় রজত কিছুটা হতচকিত হয়ে যায়। কিন্তু আয়াতুল কুরসি পড়া সে থামায় না। কারণ একবার পড়া বন্ধ করলে আবার তা প্রথম থেকে পড়তে হয়। একটা বিদ্যুতের আঘাত প্রায় তার কানে ঘেঁষে বেরিয়ে যায় ,রজত কোমরের থেকে নিজের শরীরটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে সেই আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করল। বাকিরা তখন নিজেদের রক্ষা করতে খাটের নিচে, আলমারির পিছনে গিয়ে লুকিয়েছে।

রজতের গলা তখনও গমগম করে পড়ে চলেছে..

-“ইয়া’লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়ামা খালফাহুম, ওয়ালা ইউহিতূনা বিশাইয়্যিম্ মিন ‘ইলমিহি ইল্লা বিমা শা-আ’ ওয়াসিআ’ কুরসিইয়্যুহুস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্বি, …”

কিন্তু হঠাৎ আর একটা ঘটনা ঘটল কোথা থেকে যেন দমকা বাতাস এসে সব কিছুকে এলোমেলো করে দিল। সেই বাতাসের সঙ্গে হু হু করে ঘরে ঢুকতে লাগল বালুকণা। কোন অজানা মরুভূমি থেকে যেন টন টন বালুকণা ঝড়ের সাথে উড়ে এসে গোটা ঘর ছেয়ে ফেলল। কুণ্ডলিকৃত ধূলিঝড় সব অন্ধকার করে দিল। সবার চোখে মুখে সেই ধুলো ঢুকে যেন দম বন্ধ করে দিতে লাগল। কিভাবে যে তার মধ্যে রজত নিজের পাঠ চালিয়ে যেতে পারল তা ভগবান জানে। 

-“ওয়ালা ইয়াউ’দুহূ হিফযুহুমা ওয়া হুওয়াল ‘আলিইয়্যুল আ’জিম। “

আয়তুল কুরসি পাঠ শেষে তিন বার তালি বাজাতেই সব কিছু থেমে গেল। সব শান্ত। কিন্তু সুদীপদার বাড়ি তখন সম্পূর্ন ভাবে বিধ্বস্ত। সব কিছুর উপর পুরু বালির আস্তর। দেওয়াল, আসবাবপত্র সব পুড়ে কালো হয়ে আছে। চারিদিকে একটা বিশ্রী কটু দুর্গন্ধ । একে একে এদিক ওদিক থেকে বেরিয়ে এল সুদীপদা , সুমিত , মৌমিতার মা। সকলেই বিধ্বস্ত, শরীরের নানা স্থান বিশ্রী ভাবে পুড়ে গেছে। রজত আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ধপ করে বসে পড়ল। তার অবস্থাই সব থেকে খারাপ। সুমিত রজতকে ধরতে আসতেই রজত হাত তুলে বলল,

-“আ..মি ঠিক আ..ছি। মৌমিতার ঘ..রটা খু..লে দে..খো।”

তখন মৌমিতার ঘরের দিকে সবাই এগুলো। দরজা খুলতে গিয়ে দেখা গেল সেটা ভিতর থেকে বন্ধ। সুদীপদা আর সুমিত তখন খানিকটা মরিয়া হয়ে দরজায় ধাক্কা মারতে শুরু করল। দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় কিছুক্ষনের মধ্যেই দরজাটা বিশ্রী শব্দ করে খুলে গেল। আর ঘরের মধ্যে দেখা গেল মেঝেতে উল্টো হয়ে লুটিয়ে পরে আছে মৌমিতা। রজত আর মৌমিতার মা বাকিদের সরিয়ে মৌমিতার দিকে এগিয়ে গেল। মৌমিতাকে সোজা করতেই, সকলেই যেন চমক লেগে ছিটকে গেল। মেয়েটার জ্ঞান নেই , চোখগুলো বন্ধ। কিন্তু মুখের আদল সেই ছবিতে দেখা আর পাঁচটা সাধারণ, বাঙালি, মধ্যবিত্ত মেয়ের মতো। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই অপরূপা হুর পরীর সৌন্দর্য্য! ঠিক সেই সময়েই হা হা বাতাসের মধ্যে থেকে ভেসে আসে এক অপার্থিব কণ্ঠস্বর। কিছুক্ষণ আগে এই কণ্ঠস্বরই শোনা যাচ্ছিল মৌমিতার গলা থেকে।

-“প্রফেসর সাব এটা ঠিক হইল না। আমার বাপজান যদি আসত তুমি কিস্যু করতে পারতা না। কিন্তু আমি চাই নাই। তাই তিনি আসেন নাই। তবে কথা দিতেছি ঠিক এক হপ্তা পরে আমি ফিরব। আর তখন তুমি কেন, কোনো মসিহার দোয়া কালাম কোনো কাজে আসব না।”

এরপরেই আবার যেন একটা দমকা হাওয়ার সাথে হুহু করে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে গেল গোটা বাড়ি থেকে।

রজত তখন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

-“যা ভয় পেয়েছিলাম তা শুরু হয়ে গেছে। গাইলান জ্বীন তার কাজ করেছে। তার বংশধরদের জন্ম হয়েছে। “

সুমিত অবাক হয়ে বলল,

-“গাইলান জ্বীন ! সে আবার কি? একি আলিফলেলার আলাদিনের সেই জ্বীন?”

-“এরা শয়তান জ্বীন। এখানে যে ছিল সে গাইলান জ্বীনের সন্তান জ্বীন কফিল। এরা জ্বীন জাতির বিভিন্ন প্রজাতি। আয়তুল কুরসি পড়ে তিন বার তালি মারলেই  দুষ্ট জ্বীনেরা শায়েস্তা হয়। তবে আজ যা দেখলাম তাতে মনে হয় কোনো কিছুই আর এদের ওপর কাজ করছে না।”

-“তাহলে এখন কি হবে?”

-“হুজুরে এ কেবলা নিজামত আজমল আতাপি।”

এটুকু বলার পরেই রজত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সুমিত আর সুদীপদা তাকে ধরে ফেলল। তারপর অ্যাম্বুলেন্স, হসপিটাল।

(৪)

রজত আর গার্গী আজ বাংলাদেশের নেত্রকোনা এসে পৌঁছেছে রাত দশটায়। প্রথমে ফ্লাইটে ঢাকা, ঢাকা থেকে খাওয়াদাওয়া করে, গাড়িতে নেত্রকোনা পৌঁছতেই সন্ধ্যে হয়ে যায়। তারপর সেখান থেকে কয়েলাটি গ্রাম। গ্রামটা রায়না নদীর তীরে। পোস্টঅফিস রয়ালবারি থানা, জেলা কেন্দুয়া।

***********

সুদীপদার বাড়ির সেই ঘটনার পর রজতকে হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছিল। তার শরীরের বেশ কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতও লেগেছিল। সেরকম গুরুতর না হলেও রজতকে সপ্তাহখানেক হসপিটালে থাকতে বলা হয়েছিল। তবে রজত তিনদিনের বেশি হসপিটালে থাকেতে রাজি হয়নি। সে বলেছিল,

-“এক সপ্তাহ টাইম আছে হাতে, এর মধ্যে উঠে যদি কিছু না করি তাহলে কি যে অনর্থ হবে তা ভাবতে গেলেও গা শিউরে ওঠে। “

হসপিটালে তাকে দেখতে গার্গী, সুনিতা আর গার্গীর দাদা গৌরব গিয়েছিল। সুনিতা বলল 

-“কি হবে গো রূপাইদা?”

-“কেউ একজন মৌমিতা নামের মেয়েদের ওপর নিজের ক্ষোভ উগড়ে দেওয়ার জন্য,  এমন এক ভুল করে বসেছে.. গাইলান জ্বীনকে পৃথিবীতে ডেকে এনেছে। এখন গাইলান তার বশে আছে বটে, অনেকটা নিজের প্রয়োজনেই আছে। নাহলে গাইলানকে বন্দী করতে পারে এমন ক্ষমতা এই তামাম দুনিয়ার কারোর নেই। গাইলানকে কোনো মানুষ পৃথিবীতে না আনলে তার আসার ক্ষমতা নেই। কিন্তু এর ফল যে কি মারাত্মক হতে পারে সে সন্মন্ধে যে এনেছে তার কোনো আইডিয়া নেই।”

গার্গী বলল,

-“শুনে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে কিন্তু এমন অনেক কিছুই থাকে যা আমাদের কল্পনার বাইরে । রোধির সেই ঘটনার পর তো আর অবিশ্বাস.. যাক গে এখন বলতো কি কি ঘটতে পারে ?”

-“গাইলান হচ্ছে জ্বীন জাতির জাদুকর। কোরান হাদিস অনুযায়ী জ্বীন জাতির সাথে মানুষের শারীরিক সম্পর্ক হলে সন্তান বাইসেক্সুয়াল হয়। এর যদিও কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু এই গাইলান এমন ক্ষমতা রাখে যাতে সাধারণ মেয়েকে, পরী অর্থাৎ নারী জ্বীনে পরিণত করতে পারে। যেসব নারী তার বশ্যতা স্বীকার করে, তাদের গাইলান দান করে অসাধারণ সৌন্দর্য্য।  তারপর তাকে নিয়ে যায় নিজের দুনিয়ায়। সেখানে অফুরান ঐশ্বর্য্য আর সাচ্ছন্দ্যে গাইলান সেই মেয়েকে নিজের প্রাসাদে রাখে। আর সেই পরীর সাথে সঙ্গমের ফলে সৃষ্টি হয় গাইলানের বংশধর। নতুন নতুন ক্ষমতাসম্পন্ন জ্বীন। সুদীপবাবুর মেয়েকে যে ধরেছে সে এই গাইলান জ্বীনের সন্তান জ্বীন কফিল। এরা চাইছে গোটা পৃথিবী থেকে মানুষদের দূর করতে। মানুষের পৃথিবী দখল করবে জ্বীন জাতি। আর তাদের বাদশা হবে জাদুকর গাইলান জ্বীন “

-“যে মেয়েরা বশ্যতা স্বীকার না করে তাদের কি মরতে হয়?”

-“হ্যাঁ ঠিক ধরেছো। এর জন্যই পৌলমীর কলিগকেও   মরতে হয়েছিল। তোমরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। সাত দিনের মধ্যে কিছু না করতে পারলে এমনিও কফিল জ্বীন আমাকে রেয়াত করবে না। তখন আমার মৃত্যু নিশ..”

এই পর্যন্ত বলতেই গার্গী রজতের মুখে হাত চেপে ধরে। তখনই আশপাশের আপনজনদের কৌতুক মিশ্রিত দৃষ্টির কথা মনে করে বলে ওঠে,

-“এতো বকবক করছো কেন ? এই শরীরে এতো কথা বলা ঠিক নয়।”

এতে যেন সকলের মনের কৌতুক আরও বেড়ে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে গৌরব বলল,

-“এর পরের পরিকল্পনাটা তোরা দুজনে সেরে ফেল। আমরা থাকলে কথায় কথা বাড়বে। আর আমার বড্ড চা তেষ্টা পেয়েছে। “

তারপর সুনিতা আর সুমিতকে আলগোছে উদ্দেশ্য করে বলে ,

-“কি হে তোমরাও যাবে নাকি চা খেতে?”

সুনিতা আর সুমিত মুখ টিপে হেঁসে গৌরবের সাথে বাইরে চলে যায়।

গার্গী তখন রজতকে বলে,

-“তাহলে কি করবে ভাবছো? সুমিতদা বলছিল, তুমি নাকি কি আরবী ওয়ার্ড বলেছিলে ওরা যখন কি হবে জিজ্ঞেস করেছিল।”

-“ওটা আরবী ওয়ার্ড নয়।”

একটু কৌতুকের ছলে হেঁসে নিয়ে রজত আবার বলল,

-“হুজুরে এ কেবলা নিজামত আজমল আতাপি একজন ব্যক্তি। যে সে ব্যক্তি নয় প্যারানরমাল সাইন্স, মেটাফিসিকস এর ওপর ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জ্বীনিয়া থেকে phd করেছেন। আমেরিকায় যুবক বয়সে অনেক এক্সোর্সিস্মের কেস সলভ করেছেন। কিন্তু একটা ঘটনার পর হঠাৎই সব ছেড়ে সেখান থেকে চলে আসেন। সে প্রায় দশ বছর আগের কথা। আমি আমেরিকায় থাকার সময় দু বছর ওঁর সঙ্গ পেয়েছি। আর তাতেই বুঝেছিলাম একজন আসল গুণী মানুষের সাথে থাকতে পারছি। “

-“হুজুরে কেবলা এখন আছেন কোথায়?”

-“তিনি যখন গেছিলেন কাউকে কিছু বলে যাননি। তবে আমেরিকায় থাকাকালীন একটা কেসের ব্যাপারে পাঁচ বছর আগে ভদ্রলোকের চিঠি পেয়েছিলাম। সেখানে বাংলাদেশের এক গ্রামের ঠিকানা ছিল। ভাবছি একবার সেখানে গিয়ে দেখব।”

-“কবে যাবে?”

-“যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। তুমি ব্যবস্থা করো।”

-“আচ্ছা বেশ।”

এরপর ব্যবস্থা হল। গার্গী অবশ্য রজতকে একা ছাড়ল না। রজতের  শরীরের যা অবস্থা, গার্গী নিজেও তার সাথে যাবার ব্যবস্থা করে নিল।

************************

সেই চিঠিতে পাওয়া ঠিকানাতেই রজত আর গার্গী যাচ্ছে। কয়েলাটি গ্রাম। পোস্টঅফিস রয়ালবারি, থানা কেন্দুয়া, জেলা নেত্রকোনা। রজতের কাছে পীরসাহেবের কোনো ফোন নাম্বার ছিল না, তাই ভদ্রলোককে যাওয়ার ব্যাপারে জানানোর জন্য স্পিডপোস্টে একটা চিঠিতে জানানো হয়েছিল। চিঠির উত্তর আসার অপেক্ষা করার সময় ছিল না । গার্গী আর রজত কিছুটা অনিশ্চিত হয়েই তাদের যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ঢাকা পৌঁছে যখন এমদাদ খন্দকার নামের ভদ্রলোক হাঁসি মুখে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন, তখন তারা বুঝতে পারল চিঠিটা ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছিল। এমদাদ খন্দকার

রজত আর গার্গীর দিকে এগিয়ে এসে বলল,

-“আসালামালিকুক স্যার , আমি এমদাদ খন্দকার এই পুরা বাংলাদেশে আমার মতো ক্ষমতাবান মানুষ আর নাই। এই ক্ষমতা কিভাবে পাইসি জানেন? পীরসাহেব হুজুরে এ কেবলা নিজামত আজমল আতাপি দোয়ায়। তিনিই আমারে এইহানে পাঠাইসেন । আমি গাড়ি লইয়া আসছি আপনাদের লইয়া যাইতে।”

গার্গী আর রজত দুজনেই খন্দকারের বলার ধরন শুনে বুঝতে পারল মানুষটার বাড়িয়ে কথা বলার সমস্যা আছে। আর রজতের আর একটা কথা মনে হল পীরসাহেব কোনো মানুষকে ক্ষমতাবান বানানোর জন্য দোয়া করবেন সেরকম মানুষ নয়। যাই হোক পীরসাহেবের কাছে পৌঁছানোর উপায় এখন এই মানুষটাই । তাই গার্গী আর রজত একে অপরের দিকে চোখের ইশারা করল, তাদের সামনে থাকা লাল ঝকঝক সিডান গাড়িতে ওঠার জন্য।

গাড়ি চালাতে লাগল এমদাদ খন্দকার নিজেই। বলল ,

-“নিশ্চয় ভাবসেন আমি নিজে কেন গাড়ি চালাইতাসি । আসলে এ গাড়ি আমার বড়ো শখের জিনিস। নিজের সন্তানতুল্য। এরে অন্য কারোর হাতে সাড়তে মন সরে না।”

গাড়িতে উঠেই রজত আসল প্রসঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করল।

-“আচ্ছা পীরসাহেব এখন আছেন কেমন?”

-“ভালা আসেন।”

-“তিনি থাকেন কোথায়? মানে কয়েলাটিতে কি নিজের বাড়িতে থাকেন?”

-“হ, আমেরিকা থিক্যা ফিরা তো নিজের বাসাতেই উটসিলেন। তখন উনার বাসার যা দশা, ভাঙাসোরা, সাপখোপের আড্ডাখানা। আমি হলুম গিয়া গ্রামের মাথা। এরকম একজন মুরুব্বী মানুষ গ্রামে অমন একখান বাসায় থাকসান শূইন্যা নিজে গিয়ে সব সারাইয়ের ব্যবস্থা করলাম। পীরসাহেব তো কোনো কথা কন না । কারোরে কিসু করার কথা কোনোদিনও নিজ থেকে কন নাই। অমন একজন গণ্যমান্য মানুষ , দেখাশুনা করে রাখার জন্য আমি একজন কাজের মানুষের ব্যবস্থাও কইরা দিসি। পীরসাহেবের খরচখরচাও আমি চালাই।”

ভদ্রলোক আরও কি বলতে যাচ্ছিলেন রজত বলে উঠল,

-“এক মিনিট, পীরসাহেব কোনো কথা বলেন না মানে?”

-“হ কথা কন না। প্রথমে তো আমরা ভাবসিলাম বোবা। কিন্তু কুদ্দুস রাতে ঘুমের মধ্যে ওনারে কথা কইতে শুনসে।”

-“কুদ্দুস?”

-“জি। কুদ্দুস উনার বাসার কাজের মানুষ। “

-“তাহলে আপনি যে বললেন, পীরসাহেব আপনার জন্য দোয়া করছেন?”

-“জি উনার দোয়া না থাকলে মাত্র কয় বতসরে এতো উন্নতি হয়! কথা না কইলেও মনে মনে তো সব বোঝেন। উনারে যারা এখানে রাইখা গেসিলো তারা পীরসাহেবের ব্যাপারে বলসিল ইনি খুব জ্ঞানী মানুষ। বিশাল পড়াশোনা। তাছাড়া উনার নাকি দুজন জ্বীন পোষা আসে। “

সেই সময়ই দুটো অটো, গাড়ির দুপাশ দিয়ে খুব ভয়ংকর ভাবে পাশ কাটিয়ে গেল।

খন্দকার বললেন,

-“এই বেবি ট্যাক্সিগুলা বড়ই যন্ত্রনা করে।”

গার্গী এবার খুব নরম গলায় বলল,

-“ভাইয়া আপনি মন দিয়ে গাড়ি চালান।”

-“জি আপা।”

গার্গী রজতের দিকে চোখ টিপে বলল,

-“এই মানুষকে জোর করে বললে কোনো কাজ হবে না। এখন কোনো কথা বলো না।”

নেত্রকোনা পৌঁছনো পর্যন্ত তারা আর কোনো কথা বললেন না। খন্দকার সাহেব মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনো উত্তর না আসায় তাকে চুপ করে যেতে হয়। কয়েলাটি পৌঁছানোর পর দেখা গেল রাস্তা বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। রাত দশটা মানে গ্রামের দিকে মাঝরাত। তার জন্যই রাস্তা ফাঁকা। আর খন্দকার সাহেব কোনো ছোটো লেনের মধ্যে দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। তাই এখানে অন্য গাড়ির সমস্যা নেই। হেডলাইটের আলোতে সামনের রাস্তার বেশ কিছু অংশ দৃশ্যমান। দুপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে যতদূর মনে হয় দুদিকে আদিগন্ত বিস্তৃত চাষের জমি। প্রচন্ড ঠান্ডায় গার্গী আর রজত প্রায় কাঁপছে। তাদের দুজনের গায়েই শীতবস্ত্র , গাড়ির সব জানলা বন্ধ। তাও যেন ঠান্ডা বাধ মানছে না। খন্দকার বললেন

-“নেত্রকোনায় শীত খুব পড়ে। ডবল ডবল লেপ কম্বল চাপাইলেও ঠান্ডা যায় না। “

 রজত আবার কথা শুরু করল।

-“আচ্ছা আমাদের চিঠিটা কি পীরসাহেব পেয়েছিলেন?”

-“তাতো ঠিক কইতে পারবো না।”

রজত অবাক কণ্ঠে বলল,

-“তার মানে? তাহলে আপনি কিভাবে আমাদের নিতে এলেন?”

-“আরে ভাইসাহেব আর বলেন কেন.. পীরসাহেব তো কথাও কন না, দুনিয়ার কোনো কিছুর খবরও রাখেন না। গত কয়েক বছর কুদ্দুস উনার কাছে যে সকল চিঠিপত্র আসে সেগুলো গুছাইয়া রাখে। যেগুলা জরুরি মনে হয় আমারে আইনা দেয়। বহু ভক্ত দেশদেশান্তরে ঠিক্যা ওনারে চিঠি পাঠায়। তা আপনাদের চিঠিখানা কুদ্দুস পেল, পীরসাহেবের শোয়ার ঘরের মেঝে থিক্যা। এমনিতে পিয়ন কুদ্দুসের হাতেই সব চিঠি দিয়া যায়। কিন্তু এই চিঠিখানা কিভাবে জানি পীরসাহেবের হাতে সরাসরি পৌসেসিল। চিঠি খোলাও হইয়াসিল। কুদ্দুস আমার হাতে চিঠিখানা আসতেই আমি পড়ে দেইখ্যা বুঝলাম দরকারি চিঠি। কারা যেন পীরসাহেবের লগে দেখা করতে চান। এর আগে পীরসাহেবের লগে কেউ কোনোদিন দেখা করতে আসেন নাই। তার ওপর ইন্ডিয়া হইতে আসতাসেন। তাই আমি চিঠিটা পইড়া আপনদের নিয়া যাইতে আইলাম। “

-“বুঝলাম। তার মানে যে জিনিসের জন্য সাহায্য চাইতে এখানে এলাম তা সফল হবে কিনা জানি না।”

-“কোন জিনিস?”

-“ওই একটা মেয়েকে জ্বীনে ধরেছে । তাই ভাবলাম পীরসাহেব যদি সাহায্য করতে পারেন।”

সেই সময়েই এক ভয়ংকর দুর্যোগ শুরু হল। বছরের এই সময় এমন দুর্যোগ অস্বাভাবিক। তবে এমন ঘটনা রজত আগেও দেখেছে বলে, সে খুব একটা অবাক হলো না। গার্গীও রজতের মুখে এই ঘটনা শুনেছে তাই সে একটু অবাক হলেও ঘটনাটা তার খুব একটা অস্বাভাবিক মনে হলো না। কিন্তু খন্দকার সাহেব বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ভয়ংকর বৃষ্টি শুরু হয়েছে সামনের সবকিছু একেবারে সাদা হয়ে গেছে। সেই সাথে প্রবল ঘূর্ণি বাতাস। মনে হচ্ছে বাতাসের দাপটে গাড়িটা একেবারে উল্টে যাবে। রাস্তার দু পাশ থেকে মরমর করে গাছ আর বাঁশঝাড়ের বাঁশ ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে। মাঝে মাঝে তীব্র বিদ্যুতের ঝলকে চারদিকের বিধ্বংসী রূপ চোখের সামনে যেন ঝলসে ঝলসে উঠছে। সেই সাথে কান ফাটানো বজ্রপাতের শব্দ। খন্দকার সাহেব একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি থামিয়ে দিলেন। কিন্তু হেডলাইটের আলোয় দেখা গেল  এক বিশাল বট বা ওই জাতীয় কোনো গাছ খরকে কাঠির মতো বাতাসে ভেসে আসছে । আর সেটা নিমেষের মধ্যে এসে পড়ল রজতদের গাড়ির ওপর। রজত গার্গীকে আগেই ঠেলে গাড়ির দরজা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। কিন্তু খন্দকার সাহেব গাড়ির ভেতরেই থেকে যান। গাড়ির উপরের অংশ ভেঙে খন্দকার সাহেবের মাথায় পড়ে। তার মাথায় বেশ আঘাত লাগে। গার্গী আর রজত কোনরকমে তাকে গাড়ি থেকে বার করে আনে। তারপর বলে,

-“ভাই আপনি ঠিক আছেন?”

-“জি ভাইসাহেব আমি ঠিক আসি। কিন্তু এই অসময়ে একি দুর্যোগ আইল বলেন তো।”

আকাশ ফাটানো বাজের শব্দ হল। বিশ্ব চরাচর যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তীব্র বিদ্যুতের লকলকে শিখা যেন তীব্র আঘাত হানতে বারবার এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। রজত বলে উঠল,

-“এই রাস্তা ছাড়া আর কোনোভাবে পীরসাহেবের কাছে পৌঁছানো যায় না?”

-“জি যায়। কিন্তু এখন সেভাবে যাওয়া সম্ভব নয়।”

-“কেন সম্ভব নয়?”

-“নদী পথে যাইতে হবে। এই ভয়ানক ঝড়বৃষ্টির মধ্যে যা অসম্ভব।”

-“আমাদের যে করেই হোক পৌঁছতে হবে। যদি টাকা খরচ করি তাহলেও কি যাওয়া যাবে না?”

-“আপনার কি মাথা খারাপ হইয়া গেসে? যদি বেশি টাকা দিয়া কোনো মাঝিরে নৌকা নামাইতে রাজি কইরাও ফেলেন, যা ঝড় চলতাসে নিমেষে নৌকা ডুইবা যাবে। আমরা সকলে জলে ডুইবা মরুম। “

-“দেখা যাবে আপনার তো চিকিৎসার প্রয়োজন। আপনি আমাদের কোথায় নৌকা পাওয়া যাবে দেখিয়ে দিন, আর কাছাকাছি কোনো হসপিটাল আপনার জানা থাকলে সেখানে চলে যান।”

-“জি না। আপনাদের ছাইড়া আমি কোথাও যামু না। আপনারা হলেন গিয়া পীরসাহেবের মেহমান। মেহমানরে একা ছাড়ুম কেমনে? মরতে যদি হয় তো মরুম।”

-“ঠিক আছে আমাদের কোনো মাঝির কাছে নিয়ে চলুন।”

-“রশিদ মিঞা নামের এক মাঝি আসে। আমার চেনা। প্রচন্ড ঝড়েও শুনসি তার নৌকা কখনো ডোবে না।”

রজতরা গেল রশিদ মিঞার কাছে। নদী ঘাটের কাছেই একটা খোড়ো চালের কুটির, রশিদ মিঞার আস্তানা।  শীতকালে ঝড়বৃষ্টি নেই, নদীতে বান ডাকার ভয় নেই তাই বেশ নিশ্চিন্ত হয়েই ছিল সে। কিন্তু হঠাৎ এই ঝড়বৃষ্টিতে রশিদ মিঞা বেশ উদ্বিগ্ন। নদীতে নৌকা নামানোর কথা শুনে প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না । তারপর গার্গী নিজের গলা থেকে মোটা একটা সোনার চেন খুলে দিতে রশিদ মিঞা আর না করল না। সঙ্গে নিল নিজের সব সময়ের সঙ্গী ঝন্টুকে। চোদ্দো – পনেরো বছরের ছেলে। কোনো ব্যাপারে তার কোনো ‘না’ নেই।

নদীতে প্রবল স্রোত। রশিদ মিঞার ইঞ্জ্বীনের নৌকো ছিল। কিন্তু এই প্রবল ঝড় বৃষ্টির মধ্যে একবার ইঞ্জ্বীন বন্ধ হলে আর কিছু করার থাকবে না। তাই সে দাঁড় টানা ছিপ নৌকো নিয়েছে। 

নৌকোর মধ্যে বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল তারা ছোট্ট একটা কলাগাছের কাণ্ডের খোল দিয়ে বানানো নৌকোয় বসে থাকা খুদে পিঁপড়ে। সেই খোলার নৌকো ছাড়া হয়েছে বর্ষার জল জমে তৈরী হওয়া ডোবায়। ডোবার জলে ঝমঝম বৃষ্টির ঝাঁপান ঝাঁপাই চলছে। ছোটদের কাছে সেসব খুব আনন্দের খেলা, মজার ব্যাপার। কিন্তু এই ভরা গাঙে ছোট্ট নৌকা নিয়ে প্রবল স্রোতের মুখে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো মজা বা আনন্দ নেই। উল্টে এই কাজে যেমন মিশে আছে একটা আতঙ্ক, তেমনই একটা দুঃসাহসিকতা। এই নদীর নাম রায়না। এমনিতে খুব শান্ত নদী। কিন্তু এখন কে বলবে এই নদী শান্ত, এর স্রোত দুরন্ত, পার্বত্য তটিনীকেও হার মানাবে। কুপকুপে অন্ধকারের মধ্যে জলের মধ্যে প্রবল ঘূর্ণি চলছে। রশিদ মিঞা আর ঝন্টু সেই ঘূর্ণি বাঁচিয়ে দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলেছে। খন্দকার সাহেব মাথায় নিজের ওভার কোটটা খুলে চেপে ধরে বসে আছেন। সকলকে দেখাচ্ছে  কালো কষ্টি পাথরের মূর্তির মতো। সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ নৌকা পড়ে গেল একটা ঘূর্ণির মধ্যে। তারপর কি যে হল, যেন সব কিছু মাথার মধ্যে সাদা হয়ে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কিছুক্ষন পরে দেখা গেল রজত, গার্গী, এমদাদ খন্দকার আর ঝন্টু জলের মধ্যে খাবি খেতে খেতে উঠে এল। তখন সেই সবে পুব আকাশে ছোপ ছোপ লালচে বেগুনী রঙ লাগতে শুরু করেছে। রজতেরই প্রথম চোখে পড়ল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ। মানুষটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট। দুহাত তুলে, হাত দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অদ্ভুত একটা ভঙ্গী করে চলেছে। এর বেশি কিছু লক্ষ করার আগেই সকলে বুঝতে পারল তারা অদ্ভুত ভাবে জলে ভেসে ভেসে পাড়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। পাড়ে উঠে ঝন্টু একবার সকলের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলে উঠল,

-“খালুজান কোথায় ? খালুজান কী পানি থেকে ওঠে নাই?”

সত্যিই তো তার কথায় সকলে খেয়াল করল রশিদ মিঞাকে তো সেই ঘূর্ণিতে পড়ার পর আর তারা লক্ষ্য করেনি। এদিকে তখন ঝড় বৃষ্টি সব থেমে গেছে। নদীর জল ও শান্ত। একটু আগে যে এই নদী ই ওরকম অশান্ত হয়ে উঠেছিল তা আর বোঝার উপায় নেই। হয়তো রশিদ মিঞা পাড়ের অন্যদিকে উঠেছে। ঝন্টু আর খন্দকার সাহেব এদিক ওদিক ডাকতে থাকে। 

-“খালুজান..”

-“রশিদ মিঞা ও রশিদ মিঞা..”

কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। এদিকে ভিজে জামা কাপড়ের ওপর নদীর ঠান্ডা বাতাস লেগে সকলেই মাঝে মাঝে কাঁপছে। এখন সূর্য বেশ খানিকটা উঠেছে। রজতের দৃষ্টি পড়ল পাখিদের কর্মকাণ্ডের ওপর। পাখিরা মাছ ধরায় ব্যস্ত। দুটা মাছরাঙা দেখা যাচ্ছে। মাছরাঙার প্রধান খাদ্য মাছ। তবে তারা মাছ ধরায় আগ্রহী না। তারা বাঁশের খুঁটিতে পাশাপাশি বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপর একজন আরেক জনকে দেখছে। মাছরাঙা যে এত সুন্দর পাখি তা আগে বোধহয় কেউ এতো ভালো করে লক্ষ করেননি। এই সদ্য উদিত সূর্যের নরম আলোয় হয়তো সব কিছু এতো অন্য রকম লাগছে। জায়গাটা নিৰ্জন। নদীর পাড় ধরে এখন লোক চলাচল নেই । রজত দেখল সামনে এক ব্যক্তি এগিয়ে আসছেন। ভদ্রলোক বেশ মোটাসোটা, সাদা পাগড়ি, সাদা পাজামা ও ফতুয়ার উপর কালো জহর কোর্ট। তিনি আরও কাছে আসতে রজত বুঝতে পারল আরে ইনি তো হুজুরে এ কেবলা নিজামত আজমল আতাপি। ভদ্রলোককে রজত শেষ যখন দেখেছিল তখন তার চেহারা এতটা ভারী ছিল না। আর পরনে থাকতো সাহেবি পোশাক। মুখের এই লম্বা সাদা দাড়ি গোঁফের জঙ্গলও ছিল না। মানুষটার বয়স যেন এই পাঁচ বছরে চোদ্দো পনেরো বছর বেড়ে গেছে। রজত কিছুক্ষন তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে তারপর ইসলামিক নিয়মে কদমপুশি করল। কিন্তু আর কিছু বলার আগেই ঝন্টু উদ্বিগ্ন গলায় আবার বলে উঠল, 

-“আমার খালুজান কোথায় গেল ? “

পীরসাহেব বলে উঠলেন,

-“কার কথা বলছ বাবা?”

পীরসাহেবকে, এমদাদ খন্দকার প্রথম সবার সামনে কথা বলতে দেখে বেশ অবাক হলো।

ঝন্টু সামনে এগিয়ে এসে বলল,

-“আমার খালুজানরে তো কোথাও দেকতাসি না?দাঁড় ফেইলা তো আমরা একসাথেই জলে নাইমাসিলাম। সকলেই উইঠা আইসে, তিনি কোথায় গেলেন?”

পীরসাহেব হতাশায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-“আবার , আবার আমার ভুলের জন্য একটা নির্দোষ প্রাণ গেল।”

ঝন্টু বলে উঠল,

-“প্রাণ গেল মানে! আমার খালুজান বাইচা নাই?”

তারপর সে খালুজান.. খালুজান বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল।

পীরসাহেব কোরানের সূরা পাঠ করলেন। খন্দকার সাহেব বললেন,

-“নদীতে জাল ফেলানীর ব্যবস্থা করতে হইব। যদি লাশটার খোঁজ মেলে।

ঠিক সেই সময়েই জলের মধ্যে প্রচন্ড একটা ঘূর্ণি ওঠে। আর সেই ঘূর্ণির মধ্যে ভেসে ওঠে একটা মানুষ। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো একটা ঢেউ উঠে মানুষটাকে পাড়ে ছুঁড়ে ফেলল। সামনে গিয়ে সবাই দেখল ঢেউয়ের সাথে যেটা উঠে এসেছে সেটা রশিদ মিঞার মৃতদেহ। গায়ের চামড়া কিরকম ঘাসের মতো ফ্যাকাসে, সাদা হয়ে গেছে। চোখগুলো ঠেলে বেড়িয়ে এসেছে। মুখটা হাঁ করা। জল খেয়ে পেটটা ফুলে গেছে। হঠাৎ একটা অদ্ভুদ কান্ড ঘটল সেই অবস্থাতেই মৃতদেহটা ধীরে ধীরে উঠে বসল। তারপর বসা অবস্থা থেকেই শূন্যে উঠে দাঁড়াল। সেই উড়ন্ত দেহটা সামনের একটা বিশাল বট গাছের চারদিকে পাক দিতে শুরু করল। মৃতদেহের ভেতর থেকে এক অস্বাভাবিক ফ্যাসফ্যাসে অট্টহাসির শব্দ ভেসে এল। সেরকম গলাতেই হাঁসির পর শোনা গেল কিছু কথা,

-“কি প্রফেসর সাহেব নিজে পারলেন না এবার এসসেন

এই বুড়া পীররে কাজে লাগাইতে? করেন করেন চেষ্টা করেন। দেখি আপনের দৌড় কতদূর। কিন্তু মনে রাখবেন এতে আমি কিন্তু আরও অসন্তুষ্ট হইলাম। ফল কিন্তু ভালো হইব না। “

এরপর মৃতদেহটির মাথা পুরো একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল অর্থাৎ মাথাটা ঠিক পিঠের ওপর। সেই অবস্থাতে সে পীরসাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“এই যে বুড়া তুমি আয়তুল কুরসি পড়বে এবার তাইতো? তোমার ছাত্ররে জিগাও এই কাম কইরা তার কি অবস্থা হয়েসিল। আমারে তাড়াইতে হইব না এখন আমি নিজেই চইলা যামু। কিন্তু বিদেশে তুমি যে ভুলের জন্য নিজের পোলারে আর ইস্ত্রিরে হারাইসো সেই ভুল দ্বিতীয়বার কইরো না। তাহলে এই মানুষটা তো গেছেই এরপর তোমার আশপাশ আর যারা আসে তারা সকলে এই জ্বীন কফিলের হাতেই মরব।”

আবার একটা হা হা করে ভয়ংকর অট্টহাসি আর মৃতদেহটা তারপর ধপ করে গাছতলায় পড়ে গেল।

পীরসাহেব আর রজত শুদ্ধু বাকি সবাই এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে এইসব কান্ডকারখানা দেখছিল । তাদের অবস্থা অনেকটা সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখা মানুষের মতো। বুকে আছে ভয় অথচ চোখে বিস্ময়। মানুষের যে শব্দ করে কথা বলার ক্ষমতা আছে তাও তারা যেন ভুলে গেছিল।

পীরসাহেবই প্রথম কথা বললেন এরপর। 

-“এমদাদ সাহেব মৃতদেহটা কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

-“জি ।”

বেশি কথা বলা এমদাদ সাহেবের মুখ থেকেও আর কোনো কথা বেরোচ্ছে না।

এরপর সারাদিন কেটে গেল রশিদ মিঞার সৎকার, তার আত্মীয়দের খবর দেওয়া আরও নানারকম কাজে। ঝন্টুর বাবা মা এসে তাকে নিয়ে গেল। ঝন্টুর মা ছিল রশিদ মিঞার এক মাত্র বোন। বোনের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় বনপোকে রশিদ নিজের কাছে রেখেছিল। এমদাদ খন্দকার ঘোষণা করলেন এবার থেকে ঝন্টুর সমস্ত খরচ তিনি নিজে যোগাবেন। ঝন্টুর বাবার একটা এক্সিডেন্ট দুটো হাত কাটা পড়েছিল। খন্দকার সাহেব তাদের দু লাখ টাকা দিলেন  সংসার চালানোর জন্য। মানুষটাকে প্রথমে যতটা আত্মসর্বস্ব মনে হয়েছিল, এই কাজের জন্য সব ধারণা একবারেই উল্টে গেল। 

রজত আর গার্গীর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা এমদাদ সাহেবই করলেন। 

আসরের নামাজের পর রজত, পীরসাহেবকে সমস্ত ঘটনা জানাল। পীরসাহেব খুব কম কথার মানুষ। সেই সকালের পর থেকে তিনি কোনো কথাই বলেননি রজতের সঙ্গে। রজতের মুখে সব শুনে তিনি বললেন,

-“সব শুনলাম বাবা। কিন্তু তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?”

-“সব কিছু শোনার পরেও আপনি জিজ্ঞেস করছেন? “

-“হ্যাঁ করছি। তুমি তো জানো আমার অবস্থা । আজ সকালের ঘটনার পরেও তোমার মনে হয় আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব?”

-“হ্যাঁ আজকের সকালের ঘটনার পরেই বলছি আপনিই পারবেন। আচ্ছা স্যার আপনি আমাদের না বাঁচলে এখন কি আমরা এখানে থাকতাম বলুন তো? “

-“কিন্তু নৌকার মাঝি রশিদ মিঞা?”

-“এতো বড়ো শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ ছিল না। এখন তো একজনের প্রাণ গেছে, আপনি কিছু না করলে কতোগুলো নিষ্পাপ প্রাণ যে হারিয়ে যাবে তার ঠিক নেই।”

-“তাও ঠিক ।”

-“তাহলে আপনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন তো?”

-“হ্যাঁ যাব। তার..”

পীরসাহেব কথা শেষ করার আগেই রজত বলল,

-“আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাহলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের ফ্লাইট ছিল কাল সন্ধ্যেবেলা। তার আগে যদি কোনোভাবে ব্যবস্থা করা যায়..”

-“রজত, তার আগে আমার কিছু কথা শোনো।”

-“হ্যাঁ বলুন।”

-“তোমরা এখানে আসার সময় যে বিপদে পড়েছিল সেরকম আবার হতে পারে। সেটা যাতে না হয় তার জন্য আমি কিছু ব্যবস্থা করতে চাই। “

-“কী ব্যবস্থা?”

-“দেখতে থাকো।”

পীরসাহেবের মুখে যেন একটা আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক খেলা করে গেল। নিজের সন্তানতুল্য শিষ্যকে পেয়েই কি আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে পীরসাহেবের? কথাটা নিজের মনেই চিন্তা করছিল রজত। পীরসাহেব নিজেই তাকে তাড়া দিয়ে বললেন,

-” তুমি আর গার্গী মা দুজনেই অজু করে শুদ্ধ

 জামাকাপড় পড়ে এসো। আমার অজু করা আছে। এরপর আমরা পাশের ঘরে যাব।”

পীরসাহেবের পুরনো পৈত্রিক বাড়িটা বিশাল। দোতলা বাড়িতে সব মিলিয়ে পঞ্চাশটা ঘর আছে। ওপরের তলায় বারান্দার মতো প্যাসেজ। প্যাসেজের ধারে ধারে যতগুলো ঘর আছে, তার একটাতে পীরসাহেব থাকেন। আর বাকি সব বন্ধ। যে ঘরে পীরসাহেব থাকেন তার পাশের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি একটা মোমবাতি জালালেন। সেটা রজতকে ধরতে দিয়ে ঘরের তালা খুললেন। দরজা খুলতেই এক অদ্ভুত চমক। মোমবাতির আলোয় ঘরটা থেকে যেন হীরক দুত্যির মতো আলো ঠিকরে বেরতে লাগল। চোখ ধাঁধানো আলো একটু চোখে সয়ে আসতেই রজত আর গার্গী শুনতে পেল পীরসাহেব ঘরের ভিতর থেকে ডাকছেন। তারা ঘরে ঢুকে আবার থমকালো। গোটা ঘরে দেওয়াল, মেঝে জুড়ে শুধু আয়না লাগানো আছে। আয়নাগুলো এমনভাবে লাগানো যাতে প্রতিবিম্ব একে অপরের উপর পড়ে অজস্র প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করছে। ফলে একটা শরীরের উপর আর একটা শরীরের প্রতিবিম্ব, এইভাবে অজস্র শরীর,অজস্র প্রতিবিম্ব মাথায় এক অদ্ভুত ইলুশান তৈরী করেছে। এবার পীরসাহেব আবার কথা বলে উঠলেন। গলার স্বর না শুনতে পেলে আসল মানুষটার অবস্থান নির্ণয় এই ঘরে অসম্ভব।

-“আমার দাদাজান এই ঘর তৈরি করেছিলেন পরী সাধনার জন্য। আমি এখন মৈমুনী পরীকে আহ্বান করব আমাদের সাহায্যের জন্য। তোমরা বসো এখানে।”

সকলে সেই কাঁচের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। পীরসাহেব মোমবাতিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন। তারপর বিড়বিড় করে কোনো এক অজানা মন্ত্রের উচ্চারন শোনা যেতে লাগল। পীরসাহেবের হাতে তসবী মালা। ক্রমে ক্রমে পীরসাহেবের মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে কতো সময় যে কেটে গেল। গোটা ঘরটায় হঠাৎ যেন কোথা থেকে অদ্ভুত একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। ধুনো, কর্পূর, জুঁই, বেল, আরো নানারকম ফুলের সুবাস একসঙ্গে মেশালে যেরকম গন্ধ হতে পারে কিছুটা সেই ধরনের গন্ধ। পীরসাহেব মোমবাতিটা সামনেই একটা বাতিদানে রেখেছিলেন। সেটা নেভানই ছিল, হঠাৎ সেটা নীল শিখায় জ্বলে উঠল। আর সেই বাতির নীল শিখার আগুন থেকে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া বেরিয়ে গোটা ঘরটাকে ভরিয়ে ফেলল। সেই ধোঁয়া যেন একটা মনুষ্য শরীর ধারন করে নারী কণ্ঠে খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করল। সেই সুগন্ধ আর সুমিষ্ট হাঁসির শব্দ মনকে যেন কোনো কল্পলোকের মায়াজালে জড়িয়ে অতল অন্ধকারের বুকে ডুবিয়ে দেয়। সেই ঘোর ঘোর ভাব , মায়াজালের বাঁধন ছিঁড়ে দেয় চোখ ধাঁধানো একটা হিরকদ্যুত্যি। কুন্ডলিকৃত ধোঁয়া এখন জড়ো হয়ে এক দীপ্তিময় নারীমূর্তিতে পরিণত হয়েছে। ঘরের প্রতিটা আয়নায় তার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। কি তার রূপ, চন্দ্রকলার মতো কপাল, হরিণীর মতো চোখ, সেই নীল চোখের তারায় যেন আগুন ঝরছে। মানানসই নাক, আর ঠোঁট যেন সিঁদুর মাখানো। ঠোঁটে হালকা হাঁসির ছোঁয়া। পূর্ণ দৃষ্টিতে সেই নারী, পীরসাহেব ও রজতদের তাকিয়ে যেন অভয় দান করল। তারপর বীণার ঝঙ্কারের সুরে বলে উঠল

-“আসালামালিকুম জনাব।”

পীরসাহেব বললেন,

-“মালিকুম আসলাম পরীজাদি। তোমাকে বিশেষ কিছু প্রয়োজনে আমরা ডাকতে বাধ্য হয়েছি । জাদুকর জ্বীন গাইলান আর তার পুত্র জ্বীন কফিলের অত্যাচারে খুদাতালার আদমজাত বান্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে..”

-“কি বললেন জনাব? গাইলান জ্বীন ! তাকে শাহজাদী নীলোৎফার বন্দী করে রেখেছিলেন। সে আবার কোনোভাবে পালিয়ে যায়। তখন থেকেই আমরা তাকে খুঁজছিলাম। এবার বুঝতে পারলাম সে আদম জাতদের দুনিয়ায় আছে । সে ঠিক কি কি করেছে আমাকে বলুন জনাব । “

-“সেটা এই আমার সঙ্গী রজত ভালো বলতে পারবে।”

রজতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় পীরসাহেব ডাক দিলেন 

-“রজত।”

রজত এতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে মৈমুনী পরীর দিকে তাকিয়ে ছিল। মৈমুনী পরীর পোশাক আর শরীরের হীরক দুত্যিতে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল। পীরসাহেবের ডাকে যেন তার সম্বিত ফিরল। আর তারপরেই সে যেন কিছুটা ভাবলেশহীন ভাবে বাচ্ছাদের মুখস্থ, পড়া বলার মতো গড়গড় করে সব ঘটনা বলে গেল। গার্গী এতক্ষন সবকিছু দেখছিল, আর রজতের অবস্থাও ভালো করে বুঝতে পারছিল। সে এবার রজতকে কনুইয়ের একটা গুঁতো দিয়ে বলল,

-“ওই ঠিক আছো!”

গার্গীর খোঁচা খেয়ে রজত এতক্ষনে স্বাভাবিক হলো। এদিকে পরী , পীরসাহেবকে বলছে,

-“যা শুনলাম তাতে মনে হচ্ছে এ শুধুই গাইলান আর তার এক ছেলের কাজ নয়। সে যে শুধু ইনসানী দুনিয়া দখল করতে চায় তা নয়। সে এমন শক্তি সঞ্চয় করছে যাতে আমাদের থেকেও বদলা নিতে পারে। ইনসানী দুনিয়ায় আমরা নিজেদের ইচ্ছে মতো ঘোরাফেরা করতে পারি না। তাই গাইলানের কাছে আমাদের পৌঁছাতে হলে আপনাদের সাহায্য লাগবে। তবে আপনারা যাতে নির্বিঘ্নে গাইলানের কাছে পৌঁছতে পারেন, সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। তবে এর থেকে বেশী কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই।”

পীরসাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন,

-“তারপর কি হবে? গাইলন জ্বীনের সাথে আমরা মোকাবিলা করব কিভাবে?”

-“সে ব্যবস্থাও আমি করব।”

এই বলে মৈমুনী পরী তার হীরকখচিত দেহভাগ থেকে যেন একটি অংশ নিয়ে পীরসাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। পীরসাহেব জিনিসটা হাতে নিতে দেখা গেল সেটা একটা বহুমূল্য রত্নখচিত, সুন্দর কারুকার্য করা  আয়না। মৈমুনী পরী আবার বলতে শুরু করল,

-“এই আয়নার সাহায্যে যে কোনো জায়গায় যে কোনো অবস্থায় পরীদের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব। তোমরা যখন গাইলান আর তার সন্তানদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে নামবে তখন শাহজাদী নীলোৎফারকে স্মরণ করো। “

পীরসাহেব মাথা নিচু করে বললেন

-“অবশ্যই পরীজাদি।”

-“এবার তাহলে আমি আসি। “

মৈমুনী পরী চলে যাবার পর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রজতরা ইন্ডিয়ায় ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দেয়।

প্রায় নির্বিঘ্নেই তারা ইন্ডিয়ায় পৌঁছায়। পথের ইতিহাস বর্ণনা অপ্রয়োজনীয়। 

(৫)

কলকাতায় পৌঁছেই রজতরা ছুটল সুদীপদাদের বাড়িতে। কফিল জ্বীন তাদের সাতদিন সময় দিয়েছিল। সেই সময় শেষ হতে আর একটা রাত বাকি আছে। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল তখনও সব কিছু স্বাভাবিক আছে। তবে দুর্যোগের কালো মেঘ ছেয়ে ফেলেছে সুদীপদার বাড়ির উপরের আকাশ। রজতরা এসে পৌঁছেছিল ঠিক সূর্য ডোবার পরেই। পীরসাহেব সেখানে পৌঁছেই বাড়ির চারদিকে পবিত্র নুন ছড়িয়ে দিলেন। তারপর তওবা, তাসবীহ পাঠ শুরু করলেন। সেই সময়েই ঝড় শুরু হল। পীরসাহেব সূরাপাঠ শুরু করলেন। কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের তাণ্ডব বাড়তে লাগল, আর বাড়তে লাগল হিমেল হাওয়ার পরশ। চারপাশের আবহাওয়া উতরত্তর এতটা ঠান্ডা হয়ে গেল যে মনে হল তা হিমাঙ্কের নীচে পৌঁছে গেছে। শীতকাল হলেও খাস কলকাতার বুকে এত ঠান্ডা একেবারেই অসম্ভব। একমাত্র পীরসাহেব ছাড়া সকলেই যেখান থেকে যা শীতবস্ত্র পেল গায়ে জড়িয়ে নিল। সেই সময়েই হঠাৎ করকর শব্দে বাজ পড়ল। আর সাথে সাথেই নিভে গেল বাড়ির সমস্ত আলো। পীরসাহেবের সামনে থাকা মোমবাতির নীল আলোক শিখা ছাড়া চারদিকে আর কোনো আলো নেই। তাতেই একটা দৃশ্য দেখে সকলে যেন নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। মোমবাতির সামনে পীরসাহেবের উল্টোদিকে বসে আছে মৌমিতা, আর তার গায়ে জড়ানো অভিশপ্ত লাল কম্বল। আর সেই সাথে তার মুখে অদ্ভুত একটা হাঁসি। মৌমিতার মা বলে উঠল,

-“তুই তো আমার পুরোনো শালটা গায়ে দিয়েছিলি। তাহলে তোর গায়ে এটা এল কীকরে?”

রজতও খেয়াল করল, মৌমিতার মা তো ঠিকই বলছেন। কয়েক সেকেন্ড আগেও সে লক্ষ্য করেছিল মৌমিতার গায়ে অন্য একটা চাদর ছিল। কিন্তু সেটা বদলে এখন লাল কম্বল হয়ে গেছে। কফিল জ্বীনই এই মায়ার সৃষ্টি করেছে। সুদীপদা মৌমিতার কাছে পৌঁছে গায়ের কম্বলটা খুলে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যা হল তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। কম্বল স্পর্শ করা মাত্র সুদীপদার হাতে আগুন জ্বলে উঠল। সেই আগুন নিমেষের মধ্যে তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। সকলে সুদীপদাকে বাঁচাতে নিজেদের জায়গা ছেড়ে উঠতে উদ্যত হল। কিন্তু মনে হলো কালো কাপড়ে ঢাকা বিশালদেহী কিছু মানুষ সকলকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরেছে। এমন কি সকলের মুখও এমন ভাবে তারা জড়িয়ে রেখেছে যে কেউ একটা শব্দও বার করতে পারছে না। শাহজাদী নীলোৎফারকে আয়নার সাহায্যে ডাকার জন্য বিশেষ মন্ত্রচ্চারণ করা প্রয়োজন, সেটাও পীরসাহেব করতে পারছেন না । এদিকে মৌমিতা তখন মেঝের ওপর পরে আছে । তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা লাল কম্বল। সেই কম্বলের মধ্যে মৌমিতা ছাড়াও আরও কোনো অশরীরী দেহের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। কম্বলের মধ্যে ক্রমাগত চলছে সেই অশরীরী শরীরের ওঠা নামা। মৌমিতার গলা থেকে শোনা যাচ্ছে কান ফাটানো শীৎকার ধ্বনি । কতটা সময় যে এইভাবে কেটে গেল তা যেন আর কারোর খেয়ালই রইল না। এদিকে রজতের পাশেই রাখা ছিল সুগন্ধি পবিত্র মোমবাতি। সে অনেকক্ষণ ধরে সেটা হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। একসময় তাকে ধরে রাখা অশরীরীকে এক ঝটকা দিয়ে সে নিজেকে একটু আলগা করে নিল। তারপর মোমবাতিটা খপ করে ধরে ফেলল। আর পেয়েই সেটা সে সুদীপদার জ্বলন্ত দেহের ওপর ছুঁড়ে ফেলল। আর সাথে সাথেই মোমবাতির পবিত্র সুগন্ধ চারদিক ছেয়ে গেল। সেই সাথে সকলের শরীরের ওপর থেকে অশরীরীদের বাঁধন যেন ছিন্ন হয়ে গেল। দ্রুত তৎপরতায় পীরসাহেব মৈমুনী পরীর দেওয়া আয়না হাতে তুলে নিলেন এবং সূরা পাঠ শুরু করলেন। 

তখনই মৌমিতার অচেতন শরীরের ওপর অশরীরী ওঠা নামা থেমে গেল। আর পাশে পড়ে থাকা সুদীপদার জ্বলন্ত দেহটা উঠে দাঁড়াল। শুরু হল অদ্ভুত ভয়ংকর স্বরে অট্টহাসি। সেই জ্বলন্ত দেহ থেকে এক অদ্ভুত খ্যানখ্যানে কণ্ঠ বলে উঠল,

-“কি পীরসাহেব বাঁচাতে পারলে না তো?”

তারপর আবার সেই অট্টহাসি।

ঠিক সেই সময় আয়না থেকে নীলচে বেগুনি একটা আঁকাবাঁকা চোখ ঝলসানো সরলরেখা যেন চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল । আর শোনা গেল কান ফাটানো বাজের শব্দ। ধীরে ধীরে সেই বিদ্যুৎরেখা রূপান্তরিত হল এক মানব শরীরে। নীলোৎফার পরী। তার রূপ মৈমুনী পরির মতোই। কিন্তু শরীর ও পোশাকের রং উজ্জ্বল নীলাভ, যেন নীল হীরের দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে সারা শরীর থেকে। নীলোৎফার পরী এসে দাঁড়াতেই সুদীপদার জ্বলন্ত দেহটা ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। আর সাথে সাথে গোটা বাড়িটা যেন প্রবল ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল। নীলোৎফার পরী সেই কম্পন থামিয়ে দিলেন। তারপর এক ফুঁতকারে সুদীপদার শরীরের আগুন নিভিয়ে ফেললেন। সকলে তখন সুদীপদার কাছে এগিয়ে গেল। তার দেহে তখন আর প্রাণ নেই। সুদীপদার স্ত্রী সেটা জানতে পেরেই সেখানেই অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। নীলোৎফার পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে বলে উঠল,

-“এখন ভেঙে পড়ার সময় নয়, সামনে অনেক কাজ বাকি আছে। “

পীরসাহেব বললেন,

-“আর কি বাকি আছে সব তো শেষ।”

-“শেষ নয় । এটা নতুন শুরু । গাইলান আর তার সমস্ত বংশধরদের শেষ করতে হবে। “

এবার রজত সপ্রতিভ হয়ে বলে উঠল ,

-“কি ভাবে হবে ? আমরা এবার কি করব?”

নীলোৎফারের মুখে ঈষৎ হাঁসির ভাঁজ, সে বলল,

-“কফিল খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। আমার হাত থেকে বাঁচার জন্য সে পালিয়েছে। কিন্তু তার বীজ সে রেখে গেছে মৌমিতার গর্ভে। আগামী এক মাসের মধ্যে কফিলের বংশধরের জন্ম হবে। আর সেই উত্তরসূরি আমদের সন্ধান দেবে গাইলানের সব বংশধরদের। “

গার্গী তখন বলে উঠল,

-“এক মাসের মধ্যে জন্ম নেবে মানে?”

গার্গীর প্রশ্নের উত্তরে রজত বলল,

-“জ্বীনের সন্তানদের জন্মাতে মানুষের মতো দশ মাস সময় লাগে না। তারা জন্মায় এক মাসের মধ্যে। আর তাদের মায়ের সাথে কোনো নাড়ির সংযোগ থাকে না।”

নিলোৎফর বলল,

-“হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ। জ্বীনদের সন্তানদের বড়ো হতেও সময় লাগে খুব কম। আর তাদের সকলের মধ্যে থাকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকার ক্ষমতা। একজন জ্বীনকে ধরতে পারলেই তার সকল পিতৃপুরুষের সন্ধান পাওয়া যাবে। আর সাধনা ছাড়া সহজেই একজন জ্বীনকে হাতের মধ্যে পাওয়ার উপায় একটাই। তাকে শিশুকালেই ধরে ফেলা।”

পীরসাহেব বললেন,

-“মৌমিতার সন্তান আমাদের গাইলান আর তার সমস্ত বংশধরদের সন্ধান দেবে। 

কিন্তু পরীজাদি কফিল জ্বীনের মায়া তো আজ আমরা চোখের সামনেই দেখলাম। এতো সুরক্ষাব্যবস্থা রাখার পরেও সে এমন মায়াজাল সৃষ্টি করবে কে জানতো। মৌমিতা নিজেই ওই লাল কম্বল নিজের গায়ে জড়াল।”

নীলোৎফার বলল,

-“মৌমিতাকে আমাদের কোথাও লুকিয়ে ফেলতে হবে। আর তাকে রাখতে হবে সুপ্ত অবস্থায় যাতে কফিল জ্বীন তার কোনো সন্ধান না জানতে পারে।”

গার্গী অবাক হয়ে বলল,

-“সুপ্ত অবস্থায় মানে?”

-“মানে শীতকালে বহু পশুপাখি যেমন ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে সেরকম অবস্থায় থাকলে মৌমিতাকে আর জ্বীনেরা খুঁজে পাবে না। একমাস পর সন্তান প্রসব হলে মৌমিতা আবার জেগে উঠবে। আর তার সন্তান থাকবে আমাদের কাছে। আমরা পরীরা তার থেকেই সকল জ্বীনদের সন্ধান পাব।  “

-“আচ্ছা তার মানে কোমায় থাকার মতো অবস্থা। কিন্তু সেটা কিভাবে হবে? মৌমিতার তো এখনই জ্ঞান ফিরে আসছে।”

তখন সকলের চোখ গিয়ে পড়ল মৌমিতার উপর । তার শরীরে খুব ধীরে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। নীলোৎফার তাড়াতাড়ি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, আর সাথে সাথেই মৌমিতা শান্ত হয়ে এল। নীলোৎফার বলল,

-“আমি এমন ব্যবস্থা করলাম যাতে আগামী এক মাস মৌমিতা এই অবস্থাতেই থাকে। কিন্তু ওকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে। একমাস পর ওর সন্তান ভূমিষ্ট হলে আমি তাকে নিয়ে যাব। তোমাদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনোভাবে অচেনা কেউ মৌমিতার কাছে আসতে না পারে। “

গার্গী বলল,

-“বেশ সেই ব্যবস্থা আমি করব। আমার দাদার নার্সিংহোমে মৌমিতাকে রাখা যেতে পারে । “

নীলোৎফার পীরসাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“আমি আমার কিছু মায়াবী সেনা আপনার কাছে পাঠাবো আতাপি সাহেব। আপনি তাদের মৌমিতার চারদিকে পাহারার জন্য মোতায়েন করবেন। ইনশা আল্লাহ মৌমিতার সন্তান আমাদের সব সমস্যার সমাধান করবে।”

পীরসাহেব বলে উঠলেন,

-“আমিন।”

সকলেই বলে উঠল,

-“আমিন।”

নীলোৎফার পরী বলল,

-“এবার তবে আমি আসি। খুদা হাফিজ।”

এরপরেই নীলোৎফার পরী একটা নীলচে বেগুণী বিদ্যুৎ শিখায় রূপান্তরিত হল। 

তারপর সেই বিদ্যুৎ শিখা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ।

(৬)

এরপরের ঘটনা নীলোৎফার পরীর কথা মতোই এগোলো। মৌমিতাকে রাখা হয়েছে গার্গীর দাদা গৌরবের নার্সিংহোমে। গার্গী নিজেই তার দেখাশোনা করছে। সুদীপদাকে বাঁচানো যায়নি। তার শরীর সম্পূর্ণ ভাবে পুড়ে গেছিল। মৌমিতার মাও এখন একটা মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি আছেন। সেইদিনের সেই ঘটনার আঘাত তিনি নিতে পারেননি। আতাপি পীর এই একমাসের জন্য এখন রজতদের অতিথি। এদিকে মৌমিতা নামের মেয়েদের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজ, নিউজ চ্যানেলে দুটি তিনটি করে ঘটনার বর্ণনা শোনা যাচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ওড়িশা, বিহারসহ বাংলাদেশের পুলিশ, প্রশাসনের নাজেহাল অবস্থা। রাস্তায় প্রতিদিন এই নিয়ে মিটিং, মিছিল। রজত আর পীরসাহেব যাকে বলে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছেন। তাদের এই একটা মাস অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। ধীরে ধীরে একমাস সময় পার হয়ে আসে। গার্গী, রজতকে ফোন করে জানায়, আর এক দুদিনের মধ্যেই মৌমিতা সন্তানের জন্ম দেবে। 

খবর পেয়েই পীরসাহেব নিজে নার্সিংহোমে হাজির হলেন। তারপর মৌমিতার রুমের বাইরে কলমা পড়া শুরু করলেন। জোহরের নামাজ আদা করার পরেই মৌমিতার প্রসব বেদনা শুরু হয় । পীরসাহেব নীলোৎফার পরীকে আহ্বান করলেন। নীলৎফার ডাক্তারের ছদ্মবেশে সেখানে উপস্থিত হল। সে আর গার্গী দুজনে মিলে মৌমিতার প্রসব করাল।

এদিকে রজত আর পীরসাহেব যখন বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তখন হঠাৎ মৌমিতার মা তাদের কাছে ছুটে এল। আর বলতে লাগল,

-“আমার মেয়ে কোথায়? একবার তাকে দেখব। তার নাকি সন্তান হবে? আমাকে একবার তার কাছে যেতে দিন।”

রজত বলল,

-“আচ্ছা বেশ আপনি চলুন আমার সঙ্গে।”

সেই সময়েই গার্গী আর নীলোৎফার বাইরে এল। নীলৎফার জানাল,

-“মৌমিতার প্রসব সম্পূর্ন হয়েছে। তার জ্বীন সন্তানের নাম মুগাবালি। “

রজত তখন ব্যস্ত হয়ে বলল,

-“মৌমিতার মা তার সাথে একটু দেখা করতে চায়।”

-“বেশ । আমি মৌমিতা আর তার সন্তানকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আর তো তাকে কখনও দেখতে পাবেন না । শেষবারের মতো মেয়েকে দেখে নিন।”

মৌমিতার মা মৌমিতার ঘরে ঢুকল। আর সেই সময়েই রজতের একটা কথা মাথায় এল , সে বলে উঠল,

-“কিন্তু মৌমিতার মা এখানকার ঠিকানা জানল কি করে? আর মৌমিতা যে এই নার্সিংহোম আছে সেটাও তো ওর জানার কথা নয়।”

গার্গী বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

-“আর মিস সাহার যা মেন্টাল কন্ডিশন ছিল তাতে এখানে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না।”

নীলৎফার বলে উঠল,

-“তাহলে ওটা কি মৌমিতার মা নয়?”

রজত বলল, 

-“এক মিনিট।”

তারপরেই মেন্টাল হসপিটালে ফোন করল।

কথা বলে সে জানাল, 

-“মিসেস সাহা তো সেখানেই আছেন।”

নীলোৎফার সঙ্গে সঙ্গে মৌমিতার রুমের দিকে ছুটল। তার পিছনে রজত, গার্গী , পীরসাহেব।

দরজাটা খুলতেই দেখা গেল অদ্ভূত দৃশ্য মৌমিতার শরীরটা গলা পর্যন্ত অদৃশ্য। আর যেটুকু বাকি আছে তার ওপরে চাপা দেওয়া একটা লাল কম্বল। মৌমিতার বিছানার দিকে মাথা নিচু করে এক আপাদমস্তক কালো কাপড় পড়া মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। সে মুখে অজানা ভাষায় কি যেন মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। আমরা ঘরে ঢুকতেই সেই মহিলা আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাল। সে এক বিভৎস চেহারা, সমস্ত মুখের চামড়া যেন কেউ কুড়ে কুড়ে তুলে দিয়েছে। দগদগে মুখে অসম্ভব দুটি লাল মণিহীন চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলোৎফার বলে উঠল,

-” এ তো জ্বীন্নাতুন।”

 তৎক্ষণাৎ নীলোৎফার তার দিকে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিল। কিন্তু সেই জল গায়ে লাগার আগেই জ্বীন্নাতুন মৌমিতার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে লাফিয়ে দেওয়ালে উঠল। তারপর দেওয়াল বেয়ে অদ্ভুদ ক্ষিপ্র গতিতে সে বেরিয়ে গেল জানলা দিয়ে। নীলৎফারও চোখের নিমেষে দেওয়ালে উঠে গেল। আর জ্বীন্নাতুনের মতো সেও দেওয়াল বেয়ে ক্ষিপ্র গতিতে তার পিছনে ধাওয়া করল। রজত এবার রুম থেকে বেরিয়ে একদিকের লিফটে উঠে ছাদে ওঠার জন্য বোতাম টিপল। ছাদে উঠে লিফট থেকে বেরিয়েই সে ছুটল ছাদের পাঁচিলের দিকে ।

পাঁচিলের ধারে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখল সেই ভয়ংকর মহিলা তিন হাত পায়ে দেওয়াল বেয়ে উঠে আসছে। আর তার এক হাত দিয়ে বুকের কাছে শক্ত করে জড়িয়ে রাখা মৌমিতার সন্তান মুগবালি। রজতের হাতে ছিল তসবি করার মালা। সেটাই সে জ্বীন্নাতুনের দিকে ছুঁড়ে দিল। কিন্তু সেটা গিয়ে পড়ল মুগাবালীর গলায়। আর জ্বীন্নাতুন সাথে সাথে ছেড়ে দিল সেই শিশুকে। নীলৎফার নিচ থেকে শিশুটিকে ধরে ফেলল। কিন্তু তারপর জ্বীন্নাতুনকে ধাওয়া করতে যাওয়ার আগেই সে লাফ দিয়ে পড়ে নার্সিংহোম চত্বরে। সেখানে আউটডোরে চিকিৎসা করানোর জন্য বহু রোগীর ভীড়। নীলৎফারও সেখানে ঝাঁপ দিয়ে নামে। কিন্তু ততক্ষণে নিজের রূপ বদলে জ্বীন্নাতুন ভীড়ের সাথে মিশে গেছে। তাকে খুঁজে না পেয়ে নীলোৎফার মৌমিতার রুমের সামনে ফিরে আসে। এদিকে রজতও সেখানে হাজির হয়েছে। নীলোৎফার সেখানে ফিরে এসে দেখল, রজত মৌমিতার খালি বেডের দিকে তাকিয়ে মেঝের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। পীরসাহেব দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর গার্গী হতভম্ভ হয়ে মৌমিতার বিছানার ওপরেই বসে আছে। নীলোৎফার জিজ্ঞেস করল,

-“কী হলো ? তাহলে কি মৌমিতা!”

পীরসাহেব বলে উঠলেন,

-“রজত বেরিয়ে গিয়ে লিফটে উঠতেই আমরাও পাশের লিফটে উঠে যাই। আমি আর গার্গী মা যখন সেকেন্ড ফ্লোরে পৌঁছেছি তখন আমার মনে হয় আমাদের মৌমিতার কাছে থাকা উচিত। আমি আবার নীচে যাওয়ার জন্য বোতাম টিপলাম। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে লিফট আর তখন কাজ করছে না। আমরা না লিফট থেকে বেরোতে পারছি, না নীচে যেতে পারছি। তবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই লিফট আবার নিচে নামল । এখানে এসে দেখি মৌমিতার মাথার দিকে একটু খানি অংশ শুধু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমি কিছু করার আগেই সেটাও অদৃশ্য হয়ে যায়। “

নীলোৎফার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর বলে ,

-“তোমরা কি বলতে পারবে মৌমিতা নামের প্রথম যে মেয়েটির গায়েব হওয়ার খবর পাওয়া গেছিল, তার কি একবছর হয়ে গেছে?”

রজত বলে উঠল,

-“হ্যাঁ তা এক বছর হবে। যদিও আমি সিওর নয়।”

নীলোৎফার বলল,

-“আমাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। বারবার এই একই ভুল আমাদের হয়েছে। গাইলান বা তার বংশধরেরা আদমজাতের কোনো মেয়েকে নিজের বেগম বানালে একবছর পর্যন্ত তাকে ভোগ করে। দুনিয়ার তামাম সুখ স্বাচ্ছন্দ্য তাকে দেয়, দেয় বহু অলৌকিক শক্তি। কিন্তু প্রতিবার মিলনের সাথে সাথেই তার শরীরে ঢালতে থাকে তিব্র বিষ। ঠিক একবছর পর এই বিষের জ্বালা তীব্র আকার ধারণ করে। তখন মেয়েটি অসহ্য যন্ত্রণায় পাগল হয়ে নিজেই নিজের  শরীর থেকে চামড়া ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলতে থাকে। সাধারণ ইনশান হলে মারা যেত। কিন্তু জ্বীনের দেওয়া শক্তি আছে তার কাছে। তাই তার মৃত্যু এতো সহজে হওয়ার নয়। এই বদসুরাত মেয়েদের জ্বীন তখন আর নিজের কাছে রাখে না। জ্বীনদের দুনিয়া থেকে তাকে বিতাড়িত করে। আর এই মেয়েরা ফিরে আসে ইনশানী দুনিয়ায়। নিজের শরীরের বিষ অন্য কোনো ইনশানের শরীরে ঢেলে দিয়ে কিছুদিনের জন্য স্বস্তি পায়। সেই ইনশান মারা যায়। তখন এই মেয়েরা পরিণত হয় জ্বীন্নাতুনে।” 

তখন পীরসাহেব বললেন,

-“এই ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। জানলে আমি নিশ্চই কিছু করতাম। কিন্তু এই জ্বীন্নাতুন তো কাউকে মারতে আসেনি। এসেছিল মৌমিতা আর তার সন্তানকে জ্বীনের কাছে নিয়ে যেতে।”

-“হ্যাঁ আতাপী সাহেব অনেক সময় জ্বীনেরা জ্বীন্নাতুনকে সুস্থ করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নিজেদের কাজে লাগায়। আর তাছাড়া এই জ্বীন্নাতুনরা স্বাধীন। জ্বীনদের মতো ইনশানী দুনিয়ায় আসতে তাদের কারোর সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। তাই ইনশানী দুনিয়ায় আসার জন্য জ্বীনরা জ্বীন্নাতুনদের ওপরে নির্ভর করে। গাইলান যে মেয়েদের নিয়ে গেছে তারা যাতে আর কেউ জ্বীন্নাতুনে পরিণত না হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”

এই পর্যন্ত বলে নীলৎফার একটু থামলেন ,তার মুখে একটু বিরক্তি মেশানো রাগের চিন্হ ফুটে উঠল। তারপর আবার সে বলতে শুরু করল,

 -“এক বছর আগে এরকমই এক জ্বীন্নাতুন গাইলান জ্বীনকে মুক্ত করেছিল। তবে সেই বন্ধন যে মুক্ত করবে সেই মুক্তিদানকারী নিজেই সেই বাঁধনে বাঁধা পড়বে এমন নিয়ম ছিল। অসীম শক্তি ছাড়া সেই বাঁধন  কারোর ভাঙার ক্ষমতা ছিল না। গাইলানকে মুক্তিদানকারী জ্বীন্নাতুন সেই বাঁধনে আটকা পড়ে যায়। বিষ মুক্ত না করতে পেরে সে নিদারুণ জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে একমাস পর মারা যায়। “

-“তার মানে এই জ্বীন্নাতুন গাইলানের দাস। তার কথাতেই সে এখানে এসেছিল।”

নীলোৎফার এবার বেশ তৎপর হয়ে বলল,

-” আমাদের গতিবিধি সম্পর্কে কোনোভাবে গাইলান খবর পাচ্ছে। তবে এখন মৌমিতার সন্তান মুগাবালি আমাদের কাছে আছে। আমরাও লাচার নয়। আমাদের হাতে একটা সপ্তাহ সময় আছে। এক সপ্তাহ মুগবালী শক্তিহীন থাকবে। তারপর সে জ্বীনজাতের আসল ক্ষমতা আর শক্তি লাভ করবে। “

পীরসাহেব বললেন,

-“তবে মুগাবালিকে আপনার সাথে নিয়ে যান। আর আপনাদের যা করনীয় তাই করুন।”

এই বলে পীরসাহেব মুগাবালিকে নীলোৎফারের হাতে তুলে দিলেন । শেষ বারের মতো চাঁপাফুলের কলির মতো মুগবালিকে দেখে নিল রজত আর গার্গী। এতো সুন্দর নিষ্পাপ শিশুটা জ্বীনের সন্তান ভাবতেই অবাক লাগে।

এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত হলেও, তাৎপর্যের দিক থেকে কম কিছু নয়। সেই সময়ের কথা চিন্তা করলে এখনও শিউরে উঠতে হয়। শুরু হয়ে যায় অন্ধকারের সাথে আলোর যুদ্ধ। পবিত্রতা ও পুণ্যের সাথে অপবিত্রতা ও পাপের লড়াই । যদিও রজত, গার্গী, গৌরব, সুনিতা, সুমিত ও পীরসাহেব ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো মানুষ জানল না সেই যুদ্ধের কথা। পৃথিবীর মানুষ শুধু জানল ভয়ংকর প্রাকৃতিক দূর্যোগে ভারতের বেশ কিছু অংশ ও বাংলাদেশ বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েছে। যেন প্রকৃতি পাগলপারা হয়ে দুটি দেশের মানুষের ওপর কোনো নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছে। মুগাবালিকে, নীলোৎফার পরী নিয়ে যাবার ঠিক একদিন পরেই শুরু হয় ঘটনাক্রম। আকাশ এমন কৃষ্ণ কুটিল মেঘে ঢেকে গেল যা দেখলে কলজের জল শুকিয়ে যায়। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো মেঘ যেন মাটি ছুঁয়ে ফেলছে। বাতাসে যেন গম্ভীর গর্জনের মতো শব্দ হতে লাগল। আধো অন্ধকারে, ধূসর পেঁজা তুলো মেঘের বুকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত নীল আলোর দ্যুতি। ভীষন শীতে সকলে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। সেটা হিলহিলে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায়, নাকি ভয়ের চোটে তা বোঝা দায়। তারপর শুরু হলো বৃষ্টি। এমন কনকনে ঠান্ডা জল যে মনে হয় শরীরে বরফের তীর বিঁধছে। বাতাসে শোনা যাচ্ছে এক অদ্ভুত খটখট শব্দ, যেন হাততালি দিয়ে নৃত্য করছে শতসহস্র কঙ্কাল। পাগলের মতো আচরণ শুরু করল বৃষ্টিচ্ছাস। তার এমনই দাপট যে সেইদিকে তাকালে যেন চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। তারপর থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল মাটি। যেন প্রকাণ্ড কোনো দানব দুরমুশ দিয়ে পিটিয়ে জমি সমান করতে নেমেছে।

এই দুর্যোগের কোনো পূর্বাভাস আবহাওয়া দপ্তর দিতে পারেনি। বাংলাদেশ আর ভারতের বেশ কিছু অংশে এরপর শুরু হয় প্রবল সুনামি। যেখানে যেখানে সুনামির প্রকোপ পড়ে সেইসব অংশের কোনো কিছুই আর আস্ত থাকল না । আর কতো যে মানুষ মারা গেল তার হিসাব রাখা দায়।

 রজত — গার্গী, গৌরব, সুমিত ও সুনিতা সহ নিজের  যত চেনা পরিচিত ছিল সকলকে আগাম সতর্কতা দিয়েছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে। তবে তা যে এতটা ভয়ংকর হতে পারে তা রজতও আঁচ করতে পারেনি। এক এক সময় তার মনে হয় এর থেকে বোধহয় গাইলান আর তার বংশধরদের কার্যসিদ্ধি করতে দিলেই ভাল হতো। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে ভাবে তাহলে হয়তো এর থেকেও ভয়ংকর কোনো অবস্থার সৃষ্টি হতো।

সাতদিন পর দুর্যোগ মিটল বটে, তবে তার জের চলল বহুদিন ধরে। চারিদিকে হাহাকার, মহামারী, দুর্ভিক্ষ। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে ভূমিকম্প ও ঝড়ের দাপটে একটা বাড়িও আস্ত ছিল না। সে পাকা হোক কিংবা কাঁচা। তারপর বন্যার ফলে খাদ্য পানীয়ের যোগানটুকু ছিল না। রজত সুনিতা আর সুনেত্রাকে সাতদিনের দুর্যোগের পরে রাজস্থানে নিজের এক পরিচিত বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দেয়। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগে এক বছর। এই এক বছরে সুমিত আর রজত নিজেদের প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি মেরামত করে। গৌরব ও গার্গীও এই বছরটা নিশ্বাস ফেলার অবস্থায় ছিল না। 

এক বছর পর সুনিতা ফিরে এসেই গার্গী আর গৌরবকে বাড়িতে ডাকে। তারা যে বিশাল কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, অনেকটা তার উৎযাপন হিসাবেই সকলের এই মিলিত হওয়া। যদিও সামান্য ডাল ভাত আর চায়ের ব্যবস্থা ছাড়া খাওয়াদাওয়ার আর কোনরকম ব্যবস্থা করা যায়নি। রজতদের বাড়িতে এসে গার্গী, কুশল বিনিময়ের পরেই তুলল আসল কথাটা,

-“আচ্ছা নার্সিংহোমে আমরা যখন বেরোচ্ছিলাম তখন পীরসাহেব তো আমাদের সঙ্গে ছিলেন না। নীলোৎফার পরী চলে যাবার পরে তিনি কখন যে চলে গেলেন আমরা কেউ খেয়ালই করিনি। “

রজত বলল,

-“হ্যাঁ এর মধ্যে আমিও খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যা অবস্থা ছিল এতদিন। এখন আদৌ আর …”

কথাটা বলার সময় রজতের গলাটা কেঁপে উঠল। সুনিতা সবার জন্য চা আনল। তারপর সবার হাতে চা আর বিস্কুট তুলে দিয়ে বলল,

-“কিন্তু যে সমস্যাটা ছিল সেটা তো এক জায়গাতেই রয়ে গেল। যে মানুষ গাইলানকে পৃথিবীতে ডেকে এনেছিল সে তো ধরা পড়ল না। যদি সে আবার সেরকম কিছু..”

ঠিক সেই সময়েই কলিং বেল বেজে উঠল। গার্গী চায়ের কাপটা রেখে বলল,

-“আমি দেখছি।”

এই বলে সে ঘরের জানলা দিয়ে দেখে নিয়ে, দরজা খুলতে গেল। তারপর ফিরে এল রজতের পুলিশ কমিশনার বন্ধু সৈকতকে সঙ্গে নিয়ে। রজত উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল

-“আরে তুই, কী ব্যাপার ভাই!”

সৈকতের মুখে কিন্তু হাঁসির লেশ মাত্র নেই। বরং তার চেহারায় কিছুটা থমথমে ভাব। বেশ গম্ভীর গলায় সে বলল,

-“হ্যাঁ রে এলাম। আসলে না এসে উপায় ছিল না। তোকে ফোন করতাম, কিন্তু এখন তো জানিস সব ফোনের টাওয়ার রির্স্টোড হচ্ছে। স্মার্ট ফোনের অবস্থাও প্রায় ডাম্ব ফোনের মতোই। নেটওয়ার্ক নেই।”

-“কি ব্যাপার বলতো? এতো ভনিতা না করে বল না। আচ্ছা তার আগে একটু বস স্থির হয়ে। “

-“না রে বসার সময় নেই। তুই আমার সাথে একটু যেতে পারবি এখন?”

-“কোথায় যেতে হবে ?”

-“যেতে যেতে বলব। শুধু একটা কথা বলছি, তুই হুজুরে কেবলা আল আতাপি.. হ্যাঁ এরকমই সামথিং একটা নাম ছিল..তুই এরকম নামের কোনো বৃদ্ধ ভদ্রলোককে চিনিস?”

রজত, গার্গীর দিকে একবার তাকাল। একটু আগেই গার্গী পীরসাহেবের কথা বলছিল। গার্গীর মনে প্রশ্নের ভীড়। রজত সৈকতকে বলল,

-“হ্যাঁ চিনি। কিন্তু অনেক দিন তার কোনো খোঁজ পাইনি।”

-“তাহলে এক্ষুনি চল আমার সঙ্গে।”

রজত তখন আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে সৈকতের সাথে বেরিয়ে পড়ল।

জিপে উঠতে উঠতে সৈকত আবার বলল,

-“তোকে যেতে যেতে সব কথা বলছি।”

ফুল স্পিডে জিপ স্টার্ট করার পর রজত বলল,

-“আতাপী স্যার এখন আছেন কোথায়। “

-“আমাদের গন্তব্য এখন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল। তবে মিঃ আতাপী আর পৃথিবীতে নেই। ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন।”

-“কী! কী বলছিস তুই? মানে? কী করে..”

-“তোকে ঘটনাগুলো যেমন ভাবে ঘটেছে সেভাবেই বলি। সেই ‘মৌমিতা সাইকো কিলার’ কেসটা আমি হ্যান্ডেল করছিলাম তোর নিশ্চই মনে আছে?”

-“হ্যাঁ অবশ্যই।”

-“এতদিন এইসব দুর্যোগের কারনে সব তো ধামা চাপা পড়ে গেছিল। কিন্তু আমি সেই সাইকো কিলার কম্বল ওয়ালার একটা ছবি তার আগেই জোগাড় করেছিলাম। তুই তো জানিস এখন যা অবস্থা চারিদিকে ক্রাইমের পরিমাণ কতটা বেড়ে গেছে। কিছু ক্রিমিনালদের ধরতে আমরা তিন মাস আগে গ্রেট ইস্টার্নে রেড করেছিলাম। তখনই আমদের এক কনস্টেবলের চোখে পড়ে সেই কম্বলওয়ালা হোটেল থেকে বেরোচ্ছে। সেই কনস্টেবল যখন আমাকে সে কথা জানাল তখন আমি ঠিক করি হোটেলের চারপাশে নজরদারি বসাব। যদি সেই লোক আবার আসে তাহলে তাকে ধরা যাবে। প্রায় মাসখানেক কেটে যায় তার দেখা পাওয়া যায় না। আমরা যখন আশা ছেড়ে দিয়েছি তখন তাকে আবার দেখা গেল। আমরা ঠিক সময় মতো তাকে ধরার জন্য হোটেলের চারদিক ঘিরে ফেলি। কিন্তু হঠাৎ তার পেছনে এক অদ্ভুত কালো কাপড়ে ঢাকা মহিলাও হোটেলের ভিতরে প্রবেশ করে। অদ্ভুত ব্যাপার হোটেলের গার্ডরা ওরকম অদ্ভুত মহিলাকে আটকাল না। এই ঘটনা দেখে আমাদের এক কনস্টেবল সেই মহিলা কে — জানার জন্য তার সামনে যায়। কিন্তু তখনই সেই মহিলা কনস্টেবলের ওপর হামলে পড়ে। তার মুখের ওপরে চুমু খাওয়ার ভঙ্গীতে মহিলা অদ্ভুত ভাবে ঝুলে পড়ে। তারপর সেই কনস্টেবল কিরকম কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগল। অন্য অফিসার আর কনস্টেবলরা সেই মহিলাকে ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু মহিলার গায়ে যেন হাতির মতো শক্তি, এক ঝাটকায় সকলকে সে একরকম শূন্যে ছুঁড়ে দিল। “

রজত তখন বিড়বিড় করে বলল ,

-“এ নিশ্চই জ্বীন্নাতুন।”

-“কী বললি?”

-“কিছু না তারপর বল, কি হলো?”

-“হ্যাঁ শোন, তারপর মহিলা মুখ তুলে তাকাল আর মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরে গেল। সে কি বিভৎস মুখ। মুখের ওপরে চামড়ার লেশ মাত্র নেই , গোটা মুখ জুড়ে লাল দগদগে ঘা, মুখের ওপর কালো কালো পোকা ভিনভিন করছে। মুখ থেকে লাল রক্ত ঝরছে। চোখের সে কি বিভৎস লাল দৃষ্টি। সে তখন সেই কনস্টেবলকে ছেড়ে দিয়েছে। আর কনস্টেবলের নিষ্প্রাণ দেহটা ধপ করে পড়ে গেল। বাকিরা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। আর সেই সুযোগে মহিলা লাফ দিয়ে দেওয়ালে উঠল। ঠিক টিকটিকির মতো দেওয়াল বেয়ে একটা জানলা গোলে পালিয়ে গেল। যে কনস্টেবল মারা গেছে তাকে নিয়ে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তার শরীরের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছিল, হাত, গলা, মুখ সব নীলচে কালো হয়ে গেছিল আর চামড়া কুঁচকে কিরকম থলথল করছিল । আমি পালস চেক করার জন্য হাতের যে অংশ ধরেছিলাম, হাতের চাপে সেই অংশটা গলে গিয়ে থকথকে কালো রক্ত বেরিয়ে এল। মুখটা হাঁ করা। সেখান দিয়েও বেরিয়ে আসছিল থকথকে কালো রক্ত। চোখের মনিগুলো যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আমরা এইসব দেখে হতভম্ভ, আর এই সুযোগে আমাদের সেই কম্বলয়ালাও হাতছাড়া হয়ে যায়।”

-“সেকী পালিয়ে গেল?”

-“হ্যাঁ কিন্তু আমরাও আশা ছাড়িনি। আর কনস্টেবলের মৃত্যু নিয়ে যাতে কোনো হইচই না হয় সে ব্যবস্থাও করি। তাহলে আবার লোকটা সাবধান হয়ে যেত। পরের মাসে আমরা আবার অভিযান চালাই। লোকটা বোধহয় কিছু আঁচ করেছিল। লোকটা এবারে একদিন আগেই পৌঁছে যায়। আমাদের এক পাহারাদার ব্যাপারটা জানায়। আমরা যখন পুরো ফোর্স নিয়ে পৌঁছলাম তখন হোটেলের কয়েকজন কর্মচারী এসে জানায়, টপ ফ্লোরে একটা সুইট থেকে মহিলা ও পুরুষের তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দ শোনা গেছে। আমরা সেখানে দৌড়ে গেলাম। সুইটের দরজা খোলা ছিল। আমরা ভিতরে ঢুকেই দেখি দরজার সামনে একটা মানুষ উল্টে পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি মানুষটি মৃত। কিন্তু তার অবস্থাও আমাদের সেই কনস্টেবলের মতো। হাত, গলা, মুখ সব নীলচে কালো , চামড়া কুঁচকে কিরকম থলথল করছিল। লোকটার অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখের মণিগুলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, পুরো লাল দগদগে। মুখের সরু লম্বা ঝুলে থাকা গোঁফটা আর গায়ের পোশাকগুলো না দেখলে বোঝাই যেত না এ সেই কম্বলওয়ালা। “

-“আচ্ছা এরকম লাশ কি এর আগে কোথাও পাওয়া গেছে?”

-“আসলে এতো মানুষ মারা গেছে এই কয়েক মাসে, আর তাদের এতো খারাপ অবস্থা ছিল আমাদের পক্ষে বিশেষ কোনো মৃতদেহের উপর নজর রাখা সম্ভব ছিল না।”

-“বুঝলাম, তারপর কি হয়েছিল বল।”

-“হ্যাঁ আমরা সেই কম্বলওয়ালার লাশ পেরিয়ে সুইটের ভেতরে ঢুকলাম। সেখানে সব লন্ডভন্ড অবস্থা। আর ছত্রাকার আসবাবপত্রের মধ্যে পড়ে আছে আরও দুটো লাশ। একটার ওপর আর একটা মুখে মুখ চাপা অবস্থায় পড়ে আছে। ওপরের লাশটা সেই কালো কাপড়ে ঢাকা মহিলার। আর নীচে এক বৃদ্ধ। সেই বৃদ্ধ একটা দেড়শো সিসির সিরিঞ্জ পুষ করেছে মহিলাটির ঘাড়ে। দুটি লাশের অবস্থায় দরজার সামনে থাকা লাশটির মতোই। আশপাশে দেখতে গিয়ে দেখলাম একটা চিঠি পড়ে আছে, যার মধ্যে তোর নাম লেখা।  “

বলতে বলতেই তারা পৌঁছে গেল হোটেল গ্রেট ইস্টার্নে। তারপর তারা রিসেপশন পেরিয়ে লিফটে উঠল। লিফটে সৈকত বলল,

-“ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমার মনে হয়েছিল, এখানে কিছুই স্বাভাবিক নয়। হয়তো কোনো প্যারানরমাল একটিভিটি ব্যাপার আছে এর মধ্যে। । তাই কাউকে কিছু ছুঁতে দিয়নি। তোকেই ছুটে গিয়ে ধরে নিয়ে এলাম।”

-“ভালো করেছিস খবর দিয়ে।”

লিফট থেকে বেরিয়ে করিডোর পেরিয়ে তারা এগিয়ে যাবার সময় সৈকত বলল,

-“তোর সাথে মিঃ আতাপির পরিচয় কোথায় হয়েছিল?”

-“ওই দেশে। তিনি কিন্তু যে সে ব্যক্তি ছিলেন না। প্যারানরমাল সাইন্স, মেটাফিইসিকস এর ওপর ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জ্বীনিয়া থেকে phd করেছিলেন। আমেরিকায় যুবক বয়সে অনেক একসর্সিস্ম এর অনেক কেস সলভ করেছিলেন। “

বলতে বলতেই তারা উপস্থিত হল ঘটনাস্থলে। সেখানে পৌঁছে রজত দেখল, সৈকত যেমন বলেছিল চারদিকে অবস্থা তেমনই। সেই কম্বলওয়ালার মৃতদেহ পেরিয়ে তারা ভিতরে ঢুকল। সেখানেও পীরসাহেব ও জ্বীন্নাতুনের মৃতদেহের অবস্থা পূর্ব বর্ণিত। তবে জ্বীন্নাতুনের দেহে যেন আরও বেশি পচন ধরেছে। বমন উদ্রেককারী বোটকা গন্ধে টেকা দায়। তাও টেবিলের উপরে রাখা পীরসাহেবের চিঠিটা সেখানে দাঁড়িয়েই পড়তে লাগল রজত। ফুলস্কেপ তিনটে কাগজ জুড়ে লেখা এক দীর্ঘ চিঠি..

প্রিয় রজত,

                চিঠির শুরুতেই একটা কথা বলে শুরু করব, এই চিঠি পড়ার পর তুমি যেমন অবাক হবে তেমন আমাকে ঘৃণাও করতে শুরু করবে। কিন্তু এই কথাগুলো তোমাকে জানিয়ে যেতে না পারলে আমার মরেও শান্তি হবে না। আমি গুছিয়ে হয়তো লিখতে পারব না। কিন্তু যতটা পারি চেষ্টা করছি।

 যে অপরাধ আমি করেছি তা সম্পূর্ণ রূপে ক্ষমার অযোগ্য। তবু অনেক সাহস করে কিছুটা নিজের সাফাই পেশ করার জন্যই এই চিঠির অবতারণা। গুছিয়ে বলার জন্য অনেকটা আগে থেকেই সব শুরু করছি। 

 কাহিনীর শুরু আমার আব্বুর সময় থেকে। আমাদের বংশ সেই নবাবী আমলে জমি জিরেত পেয়ে বাঙলাদেশের জায়গীরদার হয়ে বসে। তখন থেকেই আমাদের ধনসম্পত্তির কোনো অভাব ছিল না। আর আমদের বংশকে লোকে বলতো পীরের বংশ। অন্যান্য জমিদারি বংশে যেমন দেখা যায় নানারকম ভাবে তারা টাকা ওড়ায়, চরিত্রের দিক থেকেও নানারকম অশালীনতা থাকে, সেসব কিছু আমাদের বংশে ছিল না। যার জন্য সম্পত্তির অবক্ষয় একেবারেই হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জমিদারি চলে গেলেও,  সম্পত্তির পরিমাণ কমেনি । দাদাজান, আব্বু নানারকম ব্যবসা করে সেই সম্পত্তি বৃদ্ধি করেন। দাদাজান মারা যাবার পর আব্বু ওষুধের কোম্পানির নতুন একটা ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার সূত্রে তিনি কলকাতায় থাকতেন। আব্বুর পার্টনার ছিল দাদাজানের এক বন্ধু আতাউল্লাহ রায়হান। দাদাজান মারা যাবার পর তার কুলহানের দিন আতাউল্লাহ সাহেব আব্বুকে ওষুধের ব্যবসার প্রস্তাবটা দেন। ব্যবসায় সমস্ত টাকা ছিল আব্বুর, আর আতাউল্লাহর ছিল রিসোর্স। আতাউল্লাহর মেয়ে সালেহা মৌমিতা ছিল অসাধারণ রূপবতী। আব্বু যখন কলকাতায় প্রথম গেলেন আতাউল্লাহ সাহেবই তাকে নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই বাড়িতেই মৌমিতার সঙ্গে বাবার প্রথম দেখা। দেখেই বাবার মাথা ঘুরে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের বিবাহ হয়। বিবাহের পর ধীরে ধীরে মৌমিতা অজগর সাপের মতো আব্বুকে গ্রাস করতে থাকে। আব্বুর সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে সে আব্বুকে বাধ্য করে তালাক দিতে। আতাউল্লাহ সাহেব আব্বুর চরিত্র বদনাম করতেও ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত আব্বুর নামে ওষুধের ব্যবসার আড়ালে, ড্রাগ পাচারকারী বলে অভিযোগ আনা হয়। আব্বুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। হয়তো জেলও হয়ে যেত কিন্তু আব্বুর কিছু বন্ধুর চেষ্টায় সেটা বন্ধ করা যায়। কলকাতায় আর আব্বুর থাকা হল না। এক তো আতাউল্লাহ আব্বুকে ধনে প্রাণে লুট করেছিল। তার ওপর  ড্রাগপাচারের অভিযোগে থেকে মুক্তি পেতে যা বেঁচেছিল সব কিছু বিক্রি হয়ে যায়। আব্বু বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নেত্রকোনার একটি স্কুলে বাংলা শিক্ষকের চাকরী করতে শুরু করেন। এতো বিশ্বাসঘাতকতা পেয়ে আব্বুর মাথাতেও কিরকম একটা গন্ডগোল হয়ে গেছিল। গ্রামের আত্মীয়পরিজন মিলে আব্বুর আবার বিবাহের ব্যবস্থা করেন। আম্মুর সাথে আব্বুর বিবাহ হয়। বিবাহ হলেও আম্মুর সাথে তার কোনো আত্মিক সম্পর্ক কখনও তৈরি হয়নি। আমাকে অবশ্য আব্বু চোখে হারাতেন। অনেকটা আমার জন্যই আম্মুকে তিনি তালাক দেননি। কিন্তু দুর্ঘটনা কপালে লেখা থাকলে তাকে খন্ডায় কার সাধ্য! আমার যখন দশ বছর বয়েস তখন আব্বু স্কুলের এক হিন্দু ছাত্রীর প্রেমে পড়েন। অদ্ভুত ব্যাপার সেই মেয়ের নামও মৌমিতা। এই মেয়েটিও রূপবতী ছিল বটে। তবে শুধু রূপ নয় আব্বু এই নামটার জন্যই আরও মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন। আব্বু এই মেয়েটিকে বিবাহ করে নেত্রকোনা শহরে একটা বাসা ভাড়া করে আলাদা থাকতে শুরু করলেন। আমার আম্মু ছিলেন ধার্মিক মহিলা। আব্বুর অভিযোগ ছিল আম্মু নাকি ধর্মকর্মে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে ঠিক মত স্বামীসেবা করতে পারতেন না। আব্বু তাকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে বিবাহ করার কারণ এটাই। এদিকে আম্মুর তখন পাগলিনী মতো অবস্থা হয়। তিনি বহুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। প্রতিবার আমি দেখতে পেয়ে আম্মুকে বহু কষ্টে আটকে দিই। 

এক সময় এমন অবস্থা হয় আমি স্কুলে যেতাম আম্মুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে। সেই বারো বছর বয়সে নিজের হাত পুড়িয়ে কোনরকমে পোড়া ভাত রান্না করতাম। আব্বু পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে এমন ঝামেলা করেছিলেন যে কেউ সেই সময় আমাদের খোঁজ নিতেও আসেনি। কিন্তু যা হবার তাতো হবেই। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি আম্মু কোনোরকমে হাতের বাঁধন আলগা করেছেন। একটা কাঁচের জলের গ্লাস ভেঙে, সেই কাঁচের টুকরো দিয়ে হাতের শিরা কেটে ফেলেছেন। আম্মুর শরীরে তখনও প্রাণ ছিল। তিনি বলে যাচ্ছেন,

-“মৌমিতা আমারে হারাতে পারবে না.. পারবে না..”

গোটা ঘরের মেঝে, বিছানার চাদর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মেঝেতে পড়ে আছে কাঁচের টুকরো, জল, ভাত, ভাতের থালা আর আম্মুর রক্ত। বিছানার ওপর আম্মু, তার অবস্থাও রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পাগলীর মতো। অবস্থা দেখে আমার পায়ের তলা থেকে যাকে বলে সত্যিকারের মাটি সরে যায়। আমি faint হয়ে ওই মেঝের ওপরেই পড়ে যাই। কতক্ষন পরে যে আমার জ্ঞান ফিরল তার হিসাব আমার জানা নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আম্মু আর বেঁচে নেই। আমি কি করব বুঝতে না পেরে সেখানেই বসে থাকি। কখন দিনের আলো শেষ হয়ে কালো রাত এল আমার কোনো হুঁশ ছিল না। সারাটা রাত আমি আম্মুর মৃতদেহের পাশেই বসেছিলাম। মসজিদে ফজরের নামাজ শোনা গেল একটা সময়। তারও ঘন্টা দুই পরে হঠাৎই আব্বু সেদিন বাড়িতে আসেন। বাড়িতে এসে সব কিছু দেখে তারও বোধহয় আমার মতোই অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু তারপর তিনি সব সামলে নিলেন। আম্মুর কাজ মিটে যাওয়ার পর তিনি নিজের নতুন স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন। আব্বুর স্ত্রী আমার থেকে বয়সে কয়েক বছরেরই বড়ো হবেন । তবে তার দাপট কিছু কম ছিল না। আব্বুকে একেবারে হাতের মুঠোয় ভরে রাখতেন । আমার প্রতি তার অবশ্য খুব একটা আগ্রহ ছিল না। আর আম্মুর মৃত্যুর পরে আমিও যেন কেমন হয়ে গেছিলাম। খাওয়া, ঘুম আর পড়াশোনা এই ছিল আমার জীবন। বাহ্যিক কোনো বিষয়ে আমার আর কোনো কৌতূহল ছিল না। তাই বাড়িতে আব্বু না থাকাকালীন এক অচেনা ব্যক্তির ঘনঘন আগমন আমার মনে দাগ কাটেনি। তবে এই ব্যক্তি যে আমার জীবনে আর একটা অভিশাপ নিয়ে আসবেন তা যদি আগে বুঝতাম..

যাকগে আসল কথায় আসি। এই ব্যক্তির বাড়িতে যাতায়াত শুরুর এক বছরের মধ্যে আব্বু হঠাৎ মারা গেলেন। সবাই জানল কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, তবে আব্বুর মুখের গ্যাজলা আর শরীরের নীল রং অন্য কিছুই প্রমাণ করছিল। আব্বুর নতুন স্ত্রী আর সেই অচেনা ব্যক্তি কিভাবে যেন সব কিছু চাপা দিয়ে দিলেন। এই অচেনা ব্যক্তি কিছুদিনের মধ্যেই আমার নতুন আব্বা হলেন। আব্বু বেঁচে থাকাকালীন নতুন আম্মি আমাকে কোনরকম গুরুত্ব না দিলেও তিনি মারা যাবার পর আমার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ জন্মায়। তিনি আমার থাকার ব্যবস্থা করলেন বাড়ির দোতলায় । এই দোতলায় আব্বু, আম্মু আমাকে উঠতে দিতেন না। আমাদের পরিবার যে পীরের বংশ ছিল তা আগেই বলেছি। এই দোতলায় নাকি আমার দাদাজান, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তন্ত্রমন্ত্রের চর্চা করতেন। এই কথার ওপর ভিত্তি করেই প্রথমে চলল আমাকে ভূতের ভয় দেখানোর চেষ্টা। যাতে আমাকে সহজেই পাগল প্রমাণ করা যায়। তবে আমি সেখানে যে মণি মুক্তোর সন্ধান পেয়েছিলাম তাতে আমাকে আর ভয় দেখান গেল না। আমার পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন সাধনার সামগ্রী নানারকম পশুর হাড়, শুকিয়ে রাখা ফুল, ফল আরও কতো কি যে ছিল। আর ছিল হাজার হাজার বছরের পুরনো পুঁথি, বই, ডায়রী। আমি সেই সব নিয়েই পড়ে থাকলাম। তবে আমার নতুন আম্মির রাগ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল। তিনি আমার ওপর নানারকম নির্যাতন শুরু করলেন। সেইসব নির্যাতনের কথা আমার পক্ষে বলাও সম্ভব নয় , শুধু বলতে পারি তারমধ্যে যৌন নির্যাতনও ছিল। একদিন তার এই নির্যাতন চরমে উঠল। আমি মাকড়শা খুব ভয় পেতাম।  নতুন আম্মি আমাকে সম্পূর্ণ উলংগ করে, হাত পিছন দিকে বেঁধে, গলায় একটা মাকড়শার মালা পড়িয়ে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেন। মাকড়সাগুলো সেই অবস্থাতেও জীবিত ছিল। তারা কিলবিল করছিল আমার শরীর জুড়ে। আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল মাকড়শার রস। গায়ে কিরকম এক চিড়বিড়ে জ্বালানি হতে থাকে। এক সময় জ্ঞান হারাই। তারপর বহুদিন আমার ভালোভাবে জ্ঞান ফেরেনি। সারা শরীর জুড়ে ঘা, জ্বরে মরো মরো অবস্থা হয়েছিল। আমার দোতলার ঘরে বিনা চিকিৎসায় নোংরার মধ্যে আমাকে ফেলে রাখা হয়। এক সময় দেখলাম আম্মু এসে আমার শিওরে বসেছেন। আমি বললাম,

-” আমাকে নিতে এসছো আম্মু?”

-“না বেটা, মৌমিতা আমারে হারাতে পারবে না.. পারবে না..”

এই বলে একটা কাঁচের শিশি আর পুঁথির মতো খুব প্রাচীন একটা বই আমার সামনে রাখলেন। আমি সেগুলো হাতে তুলে নিতেই আম্মু আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। আমি তারদিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু তিনি দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেলেন। আমি তার পিছনে চলতে লাগলাম। আম্মু আমাদের কাঁচের ঘরের সামনে গিয়ে থামলেন । এই ঘরটা সব সময় তালাবদ্ধ থাকতো । কিন্তু আমি দেখলাম ঘরের তালা খোলা আছে। আম্মু ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন। আমিও আম্মুর পিছনে গেলাম কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছিল। উঠে দাঁড়ানোর মতো শরীরের অবস্থাও আমার ছিল না । আমি যে কিভাবে হেঁটে ওই ঘরে গেলাম তা ঈশ্বর জানেন। আমি সেই ঘরে বসে পুঁথিতে জ্বীন জাগরণের যে মন্ত্র ছিল তা পাঠ করতে লাগলাম। আমার পূর্বপুরুষ ওই কাঁচের শিশির মধ্যে দীর্ঘকাল এক জ্বীনকে বন্দী করে রেখেছিলেন। আমি তাকে মুক্ত করলাম। গোটা ঘরটা ভরে গেল কালো ধোঁয়ায়। তারপর কি ঘটেছিল আমার আর কিছু মনে নেই। পরের দিন আমি যখন চোখ খুললাম, তখন দেখলাম আমি নিজের ঘরেই শুয়ে আছি। তবে শরীর একদম ঠিক , গায়ে কোনো ঘায়ের চিন্হ মাত্র নেই। আর জ্বরও একেবারে সেরে গেছে। সেই সময়েই আমার খেয়াল পড়ল নীচ থেকে অদ্ভুত কোলাহলের শব্দ আসছে। আমি পায়ে পায়ে নীচে গেলাম । দেখলাম নতুন আম্মি আর আব্বার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের কাজের বুয়া তারস্বরে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছেন। ঘরের দরজা খোলা। আর খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের মেঝেতে চার হাত পায়ে ঠিক পশুর মত হামাগুড়ি দিয়ে নতুন আম্মি আর আব্বা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের মুখ দিয়ে পাগলা কুকুরের মতো গরগর শব্দ হচ্ছে। সকালবেলা কাজের বুয়া যখন বেড টি দিতে গিয়েছিলেন তখন নাকি নতুন আম্মি তারওপর ক্ষেপা কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়াতে গিয়েছিল। আমাকে সামনে দেখেও কাজের বুয়া ভুত দেখার মতোই চমকে যান। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন আমি মারা গেছি। কিন্তু আমি তখন আম্মি আব্বার জন্য ডাক্তার রায়ানকে ডেকে আনলাম। এই ডাক্তারই আমার আব্বুর মৃত্যুর পর স্বাভাবিক ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। তিনি এসে লক্ষণ দেখে বললেন রেবিজ। কারন ততক্ষনে তারা দুজনেই মেঝেতে পরে অদ্ভুত ভাবে কুঁকড়ে গেছেন। হাত পাগুলো অদ্ভুত ভাবে বাঁকতে শুরু করছে। আর দাঁত খিঁচিয়ে অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে – পানি.. পানি বলার চেষ্টা করছেন। অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে রায়ান সাহেব বাড়ি ফিরে যান। তবে দুপুরের দিকে নিজের দুই সঙ্গীকে নিয়ে আবার ফিরে এলেন। নতুন আম্মি আর আব্বাকে তারা ইনজেকশন দেওয়ার জন্য চেপে ধরে। কিন্তু ডক্টর রায়ান ও তার দুই সঙ্গীকে আম্মি আব্বু মিলে ভয়ংকর ভাবে আঁচড়ে কামড়ে দেয়। দশদিন পরে নতুন আম্মি, আব্বা, সেই ডাক্তার আর তার দুই সঙ্গী ভয়ংকর জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়। আমার বয়স তখন আঠারো। আমার আর কোনো আত্মীয় স্বজন ছিল না। প্রতিবেশীরা আমার দেখশোনার জন্য লোক দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেটা চাইনি। প্রতিবেশীরা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তাই আমার খাবার দিয়ে যাওয়ার জন্য একজন লোককে তারা নিযুক্ত করলেন। আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। তাই আমার শিক্ষকরা পড়াশোনার সব ভার নিলেন। আমি একসময় বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। আমার শিক্ষকরা চাঁদা তুলে বিদেশে যাবার সব ব্যবস্থা করলেন। 

বিদেশে আমার জীবনের কথা তুমি সবই জানো। তবে আমেরিকায় আমার জীবন শেষ হবার কারনটা তুমি হয়তো ভালোভাবে খেয়াল করোনি। শেষ কেসে যে মেয়েটির উপর শয়তান ভর করেছিল তার মায়ের নামও ছিল মৌমিতা । তাকে এতোবার বরণ করা স্বত্বেও আমাদের কথা না শুনে তিনি মেয়েকে বাঁধন মুক্ত করেন। আর তার ফলেই শয়তান বন্ধন মুক্ত হয়ে আমার স্ত্রী ও একুশ বছরের জোয়ান ছেলেকে হত্যা করে। এই মৌমিতা নামের মেয়েরা পৃথিবীতে সব শেষ করে দেবে রজত। এই ঘটনার পরে আমি আর আমেরিকায় থাকতে পারলাম না। দেশে ফিরে এলাম । হয়তো মরেই যেতাম । কিন্তু ঢাকা এয়ারপোর্টে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার রসদ পেয়ে গেলাম। আমারই মতো এক দুর্ভাগার সাথে পরিচয় হলো। সাদেক আলি,সে ঢাকায় ট্যাক্সি চালাতো। মেহের রাশিদা মৌমিতা নামের এক মন্ত্রীর মেয়ের সাথে তার ভালোবাসা হয়।  সেই মেয়ে বেশ কিছু দিন তাকে শোষণ করে, টাকা, দামী উপহার চেয়ে। সাদেকও মেয়েটাকে নানারকম উপহার দিতে থাকে। কিন্তু একসময় মন ভরে গেলে মেয়েটা সাদেককে ঝেড়ে ফেলতে চায়। সাদেক রাজি না হলে সেই মন্ত্রী নিজের পোষা কিছু গুন্ডাকে দিয়ে সাদেকের ওপর হামলা চালায়। সাদেক ট্যাক্সি নিয়ে যাচ্ছিল সেই সময় তারা বোমা ছোঁড়ে। দুর্ঘটনায় সাদেক প্রাণে বেঁচে যায় বটে, তবে তার একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায় আর মুখ ও গোটা শরীর কদাকর হয়ে যায়। তার জীবিকা নির্বাহের গাড়িটিও ধ্বংস হয়। ঘটনাটা নিয়ে অনেক জলঘোলা হয় কিন্তু অপরাধীরা শাস্তি পায়নি। এই সাদেক আমায়  বলে ,

-“এই মৌমিতা নামটা কোনোভাবে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা যায় না পীরসাহেব?”

আমিও তখন আমার কর্মপন্থা ঠিক করে ফেলি। কয়েলাটিতে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসি। এই গ্রামে আমার নতুন আম্মি, আব্বা মারা যাবার পর নানারকম অলৌকিক সমস্যার সমাধান আমি করতাম। তাই গ্রামে পীর বলে আমার সুনাম ছিল। খন্দকারের সাহায্যে আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আমি আমার পূর্বপুরুষের বন্দী করা গাইলান নামের এক জ্বীনকে মুক্ত করে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনলাম। ভাবছো গাইলানকে তো মুক্ত করেছিল জ্বীন্নাতুন। আসলে পৃথিবীর কোনো মানুষ জ্বীন সাধনার মাধ্যমে মন্ত্র শক্তির বাঁধন ছিন্ন না করলে জ্বীন্নাতুনের পক্ষে গাইলানকে মুক্ত করানো সম্ভব হতো না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল মৌমিতা নামের মেয়েদের এমন অবস্থা করব, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর নিজের মেয়ের নাম মৌমিতা না রাখে। গাইলান যেকোনো জিনিসের আকার ধারণ করতে পারে। যে কোনো রূপ নিতে পারে। গাইলান সুন্দর লাল কম্বলের রূপ নিল। এরফলে তার বংশবৃদ্ধির কাজ সহজ হয়। এই কম্বলগুলো ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল সাদেক।

 তখন রাগে এতটাই অন্ধ হয়ে পড়েছিলাম যে কি করছি, এর ফল কি হতে সে সম্মন্ধে কোনো জ্ঞান তখন ছিল না। জ্ঞান ফিরল তোমার উপস্থিতিতে। যখন চিঠিতে তোমার আগমনের কথা জানতে পারলাম মনটা ভোরে গেল অপত্য স্নেহয়। আমার ছেলে বেঁচে থাকলে সেও হয়তো তোমার মতোই হতো। রাগ, প্রতিশোধ স্পৃহার থেকে স্নেহ, ভালোবাসা জিতে গেল। গাইলানকে কোনো কাজে নিযুক্ত করলে তাকে আর ফেরানো যায় না। তাই আমি যেমন তোমাকে সাহায্য করছিলাম, তেমন গাইলানকেও ভাঁওতা দিচ্ছিলাম। আমিই সুদীপবাবুর মেয়েকে সেই চাদরটা গায়ে জড়াতে দিয়েছিলাম। তারপরের ঘটনা নিশ্চই তুমি আন্দাজ করতে পারছ। তোমাদের মনে নিশ্চই প্রশ্ন জেগেছিল সুদীপবাবুর মেয়েকে যে নার্সিংহোমে রাখা হয়েছিল তার খবর গাইলান কী করে পেল? সে খবরও আমিই দিয়েছিলাম। তবে জ্বীন্নাতুনের ব্যাপারটা আমি সত্যিই জানতাম না। যখন সব ঠিক হয়ে গেল নীলোৎফার পরীর কৃপায়, আমি আর তোমার সামনে আসতে চাইনি। ভেবেছিলাম নীলোৎফার সব বুঝতে পেরে আমার ব্যাপারে যদি তোমাদের জানিয়ে দেয় ! তুমি আমাকে ঘৃনা করবে। তাই নার্সিংহোম থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। জ্বীন্নাতুন তখনও মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীলোৎফার পরীর পক্ষে জ্বীন্নাতুনকে ধরা সম্ভব ছিল না। তাই আমি ঠিক করি জ্বীন্নাতুনকে হত্যা করে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। সাদেকও তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে এই কাজে আমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়।

জ্বীন্নাতুনকে পৃথিবী থেকে দূর করার উপায় একটাই। তাকে হত্যা করা। আর এই কাজটা সহজ নয়। জ্বীন্নাতুনকে কোনো অস্ত্রের আঘাতে, বা তন্ত্র মন্ত্রের দ্বারা মারা যায় না। সে একমাত্র নিজের বিষেই জ্বলে মরতে পারে। আমি সাদেককে এই বিষ সংগ্রহের কাজে লাগিয়ে দিই। নার্সিংহোমে আমি মুগাবালির সুরক্ষার জন্য তার শরীরে বিশেষ মন্ত্রপূত নুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তার সাহায্যেই জ্বীন্নাতুন কোথায় আছে তা জানা আমার পক্ষে সহজ হয়ে যায়। জ্বীন্নাতুন প্রতি মাসে যেখানেই নিজের বিষ মুক্ত করে সাদেক সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর জ্বীন্নাতুন শিকার করে চলে গেলে, সেই শিকার করা ব্যক্তির শরীর থেকে সিরিঞ্জের সাহায্যে যতটা পারে বিষাক্ত রক্ত টেনে নেয়। এই ভাবে গত এক বছর ধরে বারো জন শিকারের শরীর থেকে বিষ আমরা জমা করেছি। একটু আগে সাদেক এসেছে শেষবারের মতো সংগ্রহ করা বিষ দিতে। এখন যতটা বিষ জমা হয়েছে তা জ্বীন্নাতুনকে শেষ করার জন্য যথেষ্ট। এবার যখন জ্বীন্নাতুন শিকার করতে যাবে এই বিষ তার শরীরে ইনজেক্ট করে দিলেই কাজ শেষ হবে। 

এবার আমি চিঠি শেষ করব। শেষ করার আগে বলতে চাই আমার একটা ভুলের জন্য আমার মাতৃভূমি, আমার দেশ আজ ধ্বংসের মুখে। এরপর আমার আর এই পৃথিবীতে থাকার কোনো মানে হয় না। আমার নিজের পৈতৃক বাড়ি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে আমার স্থাবর অস্থাবর যা সম্পত্তি আছে তা যাতে দুর্যোগ পীড়িত মানুষের কাজে আসে সেই ব্যবস্থাটা তুমি একটু করে দিও। আমি এই চিঠির সাথেই পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি তোমাকে দিয়ে গেলাম। তুমি আমার ভালোবাসা আর আশীর্বাদ নিও। তোমার আগামী দিন যেন অনেক ভাল ও সুখে কাটে সেই কামনাই করি।

—ইতি 

তোমার দুর্ভাগা পীরসাহেব

এই লম্বা চিঠিটা যখন পড়া শেষ হয়েছে তখন সকলে লক্ষ্য করল জ্বীন্নাতুনের শরীর গলতে শুরু করেছে। হাত, পা, মাথা সব যেন গলে গিয়ে এক কালো চিটচিটে তরলের রূপ নিচ্ছে। সেই সাথে গোটা ঘর ভরে যাচ্ছে এক অপার্থিব পুতি গন্ধে। রজত আর সৈকত সমেত বাকি পুলিশকর্মীরা রুমের বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। এদিকে গার্গী , গৌরব, সুমিত ও সুনিতাও তখন সেখানে এসে হাজির হয়েছে। রজতদের ওইভাবে বেরিয়ে আসতে দেখে গার্গী প্রথম কথা বলে উঠল,

-“কী হয়েছে রজত?”

রজত তখন ভিতরের ঘটনা গার্গীদের বলল। চিঠিটাও দেখাল। চিঠি পড়ে সুনিতা বলে উঠল,

-“সবই তো বুঝলাম কিন্তু জ্বীন্নাতুন পীরসাহেবকে এইভাবে মারল কেন?”

রজত বলল,

-“আসলে গাইলান তার সঙ্গে বেইমানি করা হয়েছে বুঝতে পেরে জ্বীন্নাতুনকে পাঠায় বেইমানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। জ্বীন্নাতুন প্রথম থেকেই পীরসাহেবকে খুঁজছিল। আর পীরসাহেব লেগেছিলেন জ্বীন্নাতুনের পেছনে। আজকে জ্বীন্নাতুন কোনোভাবে পীরসাহেবের ঠিকানা জানতে পারে। সে এসেছিল শুধু পীরসাহেবকে মারতে কিন্তু তার আগেই সে বাধা পায় সাদেকের কাছে। তাই সাদেক জ্বীন্নাতুনের স্বীকার হয়। এদিকে যতক্ষণ না জ্বীন্নাতুন কারোর শরীরে বিষ ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ততক্ষন পীরসাহেব জ্বীন্নাতুনের শরীরে ঐ বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করতে পারতেন না। তাই নিজেকে জ্বীন্নাতুনের টোপ হিসাবে ব্যবহার করলেন। আর সেই সুযোগে তার শরীরে বিষ ঢেলে দিলেন। জ্বীন্নাতুনের শরীরে এখন বিষের পরিমাণ এতো বেশি হয়ে গেছে যে তা গোটা শরীরকে গলিয়ে দিচ্ছে।”

গার্গী বলে উঠল,

-“পীরসাহেবের মতো মানুষ রাগে অন্ধ হয়ে এমন কাজ করবেন ভাবিনি।”

রজতের চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে বলল,

-“পীরসাহেব খাঁটি মানুষ ছিলেন গার্গী। কিন্তু গাইলান জ্বীন তার আর তার পিতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে এইসব অপকর্ম করিয়েছিল। আসলে পীরসাহেবের পূর্বপুরুষ এর আগে গাইলানকে বন্দী করতে সাহায্য করেছিলেন। তার প্রতিশোধ গাইলান এতো দিনে নিতে পেরেছিল। প্রতিশোধ স্পৃহা গাইলানের ছিল , পীরসাহেবের নয়। যার মন প্রাণ জুড়ে এতটা স্নেহ মমতা সে কি খারাপ চিন্তা করতে পারে !”

সৈকত বলে উঠল -” ওই মৃতদেহগুলোর কি হবে?”

-“আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে জ্বীন্নাতুনের শরীর সম্পূর্ন নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর জমজমের পানি দিয়ে ঘরটা শোধন করে পীরসাহেব আর সাদেকের মৃতদেহ তোমরা নিয়ে যেতে পারবে। পীরসাহেবের শেষ কৃত্য আমি করব। ওঁর ছেলে যা করতো।”

বিষয় মৌলিকত্ব
0
ভাষা সাবলীলতা
0
কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা প্রবাহ
0
শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ
0
অডিও/ভিডিও রূপান্তর যোগ্য
0
Average
 yasr-loader

About Post Author

9F10 DA

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মনতত্ব | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | রিতেশ দাস | Bengali Thriller Story | 9F10