Getting your Trinity Audio player ready...
|
গীতাঞ্জলী মেট্রো স্টেশনের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা বৈষ্ণবঘাটা লেনের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তায় রথতলা বাজার। সেইখানে নলিনী দে বাইলেনে গতকাল দুপুরে সুনীল দত্ত নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোককে রাস্তার মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। পড়ে থাকা ব্যক্তিটির পরণে ছিল ব্রান্ডেড পোষাক ও দামী জুতো। তার শরীরের চারপাশ তখন টাটকা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। সুনীল দত্ত এই রাস্তার শেষ বাড়ির বাসিন্দা। মধ্য তিরিশের সুনীল উত্তরাধিকার সূত্রে একটি গ্রীলের দোকানের মালিক। সে সেইসময় তার গ্রীলের দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিল। তখন প্রায় বেলা সাড়ে তিনটে বাজে। সুনীল আনমনে রাস্তায় হাঁটছিল। হঠাৎ একহাতের মধ্যে একজন লোককে পড়ে থাকতে দেখে সে বিষম চমকে যায় এবং হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর একটু হলেই সে লোকটার শরীরে পা বেঁধে হয়তো পড়েই যেত। এরপরে তার চোখ পড়ে লোকটার পিঠের দিকে। সেখানে তখন আমূল বেঁধানো ছিল একটা ছুরি বা ছোরা গোছের কিছু। এই দৃশ্য দেখে সে এতটাই হকচকিয়ে গেছিল যে প্রথমে কিছুক্ষণ নড়তেই পারেনি। তখনও লোকটার হয়তো প্রাণ ছিল কারণ সুনীল তার ডান হাতটা মাটির ওপর একটু নড়তে দেখে। তা দেখে সুনীল সম্বিত ফিরে পায় এবং প্রাণপণ চীৎকার করে সামনের বাড়ির রবীনবাবুকে ডাকতে থাকে। এটা জৈষ্ঠ্য মাস। এবছর গরমও পড়েছে দাপিয়ে। দুপুর এগারোটা বাজতে না বাজতেই এ গলির সব বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ হয়ে যায়। সুনীলের চীৎকারে রবীনবাবু ছাড়াও আরো কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ আশেপাশের বাড়ির থেকে বেরিয়ে আসে। রাস্তার ওপর একজন ছুরিবিদ্ধ রক্তাক্ত মানুষকে দেখে তারা তখন যারপরনাই ভীত ও সন্ত্রস্ত। রবীনবাবু তার স্ত্রীকে মোবাইল আনতে বলেন এবং মোবাইল থেকে লোকাল থানায় ফোন করে সমস্ত ঘটনাটা জানান। এইসময়টা সাধারণত পাড়াতে মহিলার সংখ্যাই বেশি থাকে। এছাড়া থাকে কিছু রিটায়ার্ড মানুষ। বাকিরা যে যার কাজে স্কুলে কলেজে বা অফিসে বেরিয়ে যায়। এপাড়ার বেশিরভাগ বাড়ি বহু পুরানো আর তার বাসিন্দারাও পরস্পরের যথেষ্ট পরিচিত। এ গলিতে সবই বাড়ি। একটি মাত্র চারতলা ফ্ল্যাট হয়েছে মিত্তিরদের বাড়ি ভেঙে। ফ্ল্যাটের কিছু পরিবারের সাথে পরিচিতি বাড়লেও সব পরিবারকে পাড়ার সবার এখনও চেনা হয়নি কারণ সেই পরিবারগুলি ফ্ল্যাট কিনলেও এখানে থাকেন না। তাদের ফ্ল্যাটগুলি তালাবন্ধই পড়ে থাকে। রবীনবাবুর ফোনের মিনিট দশেকের মধ্যেই হুটার বাজিয়ে একটি পুলিশের গাড়ি আর একটি অ্যাম্বুল্যান্স প্রায় একসাথেই এসে হাজির হয়। নাকতলা থানার আই সি পল্লব মজুমদার নিজে এসেছেন, সাথে চারজন কনস্টেবল, একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর আর তার ট্রেনার। লোকটার নাড়ি দেখে পল্লব মজুমদার হতাশ গলায় বললেন,
– মনে হচ্ছে আর কিছু করার নেই।
লোকটির শরীর আর পোষাক ভালো করে পরীক্ষা করলেন তিনি। প্যান্টের পকেট থেকে পার্স, একটি পকেট চিরুণী, রুমাল আর হাতের আঙুল থেকে একটি আঙটি নিয়ে একজন কনস্টেবলকে রাখতে দিয়ে তাকে চারিদিকটা ভালো করে দেখতে বললেন কোথাও কোন মোবাইল পড়ে আছে কিনা। তারপর নিজে জায়গাটা ভালো করে ঘুরে দেখলেন বিশেষত গলিতে ঢোকার আর বেরোনোর পথগুলো। গলিটা সাকুল্যে পাঁচফুট চওড়া এবং ব্লাইন্ড। দুপাশে গোটা কুড়ি বাড়ি। পড়ে থাকা লোকটির ডানহাতের দিকে স্যান্যালদের বাড়ি আর বাঁ হাতের দিকে রবীন দাশগুপ্তর বাড়ি। গলির ভিতরের দিকে মাথা করে লোকটি একটু তেরছা ভাবে উপুড় হয়ে পড়েছিল। তার ডানহাতটা ছিল লম্বাভাবে গলির বাঁধানো অংশের বাইরে মাটির মধ্যে। সেখানে ধুলোর মধ্যে একটা গোল দাগের মতো কিছু দেখে পল্লব মজুমদার খুঁটিয়ে দেখলেন এবং ক্যামেরাম্যানকে জায়গাটার ছবি তুলতে বললেন। দাগটার সম্বন্ধে ভাবার চেষ্টা করলেন। লোকটি কি কিছু লেখার চেষ্টা করেছিল নাকি যন্ত্রণায় ছটফট করার জন্য এমন হয়েছে ? তারপর কুকুরটিকে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন একজন কনস্টেবলকে। ট্রেনার কুকুরটিকে নিয়ে লোকটির কাছে আসতেই সে মৃত ব্যক্তির আপাদমস্তক শুঁকে রবীনবাবুর বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়ালো একটুক্ষণ তারপর বড় রাস্তার দিকে ছুটল। ট্রেনার আর একজন কনস্টেবল তার সাথে সেদিকে চলে গেল। মোড়ের কাছে গিয়ে কুকুরটি একটু ডানদিকে বাস স্টপেজটায় খানিক দাঁড়িয়ে সে আর কোনদিকেই এগোলো না। একজন ফটোগ্রাফার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে পড়ে থাকা লোকটার ছবি তুলে নিল। আই সি মৃত লোকটিকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দিয়ে রবীনবাবুর কাছে এসে বললেন,
– পাড়ায় যারা উপস্থিত আছেন তাদের সাথে একবার কথা বলতে চাই রবীনবাবু বিশেষত যিনি প্রথম এই লোকটিকে দেখেন তার সাথে।
রবীনবাবুর বাড়ির একতলার বসার ঘরে সেইমতো ব্যবস্থা করা হল। এদিকে পুলিশ ততক্ষণে গলির মুখ কর্ডন করে দিয়েছে। যাতে বাইরের লোক ঢুকতে না পারে। আপাতত এখানে একজন কনস্টেবল পাহারায় থাকবে। এই ঘটনাটুকুর মধ্যে পাড়ার লোকজন মৃত লোকটিকে যা দেখল তা এরকম, লোকটি ফর্সা, স্বাস্থ্যবান আর একটু ছোটখাটো চেহারার। পোষাকআশাকে তাকে বিত্তবান বলেই মনে হয়। কিন্তু পাড়ার কেউ তাকে চিনতে পারলো না। এই বাইলেনটা ব্লাইন্ড। সুতরাং সে কোথায় যাচ্ছিল এ প্রশ্ন রয়েই গেল সবার মনে। আই সি একে একে উপস্থিত সকলের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। সবার বক্তব্য মোটামুটি একই রকম। এই সময়টা সবার বিশ্রামের সময়। সেই মতো বেশিরভাগ সবাই যে যার নিজের বাড়িতেই ছিলেন। সুনীলের চিৎকারেই সবাই বাইরে আসেন এবং এরকম ভয়ংকর একটি দৃশ্য দেখেন। তাদের সবার বাড়িতে কজন থাকে, তারা কে কি করেন এবং আজ দুপুরে কারো বাড়িতে বাইরের কেউ এসেছিল কিনা, এসে থাকলে সে কখন চলে গেছে ইত্যাদি সব তথ্য খাতায় নথিবদ্ধ করে আই সি সুনীলকে ডাকলেন। সে বেচারি ভয়ানক ভয় পেয়েছিল। সে যা বলল তা এরকম যে সে একবেলা দোকান করে বলে দুটো আড়াইটে অবধি দোকান খোলা রাখে। তারপর মাল গুছিয়ে দোকান বন্ধ করে প্রতিদিন এরকম সময়েই বাড়ি ফেরে। আজও তাই ফিরছিল। সে অন্য কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ফিরছিল তাই লোকটাকে খেয়ালই করেনি। একেবারে সামনে এসে লোকটাকে তার চোখে পড়ে। এই দৃশ্য দেখে সে এতটাই ভয় পেয়েছিল যে প্রথমে চীৎকার করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিল। লোকটার ডান হাতটা নড়তে দেখে সে সম্বিত ফিরে পায়। সবচেয়ে কাছে রবীনকাকুর বাড়ি বলে আর রিটায়ার্ড হওয়ার কারণে ইদানীং তিনি বাড়িতে থাকেন বলে তাকেই ডাকে। বাকি সবাইও তখন বেরিয়ে আসে। এর বেশি সে আর কিছু জানে না। এই লোকটাকে সে আগে কখনো দেখেনি। আই সি তাকে জিজ্ঞেস করে,
– আপনি যখন গলিতে ঢুকছিলেন তখন আশেপাশে অন্য কাউকে দেখেছিলেন ?
সুনীল একটু ভেবে বলে,
– আসলে আমি এতটাই আনমনা ছিলাম ঠিক খেয়াল করিনি গলির মুখে কেউ ছিল কিনা। তবে গলির মধ্যে মনে হয় কেউ ছিল না। তবে আমি একশোভাগ নিশ্চিত নই।
আই সি বললেন,
– ঠিক আছে আপনি বাড়ি যান। পরে যদি কিছু মনে পড়ে তবে অবশ্যই জানাবেন। আর হ্যা এখন আমাদের না বলে বাইরে কোথাও যাবেন না।
সুনীল সম্মতি জানিয়ে ভীত মুখে বাড়ি চলে গেল। সব শেষে রবীনবাবুর সাথে কথা শুরু করলেন আই সি। রবীন দাশগুপ্ত রিটায়ার্ড হয়েছেন আজ ছমাস। বাড়িতে তারা চারজন থাকতেন। তিনি, তার স্ত্রী চারু, ছেলে বিভান আর মেয়ে ঝুম। আজ দুমাস ছেলে পুণেতে, সে ইঞ্জিনিয়ার সেখানে চাকরি করে। আর মেয়ে এই মূহুর্তে কলেজে, সে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে লিটারেচারে মাস্টার্স করছে। এই লোকটিকে তারা কখনো দেখেননি। রবীনবাবুর স্ত্রী এলেন। চারুদেবী বেশ ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। তিনি বললেন এরকম ঘটনা এখানে ঘটাটা খুবই আশ্চর্যের কারণ এপাড়ার সবাই খুব শান্তিপ্রিয় লোক। সেরকম ইয়ং ছেলেও নেই গন্ডগোল ঘটানোর মতো। সুতরাং পুলিশ যেন দেখে যে ওদের দৈনন্দিন জীবনে কোন সমস্যা তৈরি না হয়। আই সি বললেন,
– আপনারা চিন্তা করবেন না। কিন্তু আপনার আর স্যান্যালদের বাড়ির সামনে যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছে তাই আপনাদের ভবিষ্যতে দরকার হতে পারে। আশা করি সাহায্য পাব।
রবীনবাবু বললেন,
– যখন দরকার হবে বলবেন আমি সবসময় আছি।
আই সি উঠতে উঠতে বললেন,
– হ্যা আর একটা কথা, কোন অচেনা লোককে দেখলে আমাদের জানাবেন। খুনীর মনস্তত্ব বলে সে অকুস্থলে একবার হলেও আসতে চায়।
রবীনবাবুর চোখেমুখে একটু ভয়ের ছায়া উঁকি মারলো। তিনি বললেন,
– কি কান্ড বলুন তো। এমন শান্তিপ্রিয় পাড়ায় এসব কি শুরু হল। লোকটা যে এই গলিতে কেন ঢুকেছিল ?
– হুম সেটাই তো ভাবাচ্ছে রবীনবাবু। আর একটা কথাও ভাবাচ্ছে। লোকটার মোবাইলটা গেল কোথায় ? খুনী নিয়ে গেল ? যাই হোক ভিকটিমের ছবি পাঠিয়ে দেব আপনার মোবাইলে। এই মূহুর্তে পাড়ায় যারা উপস্থিত নেই তারা ফিরলে দেখাবেন কেউ যদি চিনতে পারে। আমি বিকালে একবার আসব।
আই সি চিন্তামগ্ন মুখে কথাগুলো বলে ফিরে গেলেন থানায়। পুলিশ চলে গেলে পাড়াটা আবার নিঝুম হয়ে পড়ল। শুনশান গলিটাতে রবীনবাবুর বাড়ির সামনের গুলঞ্চ গাছটার ছায়ায় একজন কনস্টেবল শুধু রইল পাহারায়। রবীনবাবু নিজের বাড়ি থেকে একটি চেয়ার সেখানে পাঠিয়ে দিলেন।
পল্লব মজুমদার অনেকক্ষণ থানায় ফিরে এসেছেন। তিনি অত্যন্ত চিন্তামগ্ন। সামনে টেবিলের ওপর একটা ট্রেতে রাখা রয়েছে বৈষ্ণবঘাটা বাইলেনের মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া জিনিসপত্র। সবই মামুলি জিনিস, যা সাধারণ ভাবে একটি ছেলের কাছে থাকে। কোনকিছু থেকেই কোন সূত্র মিলছে না। পার্স থেকে হাজার দুয়েক টাকা, কিছু খুচরো পয়সা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য কোন ফোন সাথে পাওয়া যায়নি। লোকটার পরিচয় বের করার জন্য সব থানায় ছবি পাঠানো হয়ে গেছে। তবে কালকের আগে কোন মিসিং ডাইরি আশা করা যায় না। হয়তো আজ রাতে বা কাল সকালে কোথাও মিসিং ডাইরি হতে পারে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট না আসা অবধি অনেক কিছুই বোঝা যাবে না। ছুরিটাও ফরেনসিকে গেছে। ফোন না থাকাটা ভারী আশ্চর্যের এবং এ যুগে অসম্ভবও বটে আবারও ভাবলেন পল্লব মজুমদার। হয়তো খুনি ফোনটা নিয়ে চলে গেছে। কোনও পরিচয় সূত্রও মিলছে না। এখন শুধু অপেক্ষা করে থাকা কারো মিসিং ডাইরির। এ যেন খড়ের গাদায় ছূঁচ খোজা। প্রতিদিন এই শহর কলকাতায় কতজন যে নিখোঁজ হয় আর তার অর্ধেকের কোন মিসিং ডাইরিও হয় না। তার মধ্যে থেকে খুঁজে বের করতে হবে এই লোকটির পরিচয়।
দুদিন কেটে গেছে। এখনো এই লোকটার জন্য কোন মিসিং ডাইরি হয়নি। ঘটনার দিন বিকেলে আরেকবার পাড়ার লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন বিশেষত যারা সেদিন দুপুরে অনুপস্থিত ছিলেন তাদেরকে। তেমন কিছু সূত্র মেলেনি। ফ্ল্যাটে এই মূহুর্তে আটটি পরিবার থাকে। তাদের সাথেও কথা হয়েছে। বাকি চারটির মালিক বাইরে থাকে। এই গলির বেশিরভাগ বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকে। বিবাহ বা চাকরি সূত্রে। ইয়ং ছেলে মেয়ে যারা এখানে আছে তারা হল রবীনবাবুর মেয়ে ঝুম, সাহাদের দুই ছেলে আর স্যান্যালদের এক মেয়ে। সেদিন দুপুরে তারা সবাই স্কুল বা কলেজে ছিল। তাদের সাথেও কথা হয়েছে। ঝুম এবং স্যান্যালদের মেয়েকে আপাতত বাদ দেওয়া যায়। একে অল্পবয়সী মেয়ে তায় কলেজে থাকার সাক্ষী আছে। আর সাহাদের ছেলেদুটি যমজ, মাত্র ক্লাস এইটে পড়ে। পল্লব মজুমদার তার এস আই মণীষকে বললেন,
– বুঝলে মণীষ কেসটা ভোগাবে বলে মনে হচ্ছে। আরে বাবা কিছু তো একটা পাওয়া যাবে যা ধরে এগোনো যায়। আর লোকটির বাড়ির লোকও দেখো, একটা খোঁজও নেয় না।
– আচ্ছা স্যার লোকটা তো কলকাতার বাইরে মানে মফঃ স্বল থেকেও আসতে পারে।
বলল মণীষ। পল্লব মজুমদার বললেন,
– সেটা ভেবেই আজ কলকাতার বাইরের থানাগুলোকেও জানাতে বলেছি যদি ওখানে কোন মিসিং ডাইরি হয়ে থাকে।
– আরেকটা কথা স্যার লোকটার ডানহাতের কাছে মাটিতে কিছু আঁকিবুঁকি কাটা ছিল। ওটা দেখে কিছু বুঝলেন ? মণীষ জিজ্ঞেস করল।
পল্লব মজুমদার বললেন,
– হয় আচমকা আঘাতে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়ে ছটফট করেছে তখনই হাতটা মাটিতে ঘষে ওরকম হয়েছে অথবা কিছু লেখার চেষ্টা করেছে। বিকেলে আর একবার ভালো করে দেখব ভেবেছিলাম কিন্তু গিয়ে দেখি ঘেঁটে গেছে, চৈত্রের এলোমেলো হাওয়া তারপর পাড়ার লোকেরা দেখতে গেছে। তবে সকালে আর বিকালে দুবারই ছবি তুলে রেখেছি।
পল্লব মজুমদারের এই সব কথার মধ্যেই থানায় ঢুকল রাজীব ভদ্র। সে উত্তর কলকাতার বাগবাজার থানার আই সি। পল্লব মজুমদার আর সে একই ব্যাচের ছেলে। এদিকে কোন দরকারে এসেছিল তাই বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছে। পল্লবের চিন্তিত মুখ দেখে সে বলল,
– কি ব্যাপার ? মুখে আষাঢ়ের মেঘ কেন ?
– আরে আয় আয়। তেমন কিছু না তবে একটা কেস একটু ভোগাচ্ছে রে। কোথাও কোন ক্লু না ছেড়েই একটা লোক অমৃতধামে যাত্রা করেছে।
সহাস্যে বলল পল্লব মজুমদার।
– ভারি অন্যায়। আমাদের মতো অবলা নিরীহ থানার বাবুদের কথা একবার তো তার চিন্তা করা উচিত ছিল।
এই কথা বলে রাজীব হো হো করে হেসে উঠল।
– হাসছিস? হাস। এদিকে ওপরমহল থেকে যে চাপ আসতে চলেছে। ভদ্র, নির্ঝঞ্ঝাট পাড়ায় এমন ঘটনা।
পল্লব বিমর্ষ মুখে বলল। রাজীব তখন পল্লবকে বলল,
– দেখ নিশ্চয়ই কোন ক্লু পেয়ে যাবি আর খুব অসুবিধায় পড়লে দুজনকে দিতে পারি যারা তোকে আনঅফিশিয়ালি সাহায্য করতে পারে।
– তারা আবার কারা ?
– আমার এক বন্ধুর দুই ভাইঝি। বাচ্চা মেয়ে। নাম দৈ আর চিনি। গতবছর ওদের পাড়ার একটা কেসে আমাকে খুব সাহায্য করেছিল।
নাম শুনে পল্লব হেসে ফেলল। তারপর বলল,
– দৈ আর চিনি ?
– ওতো ডাকনাম। ভালো নাম অদিতি আর আত্রেয়ী। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। একবার কথা বলে দেখতে পারিস। ফোন নম্বরটা তোকে দিয়ে যাচ্ছি।
বলে রাজীব ফোন ঘেঁটে একটা ফোন নম্বর কাগজে লিখে টেবিলে রেখে উঠল।
আরো দুদিন কাটল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে। তাতে লেখা আছে বাঁদিকের কাঁধের নীচে একটা গভীর ক্ষত হয়েছিল কোন তীক্ষ্ম অস্ত্রের আকস্মিক আঘাতে। ছুরিটি বাঁ স্ক্যাপুলার প্রান্ত ঘেঁষে ঢুকে গিয়ে বাঁ লাংসে প্রবেশ করেছিল। লাংসে আঘাতই তার মৃত্যুর কারণ। অস্ত্রের ফরেন্সিক রিপোর্টে কোন হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত খুনী গ্লাভস পরে ছিল। কোন ধস্তাধস্তির চিহ্নও পাওয়া যায়নি। তার মানে হয়তো লোকটি খুনীর উপস্থিতি আগে থেকে টের পায়নি। ছুরিটিও ফেরত এসেছে। সেটি লম্বায় প্রায় সাড়ে এগারো ইঞ্চি, তার মধ্যে হাতলই পাঁচ ইঞ্চি। ফলার সাড়ে ছয় ইঞ্চির প্রায় পাঁচ ইঞ্চি ভেতরে প্রবেশ করানো ছিল। আধ ইঞ্চি চওড়া ফলার ছুরিটা হিলহিলে চেহারার। সবজি কাটার জন্য আজকাল যেরকম স্টেনলেস স্টীলের ছুরি পাওয়া যায় বাজারে সেইরকম। এই ছুরি সাধারণভাবে খুনের কাজে লাগে না। তাহলে কি খুনী আগে থেকে প্রস্তুত ছিল না তাই হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে এসেছে। তাহলে খুনী কি কাছেপিঠেই থাকে। এইসব হাজারো চিন্তার মধ্যেই রবীনবাবুর ফোন এল কেসটার গতিপ্রকৃতি জানতে। খুব একটা আশার কথা শোনাতে পারলেন না পল্লব মজুমদার। ওনারা এখনও বেশ ভয়ে আছেন। আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল তদন্তের বিন্দুমাত্র অগ্রগতি ঘটেনি। লোকটার কোন খবর এখনও পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে আর একটা ট্রাক চুরির কেস থানায় এসে পড়েছে। ট্রাকটি একজন মাঝারি মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সুতরাং এখন এটাই থানার প্রায়োরিটি। পল্লব মজুমদার চিন্তিত মুখে টেবিলের কাগজ সরাতে গিয়ে রাজীবের ফোন নম্বর লিখে দেওয়া টুকরো কাগজটি দেখতে পেল। একটু ইতস্তত করে থানার ফোন থেকে কাগজের নম্বরটাতে ডায়াল করল সে। ওপ্রান্তে কিছুক্ষণ বাজার পর একটি মেয়ের গলা পাওয়া গেল।
– হ্যালো কাকে চাইছেন ?
– আমি নাকতলা থানার আই সি পল্লব মজুমদার বলছি। রাজীব ভদ্র আমাকে নম্বরটা দিয়েছে।
– ও রাজীবকাকু ? আচ্ছা বলুন। কি দরকার।
– আমি ইয়ে মানে দৈ বা চিনির সাথে কথা বলতে পারি ?
– শুনুন আমি আত্রেয়ী মুখার্জি। চিনি আমারই নাম। অদিতি মানে দৈ আমার দিদি।
একটু গাম্ভীর্য নিয়ে বলল চিনি।
– হ্যাঁ চিনি ইয়ে মানে আত্রেয়ী আমি একবার আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই একটা কেসের ব্যাপারে।
– কেসের ব্যাপারে ? আমাদের সাথে ? ঠিক আছে আপনি আধঘন্টা পরে ফোন করুন।
ফোন নামিয়ে চিনি দৈ কে সব বলল। দৈ তখন সবে একটু দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের তোড়জোড় করছিল। তাড়াতাড়ি উঠে বসে রাজীব ভদ্রকে ফোন করে নিশ্চিত হল পল্লব মজুমদারের ব্যাপারে। রাজীব ভদ্রও ওদেরকে অনুরোধ করল পল্লব মজুমদারের কথা একটু শোনার জন্য।
সেইদিনই সন্ধ্যাবেলা। পল্লব মজুমদার উত্তর কলকাতার অনির্বাণ মুখার্জির বাড়ির বৈঠকখানায় বসে আছেন। সামনে দৈ আর চিনি। অনির্বাণ মুখার্জি দৈ আর চিনির বাবা। পল্লব মজুমদার অনির্বাণ মুখার্জির সাথে কথা বলতে বলতে মেয়ে দুটিকে ভালো করে দেখছিলেন। দুটি মেয়েই সাধারণের চেয়ে বেশ লম্বা এবং সুন্দরী। স্লিম চেহারা। বড়জন ছোটজনের তুলনায় শান্ত। কিন্তু আচার আচরণে দুজনেরই বেশ ব্যক্তিত্ব আছে। বাচ্চা মেয়ে দুটোকে শুরুতে দেখে একটু অসহায়ই বোধ করে ছিলেন এই ভেবে যে পুরোটাই না পন্ডশ্রম হয়ে যায় এখন মনে হল সেটা মনে হয় ভুলও হতে পারে। যাই হোক সমস্ত ঘটনাটা তিনি ওদেরকে খুলে বললেন। তারপর ওদের একবার থানায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া জিনিসপত্র দেখার জন্য। পরের দিন দৈ আর চিনি বাড়ির গাড়িতে গেল নাকতলা থানায়। কনস্টেবল মণীষ বাজেয়াপ্ত করা সব জিনিস ওদের দেখালে দৈ অনেকক্ষণ ছুরিটা নেড়েচেড়ে দেখল। ঘটনার দিন তোলা সব ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখল তারপর লোকটার ডানহাতের সামনের মাটিতে কিছু আঁকিবুঁকির তোলা ছবি দেখে পল্লবকে বলল,
– এই ছবিগুলো আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দিতে পারবেন ?
পাড়ার সবার পরিচয় আর তাদের এজাহারের একটা জেরক্স কপি নিল। তারপর বলল,
– কাকু এমনও তো হতে পারে লোকটা কলকাতারই নয়। তাহলে সেক্ষেত্রে জেলার থানাগুলোকেও তো লোকটির ছবি পাঠিয়ে ওইদিন বা তার পরের মিসিং ডাইরি চাইতে পারেন।
এই প্রথম পল্লব মজুমদার নড়েচড়ে বসল। না মেয়েদুটোর বয়স কম হলেও বুদ্ধি ততটা কম নয়। তিনি বললেন,
– গতকালই সেই সম্ভাবনার কথা মনে আসাতে ছবি দিয়ে খবর পাঠিয়েছি পার্শ্ববর্তী জেলার থানাগুলোতে। দেখা যাক কিছু খবর আসে কিনা। দৈ আর চিনি ফিরে গেল।
থানা থেকে ফিরে অবধি দৈ আর চিনি নিজেদের ঘরে রয়েছে। দৈ এর মাস্টার্স কমপ্লিট। এবার এম ফিল করার ইচ্ছা। ভবিষ্যতে সে গবেষণা করতে চায়। এখন ছুটি তাই একজন স্যারের একটা প্রজেক্টের কিছু কাজ করে দিচ্ছে। টেবিলের ওপর রাখা সেইসব কাগজপত্রে সে চোখ বোলাচ্ছিল। চিনি বিছানায় শুয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিল। হঠাৎ চিনি বলল,
– আচ্ছা দিদি বলতো মৃত লোকটার ছবি বা পোস্টমর্টেম দেখে কি খুনীর সম্বন্ধে কিছু ধারণা করা যায় ?
দৈ মুখ না তুলে বলল,
– দু একটা কথা তো বোঝাই যায়।
– যেমন ?
– এক, খুনী মৃত ব্যক্তির থেকে লম্বা আর দুই, সে খুব শক্তিশালী না অথবা পেশাদার খুনী নয়।
চিনি বলল,
– কারণ বল।
– যদি বেঁটে বা সমান হত তবে ছুরির আঘাতটা আরো নীচে হত। আর শক্তিশালী হলে ছুরিটা হাতল অবধি শরীরে ঢুকে যেত। কিন্তু এখানে তা হয়নি। সাড়ে ছয় ইঞ্চি ফলার পাঁচ ইঞ্চি মতো ভেতরে ছিল।
– ঠিক। আরো একটা জিনিসও কিন্তু বোঝা যায়।
– সেটা কি ? দৈ জিজ্ঞেস করে।
– এই ধর খুনী বড় রাস্তার দিক থেকে এসেছিল। ভিতর দিক থেকে এলে ছুরিটা বুকের দিক দিয়ে ঢুকতো আর মাথাটা বড়রাস্তার দিকে থাকতো।
দৈ বলল,
– লোকটার ডানহাতের কাছের আঁকিবুঁকির দুটো প্রিন্ট আউট বের করেছি দেখ ভালো করে। দৈ দুটো কাগজ এগিয়ে দিল চিনির দিকে। চিনি উঠে বসে লাইট জ্বালল। তারপর কাগজ দুটো খাটে রেখে দেখতে লাগল। অনেকটা জুম করে প্রিন্ট আউট বের করেছে দৈ। একটা সকালের আর একটা বিকালের। দেখতে দেখতে চিনি লাফিয়ে উঠল
– আরে এটা কি ? এটাতো একটা ইংরাজী অ্যালফাবেট। সম্ভবত সি অথবা ও। মৃত্যু আসন্ন জেনে ধুলোর মধ্যে আঙুল দিয়ে কারো নামের আদ্যক্ষর লেখার চেষ্টা করেছিল নাকি লোকটা ?
দৈ বলল,
– মনে তো হচ্ছে তাই। এবার পরেরটা দেখ।
পরের ছবিটা সেদিন বিকালে তোলা। অক্ষরটা ঘেঁটে গেছে। মুছে যায়নি তবে লেখাটার ওপর কিছুর ছাপ বা আস্তরণ পড়েছে। একটা চাপা ভি অক্ষরের মতো। চিনি বলল,
– এটা কি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে অনেক লোক ভিড় করে দেখেছে তাদের জুতোর ছাপ হতে পারে। কুকুর বিড়ালও হেঁটে যেতে পারে।
তাই শুনে চিন্তিত গলায় দৈ বলল,
– হুম। ভাবতে হবে।
পরের দিন দুপুরে পল্লব মজুমদার ফোন করে একটা খবর দিলেন। উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতে একটা মিসিং ডাইরি হয়েছিল নাকতলার ঘটনার দুদিন পরে। তাতে যে ছবি দেওয়া আছে সেটা এই ব্যক্তিরই। তিনি সেই ব্যাপারে খোঁজখবর করতে বারাসাত থানায় যাচ্ছেন ওরা চাইলে সাথে যেতে পারে। চিনি কলেজে তাই দৈ একাই যাবে বলল। দুপুর দুটো নাগাদ দৈ পল্লব মজুমদারের সাথে বারাসাত থানায় পৌছালো। পল্লব মজুমদার সেখানকার আই সি সুকান্ত নন্দীকে দৈ এর পরিচয় দিল ভাইঝি বলে। বারাসাত ইউনিভার্সিটিতে ভাইঝির একটা কাজ আছে তাই সাথে এসেছে। সুকান্ত নন্দী তাদের নিয়ে চলল বারাসাত ব্যারাকপুর রোডের ওপর বড়বেড়িয়া বলে একটি জায়গায়। সেখানেই একটি বাড়ির দোতলার দুখানা ঘরে ভাড়া থাকতো এই লোকটি। যাওয়ার পথে সুকান্ত নন্দী যা জানালেন তা এরকম। ঘটনার দুদিন পরে একজন শীর্ণকায় মধ্যবয়সী লোক থানায় এসে বলে তার বাবু দুদিন ধরে বাড়ি ফেরেননি। সে এখানকার রাস্তাঘাট বা মানুষজন তেমন কিছুই চেনে না তাই কোথায় খবর নেবে কিছুই বুঝতে পারছিল না শেষে লোককে জিজ্ঞেস করে করে থানায় এসেছে। তার নাম মদন সাধু। বাবুর বাড়ির সব কাজকর্ম সেই করে। তার বাবুর নাম দিলীপ সামন্ত। তিনি ডাক্তার। এইসব কথা বলতে বলতেই তারা পৌঁছে গেলেন বড়বেড়িয়া। বড় রাস্তা থেকে কিছুটা ভেতরে রাস্তার ওপর একটা ছোট দোতলা বাড়ি। নীচতলায় একটা বন্ধ দোকানঘর। বাকি লাগোয়া অংশটাও তালা দেওয়া। দোকানঘরের গা দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। দোতলার বারান্দায় একটা গামছা ঝুলছে। সিঁড়ির দরজা বন্ধ। সেই বন্ধ দরজার পাশের কলিংবেলে চাপ দিতেই ওপরের বারান্দা থেকে মুখ বাড়ালো একটি শীর্ণকায় লোক। পুলিশের গাড়ি আর সুকান্ত নন্দীকে দেখে নীচে নেমে এসে লোকটি দরজা খুলে দিল। লোকটির পিছনে পিছনে ওরা ওপরে উঠে একটা ছোট ঘরে বসল। ঘরটাতে একটা সোফা আর দুটো বেতের মোড়া পাতা। সোফার পাশে একটা কাঠের টেবিল। তাতে কিছু বইপত্র, প্যাড, পেন আর ফটোস্ট্যান্ডে একটা ছবি। সেটা মৃত দিলীপ সামন্তের। দৈ বইগুলো একটু ঘেঁটে দেখে একটা বই সবার অগোচরে নিজের ব্যাগে ঢোকাল। এদিকে সুকান্ত নন্দী তখন মদন সাধুকে পল্লব মজুমদারের পরিচয় দিয়ে বলছেন,
– যেদিন তোমার বাবু নিখোঁজ হয়েছেন সেদিন এনার থানা এলাকায় একজন খুন হয়েছে যার চেহারা তোমার বাবুর সাথে মেলে তাই ইনিই তোমার সাথে কথা বলবেন আর তোমার বাবুর ঘর একটু ঘুরে দেখবেন।
মদন সাধু খুনের কথা শুনে প্রথমে কেমন থতমত খেয়ে গেল তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে বসে থাকার পর পল্লব মজুমদার হাতের ব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে মদন সাধুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– দেখো তো একে চেনো কিনা ?
মদন সাধু একটু ঝুঁকে ছবিটা দেখে আবার ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
– এ তো আমার বাবু। এমন কি করে হল স্যার ?
বলে আবার কাঁদতে থাকল। পল্লব মজুমদার বললেন,
– আমি তোমার কাছে কিছু জানতে চাই। তুমি ঠিকঠাক উত্তর দিও।
এরপর প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে মধ্যে দিয়ে যা জানা গেল তার একটা সংক্ষিপ্ত নোট দৈ মোবাইল ঘাঁটার অছিলায় ফোনে তুলে রাখল। দিলীপ সামন্ত অকৃতদার ব্যক্তি। তার আদি বাড়ি যশোরে। আত্মীয়স্বজন সব সেখানে। দিলীপ সামন্ত স্কুল জীবন থেকেই এদেশে থাকে। এসব কথা সে বাবুর কাছেই শুনেছে। এই দুবছরে বাবুর কোন আত্মীয়স্বজনকে সে দেখেনি। বছর দুয়েক আগে মদনকে কাজে রাখে। মদনের বাড়ি বনগাঁর অনেক ভিতরে। বিয়ে থাওয়া করেনি। এর আগে যে বাড়িতে থাকতো সেই বাবু আর গিন্নিমা ছেলের কাছে বিদেশে চলে যাওয়ার সময় তাকে এই বাবুর কাছে দিয়ে যায়। বাবু পাশ করা ডাক্তার কিনা সে বলতে পারবে না কিন্তু কলকাতায় রুগী দেখতো বলে শুনেছে। বাবু দু এক মাস অন্তর তিন চার দিনের জন্য একটা কোথাও যেতেন তবে সেটা কোথায় মদন জানে না। বাবুর অবশ্যই মোবাইল ছিল, দামী মোবাইল। মোবাইল নম্বরটা একটা ছোট খাতা দেখে মদন পল্লব মজুমদারকে দিল। এরপর ঘরদুটো সার্চ করা হল। তেমন কিছু পাওয়া গেল না। দৈ ভাবল দিলীপ সামন্ত কি জানতো তাকে কোনওদিন পুলিশ খুঁজতে আসতে পারে তাই তার ঘরবাড়ি সযত্নে এমন সূত্রহীন করে রেখেছিল। এমনকি কাজের লোকটিও তার বাবু সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ। একজন ডাক্তার অথচ তার ঘরে একটা ওষুধের চিহ্নও দেখা গেল না। একসময় কথাবার্তা শেষ করে তারা ফেরার জন্য উঠল।
গাড়িতে বসে দিলীপ সামন্তের মোবাইল নম্বরে ফোন করলেন পল্লব মজুমদার। সুইচড অফ। তিনি বললেন,
– এটাই স্বাভাবিক।
আরো কয়েকটা দিন কেটে গেছে। এরমধ্যে দৈ একদিন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে গেছিল স্যারের সাথে দেখা করতে। রবীনবাবুর মেয়ে ঝুমের ডিপার্টমেন্টে কিছু খোঁজখবর করে এসেছে। এদিকে দিলীপ সামন্তের বাড়ির থেকে আনা বইটা দেখে চিনি অবাক। বইটা রুপান্তরকামীদের ওপর লেখা। সেটা রুপান্তরকামীদের নিয়ে কোন গল্পের বই নয়, রূপান্তরকামীদের ইতিহাস এবং রূপান্তর ঘটানোর পদ্ধতির মতো নানা বিষয় সেখানে লেখা। এমন একটা বই দিলীপ সামন্তের টেবিলে কেন ? প্রশ্নটা শুনে দৈ বলল,
– এদের বিষয়ে কৌতূহলী ছিলেন হয়তো অথবা কেউ পড়তে দিয়েছিল। আমরা কি আত্মহত্যা বা খুনের বিষয়ে জানতে আগ্রহী হই না।
দৈ এবার বলল,
– ওকথা এখন থাক। পাড়ার সকলের বয়ান তো দেখলাম। ঝুম আর স্যান্যালদের বাড়ির মেয়ে ঐন্দ্রিলার সাথে কথা বলা দরকার। তুই একদিন যাদবপুর ইউনিভার্সিটি যা। পরিচয় না দিয়ে কথা বল। ও আর একটা কথা ঝুমের ভালো নাম চন্দ্রাণী দাশগুপ্ত।
– স্যান্যালদের মেয়ের সাথেও একবার কথা বলা উচিত নয় কি ? চিনি বলল।
দৈ বলল,
– আশুতোষে পড়ে, বিষয় সাইকোলজি। আমার এক বান্ধবীর বোন আছে একই বিভাগে। আমি যোগাযোগ করে চলে যাব। আমার কেবলই মনে হচ্ছে এই দুটো মেয়ে হয়তো কিছু ভয়ে চেপে যাচ্ছে বিশেষত সেদিন এই দুজন কলেজে বেরিয়েছিল যে সময়ে পোস্টমর্টেমে মৃত্যুর সময়টা তার চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টার মধ্যে।
এর মধ্যে দৈ পল্লব মজুমদারের কাছ থেকে খবর নিয়েছে দিলীপ সামন্তর কোন খবর পাওয়া গেছে কিনা। না এখনো কিছু জানা যায়নি। লোকটি কোন অজ্ঞাত কারণে তার কাজের ক্ষেত্রটিকে সবার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছিল। তবে ওনারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বারাসাত এবং কলকাতা মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে নাম ঠিকানা জানিয়েছেন। কাল খবর পাওয়া যাবে ওই নামে কোন ডাক্তার ছিলেন কিনা। পরের দিন ফোন এল পল্লব মজুমদারের কাছ থেকে। দিলীপ সামন্ত নামে কোন ডাক্তার পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সে ডাক্তার নয়, হাতুড়ে। আর দুটো খবর পল্লব মজুমদার জানালেন। এক, সুনীল দত্ত জানিয়েছেন যে তার পরে একটা কথা মনে পড়েছে। ঘটনার দিন তিনি যখন গলিতে ঢুকছিলেন তখন গলির মুখে বাসস্ট্যান্ডে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মাথায় টুপি আর চোখে সানগ্লাস ছিল। বোধহয় হাতে কনুই অবধি গ্লাভস ছিল ওই আজকাল রোদের থেকে বাঁচবার জন্য যেমন পরে সবাই। একটা বাস আসলে ছেলেটি তাতে উঠে যায়। আর দুই, দিলীপ সামন্তের মোবাইলটা ঘটনার দিন খুনের পর থেকেই বন্ধ। সম্ভবত সিম মোবাইল থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে। দৈ এর কাছে সব শুনে চিনি বলল,
– ব্যাপারটা ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। যাই হোক আমি আজ অহনাদের বাড়ি যাচ্ছি। অহনার দিদি মোহনাদি যাদবপুরে ইতিহাসে মাস্টার্স করছে। যতটা সম্ভব খবর এনে দেবে বলেছে। ও কেমন স্বভাবের, বন্ধুরা কেমন, ক্লাসের পরে কাদের সাথে মেশে বা কোথায় যায় ইত্যাদি।
– বেষ্ট অব লাক চিনি।
– চন্দ্রাণীর চেহারার একটা বৈশিষ্ট্য আছে বুঝলি আত্রেয়ী। লম্বা ছিপছিপে চেহারা, কাটা কাটা চোখ নাক, ঘাড়ের কাছে ছোট করে ছাঁটা চুল, কিছুদিন আগে অবধিও জিনস আর টিশার্ট ওর কমন পোষাক ছিল। ডান হাতে ঘড়ি পড়ে। ঘড়ি ছাড়া একেবারে নিরাভরণ, কানে দুল অবধি নেই। বেশ সুন্দরী কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিটা বেশ গেছো টাইপের।
বলল অহনার দিদি মোহনা।
চিনি উদগ্রীব হয়ে বলল,
– আর কিছু ?
মোহনা বলল,
– খবর যা পেলাম চন্দ্রাণী পড়াশোনায় বেশ ভালো। খেলাধুলাতেও ছেলেদের সাথে পাল্লা দেয়। বান্ধবীর থেকে বন্ধুর সংখ্যা বেশি। ওদের সাথে ভিড়ে স্মোক টোকও করত। ছুটির শেষে ওদের সাথেই গল্প করত ঘুরতে যেত।
– যাক অনেক খবর দিলে। আজ উঠি মোহনাদি।
চিনি উঠছিল। মোহনা বলল,
– আর একটা কথা আত্রেয়ী, ওর ক্লাসের একটা মেয়ে বলল মাস দুয়েক যাবত চন্দ্রাণীর মধ্যে একটা চেঞ্জ দেখা যাচ্ছে।
চিনি চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল,
– সেটা কি ?
– ও এখন সালোয়ার কামিজ বা পালাজো কুর্তি বেশি পড়ে আসে। আর খুব একটা ক্লাসের বাইরে বেরোয় না। একটু গয়নাও পরে। ওর ক্লাসের মেয়েটি বলছিল বোধহয় বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
চিনি চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরল।
বাড়ি ফিরে দেখল দৈ আগেই এসে গেছে। সন্ধ্যের টিফিন খেতে খেতে দৈ চন্দ্রাণীর কথা সব শুনল। তারপর তার সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলল। স্যান্যালদের মেয়ের নাম ঐন্দ্রিলা। একটু ভীতু স্বভাবের। কিছুদিন আগে একটা বাজে ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরে এবং তা নিয়ে তার বাড়িতে আর কলেজে যথেষ্ট জলঘোলা হয়। ছেলেটা আর তার বন্ধুরা ঐন্দ্রিলাকে খুব শাসিয়ে ছিল সম্পর্ক ভাঙলে দেখে নেবে বলে। শেষ অবধি কলেজ ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা মেটে। তারপর থেকে ঐন্দ্রিলা নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখে।
– একটা জিনিস খেয়াল করেছিস চিনি একজনের নাম সি দিয়ে আর একজনের নাম ও দিয়ে। দিলীপ সামন্ত হয়তো সি বা ও গোছের কিছু ধুলোর মধ্যে লিখতে চেয়েছিল।
দিদির কথা শুনে চিনি বলল,
– কেন আরেকটা সি আছে তো। চারুদেবী। রবীনবাবুর স্ত্রী।
দৈ বলল,
– হুম সেটাও ঠিক। তবে খুঁজলে পাড়ায় কি আরো দু চারজন ও বা সি পাওয়া যাবে না?
এরপর নিজেদের মধ্যে কিছু পরামর্শ সেরে দৈ পল্লব মজুমদারকে ফোন করে বলল তারা চন্দ্রাণী আর ঐন্দ্রিলার সাথে সরাসরি ওদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে চায়। সেইমতো পরেরদিন ওই পাড়ায় যাওয়া ঠিক হল। পল্লব মজুমদার রবীনবাবুকে খবর দিয়ে দিলেন যে ওনার সাথে দুটি মেয়ে যাবে পাড়ার মেয়েদের কথা বলতে।
দৈ এখন ঐন্দ্রিলার দোতলার ঘরে বসে তার সাথে কথা বলছে। ঐন্দ্রিলা মাথা নীচু করে উত্তর দিচ্ছে। কলেজের ব্যাপারে বেশ কিছুক্ষণ কথা চলার পর দৈ চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল,
– তুমি সব কিছু বাড়িতে জানাতে পারতে অথবা প্রশাসনের সাহায্য চাইতে পারতে। তোমার তো কলেজের ব্যাপারটাতে কোন দোষ ছিল না।
ঐন্দ্রিলা মুখ না তুলে বলল,
– শেষে মা সব জানতো কিন্তু তখন যা জানাজানি হওয়ার হয়ে গেছিল।
– ছেলেটা কি এখনো তোমাকে থ্রেইট করে ?
– নিজে আসে না দলের ছেলেদের দিয়ে রাস্তায় বিরক্ত করে কখনো কখনো।
– এই লোকটা কি ওর দলের কেউ ?
– আমি তা জানি না। কোনদিন দেখিনি। তবে দিদি আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন যদি এই লোকটা ওদের দলের হয়েও থাকে আমি কিন্তু এ ব্যাপারে সত্যিই কিছু জানি না।
– আমিতো বলিনি ঐন্দ্রিলা তুমি কিছু জানো। তবে ক্রমাগত মার খেতে খেতে কারো তো মার দিতেও ইচ্ছে করতে পারে তাতে অন্যায় কোথায় ? শুধু পথটা সঠিক হতে হবে। ঠিক আছে আমি উঠি। যদি তোমার আর কিছু বলার থাকে তবে জানিও। আর একটা কথা ঝুমের সাথে তোমার কতটা বন্ধুত্ব ?
– ঝুম মানে চন্দ্রাণী ? ঝুম ছোট থেকে খুব ডানপিটে ছিল। একটু ছেলে ছেলে ভাব, পাড়ার ছেলেদের সাথেই বেশি মিশতো। তাই খুব বন্ধুত্ব নেই।
ঐন্দ্রিলা কথাগুলো বলে চুপ করে গেল। দৈ এবার জিজ্ঞেস করল,
– ঘটনার দিন খুনের চল্লিশ মিনিট আগে তুমি কলেজের জন্য বেরিয়েছিলে তখন পাড়ার কারো সাথে দেখা হয়েছিল ?
একটু ভেবে ঐন্দ্রিলা উত্তর দিল,
– তখন দুপুরবেলা রাস্তায় কেউ ছিল না। শুধু ঝুমের সাথে বাস স্টপেজে দেখা হয়েছিল। ও ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিল।
– ওর পরণে কি ছিল ?
– লেগিংস আর কুর্তি। চোখে সানগ্লাস আর হ্যা হাতে ও যেমন গরমে গ্লাভস পরে তাই। আমিও অবশ্য ওরকম গ্লাভস পরি খুব রোদে গেলে।
দৈ ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল স্যান্যাল গিন্নী দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন,
– অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা কিন্তু এই ব্যাপারে ও কিন্তু কিছুই জানে না। ওকে মিথ্যা জড়াবার চেষ্টা করবেন না।
তার চোখে এক মূহুর্তের জন্য যেন আগুন দেখল দৈ। সে কিছু না বলে নেমে এল।
চিনিও চন্দ্রাণীর সাথে কথা সেরে নিয়েছে। ফেরার পথে চিনি পার্ক সার্কাস অঞ্চলের একটা ঠিকানা লেখা কার্ড পল্লব মজুমদারের হাতে দিয়ে বলল,
– কাকু এখানে একটু খোঁজ নিতে হবে। কোন ডাক্তার বসেন তিনি কিসের স্পেশালিস্ট। আমার কেমন মন বলছে এখানে কিছু আছে।
সেদিন বিকালে দৈ খুব চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসে আছে দেখে চিনি বলল,
– সুনীল দত্তের দেখা ছেলেটির এই ঘটনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে কি বলিস দিদি।
দৈ বলল,
– সেটা ঠিক। তবে ঝুম বা ঐন্দ্রিলাকে এখনই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। ওদের দুজনেরই একটা অতীত আছে। যেটা বেশ জটিল। সুনীল দত্তকেও ছেড়ে দেওয়া যায় কি ? সে যে সব সত্যি বলছে তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে। দেখা যাক পার্ক সার্কাসের ঠিকানাটা থেকে পল্লবকাকু কিছু মণিমুক্তো আবিস্কার করতে পারেন কিনা। আচ্ছা চন্দ্রাণীর সাথে কি কথা হল ?
চিনি একটু গুছিয়ে বসে বলল,
– শোন চন্দ্রাণীকে তার বন্ধুদের কথা জানতে চেয়েছিলাম। আর জানতে চেয়েছিলাম দুমাস আগে কি ঘটেছিল যে তার সাজে পোষাকে আর ব্যবহারে এমন পরিবর্তন এসেছে। সে বলল বাড়িতে বিয়ের কথা চলছিল তাই মা তাকে পোষাক পরিবর্তন করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে সে খুনের ব্যাপারে কিছু জানে না আর এই লোকটিকেও চেনে না।
– ঠিকানাটা পেলি কোথায় ? দৈ এর কৌতুহলী প্রশ্ন শুনে চিনি বলল,
– এটা একটু অদ্ভুত ভাবে রবীনবাবুর বাড়ি থেকে পেয়েছি। আমি চন্দ্রাণীর সাথে কথা বলতে গেলে ওর সাথে সিঁড়ির মাঝখানে আমার দেখা হয় ও তখন কিছু বাজে কাগজ সিঁড়ির কোণায় রাখা ময়লা রাখার বাস্কেটে ফেলছিল। তারপর আমরা ওর ঘরে বসে কথা বলি। ফেরার সময় আমাকে এগিয়ে দিতে হবে না বলে যখন আমি নীচে নামছি তখন সামনে কেউ ছিল না। কি মনে হতে সিঁড়ির মাঝে থাকা ময়লার বাস্কেটটা হাতড়াই। অল্পই কাগজ ছিল আর এই কার্ডটা যাতে ডক্টরস চেম্বার কথাটা আর একটা ঠিকানা লেখা ছিল। ভাবলাম নিয়ে যাই। সেটাই পল্লবকাকুকে দিয়েছি।
পরেরদিন বিকালে পল্লব মজুমদারের ফোন এল। খুব উত্তেজিত গলা। দিলীপ সামন্তের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে অন্য নামে। সুদীপ জৈন। এই নামেই একটা ঘর নেওয়া আছে সেখানে। চারদিকে মুসলিম মহল্লা। ছবি দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। ছবি দেখে আশেপাশের লোক বলে ইনিই এখানে ডাক্তারি করতেন। তবে তিনি সাধারণ রোগ খুব একটা দেখতেন না। তার রোগীরা একটু কেমন যেন। মানে হিজড়ে গোছের আরকি। এসব শুনে একজন ইনফর্মারকে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সে এক্ষুণি খবর দিল দিলীপ সামন্ত ওরফে সুদীপ জৈন ট্রাসজেন্ডারদের দালাল ছিল। ডাক্তার টাক্তার কিছু নয়। ওটা ছদ্মবেশ। এখান থেকে একটু অন্যরকম ছেলে মেয়ে ধরে পাটনার কোথাও পাঠাতো অপারেশনের জন্য। তার টার্গেট ছিল পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলেমেয়েরা। ওই চেম্বার সার্চ করে একজন সাইকোলজিস্টের কার্ড পাওয়া গেছে। তোমাকে কার্ডটার ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর একটা কথা দিলীপ সামন্তের খুব একটা সুনাম নেই। খবর পেলাম ছেলেমেয়েদের এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের নাকি নানাভাবে এক্সপ্লয়েটও করতো। সুতরাং খুনের অ্যালিবাইটা কিছুটা ধরা যাচ্ছে। এরকম লোকের অনেক শত্রু থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই গলিতে কেন ? নলিনী দে লেনের দোকানদারদের কাছে খোঁজখবর করাতে আর একটা কথা জানা গেছে। গলির মুখের পানের দোকানের মালিক জানিয়েছে ঘটনার দিন সে যখন দোকান বন্ধ করে রাস্তার ওপারে অটোর জন্য অপেক্ষা করছিল তখন সে ঝুম ওরফে চন্দ্রাণীকে গলিতে ঢুকতে দেখেছিল। সময়টা তিনটে হবে। অর্থাৎ ঝুম একবার বাড়ি এসেছিল কিন্তু কেন? রবীনবাবুই বা এটা চেপে গেলেন কেন ? এদিকে রবীনবাবু ফোন করেছিলেন ওনার মেয়ের ইউনিভার্সিটি শেষ হয়েছে তাই তাকে তার দাদার কাছে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে পাঠাতে চান। জিজ্ঞেস করছিলেন আমাদের আপত্তি আছে কিনা। এদিকে সুনীল দত্তও বাইরে যেতে চাইছেন, তার অনেকদিন আগেই টিকিট কাটা রয়েছে মধ্যপ্রদেশ বেড়াতে যাবার। দৈ বলল,
– আপনি কি অনুমতি দিয়েছেন ?
– না বলেছি কয়েকদিন পরে জানাচ্ছি।
আচ্ছা কাল কথা হবে বলে দৈ ফোনটা রেখে দিল। চিনি ফিরলে দৈ এর মুখে সব শুনে বলল,
– হু হু বাবা ট্রান্সজেন্ডার, সুদীপ জৈনের নাম না লিখা ভিজিটিং কার্ড, তাও আবার ঝুমদের বাড়িতে, এ তো লম্বা চেইন।
পরেরদিন দুপুরে দৈ আর চিনি বাড়ির গাড়িতে চলল নাকতলা থানায়। পল্লব মজুমদারকে বলা ছিল। ওরা পৌছাতেই পল্লব মজুমদার বলল,
– এখনি যাবে ?
দৈ বলল,
– হ্যা চলুন। প্রস্তুতি নিয়েই যাবেন।
ওরা বড়রাস্তায় গাড়ি আর ফোর্স রেখে গলিতে ঢুকল। দৈ বলল,
– ওয়ারেন্ট এনেছেন তো কাকু ?
পল্লব মজুমদার চিন্তিত মুখে ঘাড় কাত করে বললেন,
– আমি কিন্তু এখনো কিছু জানি না।
– একটু পরেই জানতে পারবেন।
বলল দৈ ওরফে অদিতি।
বেল বাজাতেই দরজা খুললেন চারুদেবী। একটু যেন বিরক্ত হলেন। চিনি ভাবল হওয়ারই কথা যখন তখন হামলা করলে বিরক্ত তো হবেনই। দৈ বলল,
– একটু চন্দ্রাণীকে ডেকে দেবেন।
উনি বসতে বলে ভেতরে গেলেন। একটু পরে চন্দ্রাণী, চারুদেবী আর রবীনবাবু একসাথে এলেন। পল্লব মজুমদার ঝুমকে বললেন,
– চন্দ্রাণী ঘটনার দিন তুমি কলেজে বেরিয়েছিলে দুটোর সময়। ইউনিভার্সিটি গেলেও ক্লাস করোনি। ছটার সময় বাড়ি ঢুকেছিলে। এটা আমরা জানি কিন্তু তুমি যে তিনটে নাগাদ একবার বাড়ি এসেছিলে সেটা তো জানাওনি। আর একটা কথা বেরোবার সময় হাতে রোদের গ্লাভস থাকলেও ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার সময় তা ছিল না। কেন ?
– রোদ পড়ে গেছিল তাই খুলে ফেলেছিলাম।
চন্দ্রাণী মৃদুস্বরে জানাল।
– তুমি সেদিন বেরিয়ে আবার বাড়ি এসেছিলে কেন ? পোষাক বদলাতে ? টুপি নিতে ? সেদিন সালোয়ার পরে বেরোলেও বিকালে ফিরছিলে জিনস টিশার্ট আর জ্যাকেট পরে। পাল্টালে কখন ? মাঝে বাড়ি এসে ? সেটা খুনের আগে না পরে ?
চন্দ্রাণী কোন উত্তর না দিলেও চারুদেবী উত্তেজিত হয়ে বললেন,
– এ কিরকম কথা। সেদিন ইউনিভার্সিটি গিয়ে শোনে একটা ক্লাসের শেষে বন্ধুরা মিলে একটা জায়গায় যাবে। তাই মাঝখানে এসে পোষাক পাল্টে যায়। বেরোনোর সময় আমি দরজা বন্ধ করতে এসেছিলাম। তখন কোন ঘটনা এখানে ঘটেনি। কিন্তু পোষাক পাল্টানোর সাথে খুনের সম্পর্ক কি ?
পল্লব মজুমদার বললেন,
– সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি চারুদেবী। আপনি বা ঝুম এটা লুকোলেন কেন ?
ঝুম বলল,
– বলিনি কারণ ভয় পেয়েছিলাম যদি এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে যাই তাই।
রবীনবাবু বললেন,
– তোমরা এসব কি বলছ ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
রবীনবাবু প্রায় মারমুখী হয়ে উঠলে চারুদেবী তাকে শান্ত করলেন। তারপর পল্লব মজুমদারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আপনারা কি আমার মেয়েকে এই খুনে অভিযুক্ত বলে ভাবছেন ?
সে কথার উত্তর কেউ দিল না। দৈ চন্দ্রাণীকে বলল,
– এখন যে প্রশ্ন করা হবে তার ঠিকঠাক উত্তর দাও চন্দ্রাণী।
চন্দ্রাণী মৃদুস্বরে বলল বলুন কি জানতে চান।
– তুমি ছোটবেলায়, না শুধু ছোটবেলায় বলছি কেন কিছুদিন আগে অবধিও বেশ টমবয় গোছের ছিলে, ছেলেদের পোষাক পরতে গয়নাগাঁটি পরতে না সেটা বর্তমানে পাল্টে গেছিল। তুমি কি এই ব্যাপারে সাইকোলজিস্টের সাহায্য নিয়েছো ? না বল না যেন। আমি সেই সাইকোলজিস্টের কাছ থেকে তোমার খবর নিয়েছি। তা সাইকোলজিস্টের কাছে তুমি নিজে গেছিলে নাকি কেউ তোমাকে পাঠিয়েছিল ?
দৈ এর এই প্রশ্ন শুনে চারুদেবী বললেন,
– এর সাথে এই খুনের কি সম্পর্ক ? ও ছোট থেকে দাদার সঙ্গী তাই ওর সবকিছু দাদার মতো হয়েছিল। এখন বড় হয়ে বুঝতে পারছিল এটা ঠিক নয় কিন্তু বদলাতে পারছিল না তাই সাইকোলজিস্টের সাহায্য নিয়েছে। এটা কি অপরাধ ?
পল্লব মজুমদার বললেন,
– চন্দ্রাণীর উত্তর চন্দ্রাণীই দেবে চারুদেবী আপনি নন। আর হ্যাঁ সম্পর্ক একটা থাকতেও পারে। সেটাই আমরা খোঁজার চেষ্টা করছি। বলো চন্দ্রাণী।
চন্দ্রাণী ধীরে বলল,
– মা বুঝিয়েছে তাছাড়া আমি নিজেও বুঝেছি তাই সাইকোলজিস্টের কাছে গেছিলাম।
– কিন্তু এই বোঝাবুঝিতে দামটা বোধহয় একটু বেশিই পড়ে গেল তাই না কি ? বলল দৈ।
কথাটা শুনে এক মূহুর্তের জন্য চন্দ্রাণী চমকে উঠল বলে মনে হল দৈ এর। এবার দৈ বলল,
– গ্লাভস আর মোবাইলটা কোথায় ফেললে চন্দ্রাণী ? লুকিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। তথ্য প্রমাণ সবই তোমার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তাই সত্যি কথা তোমাকে বলতেই হবে।
চারুদেবী আর পারলেন না উত্তেজিত হয়ে বললেন,
– আপনারা কি জানেন আমাদের বলুন। আপনাদের ভুলও তো হতে পারে।
দৈ বলল,
– ঠিক আছে যা জানি তার কিছুটা বলছি। কিছু ভুল বললে চন্দ্রাণী বা চারুদেবী ধরিয়ে দিতে পারেন। যদিও আমার ধারণা চারুদেবীও সবটা জানেন না। রবীনবাবু তো ননই।
দৈ বলতে শুরু করল,
– চন্দ্রাণী আচার আচরণে পোষাক পরিচ্ছদে ছোটবেলা থেকে একটু ছেলেসুলভ ছিল। পাড়ায় এটা নিয়ে বিরুদ্ধ মনোভাব দেখলেও ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ও স্বস্তি পেয়েছিল কারণ যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে এসব খুবই সাধারণ ব্যাপার। সেখানে ওর মতন অনেক ছেলেমেয়েই ছিল। তাদের সাথে বন্ধুত্ব হতে চন্দ্রাণীর দেরি হয়নি। এইটুকু অনেকেই জানে। এর পরেরটুকু আমাদের তথ্য নির্ভর অনুমান তবে প্রমাণ করতে সময় লাগবে না। ইউনিভার্সিটির এরকম বিরুদ্ধ মনের ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে মিশতেই বোধহয় চন্দ্রাণী ট্রান্সজেন্ডার কথাটা নিয়ে ভাবা শুরু করে। আমি ঠিক বলছি তো চন্দ্রাণী ? যাই হোক যা বলছিলাম, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা দুঃসাহসী হয়, বাঁধনছেড়া হতে চায়, সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। চন্দ্রাণীরও তার বন্ধুদের কথা শুনে, তাদের অন্য সত্ত্বায় পরিবর্তিত হওয়ার উদগ্র বাসনা দেখে একবারের জন্যও হয়তো ইচ্ছা হয়েছিল নিজেকে পাল্টে ফেলার। সেই ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে সে বন্ধুদের কাছ থেকে ঠিকানা পাওয়া একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে। খুন হওয়া দিলীপ সামন্ত সেই ডাক্তার যদিও চন্দ্রাণী তাকে সুদীপ জৈন বলে জানতো। চন্দ্রাণী বোধহয় তার কাছে জানতে চেয়েছিল খরচ ও প্রক্রিয়া। এই সুদীপ জৈনের কথামতো এবং এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হিসাবে সে একজন সাইকোলজিস্টের কাছে যায়। এখানে বলে রাখা ভালো এই তথ্য আমি ওই সাইকোলজিস্টের কাছ থেকেই পেয়েছি। চন্দ্রাণী তার কাছে কয়েকটা সেশনও নিতে থাকে এই কথা বোঝার জন্য যে সে সত্যিই এই রূপান্তরটার জন্য মানসিক ভাবে তৈরি কিনা এবং অল্পদিনেই বুঝতে পারে সে মানসিকভাবে এতো বড় কাজের জন্য তৈরি নয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই সে একটা বিশ্রী চক্রের মধ্যে পড়ে যায়। কারণ সুদীপ জৈন কোন ডাক্তার ছিল না। সে ছিল আসলে একজন ট্রান্সজেন্ডারদের দালাল। ডাক্তার সেজে এইসব রূপান্তরকামী ছেলেমেয়েদের সব ব্যবস্থা করে দেবে বলে আশ্বাস দিতো। যারা শেষ অবধি আগ্রহী থাকতো তাদের পাটনার কোন নার্সিংহোমে পৌঁছে দেওয়াই ছিল তার কাজ। তার বদলে মোটা টাকা দালালি পেত। এদিকে সুদীপ জৈন কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে যায় যে চন্দ্রাণী শেষ অবধি পিছিয়ে আসতে পারে তাতে তার আর্থিক লাভের সম্ভাবনা শূণ্য। তাই সে অন্য খেলা শুরু করে। সাধারণত এরকম ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে যা করতো চন্দ্রাণীর ক্ষেত্রেও তাই করতে থাকে অর্থাৎ ব্ল্যাকমেল। চন্দ্রাণীর ফোন নম্বর ঠিকানা তার জানা হয়ে গেছিল। বাড়িতে আর পাড়ায় সব প্রকাশ করে দেবে বলে সম্ভবত চন্দ্রাণীকে শারীরিক নিগ্রহও করে। বারবার তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে তার সাথে সময় কাটানোর জন্য। চন্দ্রাণী বোধহয় রাজি হয় না। তখনই সে চন্দ্রাণীকে ফোন করে তার বাড়িতে আসার কথা জানায়। সেদিন চন্দ্রাণী সম্ভবত ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পথে ফোনটা পায়। চন্দ্রাণীর ফোন ঠিকমতো পরীক্ষা করলেই এটা জানা যাবে। চন্দ্রাণী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে কি করবে। সে মাঝপথে বাড়িতে ফিরে এসে পোষাক পাল্টে জিনস টিশার্ট পরে ও তার ওপর একটা জ্যাকেট চাপায়, টুপি পরে। তার উদ্দেশ্য ছিল তাকে দেখে যেন ছেলে বলে মনে হয়। এছাড়া সানগ্লাস আর গ্লাভস তো পরাই ছিল। এই অবধি চারুদেবীর জানা। একটা ছুরি সম্ভবত চন্দ্রাণী আগেই সংগ্রহ করে রেখেছিল ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সেটা নিয়ে বেরিয়ে বড়রাস্তার কোথাও সে অপেক্ষা করতে থাকে। কি এতো অবধি ঠিক আছে তো চন্দ্রাণী ?
চন্দ্রাণী মুখে হাত চাপা দিয়ে বসে থাকে। দৈ আবার বলতে শুরু করে।
– একটা সময় দিলীপ সামন্ত আসে এবং গলিতে ঢোকে। চন্দ্রাণী রাস্তার ওপর পার থেকে আসতে আসতে দিলীপ সামন্ত প্রায় তাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে যায়। চন্দ্রাণী নিঃশব্দে তার পিছনে এসে দাঁড়ায় এবং প্রচন্ড ক্ষিপ্রতার সাথে ছুরিটি আমূল ঢুকিয়ে দেয় দিলীপ সামন্তের পিঠে। সম্ভবত দিলীপ সামন্তের হাতেই ফোনটা ছিল। আঘাত পাওয়াতে সেটা ছিটকে পড়ে আর চন্দ্রাণী মোবাইলটা তুলে নিয়ে চলে যায় বড় রাস্তার দিকে। কিছুক্ষণ বাসস্টপে দাঁড়ায় এবং বাস ধরে ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়। এই বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকার সময় সুনীল দত্ত তাকে এক পলক দেখে ছেলে ভাবে। ছুরিকাঘাতের পর দিলীপ সামন্ত আর্তনাদ করেছিল কিনা জানি না তবে করলেও কারো কানে যে যায়নি তার কারণ হয়তো সব বাড়িতে সেই সময় দরজা জানালা বন্ধ ছিল ও টিভি চলছিল।
কথা শেষ হতেই রবীনবাবু বলে ওঠেন,
– আপনারা আপনারা এসব কি বলছেন মিঃ মজুমদার ? এটা ঠিক আমার মেয়ে ছেলেদের মতন বেশভূষা করতো কিন্তু সে তো এখন সব মেয়েরাই করে তার জন্য ও ডাক্তার বা সাইকোলজিস্টের কাছে যাবে কেন ? আর যদি যেতো আমরা বাবা মা কি কিছু জানতে পারতাম না ?
– আপনি হয়তো জানতেন না তবে আমার ধারণা চারুদেবী কিছুটা জানতেন। নইলে তিনি চন্দ্রাণীর সেদিন দ্বিতীয়বার বাড়ি আসার কথাটা চেপে যেতেন না।
বললেন পল্লব মজুমদার। চারুদেবী শান্ত গলায় বললেন,
– ওই শয়তানটাকে সুযোগ পেলে আমিই হয়তো মারতাম। ঝুম আমাকে সপ্তাহ খানেক আগেই সব জানিয়েছিল। এও বলেছিল লোকটা বাড়ি আসতে পারে। আমি ওকে অভয় দিয়ে তৈরি হয়েছিলাম লোকটার সামনাসামনি হওয়ার জন্য। কিন্তু ঝুম সেদিন বাড়ি এসেছিল কারণ ওর বন্ধুদের সাথে একটা প্রোগ্রাম ছিল যেখানে ওয়েস্টার্ন পরার কথা ও ভুলে গেছিল তাই। ও খুন করেনি। আর আমি কারোকে বলিনি ভয়ে পাছে আপনারা ওকে সন্দেহ করেন।
– কিন্তু চারুদেবী ওর বেরোনো ফিরে আসা আবার বেরোনোর সবকিছুরই সাক্ষী রয়ে গেল যে। তাছাড়া সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য, সেখান থেকেই পাওয়া যাচ্ছে দিলীপ সামন্তের সাথে যোগাযোগের কথা। আর একটা কথা দিলীপ সামন্তের ভিজিটিং কার্ড যেটা আমাদের আসার কথা শুনে তল্লাশির ভয়ে চন্দ্রাণী ময়লা ফেলার বাস্কেটে ফেলেছিল সেটা চিনি কুড়িয়ে নিয়েছিল এবাড়ি থেকেই।
বললেন পল্লব মজুমদার। ঝুম একটু সোজা হয়ে বসল তারপর পল্লব মজুমদারের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– হয় দিলীপ সামন্ত মরতো নয় আমাকে মরতে হত। দিলীপ সামন্তের কপাল মৃত্যুর আগে বেশিক্ষণ যন্ত্রণা পায়নি কিন্তু ওই নোংরা লোকটা যদি বেঁচে থাকতো তবে আমায় তিলে তিলে মরতে হত। আরো কতজনকে যে এরকম ভাবে নষ্ট করেছে ওই লোকটা সেটা কি আপনারা জানেন। আমি কোন অন্যায় করিনি স্যার বরং অনেকের সাথে করা অন্যায়ের শোধ নিয়েছি। আগেরদিন আত্রেয়ীদিদি যখন বাজে কাগজের বাস্কেট থেকে সুদীপ জৈনের ভিজিটিং কার্ডটা তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেদিনই বুঝে ছিলাম আপনারা যে কোনদিন আসবেন আমার খোঁজে। মা মিথ্যাই চেষ্টা করছিল আমাকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার। মা’কে আপনারা সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারেন। মা আমার দ্বিতীয়বার বাড়িতে আসার সঠিক কারণটা জানেন না। আপনারা বলুন আমাকে কোথায় যেতে হবে আমি প্রস্তুত। আমাকে কি হাতকড়া পরাবেন ?
দৈ এর চোখটা কড়কড় করে উঠল। চিনি তখন দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
পল্লব মজুমদার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
– না না সেসবের দরকার নেই।
তারপর রবীনবাবু আর চারুদেবীর দিকে ঘুরে বললেন,
– আপনারা একটু ধৈর্য্য রাখবেন।
দুদিন কেটে গেছে। আজ মুখার্জি বাড়ির বৈঠকখানায় নাকতলা থানার আই সি পল্লব মজুমদার, বাগবাজার থানার আই সি রাজীব ভদ্র এসেছেন দিলীপ সামন্ত ওরফে সুদীপ জৈনের হত্যা রহস্য সমাধানের বিভিন্ন অধ্যায়গুলো আলোচনা করতে। বিশেষত যে পর্যায়গুলো একান্তই দৈ আর চিনির তত্ত্বাবধানে ছিল। ওদের মা সবার জন্য কিছু খাবার নিয়ে ঢুকলেন। দৈ বলতে শুরু করল।
– নাকতলা থানায় মৃতদেহ, অকুস্থলের ছবি আর বাকি বাজেয়াপ্ত জিনিস দেখে আমি আর চিনি কয়েকটা ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসি। এক, খুনী আগে থেকে গলির ভিতরে ছিল না। সে বড় রাস্তার দিক থেকে এসেছিল কিন্তু গলিটা সে ভালোমতো চিনতো। দুই, খুনী মৃত ব্যক্তির থেকে লম্বা ছিল কারণ ছুরিটা গেঁথেছে বাঁদিকের কাঁধের কিছু নীচে। বেঁটে বা সমান হলে আর একটু নীচে ছুরি গাঁথতো। তিন, খুনী খুব শক্তিশালী নয় অথবা একাজে অভিজ্ঞ নয় নইলে ছুরিটা আমূল গেঁথে যেত। কিন্তু এখানে পুরোটা ভেতরে যায়নি। চার, দিলীপ সামন্তের ডানহাতের কাছে মাটির দাগটা আমরা জুম করে প্রিন্ট করেছিলাম। তাতে স্পষ্ট হয় ওটা সম্ভবত সি বা ও অ্যালফাবেট। এই চারটি ধারণাকে সামনে রেখে ভাবতে শুরু করি। যদি দিলীপ সামন্ত খুনীকে নির্দেশ করার জন্য কিছু লিখতে চেয়ে থাকেন তারা কে হতে পারে। পাড়ার লোকের নাম এজাহার তালিকায় দেখতে গিয়ে দেখলাম মৃতদেহের দুদিকের বাড়িতেই সি আর ও দিয়ে শুরু নামের লোক রয়েছে। চন্দ্রাণী চারু আর ঐন্দ্রিলা। আরো কয়েকজন পাড়ায় আছেন তবে তারা সবাই বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। চন্দ্রাণী চারুদেবী আর ঐন্দ্রিলাকে যদিও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদই রেখেছিলাম কারণ তাদের কোন অ্যালিবাই ছিল না। সুনীল দত্তকেও প্রথমে তালিকায় রেখেও পরে বাদ দিতে হয়েছে দুটো কারণে। এক সে বেশ বেঁটে, দুই তার সম্বন্ধে জানা যায় সে বিবাহিত এবং সংসারী মানুষ। ট্রান্সজেন্ডারদের দালালের সাথে তার কোন সম্পর্কই দাঁড়ায় না। দুটো জিনিস একটু ভাবাচ্ছিল। এক, দিলীপ সামন্তের বাড়িতে পাওয়া রুপান্তরকামীদের ওপর লেখা বই আর চন্দ্রাণীর ছেলেসুলভ আচরণ থেকে হঠাৎ পুরোপুরি মেয়েলি স্বভাবে ফিরে আসা বিয়ে বা প্রেম সংক্রান্ত কোন যোগাযোগ ছাড়াই। বিশেষত যখন জানা গেল দিলীপ সামন্ত ওরফে সুদীপ জৈনের চেম্বারে এমন লোকের ভীড় ছিল যারা ওখানকার বাসিন্দাদের ভাষায় একটু কেমন যেন। সেই বিষয়ে একটা পেরেক পোঁতা গেল যখন চিনি চন্দ্রাণীদের ময়লা ফেলার ঝুড়ি ঘেঁটে সুদীপ জৈনের চেম্বারের ঠিকানা আর ফোন নম্বর দেওয়া কার্ডটা নিয়ে এল। তখনও ভাবছিলাম পাড়ার কেউ জড়িত থাকলেও খুনটা করেছে বাইরের লোক। তারপর পাওয়া গেল চন্দ্রাণীর সেদিন আসা যাওয়ার খবর। সাক্ষ্য তো ছিলই।
– কিন্তু এগুলো থেকে এটা কি করে ভাবলে চন্দ্রাণী খুন করেছে। সে তো ভাড়াটে লোকও লাগাতে পারতো বা অন্য কেউ দিলীপ সামন্তকে ফলো করে এই গলিতে ঢুকেও তাকে মারতে পারে। এমন লোকের কি শত্রুর অভাব হয়।
বলল পল্লব মজুমদার। দৈ বলল,
– ঠিকই বলেছেন কাকু এমন সম্ভাবনা তো ছিলই। কিন্তু যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ নিয়ে চিনি জেনেছে চন্দ্রাণী বিগত দুমাস সালোয়ার কুর্তি ছাড়া পড়ত না। সেদিন এক পোষাক পরে বেরিয়ে আবার ফিরে আসা, পোষাক পরিবর্তন করা, টুপি পরে মুখ আড়াল করা আমাদের ভাবালো। আর একটা কথা আপনার বিকালে তোলা অকুস্থলের ছবিতে ওই সি বা ও লেখাটার ওপরে একটা ভি জাতীয় ছাপ পড়েছিল। ওটা আর কিছু নয় চন্দ্রাণীর নিউকাট জুতোর মাথার দিকটার ছাপ। আমি রবীনবাবুর বাড়িতে সিঁড়ির পাশের জুতোর তাকে থাকা চন্দ্রাণীর জুতো পরীক্ষা করে দেখেছি। সম্ভবত ঘটনার দিন বিকালে সে জায়গাটা দেখার অছিলায় পা দিয়ে লেখাটা ঘেঁটে দিতে চেয়েছিল। কারণ সে হয়তো রবীনবাবুর কাছে ছাপটার কথা আগেই শুনেছিল। এত কিছু সত্ত্বেও চন্দ্রাণীকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারছিলাম না। একবার ভেবেছিলাম চারুদেবী কিনা। কারণ সন্তানের জন্য হেন কোন কাজ নেই যা মা পারেনা। বাথরুম যাওয়ার অছিলায় চিনি রান্নাঘরের ভিতর দেখে এসেছিল। সেখানে একটা ছূরির সেট ছিল যাতে সব কটিই বিদ্যমান।
– বলতে পারেন সুদীপ জৈনের কার্ড আর পানের দোকানদারের পর্যবেক্ষণ এই কেসটার মূল চাবিকাঠি। তবে কাকু একটা অনুরোধ জানি অন্যায় তবুও চন্দ্রাণীর দিকটা দেখবেন। ওর দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল।
বলল দৈ। পল্লব মজুমদার একটু চুপ করে থেকে বললেন,
– আইনের উর্ধ্বে তো আমরা কেউ নই তবে আমারও একটা স্কুলে পড়া মেয়ে আছে। আমি চেষ্টা করব।