Getting your Trinity Audio player ready...
|
আজকাল আদিত্যকে খুব ভয় করে সুতপার। যদিও ও জানে আদিত্য ওকে খুব ভালোবাসে, এই ভয়ও অমূলক। তবু হাজার চেষ্টা করেও মন থেকে ভয়টা দূর করতে পারে না। আদিত্য আর সুতপার বিয়ে হয়েছে সবেমাত্র দু’বছর হয়েছে। আদিত্য সেন একজন বিখ্যাত চিত্র পরিচালক। তার সমস্ত গল্পের বিষয়বস্তু হল রহস্য, আরও ভালো করে বললে মার্ডার মিস্ট্রি। গল্পের প্রতি পরতে মিশে থাকে সাসপেন্স, থ্রিল, ভয়। আর নতুন নতুন গল্প সৃষ্টির স্বার্থে আদিত্য সারাদিন অভিনবভাবে খুনের পরিকল্পনা করে চলে। অবশ্য পুরোটাই শুধুমাত্র কাগজে কলমে। কিন্তু সেই আইডিয়া সে শেয়ার করে সুতপার সাথে। আর রোজ রোজ এই নিত্যনতুন খুনের পরিকল্পনা শুনতে শুনতেই সুতপার মনে বাসা বেঁধেছে ভয়। আজকাল সবসময় ওর ভয় হয় এই বুঝি কেউ ওকে মারতে চাইছে। বাড়িতে মানুষ বলতে তিনজন। আদিত্য, সুতপা আর ওদের ড্রাইভার সমীর। সমীর অনেক ছোট থেকেই এ বাড়িতে আছে। ওর মা একদম ছোটবেলায় মারা যান আর ওর বাবা আদিত্যর বাবার গাড়ি চালাত। অনেক কম বয়সে ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আদিত্যর বাবা ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে রাখেন। তারপর বড় হয়ে ও নিজেও ড্রাইভিং শিখে গাড়ি চালানো শুরু করে। ড্রাইভারের কাজ করলেও ও এই বাড়িরই একজন। দোকান বাজার, টুকটাক কাজকর্মও করে দেয়। বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসার পর আদিত্যর মত সুতপাও খুব ভালোবাসে ওকে। আর ছেলেটাও ওদের খুব ভালোবাসে। নিজের বলতে তো আর কেউ নেই ওর। এই মানুষগুলোর প্রতি ও ভীষণ কৃতজ্ঞ। এই তিনজন ছাড়া আর দুজন কাজের লোক আছে, মালতী আর সন্ধ্যা। মালতী রান্না করে আর সন্ধ্যা বাড়ির অন্যান্য কাজ করে। এরা দুজনেই সকালে আসে আর সন্ধের দিকে চলে যায়। আজকাল সুতপা প্রত্যেককে সন্দেহ করা শুরু করেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ও হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই মন থেকে ভয়টা তাড়াতে পারছে না। আদিত্য প্রথম প্রথম চেষ্টা করত বোঝাতে। ইদানিং বিরক্তই হয় এই পাগলামিতে। ফলে টুকটাক ঝগড়াঝাটি শুরু হয় ওদের মধ্যে। সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে ওদের সম্পর্কটা অচিরেই ভেঙে পড়বে নিশ্চিত। অনেক ভেবে সুতপা ঠিক করল কিছুদিন ওর বোন সুপ্রীতিকে ওর কাছে এনে রাখবে। তাহলে নিশ্চয়ই এই ভয় ভয় ভাবটা কাটবে।
(২)
সুপ্রীতি আসার পর কয়েকটা দিন হৈ হৈ করে কেটে গেল। সুতপা একটু শান্ত স্বভাবের হলেও ওর বোন একেবারে ওর উল্টো। সুপ্রীতি ভীষণ হৈ চৈ করতে ভালোবাসে। সুতপা ওর ভয়ের কথাটা বোনকে বলতে সে তো হেসেই অস্থির। ও সুতপাকে অনেক বোঝাল যে এগুলো ওর মনের ভুল ছাড়া আর কিছু নয়, এগুলোকে মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে। সুতপা নিজেও বুঝতে পারছে যে এটা তার মানসিক সমস্যা। নাহ্, সুপ্রীতি ঠিকই বলেছে। ওকে জোর করেই এসব মন থেকে দূর করতে হবে। ওকে নিজেকেই এই ভয়টা কাটিয়ে উঠতে হবে। এই ভেবে মনে জোর আনে সুতপা। কিন্তু কয়েকটা দিন খুব ভালো কাটলেও তারপর থেকে আবার সুতপার মনে ভয়টা ফিরে আসতে শুরু করল এবং এবার আরও বেশি করে ভয়টা চেপে বষতে শুরু করল। আগে আদিত্য একা তার গল্প শোনাত। এখন আদিত্য আর সুপ্রীতি দুজনে সারাক্ষণ সিনেমার নতুন নতুন গল্প নিয়ে আলোচনা করে। আর কী ভয়ঙ্কর সে সব গল্প! শিউরে ওঠে সুতপা। মাঝে মাঝে সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে ওদের চুপ করতে বলে। আর তাতে ওরা দুজনেই বেশ বিরক্ত হয় ও বুঝতে পারে। আজকাল তো ওর মনে হয় হ্যালুসিনেট করাও শুরু করেছে। না হলে মাঝ রাতে ওর ঘরের মধ্যে বা বারান্দায় ছুরি হাতে ছায়ামূর্তি দেখবে কেন! কিন্তু সত্যিই কি এগুলো হ্যালুসিনেশন না কি অন্য কিছু?
(৩)
সুপ্রীতি সমীরকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। সব সময় ওর ওপর নজরদারি করে চলেছে। আবার সেদিন ওর নামে দিদির কান ভারী করছিল! এত সাহস! রাগে মাথা গরম হয়ে যায় সুপ্রীতির। ওকে এখান থেকে সরাতেই হবে। কয়েকবার দিদির কাছে বলেছে একটা বাইরের ছেলেকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি না করতে। দিদি তো কথা কানেই তুলল না। আদিত্যদাকেও বলতে গিয়েছিল সেদিন খাওয়ার টেবিলে।
– আচ্ছা আদিত্যদা, তোমাদের ওই ড্রাইভার ছেলেটিকে সারাক্ষণ বাড়ির ভেতর কেন রেখে দাও বলোতো তোমরা?
– কেন ওকে নিয়ে কী সমস্যা হল?
– সমস্যা তো ও নিজেই। একটা বাইরের ছেলে সারাক্ষণ বাড়ির ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের কথার মাঝে কথা বলছে। এসব কি!
– সুপ্রীতি! আজ যেটা বললে সেটা আর কোনওদিনও মনে মনেও ভেব না। সমীর বাইরের ছেলে নয়। আমার বাবা মার কাছে আমি আর সমীর কোনওদিন আলাদা ছিলাম না। আমরা সবাই ওকে ভীষণ ভালোবাসি।
– তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারছ না। আমি বলছিলাম…
– এ ব্যাপারে আর বেশি কিছু বোঝার নেই। তোমার দিদিও কোনওদিন এরকম কথা বলেওনি আর ভাবেওনি। তাই আশা করব তুমিও এ নিয়ে আর কিছু বলবে না।
বেশ রাগ করেই কথাগুলো শুনিয়েছিল আদিত্যদা। এমনকি দিদিও কথা শোনাতে ছাড়ল না।
– তোর সাথে তো আগেই এই বিষয়ে কথা হয়েছিল বোন। তোকে তো বলেছি এসব কথা বলিস না। আর তুই যে কেন ওকে পছন্দ করিস না বুঝি না। ও খুব ভালো ছেলে।
– ঐ ভালো ছেলের মনে যে কী আছে তা তোরা বুঝতে পারছিস না। যেদিন বুঝতে পারবি সেদিন পস্তাবি।
কথাটা বলেই উঠে চলে যায় সুপ্রীতি। একজন ড্রাইভারকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা কিসের কে জানে! সুপ্রীতি মনে মনে ভাবে, ‘যে ভাবেই হোক ছেলেটাকে এই বাড়ি থেকে তাড়াতেই হবে। একটা উপায় বার করতে হবে। না হলে ওর প্ল্যানটা যে সফল নাও হতে পারে। ‘
(৪)
সৌরভ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে সুপ্রীতি ওকে এড়িয়ে চলছে। কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সৌরভ আর সুপ্রীতির সম্পর্ক বেশ কয়েক বছরের। ওদের বিয়ের ঠিক হয়ে আছে। পরের বছরই বিয়েটা সেরে নেবে, ঠিক করেছে ওরা। দুই বাড়িতে সবাই সবটা জানে। এই অবস্থায় কি এমন হল যে সুপ্রীতি এমন করছে! কিছুতেই বুঝতে পারে না সৌরভ। সুপ্রীতি দিদির বাড়িতে থাকতে যাওয়ার পর থেকেই ওর এই পরিবর্তন। দেখা তো করতে চায়ই না, এমনকি ফোনেও বেশিক্ষণ কথা বলে না। সারাক্ষণ না কি ও ব্যস্ত। কিসের এত ব্যস্ততা ওর। আগে তো এমন করেনি কোনওদিন। আর অপেক্ষা করতে না পেরে সেদিন ওর দিদির বাড়িতে চলেই গিয়েছিল সৌরভ। সুতপা ওকে দেখে খুব খুশি হলেও সুপ্রীতি যে একদম খুশি হয়নি তা ওর ব্যবহারে স্পষ্ট বোঝা গেছে। ভালো করেই কথাই বলল না। উল্টে না জানিয়ে কেন ওখানে চলে গেছে সে নিয়ে রাগারাগি করল। নাহ্, সুপ্রীতির ব্যবহার মোটেই স্বাভাবিক লাগছে না সৌরভের। সুপ্রীতি কি ওদের সম্পর্কটা শেষ করে দিতে চাইছে? কিন্তু কেন? ওদের মধ্যে তো কোনও ঝামেলাও হয়নি। তা হলে? সেদিন আবার বলল ওর নাকি একটা বড় প্ল্যান আছে। কী সেই প্ল্যান? নাহ্, এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। সবটা ওকে জানতেই হবে। কাল আবারও সুপ্রীতির সাথে দেখা করতে যাবে ও। রাগ করলে করবে কিন্তু কথা ওকে বলতেই হবে। প্রয়োজনে বিয়ের দিন এগিয়ে আনবে।
(৫)
সুতপার ভয়টা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বলতে পারছে না। আদিত্য তো অনেকদিন থেকেই ওর ওপর বিরক্ত হয়ে আছে। আগের মত আদিত্য আজকাল আর কোনও কথাই শেয়ার করে না ওর সাথে। সুপ্রীতি আসার পর থেকে ওর সাথেই সিনেমার গল্প করে। সুপ্রীতিও খুব পছন্দ করে এসব। ওর নাকি খুব থ্রিলিং লাগে। আর সুতপার অহেতুক ভয় পাওয়া নিয়ে হাসাহাসি করে। দু- একদিন ধরে অবশ্য আদিত্য সুপ্রীতির সাথেও ভালো করে কথা বলছে না সেটা সুতপা লক্ষ্য করেছে। আদিত্য চিরকাল হৈ হৈ করতে ভালোবাসে। কিন্তু দু’দিন ধরে খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। কিছু তো একটা হয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করেও কোনও লাভ হয়নি। সুতপা জানতই আদিত্য কিছুই বলবে না। আর এজন্য ও নিজেই দায়ী বা বলা ভালো ওর এই অকারণ ভয় দায়ী। কিন্তু কী করবে সুতপা! ওদিকে আবার সৌরভের সাথেও সুপ্রীতির কিছু একটা হয়েছে। সেদিন ছেলেটা এল কিন্তু সুপ্রীতি ভালো করে কথাই বলল না। হঠাৎ সমীরের বলা একটা কথা মাথায় এল সুতপার। কথাটা অবশ্য সেদিন পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল সুপ্রীতি ওকে পছন্দ করে না বলেই ওসব বলছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নাকি কথাটার কোনও ভিত্তি আছে? হঠাৎ ও চোখ কান খোলা রেখে বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু বিচার করতে বলল কেন? ঠিক কী ইঙ্গিত করতে চাইল ও?
(৬)
আজ সকালে মালতী কাজে এসে অনেকবার বেল বাজানোর পরেও কেউ দরজা না খোলায় পাড়ার লোকেদের ডেকে আনে। তারা সবাই দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। ওপরে যেতেই চোখে পড়ে বীভৎস দৃশ্য। খবর দেওয়া হয় পুলিশে।
সুপ্রীতি দোতলায় নিজের ঘরে খুন হয়েছে। বাড়িতে আর কেউ ছিল না। পুলিশ তদন্তে এসে প্রথমেই মালতীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
-বডি প্রথম তুমি দেখেছ?
-হ্যাঁ, স্যার।
-বাড়ির সবাই কোথায়? আর কাল কখন তুমি বাড়ি গিয়েছিলে?
-কাল সন্ধে সাতটা নাগাদ আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম। রাতে দাদা ফিরবে না সকালেই জানিয়ে গিয়েছিল। নতুন ছবির ব্যাপারে কিছু কাজ ছিল। বৌদিও সন্ধের মুখে বেরিয়ে যায়, ওঁর বন্ধুর বাড়িতে পার্টি ছিল। আর আমি বেরোনোর ঠিক আগেই সমীরদাও বেরিয়ে যায়। আমি যখন বাড়ি যাই তখন ছোড়দি নিজের হাতে দরজা বন্ধ করেছিল।
-সমীরদা কে?
-এই বাড়িতেই থাকে। দাদার গাড়ি চালায়।
-হুম। তার মানে ওঁকে তুমিই শেষ জীবিত অবস্থায় দেখেছিলে।
-হ্যাঁ, কিন্তু আমি এসবের কিছু জানি না স্যার।
-সে সব তো পরে জানা যাবে।
মৃতদেহ চেয়ারে বসা অবস্থায় রয়েছে। মুখ জানলার দিকে আর পিঠ দরজার দিকে। ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। এই কেসে সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল একজন মানুষকে তিনটি পন্থায় খুন করা হয়েছে। গলায় দড়ি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে, পেটে ছুরি মেরে এবং ঘাড়ে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে। এর মধ্যে ঠিক কোনটা আসল মৃত্যুর কারণ সেটা পোস্টমর্টেমের পর রিপোর্ট পেলে জানা যাবে। গলায় জড়ানো দড়ি, ছুরি ও ঘাড়ে বিঁধে রাখা সিরিঞ্জ সবই ফরেন্সিকে পাঠানো হয়েছে। বিষের প্রভাবে ঘাড়ের কাছে সিরিঞ্জ বিঁধে থাকা অংশ নীল হয়ে গেছে। লাশের মুখে আর হাতে অদ্ভুত কিছু লাল লাল দাগ ফুটে উঠেছে। সেগুলো কিসের জন্য বোঝা যাচ্ছে না।
ঘরে কোনও হাতাহাতির চিহ্ন নেই। কিছু চুরিও যায়নি। তাই এটা পরিষ্কার যে খুন করাটাই উদ্দেশ্য ছিল। আর যেহেতু অনেক রাতে হাল্কা বৃষ্টি হয়েছিল তাই কাদামাখা জুতোর ছাপ বলে দিচ্ছে খুনটা শেষ রাতে বা ভোর রাতে হয়েছে। এদিকে বিছানার টান টান চাদর থেকে এটাও পরিষ্কার সুপ্রীতিদেবী রাতে ঘুমাননি। সারা রাত এই চেয়ারেই বসেছিলেন। কেন?
এই কেসের তদন্তের ভার রয়েছে ওসি সুব্রত দত্তর ওপর। তার সহকারী এস আই চন্দন বাগচী। ওসি দত্ত নিজেই মালতীকে এতক্ষণ জেরা করছিলেন। সমস্ত ঘর খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই একে একে আদিত্য, সুতপা আর সমীর বাড়িতে এল। মালতীই সকালে এই ভয়ানক ঘটনা দেখে তিনজনকে ফোন করেছিল। এবার শুরু হল তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পালা।
(৭)
খুন হয়েছে যে রাতে সেই রাতে আদিত্য, সুতপা আর সমীর কেউই বাড়ি ছিল না। আদিত্য অফিসে অনেক রাত পর্যন্ত কয়েকজনের সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিল। তারা চলে যাওয়ার পরও আদিত্য অফিসেই কাজ নিয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। সিকিউরিটি গার্ড কনফার্ম করেছে। সুতপা তার বান্ধবীর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির পার্টিতে গিয়েছিল। রাত হয়ে যাওয়ায় বান্ধবীরই অনুরোধে সেখানে থেকে যায়। সমীর ছিল তার এক বন্ধুর বাড়িতে। সে মাঝে মাঝেই ওখানে থাকে। অ্যালিবাই সবারই আছে কিন্তু অ্যালিবাই তৈরী করাও অসম্ভব কিছু না। আবার এদের মধ্যে কেউ কন্ট্রাক্ট কিলারও অ্যাপয়েন্ট করতে পারে। সেটার সম্ভাবনাই বেশি। তাকে ধরতে পারলেই আসল মাথাকে পাওয়া যাবে। ইন্সপেক্টর দত্ত পুরো ঘটনাটা আর একবার মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এখনো আসেনি। মৃতার ঘরের লাগোয়া বারান্দার রেলিংয়ে ছেলেদের একজোড়া জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে। সেই জুতোর মাপ আদিত্য বা সমীর কারোর সাথেই মেলেনি। তার মানে হয় এই ঘটনায় চতুর্থ কেউ যুক্ত না হলে এদের তিনজনের মধ্যে কারোর ঠিক করা কন্ট্রাক্ট কিলারই কাজটা করেছে। সে সেদিন বাগানের পাঁচিল টপকে ঢুকে পাইপ বেয়ে উঠে দোতলার বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু কে সে? যদিও বাড়িতে ঢোকার আরও একটা রাস্তা রয়েছে। বাড়ির পিছনের দরজাটা ভেজানো ছিল। যে কেউ সেখান দিয়ে ঢুকতেই পারে। সন্ধ্যার বয়ান অনুযায়ী সে নিজে দুপুরের পর পিছনের দরজাটা বন্ধ করেছিল। এখন হয় সন্ধ্যা ভুল বলছে, হতেই পারে ও ভুলে গিয়েছিল আর নয় তো তারপর কেউ ওটা খুলেছিল। কিন্তু পিছনের দরজা খোলা থাকতে আততায়ী এত কষ্ট করে কেন ঢুকল? তাহলে কি সে জানত না দরজাটা খোলা? সন্ধ্যারই ভুল হয়েছিল?
সুপ্রীতির ফোনটা টেবিলেই ছিল। কিন্তু সেটা পুরো ফাঁকা। কল হিস্ট্রি, কনট্যাক্টস, মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, গ্যালারি সব ফাঁকা। কেউ এগুলো সব ডিলিট করেছে। এস.আই বাগচীর কথায় চিন্তাসূত্র কাটল ইন্সপেক্টর দত্তর।
– স্যার, একটা কথা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।
– জানি তুমি কী ভাবছ।
– আপনি জানেন?
– হুম। একজন মানুষকে তিনভাবে খুন করা হল কেন, তাই তো?
– হ্যাঁ স্যার। যে কোনও একভাবেই তো মারা যেত। খুনি মনে হয় মানসিক বিকারগ্রস্ত।
– হতে পারে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বা যে খুন করেছে তার সুপ্রীতিদেবীর প্রতি তীব্র আক্রোশ ছিল।
– হ্যাঁ স্যার, এখন ঠিক কোন কারণে ওঁর মৃত্যু হয়েছে সেটাই জানার।
– ছুরিটা যখন মারা হয় তখন সুপ্রীতিদেবী মারা গিয়েছেন। তাই ওটা মৃত্যুর কারণ নয়।
– এটা আপনি কী করে বলছেন?
– একজনকে ছুরি দিয়ে মারলে যে পরিমান রক্ত বেরোনো উচিত সেই পরিমাণ রক্ত বেরোয়নি, অনেক কম বেরিয়েছে। এটা তখনই সম্ভব যদি ছুরি মারার সময় ব্যক্তির হার্ট বন্ধ থাকে অর্থাৎ সে আগেই মারা গিয়ে থাকে।
– তাহলে খুনি আগে শ্বাসরোধ করে বা বিষ দিয়ে মেরে তারপর ছুরি মেরেছে মৃত্যু নিশ্চিত করতে?
– বিষটাও সম্ভবত মৃত্যুর পরই দেওয়া হয়েছে।
– এটা বুঝলেন কীভাবে?
– বিষের প্রভাবে ঘাড়ের কাছে নীল হয়ে গেছে কিন্তু ঠোঁট বা নখ পরিষ্কার। তার মানে শরীরে বিষের প্রবেশ হলেও তা বেশি পরিমানে ছড়িয়ে পড়েনি অর্থাৎ শরীরে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ ছিল। অবশ্য বিষটা ঠিক কী, সেটার ওপরও এগুলো নির্ভর করে। অনেক সময় শরীরে বিষ ঢোকার সাথে সাথেও মৃত্যু হতে পারে। তবু আমার মন বলছে এমনটা হয়নি।
– স্যার আপনি তো সবটাই বুঝে ফেলেছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসার আগেই এত সুন্দর করে সব ডিটেক্ট করলেন ভাবা যায় না।
– এত বছর চাকরির অভিজ্ঞতা এইটুকু তো হবেই।
মৃদু হাসলেন সুব্রত দত্ত। তারপর আবার বললেন,
– তবে আমাদের আরও একটা বিষয়ে আগে ভাবতে হবে।
– কী স্যার?
– চতুর্থ ব্যাক্তিকে খুঁজে বার করতে হবে।
– যার জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে।
– হুম। এক কাজ করো। মোবাইলের ম্যাসেজগুলো রিকভার করা যায় কিনা দেখ।
– ওকে স্যার।
কথা বলতে বলতেই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসে গেল। ইন্সপেক্টর দত্ত খুলে পড়তে লাগলেন। বাগচী আবার বলল,
– তার মানে শ্বাসরোধ করে খুন। তারপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিষ আর ছুরির ব্যবহার। রিপোর্টে এটাই এসেছে তো স্যার? তাহলে এখন খুঁজে বার করতে হবে কে এই তিনটে কাজ করেছে।
– তিনটে নয়, চারটে।
– চারটে!!!
– হুম। রিপোর্ট বলছে এই তিনটের কোনওটাতেই সুপ্রীতিদেবীর মৃত্যু হয়নি।
– তাহলে কীভাবে হয়েছে?
– তীব্র শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা গলায় লাগানো ফাঁসের জন্য নয়। শ্বাসনালীর ওপর কোনও চাপই পড়েনি। শ্বাসরোধ করে মারার জন্য যে পরিমান চাপ গলায় দেওয়া দরকার তা দেওয়া হয়নি। গলায় সেভাবে দাগও বসেনি।
– তাহলে শ্বাসকষ্ট হল কেন?
– অ্যালার্জির কারনে। মৃতার শরীরের ঐ লাল দাগগুলো অ্যালার্জির জন্য হয়েছে। আর তার জন্যই তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং মৃত্যু। মৃত্যুর সময় রাত আটটা থেকে ন’টা। অ্যালার্জির এফেক্ট শুরু হওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যু ঘটে না। অর্থাৎ মালতী বেরোনোর পরই এফেক্ট শুরু হয়েছে।
– তবে কি স্যার একাধিক ব্যক্তি এই খুনের চেষ্টা করেছিল? একজনই চারভাবে খুন করেনি? কারণ বৃষ্টি তো হয়েছিল অনেক রাতে।
– ঠিক ধরেছ। আমিও সেটাই ভাবছি। একজন তিনটে কাজ করলেও অ্যালার্জির ব্যাপারটা ঘটিয়েছে অন্য কেউ। আবার এটাও হতে পারে খুনি একজনই। অ্যালার্জিজনিত কারণে মৃত্যু যদি না হয় তাই সেটা নিশ্চিত করতে সে নিজে আবার এসেছিল বা অন্য কাউকে পাঠিয়েছিল শেষ রাতে। আমাদের সব সম্ভাবনাই মাথায় রাখতে হবে।
– এখন তাহলে কীভাবে এগোবেন?
– সুতপাদেবীর কাছে জানতে হবে কিসে কিসে সুপ্রীতিদেবীর অ্যালার্জি ছিল আর সেগুলো বাড়িতে সেদিন ছিল কিনা। চলো বেরোনো যাক।
(৮)
সুতপার থেকে জানা গেল বাদাম, কমলালেবু আর চিংড়ি মাছে মারাত্মক অ্যালার্জি ছিল সুপ্রীতির। আর সেই কারণে ও আসার পর এই জিনিসগুলো বাড়িতে ঢোকেইনি। আরও একটা খবর পাওয়া গেল। সুপ্রীতির একজন প্রেমিক আছে যার সাথে তার বিয়ের সব ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে কোনও একটা কারণে ওদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে।
ইন্সপেক্টর দত্ত সৌরভের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে সেখানে দেখা গেলেন। সৌরভ জানাল তাদের মধ্যে সামান্য একটু সমস্যা হয়েছিল এবং তা মিটেও গেছে। এর বেশি কিছুই সে বলল না। সৌরভের জুতোর মাপ নিয়ে ওখান থেকে চলে আসেন তিনি।
সৌরভের কাছ থেকে কিছু খবর না পেয়ে ইন্সপেক্টর দত্ত আবার আসেন সুতপা আর আদিত্যর বাড়িতে। বাড়িতে তখন মালতী ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিনি মালতীর সাথেই গল্প করতে শুরু করেন। আর সেখান থেকে পান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মালতী জানায় যে, সে নিজে শুনেছে সুপ্রীতি সৌরভের সাথে সম্পর্ক শেষ করার কথা বলেছিল। ফোনে সেদিন খুব ঝগড়া হয়েছিল দু’জনের। তারপর দিন সৌরভ দেখা করতে এলে তাকে সুপ্রীতি যথেষ্ট অপমান করেই তাড়িয়ে দেয়। সৌরভও যাওয়ার সময় বলে যায় এত সহজে সে সুপ্রীতিকে ছাড়বে না। আর দ্বিতীয় তথ্য হল, সুপ্রীতি মারা যাওয়ার দিন সুতপা বেরিয়ে যাওয়ার পর সমীরের সাথেও সুপ্রীতির ঝামেলা হয়। সুপ্রীতি সমীরের ঘরে গিয়ে ওকে হুমকি দিয়েছিল,
-আমার নামে দিদির কাছে নালিশ করেছিলে না? এবার দেখো তোমার কী অবস্থা করি। এই বাড়ি থেকেই তোমাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করব। এমন প্ল্যান করেছি যে দিদি আর আদিত্যদা নিজে তোমাকে বাড়ি থেকে তাড়াবে।
-আপনি যেটা করছেন সেটা অন্যায়। আমি আপনার পুরো প্ল্যানটাই জেনে ফেলেছি।
-আচ্ছা, তাই নাকি! কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা কাউকে বলার সুযোগই তুমি পাবে না। কারণ কাল সকাল থেকে তো তোমাকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। নিজের নামে বদনাম ঘোচানোর চেষ্টা করতে হবে। আর সমস্ত প্রমাণ থাকবে তোমার বিপক্ষে। জাস্ট ওয়েট অ্যাণ্ড ওয়াচ।
-আপনি ঠিক কী করতে চাইছেন?
-সেটা তো সারপ্রাইজ।
-না ম্যাডাম, এরকম কিছু করবেন না, প্লিজ।
– না করলে আমার প্ল্যানটাই তো সাকসেসফুল হবে না। আর তুমি তো বড্ড বেশি জেনে ফেলেছ।
এরপর সুপ্রীতি নিজের ঘরে চলে যায়। আর সমীরও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ওরা কেউই জানতে পারেনি মালতী লুকিয়ে ওদের কথা শুনেছিল।
(৯)
সৌরভের জুতোর মাপ সুপ্রীতির ঘরে পাওয়া ছাপের সাথে একদম মিলে গেছে। সুপ্রীতির ফোন থেকে সৌরভের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ম্যাসেজগুলো ডিলিট করা হলেও পুলিশের স্পেশাল ডিপার্টমেন্ট সেগুলো উদ্ধার করেছে। সেখানে সুপ্রীতি সম্পর্ক ভাঙার কথা বলেছে। সৌরভ বারবার বোঝানোর বিফল চেষ্টা করেছে। সৌরভকে থানায় এনে এইসব প্রমাণ দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। প্রথমে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত সে সব স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
-সেদিন সুপ্রীতিকে মারার জন্য শেষ রাতে আমি গিয়েছিলাম। কারণ এত বছরের সম্পর্ক ভাঙার কথায় আর সেদিনের অপমানে আমার মাথার ঠিক ছিল না। কিন্তু ঘরে ঢুকে নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় দেখলাম সুপ্রীতি চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ছুরিটা সজোরে বসিয়ে দিই পেটে।
– আপনি বড্ড কাঁচা কাজ করে ফেলেছিলেন। তাই আপনাকে খুব সহজেই আমরা ধরতে পারলাম।
– কিন্তু আমি খুন করিনি। যখন আমি ছুরিটা বসাই তখন ও কোনও চিৎকার না করায় ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখি ওর গলায় একটা মোটা দড়ি পেঁচানো আর কোনও নিঃশ্বাস পড়ছে না। তখনই পালিয়ে যাই।
– যাওয়ার আগে ফোন থেকে মেসেজ আর কল হিস্ট্রি ডিলিট করেছিলেন।
– হ্যাঁ।
– ঘরে আর কাউকে দেখেছিলেন? বা বাড়িতে ঢোকার সময়?
– না, ঘরে তখন আর কেউ ছিল না। কিন্তু বাড়িতে কেউ ছিল কিনা জানি না। আমি ঐ ঘরের বাইরে যাইনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি।
– বিশ্বাস করি। কারণ আপনার জুতোর কাদার দাগ যেমন আপনাকে ধরিয়ে দিয়েছে তেমন এটাও প্রমাণ করে দিয়েছে যে আপনি খুনটা করেননি। কিন্তু খুন করার চেষ্টা করেছিলেন আর আগেই উনি মারা না গেলে আপনার হাতেই মৃত্যু হত। তাই শাস্তি হয়তো আপনাকেও পেতে হবে। যদিও সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আদালত।
এস.আই বাগচী জিজ্ঞাসা করল,
– স্যার, চতুর্থ ব্যক্তিকে তো পাওয়া গেল কিন্তু আসল খুনিকে তো এখনো পাওয়া গেল না।
– সমীরকে জেরা করতে হবে। ওর মোটিভ স্ট্র্রং আর অ্যালিবাইও উইক। বন্ধুকে শিখিয়ে রাখলে সে মিথ্যে বলতেই পারে।
– কিন্তু স্যার, সুপ্রীতিদেবী কেন ওঁর ওপর রেগে ছিলেন?
– সেটা তো এখন একমাত্র সমীরই বলতে পারবে। ওকে থানায় নিয়ে এসো। দেখা যাক কী বলে।
– ওকে স্যার।
(১০)
অল্প জেরাতেই ভেঙে পড়ে সমীর।
– আমার কিছু করার ছিল না স্যার। ম্যাডাম আমাকে মিথ্যে বদনাম দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছিল। তাও ঠিক ছিল। আমি না হয় অন্য কোথাও কাজ আর থাকার জায়গা জুটিয়ে নিতাম। কিন্তু দাদা আর বৌদিকে আমি খুব ভালোবাসি। ওরাও আমাকে কোনওদিন বাইরের লোক ভাবেনি। আর ম্যাডাম ওদেরই ক্ষতির প্ল্যান করেছে। সেটা আমি কি করে মানতাম?
– ওদের কী ক্ষতি করতে চেয়েছিলেন উনি?
– বৌদি বেশ কিছুদিন ধরে ভয় পাচ্ছিলেন আর তাই ম্যাডামকে ডেকে এনেছিলেন…
– কিসের ভয়?
– ভয়টা একেবারেই অমূলক। আসলে দাদা তো খুনখারাপি নিয়ে গল্প লেখে। আর সারাক্ষণ সেই সব গল্প বৌদিকে শোনাত। আর সেই থেকেই বৌদির একটা মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সব সময় ভাবত কেউ হয়তো বৌদিকে মারতে চাইছে আর এই নিয়ে দাদাও খুব বিরক্ত হত।
– ভয়টা কি একেবারেই অমূলক?
– একদম। দাদা বৌদিকে খুব ভালোবাসে। আর ভয়ের তো কোনও কারণ ছিল না। এটা তো দাদার কাজ। দাদা তো আমার সাথেও গল্প নিয়ে আলোচনা করতো। আর বৌদির এই ব্যবহার নিয়ে ইদানীং দাদা খুবই দুশ্চিন্তায় ছিল।
– আচ্ছা, তারপর কী হল?
– ম্যাডাম এ বাড়িতে আসার পর সব শুনে উনিও বৌদির ভয়টা হেসে উড়িয়ে দিলেন। দাদার সাথে বৌদির একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। আর ম্যাডাম সেটাই কাজে লাগালেন। সারাক্ষণ দাদার কাছে কাছে থাকা শুরু করলেন, গল্পের ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাতেন। আর দাদার কাজের ব্যাপারে কারোর উৎসাহ দেখলে দাদা ভীষন খুশি হত। প্রতি রাতে ওরা দুজন অনেক রাত পর্যন্ত নতুন গল্প নিয়ে আলোচনা করত।
– কিন্তু আপনার ওপর ওঁর রাগের কারণটা কী?
– ম্যাডাম আসার পর বৌদির ভয়টা আরও বেড়ে গিয়েছিল। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকত। আসলে ম্যাডাম বৌদির মনে আরও বেশি করে ভয় ঢোকাতে শুরু করে। এমনকি মাঝরাতে অন্ধকারে বৌদির ঘরে, বারান্দায়, সিঁড়িতে ছুরি হাতে ভয় দেখাত। আমি নিজের চোখে দেখেছি। একদিন হাতেনাতে ধরি। তারপর আমি সরাসরি ওঁর সাথে কথা বলি। কেন এমন করছে জানতে চাই। তখন আমাকে উনি মুখ বন্ধ রাখার জন্য টাকার অফার করেন। আর বলেন ওঁর প্ল্যান সফল হলে আরও টাকা দেবেন। কিন্তু আমি রাজি হই না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, উনি বৌদিকে পুরোপুরি পাগল প্রমাণ করে দাদা আর বৌদির মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে, এই বাড়িতে বৌদির জায়গা নিতে চাইছেন।
– আপনার বৌদিকে আপনি কিছু জানাননি?
– সরাসরি কিছু বললে বৌদি বিশ্বাস তো করতই না উল্টে হয়তো আমাকেই ভুল বুঝত। হাজার হোক নিজের বোন। আমি শুধু বৌদিকে চোখ কান খোলা রেখে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম, সব কিছু বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে বলেছিলাম। আর সেটা শুনতে পেয়েই তো ম্যাডাম প্রচণ্ড রেগে গেল আমার ওপর। আর তখনই আমাকে যেভাবেই হোক বাড়ি থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। আমার নামে কোনও মিথ্যে বদনাম দিলে আমার কথাও আর কেউ বিশ্বাস করত না।
– আদিত্যবাবু এ ব্যাপারে একেবারেই কিছু জানতেন না বলছেন?
– মনে হয় না। দাদা সত্যিই খুব ভালো মানুষ। তবে হয়তো কিছু আন্দাজ করেছিল। কারণ কয়েকদিন ধরে দেখছিলাম দাদা ম্যাডামের সাথে বেশি কথা বলছিল না। আর সারাক্ষণ গম্ভীরভাবে থাকত।
– হুম বুঝলাম। এবার বলুন খুনটা কীভাবে করলেন?
– খুন আমি করিনি স্যার।
– আবার মিথ্যে কথা।
ধমকে ওঠেন ইন্সপেক্টর দত্ত।
– না স্যার, সত্যি বলছি। আমি সেদিন খুনের প্ল্যান করেছিলাম ঠিকই। নিজেকে আর দাদা বৌদিকে বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর প্ল্যান করেই পিছনের দরজাটা ভিতর থেকে খুলে রেখে বেরিয়ে যাই। অনেক রাতে সেখান দিয়ে বাড়িতে ঢুকে ওপরে যাই। দেখলাম ম্যাডাম দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে দড়িটা গলায় পেঁচিয়ে ধরি। কিন্তু ম্যাডাম কোনও বাধা দিল না, ছটফট করল না। সন্দেহ হওয়ায় ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখি ঘাড়ের কাছে একটা সিরিঞ্জ বেঁধানো। আমি ভয়ে পেয়ে আর কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাই।
(১১)
– স্যার আপনার কী মনে হয়? সমীরই ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর গলায় দড়িটা পেঁচিয়েছিল।
– না। যে বিষ দেওয়া হয়েছে তা যে কোনও জায়গায় সহজে পাওয়া যায় না। সমীর কয়েকঘন্টার মধ্যে খুনের প্ল্যান করেছে। এত কম সময় ওর মত সাধারণ কারোর পক্ষে ঐ বিষ জোগাড় করা সম্ভব নয়।
– আর অ্যালার্জির ব্যাপারটা?
– সৌরভ বা সমীর কারোর পক্ষেই সুপ্রীতির খাবারে কিছু মেশানো শক্ত।
– তাহলে স্যার আসল খুনি কে? আদিত্যবাবু না সুতপাদেবী?
– যে কেউ হতে পারে। অথবা দুজনেই। আবার তৃতীয় কেউও হতে পারে। এই সুপ্রীতিদেবী খুব একটা সুবিধার মানুষ ছিলেন না। তাই তাকে অনেকেই খুন করতে চেয়েছিল।
– আপনার কি মনে হয়,সমীরের কথা মতো আদিত্যবাবু সুপ্রীতিদেবীর প্ল্যান জানতেন না?
– মনে তো হয় জানতেন আর এতে উনি নিজে সামিল হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
-তাহলে ওঁকে থানায় তুলে নিয়ে এসে জেরা করি?
–অসম্ভব। আদিত্য সেনের মত নামী পরিচালককে এভাবে থানায় নিয়ে এসে জেরা করা যাবে না। আর তাছাড়া ওঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণই তো নেই। আর সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদে ওঁর মুখ খোলানো যাবে না।
-তাহলে এখন উপায়?
– প্রমাণ খুঁজতে হবে। সুপ্রীতিদেবীর ঘরটা আরও একবার ভালো করে সার্চ করতে হবে। অনেক বড় খেলা খেলছিলেন এই ভদ্রমহিলা। নিশ্চয়ই আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন ময়দানে। কিছু না কিছু তো থাকবেই ঐ ঘরে। ওঁর জিনিসপত্রগুলোও ভালো করে দেখতে হবে। চলো।
(১২)
সুপ্রীতির জিনিসপত্র আঁতিপাতি করে খুঁজেও তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তারপর গোটা ঘর তল্লাশি করা হল। শেষমেশ ফুলদানির মধ্যে থেকে পাওয়া গেল লুকিয়ে রাখা ফোনের মেমরি কার্ড। সেটা চালাতেই দেখা গেল তাতে রয়েছে সুপ্রীতি আর আদিত্যর বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি। প্রমাণ পাওয়া গেছে। এবার আদিত্যকে ডেকে সেগুলো দেখানো হল। আর কোনও কিছু লুকোনো র নেই। আদিত্য জানাল,
– এ বাড়িতে আসার পর আস্তে আস্তে সুপ্রীতি আমাকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করে। আমি ওকে ভালো করে বোঝাই। আমি সুতপাকে খুব ভালোবাসি। ও যা চাইছে তা সম্ভব নয়। ইন ফ্যাক্ট আমি ওকে চলেও যেতে বলি। তখন ও বলে যে ও বুঝতে পেরেছে। এ নিয়ে আর কিছু ভাববে না। আমিও সেটাই সত্যি ভেবে নিই। বুঝিনি ও বড় প্ল্যান করছে। একদিন আমরা বসে নতুন একটা সিনেমার প্লট নিয়ে কথা বলছিলাম। ও আমার ড্রিঙ্কসের মধ্যে কিছু মিশিয়েছিল। আমার কিছু মনে নেই। কিন্তু পরদিন সকালে ও আমাকে এই ছবিগুলো দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল শুরু করে। বলে সুতপাকে এগুলো দেখাবে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। আমি ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিই। তাতে ও আরও ক্ষেপে গেল।
– উনি ঠিক কী চাইছিলেন?
– ও বলেছিল, সুতপা পাগল হয়ে গেছে। আমি যেন সুতপাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করি। কিন্তু সেটা কখনোই আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি সুতপাকে ভালোবাসি। আমি জানি ওর একটা মানসিক সমস্যা হয়েছে। কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে। তার জন্য আমি ওকে ছেড়ে দিতে পারি না।
– আপনি সুতপাদেবীকে কেন সবটা খুলে বললেন না?
– আমি ভয় পেয়েছিলাম। ও জানতে পারলে যদি আমাকেই ভুল বোঝে? যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে? যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়?
– আর তাই খুন করা ছাড়া আর কোনও উপায় আপনি খুঁজে পেলেন না, তাই তো?
– আমি খুন করিনি।
– মিথ্যে বলে কোনও লাভ নেই, মিঃ সেন। সেদিন মিটিংয়ের পর কিছুক্ষণের জন্য আপনার গাড়িটা অফিস থেকে বেরিয়েছিল তা অফিসের উল্টো দিকের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। সমীরকে সেদিন আপনি সাথে নিয়ে যাননি। সুতরাং গাড়িটা যে আপনি চালাচ্ছিলেন তা নিশ্চিত। আর আপনার অফিসের সিকিউরিটি গার্ডও জেরায় স্বীকার করেছে আপনি সেদিন কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়েছিলেন এবং মুখ বন্ধ রাখার জন্য ওকে মোটা টাকাও দিয়েছিলেন। এরপর আর কিছু বলার আছে আপনার?
মাথা নীচু করে বসে থাকে আদিত্য। আবার ইন্সপেক্টর দত্ত বলেন,
– সেদিন আপনি বেশ অনেকটা রাতে বাড়ি এসে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে ওপরে গিয়ে পয়েজন ভরা ইঞ্জেকশন সুপ্রীতিদেবীর ঘাড়ে বসিয়ে দেন। আর তারপর ফোনের গ্যালারি ক্লিয়ার করে ফিরে যান। কিন্তু আপনি ভাবেননি ছবিগুলো অন্য মেমরি কার্ডে কপি করে লুকিয়ে রাখা ছিল। তাই তো মিঃ সেন?
মাথা নেড়ে নীরবে সম্মতি জানায় আদিত্য। ইন্সপেক্টর দত্ত বলেন,
– আপনাকে আর একটা কথা জানিয়ে রাখি, মৃত মানুষকে খুনের চেষ্টার অপরাধে আপনার শাস্তি হবে কি না বা হলেও ঠিক কী শাস্তি হবে তা আদালত ঠিক করবে। তবে আপাতত আপনাকে আমাদের কাস্টডিতে থাকতে হবে।
– মানে?
– খুনটা আপনি করেননি।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ তুলে ইন্সপেক্টরের মুখের দিকে তাকায় আদিত্য।
– হ্যাঁ, মিঃ সেন। আপনার গাড়ি যে সময় অফিস থেকে বেরিয়েছিল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী তার অনেক আগেই সুপ্রীতিদেবীর মৃত্যু হয়। আপনি যখন পয়েজন ইনজেক্ট করেছেন তখন অলরেডি উনি মারা গিয়েছিলেন অ্যালার্জিজনিত শ্বাসকষ্টের কারণে।
– অ্যালার্জি! কিন্তু ওর যেসব জিনিসে অ্যালার্জি আছে সেসব তো বাড়িতে আনা হত না। সবাই জানত ব্যাপারটা।
– হুম। সুতপাদেবী সেটা বলেছেন আমাদের। কীভাবে এবং ঠিক কী ওঁর শরীরে প্রবেশ করেছে সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি।
(১৩)
সৌরভ,সমীর, আদিত্য তিনজনই অ্যারেস্টেট। কিন্তু আসল খুনি এখনো অধরা। কোনওভাবেই আর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুতপাদেবীর সাথে কথা বলেও কোনও ক্লু পাওয়া যায়নি। এমনিতেও ওঁর স্বামীর সম্পর্কে সমস্ত সত্যিটা জানার পরে উনি খুব ভেঙে পড়েছেন। বেশিক্ষণ কথা বলা যায়নি। খুনটা নিখুঁত প্ল্যানিং করে করা হয়েছে। কোনও ফাঁক নেই। খুনটা হয় সুতপাদেবী করেছেন নয়তো এমন কেউ যার নাম এখনও এই কেসে জড়ায়নি। কিন্তু কোনওদিকেই কোনওভাবে এগোনো যাচ্ছে না। ইন্সপেক্টর দত্ত থানায় বসে এগুলো নিয়েই ভাবছিলেন। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল।
-হ্যালো।
-হ্যালো, আমি আদিত্য সেনের স্ত্রী সুতপা সেন কথা বলছি।
-হ্যাঁ ম্যাডাম, বলুন।
-আমি আপনাদের কিছু কথা বলতে চাই।
-হ্যাঁ বলুন।
– ইন্সপেক্টর,আমি জানি আসল খুনটা কে করেছে। আমি সেটাই আপনাদের জানাতে চাই।
-আপনি জানেন?
-হ্যাঁ জানি। একবার আপনি আমার বাড়িতে এলে আমি সবটা আপনাকে খুলে বলব।
-আচ্ছা, আমি এখনই আসছি।
(১৪)
– বলুন, মিসেস সেন, আপনি ঠিক কী জানেন।
– আমার স্বামী খুন করেননি।
– সেটা আমরাও জানি। আপনি বলুন কে খুনটা করেছে।
– আমি!
– কি বলছেন কি আপনি?
– ঠিকই বলছি। আমিই আমার বোনকে মেরে ফেলেছি।
– কিন্তু কেন?
– আদিত্যর সাথে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল আমার অকারণ ভয় পাওয়ার কারণে। আমি জানতাম আমার ভয়টা অমূলক। তবু চেষ্টা করেও মন থেকে তাড়াতে পারছিলাম না। সেইজন্যই বোনকে এখানে নিয়ে আসি। কিন্তু বুঝিনি কত বড় ভুল করছি। ও এ বাড়িতে আসার পর থেকে আমার মনে আরও বেশি করে ভয় ঢোকাতে শুরু করে। প্রায়ই ও বলত যে, আদিত্য নাকি এত সুন্দর নিখুঁত খুনের গল্প লেখে যে ও কাউকে খুন করলেও কেউ ধরতে পারবে না। বারবার ও আদিত্যর সম্পর্কে আমাকে ভয় দেখাত নানাভাবে।
ওদিকে আদিত্য আর আমার দূরত্বও বেড়ে যাচ্ছিল। আমি আদিত্যর কাজ নিয়ে উৎসাহ তো দূর ভয়েতে শুনতেই চাইতাম না কিছু। আর সুপ্রীতি ওর কাজের ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহিত ছিল। আদিত্যর কাজের ব্যাপারে কেউ উৎসাহ দেখালে ও ভীষণ খুশি হত। তাই আদিত্য সারাক্ষণ বোনের সাথেই সিনেমার গল্পের প্লট নিয়ে আলোচনা করত। অনেক রাত অবধি ওরা গল্প করত। আমার ভালো লাগত না। এদিকে সমীর একদিন আমাকে বলল চোখ কান খোলা রেখে বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু বিচার করতে। আমার মনে সন্দেহ বাড়ল। সেদিন রাতে প্রতি রাতের মত যখন সেই ছায়ামূর্তি আমার ঘরে ছুরি হাতে ভয় দেখাতে আসে আমি প্রথমবার ভয়কে জয় করি। অন্যদিন ভয় কুঁকড়ে ঘরেই বসে থাকতাম। সেদিন পিছু নিই ঐ ছায়ামূর্তির। আমি হঠাৎ করে এতটা সাহসী হয়ে উঠব সেটা বোধহয় সে আন্দাজ করতে পারেনি। দেখতে পাই সে আর কেউ নয়,সুপ্রীতি। ওর নিজের ঘরে ঢোকার সময় পরিষ্কার ওর মুখ দেখতে পাই। বুঝতে পারি এটা আমার কোনও মনের ভুল নয়, কোনও হ্যালুসিনেশন নয়, সুপ্রীতি ইচ্ছে করে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। হয় ও আমাকে মেরে ফেলতে চায় নয়তো পাগল প্রমাণ করতে চায়। তারপর দিন সুযোগ বুঝে ওর ফোনটা লুকিয়ে দেখি। ফটো গ্যালারি ওপেন করতেই চমকে উঠি। আদিত্যর সাথে ওর ছবিগুলো দেখে আমার মাথার ঠিক ছিল না। বুঝতে পারি ওরা দু’জনে মিলে আমাকে ঠকাচ্ছে। আমি ভেবে নিই এই সব প্ল্যান ওদের দু’জনেরই। কিন্তু আদিত্যকে আমি খুব ভালোবাসি। ওকে হারাতে চাইনি। বোনকে সেদিনই ফিরে যেতে বলি। কিন্তু ও পাত্তাই দেয় না। তাই ঠিক করি ওকে একেবারে সরিয়ে দেব।
– কিন্তু খুনটা করলেন কীভাবে?
– বাজার থেকে নিজেই বেশ কিছু কমলালেবু কিনে এনে রস করি। লোকাল মার্কেট থেকে কিনিনি কারণ জানতাম পুলিশ সেখানে খোঁজ করবে। মালতী না থাকাকালীন রস করে সেই রস আপেলের মধ্যে ইঞ্জেক্ট করে দিই। বোন এখানে আসার পর রোজ বিকেলে আপেল খেত। আমি জানতাম খাওয়ার ঘন্টাখানেক পর রিয়েকশন হয়। তাই ও আপেল খাওয়ার পরই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। আমার বান্ধবীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল ঐদিন। তাই ঐ দিনটাই বেছে নিয়েছিলাম। জানতামই ওরা থেকে যেতে বলবে। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে ছিলাম। সুপ্রীতি সম্ভবত খাওয়ার সময় আপেলের টেস্টে তফাৎ বুঝেছিল। তাই পুরোটা না খেয়েই ফেলে দিয়ে ওপরে চলে যায়। আমিও অর্ধেক খাওয়া আপেলটা তুলে নিয়ে বাইরে ফেলে দিই যাওয়ার সময়। যাতে আপনারা সেটা না পান।
– কিন্তু আপনি যে সত্যি বলছেন তার প্রমাণ কী? আপনি তো আপনার স্বামীকে বাঁচাতে মিথ্যেও বলতে পারেন।
– যেখান থেকে আমি কমলালেবু কিনেছিলাম সেখানে গিয়ে আপনারা খোঁজ নিন। এর থেকে বেশি কিছু প্রমাণ তো আমি দিতে পারব না।
– বেশ। সে সব তো আমরা করবই। কিন্তু এত নিখুঁত প্ল্যান করে সব কিছু করে শেষে নিজেই ধরা দিলেন কেন?
– আমি আদিত্যকে ভুল বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম সমস্ত প্ল্যান ওরা দু’জন একসঙ্গে করেছে। কিন্তু ভাবিনি আদিত্যও এইরকম একটা স্টেপ নিয়েছে। ও নিজেও যে একটা ষড়যন্ত্রের শিকার তা যদি বুঝতাম তা হলে এমন কাজ কক্ষনো করতাম না। ও যদি একবার সবটা আমাকে বলত তা হলে দুজনে অন্যভাবে বিষয়টা মিটিয়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু এখন সব শেষ।
– আপনিও তো ওঁর সাথে সরাসরি কথা বলতে পারতেন।
– ঠিকই বলেছেন। আমিও যদি কথা বলতাম তা হলেও এমন কিছু হত না। কিন্তু তখন রাগে আমার মাথার ঠিক ছিল না।
কান্নায় ভেঙে পড়ে সুতপা। তারপর আবার বলে,
– আদিত্য তো খুন করেনি। আমি করেছি। আপনারা আমাকে শাস্তি দিন, ওকে ছেড়ে দিন।
– দেখুন ম্যাডাম, খুনটা আদিত্যবাবুর হাতে না হলেও উনি খুন করতে গিয়েছিলেন এবং শরীরে বিষ প্রয়োগও করেছিলেন। এখন ওঁর শাস্তি হবে কি না বা কতটা হবে সেটা তো আদালত ঠিক করবে। তবে আপনার যথেষ্ট বড় শাস্তি হবে এটুকু বলতে পারি। আপনার বয়ান আমি রেকর্ড করেছি।
– আমি সেজন্য প্রস্তুত হয়েই আপনাকে ডেকেছি।
– বেশ, চলুন তা হলে।
(১৫)
থানায় ফিরে এসে এস.আই বাগচী বলে,
– সুতপাদেবী তো দেখছি তার স্বামীকেও টক্কর দিলেন। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক আদিত্য সেন, যাঁর তৈরি থ্রিলার মুভি দেখতে লোকে লাইন দেয় তাঁর মার্ডার প্ল্যানেও কিছু খামতি ছিল, কিছু প্রমাণও ছিল তার বিরুদ্ধে যার জন্য তাকে পুলিশ ধরতে পেরেছে। কিন্তু এনার প্ল্যান তো ছিল একেবারে নিঁখুত।
ও.সি দত্ত হেসে বললেন,
– হ্যাঁ, ওঁর যোগ্য স্ত্রীই বটে।
– একটা খুন, চারজন খুনি চাররকম উপায়ে খুন করল, এই কেস তো পুরো রহস্যের জালে ঢাকা।
– আর অবশেষে সেই রহস্যের জাল কাটিয়ে যবনিকা পতন হল।
সমাপ্ত