হোরাসের চোখ আর নীলকান্তমণি কবচ| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | রুমি| Bengali Detective Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

বাংলা ডেস্কঃ- আন্তর্জাতিক স্তরের এক হিস্টোরিয়ন সেমিনারে যোগ দিতে ইজিপ্টের কায়রোতে গিয়ে মৃত্যু হল বিশিষ্ট ভারতীয় লিঙ্গুয়েস্টিক অরণ‍্যভূষণ ভৌমিকের (৬৮)। কায়রোর প্রসিদ্ধ বহুতল ‘কুয়াসর-ই-ব‍্যারন’ এর ঘূর্ণায়মান বারান্দা থেকে নিচে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। ঐ সময় প্রাসাদে বিশিষ্ট কয়েকজন দর্শনার্থীই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। গোটা বিষয়টি নিয়ে দানা বেঁধেছে রহস্য। যদিও প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিসের অনুমান, অরণ্যবাবু সম্ভবত পা পিছলে নিচে পড়ে গিয়েছেন। সার্বিক তদন্ত চলছে, অটপ্সির জন‍্য দেহ পাঠান হয়েছে।

পাঁচদিন আগে সেমিনারে যোগ দিতে কায়রো পৌঁছোন ইতিহাসবিদ অবনীভূষণ ভৌমিকের সঙ্গে তাঁর ছায়াসঙ্গী জমজ সহোদর তথা সহকারী লিঙ্গুয়েস্টিক অরণ‍্যভূষণ ভৌমিক। সেমিনার শেষে ইজিপ্ট সরকারের সম্মতিক্রমে ভারতীয় দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে সকলের সঙ্গে তাঁরাও ঘুরে দেখতে যান কায়রোর বিখ্যাত প‍্যালেস ‘কুয়াসর-ই-ব‍্যারন’। আঙ্কোরভাট ও ওড়িশার বিশেষ বিশেষ মন্দিরের আদলে তৈরী, নীল নদের তীরে মিশরীয় সভ্যতার সঙ্গে জড়িত এই হিন্দু মন্দিরের ইতিহাস পৃথিবীর সকল ইতিহাসবিদের কাছেই বিশেষ আকর্ষণীয় স্থল।

————-

―দারুবুড়ো তুমি রাতে ঘুমাও না? একা একা কেন ঘুরে বেড়াও? কাকে খোঁজ?

দারুবুড়ো কোমরটাকে সামান্য নুইয়ে, গালভর্তি কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে গমগমে স্বরে উত্তর দিত,

―তোর ঠাকুইকে খুঁজি রে ভাই! আর ঐ যে, ‘গজদন্ত’ কে পাহারা দিয়ে রাখি! ওটা যে খুব প্রিয় ছিল তার…..

অমনি বড় বড় টানা টানা বিস্ময়বিহ্বল চোখে দারুবুড়োর মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকত তেজস। ‘চন্দ্রচূড় এস্টেট’ এর রাতগুলো তখন আরও গাঢ় হয়ে আসত খাঁ সাহেবের মায়াবী গলায় দরবারী কানাড়ার বিস্তারে! আর সেই অতিপ্রাকৃত পরিবেশে দারুবুড়ো হাতে একটা বল্লম আর হ‍্যাজাক নিয়ে ঘুরে বেড়াত এস্টেটের এ মহল থেকে ও মহল!

তেজস‌ অ্যানথ্রোপোলজি নিয়ে পড়াশোনা করার সময় ভীষণ ভাবে উৎসুক হয়ে পড়েছিল স্পেশাল পেপার পিক্টোগ্রাফি বিষয়টিতে। তার কাছে তার দারুবুড়োর জীবন, ধ্রুবতারার মত। অতীতকে সে দারুবুড়োর মত করেই ভালোবাসত। বলত,

―বর্তমানের ভিত্তিই হল অতীত। অতীতই একদিন ইতিহাস হয়! শিকড়ের গতি অন্ধকারের দিকে হলেও সেই অন্ধকারকে অস্বীকার করা বর্তমানের স্বতোৎসারিত আলোর স্বচ্ছন্দ গতিকে নিজের হাতে বাঁধ দেওয়ার নামান্তর হয়ে যায়।

যদিও তেজসের বাবা তৃণাঞ্জয় গৎবাঁধা ছক ভেঙে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন ‘জলঢাকা হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্ট’ এর ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। কিন্তু তেজসের যখন বছর আষ্টেক বয়স তখনই পাওয়ার প্রোজেক্টের একটা দূর্ঘটনায় আকস্মিকভাবে প্রাণ হারান তিনি। এমন অসময় ছন্দপতনে তেজসের মা জয়িতা দূর্বল হৃদযন্ত্র নিয়ে, জীবন তন্ত্রীর ছেঁড়া তারে আর কিছুতেই নতুন করে সুর তুলতে পারলেন না! স্বামীর মৃত্যুর দুমাসের মধ্যেই সন্তানকে দারুবুড়ো, ছোটাই আর ঝিনু পুসুর হাতে সঁপে দিয়ে অনেক অনেক রঙিন প্রজাপতির দলে মিশে গেলেন! অন্তত সেই বয়সে তেজস মনে প্রাণে তাই বিশ্বাস করেছিল!

শীতের বিদায় বেলার পড়ন্ত সূর্য যাই যাই করেও রয়ে গিয়েছে। তেজস রত্নদীঘিকুঠির তিনতলার ঝরোখায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তার ছোটবেলার স্মৃতিমুখর রাজপুরীর অঙ্গহানি! মণিকুঠি আর রত্নদীঘিকুঠির মাঝখানে ঝিলমবাগের বিগতযৌবনশ্রী দীর্ঘশ্বাস তখন উত্তুরে বাতাসে মিশে সকরুণ বিলাপ গাথা গাইছে! যেখানে প্রতিটি মহল ছুঁয়ে আছে তার শৈশব। দারুবুড়োর বটবৃক্ষের মত স্নেহচ্ছায়ায় নিশ্চিন্ত জীবন যাপন! ছোটাইয়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা! মানেথোর সেই অদ্ভুতদর্শন গল্পের ঝোলা থেকে বের হওয়া দেশ বিদেশের অজস্র গল্প! ঝিনুপুসুর হাতে বানানো পিঁয়াজি, ডালবড়া আর লেবুর সঙ্গে কাঁচা বরফের ঝটকা! উফফ কী সব ছিল দিনগুলো! দশাসই, ফরসা টুকটুকে নায়কোচিত চেহারার আফসার উদ্দিন খাঁ সাহেব এবং তাঁর গলায় এক এক প্রহরে এক এক আলাপ!

ইদানিং, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে দারুবুড়োর ঠাকুরদাদার আমলের মণিকুঠিকে ধোপদুরস্ত করার কাজ চলছে। বেলা বাড়তেই উত্তরের ‘গজদন্ত’ দেওয়ালের দিক থেকে ধুপধাপ, দুম-ম-ম দড়াম আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এতক্ষণে বিকট হুড়মুড় আওয়াজে চারিদিকে ধূলো ঝড়ে অন্ধকার করে ভেঙে পড়ল ‘গজদন্ত’। দারুবুড়ো বলে রেখে ছিলেন, হোরাসের চোখ আঁকা হাতির দাঁতের তারকাকৃতি চাকতিটা ‘গজদন্ত’ দেওয়াল থেকে খুলে নিয়ে ইজিপ্টের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর ভাঙার কাজ শুরু করতে। আজকে সকালেই দারুবুড়ো রওনা দিয়েছেন। মাস ছয়েক আগে ইজিপ্টের ‘কুয়াসর-ই- ব‍্যারন’ এর দূর্ঘটনায়, ওখানেই ছোটাইয়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হয়েছিল দারুবুড়োকে! অটপ্সি রিপোর্টেও ছিল, উপর থেকে পড়েই মৃত্যু হয়েছে অরণ‍্যভূষণ ভৌমিকের। তারপর অস্থিভষ্ম নিয়ে দারুবুড়ো ফিরে আসেন বিন্দুর চন্দ্রচূড় এস্টেটে। পরবর্তী পারলৌকিক ক্রিয়া এখানেই সম্পন্ন হয়।

এস্টেটের সামনেই মেঘে ঢাকা ভুটান পাহাড়। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে জলঢাকা নদী, মাঝে অসংখ্য সবুজ বুগিয়াল প্রান্তর। ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। জলঢাকার এপারে ভারত, ওপারে ভূটান। সরু নদীর ওপারে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ চাদরে মোড়া ভূটান হিমালয়। জলের কুলকুল শব্দ আর একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দু’য়ে মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে ভারতের শেষ জনপদ বিন্দু। ঘড়ির কাঁটার মত নির্দিষ্ট তার গতি, নির্দিষ্ট ছন্দ! যেন সেই মহাজাগতিক ছন্দে ব্যাঘাত ঘটলে প্রলয় হবে, ধ্বংস হবে ব্রহ্মান্ড! নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে গর্বের সভ্যতা! এ হেন প্রকৃতির কোলে সানন্দে স্থান করে নিয়েছিল চিরযৌবনের আশীর্বাদধন‍্য পাহাড় ঘেরা ‘চন্দ্রচূড় এস্টেট’।

চন্দ্রচূড় এস্টেটের মালিকানায় জমজ সহোদর অবনীভূষণ ভৌমিক আর অরণ‍্যভূষণ ভৌমিক একে অপরের পরিপূরক। একটু চাপা হাইট ছিল দুই ভাইয়ের, পাঁচফুট চার ইঞ্চির মত! চেহারাও ছিমছাম, তাই দেখতে দুজনকেই বাচ্চা বাচ্চা লাগত! অবনীভূষণ প্রায়শই হাসতে হাসতে বলতেন

―বুঝলি কনিষ্ঠ, আমরা হলাম সদা নবীন….

তিন মিনিটের বড় দাদা অবনীভূষণ ভাই অরণ‍্যভূষণকে ‘কনিষ্ঠ’ বলেই সম্বোধন করতেন। আর একটা কারণ অবশ্য ছিল, অরণ‍্যভূষণের বাঁহাতের কনিষ্ঠাটি সাধারণদের তুলনায় বেশ ছোট ছিল।

ছোট্ট থেকেই এস্টেটের ইতিহাসের ঘ্রাণ গায়ে মাখতে মাখতে ইতিহাস বিষয়টিই কখন যেন নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে মিশে গিয়েছিল দুজনের। তাই পরবর্তী কালে একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবং অপরজন প্রখ্যাত লিঙ্গুয়েস্টিক রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়ে জীবনের প্রতি ভালোবাসাটাই বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। তবুও তিন মিনিটের বড় জমজ সহোদরের সহকারী হয়ে কাজ করতে করতে মাঝে মাঝেই অরণ‍্যভূষণের মনটা বিদ্রোহ করে বসত!

চন্দ্রচূড় এস্টেটের সম্পত্তি ছিল অগাধ। তার উপর বনদপ্তর থেকে ঝালং বিন্দুর প্রায় পুরো এলাকায়, দু’শো বছরের লিজে রাবার প্ল্যান্টেশনের কাজ শুরু করতে চলেছিল। আর সেই লিজ টেন্ডারের প্রায় পুরোটাই পেয়েছিল চন্দ্রচূড় এস্টেট। তাছাড়া ছিল কমলালেবুর বাগান, বেশ কিছু ওষধি গাছের চাষও হত পাহাড়ের ঢালে বড় বড় গাছের স্নেহচ্ছায়ায়। প্রতি বৎসর বিদেশে রপ্তানি হত প্রচুর কাঠ। এদিকের সব কিছু দেখাশোনা করতেন এস্টেটের ম‍্যানেজার আফসার উদ্দিন খাঁ সাহেব, অবনীবাবু আর অরণ্যবাবুর ছোট বেলার বন্ধু। আর ওদিকে দুই ভাই ইতিহাসের পাতায় জীবন উৎসর্গ করে‌ আত্মতুষ্টি লাভ করতেন। খাঁ সাহেবের মা ছিলেন লক্ষ্ণৌ ঘরানার নামী মার্গসঙ্গিতজ্ঞা। তাই রক্তে বন্দিশ খেলে বেড়াত খাঁ সাহেবের। এস্টেট দেখাশোনার মাঝে চলত তাঁর আলাপ, বিস্তার। এক এক প্রহরে এক এক রাগের বিস্তারে চন্দ্রচূড় এস্টেট যেন নেশাতুর হয়ে থাকত। তা সত্ত্বেও জীবনে‌ খামতি ছিল বিস্তর! এস্টেট ছিল গৃহলক্ষ্মী শূন্য। দুই ভাইয়ের কেউ বিবাহে উৎসাহী নন! খাঁ সাহেব একদিন বললেন,

―দোস্তোঁ, আমার জীবনে না হয় এমন একজন খুবসুরত বেগমজান থাকতে দ্বিতীয় নিকাহ করার গুস্তাখী দেখাতে পারছি না! লেকিন তোমরা তো এবার একে একে আমার ভাবিজানদের এস্টেটে আনবার ব‍্যবস্থা করতে পার!

শুনে অবনীবাবু বলতেন,

―তা বেশ বলেছ, তোমার কাছে যদি সঙ্গীতই তোমার বেগমজান হন তো আমাদের ভার্যারা ইতিহাসের পাতাতেই না হয় আটক রইলেন! কি বল!

কিন্তু অবনীবাবুর কথা ধোপে টেকেনি। দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা দেখাশোনা করে জলপাইগুড়ি রাজবাড়ীর ছোট তরফের দ্বিতীয় কন‍্যা দময়ন্তীদেবীর সঙ্গে ধূমধাম করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দিলেন। কিন্তু ইতিহাস পাগল দুই ভাই সংসার সম্পর্কে উদাসীন থেকেই গেলেন। কোনও মাসে সেমিনারে এক দেশে তো কোনও মাসে প্রাচীন লিপি পাঠোদ্ধারে অন‍্য দেশে!

সেবারে বিয়ের কিছুদিন পরেই দুভাই গেলেন ইজিপ্টের দ্বিতীয় বিখ্যাত, সুদৃশ্য শহর আলেকজান্দ্রিয়ার ‘দ‍্য ক‍্যাটাকম্বস অফ কম আল শকাফা’ য় এক আলোচনা চক্রে যোগ দিতে। আদতে এই সমাধিক্ষেত্রটি ছিল মিশরীয়, গ্রিক ও রোমান সভ‍্যতার মিলন ক্ষেত্র। আর তারই পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালোচনার জন্য‌ বিভিন্ন দেশ থেকে পঞ্চাশজন প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদ একত্রিত হচ্ছিলেন। সেখানেই অনেকদিন পর দেখা হয়ে যায় ভাতৃসম প্রত্নতাত্ত্বিক মানেথোর সঙ্গে। মানেথোর বাবা ছিলেন মিশরীয় আর মা ভারতীয়। প্রবল রসবোধের অধিকারী মানেথো তাই ভারতবর্ষকে মামাবাড়ি বলেই সম্বোধন করতেন। গতবার ভারতবর্ষে এসে কিছুদিন ছিলেনও চন্দ্রচূড় এস্টেটে। এতদিন পরে আবার ভূমধ‍্যসাগরের তীরে এমন ভাবে দেখা হ‌য়ে যাওয়াতে সকলেই অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। তখনই মানেথো জানিয়েছিলেন-

―আবার মামাবাড়ি যাচ্ছি। আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো হল দাদা। আমার বড় মামা মারা গিয়েছেন, ওঁরই পারলৌকিক কাজে যোগ দেওয়ার জন্য আবার ভারতবর্ষে যাব। আমার খুব ইচ্ছে আপনাদের সঙ্গে আপনাদের এস্টেটে একসঙ্গে কাটাব কিছুদিন!

অবনীবাবু তো আনন্দের আতিশয্যে ঘোষণাই করে দিলেন,

―চন্দ্র‌চূড় এস্টেট আজ থেকে তোমারও বাড়ি মানেথো। যখন খুশি, যতদিন খুশি তুমি থাকবে, আসবে…. যাবে…..

সেই কথাই হয়ে রইল। দুইভাই ভারতে ফেরার দিন সাতেক পরেই ভারতে এলেন মানেথো। মামাবাড়িতে কাজ মিটিয়ে এসে উঠলেন চন্দ্রচূড় এস্টেটে। এস্টেটের উষ্ণ অভ‍্যর্থনায় মানেথো আপ্লুত হয়ে গেলেন। খাঁ সাহেব শুধু নিচু স্বরে বললেন,

― ‘চিরকুমার সভা’ য় সুস্বাগতম….

খাঁ সাহেবের কথায় সকলে হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর একে একে সকলের সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষ করে গেলেন দময়ন্তীদেবীর নতুন মহল রত্নদীঘিকুঠিতে। রত্নদীঘিকুঠি তখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি, কাজ চলছিল পুরো দমে। নতুন মহলকে নিজে হাতে একটু একটু করে সাজিয়ে তুলছিলেন নতুন বৌ। লম্বা বারান্দার দুপাশে নানান দেশ থেকে আনা সুন্দর সুন্দর শোপিস দিয়ে সাজানো হচ্ছিল। মহলের কোণায় কোণায় বেলজিয়ামের অদ্ভুত কারুকাজ করা জানালার রঙিন কাচে রোদ পড়ে স্বপ্নালু পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিল। প্রত‍্যেকটা জানালা দরজায় বাহারি চিকের পর্দার আভিজাত্য‌ ছিল অনন্য। এই সবকিছু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে মানেথো দময়ন্তীদেবীর ঘরে ঢুকলেন। নতুনবৌ অপরূপা ছিলেন না ঠিকই কিন্তু তন্বী, শ‍্যামা মেয়েটির পদ্মপাপড়ির মত সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি নজর কাড়ত সকলের। সৌজন্য বিনিময়ের পর মানেথো একটা বেশ বড় সাইজের সুচিত্রিত কাঠের বাক্স দময়ন্তীদেবীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

―বধূমাতা, খুলে দেখুন।

অসাধারণ কারুকার্য এবং চিত্র সম্বলিত কাঠের বাক্সখানা। যে কেউ খুলে দেখার আগে তার বাহ‍্যিক রূপ দেখেই মোহিত হয়ে যাবে! দময়ন্তীদেবী ধীরে ধীরে বাক্সটা খুললেন, দেখলেন বাক্সর ভিতরে নীল ভেলভেটের নরম গদির উপর রাখা বড়প্লেটের সাইজের হাতির দাঁত দিয়ে তৈরী একটি তারকা! আর সেই তারকাকৃতি চাকতিটির উপর একটি মাত্র চোখ আঁকা! আর বাক্সের ঢাকনার ভিতর দিকের অংশে রঙ তুলিতে আঁকা একটা মানুষের মূর্তি, যার শরীরটা পুরুষের আর মাথাটা বাজপাখির। যোদ্ধা বেশে একপাশে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানেও তাঁর একটা চোখই দেখা যাচ্ছে। বধূমাতা সবটা দেখে অভিভূত হয়ে গেলেও এই উপহারের আসল রূপ উদ্ঘাটন করতে না পেরে স্বামীর দিকে তাকালেন! অবনীবাবুর তখন আত্মবিহ্বল অবস্থা! দুহাত বাড়িয়ে মানেথোর দুটো হাত নিজের দুহাতের মধ্যে চেপে ধরে বললেন,

―এ তো অমূল্য মানেথো! এ যে হোরাসের চোখ!

―হ‍্যাঁ, আজ থেকে এই হোরাসের চোখ চন্দ্রচূড় এস্টেটের, আমার বধূমাতার।

কিন্তু দময়ন্তীদেবী তখনও এক্কেবারে অন্ধকারেই ছিলেন, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না! তখন সাগ্রহে বললেন,

―আপনারা সকলেই এক একজন দিকপাল ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাবিদ! কিন্তু আমি তো একজন সাধারণ গৃহবধূ! আমাকেই যখন এমন উপহার দিলেন ভাই, তখন এই উপহারের ঐতিহাসিক মর্যাদাটাও যে বুঝতে চাই!

মানেথো একটু লজ্জিত হয়ে বললেন,

―একদম সত্যি কথা, এ অন‍্যায় আমার। সার্বিক পরিচয় দেওয়ার পরেই এই বাক্স আপনার হাতে তুলে দেওয়া উচিত ছিল! ঠিক আছে ভুল যখন হয়েই গিয়েছে তখন হোরাসের চোখের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় আমিই দিই! গল্প বলতে কিন্তু আমি খুব ভালোবাসি….

― “প্রাচীন মিশরের অন্যতম পরিচিত পবিত্র প্রতীক হল এই হোরাসের চোখ। মিশরীয় বহু প্রাচীন শিলালিপি, চিত্রকর্ম, পুঁথি কিংবা পিরামিডের দেয়ালে এই প্রতীক লক্ষ্য করা যায়। হোরাসের চোখের শক্তিশালী সুরক্ষা ক্ষমতার কারণে প্রাচীন মিশরবাসীদের মধ্যে এটিকে বিপুল পরিমাণে কবচ আকারে ব‍্যবহার করতে দেখা যেত।

প্রাচীন মিশরীয় পুরাণ অনুসারে, ওসাইরিস ছিলেন মিশরের রাজা এবং আইসিস তার রানী। ওসাইরিসের ভাইয়ের নাম ছিল সেট। মিশরের রাজসিংহাসনের প্রতি তার ছিল তীব্র লোভ। ফলে কীভাবে ওসাইরিসকে হত্যা করে রাজসিংহাসন দখল করা যায় তা নিয়েই সবসময় মগ্ন থাকত সেট। অবশেষে নানা চিন্তাভাবনার পর তিনি চমৎকার একটি বুদ্ধি বের করেন।

ইথিওপিয়ার রানীর সহায়তায় ওসাইরিসের দেহের মাপে চমৎকার একটি সিন্দুক নির্মাণ করেন তিনি। এরপর সেট এক বিশাল ভোজের আয়োজন করে ওসাইরিসকে সেই ভোজে নিমন্ত্রণ করলেন। তারপর সিন্দুকটি যে কক্ষে ছিল সেই কক্ষে সকলের সঙ্গে ওসাইরিসকে নিয়ে গিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘এই সিন্দুকটিতে শোয়ার পর যার দেহের সাথে এটি মাপসই হবে তাকেই এটি উপহার দেওয়া হবে।’ যেহেতু ওসাইরিসের মাপেই সিন্দুকটি তৈরি করা হয়েছিল সেহেতু উপস্থিত সকলের চেষ্টা বিফল হল। একমাত্র ওসাইরিস সিন্দুকের মধ্যে ঢুকলেই সেটি তার শরীরের মাপের সাথে সঠিক ভাবে মিলে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে সিন্দুকের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয় সেট। ওসাইরিস সহ সেই সিন্দুকটি নিক্ষেপ করা হয় নীল নদের জলে। ফলে মৃত্যু হয় ওসাইরিসের।

দৈববলে আইসিস জানতে পারেন তাঁর স্বামী আছেন বাইব্লোসের রাজসভার পিলারের ভেতর। তখন রাজার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে নিয়ে আসেন সেই পিলার। গুঁড়ি কেটে বের করেন ওসাইরিসের দেহ। তারপর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে স্বামীর প্রাণ দান করেন আইসিস। সেই সময় ওসাইরিসের দেহের ভেতর জন্ম নেওয়া একটি অঙ্কুরকে নিজের গর্ভে স্থাপন করেন আইসিস। সেই অঙ্কুর থেকেই জন্ম নেন শক্তিশালী দেবতা হোরাস।

জীবন ফিরে পাওয়ার পর বিধাতার আদেশে ওসাইরিস পাতালের দেবতা হয়ে সেখানে চলে যান। পৃথিবী শাসন করতে থাকেন অত্যাচারী সেট। যুবক হয়ে হোরাস কাকা সেটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সত্যের জয় হয়, হোরাসের হাতে নিহত হন সেট। কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্তে সেটের অস্ত্রের আঘাতে হোরাসের ডান চোখ করোটি থেকে উপড়ে গিয়ে, পড়ে মিশরের মাটিতে। সেই দিন থেকে মিশরের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে নেয় হোরাসের চোখ। হোরাস হয় আকাশের দেবতা। বাজপাখির ছবি দিয়েই প্রাচীন মিশরে তাঁর রূপ কে প্রকাশ করা হত।”

এই হল হোরাসের একটি মাত্র চোখের কাহিনী।

অবনীবাবু সন্তর্পণে হাতে তুলে নিলেন হোরাসের চোখ। ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন সামনে পিছনে। হঠাৎ তারকাকৃতির পিছন দিকটা দেখতেই চোখ আটকে গেল! দেখলেন ভীষণ ছোট্ট ছোট্ট করে কিছু লেখা রয়েছে। অরণ‍্যবাবুর হাতে দিয়ে বললেন,

―দেখ তো কনিষ্ঠ, তারকার পিছনদিকে কিছু লেখা আছে মনে হচ্ছে! আর তাহলে তো স্টাডি রুমে যেতে হবে, ব্রাশ আর ম‍্যাগনিফাইন গ্লাসের প্রয়োজন পড়বে।

―কই দেখি! হুমম্ ঠিকই তো বলেছিস অবন, এ তো হিয়ারোগ্লিফিক লিপিতে কিছু লেখা!

তখন মানেথো বললেন,

―হ‍্যাঁ, কয়েকটা লাইন লেখা রয়েছে হোরাসের চোখ সম্পর্কে।

সকলে উৎসুক হয়ে স্টাডি রুমে গেলেন। তারপর কনিষ্ঠ একটা ম‍্যাগনিফাইন গ্লাসের নীচে লেখাগুলোকে রেখে একটা ছোট্ট ব্রাশ দিয়ে আলতো করে ঝেড়ে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলেন,

― “পবিত্র দৃষ্টি সুখে একান্তে গজদন্ত-

বুকে তার শতাব্দীর রহস্য অনন্ত!

মৃত বুকে বহমান কবচ জীবন্ত-

খিলান সরিয়ে পাও নতুন দিগন্ত।

প‍্যাপিরাসের ইতিহাসে সুরক্ষিত নীলকান্ত-

ত্রিভুজ প্রাকারে সুপ্ত অনাদি মরুপ্রান্ত!

উত্তরে দিক পাবে প্রশ্নে বিভ্রান্ত-

শ্রমের মূল্য পাবে না, হলে পরিশ্রান্ত।

জন্ম – প্রজন্মের হবে অধিকার আদ‍্যন্ত-

প্রথম সৌরমাসে যার ঊনিশ বসন্ত।”

সবটা পড়ার পর অরণ‍্যভূষণ বললেন,

―কিন্তু পুরো ছড়াটা তো হোরাসের চোখ সম্পর্কে বলে মনে হচ্ছে না! আরও একটা কিছুর প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এই ছড়ায় রয়েছে!

―হুমম্! আবার পড় তো!

বার চার পাঁচেক পড়েও আভ‍্যন্তরীণ অর্থ সেই মুহূর্তে কিছুতেই যখন বোঝা গেল না তখন মানেথো বললেন,

―আমরা যা ভাবছি হয়তো তা নাও হতে পারে! হয়তো পুরোটাই কোনও কবির দৃষ্টিভঙ্গি!

অবনীবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,

―একটু সময় নিয়ে দেখতে হবে! মানেথো কোথায় পেয়েছ তুমি এই তারকাটিকে? কনিষ্ঠ, এই লিপি কতদিন আগের লেখা কিছু আন্দাজ করতে পারছিস? আমার মনে হচ্ছে এই চাকতি ফ‍্যারাও এর সময়কার। কারণ তখনই নিকট প্রাচ‍্যে বানিজ্য শুরু হয়েছিল। আর হাতির দাঁতের উপর এই নিদর্শন সেই সময়কার বানিজ‍্যেরই পরিচয় বাহক। কারণ মিশরে হাতির দাঁত সহজলভ্য ছিল না। আমদানি করে আনতে হত।

―আমি, আপনাদের সঙ্গে আলেকজান্দ্রিয়ার ‘দ‍্য ক‍্যাটাকম্বস অফ কম আল শকাফা’ য় দেখা হওয়ার মাস ছয়েক আগেও একবার গিয়েছিলাম দশজনের একটা অভিযাত্রী দলের সদস্য হয়ে। তখনই ঐ অভিযাত্রী দলের পৃষ্ঠপোষক স‍্যর ফ্রেডরিকের তরফ থেকে আমাকে দেওয়া উপহার ছিল এটি। আর আমিও সেই সেরা জিনিসটাই বধূমাতার জন‍্য উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছি।

অরণ‍্যবাবু কিন্তু অবনীবাবুর মত অত কথা বলতেন না। কিন্তু দৃষ্টি ছিল খুব প্রখর! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখে বললেন,

―এই হায়ারোগ্লিফিক লিপিটা বেশ প্রাচীন! এটা ফ‍্যারাও যুগের মাঝামাঝি সময়কার। এই ধরণের হিয়ারোগ্লিফিক লিপিকে কার্সিভ হিয়ারোগ্লিফিক লিপি বলা হয়, যা ধর্মীয় পত্রে লেখা হত। যেহেতু এই লিপি ভীষণ জটিল! কখন কী অর্থ বোঝান হচ্ছে তা শুধু লিপি পাঠ করলেই বোঝা যায় না, তার জন্য এই লিপিকে নিয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন হয়। এই লিপির দিকনির্ণয়ও খুব প‍্যাঁচালো, কখন যে ডান দিক থেকে আর কখন যে বাম দিক থেকে পড়তে হবে তা ভীষণ ভাবে খেয়াল রাখতে হয়। নইলে পুরো ব‍্যাপারটার মর্মার্থই ভিন্ন হয়ে যায়! একটু সময় লাগবে। তবে একটা জিনিস কেউ লক্ষ্য করেছ?

অবনীবাবু, মানেথো সমস্বরে বলে উঠলেন,

―কী ই ই….

―এই চাকতির পিছন দিকের কিনারা বরাবর একটা প‍্যাঁচ আছে! অর্থাৎ…..

মানেথো বললেন,

―কিছুর একটা ঢাকনা বা চাবি!

―একদম তাই…..! একটু সময় নিয়ে ভাবতে হবে তিনজনকেই।

বললেন অরণ‍্যবাবু। তারপরেই সকলে ভিতর মহলে প্রবেশ করতে যাবেন এমন সময় অরণ‍্যভূষণ আবার বলে উঠলেন,

―মানেথো, তোমার কাঁধে এই অদ্ভুত দর্শন ঝোলাটিকে কোথা থেকে জোগাড় করলে!

মানেথো হেসে উত্তর দিলেন,

―ইনিও ঐতিহাসিক! মিশরের আসোয়ানে ‘আইসিসের টেম্পেল’ এর পুরোহিত নেছায়মুনের কাছ থেকে পাওয়া। একবার ওঁর বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলাম, ফিরে আসার সময় এই ঝোলা তিনিই উপহার দিয়েছিলেন। এর বিশেষত্ব হল এর ভিতরের অংশ প্রাচীন প‍্যাপাইরাস দিয়ে তৈরী।

―তোমার জীবন কাহিনীও তো খুব বর্ণময়! আর তুমি খুব সুন্দর করে সেই ঘটনাগুলো তুলে ধরতেও পার! খুব ভালো লাগল তোমাকে এত কাছ থেকে পেয়ে।

কথাগুলো বলার পরেও কপাল কোঁচকানোটা গেল না অরণ‍্যবাবুর! যতক্ষণ দেখা গেল, ঝোলাটাকে দেখতে থাকলেন। তারপর নিজের ঘরে যাওয়ার আগে বৌমণির কাছ থেকে তারকাটিকে নিজের কাছে কয়েকদিন রাখবার অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন।

কয়েকদিন ধরে নিবিষ্ট মনে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও হোরাসের চোখের রহস্য ভেদ করতে পারলেন না তিনজনের কেউই। তবুও খোঁজ খবর চলতেই থাকল। কখনও কখনও এমনও মনে হয়েছে এ বুঝি অভ‍্যাসগত অহেতুক অনুসন্ধিৎসা! অবশেষে বধূমাতার হাতে আবার ফিরে এল ‘হোরাসের চোখ’। ততক্ষণে দময়ন্তীদেবীও বুঝে গিয়েছিলেন আর এঁদের টিকিটিও ধরতে পারবেন না! তেমাথা ছিল, এখন আবার চৌমাথা এক হয়েছে! অনোন‍্যপায় হয়ে নতুনবৌ আপন তত্ত্বাবধানে চন্দ্রচূড় এস্টেটের ইঁট কাঠ পাথরের মহলে প্রাণ সঞ্চারে সচেষ্ট হলেন! ঢেলে সাজাতে লাগলেন মহলের অন্দর। নতুন দাসদাসী নিয়োগের সময় যদিও আফসার ভাইয়ের সাহায্য পেলেন! এস্টেট একেবারে প্রাণবন্ত হয়ে উঠল! নতুন মহল রত্নদীঘিকুঠির সঙ্গে পুরোনো মহল মণিকুঠির যোগাযোগের গাঁটছড়া বাঁধলেন ঝিলমবাগের অপূর্ব নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে! উত্তরদিকে তৈরী করা হল একটি সুদৃশ্য দেওয়াল। যার ঠিক মাঝখানে সুসজ্জিত বৃত্তের মাঝে ঠাঁই পেল হাতির দাঁত দিয়ে তৈরী সেই তারকা, যার ঠিক কেন্দ্রে খোদাই করা ছিল হোরাসের একটি মাত্র চোখ! মানেথোর দেওয়া বহুমূল্য উপহার! তখন থেকেই উত্তরের দেওয়ালের নামকরণ হয়েছিল ‘গজদন্ত’।

চন্দ্রচূড় এস্টেট আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, অবনীভূষণ আর দময়ন্তীদেবীর দুই সন্তান তৃণাঞ্জয় আর ঝিনুককে পেয়ে। বছরের পর বছর ঘুরলেও দময়ন্তীদেবী কিন্তু কিছুতেই অরণ‍্যবাবুকে বিয়ের জন‍্য রাজি করাতে পারছিলেন না! কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছিলেন, দেওরের মধ্যে কী যেন এক অস্থিরতা কাজ করছে সবসময়! মানেথো তখন ভারতবর্ষের প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে বই লিখছিলেন ‘ভারতবর্ষ, সভ‍্যতা ও প্রত্নতত্ত্ব’। তাই ভারতে সময় কাটাতে চাইছিলেন অনেক বেশি‌। মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তেন ভারতবর্ষের নানা জায়গায়। আবার ফিরে আসতেন চন্দ্রচূড়েই।

সেবারে মানেথোর এস্টেটে ফিরে আসার ঠিক পরেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল! হঠাৎ ওঁর সেই অদ্ভুত ঝোলাটা গায়েব হয়ে গেল! বহু খোঁজাখুঁজির পরেও যখন তার কোনও হদিস মিলছিল না ঠিক তখনই দৈবক্রমেই তার দেখা পেলেন দময়ন্তীদেবী! খাঁ সাহেবের গলায় তখন রাগ দীপকের বন্দিশ খেলছে। সন্ধ‍্যাপ্রদীপ হাতে দুই মহলে ধূপ সন্ধ্যা দিয়ে সবে ঠাকুর ঘরে ফিরছেন দময়ন্তীদেবী, এমন সময় দেখলেন অরণ‍্যভূষণ খুব সন্তর্পণে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন! একটু অবাক হয়ে, গাছার উপর প্রদীপ রাখতে গিয়ে চোখ পড়ল মদনমোহনের সিংহাসনের ভিতরে যে লাল ভেলভেটের আসন পাতা থাকে, তার ঠিক নীচে হালকা হলুদ রঙের আরও কিছু একটা পাতা রয়েছে! ফলে জায়গাটা একটু উঁচু হয়েও আছে! ভাবলেন, ‘‘কনিষ্ঠ তো ঘোর নাস্তিক! ঠাকুর ঘরে জীবনেও ঢোকে না, তবে …আজ…!’’ যাইহোক তিনি নিজে হাতে ঠাকুরঘর গোছগাছ করেন, এরকম কোন জিনিস তো তিনি এখানে রাখেননি! আর কিছু না ভেবেই জিনিসটা কী তা দেখবার জন‍্য কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে টেনে বের করে দেখলেন একটা ছেঁড়াখোঁড়া বস্তু! ভালো করে আলোর সামনে এনে দেখলেন, “আরে এ যে মানেথোর সেই হারিয়ে যাওয়া ঝোলা! তার এমন অবস্থা কে করল! বিশেষ করে ভিতরের হলুদ পাতার মত অংশ, যেটাকে মানেথো বলেছিল ‘প‍্যাপাইরাস’ সেটা তো একেবারে সামনের অংশটার থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে! তাতে আবার কত রকমের আঁকিবুকি!” দময়ন্তীদেবী সেই মূহুর্তে বাকি ঘটনা কিছু না বুঝলেও একটা ব‍্যাপার বুঝলেন যে এই জিনিসটা ঠিকঠাক করে সেলাই করে মানেথোর ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। তারপর সুন্দর করে সেলাই করে, চুপচাপ মানেথোর ঘরের কাঠের আলমারিতে রেখে দিয়ে এলেন।

মানেথো তো ঝোলাটাকে শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরের কাঠের আলমারির এক কোণায় আবিষ্কার করে, আনন্দে বাড়িতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন! এদিকে অরণ‍্যবাবু বোধহয় বৌমণির সজাগ দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারবেন না জেনেই দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলেন!

ইদানিং প্রায়ই অরণ‍্যভূষণ অবনীভূষণের স্টাডিরুমে গিয়ে খুব সন্তর্পণে এটা ওটা সরিয়ে কিছু খুঁজতে থাকেন আর সেটা দময়ন্তীদেবী আঁচ করতে পেরেও সংসারের চাপে সবটা তদ্বির করে উঠতে পারছিলেন না। ঐ সময়েই অরণ‍্যভূষণের ম‍্যালেরিয়া ধরা পড়ল আর তখনই দুই ভাইয়ের যৌথ আমন্ত্রণ এল ইজিপ্টের কায়রোয় তাদের বিশেষ বন্ধু রামসিসের কাছ থেকে। রামসিস একাধারে গনিতবিদ ও জ‍্যোতিষশাস্ত্রবিদ। ইজিপ্টে তখন তোলপাড় চলছে! প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে! সেই সময় ব্রিটিশ ধনকুবের লর্ড কারনারভন‌ একটি বিশেষ মমি উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন, তাঁদের সেই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত হন যুবক হাওয়ার্ড কার্টার। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয়নি। এখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই আবার নতুন উদ‍্যমে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন হাওয়ার্ড সহ লর্ড কারনারভন। তাঁরা গতবারের অভিযানের সময়েও রামসিসের কাছে এসেছিলেন এবং কত তারিখে, কোন সময়ে, গ্রহ নক্ষত্রের কোন অবস্থানকালে অভিযান শুরু করবেন বিস্তারিত ভাবে জেনে নিয়ে ছিলেন। রামসিস তাঁদের জানিয়ে ছিলেন,

―আগের সমস্ত অভিযানের মত এই অভিযানও তোমাদের বিফল হবে, মাঝ রাস্তায় কাজ বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসতে হবে। একথা যেমন ঠিক তেমনি এই অভিযান সর্বতভাবে যে বিফলে যাবে না, এটাও ঠিক…..

পরবর্তীকালে রামসিসের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাওয়ায় লর্ড কারনারভন, হাওয়ার্ড কার্টার‌ ও জোজ হেরব‍্যট সহ অভিযানে যুক্ত সকলেই দিন চারেক পরেই রামসিসের কাছে আসছেন নতুন করে অভিযানের দিনক্ষণ নির্ধারণ করবার জন‍্য।

এ যেন খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মত অবস্থা! বছরের পর বছর কাটছিল, সঙ্গে এতগুলো লোকের পরিশ্রম, অর্থ! কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। মমির কাছে পৌঁছনোর দরজা কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় সবারই যখন ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে, উল্টোদিকে ফান্ড তুলে নেওয়ার কথাও বলছেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক! কিন্তু হাওয়ার্ড কার্টার নাছোড়বান্দা, আরও খানিক চেষ্টা করে দেখতে চান! এমতাবস্থায় রামসিস ভীষণ ভাবে চাইছিলেন অবনীবাবু এবং অরণ‍্যবাবুও তাঁর কাছে উপস্থিত থাকুন।

কিন্তু অরণ‍্যবাবু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কায়রো যেতে না পারার, অবনীবাবু বাধ‍্য হয়ে একাই গেলেন। এদিকে এমন অসাধারণ একটা মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে না পেরে মনে মনে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন অরণ‍্যভূষণ। রামসিসের কাছে যাওয়ার আগে অবনীবাবু তাই অরণ‍্যভূষণের ঘরে দেখা করতে গেলেন,

―এ কী রে! তোর এমন গালভর্তি দাড়ি! আমিই তো চমকে উঠেছিলাম! হঠাৎ মনে হল নিজেই দাঁড়িয়ে দেখছি নিজের শায়িত রূপ! তবে কি এবারে আমি দাড়ি কামিয়ে ফেলব! বেশ একটা ধন্দের সৃষ্টি হবে যাহোক! যাক, তুই চটপট সুস্থ হয়ে ওঠ তো! তারপরে যেন দাড়িটা কামিয়ে ফেলিস। শোন মন খারাপ করিস না, এই ধরনের অভিযানে সফলতা পাওয়া যে কত কঠিন তা তোর থেকে ভালো আর কে জানবে বল!

অরণ‍্যভূষণ আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে চুপ করে শুয়ে থাকলেন।

একাত্ম মনে কান পাতলেই তখন ইতিহাসের ফিসফিসানি শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল! আর তার সাক্ষী থাকছিল পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা। মাহেন্দ্রক্ষণ ক্ষণ বুঝি আসন্ন, অনেক দিন পর দুই বন্ধু অবনীভূষণ আর রামসিস একত্রিত হলেন ইতিহাসের সাজানো আসরে। কিছুক্ষণ পরেই এলেন সেই অভিযাত্রীর দল যাঁরা ইতিহাসকে বিশ্ব সমখ‍্যে প্রমাণ‍ সহ দেখাতে চাইছেন, “দেখ, এই আমাদের ঐশ্বর্য আমাদের পূর্বপুরুষ, আমাদের পরিচয়!”

হাওয়ার্ডের কঠোর মনোভাব আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই পরবর্তীতে তৈরি হল ইতিহাস। মাটির বুক থেকে বেরিয়ে এল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আবিষ্কার, ‘ফ্যারাও তুতেনখামেনের মমি’। অবশ্য শুধু মমিই নয়, সেই সঙ্গে উঠে এল বহু মিথ, গল্পকথা আর ‘অভিশাপ’। পাওয়া গেল অজস্র সোনাদানা, বহুমূল্য হীরে জহরতের বিপুল সম্ভার! শুধু মমির বুকের উপর মাঝারি আকারের একটা গোল তারকাকৃতি চাকতির নিচে থাকা সুরঙ্গকে খোলা গেল না! মমির কোন রকম ক্ষতি না করে ঐ জায়গাকে তখনকার মত বাদ রেখেই কাজ শুরু হল।

চারদিকে খুশির আমেজের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে তখন মরুভূমির বালির সঙ্গে উড়ছে তুতেনখামেনের শবাধার আবিষ্কারের লৌকিক অলৌকিক কাহিনীও। শ্রমিকদের মুখে মুখে রটছে সমাধির মূল ফটকের দেয়ালে লেখা আছে, “যারা এই পবিত্র সমাধিতে প্রবেশ করবে, তাদের উপর শীঘ্রই নেমে আসবে মৃত্যুর ভয়াল থাবা!” ফলে বিপুল ভাবে শ্রমিক বিক্ষোভ শুরু হল আর তখনকার মত বন্ধ হয়ে গেল সমাধির যাবতীয় কাজ।

বাধ‍্য হয়ে বিন্দুতে ফিরলেন অবনীবাবু। এস্টেটের গাড়ি গিয়েছিল জলপাইগুড়ি থেকে তাঁকে নিয়ে আসতে। অন‍্য সময় ড্রাইভারের সঙ্গে খাঁ সাহেবও আসতেন। এবারে খাঁ সাহেবকে না দেখতে পেয়ে অবনীবাবু ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন,

―আফসার মিঞা কোথায়? আসেনি যে বড়!

―ওঁর শরীরটা ভালো নেই স‍্যার!

―সে কি ! কী হল আবার!

―স‍্যার আপনি আগে বাড়ি চলুন।

কথাগুলো একটু অস্বাভাবিক লাগলেও অবনীবাবু এতখানি রাস্তায় আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে একটা জার্নাল খুলে বসলেন। মনটা কিন্তু অস্থির হয়েই রইল! তৃণাঞ্জয় হাওড়ার বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ছে, চতুর্থ বর্ষ। তার খবর নিয়েছেন, ভালো আছে সে। বাকি সকলেই তো বাড়িতে! খাঁ সাহেবের আবার কী হল! সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতে বাড়ি পৌঁছোতেই দেখলেন খাঁ সাহেব আর মানেথো পোর্টিকোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।

―আরে! খাঁ সাহেব যে! শরীর ঠিক আছে তো? আমাকে নিতে…..

―তুমি ভিতরে চল….

―হ‍্যাঁ, চল! কিন্তু….

একটা আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছিল অবনীভূষণের মনের কোনে! সকলের মুখ কেন থমথম করছে! কী হয়েছে! ভাবতে ভাবতেই আফসার খাঁ অবনীভূষণকে সোজা দময়ন্তীদেবীর ঘরে নিয়ে এলেন। ঝিনুও তখন মায়ের মাথায় কাছ থেকে উঠে ছুট্টে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অবনীবাবু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। আজ বেশ কিছুদিন ধরেই ম‍্যালেরিয়ায় ভুগছিলেন দময়ন্তীদেবী। অবস্থা ভালো নয়। জগন্নাথ ডাক্তার তখনও পাশেই বসে ছিলেন। অবনীবাবু ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার। কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বললেন,

―বোধহয় তোমার জন‍্যই অপেক্ষা করছেন বৌমা…

চারদিন পর মাঝরাতে চাঁদ অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দময়ন্তীদেবীও চন্দ্রচূড়ের ছায়ায় বিলীন হয়ে গেলেন। চন্দ্রচূড়ে অমাবস্যা নেমে এল! মানেথো আর আফসার মিঞা কিন্তু আরও বেশি করে একাত্ম হয়ে পড়লেন এস্টেটের সঙ্গে।

————————————————————

মানেথো বছর তিনেক হল ফিরে গেছেন ইজিপ্টে। ‘ভারতবর্ষ, সভ‍্যতা ও প্রত্নতত্ত্ব’ বইটা আলোড়ন ফেলে দিয়েছে ভারতে তথা বিশ্বের দরবারে। বর্তমানে কয়েকটা ঘটনায় তেজসের মন ভীষণ ভাবে অস্থির! নিজের চোখের সামনে ছোটাইয়ের আকস্মিক মৃত‍্যু, দারুবুড়ো এক্কেবারেই মেনে নিতে পারছিলেন না! মাস ছয়েক হয়ে গেল, এখনও অব্দি গুম হয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকছিলেন সব সময়। খাঁ সাহেবের সঙ্গেও সেভাবে কথা বলছিলেন না! ঝিনুপুসু দারুবুড়োর ঘরে খাবার দিয়ে আসছে। এইসব কারণেই বোধহয় ঝিনুপুসু বিয়ে করল না। দারুবুড়ো আর ছোটাইকে কে দেখবে! আর তেজসকে! ঝিনুপুসু যে তার কাছে প্রথম বর্ষার নধর সবুজ ঘাসের উপর পেতে রাখা সেই আঁচল যার চৌহদ্দিতে স্নেহের গভীর পরিখা কাটা! নিরুপদ্রব বিচরণ ভূমি! দারুবুড়ো আগে সবসময় তেজসকে কাছে কাছে রাখতেন, হাতে কলমে শেখাতেন সব কিছু। এখন তো এমনিতেই খুব কম সময় দেখা হয়! তার উপর আবার কিছু প্রশ্ন করলে হ‍্যাঁ, হুম দিয়ে, ঘরে ঢুকে যান! তেজস বুঝতে পারছিল, দারুবুড়ো ছোটাইকে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না! এস্টেটে ফিরে আসার বেশ কয়েকদিন পর তেজস লক্ষ‍্য করল, দারুবুড়োর বাঁ হাতের কনিষ্ঠায় একটা ব‍্যান্ডেজ! মনে করে দেখল কায়রো থেকে ফেরার পর বেশিরভাগ সময় দারুবুড়ো ঘরে থাকছিল নয়তো বাঁ হাত প‍্যান্টের পকেটেই ঢুকিয়ে রাখছিল তাই বোধহয় নজরে পড়েনি!

―দারুবুড়ো তোমার আঙুলে কী হল?

―একটু কেটে গেছে, ও কিছু না!

―কই দেখি!

―না! তেমন কিছু না…

বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন! খাঁ সাহেবও সবটা লক্ষ্য করলেন দূর থেকে। তেজস একবার থমকাল, মনে মনে ভাবল, ‘দারুবুড়োর গলাটা এরকম শোনাল কেন!’ তখনই খাঁ সাহেব‌ তেজসের কাছে এসে বললেন,

―এরকম ভাবে তো জীবন চলে না তেজী! অবনের ভাতৃশোক কাটিয়ে উঠতে আমাদেরও সচেষ্ট হতে হবে!

―হুমম্

বলে তেজস ঝিনুপুসুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

―দারুবুড়ো খাবার ঠিকঠাক খাচ্ছেন তো ঝিনুপুসু?

―জানিস তেজী, কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছেন বাবামশাই! কাকাই যা যা পছন্দ করতেন সেইগুলোই খেতে চাইছেন! সোনামুগের ডাল বাবামশাই খুব খেতে ভালোবাসতেন। কিন্তু এখন শুধু কাকাইয়ের পছন্দের পিঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে মুসুর ডাল খেতে চাইছেন। রাতে কাকাইয়ের মত রুটি খান, ভাত খাওয়া ছেড়ে।! এভাবে চললে তো বাবামশাই অসুস্থ হয়ে পড়বেন রে….!

―হুমম্……দেখছি দাঁড়াও।

―তুই তোর দারুবুড়োকে একটু বোঝা বাবা!

দারুবুড়োর ঘর রত্নদীঘিকুঠির দুতলায় একেবারে ঝিলমবাগের গায়ে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর দারুবুড়োর ঘরে তেজস ঢুকতে যাবে, বুঝল দরজা ভিতর থেকে বন্ধ! টোকা দিতে গিয়েও থেমে গেল! ভিতরে যেন তন্নতন্ন করে কোনকিছু খুঁজছেন, সেই রকম হুটপাট শব্দ শুনতে পেল তেজস বাইরে থেকে! সঙ্গে সঙ্গে তেজসও নিচে নেমে অন্ধকারে ঝিলমবাগে এসে দাঁড়াল। যেখান থেকে দারুবুড়োর ঘরের জানালা দেখতে পাওয়া যায়। দেখল, দারুবুড়ো গোটা ঘর অস্থির হয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছেন! কিছু একটা খুঁজছেন! হয়তো পাচ্ছে না, তখন এক হাতের চেটোতে আর এক হাতে মুঠি বাগিয়ে ঘুঁষি মেরে চলেছেন আর এক একবার অস্থির পায়াচারি করে চলেছেন!

তেজস আর দারুবুড়োর ঘরে গেল না, ফিরে এল নিজের ঘরে। আসতে আসতে ভাবছিল ব‍্যাপারটা কী! এরকম কেন করছেন দারুবুড়ো! কিছু তো বলছেনও না! পরের দিন সকালে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এল দারুবুড়োর নামে। দারুবুড়ো সই করে চিঠি নিয়ে আবার ঘরে ঢুকে গেলেন। ঝিনুপুসু জলখাবার নিয়ে দারুবুড়োর ঘরে ঢুকল, দারুবুড়ো ঝিনুপুসুকে বলল,

―কাল সকালে ইজিপ্ট যাব। এবারে কয়েকদিন সময় লাগবে।

কথাটা কানে যেতেই তেজসও দারুবুড়োর ঘরে ঢুকে বলল,

―তবে কি ‘হোরাসের চোখ’ এর রহস্য সমাধান করে ফেলেছ দারুবুড়ো!

―দেখি গিয়ে!

―আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি না!

একটু যেন চমকে অবনীভূষণ বললেন,

―না, না…কত রকমের বিপদের সম্ভাবনা থাকে এক্ষেত্রে…তুমি না…

―আমি কী এখনও তোমার সেই ছোট্ট তেজীবাবু আছি! আমি যাব।

হঠাৎ কঠিন স্বরে অবনীভূষণ বলে উঠলেন,

―না, তুমি যাবে না।

দারুবুড়োর ইজিপ্ট রওনা দেওয়ার পর তেজস ঢুকল দারুবুড়োর ঘরে। অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না। দেখল, ঘর একেবারে ওলটপালট হয়ে আছে! অথচ দারুবুড়ো খুব গোছানো মানুষ। টেবিলের ওপর অনেক বই, ম‍্যাপ ছড়ানো। তার মধ্যেই একটা ছোট্ট পকেট ডায়রি পড়ে আছে। নাড়াচাড়া করতে করতে ডায়রির পাতা উল্টে দেখল এক জায়গায় লেখা কয়েকটা লাইন-

মৃত বুকে বহমান / কবচ জীবন্ত –

(আবহমান কাল মৃতের বুকে কবচ ধারণ! মমি!)

খিলান সরিয়ে পাও / নতুন দিগন্ত –

(ধনরত্ন! নাকি অন্য কারোর মমি!)

প‍্যাপাইরাসের ইতিহাসে / সুরক্ষিত নীলকান্ত – (প‍্যাপাইরাসে লিপিবদ্ধ! নীলকান্তমণি!)

উত্তরে দিক পাবে / প্রশ্নে বিভ্রান্ত –

(প্রশ্নের উত্তর নয়, উত্তর দিক!)

ত্রিভূজ প্রাকারে সুপ্ত / অনাদি মরুপ্রান্ত – (পিরামিড! শবাধার! মিশর!)

জন্ম – প্রজন্মের হবে / অধিকার আদ্য‍্যান্ত

প্রথম সৌরমাসে যার / ঊনিশ বসন্ত –

(ঊনিশ বৎসরেই মারা যান ফ‍্যারাও তুতেনখামেন….)

তেজস ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে বেশ কিছু কাগজ পোড়ানো হয়েছে! ঝুঁকে পড়ে একটা কাঠের স্কেল দিয়ে ঘেঁটে দেখল সেগুলো। তার মধ্যে থেকে আধপোড়া একটা কাগজ হাতে তুলে নিয়ে দেখল, দারুবুড়োর সই…একবার নয়, অনেক বার! চমকে উঠল নিজের অজান্তেই। হাতে করে আধপোড়া কাগজ আর ডায়রিটা নিয়ে তিনতলার ঝরোখায় গিয়ে দাঁড়াল কিছুক্ষণ! তারপর কর্তব্য স্থির করে তরতরিয়ে নিচে নেমে এল। সকাল হতেই তেজস খাঁ সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। সারা দিন ধরে সমস্ত প্রয়োজনীয় কাজ সেরে এস্টেটে ফিরল রাতে। ঝিনুপুসুকে জানাল পরের দিনেই বিশেষ প্রয়োজনে তাকে কায়রো যেতে হবে। মানেথো থাকবেন ওখানে।

ইজিপ্টে আসার সমস্ত ব‍্যবস্থা মানেথোই করে দিয়েছিলেন আপতকালীন তৎপরতায়। তেজসের কায়রো আসার যুক্তি সহ সমস্ত কারণ শুনে মানেথো কথা দিয়েছিলেন প্রতিটা পদক্ষেপে সঙ্গে থাকবেন। ইজিপ্ট পৌঁছনোর পর দুজনে রওনা দিলেন সোজা নীল নদের পশ্চিম দিকে, লুক্সর শহরের বিপরীতে, রাজধানী কায়রো থেকে প্রায় সাড়ে ছ’শো কিলোমিটার দূরে তুতেনখামেনের সমাধিক্ষেত্রে। তেজসরা পৌঁছেই জানতে পারল কিছুক্ষণ আগেই স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে একদল লিপি উদ্ধারকারী দল শবাধারে নেমেছেন। আর এতটুকু সময় নষ্ট না করে কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে তেজস ও মানেথো নেমে যায় শবাধারে।

অন্ধকার শবাধারে ঢোকার আগেই খুটখাট শব্দ আর চাপা গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। টর্চ জ্বালতেই নিচে নেমে যাওয়ার ধাপ, দেওয়াল, দেওয়ালে আঁকা অজস্র ফ্রেস্কো সব দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা গম্ভীর গলায় সাবধান বাণী,

―আর এক পা এগোলে গুলি করতে বাধ্য হব!

সামনেই ছিলেন মানেথো। দেখলেন তুতেনখামেনের মমির উপর থেকে সোনার সারকোফ‍্যাগাস সরানো হয়েছে। তারপর বক্তার দিকে তাকিয়ে বললেন,

―মিঃ অরণ‍্যভূষণ ভৌমিক, যদিও আপনার হাতে বেআইনী আগ্নেয়াস্ত্র, আর আমার হাতের দিকেও তাকিয়ে দেখুন এটা লাইসেন্স প্রাপ্ত। তাছাড়া কায়রো পুলিশ এল বলে!

―পুলিশ! পুলিশ কী করবে আমার! আমি কী করেছি!

এবার তেজস মুখ খুলল,

―তোমার অপরাধের ব‍্যাখ‍্যা তো আমি দেব ছোটাই! একী! শুধু যে চাকতিটা দিয়ে তুতেনখামেনের বুকের উপরের সুড়ঙ্গটা খুলে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছ! আর কিছু পেলে না বুঝি! কেন! দারুবুড়ো যে তারকাকৃতি চাকতিটার পিছনে লেখা ছড়াটার আভ‍্যন্তরীন অর্থ বের করে ফেলেছিলেন তা তো তোমাকে ‘কুয়াসর -ই -ব‍্যারন’ এ যাওয়ার আগেই জানিয়ে ছিলেন! কিন্তু কোনও কারণ বশতঃ বিস্তারিত ভাবে বলেননি। আর তারপরেই তো তোমার কুটিল ব্রেনে জন্ম নিয়েছিল এই ভয়ংকর দূর্বুদ্ধি! আবিষ্কারের খ‍্যাতির লোভেই তো দারুবুড়োকে শেষ করে দিলে! তারপর খুঁজে বের করলে দারুবুড়োর ছড়ার বিস্তার! কিন্তু এত করেও বুদ্ধিতে কুলাল না বোধহয়!

গলা বুজে এল তেজসের। একটুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল,

―ওহঃ এই তো তোমার কনিষ্ঠা তাহলে ঠিক হয়ে গিয়েছে! তোমার কনিষ্ঠা আঙুলটি যে অন‍্য সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটা ছোট, আর ওটাই তোমার শরীরের সব থেকে বড় লক্ষণ ছিল! তাই ওটাকে সকলের নজরের আড়ালে রাখতে হয় পকেটে পুরে নয়তো ব‍্যান্ডেজ করে রাখা, তাই না! জানি দারুবুড়োর মৃত্যু দূর্ঘটনায় নয়, তুমি ঠান্ডা মাথায় খুন করেছ! আর এও জানি কোনও ভাবেই তা প্রমাণ করতে পারব না..

―ঠিক, ঠিক বলেছিস। আমিও তো কম কিছু ছিলাম না বুদ্ধিতে, মানে, সম্মানে! তবে কেন আমার পরিচয় হবে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অবনীভূষণের সহকারী! এই ছড়ার সমাধান আমিও অনেকটা করে ফেলেছিলাম…আর প্রমাণ যখন নেই তখন পুলিশ আমার কী করবে তেজীবাবু…

এবার মানেথো বললেন,

―ও, ও তবে কি আমার ঝোলাটার অভ‍্যন্তর ভাগ প‍্যাপাইরাস দিয়ে তৈরী ছিল আর ছড়াতেও প‍্যাপাইরাসের উল্লেখ আছে…তাই কী একবার খোয়া গিয়ে আবার ফিরত এসেছিল! যদিও দুধরনের সেলাই দেখেও আমি আর ব‍্যাপারটা নিয়ে জলঘোলা করিনি!

তেজস অবাক হয়ে মানেথোর কথাগুলো শুনছিল, তারপর আবার বলল-

―দাঁড়াও! আরও প্রমাণ আছে যে, প্রথমতঃ তুমি পরিচয় জাল করে জীবন ধারণ করছ!

―হাঃ! কে বলল! আমি তো সারা পৃথিবীর কাছে অবনীভূষণ ভৌমিক! অরণ্যভূষণের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছি আমি নিজে!

এবার আধপোড়া কাগজগুলো দেখিয়ে তেজস বলল, দ্বিতীয়তঃ-

―এই যে তোমার নকল সই এর মহড়া! তোমার এই হাতের লেখাই প্রমাণ দেবে…

―তা আমি হতে দেব না, তার আ….আ ….আহ্

বলতে বলতেই হঠাৎ অরণ‍্যভূষণ নিজের বাঁ পায়ের নিচের অংশটা চেপে ধরে শবাধারের মেঝেতে বসে পড়লেন! আর অমনি হাত থেকে রিভলবারটাও নিচে পড়ে গেল! মানেথো দূর থেকেই ঝট করে শবাধারের মেঝেতে আলো ফেলে দেখলেন একটা বিশাল গোখরো সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে! সঙ্গে সঙ্গে মানেথো হতভম্ব হয়ে যাওয়া তেজসের হাত ধরে অনেকটা উপরের ধাপে উঠিয়ে নিয়ে এলেন। ততক্ষণে লুটিয়ে পড়েছেন অরণ‍্যভূষণ, জড়ানো গলায় বলছেন-

―আ- আমার নীই..ল…কা…আ-ন্ত মণি!

বাঁ আ…আ-চাও…..আ

আ..মি…বাঁচ-তে…চা….আ…

ততক্ষণে কায়রো পুলিশ ফোর্সও চলে এসেছে। সার্চ লাইটের জোরালো আলোয় গোখরোর ফণা নেমে গিয়েছে। দেওয়ালের কিনারা ধরে আস্তে আস্তে চোখের আড়াল হয়ে গেলেও কেউ বাধা দিল না! শ্রমিকরা ভয় পেয়ে শবাধার ছেড়ে পালিয়েছিল আগেই! এবার অরণ‍্যভূষণকে শবাধার থেকে বের করে হসপিটালে নিয়ে গেল পুলিশ।

পুলিশ অফিসারকে সাক্ষী রেখে তেজস এক পা এক পা করে তুতেনখামেনের মমির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হোরাসের চোখ আঁকা তারকাকৃতি হাতির দাঁতের চাকতিটা তখনও মমির বুকের উপরেই পড়ে আছে। আর মমির বুকের গোল সুড়ঙ্গ থেকে বের করে রাখা হয়েছে একটা ছোট্ট সোনার দণ্ড। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তখন তেজসের উপর নিবদ্ধ। তেজস দণ্ডটাকে নিয়ে সোজা উত্তর দিকের দেওয়ালে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে একজায়গায় থামল। এই তো প‍্যাপাইরাস কাগজে আঁকা তুতেনখামেনের জীবনের নানা মুহূর্ত! একটা রথের ছবি, শিকারি বেশে রথে আসীন তুতেনখামেন স্বয়ং। সেই রথের চাকার ঠিক মাঝখানটায় একটা গর্ত! হাতের দণ্ডটা ঐ গর্তে ঢুকিয়ে বেশ খানিকক্ষণ চাপ দিতেই সকলকে অবাক করে দিয়ে চওড়া খিলানের মত অংশ একটু ফাঁক হল। তারপর সকলে মিলে বেশ খানিকটা সরিয়ে ফেলতেই ভিতর থেকে একটা নীল দ‍্যুতি ঠিকরে বেরিয়ে এল। অন্ধকারে আলো ফেলতেই দেখা গেল একটি সোনার আবক্ষ মহিলা মূর্তি। মাথায় রানীর সমান্তরাল মুকুট, মুকুটের ঠিক সামনে একটি সোনার গোখরো সাপের কারুকৃতি। ঐ মূর্তিটিরই গলায় ঝুলছে বড় বড় গাঢ় নীল রঙের পাথর দিয়ে তৈরী একটা অলঙ্কার, যার ঠিক মাঝখানে কবচ আকারে ঝুলছে নীলকান্তমণিতে আঁকা হোরাসের একটি মাত্র চোখ। আর মূর্তির ঠিক পাশে একটা সারকোফ‍্যাগাস…

মানেথো উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে তেজসকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,

―তেজস! এই রানীর মত মুকুটধারী আবক্ষ নারী মূর্তিটি তো বিখ্যাত সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ফ‍্যারাও রানী নেফ্রতেতের…তবে তো সারকোফ‍্যাগাসটাও…

নিশ্চল তেজস দারুবুড়োর উদ্দেশ্যে চোখ বুজে, হাঁটু মুড়ে বসে প্রণাম জানাল। তারপর চোখ খুলতেই দু’চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল!

হ‍্যাঁ, নেফ্রতেতে! …সেই বিতর্কিত ধর্মত্যাগী রহস্যের রাণী, যাদুর রাণী, ভালোবাসার রাণী কিংবা হিংসাপরায়ণতা এবং প্রতিশোধের রাণী…নেফ্রতেতে।

#রুমি

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post অন্য আমি| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | ময়না মুখোপাধ্যায়| Bengali Detective Story
Next post লালসা| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | ‌‌অমিত সিংহ| Bengali Detective Story