দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ছোট্ট গ্রাম ফুলঝুরি। অবশ্য ফুলঝুরির জায়গায় ফুলচুরি বললে বোধ হয় ভালো হয়। শান্ত স্নিগ্ধ সবুজে ভরা গ্রামটায় প্রত্যেকটি বাড়ির উঠোন ভরে আছে নাম জানা অজানা কত্ত রকম ফুলের ডালি, তবুও প্রতিটা ভোর শুরু হয় ভটচাজ গিন্নির, “অতিসারের দল, ফুলচুরির জন্য আমার বাড়িটাই চোখে পরে তোদের!” জাতীয় অপশব্দ অথবা বোস দাদুর, “নিজের বাড়ির ফুল নিজেই ঠাকুরকে দিতে পারি না!” গোত্রের হা-হুতাশ দিয়ে। আসলে নিজের বাগান যতই ভরে থাক সুন্দর সুন্দর ফুলে তবুও পাশের বাড়ির বা পাশের পাড়ার কারোর বাগানে নতুন রকম জবা ফুল বা টগর ফুল দেখেও লোভ সামলে মর্নিং ওয়াক শেষ করে বাড়ি ফেরার আত্মসংযম খুব কম মানুষেরই থাকে। এই ফুলচুরি সাধারণত ঝগড়া, গালাগালি (প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ) বা উভয় দিয়েই শেষ হয়। খুব কম ক্ষেত্রেই সেটা হাতাহাতির পর্যায়ে যায়, যেমনটা হয়েছিল বিভাস মাঝির কালো গোলাপ চুরি হওয়ার পর।
বিদেশ থেকে অনেক শখ করে বিভাসবাবু এই বিরল গোলাপ চারা এনে লাগিয়েছিলেন, স্বামী স্ত্রী মিলে অনেক যত্নও করেছিলেন, কড়া পাহারা দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। পাশের বাড়ির দীপক কোটালের পোষা ছাগলজোড়ার হাত থেকে, তবুও শেষ রক্ষা হল না আর। আগের রাতে সবে আধফোটা গোলাপটি দেখে ঘুমাতে গেলেন আর ঘুম থেকে উঠে তাদের চক্ষু ছানাবড়া। সাধের কালো গোলাপ আর নেই গাছে। সন্দেহের তীর গিয়ে পরে দীপক কোটালের কলেজ পড়ুয়া ছেলে বাপনের ওপর, কারণ সদ্য প্রেমে পড়া বাপন প্রেমিকা মৌটুসীকে পটানোর জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করছে, আকাশের চাঁদ তারা ধূমকেতু উপগ্রহ সবকিছু সে প্রেমিকাকে এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছে কিন্তু ইসরো এবং নাসার কঠোর মহাকাশ নীতির জন্য সে তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। এমত পরিস্থিতিতে বিভাস মাঝির শখের বিদেশী গোলাপ প্রেমিকার কাছে তার মান রেখেছে। বাপনের প্রেমকাহিনীর বিন্দু-বিসর্গ না জানা মা দেবকী এবং বিভাস মাঝির স্ত্রীর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় দিয়ে শুরু হওয়া সেই ঝগড়া হাতাহাতি জামা কাপড় ছেঁড়াছিঁড়ি দিয়ে কপাল ফাটানো রক্তবন্যায় পৌঁছনোর পর, ডাক পরে ফুলঝুরি থানার বড়বাবু, ও সি ব্যোমকেশ ব্যানার্জীর।
শরদিন্দুর অন্ধ ভক্ত ব্যোমকেশবাবুর বাবা শ্রদ্ধেয় তারাচরণ ব্যানার্জী ছেলে হওয়ার পর এক মুহূর্তও সময় নেননি ছেলের নামকরণ করতে। অতীব সুপুরুষ বুদ্ধিমান তেজস্বী এই গোয়েন্দার মতো হবে তার ছেলে এই আশায়। ঘটনাক্রমে পুলিশে চাকরি করলেও ব্যোমকেশ ব্যানার্জীর সঙ্গে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ এর কোনো মিল তার স্ত্রী সুচন্দ্রিমা দেবীও বের করতে পারেননি। মাত্র চল্লিশ বছর বয়েসেই মাথার ঠিক মধ্যিখানে একটি বৃহৎ আকৃতির গোলাকার টাক পুলিশ বিভাগে বন্ধুদের গ্রুপে তার একটি নতুন নাম দিয়েছে ‘কমকেশ’। অবশ্য তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন ব্যোমকেশবাবু।
প্রমোশন পাওয়ার পর ফুলঝুরি গ্রামে তার পোস্টিং পেয়ে ব্যোমকেশবাবু একপ্রকার খুশিই হয়েছিলেন। উত্তর কলকাতার ঘিঞ্জি পাড়ায় বড় হওয়া ব্যোমকেশবাবু আর সুচন্দ্রিমা দেবী উভয়েই যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন এই গ্রামে এসে। বুক ভরে তাজা গ্রাম্য হাওয়ার স্বাদ নিয়েছিলেন মন খুলে। গ্রামের মানুষগুলো বড়োই সাধাসিধে, যে যার মতো থাকে। মূলত কৃষিকাজই বেশিরভাগের জীবিকা, তবে কৃষির আনুষঙ্গিক ব্যবসার সঙ্গেও অনেকে যুক্ত। এছাড়া রয়েছেন স্থানীয় ফুলঝুরি প্রাইমারি এবং হাই স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা, গ্রামের একটি মাত্র পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার এবং তার সহযোগী বাদল মণ্ডল, গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবু এবং ফুলঝুরি ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের কর্মীরা।
ব্যোমকেশ ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরে বড়ই বেশি বিশ্বাসী। এমনিতে তার দশাসই চেহারা, বাজখাঁই গলা আর সর্বদা উত্তপ্ত টাকটি ছাড়া এই একটি বৈশিষ্ট্য তাকে বাকি থানার বড়বাবুদের থেকে আলাদা করেছে। হরিনাম সংকীর্তনের খবর পেলে ব্যোমকেশবাবুকে আটকে রাখা যে বড়োই দায়। হরিনাম শুনতে শুনতে একবার তিনি এতটাই ভাবুক হয়ে পড়েছিলেন যে, চোখ থেকে অবিরাম ধারায় ঝর্ণা নেমে এসেছল, “হরে কৃষ্ণ হরে রাম” বলে এমন আবেগে ভেসে গিয়েছিলেন যা দেখে এলাকার ফচকে ছেলেরা নাম দিয়েছিল “রামাক্ষেপা”। গ্রামের যেই বাড়িতেই যেই পুজোই হোক না কেন ব্যোমকেশবাবুকে নিমন্ত্রণ করতেই হবে, অবশ্য তিনি নিমন্ত্রণের ধার ধারেন না আজকাল। ঈশ্বর এর কাছে যেতে আবার নিমন্ত্রণ লাগে নাকি? বিয়ের বার বছর পরেও সন্তানের মুখ দেখেননি ব্যোমকেশবাবু, অবশ্য দিদির দুই ছেলেমেয়েকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন তিনি। দিদির বড়ো ছেলে তুতুন ওরফে সায়ক চ্যাটার্জী এখন কলকাতার একটি নাম করা কলেজে ফিজিক্স অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, কিন্তু করোনা মহামারীতে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় সে মামার কাছে এসে রয়েছে মাস খানেক।
ছয় ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার বলিষ্ঠ চেহারার সুপুরুষ সায়ক কলেজ পাশ করে আই পি এস অফিসার হতে চায়। দাদুর গোয়েন্দা প্রেম নাতি সায়কের মধ্যেও প্রবল ভাবে বর্তমান। দেশী বিদেশী প্রায় সব গোয়েন্দা গল্প তার পড়া হয়ে গেছে। মামা অফিস থেকে ফিরলে রোজ সে জানতে চায় যে আজ নতুন কিছু হয়েছে কিনা, কিন্তু রোজই সে আশাহত হয়। ফুল চুরি, মাছ চুরি জাতীয় ছিঁচকে অপরাধ ছাড়া এই গ্রামে অপরাধ বলতে প্রায় কিছুই নেই। অনলাইন ক্লাস ছাড়া বাকি সারাদিন সায়ক সাইকেল করে গ্রামে ঘোরে, প্রকৃতি দর্শন করে, সবুজের নিত্য নতুন রূপ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে যায়। গ্রামের কারোর সাথে তার সেরকম বন্ধুত্ব হয়নি, তবে মুখার্জী বাড়ির পুরোহিত চন্দ্রনাথ আচার্যের ছোট ছেলে বিতনু ওরফে ছোটকার সাথে তার হালকা বন্ধুত্ব হয়েছে এই ক’দিনে। তারা সমবয়সী। ছোটকাও তার মতই পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র, তবে সে শিক্ষক হতে চায়। প্রায়ই দুজনে মিলে আড্ডা মারে, পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে। ক্রিকেট নিয়েও চা এর কাপে ঝড় ওঠে। ছোটকার দাদা সুতনু ওরফে পটকা বাবার সাথে মুখার্জী বাড়িতে পুজোর কাজে সাহায্য করে। ভাই এর মত পড়াশোনায় ভালো ছিল না সে, তাই কোনওরকমে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েই কাজে লেগে পড়েছে। গ্রামের মানুষদের এই সহজ সরল জীবনযাত্রা সায়ককে মুগ্ধ করে। কী অল্প চাহিদা এই মানুষগুলোর, সে মনে মনে ভাবে। দাদু বলতেন মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ নেই, সন্তুষ্টি সম্পূর্ণ রূপে মনের সংযমের উপর নির্ভরশীল। ফুলঝুরি গ্রামে এসে গ্রামের মানুষদের আটপৌরে জীবন যাপনের কায়দা দেখে এখন দাদুর কথার মাহাত্ম্য সে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। আর মনে মনে শপথ নিয়েছে যে এদের মতই সহজ সরল জীবন যাপন করবে সে, চাহিদার অসীম গড্ডালিকায় নিজেকে কোনোদিন ভাসিয়ে দেবে না।
যাই হোক, আজ মুখার্জী বাড়ির বাৎসরিক পূজা, কুলদেবতা রাধা মাধবের পুজো। করোনা পরিস্থিতির জন্য খুবই সাধারণ ভাবে সীমিত আয়োজন করে এবারের পুজো হবে। বসিয়ে ভোগ বিতরণ এবার বন্ধ। তবে মুখার্জী বাড়ির বড়ো ছেলে ধীমান মুখার্জী স্বয়ং নিজে থানায় এসে বড়বাবুকে নিমন্ত্রণ করে গেছেন, আজকের পুজোয় উপস্থিত থাকার জন্য। প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো এক অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণের মূর্তির পুজো হয়ে আসছে মুখার্জী বাড়িতে। শোনা যায় মুখার্জীদের জমিদারি যখন একদম পড়তির দিকে তখনও তারা এই পুজো করা বন্ধ করেননি। বাংলাদেশ থেকে দেশ ভাগের সময় যখন এক রাতের নোটিশে তাদের পূর্ব পুরুষরা এই দেশে ভিটে মাটি ছেড়ে চলে আসেন তখন সঙ্গে বিশেষ কিছু না আনতে পারলেও শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে এই মূর্তি এনেছিলেন। খুব ধুমধাম করে পুজো না করতে পারলেও নিত্য জল মিষ্টি অর্পণ করেছেন রাধামাধবকে।
তারপর আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালেন মুখার্জীরা। বিশেষত শ্রী নৃপেন্দ্রনাথ মুখার্জী ওকালতি পাস করে বিশেষ ভাবে পসার জমানোর পর মুখার্জীরা তাদের পুরনো আড়ম্বর ফিরে পায়। তাঁরই দুই ছেলে। বড়ো ছেলে ধীমান ও ছোট ছেলে বিমান। নৃপেন্দ্রনাথবাবুরা দেশ ভাগের পর ঢাকুরিয়াতে এসে উঠেছিলেন। সেখানকার একদা রেফিউজি কলোনীতে তাদের আদি বাড়ি। ধীমান এবং বিমান সেখানেই বড় হয়েছেন। তারপর ওকালতি থেকে অবসর নেবার পর নৃপেন্দ্রনাথ বাবু শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে একটু শান্তি আর স্বস্তির খোঁজে ফুলঝুরিতে এই শখের বাড়ি বানান। নাম দেন ‘একান্তে’ ধীমানবাবু বাবার সঙ্গেই এই বাড়িতেই থাকেন। তিনিও পেশায় একজন উকিল। গাড়ি চালিয়ে রোজ কাজে যান। স্ত্রী ও এক কন্যা নিয়ে তার ছোট্ট সুখের সংসার। বিমানবাবু পেশায় ডাক্তার। তিনি ছুটি পেলে মাঝে মাঝে আসেন এই বাড়িতে। তার দুই ছেলে। তারা সল্টলেকে থাকেন। করোনা পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই ডাক্তারবাবু ছুটি ম্যানেজ করতে পারেননি তাই দুই ছেলেকে নিয়ে তার স্ত্রী পুজোয় এসেছেন।
নৃপেন্দ্রনাথ বাবুর ছোট ভাই দিপেন্দ্রনাথ তার মতো এরকম কর্মঠ ছিলেন না। তিনি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেও সেরকম ভালো চাকরি জোটাতে না পেরে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু স্থিরতার অভাবে ব্যবসায় বিশেষ সুবিধা তিনি করতে পারেননি কোনোদিনই। কাপড় জামা, মুদির জিনিস পত্র, ইলেকট্রনিক জিনিস সবকিছু চেষ্টা বিফল হওয়ায় বর্তমানে শিয়ালদহতে ছোট্ট একটা প্রেস চলে তার, আয় যৎসামান্য। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনি ঢাকুরিয়ার পুরোনো বাড়িতেই থাকেন। স্ত্রী গত হয়েছেন তিন বছর হল। ছোট থেকে দাদা নৃপেন্দ্রকে হিংসে করেন দিপেন্দ্র ওরফে দিপু। এই কারণে তাদের মা বাবাও বিশেষ ভালো চোখে দেখতে পারতেন না দিপুবাবুকে, পারিবারিক মূর্তিটিও সেই জন্য নৃপেন্দ্রবাবুকেই উইল করে দিয়ে দিয়ে যান তারা। বরং নৃপেন্দ্রবাবু ছোট ভাইকে অনেক সময় অনেক ভাবে সাহায্য করেছেন, যদিও তার সদ্ব্যবহার কোনোদিনই করতে পারেননি দিপুবাবু। আজকের অনুষ্ঠানে প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরেও মেয়ে তুলিকাকে নিয়ে এসেছেন তিনি।
সেই উপলক্ষে ব্যোমকেশবাবুও স্ত্রী এবং ভাগ্নে সায়ককে নিয়ে মুখার্জী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। অন্য কোথাও হলে সায়ক না বলে দিত। কিন্তু ছোটকাও ওখানে থাকবে বলে সে আর না করেনি।
করোনা পরিস্থিতিতে এবার বেশি বড়ো প্যান্ডেল করা সম্ভব হয়নি। ‘একান্তে’ বাড়িটি আয়তনে বেশ বড়ো, বেশ সুন্দর একটা বাগানবাড়ি গোছের আমেজ আছে বাড়িটিতে, ফুলঝুরি গ্রামের অন্যতম সুন্দর একটি বাড়ি হল ‘একান্তে’। বাইরেটা বড়ো পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভেতরে দোতলা একটা বাড়ি পুরনোদিনের জমিদারবাড়ির আদলে তৈরী। বাড়ির সামনে মস্ত বড় লোহার গেট, যা পেরিয়ে ঢুকতেই ছোট বাঁধানো রাস্তা, বাড়ির আঙিনা পর্যন্ত বিস্তৃত। রাস্তার দু’পাশে বাহারি ফুলের গাছ। গেটের দুই পাশে দু’টি বড় নারকেল গাছ, বাড়ির পিছন দিকে শানবাঁধানো পুকুর আছে, যাতে বেশ কিছু মাছ আছে। নৃপেনবাবু শখ করে মাঝে মাঝে বিকেলবেলা ছিপ ফেলে বসে থাকেন। বেশিরভাগ মাছ যদিও ধরা পড়ার পরেও জলে ফেরত চলে যায়। পুকুরের মাছ খান না নৃপেন বাবু, পাড়া পড়শিদের বিলিয়ে দেন। বাড়ির পিছনের বাগানে রকমারি ফলের গাছ আছে। ফুলঝুরির মাটি এতটাই উর্বর যে, যেই গাছই লাগানো হোক না কেন ফলগুলো বড়োই সুস্বাদু হয়। ফুলঝুরির বাতাবি লেবু, সজনে, ডাঁটা, লাউ, উচ্ছে, কাঁঠাল এগুলো খাবার পর কলকাতার সবজি আর মুখে রোচে না সায়কের। কলকাতায় কড়া ডায়েটিং করলেও মামারবাড়ি এসে তাই কব্জি ডুবিয়ে খায় সায়ক। গাছের ফল দিয়েই রোজ পুজো হয় রাধামাধবের।
কুলপুরোহিত আচার্যীবাবু বড়োই গরীব, নৃপেন্দ্রবাবু আর ধীমানবাবু তাই যথেষ্ট সাহায্য করেন তাকে সাধ্য মতন। তার বড়ো ছেলে পটকাকেও কাজে রাখা একপ্রকার তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্যই। স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়ায় পটকা পুজোর মন্ত্র বিশেষ মনে রাখতে পারে না, তাই ঠাকুরঘরের সাজসজ্জা ও বাকি আনুষঙ্গিক কাজ করে সে বাবাকে সাহায্য করে।
এই বাড়ির ভোগ প্রাসাদ আগেও আস্বাদন করেছেন ব্যোমকেশবাবু, এবং এক মুহূর্তের জন্যও তার গন্ধ ও স্বাদ ভুলতে পারেননি তিনি। আহা! সে যে অমৃত। বিশেষ করে ধীমানবাবুর মা গায়েত্রী দেবীর নিজের হাতে রাঁধা পায়েস, সে কি ইহজগতের? মাঝে মাঝেই নিজেকে প্রশ্ন করেন ব্যোমকেশবাবু। খাঁটি গরুর দুধের ছানা থেকে তৈরী মিষ্টি ও পায়েসের স্বাদ আগের রাতে তার ঘুমের খুবই ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। তাই বিকেল হতে না হতেই গিন্নিকে তাড়া দিতে থাকেন, “কি গো, হল তোমার? আর কত দেরি করবে? পুজো যে শেষ হতে চলল! এত দেরি করে যাওয়া কি শোভা দেয় আমাদের?” ভাগ্নেকে সারা রাস্তা আগের বারের অমৃত সমান ভোগের গল্প করতে করতেই তারা মুখার্জী বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন।
সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী এইবার পঞ্চাশ জনের বেশি নিমন্ত্রিত ব্যক্তি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে অগত্যা কেটে ছেঁটে অতিথি তালিকা তৈরী হয়েছে। সব বাড়ি থেকেই সামান্য একজন দু’জন করে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। মুখার্জী বাড়ি পৌঁছাতেই ধীমানবাবু অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে তাদের ভিতরে আসতে বললেন। প্রতিবার যেই মন্দির, উঠোন লোকজনে গিজগিজ করে এইবার সেই অনুষ্ঠানটা বেশ ফিকে ও ফাঁকা। তবুও গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ির গন্ধে ব্যোমকেশবাবুর মাথাটা যেন সামান্য চক্কর দিয়ে উঠল।
সুচন্দ্রিমা দেবী আর সায়ককে ডাকলেন ধীমানবাবুর স্ত্রী অর্পিতা এবং তার মেয়ে আরাত্রিকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়ার জন্য। আরাত্রিকা এইবার স্কুল ফাইনাল দেবে। খুব মিষ্টি এবং শান্ত স্বভাবের। ছোটকা আর পটকা ওদের প্রতিবেশী, পাঁচিলের ঠিক পাশেই ওদের বাড়ি। আরাত্রিকা ওদের বড়দা আর ছোড়দা বলে ডাকে। আরাত্রিকা সায়ককে মন্দিরে নিয়ে গেল বিগ্রহ দর্শন করাবে বলে। ছোটকাও ওদের সাথেই ছিল। মন্দিরের বাইরে বেশ বড় একটা চাতাল আছে, মহিলারা সেখানেই শাড়ী পরে পুজোর উপাচার নিয়ে বসে। সুচন্দ্রিমা দেবী অর্পিতা দেবীর সঙ্গে গিয়ে ওখানেই বসলেন। মূল গর্ভগৃহে নৃপেনবাবু, দিপুবাবু এবং গায়েত্রীদেবী আচার্যীবাবু ও পটকার সঙ্গে বিগ্রহের গায়ে ঘি মধু লেপন করছিলেন। সমস্ত জায়গাটাতেই কী সুন্দর একটা ঠাকুর ঠাকুর গন্ধ অনুভব করলো সায়ক যা সে শুধুমাত্র দূর্গা পুজোর সময়ই পায়। মনে মনে সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল, মামাকে এরকম সুন্দর একটা জায়গায় পোস্টিং দেওয়ার জন্য, নয় তো কত্ত কিছু সে জীবন থেকে মিস করত।
যাই হোক, মূল মন্দিরে তখন বিগ্রহকে স্নান করানোর পর্ব শুরু হবে। স্নানের জল প্রস্তুত, এবার ধুতি পড়ে নৃপেনবাবু প্রথামত বিগ্রহের গায়ে জল ঢালতে আরম্ভ করলেন, পাশ থেকে আচার্যীবাবু মন্ত্র পড়া শুরু করলেন। নৃপেনবাবু চোখ বন্ধ করে জল ঢালছেন, হঠাৎ রাধামাধবের মুন্ডুটি কাঁধ থেকে খসে পড়ল। বাংলা সিরিয়াল এর মত মুখার্জী বাড়ির মন্দিরে যেন বিনা মেঘে একসঙ্গে এক ডজন বজ্রপাত হল। সবার চোখ ছানাবড়া। ‘এ কী দেখছি’ – কেউই যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সাময়িক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর সবাই বুঝতে পারল যে মূর্তিবদল হয়েছে, অষ্টধাতুর প্রাচীন মূর্তির জায়গায় কেউ একইরকম দেখতে একটা মাটির রং করা মূর্তি রেখে দিয়েছে। ব্যাপারটা চোখে পড়তেই নৃপেনবাবুর হাত থেকে তামার ঘটিটি পড়ে গেল, গায়েত্রী দেবী হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, প্রতিবেশী বৃদ্ধ দেবপ্রসাদ মিস্ত্রি মাথা ঘুরে স্ত্রী পম্পা মিস্ত্রীর কোলে ঢলে পড়লেন যা দেখে উপস্থিত দর্শনার্থীরা আঁতকে উঠলেন। ধীমানবাবু, অর্পিতা দেবী, বিমানবাবুর স্ত্রী রুচিরাদেবী ছুটে গেলেন মন্দিরের ভেতর। সায়ক, পটকা আর আরাত্রিকা একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান মুহূর্তের মধ্যে একটা রহস্যাবৃত অনুষ্ঠানে পরিণত হল।
ব্যোমকেশবাবুর মন তাৎক্ষণিক ধাক্কাটা সামলে উঠতেই তার ভেতরকার দারোগাবাবু জেগে উঠলেন। হৈ হট্টগোল কান্নাকাটির আওয়াজ থামাতে বাজখাঁই গলায় তিনি সবাইকে নিজের নিজের জায়গায় বসে থাকার নির্দেশ দিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেন। কিছুটা সাহস জুটিয়ে সায়কও মামার সাথেই মামার পিছুপিছু মন্দিরে উঁকি মারতে গেল। ভেতরে ঢুকে তারা দেখল যে, একটা উঁচু সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বেদির ওপরে দেবতার মূর্তিটি রাখা ছিল। লাল শালু দিয়ে বেদিটা ঢাকা। বেদির চারপাশটা মোটা মোটা গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে সাজানো। মন্দিরের ভেতরে কোনো জানলা নেই, দরজাও একটাই। সম্প্রতি বাইরের গেট থেকে মন্দিরের গেট অবধি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে ধীমানবাবুর নির্দেশে। কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি জবাব দিলেন যে, মূর্তিটির ওপরে বেশ কিছুজনের নজর আছে এই কথা তার কানে আসার পর থেকে তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। তাই সিসিটিভি লাগানোর কথা তার মাথায় আসে।
ব্যোমকেশবাবু খুব ভালোভাবে মন্দিরের ভেতর পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর ধীমানবাবুকে জানালেন যে, অফিসিয়ালি তাকে একবার থানায় গিয়ে একটা কেস লেখাতে হবে। তবে তিনি কেস না করলেও ব্যোমকেশবাবু মূর্তিচোরকে যে কোনোভাবে ছাড়বেন ন, সেই কথা জোর গলায় সবার সামনে বলে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সায়ককে বললেন “ভাগ্নে, যা তোর মামীকে নিয়ে বাড়ি যা, আমি থানায় গিয়ে রিপোর্ট লিখিয়ে একটু ইন্সপেকশন করে বাড়ি ফিরব।” মামার চোখ মুখ দেখে সায়ক বুঝল যে, মামা খুব আঘাত পেয়েছেন, যত না মূর্তিচুরির দুঃখ, তার থেকে অনেক বড়ো দুঃখ অমৃত সমান পায়েস হাত ছাড়া হওয়ার জন্য।
সেই রাতে অনেক দেরি করে ব্যোমকেশবাবু বাড়ি ফিরলেন। তার বরাবরের গর্ব যে তার এলাকায় ছুটকো ছাটকা ঝামেলা ছাড়া বিশেষ বড় কোনো গন্ডগোল নেই, আর সেখানেই কিনা কোটি টাকার মূর্তি উধাও। কোথায় ভেবেছিলেন যে গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, গরম গরম বেগুনি, পাঁচমিশালি সবজির ঘ্যাঁট, গাছ থেকে পাড়া কচি আমের চাটনি, ঘন দুধের পায়েস, এইসব দিয়ে ডিনার সারবেন, তা না। মাছের বোরিং ঝোল ও ভাত। ধুর! কোনও মানে হয় এর। “এর শেষ দেখেই ছাড়ব আমি।” মনে মনে গজরাতে থাকেন ব্যোমকেশবাবু।
বাড়ি ফিরে অনেক্ষণ ধরে মামীর সাথে এই মূর্তি চুরি নিয়েই আলোচনা করছিল সায়ক। রাতে নিমন্ত্রণ থাকায় রাতের খাবার তৈরী ছিল না ঘরে। তাই ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে রাতে মাঝের ঝোল আর ভাত দিয়েই রাতটা চালিয়ে দেবেন বলে মনস্থির করেন সুচন্দ্রিমা দেবী। মামী রান্নাঘরে যেতেই সায়ক হোয়াটস্যাপ-এ পিং করে ছোটকাকে ওই বাড়ির খবর নেওয়ার জন্য। ছোটকা জানায় দাদু দিদা দু’জনেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ঘটনার আকস্মিকতায়। রাতে দু’জনেই কিছু না খেয়ে ঘুমাতে গেছেন। ছোট দাদু মানে দিপুবাবুও মুষড়ে পড়েছেন। ভেঙে পড়েছেন পটকার বাবা আচার্যীবাবুও। রাধামাধবের মূর্তির নিত্য সেবা করার জন্যই তার চাকরি। মূর্তি না থাকলে তিনি কী কাজ করবেন ভেবেই দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। দাদাও হঠাৎ কাজ হারিয়ে কী করবে ভেবে ছোটকার খুব মন খারাপ। এখনও কলেজে পড়ছে সে। কোনও কাজের যোগ্য নয় যে বাবার পাশে দাঁড়াবে। দাদা পটকা সবে ভাবছিল যে, একটা বাইক কিনবে। পি কে অটোমোবাইলসের এর দোকানে গিয়ে সে মডেল পছন্দ করেও এসেছে। পুজোর সামান্য মাইনের টাকায় তা সম্ভব নয় বলে ড্রাইভিং শিখে সে ছোট-হাতি গাড়ি চালিয়ে টুকটাক রোজগারও করে। করোনার জন্য এখন সে সব যদিও বন্ধ। খুব কম সে ডাক পায়, যদি মুড়ির ব্যবসায়ী প্রণব মান্নার রোজকার ড্রাইভার যদি ছুটি নেয় তাহলে। খাবার জিনিস নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকায় থাকায় মাঝে মাঝে ইদানিং তার ডাক পড়ছে গাড়ি নিয়ে হাওড়া যাওয়ার, যেমন আগামীকাল দুপুরে যেতে হবে। বাইকটা তার এত্ত পছন্দ যে, হোয়াটস্যাপ ডিপিতেও বাইকের ছবি দিয়ে রেখেছে সে, ছবিটার স্ক্রিনশট পাঠায় সায়ককে। ইয়ামাহা কোম্পানির দামি মডেল, সায়ক দেখেছে কলেজের একটা দাদাকে চালাতে। যাই হোক, মন তো সায়কেরও ভালো নেই। তাই গুড নাইট লিখে সে চ্যাট বন্ধ করে ডিনার সেরে নেয়।
মাঝরাতে বাথরুম যাওয়ার জন্য ওঠে সায়ক, দেখে উঠোনে পায়চারি করছেন ব্যোমকেশবাবু। “ও মামা, তুমি ঘুমাওনি এখনও!” সায়ক জিজ্ঞেস করলে, ব্যোমকেশবাবু বলেন, “ঘুম আসছে না রে ভাগ্নে! এত্ত বছরের চাকরি জীবনে এরকম সমস্যায় পড়িনি যেখানে কাউকেই সন্দেহ করতে পারছি না। এরা যে সবাই বড় সাধাসিধে, ভালো মানুষ।”
– “সবার বয়ান নিয়েছ তুমি মামা, কোথাও কোনো ফাঁকফোকর পাওনি?” সায়ক জিজ্ঞেস করে মামাকে।
– “তাহলে বলি শোন,” ব্যোমকেশবাবু বলতে শুরু করেন, “সবার অ্যালিবাই শুনেছি আর সব কটাই সলিড। আগের রাতে নৃপেন্দ্রবাবু নিজের ঘরে বই পড়ছিলেন, দিপুবাবুও নিজের ঘরেই ছিলেন, শরীরটা খারাপ থাকায় ওষুধ খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বাড়ির মেয়ে বউরা পুজোর জোগাড় যন্ত্র করছিল। ভোগের সবজি কাটা, নাড়ু বানানো, খৈ পাক দেয়া এসব করছিল। আচার্যীবাবু মন্দিরে রাতের পুজো করে তালা দিয়ে বাড়ি চলে যান এবং রোজকার কাজই করছিলেন। পটকা নিজের ঘরে ফুটবল ম্যাচ দেখছিল। ছোটকা নিজের ঘরে পড়াশোনা করছিল। সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছি। আচার্যীবাবু দরজায় তালা দেওয়ার পর আর কেউ ওই ঘরে ঢোকেনি। নৃপেন্দ্রবাবু ও তার পরিবারের কোনও দায় পড়েনি নিজেদের মূর্তি নিজেরাই সরানোর। সত্যি কথা বলতে এই মূর্তিকে ওঁরা নিজেদের সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করেন। এই মূর্তি সঙ্গে থাকায় তারা ঈশ্বরের কৃপাধন্য বলে মনে করেন নিজেদের। ছোট ভাই দিপুবাবুর মোটিভ আছে মানছি। কিন্তু তিনি বড্ড অসুস্থ থাকেন আজকাল। এই কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আচার্যীবাবুর রুটি রুজি এই মন্দিরের উপর নির্ভরশীল, তাই মূর্তি চুরি করে উনি নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারবেন না। জানলা নেই, দরজার সামনে সিসিটিভি বসানো, আর কেউ যেন ইঁদুরের মত মাটি ফুঁড়ে এসে মূর্তি গায়েব করে নকল মূর্তি বসিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল!”
“আচ্ছা মামা, হয়তো কেউ মাটি ফুঁড়েই এসেছিল!”
“মানে!”
“মানে মাটি কেটে সুড়ঙ্গ বানিয়ে এসেছিল।”
“কি বলছিস কি ভাগ্নে? এটা তো ভেবে দেখিনি। কিন্তু ঘরে কোত্থাও তো কোনও মাটি কাটার বা সিমেন্ট ভাঙার নিশানা পাইনি। তবে তুই বলছিস যখন তখন কাল সকালে উঠেই মন্দিরে একবার ঢুকব। তুইও সঙ্গে যাবি। দেখি তোর গোয়েন্দা গল্পের জোর। তবে তার আগে বল, যে কাকে কাকে তুই সন্দেহের তালিকায় রেখেছিস? “সায়ক প্রায় একঘন্টা কেসটা নিয়ে মামার সাথে আলোচনা করে, তার সন্দেহের কথা জানায়। মামা যুক্তি প্রতিযুক্তি দিয়ে তার সঙ্গে উত্তর আদানপ্রদান করেন। রিয়েল লাইফ ব্রেইন টিজার খেলছে মনে হয় সায়কের।
সারা রাতে একটুও ঘুম আসে না সায়কের। গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে, টিভি সিরিজ দেখে দেখে তার মাথায় অনেকগুলো গল্প খেলছে। শুধু প্রমাণের অপেক্ষা। সকাল হতে না হতেই ব্যোমকেশবাবু সায়ককে সঙ্গে নিয়ে মুখার্জী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। মেজবাবুকেও ফোন করে ডেকে নিলেন। গোয়েন্দা গল্প না পড়তে পারেন, তবে গোয়েন্দা বুদ্ধি যে কিছু কম নেই তারও।
মুখার্জীবাড়িতে প্রায় সকলেই উপস্থিত। সবারই চোখ মুখ দেখে পরিষ্কার যে, রাতে কেউই ঘুমায়নি। ব্যোমকেশবাবু সকলকে মন্দিরের মূল ঘরে ডাকলেন। এবং সকলকে অবাক করে দিয়ে লাল শালু ধরে দিলেন এক টান। দেখে সকলের চোখের পলক আর পড়ে না। বিগ্রহ রাখার বেদির তলায় সিমেন্টের ভাঙা চাঙড়। যেন কেউ গোল করে ওপরের অংশটুকু কেটে নিয়ে আবার সেখানে ওই অংশটা মাপ মত বসিয়ে দিয়েছে। ব্যোমকেশবাবু জানালেন যে, চোর সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ওই বেদির অংশ দিয়ে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে মূর্তি অদলবদল করে আবার ওই পথেই সে পালিয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন তা হল সে কে? সবাই এর ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সায়ক জিজ্ঞেস করে, “পটকাদা, তুমি পরশু রাতে কী করছিলে বলবে প্লিজ?”
পটকা চমকে ওঠে হঠাৎ তাকে এই প্রশ্ন করায়। “আমি খেলা দেখছিলাম নিজের ঘরে।”
“আমি ফুটবল একদম বুঝি না, তবুও জিজ্ঞেস করছি কার সাথে কার খেলা ছিল বলবে প্লিজ?”
“ফিনল্যান্ডের সাথে ডেনমার্ক। কিন্তু এখন আমাকে এই প্রশ্ন কেন করছ?” বিরক্ত হয়ে বলে পটকা। বাকি সকলের চোখে মুখেও বিরক্তি প্রকাশ পায় বুঝতে পারে সায়ক। তবুও দুঁদে গোয়েন্দার মতোই স্বাভাবিক গলায় সে জিজ্ঞেস করে, “শেষ প্রশ্ন, পটকাদা। কালকের ম্যাচে কে জিতেছে বলবে?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় পটকা হঠাৎ। তার কনফিডেন্সটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, “ডেনমার্ক। না না ফিনল্যান্ড। আরে, না না না, একদম ভুলে গিয়েছিলাম কালকের ম্যাচ তো ড্র হয়েছে!”
“সে কী, এই সবে দু’দিন আগের ম্যাচ আর তুমি রেজাল্টটা মনেই করতে পারছ না! তোমার ভাই বলে তুমি ফুটবল অন্তপ্রাণ, ইউরো কাপ চললে রাতের ঘুম ত্যাগ করে তুমি খেলা দেখো, সব ম্যাচের রেজাল্ট তোমার কণ্ঠস্থ, আর দু’দিন আগের ম্যাচের রেজাল্ট বলতে তুমি তিনটে উত্তর দিলে! আসলে তুমি ফুটবল ভক্ত ঠিকই, এই ম্যাচের রেজাল্টটাও তুমি মনে রাখতে পারতে যদি সত্যি সত্যি তুমি ম্যাচটা দেখতে! তুমি ম্যাচ না দেখে সুড়ঙ্গ দিয়ে মূর্তি পাচার করতে ব্যস্ত ছিলে, তাই না পটকাদা?”
পটকা ফুঁসে ওঠে, “যা সব হচ্ছে চারিদিকে আমি ঘাবড়ে গেছি, মাথার ঠিক নেই, রাতে ঘুমাতেও পারিনি, তাই ভুল বলে ফেলেছি, তাই বলে আমি চোর?”
“তুমি চোর কিনা চুরি যাওয়া মূর্তি তোমার ঘর থেকে উদ্ধার হলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তবে তুমি যে পুলিশকে মিথ্যে কথা বলেছ, সেটা প্রমাণিত, কারণ পরশু রাতের ম্যাচের ফল অমীমাংসিত। ড্র না, খেলাই হয়নি। একজন ফুটবলার ফুটবলের মাঠে আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে বলে মেডিকেল ইমার্জেন্সির কারণে ম্যাচ ক্যানসেল হয়ে গেছে।”
পটকার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে যায়। উপস্থিত সকলে যেন নিজেদের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা। আচার্যীবাবু হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন, সারাজীবনের সততার এই ফল? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেন ছেলেকে, “এই কাজ তুই কেন করলি?”
উত্তর দেন ব্যোমকেশবাবু। “এই গ্রামের বাকি সকলের মতো সহজ সরল জীবন যাত্রা পটকার আর ভালো লাগছিল না। মেধাবী না হওয়ায় খুব ভাল চাকরি পাওয়া যে তার পক্ষে সম্ভব না, এই কথা সে নিজেও মানত। কিন্তু যোগ্যতা আর চাহিদার মেলবন্ধন না থাকায় সে অসৎপথে পাড়ি দেয়। আমার ভাগ্নে সায়কের একটা ছোট্ট ইনফরমেশন থেকে আমি প্রথম পটকাকে সন্দেহ করা শুরু করি। যে কোনও অপরাধেরই প্রথম কারণ হল মোটিভ। যা আমি এই কেসের ক্ষেত্রে কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। মূর্তিটি দুর্মূল্য হলেও সেটি চুরি করে বিক্রি করার মতো সাহস বা মানসিকতা আমি কারোর মধ্যেই পাইনি। ভাগ্নে আমায় কথা প্রসঙ্গে প্রথম জানায় যে, পটকা একটি খুবই দামি বাইক কেনার পরিকল্পনা করছিল। সাধারণ বাজারচলতি সস্তা বাইক নয়, এটি সৌখিন বাইক যার দাম প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। পুজো এবং ছোট-হাতি চালানোর সামান্য রোজগারে যার ই এম আই ভরা তার পক্ষে সম্ভব নয় আমি বুঝে গেছিলাম। সন্দেহ হওয়ায় আমি পি কে অটোমোবাইলসের মালিক সুব্রত দাসকে সকালে ফোন করে জিজ্ঞেস করি এই ব্যাপারে, আর জানতে পারি যে, পটকা ই এম আই নয়, পুরো টাকাটাই ডাউন পেমেন্ট দিয়ে কিনবে বলে জানিয়েছিল। সেখান থেকেই আমাদের সন্দেহ আরো জোরালো হয়। বুঝতে পারি যে কোন বড় দাঁও মারতে চলেছে সে। তারপর ভাগ্নে ফুটবল ম্যাচের কথা জানানোয় আমরা সিওর হয়ে যাই যে, পুরো ঘটনাটাই পটকার কৃতিত্ব। দু’দিন কলকাতায় যাওয়া আসা করে সে গ্রামের সারল্য ভুলে গেছে, কৃত্রিম পৃথিবীর আকর্ষণে সে এরকম অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়তে দু’বার ভাবেনি।”
সকলের মন খারাপ হয়ে যায়। চেনা মানুষের কাছ থেকে অচেনা ব্যবহার বড়ই কষ্টদায়ক। আচার্যীবাবু কান্না জড়ানো গলায় বলেন ব্যোমকেশবাবুকে, “নিয়ে যান ওকে আপনারা থানায়, রেখে দিন সারা জীবন জেলে। পরিবারের মুখ পোড়ায় যে ছেলে তাকে আমি আর ঘরে নেব না।”
লৌহকঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে পটকা। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেও সামনে সে প্রকাশ করে না। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে গেলে হঠাৎ কেঁদে ওঠে আরাত্রিকা, পটকাকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে থাকে।
– “আমার বড়দাকে তোমরা জেলে দিও না প্লিজ। বড়দা একটা ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু আর করবে না। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও ওকে তোমরা।” মিনতি করে বলে সে। যা দেখে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারে না পটকা, নৃপেনবাবুর পা ধরে কাঁদতে থাকে সে।
গায়েত্রী দেবী চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “কেউ জেলে যাবে না। আমরা কেস ফেরত নিলাম। শুধু তুই আমার রাধামাধবকে ফিরিয়ে দে বাবা, তাকে ছাড়া যে এ ঘরটা শূন্য হয়ে আছে।”
পটকা জানায় যে, মূর্তি এখনও তার ঘরেই আছে।
পরে পুলিশ তার ঘর থেকে চুরি হওয়া মূর্তি উদ্ধার করে। আজকেই মুড়ির গাড়ির ভেতর লুকিয়ে যেটা সে বাইরে পাচার করার ফন্দি এঁটেছিল। সামান্য একটা বাইকের লোভে সে এরকম ভুল কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মন্দিরে প্রবেশ করার অবাধ স্বাধীনতা থাকায় সে মূর্তিটির ক্লোজ আপ শট নিয়ে হুবহু একটি মাটির মূর্তি গড়ে অদল বদল করেছিল। বাড়ির পিছনের জঙ্গলে ভরা জমিতে খোঁড়াখুঁড়ি করে সুড়ঙ্গ তৈরী করার কাজ শুরু করে, গ্রামের দিকে রাত ৮টার পরেই মোটামুটি জনমানব শূন্য নিশুতি রাত নেমে আসায় সারা রাত ধরে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে তার বিশেষ কোনও অসুবিধাই হয়নি। আর আগেরদিন রাতে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় মাটি নরম ছিল, তাই সুড়ঙ্গ খুঁড়তে তাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। প্ল্যানটি তার ভালোই ছিল, শুধু কাঁচা হাতের কাজ হওয়ায় সে ধরা পড়ে যায়।
আসল মূর্তি মুখার্জী বাড়িতে ফিরে আসে। হাপুস নয়নে মুখার্জী গিন্নি রাধামাধবকে জড়িয়ে ধরেন, আজকেই এখনই পুজো হবে রাধামাধবের, পূর্ণিমা যে এখনও ছাড়েনি। আমতা আমতা মুখে ব্যোমকেশবাবু জিজ্ঞেস করেন, “একটা কথা বলব, প্লিজ কিছু যদি মনে না করেন তো, পুজোর সঙ্গে ভোগের বন্দোবস্তও কি থাকছে?”
গায়েত্রী দেবী বলেন, “নিশ্চয়ই বাবা, তুমি আমার রাধামাধবকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছ। তোমাকে আর ভাগ্নেকে আজ আমি নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াব।”
বিজয়ীর হাসি ফুটে ওঠে সায়ক আর তার মামা দু’জনের মুখেই। সমাপ্ত।