বিপ্রদীপের বিপদ| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | সায়ন দাস| Bengali Detective Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

সেবারে যখন বীরভূমের স্থাপত্যকীর্তি সম্পর্কে একখানি বই লেখার ইচ্ছে হল, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে পুজোর ছুটিটা বীরভূমে কাটাব। দুবরাজপুরে আমার এক সম্পর্কের কাকার বাড়ি। তাই থাকা খাওয়াটাও মন্দ হবে না। সে সব ভেবেই যাওয়ার কথাটা নিয়ে আর দু’বার ভাবিনি, ঠিক করেই নিলাম যে যাব। আর সঙ্গে নেব শুভকে। কারণ শুভরও ঘুরতে বেড়াতে বেশ ভালই লাগে।

শুভ হল আমার মাসতুতো দাদা। আসলে ও আমার থেকে মাত্র এক সপ্তাহের বড়। ওর যে শুক্রবারে জন্ম, আমার ঠিক তার পরেরটায়। তাই আমি ওকে নাম ধরেই ডাকি। দু’জনেরই বয়স এক হলেও ও যেহেতু এক বছর আগে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, তাই স্কুল-কলেজ সব আমার থেকে এক বছর আগে পাস করেছে। এখন শুভর ইউনিভার্সিটির থার্ড সেমিস্টার চলছে আর আমার ফার্স্ট। শুভ ভূগোলের স্টুডেন্ট আর আমি ইতিহাসের। অবশ্য ইতিহাসের স্টুডেন্ট হওয়ার জন্যই ঠিক করেছি বীরভূমের স্থাপত্যকীর্তি নিয়ে বইটা লেখার কথা।

শুভকে যখন বলি দুবরাজপুর যাওয়ার কথাটা, সে তো শুনে বেজায় খুশি। আর বলতে গেলে পড়াশোনার চাপে আজকাল তেমন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না। সে বলল, “আরে বাহঃ! বেশ ভালই হল, দুবরাজপুর থেকে মামাভাগ্নে পাহাড় আর হেতমপুর রাজবাড়ি, এ দু’টোই বেশ কাছে হবে। ওই দু’টো জায়গা তো ঘুরে দেখা চাই-ই চাই। কি বলিস বনী?” আমার পুরো নাম শ্রাবণী, শুভ তাই ছোট করে ‘বনী’ বলে ডাকে। ঠিক হল দুর্গাপুজোটা শেষ হলেই দিন তিন চারেকের মধ্যেই রওনা দেব দু’জনে।

।।২।।

আজ ত্রয়োদশী। প্রায় কুড়ি মিনিট হল আমরা দুবরাজপুরে বাস থেকে নেমেছি। তপুকাকাকে ফোনে বলেছিলাম যে আজ আমরা আসব। সেজন্য কাকাও বলেছিলেন যে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু এখনও গাড়ির পাত্তাই নেই।

এখান থেকে তপুকাকাদের বাড়ি কতটা সেটাও জানি না। বলতে গেলে এখানে আমি জ্ঞান হওয়ার পর এই প্রথম আসছি। বাবার কাছে শুনেছিলাম যে আমার যখন বছর তিন বয়স, তখন একবার এখানে এসেছিলাম তাদের সঙ্গে। অবশ্য ওই বয়সের স্মৃতি মনে না থাকাই স্বাভাবিক।

কাকা বলেছিলেন একটা কালো রংয়ের মারুতি ভ্যান আমাদের নিতে আসবে। আরও প্রায় মিনিট দশেক পর কাকার বর্ণনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা সেরকম কালো মারুতি ভ্যান এসে দাঁড়াল এ চত্বরে। বছর পঁচিশের ড্রাইভার যুবকটি দরজা খুলে যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, দেখলাম সে বোধহয় কাউকে খুঁজছে, বোধহয় আমাদেরকেই নিতে এসেছে। শুভকে বলতেই ও তার দিকে এগিয়ে গেল তাকে সে কথা জিজ্ঞাসা করতে। তারপর একটা চোখের ইশারাতে আমাকে ডাকতেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে গাড়িটা আমাদেরই নিতে এসেছে।

গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। বাইরে দেখতে দেখতে যাচ্ছি, এদিকটায় শহরের বিস্তার রয়েছে বটে কিন্তু আমাদের ওখানকার মত অতটা ঘন নয়। তপুকাকা বলেছিলেন, যে ওঁদের বাড়ির ওপাশটায় গ্রাম্য পরিবেশটাই বেশি। চাষের জমিও আছে। আর শহরের ভিড় থেকে দূর কোন গ্রামে গিয়ে পড়তে মন্দ লাগে না। শান্ত পরিবেশ, স্নিগ্ধ বাতাস, খোলা আকাশ, সবুজ প্রান্তর এসব আর কে না ভালোবাসে।

গাড়িতে আমাদের প্রায় আরও পনেরো মিনিট লাগল পৌঁছাতে। তপুকাকাদের বাড়িটা বেশ পুরনোই। তবে একটি অংশে সম্ভবত খুব সম্প্রতি কাজ হয়েছে। ওপাশটা বাকি অংশের থেকে একটু উন্নত অবস্থায় আছে। ড্রাইভার আমাদের একদম বসার ঘরে নিয়ে গিয়েই তুলল। ঢোকার সময় একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখতে পেয়ে বলল, “নৃপেনদা, বাবুকে বল যে যাদের আসার কথা ছিল তাঁরা এসেছেন।” ভদ্রলোকটি এক কাতে হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়লেন। গাড়িতে আসার সময় জেনেছি যে ড্রাইভারের নাম তুষার।

তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই ভদ্রলোক কে তুষারদা?”

সে বলল, “কে নৃপেনদা? ওঁ এ বাড়ির কেয়ারটেকার গোছের। আবার কোন প্রয়োজনে শহরের দিকে যেতে হলে বাবু ওঁকেই পাঠান। আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখন চলি, পরে আবার দেখা হবে।”

— “হ্যাঁ হ্যাঁ।” বললাম আমি।

বসার ঘরটা বেশ বড়। দু’টো বড় সোফা এবং তার দু’পাশে দু’টো করে মোট চারটে আড়াআড়ি করে চেয়ার পাতা। সেই চেয়ারেরই দু’টোতে আমরা বসেছি। ঘরের চারপাশের দেয়ালে কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে পড়েছে। তপুকাকা এখানে এসে ঢুকলেন। আমার চিনতে অসুবিধা হয়নি কারণ বাবার মোবাইলে ওঁর ফটো দেখেছি। আমরা উঠে দাঁড়ালাম।

উনি বললেন, “আরে বোসো বোসো, তা তোমাদের এখানে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো? যদিও অনেকটা দেরি হয়ে গেল, আসলে তুষারকে আমার একটা কাজে একটু পাঠিয়েছিলাম।”

উত্তরটা শুভই দিল, “না না কোন অসুবিধা হয়নি আমাদের।” শুভর দিকে চেয়ে তপুকাকা বললেন, “আচ্ছা এই তাহলে – ”

— “আমার মাসতুতো দাদা।” আমি কথাটা কেড়ে নিয়ে বললাম।

— “নমস্কার মেসোমশাই, আমার নাম শুভদীপ চ্যাটার্জী।” বলল শুভ।

তারপর তিনি শুভর দিকে তাকিয়েই বললেন, “অনেক সকালেই বোধহয় তোমরা তো বেরিয়েছ। এতটা রাস্তা জার্নি করে এসেছ এখন বরং একটু বিশ্রাম নাও। পরে কথা হবে, এখন তো কিছুদিন রয়েছই। জলখাবার ঘরেই পাঠিয়ে দিতে বলছি কেমন।”

এই বলে তপুকাকা চলে গেলেন। আমাদের যে ঘরটা দেওয়া হল, সেটা বেশ বড় দু’জনের পক্ষে। ঘরটা যে আমাদের আসার কারণেই দিন কয়েকের মধ্যে পরিষ্কার করা হয়েছে, তা বেশ বুঝতে পারলাম। সমস্ত ঘরটা পরিষ্কার করে এখানে দু’টো তক্তপোশ পাতা হয়েছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে একটা ব্যালকনি বারান্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে দিগন্তে তাকিয়ে থাকতে মন্দ লাগছে না।

জলখাবারে দেওয়া হল ঘি-এ ভাজা লুচি। গ্রামের খাঁটি ঘি তা গন্ধেই বোঝা যাচ্ছে। আর তার সঙ্গে আলুর দম, সন্দেশ, রসগোল্লা।

— “নাহ্, তোর কাকার রাঁধুনির রান্নার হাতটা কিন্তু জবরদস্ত। তাজ্জব বানিয়েছে।” বলল শুভ।

খাওয়া শেষ করে শুভ দেখলাম ওর বিছানায় দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে ‘গোয়েন্দা ত্রিদিব সমগ্র’ না কি বেশ একটা বই নিয়ে। ওর আবার এইসব বইয়ের খুব নেশা। ওর তো ইচ্ছেই হল যে ভবিষ্যতে বড় মাপের ডিটেকটিভ হবে। ওই ব্যাপারে ওর বেশ একটা ইয়ে, মানে কী বলে এলেম আছে। অবশ্য ওকে ডিটেকটিভ বলাও চলে। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও ওর দারুণ। এই তো গত বছরেই যখন আমাদের পাশের বাড়িতে চুরি হল, তখন শুভ আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। সেবারে তো বলতে গেলে চোরটা শুভই ধরে দিয়েছিল। যদিও চোরকে পুলিশই গ্রেফতার করেছিল কিন্তু সমস্ত ঘটনা বিশ্লেষণসহ চোরের হদিশটা শুভই দিয়েছিল।

* * *

আমার লেখালেখির জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ আগামীকাল থেকে শুরু করব। বাড়ির বাইরে পিছনের দিকে একটা বাগান আছে। তো বাগানে একটু পায়চারি করছিলাম। এখানে যেমন রয়েছে ছায়াদায়ী বৃহৎ বৃক্ষ, তেমনই রয়েছে নানা লতাগুল্ম, ফুলের গাছও। গোলাপই রয়েছে প্রায় ছয়-সাত রকম রঙের। আর প্রত্যেক রঙের প্রায় আট-দশটা করে চারা। গোলাপ ছাড়াও কত রকমের যে ফুলের গাছ রয়েছে তার বেশিরভাগই আমার অচেনা।

।।৩।।

দু’পুরে খাওয়ার পর শুয়ে কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। যখন ঘুম ভাঙল তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজতে যাচ্ছে। শুভ দেখলাম ঘরে নেই। আমি গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলাম। পর মুহুর্তেই দেখি শুভ কোথাও গিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গের ঐ লোকটা কে? অচেনাই তো। হাঁটতে হাঁটতে শুভ তার সঙ্গে হেসে কথা বলছিল। আর তারপর আরও প্রায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে কথা বলার পর ভদ্রলোক অন্যদিকের রাস্তায় চলে গেলেন আর শুভ এই দিকে এগিয়ে এল।

ও ঘরে এসে ঢুকতে না ঢুকতেই আমি বলতে গেলাম, “বলছিলাম যে-…”

অমনি ও নিজে থেকেই বলল, “থাক আর বলতে হবে না। ভদ্রলোকের নাম অর্কদীপ সান্যাল। এখানে ওঁদের পাঁচ পুরুষের জমিদারি ছিল। যদিও এখন আর জমিদার নন, তবে লোকমুখে যা প্রচলিত তাই চলে আসছে আর কি। আমি বিকেলে একটু কাছাকাছির মধ্যে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। উনিও মাঠের ধারে নাকি হাঁটতে আসেন। আমাকে দেখে ভদ্রলোক নিজেই আলাপ জমাতে আসেন, ‘এখানে নতুন মনে হচ্ছে, তা কার বাড়ি এসেছেন?’ শেষটায় উনি এটাও বলেছেন, আমরা যখন কিছুদিন এখানে রয়েছি তো পারলে ওঁদের বাড়িটা যেন একদিন ঘুরে আসি।” এতদূর কথাগুলো একটানা বলে ও থামল।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই কি বললি?”

— “কী আবার বলব, বললাম যে যাব।”

এরপর একটু থেমে শুভ আবার বলল, “আর হ্যাঁ, ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর যখন এদিকে আসছিলাম তখন দেখলাম তুই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলিস। তাই অনুমান করতে অসুবিধা হয়নি যে তুই কী জিজ্ঞাসা করবি।”

শেষ কথাটুকু হেসে হেসেই বলল শুভ। আমার ফ্যালফ্যাল করে তাকানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

* * *

সন্ধ্যেবেলা দেখলাম শুভ আবার ওর সেই বইটা খুলে বসেছে। এখানে ইন্টারনেটের স্পিড খুবই স্লো, তাই মোবাইল বলতে গেলে অকেজো একেবারেই। তাই ভাবলাম এখানে আসার বর্ণনাটা আজ আমার খাতাটায় তুলে রাখি। খাতা পেন নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। লেখা যখন শেষ হল, তখন রাত ন’টা বাজছে। এপাশে রাতটা বেশ নিঝুম নিস্তব্ধ। মনে মনে এটাই ভাবছিলাম, করার তো তেমন কোন কাজ নেই তাই তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে শুয়ে ঘুমোতে পারলে মন্দ হত না। স্বয়ং ঈশ্বর যেন আমার কথা শুনে ফেলেছেন আর সত্যি সত্যিই রাতের খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল।

রাতের আয়োজন ভাত, মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, ফুলকপির রোস্ট আর দেশি মুরগির কারি। ভাত ভেঙে ডাল ঢালতে ঢালতে তপুকাকা বললেন, “তা শুভদীপ তোমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?”

— “না না, আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বাই দ্য ওয়ে আপনার রাঁধুনীর রান্নাগুলো কিন্তু একদম লাজাবাব।”

কিছুক্ষণ পরে আবার শুভ বলল, “আচ্ছা মেসোমশাই, সান্যালদের সঙ্গে কি আপনার পরিচয় আছে?”

কাকা অবাক হয়েই তাকালেন, “তুমি ওঁদের কী করে চিনলে?”

— “না না চিনি বিশেষ কিছুই না।” হেসে ফেলল শুভ।

তারপর আবার বলল, “অর্কদীপ সান্যাল মানে ও বাড়ির ছেলের সঙ্গে বিকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখা হয়েছিল। আমাকে তল্লাটে নতুন দেখে ভদ্রলোক নিজেই দু’কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। এই আর কী।”

— “ও আচ্ছা তাই বল। পরিচয় বলতে তেমন কিছু নেই। ওঁরা তো এখানকার জমিদার ছিলেন। এককালে আমরা ওঁদের প্রজাই ছিলাম। এখন যদিও জমিদারির পাট চুকেছে। ওঁদের বাড়ি আমি এক-দু’বার দরকারে গিয়েছিলাম, ব্যাস এটুকুই।”

এতটা বলে থামলেন তপুকাকা। অর্কবাবু যে তাঁদের বাড়ি যাওয়ার কথাও বলেছেন সেটাও বলল শুভ। সেই শুনে তপুকাকাও বললেন, “ওহ! তা বেশ তো, যাও না ঘুরেই এসো। বেশি নয় এই মিনিট পনেরো হাঁটাপথ এখান থেকে।”

।।৪।।

পরদিন খুব সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেড়িয়ে পড়লাম আমরা, আমার লেখালেখির জন্য আজ কিছু ডেটা সংগ্রহ করে রাখতে হবে সকালে। তাহলে সারা সন্ধ্যেটা বসে সেগুলো সব সাজিয়ে ঠিকঠাক লিখতে পারব। সকাল করেই বেরিয়েছি যাতে দুপুরের আগেই ফিরতে পারি। কাছাকাছির মধ্যে এখানে প্রচুর মন্দির রয়েছে। কোনটার খুবই জরাজীর্ণ দশা তো আবার কোনটার অবস্থা একটু ভাল। কিছু মন্দিরে তো কোন বিগ্রহই নেই। অর্থাৎ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। সবগুলোতেই চুন-সুড়কির উপর টেরাকোটা নকশা বিদ্যমান। আমি সেগুলো সম্পর্কে কিছু শর্ট নোট হিসেবে বর্ণনা লিখছি আর শুভ প্রতিটার ফটো তুলে রাখছে ওর মোবাইলে। কিছু কিছু মন্দির পরিত্যক্ত হলে কী হবে সবগুলোই বলতে গেলে বেশ ঐতিহ্য বহনকারী।

কাজ শেষ করে ফিরতে আমাদের প্রায় দুপুর একটা বেজে গেছিল। স্নান খাওয়া সেরে সবে ঘরে এসে বসেছি, শুভ হঠাৎ বলল, “আজ বিকেলের দিকে একবার ভাবছি সান্যালবাড়িটা ঘুরে আসব। এখন আড়াইটা বাজে, অতএব এক চটকা ঘুম মেরে দে। তাহলে দেখবি বিকেলে ফ্রেশ লাগবে।”

এই বলে সে তার বইটা পাশের টেবিলটায় রেখে চোখ বুজল। আমিও শুয়ে ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। কিন্তু বিশেষ কিছু গতিক না হওয়ায় বৃথা চেষ্টা বন্ধ করে ফোনটা বালিশের একপাশে রেখে চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম, ঘুমটা ভাঙল শুভর ডাকাডাকিতে, “এই বনী ওঠ। পাঁচটা বাজল আর কত ঘুমোবি।”

।।৫।।

আমাদের জীবনে অনেক সময় এমন অনেক কিছু হঠাৎ করেই ঘটে যায় যার জন্য আমরা প্রস্তুত থাকি না। আমরা তো এসেছিলাম এখানে মূলত আমার লেখালেখির উদ্দেশ্যেই আর কয়েকটা দিন একটু নিরালায় ছুটি কাটাতে। তো তখন কি আর জানতাম যে এখানে এক রহস্যের দানা বাধবে আর সেখানে শুভ এবং ওর সঙ্গে আমিও জড়িয়ে পড়ব!

যেমনটা শুভ বলেছিল সেই অনুযায়ী আমরা বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এসেছি সান্যালবাড়িতে। সান্যালদের বাড়িখানা বেশ জরাজীর্ণ হলে কি হবে, বাড়ির আদল দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে এটা এক সময় সত্যিই জমিদার বাড়িই ছিল, আর বাড়িখানা যেন ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তার সেই পুরনো সুন্দর দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করছে। তপুকাকাদের বাড়িটার থেকে এটার বয়স আরও অনেক বেশি তা আর বলে দিতে হয় না। বাড়িটার এক পাশের একটা অংশ বহুকাল আগেই বোধহয় খসে পড়েছে। জীর্ণ অট্টালিকার অসংখ্য খুপরিতে অসংখ্য পায়রার আনাগোনা। গেটে দারোয়ানকে শুভ আমাদের পরিচয় দিয়ে বলল যে অর্কদীপবাবুকে গিয়ে খবর দিতে, উনি আমাদের চিনবেন। কিছুক্ষণ পরে সে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল।

অর্কদীপবাবু আমাদেরকে বসার ঘরে বসালেন। ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ ত্রিশ বত্রিশই হবে। পরনে নীল হাফ শার্ট, পাজামা, চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা। আমার দিকে দেখিয়ে শুভ বলল, “একে আপনি দেখেননি আগের দিন। এ আমার মাসতুতো বোন। নাম হল শ্রাবণী, শ্রাবণী ঘোষাল।” আমি হাসিমুখে নমস্কার জানালাম। ভদ্রলোকও নমস্কার করলেন। তারপর কাউকে হাঁক পেড়ে বললেন, “সদাই’দা, চা পাঠিয়ে দাও।” তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “দাঁড়ান বাবাকে ডাকি। এ বাড়িতে তেমন লোকজনের যাতায়াত নেই। আপনারা অতিথি হয়ে এসেছেন জানলে বাবাও খুশি হবেন।” ভদ্রলোক চলে গেলেন। ফিরে এলেন প্রায় মিনিট পাঁচেক পর, সঙ্গে যিনি রয়েছেন তার বয়স কত হবে, ওই প্রায় পঞ্চান্ন। ভদ্রলোক ধুতি এবং সুতির হাফহাতা বাটিকের কাজ করা পাঞ্জাবি পরে আছেন। মাথায় ঘন কাঁচাপাকা চুল আর নাকের নীচে পুরু গোঁফ। ওঁর সঙ্গে অর্কবাবু আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, “বাবা ইনি হলেন শুভদীপ চ্যাটার্জি।” এবার আমার দিকে দেখিয়ে বললেন, “আর উনি ওঁর বোন শ্রাবণী ঘোষাল। ওঁরা এখানে ক”দিন বেড়াতে এসেছেন। উত্তরে চৌধুরীবাড়ি আছে না, তপেশ চৌধুরীর রিলেটিভ ওঁরা।”

— “তোমাদের দেখে তো আমার ছেলের থেকেও ছোট মনে হচ্ছে, তুমি করেই বলি।” একটু হেসে আবার বললেন, “আমি হলাম বিপ্রদীপ সান্যাল। ছেলের মুখে তো বোধহয় শুনেছ যে এককালে আমরা জমিদার ছিলাম। অবিশ্যি আমি কোনদিনই জমিদারি করিনি। আমার পরলোকগত পিতার আমলেই জমিদারির অবসান ঘটে।” এটা বলার পর কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সঙ্গে ভদ্রলোক বললেন, “বাহঃ এটা তো লক্ষ্য করিনি বিপ্রদীপ, অর্কদীপ, শুভদীপ! সব একেবারে দীপে দীপ যে।” বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। বিপ্রদীপবাবুর কাছে ওঁদের পূর্বপুরুষদের নানা ঘটনা শুনছিলাম, যে কীভাবে তাঁরা জমিদার হলেন, তাঁদের জমিদারি কত বছরের ইত্যাদি। কিছুক্ষণ হল সদাই বলে লোকটা চা দিয়ে গেছে, সঙ্গে বিস্কুট। একটা বিস্কুট ট্রে থেকে তুলে চা-এ ডুবিয়ে মুখে পুরতে পুরতে অর্কবাবু বললেন, “বাবা তোমাকে তো বলাই হয়নি, শুভদীপবাবুর পেশাদার গোয়েন্দা হওয়ার ইচ্ছা। অবশ্য এখন পেশাদার না হলে কী হবে, উনি একরকম শখের গোয়েন্দা।” এবার বিপ্রদীপবাবু শুভর দিকে ফিরে বললেন, “তার মানে আমাদের মানিকবাবুর ফেলু মিত্তিরের মতো ব্যাপার নাকি!”

— “হ্যাঁ বাবা তাই তো বলছি, তুমি কী অসুবিধার কথা আর কী সব চিঠির কথা বলছিলে সেদিন, তো সেগুলো ওঁকে দেখাতে পার তো একবার।” ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন একথা শুনে, তারপর আমাদের চা খাওয়া শেষ হলে উনি তাঁর ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে ড্রয়ার থেকে কয়েকটা কাগজের টুকরো বের করলেন। সেগুলোকে চিঠি না বলে চিরকুট বলাই ভাল, সব মিলিয়ে তিনটে চিরকুট। প্রতিটা দেখার পর শুভ আমার দিকে দিল। সেগুলো পরপর দেখলে যা হয়, প্রথমটায় রয়েছে “সাবধান”, তারপরেরটায় “তোমার বোধহয় নিজের প্রাণের থেকে ওই মূর্তিটা বেশি প্রিয়।” আর একেবারে শেষটায় লেখা আছে, “মূর্তি এমনিও আমার হেফাজতে আসবে কিন্তু তোমার প্রাণটা থাকবে না, শেষবার বলছি।”

— “এ তো রীতিমত হুমকি।”

— “তবে আর বলছি কী! সত্যিই চিন্তার আর ভয়ের ব্যাপার বুড়ো বয়সে এসে যদি খুন হতে হয়।”

— “আচ্ছা এগুলো কতদিন হল আসছে? আর কোন মূর্তির কথাই বা বলা হয়েছে?” প্রশ্ন করল শুভ।

— “তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল চিরকুটগুলো এক মাস ধরে আসছে প্রতি দশ দিন অন্তর। কেউ এসে ইঁটের টুকরোতে কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারে পাঁচিলের ওপার থেকে। আর প্রতিবার ঠিক এমন সময়েই আসে সেগুলো যখন আমি বাগানে ঘোরাফেরা করি। আর দ্বিতীয়টার উত্তর হল, এখানে একটা গোপালের সোনার মূর্তির কথা বলা হয়েছে। আমার পিতার পিতামহ সেটা পেয়েছিলেন কোন একভাবে। আমাদের ঘরে গোপাল আছে। তবে সোনার মূর্তি পূজাস্থলে রাখা হয় না।”

— “আচ্ছা এই মূর্তিটার কথা কে কে জানে?”

— “বাড়ির আমরাই জানি, মানে আমি, আমার ছেলেমেয়ে আর জানত আমার স্ত্রী। তবে ও বছর দুয়েক হল গত হয়েছে।” ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

— “পুলিশকে জানিয়েছেন ব্যাপারটা?”

— “হ্যাঁ লোকাল থানায় ডায়েরি করে এসেছি।”

পরের প্রশ্নটা শুভ যেই করতে যাবে অমনি কোথা থেকে বাঁশির একটা সুন্দর সুর হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আমাদের কানে এল। সম্ভবত দোতলার কোন ঘর থেকেই সেটা আসছে। আমি যেই জিজ্ঞাসা করব যে এ বাড়িতে কে বাঁশি বাজাচ্ছে, তার আগেই ভদ্রলোক নিজেই বললেন যে ওঁর মেয়ে বাজাচ্ছে বাঁশিটা। মেয়ের নাম অত্যুত্তমা। শুভ বলল, “বাহ চমৎকার বাজাচ্ছে তো! এটা তো ভূপালী রাগ।” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “ভূপালী হল সন্ধ্যাকালীন রাগ বুঝলি?” আমার শোনা ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ আমি এসব রাগরাগিণীর ‘র’ জানি না।

— “তো আমি যেটা বলছিলাম, আপনার কি কারও উপর কোন সন্দেহ হয়?” ভদ্রলোক প্রথমে ঘাড় নাড়িয়ে ‘না’ বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তারপর কিছু একটা ভেবে বললেন, “সন্দেহ হয় একজনের উপর। লোকটার নাম দিবনীশ পাল। ও প্রায় দু-তিনবার আমার থেকে মূর্তিটা কিনতে চেয়েছে। আমি রাজি হচ্ছি না দেখে শেষটায় তো প্রায় আট লাখ টাকা অফার করল। ওতেও রাজি হলাম না দেখে ভদ্রলোক চলে গেল ঠিকই, তবে বলেছিল সে আবার আসবে। বিশ্বাস কর ওঁর চাহনিটা কিন্তু আমার মোটেও ভাল লাগেনি।”

— “শেষ প্রশ্ন, সেই মূর্তিটা একবার দেখা যায়?”

— “অবশ্যই। দাঁড়াও এই ঘরের লকারেই আছে।”

মূর্তিখানা চকচকে বেশ। মূল্য যে বেশ কয়েক লাখ অনায়াসেই হবে তা পরিষ্কার কিন্তু জমিদারের ঐতিহ্যবাহী চিহ্ন হিসেবে এর মূল্য টাকায় পরিমাপ করা সম্ভব না।

— “আচ্ছা উঠলাম তাহলে। তবে যাওয়ার আগে একবার আপনার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

— “দোতলায় উঠে প্রথম ঘরটাই ওর।”

— “আর আপনার বা এই মূর্তির কোন বিপদ হবে না বিপ্রদীপবাবু।”

শুভ একথা বলার পর আমরা ও ঘর থেকে গেলাম অত্যুত্তমার ঘরে। সে এক মনে বাঁশি বাজাচ্ছিল। দরজায় গিয়ে নক করতেই ভিতরে যাওয়ার অনুমতি মিলল। শুভ আমাদের এখানে আসা থেকে এখনও পর্যন্ত ঘটা সমস্ত ব্যাপারটা তাঁকে বলে জিজ্ঞাসা করল, “আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?” হ্যাঁ সূচক সম্মতি পেয়ে সে জিজ্ঞাসা করল এই ব্যাপারে অত্যুত্তমা কিছু জানে নাকি। সে বলল সে কিছু জানে না এ সম্বন্ধে। দ্বিতীয় প্রশ্নটা হল সে কখনও মূর্তিটা দেখেছে নাকি। এটার উত্তরে সে বলল এরকম কোন মূর্তি যে বাড়িতে আছে, সে বা তার দাদা এ সম্বন্ধে কিছুই জানত না, তারা এটা জেনেছে মাত্র বছরখানেক আগে। অত্যুত্তমার ঘরের এককোণে একটা স্ট্যান্ডে অসংখ্য বাঁশি রয়েছে দেখলাম। সে দিকে চোখ যেতেই শুভ এগিয়ে গেল, “আপনার বাঁশিগুলো দেখতে পারি?”

— “হ্যাঁ হ্যাঁ দেখুন না।”

আমিও দেখলাম সেখানে নানা মাপের বাঁশি রয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে তাদের সব স্কেল আলাদা আলাদা। এমন কি সবেতে ছিদ্রও সমান নয়। কোনটায় চারটে, কোনটায় ছ’টা আমার কোনটায় আটটা। দেখা শেষ হলে শুভ বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আজ তবে চলি আমরা।” এরপর আমরা রওনা হলাম। অর্কবাবু দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, উনি আমাদের কিছুটা এগিয়েও দিলেন।

।।৬।।

আজ সান্যালবাড়ি থেকে আসার পর শুভ আর ওর সেই বইটা খুলে বসেনি বরং প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হল কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা করছে। কখনও বসে আবার কখনও হাঁটাহাঁটি করছে ঘরে। আমি আজ যা যা তথ্য সংগ্রহ করেছি তা সব খাতায় বর্ণনাসহ লিখছিলাম। এই কিছুক্ষণ হল লেখা আজকের মত শেষ করেছি। শুভ যে বিপ্রদীপবাবুর ব্যাপারটা নিয়েই ভাবছে সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। হঠাৎ আমাকে বলল, “আমি কয়েকটা প্রশ্ন বলছি পরপর একটু খাতায় লিখে রাখ।” সে বলা শুরু করল, “বিপ্রদীপবাবু বাগানে থাকাকালীনই চিরকুটগুলো কেউ ছুঁড়ে মারে কেন, আর যে ছোঁড়ে সে এত তাড়াতাড়ি উধাও হয়ে যায় কীভাবে যে দারোয়ানও কোনবার দেখতে পায় না? তারপর হল বিপ্রদীপবাবু মূর্তিটার কথা ছেলেমেয়ের থেকে লুকিয়েছেন কেন আর হঠাৎ এক বছর আগেই বা বললেন কেন? শেষ প্রশ্ন হল, দিবনীশ পাল কীভাবে মূর্তিটা এখানে আছে জানতে পারলেন?” আমি সব প্রশ্নগুলো লিখে নিলাম। তারপর সে বলল, “দিবনীশ পালের বাড়িটাও একবার যেতে হবে। আরেকটা কথা তোর যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে হেতমপুর রাজবাড়িটা ঘুরে এলে কেমন হয়?” আমি বললাম, “আমার আবার কী অসুবিধা থাকবে?” তারপর দেখলাম শুভ নিজের মনে একটা কথাই বিড়বিড় করছে, “ওই মূর্তিটা… আমার কী কোন ভুল নাকি…” ব্যাস এটুকুই ক্ষীণভাবে শুনতে পেলাম।

।।৭।।

আজ সকালে আমরা চলেছি হেতমপুর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। রাতে খাওয়ার সময় তপুকাকাকে বলেছিলাম যে আজ ওখানে যাব ঠিক করেছি। সেটা শুনে উনি নিজেই ওঁর ড্রাইভারকে বলে দিয়েছেন যেন আমাদের নিয়ে যায়। অবশ্য গাড়ি না নিয়ে এলেও চলত কারণ কাকার বাড়ি থেকে রাজবাড়ি মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার। কিন্তু অচেনা জায়গা, একটু বেড়িয়ে দেখার জন্য একজন গাইড থাকা ভাল। সেই হিসাবে তিনি তুষারদাকে আমাদের সঙ্গে পাঠিয়েছেন।

এই রাজবাড়ি যে বহু পুরনো তা তার কঙ্কালসার অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে কিছু কিছু অংশ এখনও বেশ সুগঠিত শক্ত-সমর্থভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও আবার দেওয়াল ফাটিয়ে বেড়ে উঠেছে বট অশ্বত্থ। গুল্ম জাতীয় ঝোপঝাড়ে এপাশটা এমন ছেয়ে আছে যে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে, পাছে কোন বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ বা সাপে কামড় বসায়। একথা ভাবতে না ভাবতেই প্রায় আমাদের সামনে হাত পাঁচেক দূর দিয়ে একটা দীর্ঘদেহী কেউটে পেরিয়ে গেল। তুষারদা আমাদেরকে চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। এই রাজবাড়ির সঙ্গে সান্যালবাড়ির অনেকাংশেই মিল রয়েছে। হতে পারে এ রাজবাড়ির ধাঁচে এবং নকশা অবলম্বন করেই ওটা তৈরি করা হয়েছিল। তবে এর কাছে সান্যালদের জমিদারবাড়ি কিছুই না। ওরকম দু’তিনটে সান্যালদের বাড়ি একযোগে বোধহয় আকার আয়তনে এর সমান হবে।

এখান থেকে বের হতে প্রায় বেলা এগারোটা বেজে গেল। তুষারদা আমাদের আরও দু’জায়গায় একটু ঘুরিয়ে দেখাবে বলল। হেতমপুর রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এক জায়গায় আমরা গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা জলখাবার খেয়ে নিয়েছি। কারণ বাড়ি ফিরতে তো কমপক্ষে একটা বাজবেই। সুতরাং অন্ততপক্ষে দেড়টার আগে দুপুরের খাওয়া হচ্ছে না।

* * *

দুপুরের খাওয়া শেষ করে ঘরে আসতেই শুভ দেখলাম মোবাইল নিয়ে খুটখাট করতে — সম্ভবত কাউকে ফোন করবে। আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, “এবেলা ফোনের টাওয়ার বেশ ভাল রয়েছে। ফোন করতে হবে, ফোনটা সেরে ফেলি কি বলিস?” আমি হ্যাঁ বা না কিছু বললাম না শুধু শুনে গেলাম। কারণ আমি ভাল করেই জানি আমার হ্যাঁ বা না তে ওর সিদ্ধান্তের কোন বদল হবে না। শুধু এটুকু জিজ্ঞাসা করলাম, “কাকে ফোন করবি?” সে বলল, “প্রথমত, অর্কবাবুকে।” আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম আবার, “প্রথমত মানে? দ্বিতীয় কেউ আছে নাকি?”

— “বাহ, এক্সেলেন্ট! ঠিক ধরেছিস। আর একটা ফোন করব আমার কলকাতার এক বন্ধুকে।”

প্রথমে শুভ অর্কবাবুকে ফোন করে বলল যদি ওঁর বাবার কাছে দিবনীশ পালের বাড়ির ঠিকানা থাকে তাহলে উনি যেন একটু দেন। ঠিকানাটা শুনে শুভ আমাকে বলতে থাকল, আমি বুঝতে পারলাম সেটা আমাকে লিখতে হবে। যেটুকু জানা গেল তাঁর বাড়ি পার্শ্ববর্তী গ্রামেই। গ্রামটার নাম ‘কনক’।

দ্বিতীয় ফোনটা যাকে করা হল, শুভর কথায় বুঝলাম তাঁর নাম অনির্বাণ। কথা খুব সামান্যই হল। এপাশ থেকে যা কথা হল তা মোটামুটি এই, “ভাই অনির্বাণ, তোর একটা হেল্প দরকার। তোকে আমি একটা ঠিকানা দিয়েছি হোয়াটসঅ্যাপে, তোকে শুধু একটা জিনিস নিয়ে আমাকে খোঁজ দিতে হবে। কোন জিনিস আর তোকে কী করতে হবে দেখবি আমি সব লিখে দিয়েছি। পারলে কালকের মধ্যেই খবর দিস। হ্যাঁ থ্যাংকস। চল তাহলে রাখলাম।” ফোনটা রেখে দিল শুভ। ব্যাপারটা কী আমি জানার জন্য প্রশ্ন করতেই ও শুধু এটাই বলল যে ব্যাপারটা কী সেটা বোঝারই চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে ওর পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয় কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আগে দরকার। আমি বুঝলাম অগত্যা আমার অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

।।৮।।

গতকাল হেতমপুর আর তার পাশাপাশি জায়গাগুলো সম্পর্কে যা যা তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম তা গতকাল দুপুর থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত লিখেছি। তাই কাল বিকেলের দিকে তেমন কোথাও বেরনো হয়নি। এমন কি আজ বিকেলেও কোথাও বেরতে পারিনি। শুভ যদিও একবার হাঁটতে বেরিয়েছিল। আজ সকাল থেকে টানা বিকেল তিনটে পর্যন্ত আমরা নানান জায়গায় ঘুরে দেখেছি। আর বড় কথা হল আজ কাকাও গিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে। এতটা সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হবে সেটা জেনে স্নান করে বেরিয়েছিলাম। সকালে চা ছাড়া কিছু খেয়ে বের হইনি। তাই জলখাবার, লাঞ্চ সব বাইরেই সারতে হল। বিকেল পাঁচটা থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা হল আজ সারাদিন যেখানে যেখানে ঘুরেছি সেগুলো লিখে রাখছি। লেখালেখির কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হলেই ভাল হয় কারণ ওইদিকে গোপালের মূর্তি চুরির সম্ভাবনা, খুনের হুমকি এসবই মাথায় ঘুরছে আমার। আর একটা উত্তেজনা কাজ করছে মনের মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে। আরেকটা দিন হলেই বোধহয় লেখালেখির কাজ শেষ হয়ে যাবে।

আজ ওইবেলায় গাড়িতে যেতে যেতে এসব ঘটনা আমি কাকাকে বলছিলাম। আর সেজন্যই বোধহয় উনি নিজেই রাত্রে খাবার টেবিলে এই নিয়ে কথা পাড়লেন। বলতে গেলে শুভর গোয়েন্দাগিরি করার ব্যাপারটারই প্রশংসা করলেন। আজ রাতে ভাতের সঙ্গে আলুপোস্ত, কাতলার কালিয়া আর চিংড়ির মালাইকারি হয়েছে। খাওয়া সেরে ঘরে এসে শোবার তোড়জোড় করছি, শুভ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখলাম ও তীব্রবেগে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কি হল ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম না। ব্যালকনির কাছে গিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম সে কিছু একটা লক্ষ্য করে ছুটে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মিনিট দুয়েক পর দেখলাম ফিরে আসছে হেঁটে। ঘরে আসতেই আমি ধরমরিয়ে সামনে এগিয়ে প্রশ্ন করলাম, “ক কী হয়েছে?” সে বলল, “কেউ একটা হেঁটে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে, আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হঠাৎ ছুটতে শুরু করল। আমি যদিও বুঝতে পারিনি যে ওটা কে ছিল আর কেনই বা দৌড়ে পালাল আমাকে দেখে।”

অনেক রাত অবধি জেগে রইলাম। নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। যে ছুটে পালাল তাকে কি সত্যি আমরা চিনি? কে হতে পারে? শুভ কী রকমভাবে দেখছে ব্যাপারটা? মনে প্রশ্ন থাকলেও আর জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয়নি।

* * *

পরের দিন সকালবেলা। আজ আমার তথ্য সংগ্রহের জন্য কোথাও যাব না ঠিক করেছি। আজ ওই টপিকটা থেকে বিরতি।

সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রওনা দিলাম দিবনীশ পালের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও সেখানে গিয়ে বিশেষ লাভ হল না। গেটে দারোয়ানকে প্রশ্ন করল শুভ, “দিবনীশবাবু আছেন? ওঁর সঙ্গে কি দেখা করা যাবে?” সে বলল যে তার বাবু বাড়িতে নেই। তিনি দিন দু’য়েক হল একটা বিশেষ কাজে দিল্লি গেছেন। ফেরার কথা আজ রাতেই। তারপর মাঝবয়সি দারোয়ান এমন একটা পাল্টা প্রশ্ন করল যেটার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সে বলল, “আপনারা কি পুলিশের লোক?” শুভ পাল্টা জিজ্ঞাসা করল, “কেন কী ব্যাপার বলো তো?”

— “আর বলেন কেন, বাপ ব্যাটার মধ্যে টাকা পয়সা নিয়ে দ্বন্দ্ব। ছোটবাবু তাঁর কিসব গবেষণার কাজ চালাচ্ছেন, সে জন্য দিনরাত বাবার কাছে টাকা চাওয়া। বাবু বলেন এসব বাজে খরচ, সেজন্য তিনি এক পয়সাও দেবেন না। ওঁর তো গবেষণার জন্য ল্যাব না কী বলে, সেই ঘরও আছে একটা। অনেক জিনিস আছে সেখানে।”

— “আচ্ছা এই ব্যাপার। শোন আমরা পুলিশের লোক ঠিক নই তবে গোয়েন্দা বলতে পার। আর এসব কথা যে তুমি আমাদের বললে, আমাদের অনেক উপকার হল।” এই বলে আমরা ওখান থেকে চলে এলাম, আর কোথাও যাওয়ার নেই তাই বাড়ি ফিরে এলাম।

।।৯।।

তারপরের দিন আরও একবার আমরা গেলাম দিবনীশবাবুর বাড়ি, ভদ্রলোক ফিরেছেন নাকি দেখতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা দেখলাম তা তো রীতিমতো আমার ঘাম ছুটিয়ে দিল। দেখলাম দিবনীশবাবুর পাঁচিলের বাইরে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। দারোয়ানটা কই? বাড়ির দরজার কাছে নেই। সেই দেখে আমরা সোজা ঘরে গিয়ে ঢুকতে যাব ঠিক এমন সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পুলিশ কনস্টেবল আমাদেরকে বাধা দিল। দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপারে, শোকের ছাপ তার মুখে স্পষ্ট। আমাদের যেই দেখল, সে অমনি পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ডেকে আমাদের উদ্দেশ্য করে বলল, “স্যার এই সেই দু’জন।” বিষয়টা কিছু বুঝলাম না। পরে ইন্সপেক্টর আমাদের একবার পা থেকে মাথা অবধি দেখে প্রশ্ন করলেন, “ও তার মানে আপনারাই গতকাল এখানে এসেছিলেন? কিন্তু কেন? দিবনীশ পালের খুনের পেছনে আপনাদের হাত নেই তো?” প্রথমে চমকে গেলাম এটা শুনে তারপর মনে মনে ভাবলাম কী আজেবাজে বকছে লোকটা! আমাদেরকে কি ওঁর খুনি মনে হচ্ছে? আচ্ছা সমস্যায় পড়া গেল তো। মনে মনে ভীষণ রাগ হল, যদিও একথা সত্যি যে আমরা একে অপরিচিত তার উপর আমরা আসার পরের দিনই ভদ্রলোক খুন হলেন, তাই আমাদের উপর সন্দেহটাও কিছু অস্বাভাবিক নয়। শুভ দেখলাম পরিস্থিতি সামাল দিল, প্রথমে আমাদের পরিচয় থেকে শুরু করে গতকাল পর্যন্ত যা ঘটেছে সব তাঁকে খুব সংক্ষেপে বলল। আর এটাও বলল যে উনি যদি অনুমতি দেন তাহলে এই খুনের ব্যাপারটা নিয়েও ও একটু তদন্ত করতে চায়।

ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি ইন্সপেক্টরের নাম সুদীপ দত্ত। শুভর একথা শুনে তিনি বললেন, “দেখুন আমার অসুবিধে নেই। কিন্তু পুলিশের কাজে ব্যাঘাত না ঘটলেই হল।”

— “না না পুলিশের কাজে কোন হস্তক্ষেপ আমরা করব না। আচ্ছা মৃতদেহটা একবার দেখা যায় কি?”

— “হ্যাঁ আসুন আমার সঙ্গে।”

অন্দরে প্রবেশ করে দেখলাম একটা ঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে একটা মৃতদেহ। দিবনীশবাবুকে আমরা আগে দেখিনি, তবে পুলিশের কথাতেই সদর দরজার কাছে বুঝেছি যে দিবনীশ পালই খুন হয়েছেন, তাই এই দেহ তারই। মৃতদেহের পেটে কিছু একটা দিয়ে সজোরে আঘাত করা হয়েছে। একটা গভীর ক্ষত স্পষ্ট। “বাড়ির কাজের লোকেরা বলছে যে ভদ্রলোক নাকি রাতে দরজা খুলেই শুতেন। স্ত্রী মারা গেছেন, বয়স তো অনেক হয়েছে কখন কী হয়ে যায় তাই আর কি…। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কী বলুন তো মিঃ চ্যাটার্জী, এই ক্ষতটা ভাল করে দেখুন। কিসের হতে পারে বলতে পারেন? এ ক্ষত যে কোন ছুরির নয় তা আমি বেশ ভাল করে জানি, কারণ কোন ছুরির আঘাতে এরকম আকৃতির ক্ষত হতেই পারে না!” শেষটুকু বেশ জোর দিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর দত্ত। আমরা দুজন একটু কাছে গিয়ে ক্ষতস্থানটা দেখলাম। শুভ বলল, “ঠিক বলেছেন স্যার। এটার আকৃতি একদম গোলাকার আর ব্যাস… কত হবে, খুব বেশি হলে এক সেন্টিমিটার।” শুভ চারপাশটাতে চোখ বোলাচ্ছিল। এ ঘরটাতে এমন কিছুই পাওয়া গেল না যা থেকে কোন সূত্র পাওয়া যায়। ঘরটার থেকে বেরিয়ে যেই আমরা দরজার কাছে দাঁড়িয়েছি, অমনি শুভ হঠাৎ বলে উঠল, “মৃতদেহটা যে ঘরটায় পাওয়া গেছে মানে দিবনীশবাবুর ঘরটায়, তার পাশেই এই ঘরটার দিকে চোখ পড়েনি তো আর এটাও তো লক্ষ্য করিনি এ ঘর খোলা অবস্থায় পড়ে আছে!” পাশের একটা ঘরের দিকে তাকিয়ে বলে শুভ।

— “ওটা একটা ল্যাব মিঃ চ্যাটার্জি। চাকরবাকররা বলছে ল্যাবটা নাকি ভদ্রলোকের ছেলের।”

— “আসুন তো স্যার একটু ভিতরে।” শুভর কথায় আমরা তিনজন ভিতরে ঢুকলাম। সেখানে নানা মাপের কাচের বিকার, টেস্টটিউব, আরও বিভিন্ন রকমের পাত্র, নানা রংয়ের কেমিক্যাল, অ্যাসিড ইত্যাদি রয়েছে। প্রতিটার গায়ে নামও লেখা আছে। কিন্তু যেটা অবাক করা ব্যাপার তা হল কিছু জিনিস টেবিল থেকে নীচে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে, অনেক কাঁচের পাত্র ভেঙে গেছে।

— “এখানে তো বেশ একটা ধস্তাধস্তি হওয়ার সূত্র পাওয়া যাচ্ছে স্যার।”

— “ঠিক ধরেছেন মশাই, আশ্চর্যের ব্যাপার হল এ ঘর তালা বন্ধ থাকে না। যদি ধরা যায় যে খুনের আগে আততায়ীর সঙ্গে মিঃ পালের ধস্তাধস্তি হয়েছে কিন্তু সেখানেও একটা সমস্যা, মিঃ পালের মৃতদেহ পাওয়া গেছে তাঁর নিজের ঘরে। এ ব্যাপারটা তো বেশ স্পষ্ট যে খুনটা ও ঘরেই হয়েছে। কারণ যদি এই ল্যাবরেটরিতে হত তাহলে বডিটা ঘষটে নিয়ে যাওয়ার একটা দাগ নিশ্চয়ই থাকত।”

— “ঠিক বলেছেন স্যার। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ধস্তাধস্তির চিহ্ন এখানে আর খুনটা অন্য ঘরে, এর পিছনে কারণ কী?”

— “সেটাই তো খুঁজে বের করতে হবে মিঃ চ্যাটার্জি। ওই দেখুন ওটা হল ভদ্রলোকের ছেলের ছবি।” একটি ছবির দিকে ইঙ্গিত করে ইন্সপেক্টর দত্ত বললেন। টেবিলে রাখা ফটোটায় দেখলাম একজনকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এই পুরস্কারপ্রাপকই হল দিবনীশবাবুর ছেলে। শুভ ঘরের ভিতরটা ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা খুনটা যখন হয় কেউ কি দেখেনি বা কোনও আওয়াজ শোনেনি! এমনকি ওনার ছেলে…?” বলতে বলতে হঠাৎ থমকে গিয়ে আবার বলল, “দিবনীশবাবুর ছেলেকে দেখছি না তো!”

— “আসলে বাড়ির কাজের লোকেরা রাতে কাউকে দেখেনি। বলতে গেলে সবকটা টেনে ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ ভদ্রলোকের চিৎকারে দু’জনের ঘুম ভাঙে। তারা দারোয়ানকে হাঁক পাড়ে, কিন্তু সে ব্যাটা তখন আরও ঘুমিয়ে কাদা। ওটাকে বেশ করে শুনিয়েছি, যে বাড়ির মালিক খুন হয়ে যাচ্ছে আর তোমরা সব ঘুমোচ্ছ। এই খুন হওয়ার পিছনে তোমরাও কম দায়ী নও। আর আপনি বলছিলেন না ভদ্রলোকের ছেলের কথা, সে নিরুদ্দেশ, কাল রাত থেকেই। আমার প্রাথমিক সন্দেহ সে-ই খুন করেছে। আরে সেজন্যই তো পালিয়েছে। আর এদের কাছে তো জানলাম বাবা ছেলের সম্পর্ক একদম ভাল ছিল না।” এরপর তিনি শুভর ফোন নম্বরটা আর আমরা কোথায় রয়েছি সেটা জানতে চাইলেন, দিয়ে বললেন, “এখান থেকে এবার বেরুতে হবে আমায়। দেখি বডি পোস্টমর্টেমে পাঠাতে হবে।”

— “হ্যাঁ আমরাও যাব। আর স্যার খুনের অস্ত্রটা সম্পর্কে কিছু জানতে পারলে বলবেন একটু।” বলল শুভ। সেদিন ওখান থেকে আমরা চলে এলাম। তবে বাড়ি ঢোকার সময় হঠাৎ কী হল, শুভ বলল, “চল তো সান্যালবাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসি। দেখি গিয়ে যে বিপ্রদীপবাবু ব্যাপারটা কোন মাধ্যমে জানতে পেরেছেন নাকি।”

ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি। অনেকক্ষণ ধরেই শুভকে একটা প্রশ্ন করব ভাবছিলাম, আসলে ইন্সপেক্টর দত্তর চোখের আড়ালে ওকে দিবনীশবাবুর ছেলের ল্যাবরেটরি থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে নিতে দেখেছি। সেটা কী জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। আর জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না। সে প্রশ্ন শুনে বলল, “আংটি।” বেশ অবাকই হলাম, “আংটি! কার আংটি?”

— “হয়ত যে সেই ল্যাবটায় কাজ করে তাঁর, আবার খুনিরও হতে পারে।”

সান্যালবাড়ি পৌঁছে প্রথমেই বিপ্রদীপবাবুর সঙ্গে দেখা করে শুভ জানতে চাইল যে আর ওরকম হুমকি লেখা কাগজ এসেছে নাকি। ভদ্রলোক বললেন যে আর আসেনি। এরপর শুভ তাঁকে দিবনীশবাবুর খুনের কথাটা বলল, “আপনি কি জানেন দিবনীশ পাল কাল রাতে খুন হয়েছেন? বোধহয় জানেন না, তাই না?”

— “না, আমি তো তোমার কাছেই শুনলাম। খবরটা যদিও দুঃখের তবে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম বুঝলে।”

— “কেন বলুন তো?”

— “ওমা তুমি তো গোয়েন্দা, আর এটা বুঝলে না। আমি সিওর ওইসব লেখা কাগজ ওই দিবনীশই আমাকে পাঠাত। তুমি নিজেই দেখ না ওরকম কোন কিছু আর আসেনি, সম্ভবত শেষেরটা থেকে গুনলে আবার আজকেই তো দশদিন হওয়ার কথা। বলতে গেলে ওরকম কিছু আসবেও না আর। তাই তোমাকে আর তদন্ত করতে হবে না। এখন বোধহয় আমার গোপাল আর আমি দু’জনেই সুরক্ষিত।” শেষটুকু বেশ হেসেই বললেন ভদ্রলোক। একথার কোন জবাব দেয়নি শুভ। আমি বুঝতে পারছিলাম ও দিবনীশবাবুর খুনের রহস্যটা না সলভ করে এই জায়গা ছেড়ে যাচ্ছে না।

ওখান থেকে ফিরে আসার পর দেখলাম শুভ কাউকে ফোন করছে। কথা বলতেই বুঝতে পারলাম যে কে।

— “হ্যাঁ অনির্বাণ দু’দিন হয়ে গেল কোন খবর দিলি না। ও … ইনফরমেশনটা কালেক্ট করতে দেরি হল। আচ্ছা যেটা বলেছিলাম সেটা জানতে পারলি তো, … আচ্ছা এই ব্যাপার। এবার বুঝলাম! … ঠিক আছে এখন রাখলাম বুঝলি।” ফোনটা কেটে দিল ও। ফোনে কথা বলার সময় ওকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। সে ভাব এখনও বজায় রয়েছে।

সারা দুপুরটা আজ শুভ ঘরের মধ্যে পায়চারি করে চলেছে। আর মাঝে মাঝে খাতায় কিসব লিখছে। ওকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। বিকেলে হঠাৎই শুভর ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরে, “হ্যালো, আচ্ছা ইন্সপেক্টর দত্ত …” একথা বলতেই বুঝতে পারলাম যে পুলিশের ফোন। কিন্তু কি জন্য? শুভ হ্যালো হ্যালো করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নেটওয়ার্ক প্রবলেম তাই শুনতে পাচ্ছে না বোধহয়। কী কথা হল আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। ও ঘরে আসতে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী বলছিলেন মিঃ দত্ত?”

— “পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসেছে দিবনীশবাবুর, ওঁকে যে বস্তুটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সেটা কাঁচের ছিল বলে অনুমান। কারণ ক্ষতস্থানের ভিতরে কাঁচের টুকরো পাওয়া গেছে। আর ইন্সপেক্টর দত্ত বললেন ওঁর ধারণা যে ল্যাবের কোন টেস্টটিউব দিয়ে খুনটা করা হয়েছে। সেজন্যই আঘাতের চিহ্নটা পুরো গোলাকার। টেস্টটিউবের মাথাটা ভেঙে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পেটে। সেজন্য ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো পাওয়া গেছে। আর দ্বিতীয় যে খবরটা উনি দিলেন, সেটা হল আরও একটা খুন!” আমি অবাক হয়ে গেলাম, “আবার খুন! কিন্তু কার!”

— “দিবনীশ পালের ছেলের। সে নিরুদ্দেশ হওয়ায় প্রথমে পুলিশের ধারণা হয়েছিল যে সেই বোধহয় খুন করেছে তাঁর বাবাকে। কিন্তু আজ যখন তারও মৃতদেহ পাওয়া যায় কিছুটা দূরে একটা ঝোপঝাড় জলা জায়গায়, তখন পুলিশের সমস্ত ধারণাই পাল্টে যায়। আবার নতুন করে তদন্ত শুরু করতে হবে ওঁদের, এটাই ইন্সপেক্টর দত্ত বললেন।” আমি প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা তুই কি কিছু বুঝতে পারছিস এগুলো কেন হচ্ছে আর এর পিছনে কার হাত আছে?”

— “বোধহয় কিছু কিছু জিনিস বুঝতে পারছি এখন।”

— “কী বুঝতে পারছিস?”

— “সেটা বলার সময় এখনও হয়নি, খুনের অস্ত্রটা খুঁজে বার করতে পারলেই সবটা পরিষ্কার হবে।”

— “কেন পুলিশ যে বলছে অস্ত্র …” আমার কথাটা সম্পূর্ণ হল না। শুভ থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমার ওটা মনে হয় না কারণ ওগুলো তুলনামূলক পাতলা কাচের হয়। অত জোরে আঘাতে ও বস্তুর আরও কিছু বড় টুকরো পাওয়া যেত যদি আঘাতটা টেস্টটিউব দিয়ে করা হত। কিন্তু পাওয়া গেছে তুলনামূলকভাবে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো।”

— “আর ওঁর ছেলে কি একইভাবে খুন হয়েছে?”

— “না, তাঁকে সম্ভবত ভারী কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করে মারা হয়েছে। ইন্সপেক্টর দত্ত আর একটা কথাও বললেন, দিবনীশবাবুর ঘরের ড্রয়ারে একটা হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। সেটা কিন্তু দিবনীশবাবু, তাঁর ছেলে বা বাড়ির অন্য কারও সঙ্গে মেলেনি। সুতরাং সম্ভাব্য যে খুনি তারই হাতের ছাপ ওটা।”

।।১০।।

পরদিন সকালে দেখলাম শুভ বেশ ফ্রি মাইন্ডেই রয়েছে। গতকালের সেই দুশ্চিন্তার বিন্দুমাত্র লেশ তার চোখে-মুখে নেই। তপুকাকাকে সঙ্গে নিয়ে আজ আমাকেই যেতে হল বাকি জায়গাগুলো। শুভ একটু ব্যস্ত এসব ঘটনা নিয়ে। তাই আজ ও আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না। প্রথম থেকে নাকি আবার পর পর সব ঘটনাগুলো ভাবতে চায় ও। তাই ওকে বাড়িতে রেখেই আমরা রওনা দিলাম। যখন আমরা ফিরে এলাম তখন দেখছি শুভ চোখ বুজে শুয়ে আছে। আমার অস্তিত্ব বুঝতে পেরেই বলল, “কি রে ঘোরা আর কাজ হল?” আমি বললাম, “হ্যাঁ সে তো হল কিন্তু তুই তো যেতে পেলি না।” আমার এ কথা শুনে ও হাসল। তারপর উঠে বসতে বসতে বলল, “আজ বিকেলে সান্যালবাড়ি যেতে হবে বুঝলি, তুই তৈরি হয়ে থাকিস।”

যখন সান্যালবাড়িতে পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যাচ্ছে। শুভ বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে অর্কবাবুকে দেখতে পেয়ে বলল, “আপনার বোনের সঙ্গে কি একটিবার দেখা করা যায়?”

— “হ্যাঁ যায়, কিন্তু কেন বলুন তো হঠাৎ?”

— “সব বলব। আপনি আর আপনার বাবা বসার ঘরে অপেক্ষা করুন আমরা আসছি।”

ঘরের দরজা খোলাই ছিল। অত্যুত্তমাকে দরজার বাইরে থেকে ডেকেই শুভ বলল, “আপনার বাঁশির কালেকশনটা আর একবার দেখতে চাই।” অত্যুত্তমা বলতেই শুভ সোজা একদম চলে গেল বাঁশিগুলোর কাছে। দেখতে দেখতে কী হল বুঝলাম না, হঠাৎই শুভর ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি লক্ষ্য করলাম। সে আবার অত্যুত্তমার দিকে ফিরে বলল, “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আর একবার বসার ঘরে চলুন আপনাদের সবাইকে কিছু বলার আছে আমার।” আমরা উপরতলা থেকে নেমে এলাম। অত্যুত্তমাও আমাদের পিছন পিছন এল। একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে শুভ বিপ্রদীপবাবুকে বলল, “তাহলে আপনি এখন পুরোপুরি চিন্তামুক্ত তাই তো, আর তো বোধহয় সেরকম কিছু আসেনি?” ভদ্রলোক হেসে হেসেই বললেন, “একদম! তোমাকে তো কালকেই বললাম, তা তুমি কী বলবে বলে ডেকে পাঠালে বলো তো?”

— “বলছি। বলব বলেই তো এলাম আজকে। তবে আরও একজন এখানে আসবেন উনি এলেই বলা শুরু করছি।”

— “আবার কে আসবেন মিঃ চ্যাটার্জী?” এবারে প্রশ্ন অর্কবাবুর।

— “দাঁড়ান, এত অধৈর্য হলে চলে অর্কবাবু।” কথাটা শেষ হতে না হতেই একটা গাড়ি বাইরে থামার আওয়াজ শুনতে পেলাম। শুভ বলল, “ওই বোধহয় উনি এসে গেছেন।” দেখলাম পুলিশ ইন্সপেক্টর দত্ত এসেছেন, সঙ্গে দু’জন কনস্টেবলও রয়েছে।

— “আরে পুলিশ কেন? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আপনি কী করতে চাইছেন বলবেন কী?” এবারে কথাগুলো বেশ বিরক্তি মেশানো সুরেই বললেন অর্কবাবু।

— “বললাম না ধৈর্য ধরুন সব বলছি।” এরপর দরজার দিকে ফিরে বলল, “আসুন, বসুন স্যার। আমি এই খুনের কেসটার সমাধান করেছি বুঝলেন স্যার।”

— “বলছেন কি মিঃ চ্যাটার্জী!” ইন্সপেক্টর দত্ত তো রীতিমতো হতবাক।

— “হ্যাঁ স্যার। শুনুন তাহলে, আপনি খুনের অস্ত্র কী সেটা বুঝতে পারেননি ঠিক। দিবনীশবাবুকে খুন করা হয় যেটা দিয়ে সেটা হল একটা বাঁশি।” একথা শুনে আমরা তো অবাক, ইন্সপেক্টর দত্ত তো বলেই ফেললেন, “অ্যাঁ! বলছেন কি! তা কী করে সম্ভব?”

— “সম্ভব। আপনি অনুমান করেছিলেন টেস্টটিউব হল খুনের অস্ত্র। আর সেটাই ভাবা স্বাভাবিক কারণ তেমনটাই খুনি দেখানোর চেষ্টা করেছে।” এবার শুভ অর্কবাবুর দিকে ফিরে বলল, “অর্কবাবু কিছু কি বুঝতে পারছেন যে খুনি কতটা চালাক আর এই খুনের ঘটনাটাও কতটা জটিল?”

— “আ – আমি কী বুঝব? না পারছি না কিছু বুঝতে।”

— “পারবেন পারবেন আর একটু খোলসা করে বিষয়টা বললেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু আপনার বাবা বোধহয় পারছেন সমস্তটাই বুঝতে!” শুভর চোখ জ্বলজ্বল করছে।

একরাশ বিরক্তি ভরা চোখে বিপ্রদীপবাবু বললেন, “কী বলছ তুমি? আমি বুঝব মানে?”

— “মানেটা তো আপনি খুব ভাল করেই জানেন আর এখন আমিও বুঝতে পেরেছি। আর সেই মানেটা হল দিবনীশ পালকে খুন আপনিই করেছেন মিঃ বিপ্রদীপ সান্যাল।” শুভর কথাগুলো পুরো বজ্রপাতের মত শোনাল। যেমনি তার গর্জন তেমনি অপ্রত্যাশিত।

— “কী সব আজেবাজে বকে চলেছ! আমি কেন খুন করতে যাব ওঁকে? উল্টে ওঁই বরং আমাকে খুনের হুমকি দিত।”

— “এসব বলে কোন লাভ নেই বিপ্রদীপবাবু, খুন যে আপনি করেছেন তার সাক্ষী আছে। আর সেই সাক্ষী দিবনীশবাবুর ছেলে।” একথা শোনা মাত্রই বিপ্রদীপবাবুর মুখের ভাবটা পাল্টে গেল। উনি নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, “সেটা কী করে সম্ভব?..কারণ…!!” উনি হঠাৎ থেমে গেলেন।

— “কারণ… তারপর কী বলুন। আচ্ছা আমি বলছি, কারণ আপনি তাঁকেও খুন করেছেন। কারণ সে আপনাকে তাঁর বাবাকে খুন করার সময় দেখে ফেলেছিল। সেই একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী এবং সাক্ষী এই ঘটনার, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে বেঁচে নেই। এটা ছাড়া আরও আছে। আচ্ছা আপনার ডান হাতে আগে যতবার এসেছি একটা আংটি দেখেছিলাম, কই গতকাল বা আজকে তো সেটা দেখলাম না। সেটা কোথায়? অবশ্য এ প্রশ্নের কোন উত্তর আপনার কাছে নেই যদিও বা কিছু উত্তর দিতেই হয় সেটা তো বানাতে হবে, তাই নয় কি? কারণ ও আংটি তো আপনার কাছে নেই, আছে তো আমার কাছে।” শুভ তার প্যান্টের পকেট থেকে সেই আংটিটা বার করল যেটা আমি ওকে দিবনীশবাবুর বাড়ি থেকে তুলতে দেখেছিলাম। এরপর ইন্সপেক্টর দত্তকে উদ্দেশ্য করে শুভ বলল, “স্যার, এটা আমি দিবনীশবাবুর ছেলের ল্যাব থেকে পেয়েছিলাম। আপনাকে যেটা বলছিলাম, খুনের অস্ত্র একটা বাঁশি। এ বাঁশি তবে বাঁশের তৈরী নয়, এ হল কাঁচের তৈরি বাঁশি, নাম ‘ক্রিস্টাল ফ্লুট’। এবার আপনাদের মনে হতে পারে যদি তাই হবে তাহলে সেই বাঁশি তো পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার কথা কিন্তু তার তো সে রকম কোন টুকরো পাওয়া যায়নি, যা পাওয়া গেছে তা খুবই ছোট টুকরো। এ প্রশ্নের উত্তরও আছে আমার কাছে। খুনটা করা হয়েছে ওই ক্রিস্টাল ফ্লুটটা দিয়ে, তবে ওখানে বাঁশের তৈরি বাঁশিরও একটা ভূমিকা আছে।”

— “কিন্তু মিঃ চ্যাটার্জি উনি এ খুনটা করতে গেলেন কেন?”

— “আপনাকে তো আগের দিন বলেছিলাম যে উনি আমাকে একটা কাজে নিয়োগ করেছিলেন, ওঁর গোপালের সোনার মূর্তি দিয়ে দেওয়ার জন্য আর নাহলে খুনের জন্য কেউ হুমকি দিচ্ছে।” এরপর শুভ আবার বিপ্রদীপবাবুর দিকে ফিরে বলতে শুরু করল, “কিন্তু আমি যদি বলি যে ব্যাপারটা অন্য। ও গোপালের মূর্তি আপনাদের জমিদার বংশের কোন সম্পত্তিই নয়। ওটার আসল মালিক বরং দিবনীশবাবুই ছিলেন আর আপনি ওটা চুরি করার চেষ্টা করেছিলেন এবং বোধহয় সফলও হয়েছেন। আপনি যেদিন প্রথম ওই মূর্তি আমাদের দেখিয়েছিলেন সেইদিনই আমার একটা খটকা লেগেছিল, যে ওই মূর্তিটা কোথাও দেখেছিলাম। এটা শুধুই আমার একটা ধারণা ছিল তাই আমার এক বন্ধু মারফত আমি কলকাতায় খবর নেই। সেখান থেকে জানতে পারি আমার খটকাটাই ঠিক ছিল। তখনই মনে পড়ে ওই মূর্তির ছবি দেখেছিলাম খবরের কাগজে বছরখানেক আগে। আর খবর নিয়ে জানতে পারি ওটা দিবনীশবাবু নিলামে কিনেছিলেন। সেটা পাওয়ার লোভ ছিল আপনারই। আপনি একটা নকল ওরকম মূর্তি বানিয়ে বাড়িতে রেখেছিলেন। আপনার ছেলে বা মেয়ে এ মূর্তির কথা জানত না, এরকম তো কোন মূর্তিই ছিল না। সম্ভবত আপনি বছরখানেক আগে নকল মূর্তিখানা বানানোর পরেই ছেলেমেয়েকে গোপালের মূর্তির কথাটা বলেন। আর আপনি যে হুমকির চিরকুটগুলো আমাকে দেখিয়েছিলেন সেরকম কোন হুমকি বোধহয় আপনার কাছে আসেনি, ওটা তো বোধহয় সম্পূর্ণ আপনার মনগড়া। এর পিছনে আপনি কী যুক্তি দেবেন তা আমি জানি না তবে পরের ঘটনাগুলো কি আপনি একটু বলবেন?” শেষটায় এ প্রশ্ন করে থামল শুভ।

বিপ্রদীপবাবু শেষটায় স্বীকার করলেন, “হ্যাঁ খুনটা আমিই করেছি। আর এটাও সত্যি যে ওই মূর্তিটার জন্যই করেছি।” এরপর উনি যা বলে গেলেন তা মোটামুটি এইরকম – উনি নকল যে মূর্তিটা বানানো করিয়েছিলেন, সেটার একটা কারণ ছিল। বেশ কয়েকবার দিবনীশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন ওই মূর্তিটা কেনার জন্য। দিবনীশবাবুই রাজি হননি। দিবনীশবাবুর কাছে ওই মূর্তি আছে উনি জানতেন কিন্তু ঠিক কোথায় রাখা আছে তা জানতেন না। তিনি এই নকল মূর্তিটা দেখিয়ে দিবনীশবাবুকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে উনি মূর্তি হাতিয়ে ফেলেছেন। আর সেটা দেখা মাত্রই দিবনীশবাবু যেখানে মূর্তি থাকার কথা সেখানে খুঁজতে যান আর তখনই বিপ্রদীপবাবু জানতে পেরে যান যে মূর্তি কোথায় আছে। সেই মূর্তিটা চুরি করে পালানোর জন্য তিনি খুনটা করেছেন। আর সেই সময় তাঁর ছেলে দেখে ফেলায় তাঁকেও খুন করতে তিনি বাধ্য হন। অবশ্য তাঁকে খুন করে সরিয়ে ফেলে তার একটা সুবিধাই হয়েছিল, বাবাকে খুনের দোষটা অনায়াসে দিবনীশবাবুর ছেলের ঘাড়েই চাপানো যাবে। আর তিনি জানতেন যে ওই ল্যাবের দরজায় তালা দেওয়া থাকে না। তাই ওই জায়গায় তিনি এমন একটা অবস্থা তৈরি করেন যাতে দেখে মনে হয় বেশ একটা ধস্তাধস্তি হয়েছে আর ওই ভাঙা কোন একটা বিকার বা টেস্টটিউব দিয়েই খুন করা হয়েছে। খুনের জন্য তিনি খুব নিপুণভাবে ক্রিস্টাল ফ্লুটটাকে একটা সাধারণ বাঁশের তৈরি অপেক্ষাকৃত বড় ব্যাসের বাঁশির মধ্যে ফিট করেন আর ক্রিস্টাল ফ্লুটের মাথার দিকটা ভেঙে দেন যাতে সেটা খুব সহজেই পেটের মধ্যে ঢুকে যায় আর যেহেতু বাইরে আরেকটা বাঁশির আবরণ ছিল তাই কাচের বাঁশিটার বেরিয়ে থাকা অংশটা ছাড়া আর কিছুই ভাঙেনি।

সবটা শোনার পর শুভ বলল, “গতকাল রাতেই আমি আপনাকে ধরে ফেলেছিলাম। সম্ভবত পরশু আপনি খুনটা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেদিন দিবনীশবাবু ছিলেন না, উনি দিল্লি গিয়েছিলেন। সেদিন ফেরার সময় আপনিই তো ছিলেন যে আমাকে ব্যালকনিতে দাঁড়াতে দেখে ছুটতে শুরু করেছিল। সেদিন যদিও আপনি আমার নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল রাতে আবার সেই একই ব্যক্তিকে একইরকমভাবে হেঁটে যেতে আমি দেখেছিলাম। সে আমাকে দেখতে পায়নি কারণ আমি লুকিয়েছিলাম। তারপর তার পিছনে পিছনে যেতে থাকি। সেই আগন্তুকের চলনটা আপনার মত মনে হয়েছিল কিন্তু ওটা যে আপনি তখনই বুঝতে পারলাম যখন সে আগন্তুক এই সান্যালবাড়িতে ঢুকল। কিন্তু এই বিষয়টা আমি চেপে গিয়েছিলাম, তখনও খুনটা করা হয়েছে কী দিয়ে সেটা বুঝতে পারছিলাম না বলে। কিন্তু আজ সকালেই একটা আন্দাজ করি এসব জিনিসগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে, সে জন্যই এখন এখানে এসে প্রথমেই গিয়েছিলাম অত্যুত্তমার ঘরে। গিয়ে দেখলাম আমার সন্দেহই ঠিক, হয়ত আপনার মেয়ে তেমন লক্ষ্য করেনি যে তার চারটে ক্রিস্টাল ফ্লুটের মধ্যে একটা মিসিং।” এরপর একটু থেমে ও ইন্সপেক্টর দত্তর দিকে ঘুরে বলল, “নিন স্যার আপনার আসামি। আর যে হাতের ছাপটা আপনি দিবনীশবাবুর ঘরের ড্রয়ার থেকে পেয়েছেন ওটা নিঃসন্দেহে এঁরই, মিলিয়ে দেখবেন পরে।”

— “অদ্ভুতভাবে অবাক করে কেসটা সলভ করলেন তো মশাই!” বলে উঠলেন ইন্সপেক্টর দত্ত।

— “আরেকটা কথা বিপ্রদীপবাবু, আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আপনি বিপদে পড়েছেন। সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সে রকম বিপদ আদৌ হয়নি কিছু সেটা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু খুন এবং চুরির অপরাধ করে আপনি যে বিপদে পড়লেন তা থেকে বোধহয় স্বয়ং সেই গোপালও আপনাকে উদ্ধার করবেন না, যাঁর মূর্তির জন্য আপনি এত কিছু করেছেন। আপনি যে অতি চালাকির সঙ্গে সমস্ত জিনিসটাকে সাজিয়েছিলেন আর সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন তা বেশ বুঝতে পারছি। আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন যে ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ বলেও একটা কথা আছে। আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপনার সুদীর্ঘ হাজতবাসের কথা।”

।।১১।।

গতকাল অনেক রাত করে শুয়েছি। তাই আজ উঠতে অনেকটা দেরি হল। আজ আমরা এখানেই থাকছি, ফিরব আগামীকাল। আমার লেখালেখির সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। আজকের দিনটা পুরো ফাঁকা। আজ মামাভাগ্নে পাহাড়টা ঘুরে আসব। এইখান থেকে কাছেই, ওই চার সাড়ে চার কিলোমিটার মত। শুভ আগেই উঠে পড়েছিল। আমাকে উঠতে দেখেই বলল, “যে উদ্দেশ্য নিয়ে আসা তা তো সম্পূর্ণ হয়েছেই। আর মাঝখান থেকে এমন একটা ঘটনার অভিজ্ঞতাও হল, কী বলিস বনী?” এই কথা শুনে আমি হাসলাম। হঠাৎ কোথাও থেকে একটা বাঁশির সুর ভেসে আসছে। তবে এ সুর অত্যুত্তমার বাজানো বাঁশির নয় কারণ ওঁর বাড়ি থেকে এত দূরে আওয়াজ আসবেও না আর এখন বাঁশি বাজানোর মতো মনের অবস্থাও বোধহয় তাঁর নেই।

— “কি রে বাঁশি শুনে থমকে গেলি নাকি?”

— “না, মানে ভাবছি বাড়ি গিয়ে একটা ওরকম ‘ক্রিস্টাল ফ্লুট’ কিনব।” আমার কথা শুনে শুভ হেসে উঠল। বলল, “সে না হয় কিনিস কিন্তু এখন আপাতত ওঠ যদি মামাভাগ্নে যেতে চাস, আর নাহলে আমরাই চললাম, তুমি থাকো বসে এখানে।”

— “ওই দাঁড়া তো, এত বড় সাহস! বলে কিনা আমাকে ফেলে ওরা যাবে। দাঁড়া যাওয়া করাচ্ছি।”

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post বিড়াল তপস্বী| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | নুজহাত ইসলাম নৌশিন| Bengali Detective Story
Next post ফুলঝুরির গপ্পো| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | দেবশ্রী ঘোষ| Bengali Detective Story