ননীবালার হত্যাকান্ড| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | দীপঙ্কর পয়ড়্যা| Bengali Detective Story
0 (0)

রমেন একা বিদ্যুৎহীন কক্ষে বসে নির্জনে চিন্তামগ্ন ছিল, এমন সময় হঠাৎ দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দে কক্ষের নিস্তব্ধতা কেটে গেল৷ অবস্থান পরিবর্তন না করেই রমেন বললো, “কে?”

দরজার ওপার থেকে কোমল কন্ঠে উত্তর এলো, “আমি রাজু৷ রমেন আছে নাকি?”

রমেনের নামটি শুনে কেমন পরিচিতি বলে মনে হল৷ সে একটুখানি ভেবে বললো, পালপাড়ার, “রাজু?” উত্তর এলো, “হ্যাঁ৷”

তৎক্ষণাৎ উঠে দরজা খুলতেই কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করলো আগন্তুক রাজু I কলেজে পড়াকালীন চার জনের ‘অনুসন্ধান’ নামক গুপ্ত শাখার অন্যতম সদস্য ছিল রাজু৷ রমেন ছাড়া বাকি দু’জন ছিল রাহুল ও পরম৷ পরিচিতদের মধ্যে ঘটা বিভিন্ন রহস্যগুলোর সমাধান করাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য৷ কিন্তু কলেজ পরিসমাপ্তির পর উচ্চশিক্ষার জন্য রাজু, রাহুল ও পরম বাইরে চলে যাওয়ায় একাই পুরোনো শখের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে আছে রমেন৷ লোকালয়ে বর্তমানে গোয়েন্দা হিসেবে রমেনের নামডাক হয়েছে অল্পবিস্তর৷ শহরের একটা দোকানের খাতাপত্র দেখার কাজ করার পাশাপাশি অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যায় সে৷ দোকানের মালিক ‘পলাশবাবু’ তদন্তের জন্য সব সময় স্বাধীনতা দিয়েছেন রমেনকে, কারণ রমেন যে তার কাছেই থাকে পলাশ বাবু এটা বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে লোকের কাছে বলে থাকেন৷

দীর্ঘদিনের পুরোনো বন্ধু রাজুর সঙ্গে প্রায় চার বছর বাদে রমেনের দেখা হতেই আনন্দে মেতে উঠল তার মন৷ দু’জনের আলাপের পর্ব চলাকালীন রাজুকে দেখে মনে হলো সে খুব চিন্তিত৷ রমেন কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় রাজু বলে উঠল, “ভাই তোর কাছে ছুটে এলাম একটা গভীর সমস্যায় পড়ে৷ শহরে তোর খুব নাম ডাক হয়েছে গোয়েন্দা হিসেবে, তাই তোর কাছে ছুটে এলাম৷ তুই আমায় উদ্ধার করতে পারবি?”

রমেন বললো, “আগে শান্ত হয়ে বস! তারপর কি হয়েছে আমাকে বল৷ আমি সব শুনি কি ঘটেছে৷”

রাজু বলতে লাগলো, “আমার দাদুর বাবা রাজেন্দ্র প্রতাপ পাল ছিলেন বিশাল জমিদার, বহু সম্পত্তির মালিক৷ আমার দাদু রবীনচন্দ্র পাল ছিলেন তাঁর একমাত্র পুত্র, তাই ওনার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ছিলেন আমার দাদু৷ কিন্তু বহু সম্পত্তি বেনামে থাকায় সরকার সেগুলোকে কৃষকদের মধ্যে বিলি করে দেয়৷ তারপরেও আমার দাদুর ভাগে কম ছিল না৷ আমার দাদু রবীনচন্দ্র পালের তিন ছেলে – আমার বাবা নারায়ন চন্দ্র পাল, মেজো কাকু নরেন্দ্র পাল ও ছোটো কাকু নবকান্ত পাল৷ আমার দাদুর কন্যা সন্তান না থাকায় অনাথ আশ্রম থেকে একটি অনাথ শিশু কন্যা দত্তক নিয়েছিলেন। দাদু তার পিতার কাছ থেকে পাওয়া একটি হীরের হার দত্তক কন্যা ননীবালা পাল কে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন৷ কথিত আছে সেটা সম্রাট আকবরের সমসাময়িক হীরে৷ ছোটো কাকু নবকান্ত ও পিসিমণি ননীবালা একসঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হয়েছেন, ছোটকাকু থেকে প্রায় পাঁচ বছরের ছোটো ছিলেন ননীবালা পিসিমণি। জন-মানসে একটি কথা ঘোরাঘুরি করে যে নবকান্ত কাকু পিসিমণিকে প্রেমিকার চোখে দেখেন৷ তিনি বোন হিসাবে কখনোই মান্যতা দেননি ননীবালাকে৷ কারণ কাকু শৈশব থেকেই জানতেন ননীবালা তার বোন নয়, তাদের বয়সের পার্থক্য প্রায় পাঁচ বছরের৷ তাছাড়া পিসিমণি ছিলেন পরীর মতো সুন্দরী, গায়ের রং দুধে আলতা৷

এই ঘটনা জানাজানি হলে দাদু খুব কষ্ট পান এবং ছোট কাকুকে খুব শাস্তি দিয়েছিলেন। সেই সময়ই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দাদুর মৃত্যু হয়৷ সেই শোকে ঠাকুমাও পরলোক গমন করেন৷ তাই ছোটকাকু বিয়ে করেননি আর ননীবালা পিসিও অবিবাহিতা থেকে গেছিলেন এখন পর্যন্ত৷ এখন ছোটকাকুর বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর৷

“অবিবাহিতা থেকে গেছিলেন মানে, এখন কি তিনি আর বেঁচে নেই?”

“না তিনি আর বেঁচে নেই, সেই কারণেই তোর কাছে আমার আসা৷

গতকাল রাতে সবাই একত্রে বসে আহার সম্পন্ন করার পর যে যার ঘরে শয়নের উদ্দেশ্যে চলে যান৷ এমনিতে সকালে সবাই একটু দেরি করে শয্যাত্যাগ করেন৷ কিন্তু সকাল ন’টা পর্যন্ত যখন পিসিমণি বাইরে এলেন না, তখন দরজা ধাক্কা দিয়ে কোনো লাভ না হওয়ায় দরজা ভেঙ্গে দেখা যায় বিছানায় পড়ে আছে পিসিমণির নিথর দেহ৷ আমি পুলিশকে ফোন করে খবর দেওয়ার ঘন্টা খানেক পর পুলিশ এসে সমস্ত ঘরের ছবি তুলে দেহটি ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়৷ তবে প্রাথমিকভাবে পুলিশ অফিসার দেবকুমার বাবুর অনুমান, ঘুমন্ত অবস্থায় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হয়েছে৷ আগামীকাল রবিবার, তাই ময়না তদন্তের ফলাফল সোমবার বিকালের আগে পাওয়া যাবে না বলেছেন তিনি৷ তবে আমার অনুমান এটা খুন!”

“তোর এই ধারণার কারণ?”

জানিনা কেন যেন আমার মনে হচ্ছে এটা খুন৷ পিসিমণি প্রায়ই বলতেন ‘এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া তার পরম প্রাপ্তি’। তিনি প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসতেন৷ তাই বাড়ির চারপাশের বাগানে নিজের হাতে বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে ছিলেন৷ এই রকম মানুষ এত তাড়াতাড়ি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে পারেন না৷

রমেন প্রশ্ন করলো, “হীরের হারের খবর কী?”

রাজু বললো, “মৃতদেহে হীরের হার দেখা যায়নি, তবে বাক্সের মধ্যে থাকতে পারে৷ পুলিশ ঘরের তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে গেছে৷”

“পুলিশ অফিসার দেবকুমার বাবু তোর বাড়িতে এসেছিলেন?”

“হ্যাঁ৷”

“দেবকুমার বাবুর সঙ্গে আমার সু-সম্পর্ক আছে৷ আমি চেষ্টা করছি মৃত দেহের ছবিগুলো পাওয়া যায় কিনা৷ তুই আজ আমার কাছে থাক, কাল ভোরের বাস ধরে আমরা তোর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব৷”

রমেন মোবাইল ফোনে নম্বর সার্চ করে দেবকুমার বাবুকে কল করে নিজের পরিচয় দিয়ে, নারায়ণ বাবুর পরিবারের সঙ্গে রমেনের পারিবারিক আত্মীয়তার সম্পর্কের উল্লেখ করে ছবিগুলো চাইল৷

দেবকুমার বাবু বললেন, “ঠিক আছে তোমাকে আমি ছবিগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি, তবে আমার প্রাথমিক অনুমান এটা স্বাভাবিক মৃত্যু৷” রমেন বললো, “তাহলে তো আমাকে বেশি মানসিক চাপ নিতে হয় না৷”

ফোন রেখে দেওয়ার অল্প সময়ের ব্যবধানে রমেনের হোয়াটসঅ্যাপে ছবিগুলো চলে এলো৷ রমেন সেগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃঢ় মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো৷ সবকটা ছবি দেখার পরে রমেন বললো, “এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, খুন করা হয়েছে তোর পিসিমনিকে৷ কাল ভোরের বাস ধরে তোর গ্রামে যাচ্ছি৷”

রাজু জিজ্ঞাসা করলো “কি দেখে তোর মনে হলো এটা খুন?”

রমেনে সে কথায় জবাব না দিয়ে বললো, “চল পাশের হোটেল থেকে আজকের রাতের আহারটা সেরে আসি৷”

ভোর চারটার সময় এলার্মের শব্দে দু’জনের ঘুম ভেঙ্গে গেল৷ তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে দু’জন বেরিয়ে পড়লো৷ রাজুর বাড়ি কাঁথির কাছে বিলাসপুর গ্রামে, রমেন থাকে এগরা তে৷ এগরাতে বাস ধরলে 40- 45 মিনিটের মধ্যে কাঁথি পৌঁছানো যায়৷ সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ভোর পাঁচটায় বাস ধরল তারা৷ ভিড় না থাকায় দু’টো সিট পেয়ে গেল অনায়াসে৷ বেশিরভাগ যাত্রী তখন ভোরের নিদ্রায় আচ্ছন্ন৷ কিছুটা যাওয়ার পর রমেন বলল, “কাঁথি বাস স্ট্যান্ড থেকে তোর বাড়ি কত দূর?

রাজু বললো, “প্রায় পাঁচ কিমি দূরের গ্রাম্য প্রান্তরে বিলাসপুর গ্রাম, আমার বাড়ি শহরের খুব কাছে হলেও সেখানে গেলে তোর মনে হবে যেন সবুজ প্রকৃতির মাঝে কোন একটি রূপকথার স্থান৷” কথোপকথনের মাঝে বাস কন্ডাক্টারের হাঁক শোনা গেল, “রূপসী বাইপাস – রুপসী বাইপাস৷” তারা দু’জন তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে পড়লো৷

রমেন বললো, “এখান থেকে তোর বাড়ি যাব কিভাবে?”

রাজু বললো, “সামনের গ্যারেজে আমার সাইকেল আছে, মিনিট পনেরো- কুড়ির মধ্যে আমরা বাড়ি পৌঁছে যাব৷”

রমেন বললো, “চল তবে সাইকেলেই যাই৷”

ভোর ছ’টা নাগাদ রমেন রাজুর বাড়িতে পৌঁছালো৷

রাজু বললো, “ভিতরে চল জল খাবার খেয়ে সবকিছু ঘুরে দেখবি৷”

রমেন কথাটি নাকচ করে দিয়ে বললো, “চল আগে তোর ননীবালা পিসিমণির বাড়িটা গিয়ে দেখে আসি, তারপর অন্যান্য কাজ হবে৷”

রাজু অনিচ্ছাসত্ত্বেও রমেনকে পিসিমণির বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেল৷ ননীবালা দেবীর বাড়িটা রাজুদের প্রধান বাড়ি থেকে 25- 30 গজ দূরে অবস্থিত। সুপারি গাছে ঘেরা বাড়িটার চারিদিক, বাড়ির সামনে বিভিন্ন রঙিন ফুলের বাগান৷ তারই মাঝে একতলা ঘরটি অবস্থানরত৷ অনুসন্ধিৎসু চোখে বাড়ির চতুর্দিক ভালো করে দেখলো রমেন৷

“তোর পিসিমণির বাড়িটা এতটা দূরে কেন?”

রাজু বললো, তোকে তো বলেছি পিসিমণি প্রকৃতি খুব ভালোবাসতেন৷ তাই কিছুটা দূরে নিজের হাতে বাগান তৈরি করে সেখানেই নিরিবিলিতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে তিনি বাস করতেন৷ আমি যখন তখন এসে বাগানে ঘুরতাম, পিসির সাথে গল্প করতাম৷”

বাড়ির উওর দিকে রজনীগন্ধার স্টিক গুলো ঘরের জানালা পর্যন্ত উঠে গেছে, বাড়ির মধ্যে থেকেই স্টিক গুলোকে স্পর্শ করা যায়৷ হঠাৎ রমেনের চোখ গেল রজনীগন্ধা গাছের নিচে মাটির দিকে, কয়েকটা অস্পষ্ট পদচিহ্ন দেখে ফোন বের করে ভালো করে ছবি তুলে নিল সে৷

তারপর রাজুকে বললো, “বাগানে কবে জল দেওয়া হয়েছিল?”

রাজু বললো, “গত পরশু আমি আর পিসিমণি মিলে বাগানে জল দিয়েছিলাম৷ কিন্তু সেই রাতেই সব শেষ হয়ে গেল৷”

বাড়ির দক্ষিণে দেওয়ালের খুব কাছেই একটা সুপারি গাছ। এই গাছে উঠলেই বাথরুমের কাইলাইট (বাথরুমের উপরের ফাঁকা অংশ) দিয়ে অনায়াসে যে কেউ বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে পারে৷ হঠাৎ রমেনের চোখ গেল সুপারি গাছের নিচে সেখানেও অস্পষ্ট পদচিহ্ন বর্তমান৷ সুপারি গাছটি ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখা গেল গাছের ছালে ঘর্ষণের দাগ৷ অর্থাৎ কেউ গাছে উঠলে তার পোষাকের ঘর্ষনে যেমন দাগ হয় তেমন৷ রমেন এগুলোর ছবি তুলে নিয়ে দেবকুমার বাবুকে ফোন করে বললো, “আপনি যদি দয়া করে নারায়ণ বাবুর বাড়িতে একটু আসেন তাহলে ননীবালা দেবীর ঘরটি একটু দেখা যেত৷”

“একটু অপেক্ষা করো ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমি পৌঁছে যাচ্ছি, দেবকুমার বাবু বললেন৷

রমেন বললো, “দেবকুমার বাবু আসবেন কিছুক্ষন পরে ততক্ষণে চল একটু চারপাশটা বেড়িয়ে আসি৷”

কাজেই ব্যস্ত হয়ে রাজু বললো, “চল আগে টিফিন করে নেই৷”

রমেন বললো, “সে হবেখন, এখন চল৷” তারপর দু’জন পার্শ্ববর্তী স্থান একটু ঘুরে, একটা চায়ের দোকানে চা, বিস্কুট খেয়ে রাজুর বাড়িতে ফিরে আসার পথ ধরলো৷ এমন সময় দেবকুমার বাবুর ফোন এলো রমেনের কাছে৷ তিনি চলে এসেছেন, তাই দু’জন দ্রুত পা চালিয়ে রাজুর বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো।

বাড়ি ফিরে দেখে রাজুর বাবা নারায়ন বাবুর সাথে বাগানে বসে কথা বলছেন দেবকুমার বাবু৷

রাজু তার বাবার সাথে রমেনের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “বাবা রমেন মনে করছে পিসিমণি কে কেউ খুন করেছে৷

নারায়ন বাবু যেন চমকে উঠলেন, “খুন? আমার বাড়িতে খুন?”

দেবকুমার বাবু বললেন, “কি কারণে তোমার মনে হচ্ছে রমেন এটা খুন?”

রমেন বলল, “একটা কনফিউশন আছে, সেটা কেটে গেলে সব বলবো৷ এখনও পর্যন্ত শুধু অনুমান মাত্র৷ তাইতো আপনাকে ডাকলাম ননীবালা দেবীর ঘরের তল্লাশি নেওয়ার জন্য৷”

নারায়ন বাবু বললেন, “আমি তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমার বাড়িতে আমার বোন খুন হয়েছে৷ এমনিতে বেশিরভাগ সময় আমাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়৷ সেদিন রাতে একসাথে বসে ডিনারের সময় কত কথা বলছিলেন ননী৷”

রমেন বললো, “কাকু আপনি কি করেন?”

রাজু বললো, “বাবা ইতিহাসের গবেষক।”

দেবকুমার বাবু বললেন, “চলো রমেন ঘরটা দেখে আসি দু’জনে৷”

রাজু বললো, “আমি কি যেতে পারি?”

“ঠিক আছে আয়”, রমেন বললো৷

দেবকুমার বাবু দরজা খুলতেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো তিন জন। একটি বেডরুম, কিচেন ও বাথরুম নিয়ে ছোট্ট কিন্তু গোছালো একটা ঘর। বাথরুমের কমোড থেকে কাইলাইট এর (বাথরুমের উপরের ফাঁকা অংশ ) খুব একটা দূরত্ব নয়৷

রমেন বললো, “হীরের হার কোথায় আছে দেখতে হবে৷ রাজু আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, “এই বাক্সের মধ্যে থাকতে পারে৷”

দেবকুমার বাবু চাবি না পেয়ে রাজুর সাহায্যে বাক্সের তালা ভেঙ্গে দেখলেন ভিতরে হীরের হার নেই৷

রাজু বিস্ফারিত চোখে বললো, “হীরের হার কোথায় গেল?”

তিনজন মিলে ঘরের সমস্ত অংশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোন সন্ধান পেল না৷

দেবকুমার বাবু বললেন, “তোমার ধারণাই ঠিক৷ হীরের হারের জন্যই তাহলে খুন হয়েছে৷”

রমেন বললো, “আমি প্রথম থেকে এটাই অনুমান করছিলাম৷” হঠাৎ বিছানায় পড়ে থাকা বালিশটি তুলে রমেন ভালো করে দেখলো, তারপর ফোন বের করে বালিশের ছবি তুলে নিয়ে রমেন বলল, “দেবকুমার বাবু আপনি আগামি কাল ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলেই চলে আসবেন৷ আমি আপাতত এখানেই আজ থাকবো৷ হীরের হার চুরির ব্যাপারটা যেন বাড়ির কেউ না জানতে পারে৷ সেই কারণে আমাদের সাবধান থাকতে হবে৷ যদি জানা জানি হলে খুনি সতর্ক হয়ে যাবে, চুরির কথা যেন প্রকাশ্যে না আসে৷” দেবকুমার বাবু সম্মতি দিয়ে থানায় চলে গেলেন৷

রমেন বললো, “হারটি কেমন ছিল জানতে পারলে ভালো হত৷”

“আমার ফোনে হীরের হারের ছবি আছে৷ হবে?”

রমেন উত্তেজিত হয়ে বললো, “হ্যাঁ, হবে৷ কই দে তো দেখি৷”

রমেন ছবিটা ভালো করে দেখতেই তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো৷ সঙ্গে সঙ্গে কাকে একটা ফোন করে বললো, “একটা ছবি পাঠাচ্ছি, বিস্তারিত বর্ননা চাই৷”

“এবার চল তোদের বাড়ির সবার সঙ্গে পরিচয় ও জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব সেরে আসি৷ প্রথমে তোর ছোটকাকু নবকান্ত বাবুর সঙ্গে দেখা করবো৷” নবকান্ত বাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল তিনি চেয়ারে মনমরা হয়ে বসে আছেন৷

“আসতে পারি?”

নবকান্ত বাবু বললেন, “কে?”

রাজু বললো, “আমার বন্ধু রমেন, তোমার সঙ্গে পরিচয় করতে এলো৷”

“আসুন।” নবকান্ত বাবু বললেন৷

এরপর রাজু বললো, “পিসিমণির মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য এসেছে৷”

“আমি আবার কি করলাম? যে কারণে আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? তাছাড়া এটা স্বাভাবিক মৃত্যু৷”

“আমার বন্ধু রমেন মনে করছে এটা খুন, স্বাভাবিক মৃত্যু নয়৷”

রমেন বললো, “ঘটনার দিন রাতে আপনি ক’টার সময় ঘুমিয়েছেন?”

নবকান্ত বাবু বললেন, “রাতে সবাই একসাথে খাওয়ার পর যে যার রুমে চলে যায়, আমিও আমার রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে দেখি এই অঘটন৷”

“আচ্ছা ননীবালা দেবীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?” রমেন বললো৷

একটু অস্বস্তি বোধ করে নবকান্ত বাবু বললেন, “কেন ভাই বোনের সম্পর্ক যেমন হয় তেমন।”

রমেন বললো, “আমি তো শুনেছি আপনি ননীবালা দেবী কে একটু অন্য চোখে দেখতেন, বোন বলে মানতেন না৷ আপনার উদ্দেশ্য ছিল তাকে বিয়ে করা৷ কিন্তু ননীবালা দেবী অস্বীকার করায় আপনি বিভিন্ন সময়ে জোর করে ননীবালা দেবীর সঙ্গে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করতেন৷ যেহেতু ননীবালা দেবী আপনাকে দাদা হিসেবেই মানতো তাই আপনার আশা পূরণ না হওয়ায় আপনি তাকে খুন করেছেন৷” এই সমস্ত কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনুসন্ধিৎসু চোখে বাড়িটার দিকে নজর দিতে থাকে রমেন৷

কথাগুলো শুনে রাগে চোখ দু’টো আগুনের মত জ্বলে উঠলো নবকান্ত বাবুর৷ তিনি বললেন, “মুখ সামলে কথা বলবেন৷ এই মুহুর্তে আপনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, না হলে খারাপ হবে৷”

“আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু যাওয়ার আগে আপনার বাড়িটা একটু সার্চ করতে চাই, তাতে নিশ্চয়ই আপনার অসুবিধা হবে না?”

নবকান্ত বাবু নীরব থাকলেন৷

রমেন প্রথমে নবকান্ত বাবুর জুতো জোড়া ভালো করে দেখে ফোনে ছবি তুলে নিয়ে, চুরি যাওয়া হিরে কোথাও লুকানো আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলো৷ তারপর বলল, “চল রাজু এখন যাই প্রয়োজনে পরে আবার আসবো।”

নবকান্ত বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রমেন বললো, “রাজু এবার তোর মেজো কাকুর রুমে চল একটু ঘুরে আসি৷”

রাজু বললো, “মেজো কাকু সম্ভবত দোকান যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছেন৷”

“দোকান? কিসের দোকান? কোথায়? ”

রাজু বললো, “কাঁথির সুপার মার্কেটে কাকুর সোনার দোকান আছে৷”

“সোনার দোকান আছে? আচ্ছা চল৷”

যখন তারা পৌঁছায় তখন নরেন্দ্র বাবু দোকান যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে জল খাবার খাচ্ছেন৷

রাজু বললো, “কাকু আমার বন্ধু রমেন পিসিমণির মৃত্যু সংক্রান্ত কিছু কথা বলতে চায়৷ রমেনের ধারনা পিসিমনির মৃত্যু স্বাভাবিক নয়৷”

নরেন্দ্র বাবু যেন আঁতকে উঠলেন, “খুন? ননী খুন হয়েছে?”

রমেন বললো, “প্রাথমিক ভাবে সেটাই অনুমান করছি, তবে আগামীকাল ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে৷”

“আচ্ছা আপনি ঘটনার দিন রাতে কোন কিছুর আভাস পেয়েছিলেন?”

“না, তেমন কিছু তো বুঝতে পারিনি৷ রাতে সবাই একসাথে ডিনার করার পর যে যার ঘরে চলে গেলে আমিও আমার রুমে এসে ঘুমিয়ে যাই৷ সকালে উঠে দোকানে যাওয়ার পরে ননীবালার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমি দ্রুত বাড়ি ফিরে আসি৷”

কথা বলতে বলতে রমেনের অনুসন্ধিৎসু চোখ পরখ করে নিচ্ছে বাড়ির আনাচে-কানাচে, এমনকি জুতো জোড়াও বাদ গেল না৷ যেহেতু নরেন্দ্র বাবুর দোকানে যাওয়ার তাড়া আছে তাই রমেন বললো, এখন যাচ্ছি আপনি ফ্রি থাকলে পরে আবার আসব৷ আপনার কোন সমস্যা নেই তো?”

নরেন্দ্র বাবু বললেন, “না না, আপনি আবার আসবেন৷”

নরেন্দ্র বাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে রমেন বললো, “চল তোদের ঘর থেকে ঘুরে আসি৷”

রাজু বললো, “আমাকেও তুই সন্দেহ করছিস নাকি?”

রমেন বললো, “আমার সন্দেহের বাইরে এখন কেউ নয়৷ চল তোর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি৷”

রাজু তাদের কক্ষে নিয়ে গেল৷ পাশাপাশি দু’টি রুম, একটিতে রমেন অপরটিতে তার মা ও বাবা থাকেন৷

রমেন সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে খুজে দেখল৷ রাজুর বাবা, মা বাইরে ছিলেন তাই রমেনের অনেক সুবিধা হল৷ কিন্তু হারের সন্ধান পেল না৷ রমেন নারায়ন বাবুর জুতো জোড়া অনেক্ষন দেখে ফোনে ছবি তুলে নিল৷ তারপর পালঙ্কের নিচে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিয়ে দেখল একটি ট্রাউজার৷ ট্রাউজার টি হাতে তুলে নিয়ে রমেন দেখলো তাতে হালকা সবুজ কিছু লেগে আছে৷ তাড়াতাড়ি ফোনে ছবি তুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় রাজুর বাবা ও মা বাড়িতে প্রবেশ করলো৷ মায়ের সঙ্গে রমেনের পরিচয় করে দিল রাজু৷ তারপর রমেন বেরিয়ে এলো তার ঘর থেকে৷ রাজুর ঘরের সামনের অংশে তার দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতিসৌধ অবস্থিত৷ তাতে কাচের মধ্যে ফুলদানিতে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত৷ বেশ ভালো লাগছে দেখে৷ কিন্তু ফুলদানিগুলো ভালো করে দেখে রমেনের কোথায় যেন একটা বেমানান লাগলো৷ তাই তাড়াতাড়ি ফোন বের করে একটা ছবি তুলে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল৷

বিকাল 4 টা নাগাদ পাশের রেললাইনে বেড়াতে গেল তারা৷ ঘাসফুলের মাঝে রেলের পাতের উপর বসে দুজন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করল৷ একসময় রাজু বললো, “তুই কিছু অনুমান করতে পারলি?”

রমেন বললো, “তোকে বাদ দিয়ে এই বাড়ির সবারই খুন করার মোটিভ আছে৷” রাজুর মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল৷

রমেন বলল, “যেই খুন করুক না কেন তোর বাড়ির মধ্যেই খুনি আছে৷ অর্থাৎ সে তোর আপন জন৷ যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তোকে প্রস্তুত থাকতে হতে পারে, যদি তুই তোর পিসিমণির হত্যাকারীকে সাজা দিতে চাস৷ তাছাড়া তোর কথাতেই আমি এখানে এসেছি, তাই আমি চাই তুই যেন ফলাফল দেখে পিছিয়ে না আসিস৷”

রাজু সম্মতি দিয়ে বলল, “ফলাফল যাই হোক আমি তোর পাশে থাকবো৷”

সূর্যদেব অস্ত গিয়ে যখন সন্ধ্যা আসন্ন তখন রমেন বললো, “বাড়ি চল অনেক কাজ আছে৷”

রাতের ডিনার টেবিলে বাড়ির সবাই একসাথে রাতের আহার এর সময় নানা প্রসঙ্গ আলোচনা করতে লাগলো৷ রাজু ছাড়া তেমন কেউ ননীবালা দেবীর জন্য দুঃখ, কষ্ট পেয়েছেন বলে রমেনের মনে হলো না৷ যেন বাড়িতে কিছুই হয়নি, এর একটা কারণ হতে পারে ননীবালা দেবী ছিলেন দত্তক কন্যা। এমন সময় নারায়ন বাবু বললেন, “রমেন কিছু তথ্য পেলে নাকি?”

রমেন বললো, “ননীবালা দেবীর বাড়ির আশেপাশে খুনি কিছু ক্লু ছেড়ে গেছে৷ কাল সকালে পুলিশ এলে হাতে নাতে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে৷”

ডিনারের পর রাজু রমেন কে বললো, “গেস্ট রুমে একা রাত কাটাবি? নাকি আমার সাথে রুম শেয়ার করবি?”

রমেন বললো, গেস্ট রুমে আজ আমরা দু’জন একসাথে থাকব৷ রাতে অনেক ঘটনা ঘটতে পারে তাই আমাদের রাত জাগতে হবে৷

গেস্ট রুম থেকে ননীবালা দেবীর ঘরটি স্পষ্ট দেখা যায়৷

রমেন রাজুকে বললো, তুই চেয়ার নিয়ে জানালার কাছে বসে থাক৷ আমি সারাদিনের সমস্ত ঘটনা নিয়ে একটু চিন্তা করি৷

রাজু সম্মতি জ্ঞাপন করে নাইট বাল্ব জ্বালিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে, জানালার পাশে বসে ননীবালা দেবীর ঘরের দিকে তাকিয়ে রইল৷ রমেন ঘুরতে থাকা পাখার দিকে চেয়ে নিশ্চুপ হয়ে ঘটনাগুলো স্মরণ করতে লাগলো৷ রাত একটা নাগাদ রাজু বলল, “রমেন ঘুমিয়ে গেলি নাকি?”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, “না৷”

“তুই কিছু দেখতে পেলি নাকি রাজু?” রমেন বললো৷

রাজু উত্তর দিল, “না৷”

“এখন তো সবে রাত একটা, আরও এক-দেড় ঘন্টা অপেক্ষা কর৷” এরপর সকাল থেকে মোবাইল ফোনে তোলা ছবিগুলো মনোযোগ সহকারে বিশ্লেষণ করতে লাগল রমেন৷ রাত আড়াইটা পর্যন্ত এইভাবে চলার পর রাজু ফিসফিস করে বললো, আজ আর কিছু হবে না চল ঘুমিয়ে পড়ি৷

রমেন ফোন রেখে একটা চেয়ার নিয়ে জানালার কাছে এসে বললো, “যা ঘটার আর তিরিশ মিনিটের মধ্যেই আশা করি ঘটবে৷ দরজা খোলা রেখেছিস তো?”

“হ্যাঁ! কিন্তু কারণটা কি?”

“দরজা খোলা থাকলে বেরোনোর সময় শব্দ হবে না৷”

রাত পৌনে তিনটা, এমন সময় একটা খসখস শব্দে রাজু ও রমেনের মনঃসংযোগ ফিরে এলো৷ সম্ভবত শুকনো পাতাতে কেউ পা দেওয়ার ফলে এমন শব্দ হয়েছে৷ এমন সময় নবকান্তবাবুর বাড়ির সামনে একটা মৃদু আলো দেখা গেল৷ আলোটি ধীরে ধীরে ননীবালা দেবীর ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো৷ ননীবালা দেবীর বাড়ির সামনের বাগানের কাছে আলোটি যেতেই খুট করে আবার একটা দরজা খোলার শব্দ হল৷ সাথে সাথে মৃদু আলোটা নিভে গেল৷ এবার দেখা গেল রাজুর বাড়ির দরজা খুলেছে, দরজার ফাঁক দিয়ে এক ফালি আলোর রেখা বাইরে স্মৃতিসৌধের কাঁচের উপর পড়ে চকচক করছে৷ ক্ষণিকের মধ্যে আলোর রেখা মিলিয়ে যাওয়ার পরে আবার একটি মৃদু আলো ননীবালা দেবীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল৷

রমেন ফিসফিস করে বললো, “এবার চুপিচুপি বাইরে বেরিয়ে চল৷”

উত্তেজনায় দ্রুত ঘর থেকে বেরোনোর সময় রাজুর হাত লাগলো দরজায়৷ সঙ্গে সঙ্গে ধড়াস করে একটা শব্দ হলো৷ রমেন ফিস ফিস করে বলল, “একি করলি তুই? সব চেষ্টা বিফলে গেল আমার৷”

তবুও দু’জন বাইরে গিয়ে গাছের আড়ালে বসে থাকল অনেকক্ষণ কিন্তু আর কারোর অস্তিত্ব অনুভব করা গেল না৷ রাত চারটার সময় গেস্ট রুমে ফিরে এলো দু’জন৷ কারো মুখে কোনো কথা নেই৷ রমেনের পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছিল অপরাধী, কিন্তু একটু অসাবধানতার কারণে হাতছাড়া হয়েছে৷ তাই রাজু নিজেকে অপরাধী ভেবে মুখ শুকনো করে বসে রইল৷

রমেন রাজুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “কষ্ট পাস না৷ আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ কাল সকালে সব কিছু বলবো৷ এখন ঘুমিয়ে পড়৷” রাজু কোনো কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল৷

সকাল আটটায় রাজুর ঘুম যখন ভাঙল দেখে রমেন খাতা, পেন নিয়ে কি সব হিজিবিজি রেখা টেনে যাচ্ছে৷

মাথা তুলে রমেন বললো, “ঘুম ভেঙেছে?”

রাজু শয্যা ত্যাগ করে বলল, “হুম। অনেক দেরি হয়ে গেল না রে!”

রমেন বললো, “তাড়াতাড়ি প্রাতঃক্রিয়া সেরে আয়, কথা আছে৷”

প্রাতঃক্রিয়া সম্পাদন করে রাজু রুমে প্রবেশ করতেই রমেন বলল, “বাইরে চল সবাই অপেক্ষা করছে৷”

রাজু বলল, “কারা অপেক্ষা করছে?”

“চল দেখতে পাবি৷”

রাজুকে নিয়ে ননীবালা দেবীর বাড়ির সামনের বাগানে উপস্থিত হল রমেন৷ রাজু হতভম্ব হয়ে দেখলো বাড়ির সবাই সেখানে উপস্থিত৷ রাজুর মা, বাবা, মেজো কাকু, কাকিমা ও ছোটকাকু৷ কারো মুখে কোন কথা নেই, সবাই চুপ৷ ভোরে উঠে রমেন সবাইকে বলে দিয়েছে, ‘কেউ যেন আজকে বাইরে না যায়, সবাই যেন বাড়িতে থাকে’৷

রমেন সবার উদ্দেশ্যে বললো, “দেবকুমার বাবু ফোন করেছিলেন, তিনি বারোটা নাগাদ ময়নাতদন্তের ফলাফল নিয়ে আসবেন৷ তখন সব পরিষ্কার হয়ে যাবে ননীবালা দেবীকে খুন করা হয়েছে নাকি তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ আমি জানি ননীবালা দেবীকে খুন করা হয়েছে৷”

নরেন্দ্র বাবু বললেন, “কে খুন করেছে ননীবালা কে?”

রমেন বললো, “সেই কথা বলার জন্য আমি আপনাদের সবাইকে এখানে ডেকেছি৷ আমি পারতাম দেবকুমার বাবুকে সঙ্গে নিয়েই এই কথা বলতে কিন্তু রাজু আমার কলেজ জীবনের বন্ধু, তার আমন্ত্রণে আমি এখানে এসেছি৷ প্রথমে আমি রাজুকে বলেছি সব রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে৷ কিন্তু এই বাড়ির মান-সম্মানের কথা ভেবে আমার ঠিক কি করা উচিত সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছি৷”

রমেন একটু থামল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করল, “দেবকুমার বাবুর কাছ থেকে পাওয়া ছবিগুলো দেখেই আমি বুঝেছিলাম ননীবালা দেবী কে খুন করা হয়েছে৷ দেবকুমার বাবু ঘটনাস্থলে তাড়াহুড়ো করেছেন বা ভালো ভাবে নজর না দেওয়ার জন্য মিস করে গেছেন৷ ননীবালা দেবী বিছানাটা ছিল লন্ডভন্ড অর্থাৎ ধস্তাধস্তির ফলে এমন হয়েছে৷ তাছাড়া ননীবালা দেবীর মুখে হালকা তুলোর অস্তিত্ব রয়েছে যেটা বালিশ থেকে লেগেছে বলে অনুমান করছি৷ বালিশে হালকা গোলাপি রঙের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, ফরেনসিকে পাঠালে প্রমাণ হয়ে যাবে সেটা ননীবালা দেবীর লিপস্টিকের অংশ বিশেষ৷ যেখান থেকে অনুমান করা যায় মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে তাঁকে খুন করা হয়েছে৷ ননীবালা দেবীর বাড়ির জানালার কাছে রজনীগন্ধা গাছের নিচে মাটিতে পদচিহ্ন পাওয়া গেছে৷ বাথরুমের কাইলাইটের (বাথরুমের উপরে ফাঁকা অংশ ) কাছে যে সুপারি গাছটি আছে সেই গাছের নিচে পায়ের দাগ ও সুপারি গাছে ওঠার ঘর্ষণের দাগ পাওয়া গেছে৷ খুব সহজেই সুপারি গাছ দিয়ে বাথরুমের উপরের ফাঁকা অংশ দিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করা যায়৷ খুনি সেই জায়গা দিয়ে প্রবেশ করে খুন করেছে৷ আমি প্রথমে মোটিভ নিয়ে ভাবতেই দেখলাম আপনাদের তিন ভাই এর এই মৃত্যুতে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ নবকান্ত বাবু ননীবালা দেবী কে বোনের চেয়ে প্রেমিকা হিসাবে বেশি পছন্দ করতেন৷ বার বার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি খুন করতে পারেন৷ নরেন্দ্র বাবু যেহেতু সোনার ব্যবসায়ী, তাই হীরের হারের লোভে খুন করতে পারেন৷ আপনারা জানলে অবাক হবেন ননীবালা দেবীর হীরের হারটি চুরি গেছে৷

সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, “হীরের হার চুরি গেছে?”

রমেন বললো, “হ্যাঁ! আমি দেবকুমার বাবু ও রাজু কে বারণ করেছিলাম হীরে চুরির কথা প্রকাশ করতে৷ জানা জানি হলে হীরে পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল৷ নারায়ন বাবু যেহেতু ইতিহাসের গবেষক তাই তিনি ভালো করেই জানেন আকবরের সমসাময়িক এই হারের ঐতিহাসিক মূল্য কতখানি৷ আমি এই হারের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছি আন্তর্জাতিক বাজারে এই হীরের হারটির গুরুত্ব যথেষ্ট। তাই তিনজনের মধ্যে থেকে আসল খুনি কে সেটা বের করা খুব কঠিন ছিল৷ একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম খুনি এই পরিবারের কেউ হবে৷ তাই ডিনার টেবিলে আমি বলেছিলাম খুনি একটা ক্লু ছেড়ে দিয়ে এসেছে, আমি জানতাম খুনি রাতে অবশ্যই ঘটনাস্থলে তার ফেলে আসা ক্লু টাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যাবে৷ কিন্তু আমি আরও হতবাক হয়ে যাই ঘটনাস্থলে দু’জন ব্যাক্তির অস্তিত্ব দেখে৷ গুলিয়ে ফেলেছিলাম দু’জনের মধ্যে একজন খুনী নাকি যৌথভাবে খুন করেছে৷ কিন্তু মোবাইল ফোনে তোলা ছবিগুলো ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর আসল হত্যাকারী কে ধরতে পেরেছি৷ নারায়ন বাবু ও নবকান্ত বাবু ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন আমাকে৷”

রমেন বলতে থাকলো, “সেদিন রাতে নবকান্ত বাবু জানালার কাছে ননীবালা দেবী কে পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব দিতে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু ননীবালা দেবী রাজি হচ্ছিলেন না, এমন সময় নারায়ন বাবু ঘর থেকে বেরিয়ে নবকান্ত বাবুকে সম্ভবত দেখতে পান, জানালার পাশে ননীবালা দেবীর সঙ্গে কথা বলতে৷ তিনি আড়ালে লুকিয়ে রইলেন৷ যখন নিরুপায় হয়ে নবকান্ত বাবু মনের দুঃখে তার ঘরে ফিরে গেলেন, তার অনেক সময় পরে নারায়ন বাবু সুপারি গাছ বেয়ে বাথরুমের কাইলাইট (বাথরুমের উপরের ফাঁকা অংশ) দিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেন৷ সম্ভবত নারায়ন বাবুর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হীরের হারটাকে চুরি করা, খুন করার ইচ্ছা ছিল না৷ কিন্তু ননীবালা দেবীর কাছে হাতে নাতে ধরা পড়ে যাওয়ায়, চুরির অপবাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, বাধ্য হয়েই ননীবালা দেবীর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে, শ্বাসরোধ করে খুন করেছেন৷ আমি নবকান্ত বাবু ও নারায়ন বাবুর জুতোতে হালকা মাটির দাগ দেখেছি৷ কারন সেই দিন বাগানে জল দেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু নারায়ন বাবুর ট্রাউজারে সুপারি গাছের ছালের হালকা সবুজ অংশ লেগে থাকতে দেখেই, পুরো ঘটনাটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়৷ সুপারি গাছ দিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করার সময় গাছের ছালের অংশটা ট্রাউজারে লেগেছে৷ আমি রুম পরিদর্শনের সময় সেই সবুজ অংশ দেখেছি ট্রাউজারের মধ্যে লেগে থাকতে৷ আশাকরি নারায়ন বাবু অস্বীকার করবেন না৷ কারন আমার কাছে সমস্ত প্রমাণ আছে৷”

সঙ্গে সঙ্গে নারায়ন বাবু মুখ নিচু করে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন৷ বললেন, “আমি খুন করতে চাইনি৷ আমি গলা থেকে হীরের হারটি খোলার সময় নাইট বাল্ব এর আলোতে সে আমাকে চিনে ফেলে৷”

“দাদা তুমি এত রাতে আমার ঘরে? হার চুরি করতে এসেছ?”

“এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বাচানোর জন্য আমি তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেছি৷ তারপর থেকে আমার হৃদয় যন্ত্রণায় ছটফট করছে৷ আমি এ কী করলাম! কিন্তু নিজের মুখে স্বীকার করতে পারছিলাম না৷ রাজু পুলিশকে ও তোমাকে খবর না দিলে মৃত দেহ সৎকার করে দিতাম৷ পরিবারের মান-সম্মান নষ্ট হতে দিতে চাইছিলাম না৷”

রাজু বললো, “তবে হীরের হার টি কোথায়?”

রমেন বললো, “তোর দাদু-ঠাকুমার স্মৃতিসৌধে যে ফুলদানি গুলো আছে তাদের একটার মধ্যে হীরের হারটি লুকানো আছে৷”

নারায়ন বাবু অবাক হয়ে বললেন, “তুমি সেটাও জেনে ফেলেছো?”

রমেন বললো, “সমস্ত ফুলদানি গুলো কাঁচের মধ্যে থাকলেও অল্প ময়লা, ধুলো লেগেছিল৷ কিন্তু তাদের মধ্যে একটাতে দেখেছিলাম কয়েকটা আঙ্গুলের দাগ এবং ফুলদানি থেকে ফুল বের করার চিহ্ন স্পষ্ট৷ তাই অনুমান করতে অসুবিধা হয়নি হীরের হারটি কোথায় আছে৷”

রাজু সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ফুলদানির মধ্য থেকে হারটি বের করে নিয়ে এলো৷ সবাই চুপ, কারও মুখে কোন কথা নেই৷ নবকান্ত বাবুর হৃদয় ভেঙেছে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল৷

রাজু বললো, “এবার করণীয়?”

রমেন বললো, “আমি চাই না এই ব্যাপারটা পুলিশের কানে যাক। আমি এখনই এগরা ফিরে যাচ্ছি৷ পুলিশ তার মতো তদন্ত করুক৷ আশা করি ধরতে পারবে না৷ আমি না হয় আমার বন্ধুর জন্য একটা মিথ্যা কথা পুলিশকে বলবো যে খুনটা বাইরের কেউ করেছে৷”

সবাই নিশ্চুপ হয়ে রমেনের দিকে তাকিয়ে রইলো।

“আমি এখন চলি, রাজু চল, আমায় বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে আসবি৷”

সমাপ্ত

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মুখোশ| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | শুভাশীষ রায়| Bengali Detective Story
Next post অনন্ত আর আটশো আট| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | সায়ণী ঘোষ| Bengali Detective Story