বাঃ! অফিসটা দিব্যি বানিয়েছ তো।” কথাটা বলে সামনের সোফাটায় গা এলিয়ে দিলাম।
দাদু টেবিলের ওধারে রিভলবিং চেয়ারে বসে কী একটা ইংরাজি বই পড়ছিলেন। আমার গলা শুনে বইটা বন্ধ করে বললেন, “ও, তুই এসে গিয়েছিস। কিছু খাবি?”
“না।” দু’দিকে মাথা নেড়ে বললাম, “কখন আসবে তোমার মক্কেল?”
দাদু একবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, “বলেছে তো সাড়ে পাঁচটা।”
আমার নাম অলিভিয়া। ক্লাস নাইনে পড়ি। আর আমার দাদু হলেন সাগর রায়। ছ ফুট লম্বা। প্রতিদিন নিয়ম করে যোগব্যয়াম করেন। এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও রীতিমত টান টান শরীর। ত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করার পর রিটায়ার করে কয়েক মাস হল পার্কস্ট্রীটে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসেছেন।
দাদুকে দু’একবার জিজ্ঞেস করেছি, “হ্যাঁ গো, তোমার কাছে কী রকম সব কেস আসে? মূর্তি চুরি, গয়না চুরি, খুন?”
দাদু বলেছিলেন, “তোর মত গর্দভরা অবশ্য তাই ভাববে। বেশিরভাগ কেসই আসে বিয়ের জন্য ছেলের বা মেয়ের হাঁড়ির খবর এনে দিতে হবে।”
আমার স্কুলে এখন গরমের ছুটি চলছে। বাড়িতে বসে বসে ভ্যারাণ্ডা ভাজছিলাম। হঠাৎ দাদু ফোন করে বললেন যে আজ বিকেলে ওঁর অফিসে চলে আসতে।
ক্লাস নাইনে পড়লেও আমি একা একাই স্কুলে যাই। নাকতলা থেকে পার্কস্ট্রীট আসাটাও এমন কিছু ব্যাপার নয়। সরাসরি মেট্রোতেই চলে আসা যায়।
ঠিক পাঁচটা চল্লিশে এক ভদ্রলোক দরজা ঠেলে মাথাটা বাড়িয়ে উঁকি মারলেন।
“নমস্কার। ভেতরে আসতে পারি?”
“আসুন আসুন।”
ভদ্রলোক অফিসে ঢুকে এলেন।
“বসুন। আমিই সাগর রায়।”
ভদ্রলোক গদগদ ভাব করে দাদুর সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লেন।
“আমার নাম গগন রায়। আমিই ফোন করেছিলাম আপনাকে।”
গগনবাবুর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। মাঝারি হাইট। রোগাটে শরীর। মাথায় চুলের পরিমাণটা বেশ কম। গোলগাল মুখ। পরে আছেন একটা নেভি ব্লু রঙের হাফহাতা শার্ট আর ডেনিম জিন্স।
“তারপর, মেট্রোয় আসতে কোনও অসুবিধা হয়নি তো?” দাদু আচমকাই কথাটা বললেন।
“না না। আপনি যেভাবে বলে দিয়েছিলেন-” তারপরই কথা থামিয়ে ভদ্রলোক বলে উঠলেন “আমি মেট্রোয় এসেছি, আপনি জানলেন কি করে?”
“আপনার বুক পকেটে মেট্রোর স্মার্ট কার্ডটা দেখা যাচ্ছে। সাধারণতঃ স্মার্ট কার্ড লোকে পার্সেই ঢুকিয়ে রাখে। একমাত্র ব্যবহার করলেই সেটা অনেক সময় আমরা বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখি।”
গগনবাবু এক গাল হেসে বললেন “অ্যাই। ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আপনিই পারবেন আমার সমস্যার সমাধান করতে।”
“চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু সমস্যাটা যদি আপনার ব্যবসা সংক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে কিন্তু আমি অপারগ।”
আবার ভদ্রলোকের চোখ গোল গোল হয়ে উঠেছে। “আমি ব্যবসা করি সেটা আপনি জানলেন কিভাবে?”
“যদি চাকরি করতেন তাহলে ছ’টার পর আমার সাথে দেখা করতে আসতেন। আর তাছাড়া আপনি কোনও ব্যাগ সঙ্গে আনেননি। চাকুরীজিবী হলে বুক পকেটে অন্ততঃ একটা পেন তো রাখতেন। তার মানে আপনার কোথাও একটা অফিস ঘর আছে। সেখানে ব্যাগ, পেন, জলের বোতল সব রাখা আছে। নিজস্ব ব্যবসার ক্ষেত্রেই সেটা সম্ভব।”
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ঠিকই ধরেছেন। বড়বাজারে একটা বড় শাড়ির দোকান আছে আমার। চালু দোকান। বিক্রি-বাট্টাও খারাপ হয় না। সমস্যাটা ওসব নিয়ে নয়।” একটু থেমে গগনবাবু বললেন “আমার বাবা হলেন যোগীন্দ্রনাথ মজুমদার। এই শ্রাবণে তিয়াত্তরে পড়বেন।” একটু থেমে গগনবাবু বললেন, “সমস্যাটা আমার বাবাকে নিয়েই। কদিন হল বাবা হুমকি চিঠি পাচ্ছেন।”
“হুমকি চিঠি? কিরকম?”
“এই ধরুন মাসখানেক হল উপদ্রবটা শুরু হয়েছে। এই নিয়ে চারবার হল। স্পিডপোস্টে একটা করে খাম আসছে। খামের মধ্যে একটা করে সাদা কাগজ। তাতে কম্পিউটার প্রিন্ট করে বড় বড় হরফে হুমকি লেখা থাকছে।”
“চিঠিগুলো সঙ্গে আছে?”
“ইয়ে, চিঠিগুলো তো সঙ্গে নেই তবে কী লেখা ছিল বলতে পারি। প্রথমটায় লেখা ছিল, ‘তোমার পাপের হিসেব হবে’। তারপরের চিঠিতে লেখা ছিল, ‘তোমার শাস্তি হল মৃত্যু’। তারপরের চিঠিতে লেখা ছিল, ‘এবারে মরার জন্য প্রস্তুত হও’। শেষ চিঠিটা এসেছে গত সোমবার। তাতে লেখা ছিল, ‘এবার তুমি মরবে’।
“আপনার বাবা আপনাদের সঙ্গেই থাকেন?”
“না না, আমাদের আদি বাড়ি মেদিনীপুরে। ‘মজুমদার বাড়ি’ বলে মেদিনীপুরে আমাদের কিছুটা নামডাকও আছে। আমার প্রপিতামহ ছিলেন ব্যারিস্টার। অগাধ পয়সা করে শেষ বয়সে শান্তিতে থাকবেন বলে মেদিনীপুরে এক পেল্লায় বাড়ি তৈরি করেন। আমার বাবাও ওকালতি করে বেশ ভাল পসার জমিয়েছিলেন। এখন অবশ্য আর প্র্যাকটিস করেন না।”
“বাড়িতে আর কে কে থাকেন?”
“আমার মা বহুদিন আগেই গত হয়েছেন। বাড়িতে বাবা ছাড়াও একটা সর্বক্ষণের চাকর, আমার খুড়তুতো ভাই প্রবাল আর আমার ভাগ্নে গোপাল থাকে। এছাড়াও একটি রান্নার লোক আর মালি থাকে। আগে আমি মেদিনীপুর থেকেই যাতায়াত করতাম। কিন্তু ক্রমশঃ বয়স বাড়ছে তো। ডেলি প্যাসাঞ্জারি আর সহ্য হয় না। তাই মাসখানেক হল কলকাতায় একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট কিনেছি। বিয়ে থা করিনি।”
দাদু ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “এ ব্যাপারে আমার কাছে কী সাহায্য চাইছেন?”
“ইয়ে বলছিলাম কী-” একটা গলা খাঁকারি দিয়ে গগনবাবু বললেন, “ক’দিন যদি আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে আসেন তাহলে আমি খুবই কৃতজ্ঞ হব। সেইসঙ্গে কে বা কারা এইরকম চিঠি লিখছে, কেন লিখছে, সেটাও তদন্ত করতে পারবেন। আমাদের বাড়িটা একদম কংসাবতী নদীর ধারেই। জায়গাটাও খুব সুন্দর। তদন্তের সাথে সাথে আপনার একটা উইক এণ্ড ট্যুরও হয়ে যাবে।”
আমার বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। দাদু এর আগে কোনও তদন্তে আমাকে সঙ্গে নেননি।
দাদু আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বললেন, “কি রে যাবি নাকি?”
আমি তো এক পায়ে খাড়া। লম্বা করে ঘাড় হেলিয়ে দিলাম।
দাদু গগনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিক আছে গগনবাবু, আমরা দু’জন যাব।”
গগনবাবু গদগদ মুখ করে বললেন, “কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব!”
“না না ঠিক আছে। তবে আমার মনে হয় তাড়াতাড়ি যাওয়াটাই ভাল। দেরি করে লাভ নেই।”
“আমিও তাই চাই। আজ তো বৃহস্পতিবার। তাহলে পরশু মানে শনিবার চলুন। সকাল আটটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে চলে আসব আমি। আর ইয়ে, এই যে আপনার পারিশ্রমিকটা।” গগনবাবু একটা খাম এগিয়ে দিলেন দাদুর দিকে। দাদু দেখলাম অম্লানবদনে খামটা জামার বুক পকেটে চালান করে দিলেন।
“২”
শনিবার সকাল সাতটাতেই বাবা আমাকে দাদুর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিলেন। পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে নিয়েছি। তিনদিন থাকব।
ঘরে ঢুকতেই দাদু বললেন, “গগনবাবু আসছেন না।”
“অ্যাঁ! সে কি?”
“ঘণ্টাখানেক আগে উনি ফোন করেছিলেন। কী একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে তাঁর। তাই উনি আমাদের সঙ্গে যেতে পারছেন না। অবিশ্যি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। মেদিনীপুরে ওঁর বাবা অর্থাৎ যোগীন্দ্রনাথবাবুকেও সব বলে রেখেছেন। গগনবাবু কাল সকালেই চলে আসবেন মেদিনীপুরে।”
“আমরা তাহলে কী করব? যাব আজকে?” বুকটা আবার ঢিপ ঢিপ করছে।
দাদু মোবাইলে কি সব খুট খাট করতে করতে বললেন, “গোয়েন্দাদের অত চক্ষুলজ্জা থাকতে নেই। আর তাছাড়া উনি তো কাল এসেই যাবেন।”
মেদিনীপুর টাউনে ঢুকতে ঢুকতে ঝাড়া সাড়ে চার ঘণ্টা লেগে গেল। মাঝখানে শুধু আধঘণ্টার জন্য কোলাঘাটের কাছে ‘শের-ই পাঞ্জাব’ ধাবাতে সকালের জলখাবার খাওয়া হয়েছে।
এর আগে গাড়িতে এত লম্বা জার্নি কখনও করিনি। গগনবাবু একটা মারুতি সুইফট গাড়ি পাঠিয়েছেন আমাদের জন্য।
‘মজুমদার বাড়ি’ দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল। কংসাবতী নদীর গা ঘেঁষেই বেশ বড় সড় দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। বাড়ির সামনে ফুল বাগান। আর বাগানের মাঝখান দিয়ে নুড়ি বিছানো প্যাঁচালো পথ।
যোগীন্দ্রনাথবাবুকে গগনবাবু আগে থেকে বলে রেখেছিলেন। ফলে আমরা পৌঁছতেই যোগীন্দ্রনাথবাবু বেশ খাতির করে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
যোগীন্দ্রনাথবাবুকে তিয়াত্তর বছর বয়স বলে মনেই হয় না। ছেলের মতই বাবারও মুখ গোলগাল। মাথা জোড়া টাক। রোগাটে শরীর।
আমরা বাড়ির একতলায় বৈঠকখানায় বসলাম। বাড়ির সাথে মানানসই বসার ঘর।
দাদু দু’হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, “আমি সাগর রায়। গগনবাবু আমাদের পাঠিয়েছেন।”
“গনুটা যে কী করে না! আমি কতবার বলেছি, ওটা এই পাড়ার ছোঁড়াগুলোর কীর্তি। আসলে ওদের ওই সরস্বতী পূজোয় বেশি চাঁদা দিইনি বলে মশকরা করছে।”
“তাই বলে একেবারে মেরে ফেলার হুমকি দেবে?”
“আরে আজকাল ছেলেমেয়েদের জানেন তো? সিনেমা দেখে দেখে গোল্লায় গেছে। সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।”
“বুঝলাম। কিন্তু-”
“একি আপনি কি ঘরে ঢুকেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করলেন নাকি?” দাদুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে যোগীন্দ্রনাথবাবু বলেলেন, “শুনুন অতিথি সেবাতে আমাদেরও কিছুটা সুনাম আছে। কলকাতা থেকে অনেক বড় বড় লোক এসে আমাদের বাড়িতে রাত কাটিয়ে গেছেন। আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি। স্নান খাওয়া সেরে আগে বিশ্রাম করে নিন। হুমকি চিঠি পালিয়ে যাচ্ছে না। কানু, যা তো, বাবুদের ঘরটা দেখিয়ে দে।”
একটা বছর পঞ্চাশেক লোক এসে আমাদের ব্যাগ দু’টো তুলে নিল। তাকে দেখিয়ে যোগীন্দ্রনাথবাবু বললেন “এ হল কানু। কানাই মণ্ডল। কিছু দরকার হলে একে বলবেন।”
আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে দোতলায়। একতলায় তিনটে ঘর আর দোতলায় পাঁচটা ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকের সবচেয়ে বড় ঘরটাতে থাকেন যোগীন্দ্রনাথবাবু। তার পাশের ঘরটা গগনবাবুর জন্য।
সিঁড়ির বাদিকের প্রথম ঘরটা দেওয়া হয়েছে আমাদের, বেশ বড়সড় দু’খানা খাট ছাড়াও একটা সোফা, টিভি, বড় বড় তিনটে জানলা রয়েছে। আমাদের ঘরের পাশেই প্রবালবাবুর ঘর।
কানু দু’টো জানলা খুলে দিয়ে গেল। জানলা খুলতেই চোখটা জুড়িয়ে গেল। কংসাবতী নদী দেখা যাচ্ছে।
“৩”
সরু চালের ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফিশ ফ্রাই, আর খাসির মাংস দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা হল ফার্স্ট ক্লাস। খাবার টেবিলে গগনবাবুর খুড়তুতো ভাই প্রবালবাবুর সাথে আলাপ হল। ইনি মাঝারি হাইটের হাসিখুশি মানুষ। মেদিনীপুরে বাস স্ট্যাণ্ডের কাছে একটা মনিহারি দোকান চালান প্রবালবাবু। দুপুরে ঘণ্টাদুয়েকের জন্য বাড়িতে খেতে আর একটু বিশ্রাম নিতে আসেন।
খাওয়ার পর বিছানায় শুতেই চোখে নেমে এল একরাশ ঘুম। চোখ বোজার আগে দেখলাম দাদু কোথায় যেন বেরুনোর তোরজোর তোড়জোড় করছেন। বললেন, “চারপাশটা একটু ঘুরে আসি, বুঝলি?”
ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা পড়ে গেছে। যথারীতি দাদু ঘরে নেই। বিছানা ছেড়ে উঠে ভাবছি কী করা যায়, এমন সময় দাদু ঘরে এসে ঢুকলেন। হাতে কতকগুলো কাগজ। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “কি রে ঘুম হল?”
“হুম। তোমার হাতে ওগুলো কী? হুমকি চিঠি?”
“হ্যাঁ।”
“কই দেখি?”
দাদু হাত বাড়িয়ে কাগজগুলো এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
চারটে বড় বড় এ ফোর সাইজের ফুলস্কেপ পেপার। কম্পিউটার প্রিণ্ট করে হুমকির কথাগুলো লেখা।
ভাল করে খুঁটিয়ে কাগজগুলো দেখে ফেরত দিলাম দাদুকে। “কিছু বুঝলে এগুলো থেকে?”
“কাগজগুলো থেকে কিছু বোঝা যাবে না। বোঝা যাবে এইগুলো থেকে।” দাদুর হাতে চারটে খাম। দাদু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খামগুলো দেখে খানিকটা নিজের মনেই বললেন, “খামের উপর ঠিকানাগুলোও লেখা হয়েছে টাইপ করে। তার মানে হাতের লেখা একদমই প্রমাণ করতে চায় না। আর সব চিঠিগুলোই স্পিড পোস্ট করা হয়েছে মেদিনীপুর হেড পোস্ট অফিস থেকে।”
“তার মানে এখানকার লোক।”
দাদু কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে চেয়ে থেকে বললেন, “আশপাশের লোকেদের কিন্তু মজুমদার বাড়ি সম্বন্ধে বেশ সম্ভ্রমই আছে। পাশের ক্লাবের ছেলেগুলো যোগীন্দ্রনাথবাবুকে ভালই শ্রদ্ধা করে। যোগীন্দ্রনাথবাবু ক্লাবে নিয়মিত চাঁদা দেন, এবং সেটা খুব কম অংকের নয়।”
“ওঃ তুমি দুপুরবেলা বুঝি এইসব তথ্য জানতে গিয়েছিলে?”
“ইয়েস ম্যাম।”
“তাহলে পাড়ার ছেলেরা হুমকি চিঠিগুলো লেখেনি বলছ?”
“মনে হয় না।”
“তাহলে কে লিখতে পারে?”
“সেটা বুঝতে পারলে তো দুপুরে তোর মত নাকে সর্ষের তেল ঢেলে ঘুমোতাম।” কথাটা বলে উঠে পড়লেন দাদু।
সন্ধ্যেবেলাটা যোগীন্দ্রনাথবাবুর সঙ্গে গল্প করে কাটল। গগনবাবুর ভাগ্নে গোপালের সঙ্গেও আলাপ হল। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। সুঠাম চেহারা। পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশন করে এখন বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। গোপাল একটু চুপচাপ ধরণের। এই বাড়ির সবকিছু দেখাশোনা সেই করে। আমাদের উল্টোদিকের ঘরটা তার। হুমকি চিঠির ব্যাপারে তারও মত হচ্ছে কেউ বদমায়েশি করেই এটা করেছে।
যোগীন্দ্রনাথবাবু মেদিনীপুরের ইতিহাস শোনাচ্ছিলেন। ১৭৫৭ সালে নাকি মারাঠা বর্গীদের খুব অত্যাচার ছিল। বর্গী সর্দার ভোঁসলে বর্ধমান অবধি চলে গিয়েছিলেন। তখন সিরাজ দৌল্লার দাদু আলিবর্দি খাঁ’র সাথে খুব যুদ্ধ হয় বর্গীদের। বর্গীরা তাতে হেরে গিয়ে চম্পট দেয়। বর্গীরা পালিয়ে এসে এই মেদিনীপুরেই প্রথম ডেরা তৈরি করে।
“কাল একবার সময় করে এখানকার ‘জোড়া মসজিদ’, নতুন বাজারে ‘কালী মন্দির’ দেখে আসবেন।” যোগীন্দ্রনাথবাবু বলেছিলেন।
আরও কিছুক্ষণ গল্প করে উঠে পড়লাম আমরা। প্রায় রাত সাড়ে দশটা বাজে।
অবিশ্যি একটা কথা বলা হয়নি। গগনবাবুর বেশ দায়িত্বজ্ঞান আছে। মাঝে মাঝেই ফোন করে আমাদের খবর নিয়েছেন। আর প্রত্যেকবারই অত্যন্ত দুঃখপ্রকাশ করেছেন আমাদের সঙ্গে না আসার জন্য। ঘণ্টাখানেক আগেও একবার ফোন করেছিলেন। বললেন কাল সকালের ট্রেনেই চলে আসবেন।
বিছানায় শুয়ে আমি বললাম, “আচ্ছা দাদাই হুমকি চিঠি নিয়ে তো এঁদের কোনও চিন্তাই নেই দেখছি। শুধু গগনবাবুই যা চিন্তিত।”
“ছেলে তো। বাপের জন্য চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে – ”
দাদু থেমে গেলেন। দাদুর গলা ছাপিয়ে আর একটা গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যোগীন্দ্রনাথবাবুর গলা। বেশ জোর গলায় কাউকে ধমকাচ্ছেন। “তোমায় আর টাকা দিতে পারব না। ভেবেছ কি? প্রত্যেকবার টাকা নিয়ে ফূর্তি করা? ভাবছ আমি কিছু জানি না?”
“ঠিক আছে। টাকা দিতে হবে না। সম্পত্তিতে আমার যা ভাগ, তাহলে সেটা আমায় দিয়ে দিন।” প্রবালবাবুর গলা।
“ভাগ চাইছ? অকৃতজ্ঞ? তোমায় লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার এই পরিণাম?” একটু থেমে গেলেন যোগীন্দ্রনাথবাবু। “ঠিক আছে, বাড়িতে এখন বাইরের লোক আছে। তাঁরা চলে গেলে আমি এ ব্যাপারে কথা বলব।”
প্রবালবাবুকে দেখলে যতটা ভাল মানুষ বলে মনে হয় ততটা তিনি নন তাহলে।
“৪”
আমি এমনিতেই লেট রাইজার। তাছাড়া নতুন জায়গা বলে অনেক রাত অবধি ঘুম আসেনি। তাই সকালবেলায় অঘোরে ঘুমোচ্ছিলাম। দাদুর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল আমার। দাদুর মুখ দেখেই বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে।
“যোগীন্দ্রনাথবাবু মারা গেছেন।”
“অ্যাঁ! সে কি?”
দাদু আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন। আমি ঝটপট উঠে চোখে মুখে একটা জলের ঝাপটা দিয়েই যোগীন্দ্রনাথবাবুর ঘরে গেলাম।
ভদ্রলোক দেখি খাটে শুয়ে আছেন। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন ঘুমোচ্ছেন। যোগীন্দ্রনাথবাবুর ঘরে এই প্রথম ঢুকলাম। ঘরটা বেশ বড়। একটা পুরনো দিনের পালঙ্ক ছাড়াও ঘরে আবলুশ কাঠের মানানসই ড্রেসিংটেবিল, আরামকেদারা আছে। খাটের পিছনেই একটা বড় আলমারি। আর সেটা খোলা।
খাটের পাশে গলায় স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে একজন বয়স্ক ডাক্তার দাঁড়িয়ে। কানু মেঝেতে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গোপাল ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে। খুব সম্ভবতঃ গগনবাবুর সাথে। কারণ দু’একবার মামা বলে সম্ভাষণ শুনলাম। প্রবালবাবু ছল ছল চোখে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন।
খাটের পাশে টেবিলের উপর কাঁচের একটা জাগ আর গ্লাস রাখা আছে।
রোজ সকাল ছটায় নিয়ম করে কানু যোগীন্দ্রনাথবাবুকে চা দেয়। আজ চা দিতে এসে দেখে যোগীন্দ্রনাথবাবু উঠছেন না। তখন কানু বাড়ির সবাইকে ডাকে। দাদু আগেই উঠে পড়েছিলেন। ঘরের বাইরে হইচই শুনে বেরিয়ে এসে দেখেন এই অবস্থা। দাদুই প্রবালবাবুকে বলেন ডাক্তার ডাকতে। প্রবালবাবু হাউস ফিজিশিয়ান ডক্টর মুখার্জীকে খবর দেন।
ডাক্তারবাবু স্টেথো ব্যাগে ভরতে ভরতে বললেন, “আমি ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারছি না। আপনারা কেউ পুলিশে খবর দিন।”
দাদু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন?”
“মনে হচ্ছে তীব্র কোনও বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন। কী বিষ, সেটা পোস্টমর্টেম না করলে বোঝা যাবে না।”
“কীভাবে বিষ শরীরে ঢুকল সেটা কি বোঝা যাচ্ছে?”
“উঁহু।” দু’দিকে মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু, “সেরিব্রাল হাইপোক্সিয়া অর্থাৎ সোজা কথায় মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবাহ বন্ধ হয়ে ততক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে। রাতের খাবারের সাথে মনে হয় না বিষ ঢুকেছে। কারণ এখনও রিগার মর্টিস হয়নি।”
“তার মানে বলছেন ভোরের দিকে মারা গেছেন।”
“তাই তো মনে হচ্ছে। তবে পোস্টমর্টেম না করলে ঠিক সময়টা বলা যাবে না।” কথাগুলো বলে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন।
দাদু বললেন, “আমি পুলিশে খবর দিয়ে দিচ্ছি। আচ্ছা গোপাল, গগনবাবুকে খবর দেওয়া হয়েছে? কতদূর আছেন উনি?”
“হ্যাঁ কথা হয়েছে। মামা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসে পড়বেন।”
“ঠিক আছে। যতক্ষণ না পুলিশ আসছে ততক্ষণ কেউ এই ঘরের কোনও কিছু ছোঁবেন না।” গম্ভীরগলায় কথাগুলো বললেন দাদু।
চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এলাম। যাঃ! সত্যি সত্যি ভদ্রলোককে খুন করল কেউ? তার মানে হুমকিগুলো ঠিকই ছিল?
কিন্তু এইভাবে বিষ দিয়ে খুন করবে কে? বাড়িতে তো শুধু কানু, গোপাল আর প্রবালবাবু। তাহলে কি বাইরে থেকে কেউ এল? কিন্তু বাইরের লোক বাড়ির ভিতর ঢুকবে কী করে?
হঠাৎ বুকটা ধড়াস করে উঠল। পুলিশ আবার আমাদের নিয়ে টানাটানি করবে না তো?
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গগনবাবু আর পুলিশ প্রায় একসাথেই এসে গেল। পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। তবে আমি যেটা ভয় পাচ্ছিলাম সেসব কিছুই হল না। পুলিশ ইন্সপেক্টর সুবোধ ঘোষাল ঘরে ঢুকে দাদুকে দেখে, “কেমন আছেন রায়দা” বলেই ঢিপ করে প্রণাম সেরে নিল। উনি নাকি দাদুর অধীনে বহুদিন চাকরি করেছেন।
পুলিশ মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল। পোস্টমর্টেম হবে। দাদু কেমন যেন গুম মেরে গেছেন। আমার বিশ্বাস যোগীন্দ্রনাথবাবুর মৃত্যুটা এতই অপ্রত্যাশিত যে দাদুর ক্যালকুলেশনে সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
দাদু গগনবাবুর ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
ভদ্রলোকের বেশ বিধ্বস্ত চেহারা। সোফায় চুপচাপ বসে আছেন। একটা গলা খাঁকারি দিয়ে দাদু বললেন “আপনার বাবা দরজা বন্ধ করে শুতেন না?”
“না।” দু’দিকে মাথা নাড়লেন গগনবাবু। “বয়স হয়েছিল বলে আমিই বলেছিলাম দরজা বন্ধ না করতে।”
“তাহলে তো যে কেউ ওঁর ঘরে ঢুকতে পারবে?”
“কী করে পারবে? বাড়ির বাইরের দরজা তো বন্ধ থাকে।”
“হুমম। রাত্তিরে দরজায় তালা কে দেয়?”
“রাত্তিরে গোপালই গেট বন্ধ করে তালা দিয়ে শুতে যায়। আর সকালে ওই তালা খুলে দেয়। রান্নার লোক আসে।”
একটু থেমে গগনবাবু হঠাৎ দাদুর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, “কিন্তু বাবাকে কি সত্যিই খুন করা হয়েছে? আমি এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না।”
“আপনাদের পারিবারিক ডাক্তারের তাই মত। আমারও সেরকম মনে হচ্ছে। যতদুর মনে হচ্ছে ওঁর খাবার জলে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়ে থাকবে। তবে কী বিষ, সেটা ফরেন্সিক রিপোর্টেই জানা যাবে। পুলিশ তো স্যাম্পেল নিয়ে গেছে। ও ভাল কথা, টাকা পয়সা কিছু চুরি গেছে কি? আলমারিটা দেখলাম খোলা।”
“জানি না বাবা আলমারিতে কত টাকা রেখেছিলেন? তবে আলমারিতে টাকা পয়সা কিছুই নেই।”
গগনবাবু আবার মাথা নিচু করে বসে পড়লেন। আমরা গগনবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে প্রবালবাবুর ঘরে গেলাম।
প্রবালবাবুকে তাঁর ঘরেই পেয়ে গেলাম।
“আসতে পারি?”
“ও হ্যাঁ। আসুন আসুন। কী যে হয়ে গেল!”
“শুনেছেন তো ডাক্তার সন্দেহ করছে খুন বলে।” গম্ভীর গলায় কথাটা বললেন দাদু।
“তাই তো শুনছি।”
“আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?”
দু’দিকে মাথা নাড়লেন প্রবালবাবু। “জ্যেঠুকে খুন করতে পারে এমন কারোর কথা তো মাথাতেই আসছে না।”
“খুন করার সুযোগ কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিল আপনারই। তাই না প্রবালবাবু?”
আশ্চর্য্য নার্ভ বটে প্রবালবাবুর। দাদুর এই বেমাক্কা প্রশ্নে এতটুকু ঘাবড়ালেন না। একটা স্মিত হাসি হেসে শুধু বললেন, “কী রকম?”
“বাঃ, আপনার জেঠু দরজা বন্ধ করে শোন না। এটা আপনি জানতেন। রাত্রিবেলা উঠে চুপি চুপি যোগীন্দ্রনাথবাবুর খাবার জলে বিষ মিশিয়ে দেওয়াটা কি আপনার পক্ষে খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার? আর তাছাড়া যোগীন্দ্রনাথবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটাও তো খুব ভাল ছিল না।”
“আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন।” মুখে একটা ডোণ্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে মোবাইল নিয়ে বসে পড়লেন প্রবালবাবু।
“আয় অলি।” বলে প্রবালবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দাদু। “চল গোপালের ঘর থেকে ঘুরে আসি একটু।”
দাদুর সাথে সাথে আমিও গোপালের ঘরে ঢুকলাম।
“কী হল গোপাল? কী করছ?”
“আসুন, কিছুই না। সব কেমন ওলট পালট হয়ে গেল।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গোপাল বলল।
“কে খুন করেছে বলে মনে হয়?”
“জানি না।” দু’দিকে মাথা নাড়ল গোপাল।
“আচ্ছা, আলমারিটা দেখলাম খোলা। কত কী চুরি হয়েছে কিছু বলতে পার?”
“মনে হয় না তেমন কিছু চুরি গেছে। উনি নিজের কাছে বেশি টাকা রাখতেন না।”
“হুমম। বুঝলাম।” বলে উঠে পড়লেন দাদু।
ঘরে ঢুকে দাদু শরীরটা এলিয়ে দিলেন বিছানায়। নিজের মনেই যেন বলছেন এইভাবে বললেন “ছকটা মিলছে না রে অলি। যোগীন্দ্রনাথবাবুকে খুন করার মত জোরালো মোটিভ কিছু পাচ্ছি না।”
“কেন প্রবালবাবু? যোগীন্দ্রনাথবাবুর সাথে তো ওঁর গণ্ডগোল ছিলই।”
“তা ছিল। তবে এই অবস্থায় যোগীন্দ্রনাথবাবু মারা গেলে ক্ষতিটা প্রবালবাবুরই। তিনি চলে যাবার পর সম্পত্তি ভাগ হত। আর আমার বিশ্বাস তাতে প্রবালবাবু একটা মোটা অংশ পেতেন।”
“তাহলে চাকরটা বা গোপাল? এই দু’জনকেই তো মূলতঃ সন্দেহ করা যায়। আর গগনবাবু তো এখানে ছিলেনই না।”
“হুম। সেটাই তো খটকা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দাদু বললেন “অলি, চটপট জিনিসপত্র গুছিয়ে নে। আমরা এখনই বেরোব।”
“বেরোব মানে? চলে যাব?”
“হ্যাঁ।”
“সে কি? তদন্ত শেষ না করেই?”
“তুই বুঝতে পারছিস না। যে লোক রাতের বেলা যোগীন্দ্রনাথবাবুকে বিষ দিতে পারে সে তো আমাদেরও ক্ষতি করতে পারে?”
তাই তো। এই ব্যাপারটা তো ভেবে দেখিনি।
“৫”
আধ ঘণ্টার মধ্যেই মজুমদার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। গগনবাবু কেমন জানি থম মেরে আছেন। ঘটনার জের বোধহয় এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আমরা চলে যাচ্ছি শুনেও তেমন কিছুই বললেন না। শুধু এমনভাবে মাথা নাড়লেন যার অর্থ ‘হ্যাঁ’ ও হয়, আবার ‘না’ও হয়।
মজুমদার বাড়ি থেকে একটু দূরেই টোটো স্ট্যাণ্ড। দাদু একটা টোটোয় উঠে বললেন, “স্টেশন।”
যাঃ। দাদু কি তাহলে হাল ছেড়ে দিল নাকি। দাদুর মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে দাদু বললেন, “সাড়ে পাঁচটায় একটা হাওড়া লোকাল আছে। এখন সাড়ে চারটে বাজে। আরামসে পেয়ে যাব।”
“আমরা হাওড়া যাচ্ছি?”
“না। কলকাতা। তেরোর ছয় নাকতলা রোড। অলিভিয়া রায়ের বাড়ি।”
“সেকি? তদন্ত শেষ? বাড়ি ফিরে যাব?”
“এখানে আর কিছু করার নেই। তাছাড়া পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পেলে এগোনো যাবে না। কি বিষ দিয়ে খুন করা হয়েছে? কখন খুন করা হয়েছে? এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তরই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলবে।”
বাড়ি ঢুকলাম প্রায় রাত দশটা। আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে দাদু চলে গেলেন তাঁর ফ্ল্যাটে।
পরেরদিন একরকম কেটে গেল। দাদুকে দু’একবার ফোনও করেছি, তোলেননি।
কী আর করব! মজুমদার বাড়িতে কতকগুলো সেলফি তুলেছিলাম। তার মধ্যে একটা ছিল বাড়িটার পিছনে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে। সেই ছবিটা হোয়াটসঅ্যাপের ডিপি করে দিলাম। মজুমদার বাড়ির অনেকটাই এ ছবিতে এসেছে।
পরদিন সকালবেলাতেই দাদুর ফোন। ঘড়িতে সবে ছটা বাজে। ছটার সময় বাবা মা উঠে পড়লেও আমার মধ্যরাত্রি। তাছাড়া এখন স্কুল ছুটি। ওঠার কোনও তাড়া নেই।
কোনোরকমে ফোনটা ধরে, “হ্যালো” বললাম।
“তুই মজুমদার বাড়িতে যে ছবিগুলো তুলেছিস এক্ষুনি হোয়াটস-অ্যাপে পাঠা তো আমায়।” খট করে কেটে দিলেন ফোনটা।
কী জ্বালা! বেশি নয় গোটা সাতেক ছবি তুলেছিলাম মজুমদার বাড়িতে। সবগুলোই পাঠিয়ে দিলাম দাদুকে।
ভারি রাগ হল আমায়। একে তো সকালবেলাতেই ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে আমার। তার ওপর দাদু আমাকে কিছুই বলছে না। অথচ গোয়েন্দাদের নিয়মই তো অ্যাসিস্ট্যান্টদের সব বলা। ঠিক করলাম কাল বিকেলে একবার দাদুর অফিসে ঢুঁ মারব।
বিকেল অবধি আর অপেক্ষা করতে হল না আমাকে। পরদিন সকাল দশটা নাগাদ দাদু নিজেই চলে এলেন আমার বাড়িতে। আমাকে দেখেই বললেন, “দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হতে পারবি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু যাব কোথায়?”
“মজুমদার বাড়ি। নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।”
গাড়িতে উঠে দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ গো, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে?”
“হ্যাঁ। গতকাল দুপুরেই ইন্সপেক্টর সুবোধ ফোন করেছিলেন। আমার অনুমানই ঠিক। খাবার জলের মধ্যেই বিষ মেশানো হয়েছিল।”
“কী বিষ?”
“পটাশিয়াম সায়ানাইড। যোগীন্দ্রনাথবাবু পটাশিয়াম সায়ানাইড মেশানো জল খেয়ে শোবার সাথে সাথেই মৃত্যু হয়েছে ওঁর। নেহাৎ বিষটা জলে মেশানো হয়েছিল। তাই খাটে গিয়ে শুতে পেরেছিলেন।”
“মৃত্যুর সময়টা কিছু জানা গেল?”
“হুমম ভোর চারটে নাগাদ। জাগের জলের স্যাম্পেলেও বিষের অস্তিত্ব মিলেছে।”
“কে খুন করেছে?”
“সেটা মজুমদার বাড়ি গেলেই জানতে পারবি।”
বাকি রাস্তাটায় আর কোনো কথা বললেন না দাদু। শুধু গুণ গুণ করে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে গেলেন।
মেদিনীপুর টাউনে ঢুকতেই দাদু একটা ফোন সেরে নিলেন। “হ্যালো। সুবোধ … আমরা চলে এসেছি।… তুমি মজুমদার বাড়ি চলে এস। … হ্যাঁ, ওদেরকেও সঙ্গে এনো। …ঠিক আছে।”
দশ মিনিটের মধ্যেই মজুমদার বাড়ির সামনে আমাদের গাড়িটা থামল। দেখি একটা পুলিশের জিপ আগে থাকতেই দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়ি থেকে নেমেই দাদু ‘এক মিনিট আসছি’ বলে কোথায় চলে গেলেন। অবশ্য মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চলে এলেন।
“৬”
মজুমদার বাড়ির একতলার বৈঠকখানায় সবাই জড়ো হয়েছে। চাকর কানাই মণ্ডল, ভাগ্নে গোপাল, প্রবালবাবু, আর গগনবাবু।
“আমি ভাবছি আজই কলকাতা ফিরে যাব। গগনবাবু বললেন, “এখানে থেকে আর কী করব?”
“কলকাতা পরে যাবেন গগনবাবু। আগে বলুন তো শনিবার রাতে অর্থাৎ যোগীন্দ্রনাথবাবু মারা যাবার রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?” বুলেটের মত প্রশ্ন করলেন দাদু।
“আমি?” একটু থতমত খেয়ে গগনবাবু বললেন, “সাঁত্রাগাছি স্টেশনের কাছে একটা লজে ছিলাম। পরদিন সকাল সাড়ে ছটায় রুপসী বাংলা এক্সপ্রেস ধরার তাড়া ছিল। আসলে আমার কলকাতার বাড়ি থেকে আবার অত সকালে সাঁত্রাগাছি স্টেশনে আসাটা একটু অসুবিধাজনক।”
“আর আমি যদি বলি ওই রাতে আপনি মজুমদার বাড়িতে এসেছিলেন।” বরফশীতল গলায় কথাটা বললেন দাদু।
“কী যা তা বকছেন আপনি?” চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন গগনবাবু। “তাছাড়া রাত নটা অবধি তো আমি আপনার সাথে ফোনে কথা বলেছি। ফোনের টাওয়ার লোকেশন দেখলেই বোঝা যাবে আমি কোথায় ছিলাম। হোটেলের রেজিস্টারে আমার সই আছে।”
গগনবাবুর কথাগুলোর সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে দাদু বললেন, “এটা ঠিক গগনবাবু, প্রথমে আপনাকে আমি সত্যিই সন্দেহ করিনি। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। প্রবালবাবু, কানু বা গোপাল যদি খুন করত তাহলে যে কোনও দিনই খুন করতে পারত। বরং আমরা না থাকলেই ওদের এই কাজ করার সুবিধা বেশি। তাছাড়া ওরা যোগীন্দ্রনাথবাবুকে খুনই বা করবে কেন? শুধু চুরির মতলব থাকলে তো ঘুমের ওষুধ দিয়ে বা অজ্ঞান করেও কাজটা হাসিল করা যেত।” একটু থামলেন দাদু। “আমার কেবলই সন্দেহ হচ্ছিল আমাদের মজুমদার বাড়িতে গিয়ে হাজির হওয়া আর যোগীন্দ্রনাথবাবু খুন হবার মধ্যে কোথাও একটা যোগসূত্র আছে। খুনী যেন আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল। আপাতদৃষ্টিতে গগনবাবুকে সন্দেহ করা যায় না। উনি তো মজুমদার বাড়িতে এলেনই রবিবার সকালে।”
ঘরে সবাই চুপ। দাদু পকেট থেকে মোবাইল বার করে একটা ছবি সবাইকে দেখালেন। আরে এটা তো আমার তোলা একটা সেলফি। দাদু আমার মুখটা বাদ দিয়ে শুধু মজুমদার বাড়িটা বড় করে দেখাচ্ছেন। এটা মজুমদার বাড়ির পিছনের দিকটা।
“এই দেখুন। বাড়ির পিছনের এই ঘোরানো সিঁড়িটা দেখুন।”
“এটা দেখার কি আছে? একসময় বাড়িতে বাথরুম পরিষ্কার করতে জমাদার আসত। তারা এই সিঁড়ি ব্যবহার করত। এখন আর এটা ব্যবহার করা হয় না।”
“ভাল করে ছবিটা দেখুন।” দাদু ছবিটা আরও বড় করলেন “সিঁড়ির উপরে বাড়িতে ঢোকার দরজাটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। দরজা বন্ধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকবে কেন? সিঁড়ির দরজা তো বন্ধ থাকবে ভিতর থেকে। আর এই দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলে একদম গগনবাবুর ঘরে গিয়ে ঢুকব। তাই না গগনবাবু?”
দাদুর আচমকা প্রশ্নে গগনবাবু একটু তুতলিয়ে গেলেন। “অ্যাঁ। হ্যাঁ। আগে আমার ঘরটা ছিল দোতলার অতিথিদের ঘর। শুনেছি জমাদারকে বাড়ির কোনো লোকের ঘরে ঢোকানো হবে না বলে ওই ঘরটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। যাতে ওই ঘর দিয়ে ঢুকে একদম বাথরুমে চলে যেতে পারে। আসলে আগেকার দিনের লোক তো, এইসব গোঁড়ামি ভালই ছিল। আমি বাবাকে অনেকবার বলেছিলাম সিঁড়িটা খুলে দেবার জন্য।”
“যোগীন্দ্রনাথবাবু সিঁড়িটা খুলে দিলে ভালই করতেন। তাহলে আর এইভাবে মরতে হত না ওঁনাকে। যাকগে যা বলছিলাম। রবিবার সকালে আমি আপনার ঘরে ঢুকেছিলাম গগনবাবু। তখন দেখেছিলাম ওই দরজাটা ভিতর থেকে আটকানো নেই। ব্যাপারটার গুরুত্ব তখন বুঝতে পারিনি। বাইরের একটা সিঁড়ির দরজা সেটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া অথচ ভেতর থেকে খোলা। অর্থাৎ কেউ ওই দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়েছে।”
গগনবাবুর দেখলাম মুখটা শুকিয়ে গেছে। শুকনো গলায় বললেন “সেই তো। ব্যাপারটা আগে খেয়াল করিনি। তাহলে কি ওই সিঁড়ি দিয়েই কেউ বাড়ির মধ্যে ঢুকে বাবাকে খুন করে টাকা পয়সা হাতিয়ে চম্পট দিয়েছে?”
“অন্য কেউ নয় গগনবাবু।” দাদু একটু হাসলেন “কুকীর্তিটা আপনারই।”
হা হা করে হেসে উঠলেন গগনবাবু। “আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন মিস্টার সাগর রায়। আমি ওই রাতে মেদিনীপুরেই ছিলাম না। ছিলাম সাঁত্রাগাছির হোটেলে। এখান থেকে একশ কিলোমিটার দূরে।”
“আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।” গমগম করে উঠল দাদুর গলা। “আপনার মোবাইলটা ছিল ওই হোটেলে। যাতে পরে লোকেশন টাওয়ার সার্চ করলে আপনার মোবাইলে ওই লোকেশনটাই দেখায়। আর আপনি? বলে যাচ্ছি ভুল হলে শুধরে দেবেন।” দাদু বলে চললেন, “আপনি ঠিক রাত সাড়ে ন’টায় আমায় ফোন করে বলেন যে কাল ভোরে ট্রেন ধরবেন। এটা বিশ্বাস করানোর জন্য যে আপনি কলকাতাতেই আছেন। তারপরই ফোনটা হোটেলে রেখে বেরিয়ে পড়েন আপনি। রাতে সাঁত্রাগাছি থেকে মেদিনীপুর আসার কয়েকটা ট্রেন আছে। তবে আমার ধারণা আপনি সাঁত্রাগাছি থাকে হাওড়া স্টেশন চলে যান। হাওড়া থেকে আদ্রা চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ধরে মেদিনীপুর স্টেশন নামেন রাত দু’টোয়।” দাদু ইন্সপেক্টর ঘোষালের দিকে তাকিয়ে বললেন “রেলের অফিস থেকে ওই ট্রেনের রিজার্ভেশন লিস্টটা দেখ একবার। ওঁর নাম পেয়ে যাবে।” একটা দম নিয়ে দাদু বললেন, “হ্যাঁ যা বলছিলাম। মেদিনীপুর নেমে আপনি সোজা চলে আসেন আপনার বাড়িতে। পিছনের ওই সিঁড়ি ব্যবহার করেন আপনি। তালাটা কয়েকদিন আগে আপনিই লাগিয়েছিলেন। আর সেইজন্য ওটা এখনও চকচকে আছে। পুরনো তালা হলে মরচে পরে জং ধরে যেত। ওই তালার চাবি আপনার কাছেই ছিল। সটান নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। আপনি জানতেন আপনার বাবা রাতে দরজা বন্ধ করেন না। আর এটাও জানতেন যে উনি ভোরবেলা একবার করে টয়লেটে যান, তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়েন। আপনি আপনার বাবার ঘরে ঢুকে খাবার জলের জগের মধ্যে পটাশিয়াম সায়ানাইড বড়ি ফেলে দিয়ে যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই পালিয়ে গেলেন। তবে ফেরার সময় খুব সম্ভবতঃ আপনি মেদিনীপুর থেকে খড়গপুর যান। ওখানে ট্রেন চেঞ্জ করে সাঁত্রাগাছি যান। সাঁত্রাগাছি লজ থেকে চেক আউট করে রুপসী বাংলা ট্রেনে চেপে বসেন। সুবোধ, ঘোরানো সিঁড়ির তালাটা রেখে দিও। কোর্টে এভিডেন্স হিসেবে দিতে পারবে। আর তাছাড়া ওই তালায় গগনবাবুর আঙুলের ছাপও পাবে।”
গোপাল এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। এবার বলে উঠল, “কিন্তু মামা এমন কাজ কেন করবেন? দাদুকে খুন করে ওঁর কি লাভ?”
“গগনবাবু উত্তরটা কি আপনি দেবেন, না আমিই দেব?”
দাদুর প্রশ্নে কোনও উত্তর দিলেন না গগনবাবু। মাথাটা নিচু করে বসেই রইলেন।
“বেশ তাহলে আমিই বলি। গগনবাবুর দোকানে গিয়ে আমি খোঁজ নিই। দেনার দায়ে দোকান ডুবতে বসেছে। বিক্রি-বাট্টাও সেরকম নেই। যে কটা টাকা গগনবাবু পান সেটার বেশিরভাগটাই খরচ হয়ে যায় রেসের মাঠে। এই ভরাডুবির হাত থেকে গগনবাবুকে বাচাতে উদয় হন মিস্টার ভার্গব। খুব সম্ভবতঃ রেসের মাঠেই মিস্টার ভার্গবের সাথে আলাপ হয় গগনবাবুর। মিস্টার ভার্গব বলেন মজুমদার বাড়ি ওঁকে বিক্রি করে দিতে। কংসাবতী নদীর ধারে এত বড় একটা জায়গার দাম কম হবে না। গগনবাবু তাঁর বাবার সাথে কথা বললে, যোগীন্দ্রনাথবাবু ব্যাপারটা একদম উড়িয়েই দেন। শুধু তাই নয় ভবিষ্যতে এই ধরণের লোকের সাথে মিশলে ত্যাজ্যপুত্র করবেন বলেও ধমকে দেন।”
“ইয়েস, হি ওয়াজ আ ফুল।” এবারে চেঁচিয়ে উঠলেন গগনবাবু। “ভার্গব পঞ্চাশ লাখ টাকা অবধি অফার করেছিলেন। এত বড় বাড়ি রেখে কী হবে? ভার্গবের কাছ থেকে টাকা পেলে আবার নতুন করে ব্যবসাটা শুরু করতে পারতাম। শুধু তাই নয় কলকাতার রাজারহাটে একটা ফোর বেডরুম ফ্ল্যাটেও দেবেন বলেছিলেন।”
“ঠিক। এদিকে আপনার টাকার খুব দরকার। কবে আপনার বাবা মারা যাবেন, তখন আপনি সম্পত্তির মালিক হবেন আর তারপর আপনি মিস্টার ভার্গবকে বেচতে পারবেন। এতদিন অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না আপনার পক্ষে। আর তখনই আপনি আপনার বাবাকে সরিয়ে দেবার প্ল্যানটা ছকে ফেলেন। একমাস ধরে কতকগুলো হুমকি চিঠি ছাড়লেন। তারপর আমার অফিসে গিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে এলেন এখানে। আর এমন ভাব করলেন যেন আপনি কলকাতাতেই রয়ে গেছেন। নিজের অ্যালিবাই পাকা করলেন।”
গগনবাবু স্থির দৃষ্টিতে দাদুর দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “এগুলো তো আপনার অনুমান মাত্র। কোর্টে অনুমান চলে না। প্রমাণ লাগে। আপনি কোনও মতেই প্রমাণ করতে পারবেন না যে আমিই খাবার জলে বিষ মিশিয়েছি। উল্টে আমি প্রমাণ করে দেব যে আমি শনিবার রাতে মেদিনীপুরেই ছিলাম না।”
“আপনি তো কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট করেছেন? তাই না?” গগনবাবুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই দাদু বলে চললেন, “কলকাতার রাজাবাজারে যে বাড়িটায় আপনি ল্যাবরেটরি বানিয়েছেন সেটা এখন পুলিশের জিম্মায়। আর আপনি ওই ল্যাবরেটরিতে সম্পূর্ণ অবৈধ উপায় পটাশিয়াম সায়ানাইড তৈরি করেছেন সেটা প্রমাণ করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না গগনবাবু।”
এবারে গগনবাবু দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন। ইন্সপেক্টর ঘোষাল এগিয়ে গেলেন গগনবাবুর দিকে।
“গল্প তো এখনও শেষ হয়নি।” কথাটা বলে দাদু এক মিনিট থেমে রইলেন। “গগনবাবু বিষ দিয়ে যোগীন্দ্রনাথবাবুকে খুন করেন। আর এক ব্যক্তি যোগীন্দ্রনাথবাবুর ঘর থেকে আলমারি খুলে টাকা সরিয়ে নেন। এই দ্বিতীয় ব্যাক্তি গগনবাবুকে রাতে যোগীন্দ্রনাথবাবুর ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন। আর কিছু একটা আন্দাজ করে সকালবেলা সবার আগে যোগীন্দ্রনাথবাবুর ঘরে ঢোকেন। আর ঢুকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারেন এবং সুযোগ বুঝে যোগীন্দ্রনাথবাবুর বালিশের তলা থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে টাকা চুরি করে নেন। কি? তাই না গোপাল? হুমকি চিঠিগুলো নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি, মারা যাবার দুদিন আগে যোগেন্দ্রনাথবাবু পোষ্ট অফিস থেকে প্রায় ষাট হাজার টাকা তুলেছিলেন। আর এই টাকাটা তুমিই তুলে দিয়েছিলে যোগীন্দ্রনাথবাবুকে। অথচ তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম তখন তুমি বেমালুম মিথ্যে কথা বললে যে তেমন কিছু চুরি যায়নি। শুধু তাই নয় এও বললে যে যোগীন্দ্রনাথবাবু বেশি টাকা নিজের কাছে রাখতেন না। এত দুর্বল স্মৃতি শক্তি নিয়ে কি চাকরির পরীক্ষা দেওয়া যায় গোপাল?” একটা দম নিলেন দাদু, “আশা করি টাকাগুলো তোমার কাছেই এখনো আছে। তুমি নিজের থেকেই ওগুলো পুলিশের হাতে তুলে দেবে না তোমার ঘর সার্চ করাতে হবে?”
“৭”
ফেরার পথে ট্রেনে পাশাপাশি আমি আর দাদু বসে আছি। মনটা ভারি হয়ে আছে। প্রথম থেকে গগনবাবুকে হাসিখুশি মজার মানুষ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তিনিই যে খুনি একথা কিছুতেই মন মানছিল না। সে কথা দাদুকে বলতে দাদু বললেন, “কী করবি বল? গগনবাবুও তো মানুষ। আর মানুষ মাত্রই তার লোভ, হিংসা থাকবে।”
“গগনবাবুর ল্যাবরেটরির কথা জানলে কীভাবে?”
“গগনবাবুর অফিসে যখন খোঁজখবর আনতে যাই তখন কলকাতার এক নামকরা কেমিস্ট দোকানের কার্ড পাই। খটকাটা সেখানেই লাগে। শাড়ির দোকানের মালিক কেমিস্ট দোকানের খবর রাখবে কেন? বুঝলি, তখন সেই কেমিস্ট দোকানে যাই। গগনবাবুর ছবি দেখাতেই চিনতে পারে দোকানের লোকজন। ওদের কাছ থেকেই খবর নিয়ে জানতে পারি গগনবাবু কী কী কিনেছেন? মালপত্তর পৌঁছে দেবার জন্য রাজাবাজারের বাড়ির ঠিকানাটাও ওদের দিয়ে এসেছিলেন গগনবাবু। ব্যাস, এরপর থেকেই সবকিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে। আসলে কোনও দোকান থেকে পটাশিয়াম সায়ানাইড কেনার ঝুঁকি উনি নেননি। যেহেতু নিজেই কেমিস্ট্রি অনার্সের ছাত্র সেইজন্য ঠিক করেন নিজেই বানিয়ে নেবেন বিষটা। যাকগে আসল কথা হল এই রহস্য সমাধানের সম্পূর্ণ ক্রেডিট তোর।”
“আমার?”
“ইয়েস ম্যাম। তোর হোয়াটস অ্যাপের ডিপিতেই বাইরের সিঁড়ির তালাটা নজরে আসে। তখনই গগনবাবুকে সন্দেহ হয় আমার। তারপরই তো ওঁর দোকানে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করি। এইজন্য তোর একটা ট্রিট পাওনা হয়েছে।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বললাম, “গোলবাড়ির কষা মাংস আর পরোটা।”
________ xxx ________