চারিদিকে তখন পূর্ণিমার চাঁদের মায়াবী আলোকিত রাস্তা। রাস্তায় কোনও গাড়ি নেই, কোনও কোলাহল নেই, নিস্তব্ধ নিঝুম একটি মধ্যরাতের কলকাতা। মাঝে মাঝে সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে কিছু কুকুরের দলের অজানা জটলার হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। লাইটপোস্টে কমলা রঙের আলোর বিলুপ্তি ঘটেছে। এলাকায় কেবল কিছু বাড়িতে জেনারেটারের আলো জ্বলে কিন্তু এখন মধ্যরাত তাই লোডশেডিংয়ের ধর্মঘটে সমর্থন বেশ তীব্রভাবে জুটেছে। কেবল একটি বাড়ি সেই ধর্মঘটকে বাঞ্চাল করার প্রচেষ্টায় মগ্ন। এলাকায় কেবল একটিমাত্র বিদ্রোহী বাড়ি যার মধ্যরাত হয় ভোরের সময়।
বাড়ির মালিক একজন খ্যাপাটে বয়স্ক ভদ্রলোক, বয়েস আন্দাজ বছর সত্তর হবে। পূর্বে সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন এখন পেনশন পান তাই দিয়ে সংসার চলে। আসলে চলে বললে ভুল হবে বলা উচিত দৌড়ায়। একা মানুষ বাড়িতে লোক বলতে দু’জন, তিনি এবং তাঁর চাকর। ভদ্রলোকের নাম পরিতোষ মজুমদার, একসময় বাড়ির দ্বিতলে তিনি ট্যুইশন পড়াতেন। সেই কাজ থেকেও অবসর নিয়েছেন বেশ কিছু বছর হল। এখন তিনি কেবল রাত জেগে দেশি বিদেশী লেখকদের বই পড়েন, তাই এখন তাঁর বাড়ির এই তীব্র বিদ্রোহ। বিবাহ করেছিলেন শুনেছিলাম কিন্তু তাঁর কোনও ছেলেমেয়ে ছিল না। বৌয়ের সাথে ডিভোর্স হয়েছিল বিবাহের তিন বছরের মাথায় তাই সেদিন থেকেই তিনি একাকীত্বকে নিত্য সঙ্গী করে পথ চলছেন। ছেলেমেয়ে নেই। ডিভোর্সি বৌয়ের মৃত্যু হয়েছে বছর তিনেক হল, তাই তিনি উইল করে তাঁর মৃত্যুর পরে সমস্ত সম্পত্তি অনাথ আশ্রমকে দান করেছেন।
হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতাকে ম্লান করে বাড়ির কলিংবেলটা বাজতেই তিনি চমকে উঠলেন, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সময়টা রাত আড়াইটা। বাড়ির চাকর নিধিরাম ভোরে ঘুম থেকে ওঠে তাই সে এখন তীব্র নিদ্রামগ্ন, কিন্তু এত রাতে অতিথির আগমন অশুভ লক্ষণের কারণ। চোর-ডাকাতও হতে পারে, তাই তিনি নিধিরামকে ঘুম থেকে তুললেন। তারপর হাতে একটা বঁটি তুলে নিয়ে নিধিরামকে দরজা খুলতে পাঠালেন। এত কাণ্ডের মাঝে বেলের আওয়াজ তিন-চারবার বাজার পরে থেমে গিয়েছে। দরজাটা খুলতেই নিধিরাম দেখল একটা ছায়ামূর্তি দরজার কাছে মূর্ছিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, বৃদ্ধ হাতের বঁটিটা ফেলে দিয়ে দ্রুত তার নাকের কাছে হাত রেখে দেখলেন যে নিঃশ্বাস পড়ছে অর্থাৎ সে বেঁচে আছে।
দ্রুত তিনি নিধিরামের সাহায্যে সেই ছায়ামূর্তিকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে তার সংজ্ঞা ফেরানোর চেষ্টা করলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে সেই ছায়ামূর্তির চেতনা ফিরল। চোখ খুলে চারিপাশে দেখে সে ভয়াল ভীত হয়ে পড়লে, বৃদ্ধ তাকে বললেন, “মা, তোমার কোনও চিন্তা নেই তুমি এখন নিরাপদে আছ।”
পর্বঃ ২
মেয়েটির বয়েস আন্দাজে বছর পঁচিশ হবে। পরনে তার একটি কালো রঙের ময়লা ওয়েস্টার্ন ফ্রগ, চোখের কোণের কাজল ঘেঁটে গিয়েছে, চুলগুলো এলোমেলো, পায়ে জুতোজোড়া ছাড়া দৌড়ানোর ফলে লালচে কিছু এলোমেলো ছড়ে যাওয়ার দাগ বর্তমান। হাতের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের একাধিক চিহ্নের সাথে মাথায় একটি ছোট্ট আঘাতের চিহ্ন বর্তমান। মুখটা বেশ ভয়াল ভীত, চোখের কোণে কেবল অশ্রুর ফোঁটা বিদ্যমান, গাল বেয়ে নদীর আঁকাবাকা স্রোতের মতো রেখাপাতে তার প্রকাশ ঘটেছে। বেশ কিছুক্ষণ সে কেবল বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর সে বলল, “আমি আমার এক বন্ধুর পার্টিতে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে ফেরার পথে কয়েকজন ছেলে আমাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে –”
কথাটা শেষ হওয়ার পূর্বেই সে পুনরায় কাঁদতে লাগল। বৃদ্ধ তার দিকে একটা জলের গেলাস এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আর বলতে হবে না মা, আমি বুঝতে পেরেছি, তা তোমার নাম কী?”
মেয়েটি বলল, “নলিনী।”
বৃদ্ধ – “মা দেখ চিন্তার কিছু নেই আমি পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছি, ওরা দ্রুত চলে আসবে, তুমি চিন্তা কোরো না।”
নলিনী – “পুলিশ কেন!”
বৃদ্ধ – “দেখ মা, যে দুর্ঘটনা তোমার সাথে ঘটেছে সেটার একটা পুলিশ রিপোর্ট দরকার, তুমি চিন্তা কোরো না, লোকাল থানার ওসি আমার প্রাক্তন ছাত্র।”
রিপোর্ট করার সাথে সাথেই পুলিশ এসে দ্রুত হাজির হল সেইসাথে শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ।
মেয়েটির থেকে ঘটনার বিবরণ সংগ্রহ করতে তাঁরা তাকে থানায় নিয়ে গেল, বৃদ্ধ নিজেও তাঁদের সঙ্গে গেলেন।
ওসি বললেন, “প্রণাম নেবেন স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা দ্রুত সেই ব্যাক্তিদের গ্রেফতার করব।”
বৃদ্ধ – “সত্যি আজকাল যা যুগ পরেছে মানুষ মোটেই নিরাপদ নয়। তবে তোমাকে একটা কথা বলি এত রাতে মেয়েটির একাকী রাস্তায় বেরোনো মোটেই উচিত হয়নি।”
ওসি – “স্যার, আপনি কিন্তু ‘ফেমিনিজম’ বিরোধী উক্তি করছেন। আপনার বিরুদ্ধে কেস করে দেবে কিন্তু মহিলা কমিশন।” কথাটা বলেই ওসির অট্টহাসি।
বৃদ্ধ – “তা যা বলেছ, কিন্তু দেখ নিজের সেফটির ব্যাপারেও মানুষের সাবধান হওয়া উচিত।”
কথাটা শেষ হওয়ার পূর্বেই বাইরে থেকে কনস্টেবল এসে খবর দিল, মেয়েটির বাড়ির লোক এসেছেন।
বৃদ্ধ বাইরে বেরিয়ে দেখলেন একজন ভদ্রলোক, বয়েস আন্দাজ বছর পঞ্চাশ হবে – মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে তাকে নানা ভাষায় তিরস্কার করছেন। বৃদ্ধকে দেখে তিনি থামলেন এবং তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে তাঁকে বললেন, “আমি মিস্টার সেন, নলিনীর বাবা, আপনি আজকে আমাদের যা উপকার করলেন তা আমি জীবনেও ভুলতে পারব না।”
বৃদ্ধ – “এটা তো আমার কর্তব্য, দেখুন যা হয়েছে দোষীরা নিশ্চয় শাস্তি পাবে।”
মিস্টার সেন – “কিন্তু এখন সমাজে যে কীভাবে মুখ দেখাব কে জানে!”
বৃদ্ধ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু শুধুমাত্র এই অল্প পরিচয়ে সেই কথাটা বলা ঠিক নয় ভেবে তিনি চুপ করে গেলেন।
বৃদ্ধ – “ওসি আমার প্রাক্তন ছাত্র তাই সে নিজের তরফ থেকে আপনাদের সমস্ত রকমভাবে সাহায্য করবে, আজ তবে চলি।”
নলিনীর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে তিনি চলে গেলেন।
পরদিন সকালে বৃদ্ধ খবরের কাগজে সেই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পড়বার জন্য খুঁজছেন ঠিক তখনই নিধিরাম এসে বলল, “বাবু থানার ওসিবাবু এসেছেন।”
বৃদ্ধ নিজের শোয়ার ঘর ছেড়ে নীচে নেমে এলেন, বৈঠকখানায় এসে বললেন, “অনিমেষ হঠাৎ সকাল সকাল, কেসের ব্যাপারে বিশেষ কোনও প্রয়োজন নাকি?”
ওসি অনিমেষ – “স্যার, কালকে আপনি চলে যাওয়ার পরে মেয়েটির বাবা কেসটি তুলে নিয়ে চলে গিয়েছেন।”
বৃদ্ধ – “মানে!”
অনিমেষ – “স্যার, সোসাইটিতে নাকি কেস করলে তিনি মুখ দেখাতে পারবেন না, তাই মেয়েটির মেডিকেল টেস্টও তিনি করতে দেননি।”
বৃদ্ধ – “সত্যি, লোকের কাছে আজকাল সোসাইটি বেশি জরুরী হয়ে গিয়েছে আর মেয়েটির উপর হওয়া অত্যাচারের কোনও প্রতিবাদ নেই। এইজন্য আজকাল এই জঘন্য অপরাধীগুলো রাস্তায় নির্বিচারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
অনিমেষ – “সত্যি, অপরাধীদের এইভাবে যদি কেবল চক্ষুলজ্জার ভয়ে ছাড় দিয়ে দেওয়া হয় তবে সমাজটা এগাবে কীভাবে?”
বৃদ্ধ – “তা চা না কফি?”
অনিমেষ – “না স্যার আজ থাক। কাল থেকে সারারাত ডিউটি করে এখনো বাড়ি ফিরিনি, মা চিন্তা করছেন। আজ তবে চলি, আপনাকে জানানো উচিত তাই জানিয়ে গেলাম।”
ওসি প্রস্থান করল।
বৃদ্ধ খবরের কাগজের হেডলাইনটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাতে লেখা ‘কলকাতার প্রকাশ্য রাস্তায় আবার ধর্ষণের চেষ্টা।’ তার মুখ থেকে কেবল একফালি দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল।
পর্বঃ৩
বিকেলে বৃদ্ধ তখন নিজের উপরের ঘরে বসে একটি গল্পের বই পড়ছেন, তখনই চাকর নিধিরাম এসে বলল, “বাবু কালকের ওই মেয়েটি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
বৃদ্ধ বেশ অবাক হয়ে দ্রুত নীচের বৈঠকখানায় এসে হাজির হলেন।
মেয়েটি তাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলল, “আমি এই কেসটা লড়তে চাই স্যার। আমার বাবা চান না আমি এই কেসটা লড়ি তাতে নাকি পাঁচজনে জানাজানি হলে আমার বিয়ে হবে না, কিন্তু স্যার যদি আমি এই কেসটা না লড়ি তবে ওই অপরাধীগুলো আবার কোনও মেয়ের সাথে-”
কথাটা শেষ হওয়ার পূর্বেই সে কাঁদতে লাগল। বৃদ্ধ কেবল একটি কথা বললেন, “তুমি সত্যি অনেক সাহসী মা, আমি এখনি অনিমেষকে টেলিফোন করছি।”
ফোনের ওপাশ থেকে অনিমেষ বলল, “হ্যালো, ওসি অনিমেষ স্পিকিং।”
বৃদ্ধ – “অনিমেষ, আমি পরিতোষ স্যার বলছি।”
অনিমেষ – “হ্যাঁ, স্যার বলুন।”
বৃদ্ধ – “অনিমেষ, মেয়েটি আমার কাছে এসেছে কেসটা লড়তে চাইছে।”
অনিমেষ – “আপনি দ্রুত ওঁকে থানায় নিয়ে আসুন স্যার, আমি মেডিকেল টেস্টের ব্যাবস্থা করছি।”
মেডিক্যাল টেস্ট হল, ‘এফআইআর’ তৈরি হল, মিডিয়াতে শোরগোল পড়ে গেল। অপরাধীদের স্কেচ তৈরি করা হল। সবকিছু শুনে নলিনীর বাবা ফোন করে তাকে বললেন, “আমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিলি তুই। ছি! ছি! আর ফিরে আসতে হবে না। আজ থেকে আমার আর কোনও মেয়ে নেই।” ফোনটি তিনি কেটে দিলেন, নলিনীর চোখ দিয়ে অশ্রুর ফোঁটা ঝরে পরতে লাগল।
বৃদ্ধ বললেন, “মা , বাবার মন বলে কথা, অভিমান ঠিক একদিন গলে যাবে।”
নলিনী কোনও কথা বলল না। বৃদ্ধ তাকে বললেন, “মা তুমি চল, আমি তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসি।”
নলিনী – “ওই বাড়িতে আমি ফিরে যেতে পারব না স্যার।”
বৃদ্ধ – “কেন পারবে না?”
নলিনী – “না স্যার এই কেস জিতে তবে আমি আবার বাবার মুখোমুখি হব তার আগে নয়, উনি আমাকে বিতাড়িত করেছেন।”
নলিনীর চোখের কোণে ঈষৎ জলের ছিটে, বৃদ্ধ নলিনীকে পিতৃস্নেহে বুকে আগলে নিলেন, তারপর তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন।
বৃদ্ধ – “নিধিরাম, গেস্টরুমটা একটু তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে ফেল। আর হ্যাঁ, রাতের খাবারটা একটু ভালো বানিও আজকে।”
নিধিরাম – “আচ্ছা, তা কে আসবেন বাবু?”
বৃদ্ধ – “আজ থেকে নলিনী এখানেই থাকবে।”
নিধিরাম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বৃদ্ধ রাশভারী তাই থেমে গেল। তারপর সে দ্রুত গেস্টরুম পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়ল।
বৃদ্ধ – “নলিনী মা, তুমি চিন্তা কোরো না, এটাকে নিজের বাড়ি বলে মনে কোরো । দেখো মা আমার কোনও সন্তান নেই, তুমি আমার মেয়ের মতো তাই এই বৃদ্ধ বাবার কাছে কিছু দরকার হলে চাইতে লজ্জা কোরো না।”“
নলিনী – “স্যার, আপনি আমার জন্য যা করলেন তা আমি জীবনেও ভুলতে পারব না।”
বৃদ্ধ – “আমাকে কাকু বলে ডেকো মা, আমার ভালো লাগবে। আর মা আমি তেমন কিছু করিনি একজন মানুষের যা করা উচিত আমি তাই করেছি।”
বৃদ্ধ – “তাহলে আমাকে বাবা কেন তাড়িয়ে দিলেন স্যার?”
বৃদ্ধ – “উনি এখন ভয়ে রয়েছেন মা, একদিন ঠিক ভয় কেটে যাবে তখন তিনি নিজেই তোমার কাছে ছুটে আসবেন।”
নলিনী নীরব হয়ে রইল, কোনও কথা বলল না। বৃদ্ধ নলিনীকে বললেন, “মা, নিধিরামের সাথে যাও, নিধিরাম তোমাকে গেস্টরুমটা দেখিয়ে দেবে।”
নলিনী চলে যাওয়ার পরে বৃদ্ধ নিজের শোওয়ার ঘরে গিয়ে একটা সিগারেট জ্বালালেন, তারপর নিজের স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজ তুমি থাকলে সত্যি দারুণ খুশি হতে জানো, নলিনী যদি আমাদের মেয়ে হত তাহলে আমাদের জীবনটা এইরকম জটিল হয়ে যেত না।”
আচমকা বৃদ্ধের সেলফোনটা বেজে উঠল,
বৃদ্ধ – “হ্যালো, হ্যাঁ অনিমেষ বলো।”
বৃদ্ধ – “কী বলছ!! অপরাধীদের একজন ধরা পড়েছে। হ্যাঁ নিশ্চয়। আমি কাল সকালেই নলিনীকে নিয়ে গিয়ে ‘আইডেন্টিফিকেশন’ করিয়ে নেব।”
নিধিরাম – “বাবু! বাবু! রাতের খাবার হয়ে গেছে, চলুন খেয়ে নেবেন।”
নিধিরামের ডাকে বৃদ্ধের সংজ্ঞা ফিরল, তিনি চোখ খুলে দেখলেন যে, তিনি এইমাত্র একটি স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে অপরাধী ধরা পড়েছে। আসলে চেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
চোখ মুখ মুছে নিয়ে তিনি বললেন, “নলিনীকে ডেকে নে, আমি আসছি।”
পর্বঃ ৪
কিছুদিন কেটে গেল, কোনও অপরাধী ধরা পড়ল না। নলিনী মানসিকভাবে ক্রমে ভেঙ্গে পড়তে লাগল। বৃদ্ধ মনে মনে নিজেকে এবং বহিঃরঙ্গে নলিনীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।
অনিমেষের আনাগোনা বৃদ্ধি পেল, নলিনীকে সেও অনেক সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তেমনভাবে বিশেষ কোনও লাভ হল না।
বৃদ্ধ – “কেসটা এইভাবে চললে বন্ধ হয়ে যাবে কি অনিমেষ?”
অনিমেষ মাথাটা নিছু করে বলল, “আর জাস্ট একটা কি দু’টো সপ্তাহ স্যার তারপর জাস্ট – ”
বৃদ্ধ – “আই ক্যান ‘আন্ডারস্ট্যান্ড’ অনিমেষ।”
অনিমেষ – “স্যার, মেডিকেল টেস্টে এমনিও কোনও রেপের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাছাড়া নলিনী যে ব্যাক্তিদের স্কেচ আঁকিয়েছে তাদের কোনও রেকর্ডই পাওয়া যায়নি, কীভাবে এগোব বলুন স্যার?”
বৃদ্ধ – “অনিমেষ কালো ইন্ডিগো গাড়ির কোনও খোঁজ কি পাওয়া গেছে?”
অনিমেষ – “স্যার গাড়ির নম্বর নলিনী বলতে পারেনি। তাছাড়া এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না, তাই সেটারও কোনও খোঁজ মেলেনি।”
বৃদ্ধ – “কিন্তু অনিমেষ মেয়েটা যে দিনে দিনে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে, একটা কিছু না হলে জানি না কী করবে! তাছাড়া ওর বাবা অনেকবার ওকে নিয়ে যেতে চাইছেন কিন্তু ও যেতে চাইছে না।”
অনিমেষ – “স্যার, আমি চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব, যদি কিছু করা যায়।”
বৃদ্ধ – “নলিনী মা, তুই কোনও চিন্তা করিস না, অনিমেষ আছে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নলিনী – “কাকু, আমি জানি কোনও প্রমাণ জোগাড় করা যায়নি, তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি, আমি বাবার সামনে কীভাবে যাব কাকু?”
বৃদ্ধ – “মা ধৈর্য রাখ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বিকেলে অনিমেষের ফোন এল সে বলল, “স্যার, একবার যদি আপনি থানায় আসেন ভালো হয়, আর স্যার নলিনীকে নিয়ে আসতে হবে না একা এলেই হবে।”
বৃদ্ধ থানায় এসে দেখা করলেন অনিমেষের সাথে।
অনিমেষ বলল, “স্যার, সেদিন নলিনী যে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল সেই বন্ধু কাল লন্ডন থেকে ফিরেছে আমি তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম, ওঁর থেকে জানতে পারি নলিনী সেদিন রাত ১২টা নাগাদ ওঁর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় আর ঘটনাটা ঘটেছে আনুমানিক রাত ২টো নাগাদ। তাহলে প্রশ্ন হল মাঝের এই সময়টুকু নলিনী কোথায় ছিল?”
বৃদ্ধ – “নলিনীর বাবার সাথে একবার আমার মনে হয় কথা বলা দরকার অনিমেষ।”
অনিমেষ – “কিন্তু স্যার, ওই মানুষটা নিজের মেয়ের কেসে কোনও সাহায্যই আমাদের করবেন না, উনি সময়ই দিতে চাইছেন না।”
অনিমেষ একটু থেমে বলল, “আর স্যার, আরো একটা কথা। নলিনী সেদিন ড্রাগ নিয়েছিল। ওর ব্লাড স্যাম্পেলে ‘LSD’ পাওয়া গেছে।”
বৃদ্ধ – “হ্যাঁ, হতে পারে অপরাধীরা ওকে ড্রাগস খাইয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে।”
অনিমেষ – “হ্যাঁ, স্যার হতে পারে। কিন্তু যে কোনওদিন ‘LSD’ নেয়নি তাকে একবার এই ড্রাগ দিলে যে তার পক্ষে তিনজন লোকের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”
বৃদ্ধ – “তার মানে!? কী বলতে চাইছ তুমি অনিমেষ?”
অনিমেষ – “স্যার, নলিনী আগে থেকে ড্রাগ নিত বলে আমার ধারনা। তাই আমি ওকে একবার জেরা করতে চাই।”
বৃদ্ধ – “কিন্তু নলিনীর মানসিক অবস্থায় ওকে জেরা করা কি ঠিক হবে? তাও আবার শুধু একটা ধারনার ভিত্তিতে?”
অনিমেষ – “তাহলে স্যার এই প্রশ্নের উত্তর না জানলে কীভাবে কেসটা শেষ হবে?”
বৃদ্ধ – “আমার দৃঢ় বিশ্বাস অনিমেষ, নলিনী ড্রাগ নিতে অভ্যস্ত বলে মনে হয় না।”
অনিমেষ – “স্যার, আমি কাল একবার আপনার বাড়ি যাব। একটু কথা বলে দেখি নলিনীর সাথে তারপর ভাবা যাবে।”
বৃদ্ধ – “দেখ ও যেন বুঝতে না পারে যে তুমি ওকে জেরা করছ।”
অনিমেষ – “আমি নিশ্চই চেষ্টা করব স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না।”
বৃদ্ধ – “আচ্ছা ঠিক আছে আজ তবে চলি।”
পর্বঃ ৫
পরদিন বিকেলে অনিমেষ এসে হাজির হল পরিতোষ স্যারের বাড়ি। নলিনী চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হলে বৃদ্ধ তাকে বসতে বললেন, তারপর একটা ফোন কলের বাহানায় তিনি ঘরের বাইরে চলে গেলেন। অনিমেষ এর আগে নলিনীর সাথে কথা বলেছে, কিন্তু তখন সে তার সাথে কথা বলেছে পুলিশের ভঙ্গিমাতে। এখন সে তাকে একজন বন্ধু রূপে ধরা দিতে চাইল কিন্তু মুখে কোনও কথা বলতে পারল না। নলিনী তার মুখের চাহনিটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কি কিছু বলবেন?”
অনিমেষ – “না মানে তেমন কিছু নয়। কিন্তু মানে, আমি জানতে চাইছিলাম যে আপনি কেমন আছেন?”
নলিনী – “ভালই আছি। কাকু যেভাবে আমার খেয়াল রেখেছেন, সত্যি বাবাও কোনওদিন আমার এত খেয়াল রাখেননি।”
অনিমেষ – “স্যার মানুষটাই সত্যি খুব মানবিক, কিন্তু বাইরেটা একেবারে শক্ত।”
নলিনী – “তা আমি বেশ বুঝেছি। তাইতো উনি কতবার নিজের স্ত্রীর গল্প আমাকে বলেছেন, সত্যি উনি কেন যে ওঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কে জানে?”
অনিমেষ – “আমি স্যারকে ওঁর বিয়ের আগের সময় থেকে চিনি। ওই ঘটনার পর থেকেই কেমন যেন বদলে গেলেন।”
নলিনী – “সত্যি, আমার মা মারা যাবার পরে আমিও কেমন যেন বদলে গিয়েছিলাম। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। তারপর দিদিমা আমাকে মানুষ করেছেন। উনিও একদিন চলে গেলেন, সেই থেকেই বাড়িতে খালি আমি আর বাবা।”
অনিমেষ – “কেন আপনার বাবা আপনাকে ভালবাসেন না?”
নলিনী – “জানি না, কোনওদিন সময়ই দেননি আমাকে। খালি নিজের কাজ, কালচার নিয়ে ডুবে থেকেছেন।”
অনিমেষ – “আচ্ছা আপনি ‘LSD’-র নাম শুনেছেন?”
নলিনী – “সেটাতো ড্রাগ বলে জানি।”
অনিমেষ – “হ্যাঁ, সেই ড্রাগ আপনার শরীর থেকে সেদিন রাতে পাওয়া গিয়েছে, আপনি কি এই ব্যাপারে কিছু জানেন?”
নলিনী – “দেখুন হতে পারে ওই দুষ্কৃতীরা আমাকে ওই ড্রাগ দিয়েছিল। কিন্তু আমার তেমন স্পষ্টভাবে কিছু মনে নেই।”
অনিমেষ – “আপনি সেদিন বন্ধুর বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিলেন সময়টা মনে আছে?”
নলিনী – “না, মনে নেই।”
অনিমেষ -”আপনার দিদিমা কি আপনাদের বাড়িতেই থাকতেন?”
নলিনী – “না, মানে আমাদের বাড়িটা দিদিমার নিজেরই, আসলে বিয়ের পরে আমার মা-বাবা আমার মামা বাড়িতেই থাকতেন।”
অনিমেষ – “আপনার দাদুর ব্যাবসাটাই বুঝি উনি এখনো চালাচ্ছেন?”
নলিনী – “হ্যাঁ, তবে তারপর বাবা নিজের আরো অনেক ব্যাবসা খুলেছেন। মা আগে দাদুর ব্যাবসাটা পুরোটা দেখতেন তারপর মা মারা যাওয়ার পরে বাবাই সব দেখাশোনা শুরু করেন।”
অনিমেষ – “আপনার মা’র কীভাবে মৃত্যু হয়?”
নলিনী – “মা’র ক্যান্সার ছিল, দীর্ঘদিন ভুগেছিলেন তারপর আর কিছু করা যায়নি।”
অনিমেষ – “আপনার বাবা আপনাকে অনেকবার বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছেন আপনি যাননি কেন?”
নলিনী প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চোখের কোণে জল নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
বৃদ্ধ ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু জানতে পারলে?”
অনিমেষ – “কিছু অজানা তথ্য জানা গেল, তবে এখন নলিনী বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে দেখছি।”
বৃদ্ধ – “হ্যাঁ, তা বটে কাল থেকে অফিসে জয়েন করছে।”
অনিমেষ – “বেশ ভালো, একবার খালি ওর অফিসে খোঁজখবর নিতে হবে, আচ্ছা ওঁর অফিসটা কোথায় আপনি জানেন?”
বৃদ্ধ – “হ্যাঁ, এই হল নলিনীর কার্ড।”
অনিমেষ – “আচ্ছা তবে চলি স্যার পরে দেখা হবে।”
পর্বঃ ৬
দুই সপ্তাহ কেটে গেল অনিমেষের কোনও ফোন এলো না। সে দেখা করতেও এল না। কেসটা বোধহয় বন্ধ হয়ে যাবে এই ভেবে মানসিকভাবে নলিনী নিজেকে অনেকটা প্রস্তুত করে নিয়েছিল, এমন সময় আচমকা বৃদ্ধের কাছে টেলিফোন এল, অপরাধী ধরা পড়েছে।
নলিনীকে নিয়ে বৃদ্ধ ছুটে গেলেন থানায়, সেখানে পৌঁছে তারা দেখলেন নলিনীর বাবা হাতকড়া পড়ে বসে রয়েছেন।
নলিনী – “আপনি কি মজা করছেন আমার সাথে? আমার বাবাকে কেন এইভাবে বন্দী করেছেন?”
অনিমেষ – “আমাকে ক্ষমা করবেন মিস নলিনী কিন্তু আপনার বাবাই এই কেসের মুল অপরাধী।”
নলিনী রেগে গিয়ে বলল, “আমার উপর তিনজন ব্যাক্তি রেপ করার চেষ্টা করে। আমার বাবা সেখানে কীভাবে অপরাধী হতে পারেন?”
অনিমেষ – “আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে দিন। স্যার প্লিজ, আপনি ওকে একটু শান্ত করুন।”
ওসি অনিমেষ একটু থেমে বলল, “আপনার সাথে সেদিন রেপের কোনও প্রচেষ্টাই হয়নি তাই মেডিকেল টেস্টে কোনও রেপের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।”
বৃদ্ধ – “মানে কি বলতে চাইছ তুমি অনিমেষ?”
অনিমেষ বলল, “স্যার তবে শুনুন –
সেদিন রাত বারটায় মিস নলিনী তার বন্ধুর পার্টি থেকে বেরিয়ে ওলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখনই মিস্টার সেন তার গাড়ি নিয়ে নলিনীকে রাস্তা থেকে পিকআপ করেন। লোডশেডিংয়ের জন্য রাস্তা অন্ধকার ছিল। এই সুযোগে তিনি নলিনীকে ‘LSD’-র ইঞ্জেকশন দেন। তারপর নলিনী ‘হ্যালুসিনেসনের’ জগতে চলে যান, ক্রমে মিস্টার সেনের সাথে তার ধস্তাধস্তি শুরু হলে নলিনী আচমকা চলন্ত গাড়ির গেট খুলে পড়ে যান। মিস্টার সেন তারপর নলিনীর পিছন পিছন ধাওয়া করেন। অবশেষে সে যখন আপনার বাড়িতে পৌঁছে কলিং বেল বাজিয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে যায়, তখন উনি সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যান। নলিনীর যখন চেতনা ফিরে আসে তখন তাঁর ‘হ্যালুসিনেসনের’ জন্য মনে হয় তিনজন ব্যাক্তি তাকে রেপ করার চেষ্টা করেছে। মিস্টার সেনের কথা তাঁর কিছুই মনে থাকে না। শুধু নলিনীর কালো ইন্ডিগো গাড়ির কথা মনে ছিল কারন ওই গাড়িটা নিজের বাড়ির গাড়ি আর বাকিটা সবই ড্রাগের ‘হ্যালুসিনেসনের’ ফলে নলিনীর মনে গড়ে ওঠা একটা অবাস্তব সত্য, কী ঠিক বললাম তো মিস্টার সেন?”
লকাপে বসে মিস্টার সেন মুচকি হেসে বললেন, “আপনার আজগুবি গল্পের কোনও প্রমাণ নেই মিস্টার অনিমেষ, তাছাড়া আমি আমার মেয়েকে ড্রাগ দিয়ে কী করতে চেষ্টা করব?”
অনিমেষ – “খুন করতে মিস্টার সেন, সিম্পিল ‘মার্ডারের’ জন্য যাতে মৃত্যুর পরে মনে হয় ড্রাগের নেশার কারণে তার এক্সিডেন্টে মৃত্যু ঘটেছে।”
নলিনী তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা এই কথাগুলো কি সত্যি? বাবা আনসার মি! চুপ করে থেকো না।”
মিস্টার সেন – “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আমি তোকে খুন করতে চেয়েছিলাম।”
নলিনী ধরা ধরা গলায় বলল, “কিন্তু কেন!!? তোমার নিজের মেয়েকে কেন তুমি খুন করতে চাইলে বাবা?”
নলিনী ক্রমে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। বৃদ্ধ নলিনীকে বুকে আগলে নিলেন।
ওসি অনিমেষ বলল, “বাকি গল্পটা আপনি বলবেন নাকি আমি বলব মিস্টার সেন?”
মিস্টার সেন বললেন, “আপনিই বলুন মিস্টার অনিমেষ।” (ব্যাঙ্গাত্মক হাসি)
ওসি অনিমেষ বলতে লাগলেন, “নলিনীর মাকে বিয়ে করে মিস্টার সেন ঘর জামাই হন। বিস্তর পয়সার মালিক হওয়ার স্বপ্নে তিনি নলিনীর মাকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু বৃদ্ধের মৃত্যুর পরে তিনি জানতে পারেন বৃদ্ধ তার সমস্ত সম্পত্তি তার মেয়ের নামে করে দিয়েছেন, তাই নলিনীর মার থেকে অনেক টাকা নিয়ে তিনি ব্যাবসা শুরু করেন কিন্তু সেই ব্যাবসা লাটে ওঠে। নলিনীর মায়ের ক্যানসার ধরা পরার পরে যাবতীয় সমস্ত সম্পত্তি সেই রোগের পিছনে খরচা হয়ে যায়, থাকার বলতে বৃদ্ধের পুরানো ব্যাবসা এবং নলিনীদের বাড়িটা। কিন্তু নলিনীর মা বাড়িটাকে নলিনীর নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন তাই সেই বাড়িতে মিস্টার সেনের কোনও অধিকার ছিল না। ব্যাবসায় সম্প্রতি তিনি বিশাল লস খান, বাজারে তার অনেক দেনা ছিল তাই তিনি নলিনীকে বাড়ি বিক্রির কথা বলেন এবং নলিনী তা নাকচ করে দেন। তাই এই ষড়যন্ত্র।”
মিস্টার সেন চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “ভুল, ভুল, মিস্টার অনিমেষ ভুল, আমি নলিনীকে বাড়ি বিক্রির কথা বলিনি। আমি তাকে বলেছিলাম কেবল বাড়িটা বন্ধক দিতে কিন্তু ও রাজি হয়নি। আমাকে বলেছিল ওই বাড়ি নাকি ওঁর মায়ের ইচ্ছা অনুসারে অনাথ আশ্রমকে দান করবে, আমার বাড়ি আমি অনাথ আশ্রমকে দান করতে দেব না। তাই এই কাজ আমি করেছি।”
নলিনী – “বাবা আমি তোমার মেয়ে, আমাকে খুন করতে তোমার একটুও বিবেকে বাধল না?”
মিস্টার সেন বললেন, “কে বলেছে তুই আমার মেয়ে? তুই আমার সন্তান নস, তোর মা মরার আগে আমাকে সত্যিটা তোকে বলতে বারণ করেছিল। কিন্তু আজ আমি আর সেই সত্য গোপন করতে পারলাম না।”
নলিনী প্রশ্ন করল, “মানে!”
মিস্টার সেন – “আমার সাথে তোর মায়ের বিয়ের আগেই তুই তার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলি, তাই সেই কথা জেনে আমি তোর মাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোর দাদু বিস্তর টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে ঘর জামাই বানিয়ে নিলেন। তোর শরীরে আমার রক্ত নেই।”
কথাগুলো শুনে নলিনী মূর্ছিত হয়ে পড়ল, তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।
নলিনীর মাথার পাশে বসে রয়েছেন বৃদ্ধ পরিতোষ, দরজার ধারে দাঁড়িয়ে ওসি অনিমেষ। নলিনী চোখ খুলে দেখল তাদের দু’জনকে, তারপর বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কাকু আমার বাবা নেই, মা নেই কেউ নেই, এই পৃথিবীতে আমি একা।”
বৃদ্ধ বললেন, “আজ থেকে আমি তোর বাবা তুই আমার মেয়ে।”
দূর থেকে অনিমেষ তাদের দেখে মনে মনে বলল, “রক্তের টান ছাড়াও সম্পর্ক গড়ে ওঠে।” দরজার বাইরে যাওয়ার মুখেই নলিনী তাকে ডাকল,
নলিনী – “আপনি কীভাবে বুঝলেন বাবা-ই অপরাধী?”
অনিমেষ – “আমার সেদিন থেকেই সন্দেহ হয় যেদিন উনি কেসটা বাতিল করে আপনাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর কালো ইন্ডিগো গাড়ি, আর আপনার বন্ধুর বাড়ির সামনে থেকে ঘণ্টা দু’য়েক উধাও থাকার ঘটনাটা।”
নলিনী অবাক হয়ে প্রশ করল, “কিন্তু এই দু’ঘণ্টা আমি কোথায় ছিলাম, এই দু’ঘণ্টা আপনি আপনার বাবার সাথে গাড়িতেই ছিলেন, আপনার বাবা আপনাকে কোনও নির্জন প্রান্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এরই মাঝে আপনার হঠাৎ চেতনা ফিরে আসে এবং আপনার সাথে তার ধস্তাধস্তি শুরু হয়। তারপর আপনি চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে যান, তাই আপনার গায়ে কেবল গাড়ি থেকে পড়ে গেলে যেমন আঘাত লাগে তারই চিহ্ন বর্তমান ছিল।”
নলিনী স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে কিভাবে যে আমি ধন্যবাদ দেব।”
অনিমেষ – “ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। আজ তবে চলি।”
অনিমেষ গেটের বাইরে বেরোতেই নলিনী তার হাত টেনে ধরল। বাইরে তখন পড়ন্ত সূর্যের আলো, তার মাঝে নলিনী অনিমিষের চোখে চোখ রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। দু’জনের থমকে যাওয়া চক্ষুযুগলের মাঝে একফালি নিষ্পাপ পক্ষীযুগলের ঘরে ফেরার দৃশ্য যেন উজ্জ্বল