চক্রান্তের শিকার| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | চৈতী চ্যাটার্জী| Bengali Detective Story
0 (0)

হঠাৎ মাথায় কিসের যেন আঘাত! লুটিয়ে পড়ল সুজন। দু’দিন কেটে গেছে সুজন বাড়ির বাইরে বের হয়নি আর। সুজন খুবই মিশুকে ছেলে সবাইকে আপন করে নিতে পারে তাই পাড়ায় ওর নামডাকও আছে। সুজনের মতো ছেলে তো বাড়িতে আটকে থাকবে না। দিনে একবার পাড়ায় বসে আড্ডা না দিলে ওর কেমন যেন দমবন্ধ লাগে, আর সেই ছেলে নাকি ঘরবন্দী। না লীনাও তো বাড়িতে নেই মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে গেছে। তাহলে ঝামেলা হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তাহলে সুজনের হলটা কী? এইসব আলোচনা করতে করতেই পাড়া প্রতিবেশীর লোক সুজনের বাড়িতে গিয়ে ডাকাডাকি করে। কিন্তু কোনও সাড়া না পেয়ে তাদের মধ্যে একজন দাসবাবু লোকাল থানায় ফোন করে পুলিশকে খবর দিল। সাথে সুজনের শ্বশুর বাড়িতেও এই খবরটা জানানোর প্রয়োজন, তাই লীনার ফোনে ফোন করল সুমনা বৌদি নামে পাড়ার এক প্রতিবেশী। লীনা মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে বেশ কিছুদিন হল। মেয়ের স্কুলের গরমের ছুটি চলছে তাই কদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেছে। মেয়ের স্কুল থাকলে তো যাওয়াই হয় না। তাই সুজন একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়েছে বাপের বাড়িতে। এখানে সারাদিন লীনার কত কাজ থাকে ওখানে গেলে ক’দিন অন্তত লীনা বিশ্রাম নিতে পারবে এই ভেবেই পাঠানো।।

কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে দেখে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ আর জানালাগুলোও ভিতর থেকে দেওয়া। তাই বাধ্য হয়ে ঘরের দরজা ভাঙতে হয়। ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঢুকে দেখলো সুজনের বডিটা পড়ে আছে মাটিতে। মাথায় চাপ রক্ত জমাট বেঁধে আছে আর গলায় ছুরির আঘাত। শ্বাসনালী কেটে দেওয়া হয়েছে। মাটিতেও নানা জায়গায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। গন্ধে টেঁকা যাচ্ছে না ঘরে! সবারই এই গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে তাও পাড়ার লোকজনের কৌতুহল এর কোনও খামতি নেই, উঁকি মেরে দেখে যাচ্ছে একবার হলেও। কী করে সুজন মারা গেল? কে মারল? এইসব চিন্তাভাবনা। যদিও পুলিশ সবাইকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল। পুলিশ এসে লীনাকে ফোন করে সুজনের মৃত্যু সংবাদ দেয়। পুলিশের বড় কর্তা মিঃ রায় তার এক অফিসারকে সারা বাড়ি তল্লাশির আদেশ দেন। কিন্তু সারা বাড়ি তল্লাশি করেও রহস্যজনক কিছু পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে এসে উপস্থিত হল লীনা। সঙ্গে বাবা ও এক দাদা। সুজনকে ওই অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে এবং ওর শরীরে রক্তের দাগ দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ল লীনা। পুলিশের বড় কর্তা ও তার সহকর্মী সুজনের বডিটা অ্যাম্বুলেন্স এ তুলে মর্গে পাঠিয়ে দিয়ে পাড়ার কিছু লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিল।।

এরপর মিঃ রায় লীনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য লীনার কাছে আসে। লীনার তখনও জ্ঞান আসেনি। লীনার বাবা আর দাদা লীনার জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত তখন। কোনও মতে লীনার জ্ঞান ফেরাতে সক্ষম হয়েছে এমন সময় এক পুলিশ অফিসার এসে উপস্থিত লীনার সামনে। সুজনের হত্যার ব্যাপারে সমস্ত ঘটনাবলি জানার জন্য কথা বলতে চাইছিলেন অফিসার লীনার সাথে। কিন্তু লীনার অবস্থা তখনও খুবই খারাপ। ও এখনও এই সব কিছু মেনে নিতে পারছিল না। ওর অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়ায় অফিসার পরের দিন থানায় যোগাযোগ করতে বলে চলে যান। লীনার বাবা ও দাদা লীনাকে নিয়ে ফিরে আসে বাপের বাড়িতে। ওখানে লীনাকে একা রেখে আসতে পারেনি। আর লীনার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। অতিরিক্ত কাঁদার ফলে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। আর তাছাড়া এবাড়িতে ওর ছোট মেয়েও আছে। মেয়েটা তো এসবের কিছুই জানে না। লীনার ছোট মেয়ে মাকে ছাড়া থাকতে পারে না। তাই একপ্রকার বাবা জোর করে লীনাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। বাবা বলেছিল যা থানা পুলিশ করার সব এবাড়ি থেকেই হবে।

পরের দিন সকালে বাবাকে নিয়ে লীনা থানায় আসে। মিঃ রায় অন্য একটা কেসের ব্যাপারে তার বন্ধু তথা সহকর্মীর সাথে আলোচনা করছিল। তাই লীনাকে ও তার বাবাকে এক কনস্টেবল কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করতে বলে। প্রায় পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর একজন কনস্টেবল এসে লীনাকে অপেক্ষা করতে বলে তার বাবাকে নিয়ে যায় অফিসারের ঘরে। অফিসার লীনার বাবাকে বসতে দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। প্রথমে লীনার বাবার কাছে জানতে চায় সুজনের সাথে তার বা তার স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন। তার বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল সুজনের। সুজনের সাথে লীনার সম্পর্ক কেমন ছিল। কোনও ঝামেলা হয়েছিল কিনা ওদের মধ্যে। সেই কারণেই লীনা বাপের বাড়িতে গিয়েছিল কিনা। সুজন শেষ কবে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল। ওখানে গিয়ে সুজন কি সবার সাথে ভালোভাবে কথা বলত এইসব। কোনওকিছু সন্দেহজনক উত্তর না পাওয়ায় লীনার বাবাকে যেতে বলল এবং এও বলেছিল বাইরে না যেতে। প্রয়োজন পড়লে আবার আসতে হতে পারে। এরপর লীনাকে ভিতরে ডাকা হয়। লীনা ভিতরে যেতেই অফিসার একটা একটা করে প্রশ্ন করতে থাকে। প্রথমেই জানতে চায় ওর সাথে সুজনের সম্পর্ক কেমন ছিল। তারপরে ওদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল কিনা? সুজন কেমন মানুষ ছিল। সুজন বাড়িতে কতটা সময় দিত। সুজনের বিবাহ বর্হিভূত কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা। লীনা এ বিষয়ে কিছু জানে কিনা। লীনার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা। দু’জনের মধ্যে শেষ কখন কথা হয়। বাবার বাড়িতে যাওয়ার পর সুজন লীনার সাথে যোগাযোগ করেছিল কিনা ইত্যাদি। জিজ্ঞাসাবাদের পর এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়ায় লীনাকে ছেড়ে দেন অফিসার। লীনাকে বলা হয় আবারও তাকে আসতে হবে। লীনা বেরিয়ে যাওয়ার পর এক অফিসারকে লীনার ওপর নজর রাখতে বলল মিঃ রায়। এরমধ্যে সুজনের ময়নাতদন্ত হয়ে যায়। লীনা তার বাড়িতে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজনকে শেষবারের মতো নিয়ে আসা হয় তার বাড়িতে। পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই এসেছে সুজনের বাড়িতে। সবাই নানারকম কথাবার্তা বলছে। সুজনকে এই অবস্থায় দেখে লীনা আর নিজেকে সামলাতে পারছে না। সুজনকে আগলে বসেছিল সবসময়। এবার যে সুজনকে নিয়ে যেতে হবে, অনেক দেরি হয়ে গেছে, আরও দেরী করলে কাজ মেটাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। সুজনের বাবা মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। কাছের লোক বলতে এক দাদা আর বৌদি। কিন্তু ওরা অনেক দূরে থাকে ওরা আসতে পারেনি। খবর দেওয়া হয়েছে হয়তো চলে আসবে এর মধ্যেই। তাই সুজনের শেষ কাজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও লীনাকেই করতে হল। কাজ মিটিয়ে লীনা আর ওর বাড়িতে ফিরে যায়নি। লীনা ওই বাড়িতে একা থাকতে পারবে না। ওই বাড়িতে যে, ওর আর সুজনের অনেক স্মৃতি আছে। তাই লীনা ওর বাবার সাথে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু মাঝপথে যেতেই লীনার ফোনে একটা ফোন আসে। লীনা ওর বাবাকে বলে, ওর এক বন্ধু খুব অসুস্থ হসপিটালে ভর্তি আছে। ওকে একবার সেখানে যেতে হবে। এই বলে বাবাকে বাড়ি চলে যেতে বলে। লীনা গাড়ি থেকে নেমে কোথায় যেন চলে যায়।।

ঠিক দু’দিন পর পুলিশের হাতে এসে পৌঁছায় সুজনের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। রিপোর্ট আসার পরের দিন সকালে পুলিশ গিয়ে হাজির হয় লীনার বাপের বাড়িতে। লীনাকে সন্দেহ করে এবং আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লীনাকে থানায় ধরে নিয়ে যান তারা। প্রথমে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয় লীনা। যাতে লীনার ওপর কোনও সন্দেহ না পড়ে। পুলিশ যতই লীনাকে দোষী প্রমাণিত করতে চাইছে ততই লীনা নিজেকে নির্দোষ বলছে। কিন্তু কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের সামনেও লীনা একমূহুর্তের জন্য ও ভেঙে পড়েনি, স্বীকার করেনি যে সব দোষ তার। পুলিশের সন্দেহ হয় এবার লীনার ওই পাড়াতুতো দাদাকে। সন্দেহ হওয়া মাত্রই পুলিশ ওই দাদাকে নিয়ে আসে থানায়। কিন্তু এবারেও সেই এক ঘটনা, কেউ স্বীকার করছে না। লীনার ওই দাদা বলেছে, সে এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। একই পাড়ায় থাকার ফলে ছোট থেকেই লীনা বা তার বাড়ির সবার সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভালো এর বেশি আর কিছু নয়। সেই কারণেই এই ঘটনায় লীনার বাবা ওকে এনেছিল। লীনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ও কিছুই জানে না। তাই অযথাই ওকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

মাঝে কেটে গেছে কিছুদিন। সুজনের কাজও মিটে গেছে। কিন্তু এখনও পুলিশ এই ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। সুজনের মৃত্যু আস্তে আস্তে গুরুত্বহীন হচ্ছিল। এরই মধ্যে লীনার ওই দাদা সকলের চোখের আড়ালে কোথায় যেন চলে গেছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই রাতে যখন ঘুমোচ্ছে ঠিক সেই সময়ে লীনার দাদা বাড়ি থেকে চলে যায় কাউকে কিছু না বলে। তিন দিন কেটে গেছে লীনার দাদার কোনও খোঁজ মেলেনি। তাই তিন দিন পর ওই দাদার স্ত্রী সুমিতা থানায় এসেছিল সবকিছু জানিয়ে নিখোঁজ ডায়েরী করতে। সুমিতা এসে বড়বাবুকে সব ঘটনাই বলে। পলাশ ওরফে লীনার ওই দাদা সুমিতার ওপর কী রকম মানসিক অত্যাচার করত। যদিও তারা নিজেরা দেখেই বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর প্রথম কিছু মাস সংসার ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু তারপর পলাশ যে কোম্পানিতে কাজ করত, সেখান থেকে চুরির দায়ে ওকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পলাশের বাড়ি থেকে চুরির কোনও জিনিস পাওয়া যায়নি। তাই কোম্পানি ওকে জেলে দিতে পারেনি। ও পরে সুমিতাকে এটা বোঝাতে পেরেছিল যে ও কোনও চুরি করেনি। কোম্পানি ওকে মিথ্যা বদনাম দিয়েছে। সুমিতাও ওর সব কথা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পলাশের ব্যবহার বদলে যেতে থাকল। সুমিতাকে সে জানায় সে এবার একটা নতুন ব্যবসা শুরু করবে তাই সুমিতা যেন ওর বাবার থেকে টাকা আনার ব্যবস্থা করে। কিন্তু সুমিতা টাকা আনতে অস্বীকার করায় ওর ওপর মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। আস্তে আস্তে মানসিক থেকে শারীরিক নির্যাতনও শুরু হতে থাকে। সুমিতাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও সুমিতা ওর বাবার কাছে টাকা চাইতে পারেনি। কারণ সুমিতার বাপের বাড়ির অবস্থা ভালো নয় তার ওপরে ওর এক ছোট বোন আছে তারও বিয়ে দিতে হবে। বাবা কোথা থেকে টাকা পাবে। কিন্তু সুমিতার একটাই চিন্তা – যে ওকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল, যে ওকে মানসিক নির্যাতন করত, সে-ই আজকে নিখোঁজ। সুমিতা এই সব কথা বড়বাবুকে বললেও, ওর অন্য কোনও মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে কিনা সেই বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি। এরপর বড়বাবু জানতে চায় লীনার সাথে ওদের বা পলাশের সম্পর্ক কেমন এইসব। সুমিতার থেকে সবটা জেনে একটা ডায়েরী লিখে নিয়ে সুমিতাকে যেতে বলা হয়। ঠিক এর পরের দিন লীনা গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। ওর শরীরটা দু’দিন ধরে ভাল নেই। তাই যেতে হয়েছিল। বাবা যাবে বলেছিল ওর সাথে। ওই একপ্রকার জোর করে একা গিয়েছিল। কিন্তু দিন গড়িয়ে রাত হয়ে গেল লীনা বাড়ি আসেনি। লীনা বাড়ি না ফেরায় ওর বাবা ওর পাড়া প্রতিবেশী বন্ধু বান্ধব সবার বাড়িতে গিয়ে বা ফোন করে জেনেছে লীনা আছে কিনা। কিন্তু না লীনা কারোর বাড়িতেই নেই। এরপর লীনা যেখানে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল সেখানেও যায় লীনার বাবা। কিন্তু না লীনা সেখানেও যায়নি। তাহলে লীনা ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার নাম করে কোথায় গেল। আর কোনও উপায় না দেখে লীনার বাবা থানায় যায় লীনার খোঁজ পাওয়ার জন্য। থানায় গিয়ে সবটা জানাতে সবারই সন্দেহ গিয়ে পড়ে পলাশ আর লীনার প্রতি। কিন্তু খুঁজে পাবে কী করে তাদের। তার পরের দিন হঠাৎই কিছুক্ষণ এর জন্য পলাশের ফোন খোলা পায় পুলিশ। সুমিতা ফোন করেছিল এটা বলার জন্য যে, সে ভালো আছে আর ব্যবসা করতে বাইরে গেছে। যেহেতু সুমিতার ফোন ট্র্যাপ করেছিল পুলিশ। তাই সুমিতা বলার আগেই পুলিশের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় পলাশের বর্তমান জায়গা ঠিক কোথায়। কথামত বড়বাবু তাদের লোকজন লাগিয়ে দেয় পলাশকে খুঁজে বের করার জন্য। শেষ পর্যন্ত পলাশক পাওয়া যায় ওর এক বোনের বাড়িতে। ওখানেই লুকিয়ে ছিল পলাশ। শুধু পলাশ বললে ভুল হবে লীনাকেও পাওয়া যায় ওখান থেকে। পলাশের বোন প্রথম থেকেই পলাশের আর লীনার সম্পর্কের ব্যাপারে সবটা জানত। ও ভীষণ ভাবে চেয়েছিল যাতে ওরা এক হয়। তাই ওদের বিপদের দিনে ওই বোন ওদের আশ্রয় দেয়। দুজনকে সরাসরি নিয়ে আসে থানায়। দু’জনকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। দু’ঘা দিতেই পলাশ সুড়সুড় করে বলতে থাকে সব ঘটনার কথা। যদিও লীনা তার আগেই স্বীকার করে নিয়েছিলো সব দোষ তার। তবুও ছেলেটার থেকে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিল অফিসার।

লীনা জানায় সুজনকে বিয়ে করার আগে থেকেই তাদের সম্পর্ক ছিল। ওদের সম্পর্ক ছিল ছোটবেলা থেকেই। যখন লীনা স্কুলে যেত, কোচিং এ যেত পলাশ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত। সেই থেকেই ওদের সম্পর্কের শুরু। যদিও লীনার বাড়িতে কেউ জানত না এই সম্পর্কের ব্যাপারে। পরে বড় হওয়ার পর যখন লীনার বাবা জানতে পারে লীনার আর পলাশের কথা। তখন কেউ মেনে নেয়নি এই সম্পর্কের কথা। এই কথা জানার পর লীনাকে ওর বাবা বোঝায় এতে ও সারাজীবন ভালো থাকবে না। তাই পলাশকে ভুলে যেতে বলে। লীনার জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ আসে। যেহেতু পলাশের ভালো আয় ছিল না তাই লীনারও আপত্তি ছিল না ঐ ছেলেকে বিয়ে করতে। কিন্তু সম্পর্ক নষ্ট হল না লীনা আর পলাশের।

সুজনকে বিয়ে করলেও বিয়ের পরেও চলতে থাকে তাদের এই সম্পর্ক সুজনের চোখের আড়ালে। একদিকে সুজনের সাথে লীনার ভালো বিবাহিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবার অন্যদিকে পলাশের সাথে। এরই মধ্যে লীনার কোলে ওর মেয়ে আসে। মেয়েকে বড় করে তুলতে ওদের সম্পর্কের কিছুদিন বিরতি থাকলেও মেয়ে একটু বড় হতেই আবারও শুরু হয় পলাশের যাতায়াত লীনার বাড়িতে। পাড়া প্রতিবেশী দেখলেও তেমন সন্দেহ করত না প্রথমদিকে। সবাইকে বলেছিল লীনা, “ও আমার দাদা।” তাই কারোর মনেই সন্দেহ হয়নি। সুজনের সাথেও প্রথম থেকেই পলাশের সম্পর্ক ভালো ছিল। তাই সুজনের মনে কোনওদিন পলাশের ওর বাড়িতে আসা নিয়ে কোনও সন্দেহ তৈরি হয়নি। কিন্তু একদিন সুজনের শরীর ঠিক না থাকায় তাড়াতাড়ি অফিস থেকে সে বাড়ি ফিরে এসে লীনাকে পলাশের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পায়। মেয়ে পাশের ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে তখন। এইসব দেখে সুজন আর ঠিক থাকতে পারেনি ওই দিন, লীনার গালে এক চড় বসিয়ে দেয়।

বাড়ির ঝামেলা ও চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় ওদের মেয়ের। বাবা মায়ের অশান্তি দেখে সেও কাঁদতে শুরু করে দেয়। লীনা মেয়েকে ভোলানোর জন্য পাশের ঘরে নিয়ে চলে যায়। রাতে লীনা সুজনের কাছে ক্ষমা চায়, বলে আর এমনটা হবে না আর কোনওদিন, ওকে যেন সুজন আর একবার সু্যোগ দেয়। মেয়ের কথা ভেবে সুজন ক্ষমাও করে দেয় লীনাকে। তাছাড়া সুজন লীনাকে বিশ্বাস করত নিজের থেকে বেশি। বেশ কিছুদিন লীনা ভালোভাবেই সুজনের সাথে সংসার করে। ওকে সন্দেহ করার কোনও সুযোগ দেয়নি। তবে কিছুদিন যোগাযোগ না রাখলেও পরে আবারও যোগাযোগ করে লীনা পলাশের সাথে। প্রায়ই দেখা করত তারা বাইরে, বাড়িতেও আসতে শুরু করে পলাশ দুপুর করে। সুজন পাড়ার এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পায় লীনা আর পলাশের ব্যাপারে। ওই বন্ধু লীনা আর পলাশকে একদিন একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে দেখেছিল। আর ও একদিন দেখেছিল সুজনের অনুপস্থিতিতে ওর বাড়ি আসতে। এইসব শুনে সুজন বাড়িতে এসে লীনার থেকে জানতে চায় সবটা। প্রথমে লীনা পুরো অস্বীকার করে ঘটনাগুলো। বলে যে ওকে মিথ্যা ফাঁসানোর জন্য সুজনের বন্ধু এমন সব করছে। সুজন লীনাকে সুযোগ দিয়েছিল সবটা স্বীকার করার। কিন্তু বারে বারে অস্বীকার করায় সুজন লীনার বাবা মাকে খবর দেয়। ওঁরা আসেন সবটা শোনেন প্রথমে মেয়ের হয়েই কথা বলেন। কিন্তু সুজন সবটা জানাতেই তখন লীনার বাবা সবটা স্বীকার করে। উনি জানতেন, লীনা আর পলাশের সম্পর্কের ব্যাপারে। তিনি এও বলেন, তিনি মেয়ের হয়ে কথা দিচ্ছেন লীনা আর এমন কাজ করবে না। কিন্তু লীনা তা বুঝতে চায় না। ও মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে ও পলাশের সাথেই সম্পর্ক রাখবে। লীনার বাবা সুজনকে বুঝিয়ে বলে ‘কিছুদিনের জন্য লীনাকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে। লীনা একটু ঠিক হলেই ওকে আবার দিয়ে যাবে’। এইভাবেই কেটে গেল কিছুদিন। মেয়ের বায়নাতে আবার ফিরে এল লীনা সুজনের কাছে। কিন্তু এলে কি হবে ওর মন তো পলাশের কাছেই আছে। তাই আবারও সুজনকে ঠকিয়ে যোগাযোগ শুরু করে ওরা। কিন্তু ওই যে সত্যি কখনও চাপা থাকে না। সুজনের এবারের সন্দেহই ঠিক প্রমাণিত হল। কিন্তু লীনাকে কিছু বলতে গেলেই ও ভীষণ অশান্তি করে। সুজনের এখন আর অশান্তি ভালো লাগে না। বন্ধুদের কাছেও মুখ দেখাতে পারে না সুজন ঠিক ভাবে। সবাই ওকে নিয়ে নানান আলোচনা করে। একবার তো সুজন নিজেই ভেবেছিল আত্মহত্যা করবে এইসব থেকে বাঁচতে। কিন্তু মেয়ের কথা ভেবেই আর করতে পারেনি। মেয়ে যে বাবাকে খুব ভালোবাসে। এই নিয়ে শুরু হয় লীনা ও সুজনের মধ্যে নিত্যদিন অশান্তি। একদিন চরমে পৌঁছায় তাদের এই অশান্তি। লীনা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেয়েকে নিয়ে।

বাপের বাড়িতে এসে মেয়েকে রেখে দিয়ে দেখা করে পলাশের সাথে, খুলে বলে সবকিছু যে ও আর এইভাবে বাঁচতে পারছেনা। দুজনে মিলে ঠিক করে সুজনকে তাদের মধ্যে থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তবেই ওরা একসাথে থাকতে পারবে। আর পলাশের স্ত্রী ওকেও হয় ডির্ভোস না হয় খুন করবে। প্ল্যানও করে ফেলে ওরা কি ভাবে কী করবে। লীনা জানত যে ওই বাড়ির ছাদের দরজাটা ভাঙা। গতবারের ঝড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এখনো ঠিক হয়নি দরজাটা। সুজন অফিস থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে বসে একটু টিভিতে খবর দেখে। যেহেতু লীনা ছিল না তাই বাড়িতে ফিরে একাই বসে ছিল। ঠিক ওই সময় পলাশ পিছন থেকে এসে একটা শক্ত গাছের ডাল বসিয়ে দেয় সুজনের মাথায়। সুজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ততক্ষণে মাথায় আঘাত লাগার কারণে অজ্ঞান হয়ে যায় সুজন। তখনও প্রাণ ছিল সুজনের। ঠিক তখনই ছুরি গলায় বসিয়ে দেয় কোনও কিছু না ভেবেই। সুজন অফিস থেকে ফেরার আগেই অপেক্ষা করছিল বাড়ির ছাদে। পাইপ বেয়ে উঠেছে সে, আবার ঐ পথ ধরেই পালিয়ে যায় সে। যাওয়ার সময় পাশের পুকুরে ছুরি ফেলে দিয়ে যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না শুধু একটা ফোন কল আর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এর জন্য। অফিসার এর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অফিসার লীনার ফোন ট্র্যাপ করতে হুকুম দিয়েছিলেন নিম্নতম কনস্টেবলকে। তাতেই কেস সলভ হয়ে গেল অর্ধেক, আর বাকিটা লীনাকে জেরা করে। পাড়া প্রতিবেশীদের কথাতেও কিছুটা ইঙ্গিত পেয়েছিলেন ঐ অফিসার, কিন্তু প্রমাণ যোগাড় করতে সময় লেগে গেল এই যা!

যে কোনও অপরাধেরই উদ্দেশ্য খুঁজলেই, অপরাধীকে ধরে ফেলা সহজ এটাই প্রমাণ হয়। শুধু মাঝে মাঝে যা সময় লাগে এই যা। তবে অপরাধী অপরাধ করে কখনো বেঁচে যায় না!

-সমাপ্ত-

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post শব্দভেদী| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | হীরক সানা| Bengali Detective Story
Next post কালো চোখের রহস্যে| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | সন্দীপ মন্ডল| Bengali Detective Story