যে ভিলেন সেই হিরো| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | প্রতিম ভট্টাচার্য| Bengali Detective Story
0 (0)

আমি একটা ছোট অফিসে কাজ করি। বুদ্ধি দিয়ে ছোটখাটো রহস্যরও সমাধান করেছি। আমার ছোটবেলার বন্ধু রমেশ একদিন আমায় ফোন করে পার্টি করবে বলে তার বাড়ি ডাকে। একসময় যখন আমি স্কুলে পড়তাম রমেশ আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। এখন অনেকদিন তার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এতদিন পরেও যে সে আমাকে মনে রেখেছে তা দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। বিকেলবেলা অফিস থেকে বেরিয়ে ওর বাড়ি গেলাম। আমিতো জানতামই না রমেশের কবে বিয়ে হয়ে বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে। রমেশ পরিবারের সবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিল। ওর স্ত্রী’র নাম প্রিয়াঙ্কা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আজ পার্টি কি উপলক্ষে? রমেশ বলল আজ আমার জন্মদিন তাই আজ এই এত কিছুর আয়োজন। আমরা পার্টি করবার সময় হঠাৎ দোতলার ছাদ থেকে একটা কারোর পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পাই। আমরা নিচে নেমেই দেখি রমেশের স্ত্রীয়ের মৃতদেহ বাড়ির গেটের সামনে পড়ে আছে। রমেশ তার স্ত্রীয়ের মৃতদেহ দেখে দুঃখে পাগলের মত করছে‌। সবাই ভেবে নিচ্ছে উনি হয়তো সুইসাইড করেছেন।

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, “উনার কি সুইসাইড করার মত কোন কারণ আছে?”

রমেশ বলল, “না।”

তখনই ওর দাদা চিৎকার করে বলল, “এসব কি বলছিস রমেশ মনে নেই তোর সঙ্গে বৌদির কত ঝগড়া হলো আগের দিন।”

আমি বললাম, “কিসের ঝগড়া হয়েছিল?”

রমেশ বলল, “না না কিছু না। ওই সামনে দুর্গা পুজো আসছে তাই প্রিয়াঙ্কা অনেক জামা কাপড় কিনতে চাইছিল কিন্তু মা পারমিশন দিচ্ছিল না অত জামা কাপড় কেনার। সেই নিয়ে ঝামেলা আর কি।”

আমার দেখে মনে হলো কিছু একটা রহস্য আছে এর ভেতর। আমায় কথাটা বলবার পর রমেশ চোখ মেরে ওর ভাই বিজয়কে থামিয়ে দিল। আমি ওদের বাড়ির ছাদটায় যেতে চেয়েছিলাম। ছাদে গিয়ে মনে হল মৃতদেহটা ছাদের সামনের দিক থেকে সোজাসুজি পড়েছে। যে জায়গাটা থেকে মৃতদেহটা পড়েছে সেখানেই একটা সিগারেট পড়ে থাকতে দেখলাম। আমার মনে হল কারোর পকেট থেকেই পড়ে গেছে। আর কিছু সেরকম ভাবে পেলাম না যেখান থেকে ক্লু পেতে পারি। আমি রমেশের বাবার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। রমেশের বাবা প্রথমে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাননি। খুব জোরজারি করাতে বাধ্য হয় সে আমার সঙ্গে কথা বলতে। সে তার বৌমাকে নিয়ে একদম খুশি নয়।

সে খালি খালি বলে যাচ্ছিল, “ওই মহিলাটা সুবিধার নয়। মরেছে বাচাঁ গেছে। চরিত্রেরও কোন ঠিক ছিল না। তার ওপর আবার মুসলিম ধর্মের মেয়ে।”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার হঠাৎ মনে হল কেন ওনার চরিত্রের দোষ আছে? আপনার ছেলেতো দেখে মনে হল ওনাকে নিয়ে খুব খুশি।”

সে তখন বললো, “আমি অত কিছু জানি না। আপনি চাইলে নিজে তদন্ত করে খোঁজ করতে পারেন এইসব। তবে এটুকু বলে দেই আপনি যদি এর তদন্ত করেন তাহলে আপনার বিপদ হতে পারে।”

আমি বললাম, “আমি বিপদে ভয় পাইনা। একটা রহস্য যখন পেয়েছি তার সমাধান না করে আমি ছাড়ছি না।”

আমি তারপর রমেশের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই। রমেশের বাবা বার-বার বলছিলেন, “আমার স্ত্রীয়ের মাথায় একটু গন্ডগোল আছে। কি বলতে কি বলে ফেলবে। ওনাকে আর আপনি জ্বালাবেন না।”

রমেশ বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে বলল, “না বাবা। আমার বন্ধু যখন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে তখন তার নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। দয়া করে তুমি আর ওকে বাধা দিও না।”

আমি যখন রমেশের মায়ের ঘরে গেলাম আমার মনে হল উনি আমাকে কিছু বলতে চাইছেন। আমি ওনাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার বৌমাকে কেমন লাগতো?”

সে বলল “আমি আমার বৌমাকে খুব ভালবাসতাম। সে খুব শান্ত, ধীর, স্থির ছিল। কি করে যে কি হয়ে গেল আমি নিজেও জানি না। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি যে আমার বৌমা কোনদিনও সুইসাইড করতে পারে না।”

ওনার মুখ চোখ দেখে আমার মনে হয়েছিল উনি হয়তো ভয় পেয়ে কিছু একটা বলছেন না। উনি আমায় আরও বললেন, “সোনা তুমি এই কেসটার সুরাহা করো প্লিজ।”

আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে একটু রমেশের ঘরটা দেখতে চাই। রমেশের ঘরটা দেখে বুঝতে পারলাম ওই মহিলা সত্যিকারেরই খুব ভাল ছিল না। ঘরভর্তি কনডমের প্যাকেট। চারিদিকে দেয়ালে সব উল্টোপাল্টা ছবিতে ভরা। হঠাৎ খুঁজতে খুঁজতে একটা খবরের কাগজ পেলাম। খবরের কাগজটা আমি আমার সাথেই নিয়ে গেলাম।

আমার ছোটবেলার বন্ধু পবন রহস্য খুব ভালোবাসে। ওর সঙ্গেও আমার অনেকদিন সম্পর্ক নেই। পবন আমাকে দাদার মতই শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। ওকে আমি আমার রহস্যের খোঁজে কম্পানিয়ন হিসেবে ডাকলাম। প্রথমদিন ও যখনই এলো আমি ওকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। আমার এবং ওর দু’জনেরই এইটা ভেবে অবাক লাগছিল যে যখন খুনটা হয়েছিল, রমেশের বাড়ির মেন গেটের তালা বন্ধ ছিল ও বাড়ির সবাই পার্টিতেই ব্যস্ত ছিল। এইটাও আবার খটকা লাগছিল যে সিগারেটটা কি করে এলো ছাদে? আমি বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞাসা করাতে বলেছিল ওদের বাড়ির কেউ সিগারেট খায় না। তার পরের দিন সকালেই রমেশের দাদা আমার বাড়িতে এল। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও কোন কারণে খুব ভয় পেয়ে আছে।

আমি বললাম, “একটু জল খেয়ে পেটের কথা সব খুলে বলুন দেখি।” তাকে দেখে এটুকু বুঝতে পারা যাচ্ছে যে তার চরিত্রের অল্পবিস্তর দোষ আছে। আমার স্ত্রী সুচিত্রা ও আমার মেয়ে তনুশ্রীর দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে ছিল সে। তারপর কিছুক্ষণ টানা চোখে চোখ রেখে তাকানোর পরে আমাকে বলল, “দাদা ভালোই তো বউকে বিয়ে করেছেন।”

আমি বললাম, “ধন্যবাদ কিন্তু এসব নকল কথা ছেড়ে আসল কথা শুনতে পারলে আরো বেশী ভালো লাগবে।”

সে একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ এবার তাহলে বলা শুরু করি। আমার না একটা জিনিস খুব প্রিয়। সেটা হল মেয়ে পটানো আর লোক ঠকানো। এ রকম কত মেয়েকে পটালাম? সত্যি কথা বলতে আমি মেয়েদের কাছে যাই না। মেয়েরাই আমার কাছে আসে। সব মেয়েরাই আমাকে খুব ভালোবাসে। যে মেয়ে ভালবাসে না তাকে আমি নিজের দায়িত্বে ভালবাসিয়ে নি। আপনার স্ত্রীকেও আমার খুব ভালো লেগেছে।”

আমি বললাম, “এসব আপনি আমাকে বলছেন কেন?”

সে বলল, “দরকার আছে বলেই বলছি।”

সে অনেকগুলো সাদাকালো ছবি বের করল। সেই ছবিরগুলোর মধ্যে রমেশের দাদা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে ছিল। সেটা দেখেই বুঝতে পারা গেল এই ছেলে আর যাই হোক ভদ্র সমাজের ছেলে নয়। তার সঙ্গে আবার লজ্জা ঘেন্নাও নেই। না হলে কেউ এত গর্বের সাথে নিজের কুকীর্তি গুলো বলতে পারে। আমার সঙ্গে তার এত কথা হল। এদিকে আমি ওর নামটাই জানতে ভুলে গেছি।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার নাম কি?”

উনি বললেন, “আমার নাম দেবায়ন।”

তারপরেই সে বলা শুরু করলো, “আমার না সামনে খুব বড় বিপদ। আমি চারিপাশে  সব সময় কার একটা কথা বলার, চলাফেরার আওয়াজ শুনতে পাই। আমার মনে হয় কেউ একটা আমার চারি পাশ দিয়ে ঘুরছে, আমাকে হুমকি দিচ্ছে যে সে আমাকে খুন করে দেবে।”

পবন পুরো ব্যাপারটাই মন দিয়ে শুনছিল। কিছুক্ষণ পর একটু থতমত খেয়ে বলল, “আপনি যে রূপ বলছেন। সেই রূপ তো ভূত ছাড়া আর কারোর হতে পারে না। তবে কি আপনাকে ভূতই হুমকি দিচ্ছে খুন করার?”

সে বলল, “আমি এসব কিছুই জানি না কিন্তু এটুকু জানি আমায় খুন হওয়ার হাত থেকে কেউ বাচাতে পারবে না।” পবন একটু মিটিমিটে হাসতে শুরু করে।

আমি পবনকে ধমক দিয়ে বললাম, “সব সময় হাসতে নেই পবন। উনি হয়তো সত্যি কথাই বলছেন।”

আমি তারপর ওনাকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনিতো বলছেন আপনি খুন হবেন কিন্তু খুন তো হাতের মোয়া না যে চাইলাম আর হয়ে গেল। তার জন্য একটা মোটিফ লাগে। আপনার কেন মনে হচ্ছে আপনি খুন হলেও হতে পারেন?”

সে বলল, “আমি এসব জানলেও আপনাদের বলবো না। যদি আমিই বলে দি তাহলে আর আপনাদের কি কাজ রইলো? এখন আমি জানি আমাকে মরতেই হবে যদি আমি আপনাকে সত্যিটা বলিই কি না বলিই।”

আমি বললাম, “না যদি আপনি আপনার মৃত্যুর কারণটা বলতেন তাহলে আমি আপনাকে একটু সিকিউরিটি দিতে পারতাম।”

– “এখন আর সিকিউরিটি দিয়ে কোন কাজ হবে না। আমাকে মরতেই হবে। আমি আমাকে খুন করার কারণের একটা ক্লু আপনাকে দিতে চাই যেটা আপনাকে রহস্যের খোঁজে সাহায্য করবে। সেটা হলো পাপ।”

কিছুক্ষণ পর চা খেয়ে সে বলে,  “আমি এখন উঠছি তাহলে। আর হয়তো কোনোদিনও দেখা হবে না। ওই সাদা কালো ছবি গুলো আপনার কাছে যত্ন করে রেখে দেবেন। হয়তো ওইগুলো আপনার কেসে সাহায্য করলেও করতে পারে।”

দেবায়ন চলে যাওয়ার পর ওর কথাগুলো আমাকে একটু চিন্তিত করে তোলে। পবন বুঝতে পারে না আমি হঠাৎ এইটুকু ব্যাপার নিয়ে কেন এত চিন্তা করছি? সে জানতো আমি কোনদিনও ভূত বা অলৌকিকে বিশ্বাস করি না। পবন বুঝতে না পেরে আমাকে বলেই বসলো, “আচ্ছা তুই এত একটা ছোট ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছিস কেন? ওনার হয়তো মাথা টাথা খারাপ তাই এসব ভুলভাল বকে গেল। তুই আবার ওনার কথা বিশ্বাস করলি নাকি?”

আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললাম, “বিশ্বাস না করে কি আর উপায় ছিল? প্রথমে মনে হয়েছিল উনি হয়তো ভুলভাল বকছেন কিন্তু ওনার চোখ মুখে স্পষ্ট একটা চিন্তার ছাপ দেখা দিয়েছিল। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি খুব সিওর ওনার মৃত্যু হবেই। উনি ওনার মৃত্যুটাকেও খুব সহজে মেনে নিয়েছেন। সর্বশেষে যখন উনি বললেন যে ওনার মৃত্যুর কারণ হলো পাপ ওনার মুখ চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল উনি মিথ্যে কথা বলছেন না। ওনার চোখে, মুখে একটা ভয়ের ছায়া আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলাম। তুই হয়তো ভালো করে ওনার শরীরটা লক্ষ্য করিস নি। উনাকে দেখে স্পষ্ট এটাও বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে অনেকদিন উনি কিছু একটা ভয়ে খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে দিয়েছেন। না হলে তুই ভাব না চা খাওয়ার সময় প্রায় তো গোটা একশো বিস্কুট পুরো একাই সাঁটিয়ে দিল।”

পবন এসব শুনে বলল, “হ্যাঁ এই জিনিসগুলো আমি অতো লক্ষ্য করিনি। কিন্তু উনি যা বললেন সেখান থেকে উনি অলৌকিক জিনিসপত্রের কথা বোঝাতে চাইলেন। তুমি তো জানো ভূত বা অলৌকিক বলে কিছু হয় না। এইগুলো সব মনের ভুল। তুমিই তো আগে বলতে তুমি নাকি ভূত বা অলৌকিক জিনিসপত্রতে বিশ্বাস করো না। তাহলে এখন হঠাৎ কি হল?”

আমি বললাম, “আমি এসব কিছুতেই বিশ্বাস করি না। তুই ভাব না এটাও তো হতে পারে যেটা উনি ভাবছেন ভূত সেটা হয়তো ভূত নয়। সেটা হয়তো কোন ভূত রূপী মানুষ।”

পবন আমার কোন কথাতেই কোন যুক্তি পায়না। পবন আবার খুব যুক্তি দিয়ে সব কাজ করে‌। কোন তর্কে যুক্তি না পেলে ও সেই তর্কে আর না থেকে অন্য কোথাও চলে যায়। এখনো সেই তাই হল। ও আমার সঙ্গে কোন তর্কে না পেরে উঠে এখান থেকে উঠে অন্য জায়গায় চলে যায়। আমিও বুঝতে পারি না আমাকে ওনার কথাগুলো এত ভাবাচ্ছে কেন? আমার খালি মনে হচ্ছিল ওনার কথাগুলোর সাথে খুনটার কোন না কোন কানেকশন আছে কিন্তু কি কানেকশন সেটাই ভেবে বের করতে পারছি না। এই ভাবতে ভাবতেই সেদিন রাত হয়ে গেল। সেদিন রাত্রে ঘুমের সময় আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম এই যে দেবায়ন যা বলেছিল তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। দেবায়নের সত্যি মৃত্যু হয়েছে। এই স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই আমার মনে একটা চিন্তা কাজ করছিল। আমার মনে হচ্ছিল কালকেই হয়তো দেবায়নের মৃত্যু হবে। বাবা বলতেন ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। তাই হয়তো এত চিন্তা। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার এইটাই আমি কোনভাবেই নিজের মনকে মানাতে পারছিলাম না যে আমি যা ভাবছি সব ভুল। আমি কোনদিনই এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করতাম না যেমন ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় ইত্যাদি। আমার বাবা মা এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করত কিন্তু ভোরের স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে স্বপ্ন হয়তো সত্যি হবে। সকালবেলা উঠে জাস্ট চায়ে চুমুক দিতে যাচ্ছি তখনই রমেশের বাবা কালীচরণ বাবু আমার বাড়ি এসে হাজির।

কালীচরণ বাবু এসেই আমার পায়ের সামনে কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, “দাদা আপনি আমাদের কেসটার প্লিজ সমাধান করুন। আজ এক বড় বিপদ ঘটে গেছে। সকালে উঠে দেখি আমার বড় ছেলে দেবায়নের মৃতদেহ বাড়ির বাথরুমে পড়ে আছে।” এই কথাটা শুনে আমার সারা শরীর ভূমিকম্প ওঠার মতো কেঁপে ওঠে। আমি ভাবলাম তাহলে যা আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম তাই হলো। আমি গভীর ভাবনার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাই। আর কিছু বলবার জায়গা থাকে না আমার।

পবন কিছুক্ষণ পর কাকুকে বলল, “কাকু তোমাকে দেখে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আগে একটু জল খেয়ে নাও। তারপরে আবার কথা বলো।”

জল খেয়ে সে যেন একটু স্বস্তি পেল। তারপর সে আমাকে বলল, “দাদা আমি আপনাকে একটা সত্যি কথা বলিনি। আমরা না বেশ কিছুদিন ধরে কাদের সব চলে বেড়ানোর শব্দ, ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ পাচ্ছি। আমি আপনাকে কিছু জানাইনি এই ভেবে যে আপনি হয়তো এইসব কথা বিশ্বাস করবেন না। দেবায়নকে নিশ্চয়ই কেউ খুন করেছে।”

আমি এসব শুনে বললাম, “ঠিক আছে আমি আমার প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব এই রহস্যের সমাধান করার।”

সে চলে যাওয়ার পর পবন আমায় জিজ্ঞাসা করল, “তোর কি মনে হচ্ছে এগুলো কি করে হতে পারে?” আমি একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উত্তর দিলাম, “জানি না। তবে যা বুঝতে পারছি এর পিছনে বড় একটা হাত আছে।”

আমরা কথা বলতে বলতেই একটা কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলে দেখলাম আমার নামে চিঠি এসেছে। চিঠিটা সই করে নিয়ে নিলাম। চিঠিটা হাতে নিতেই দেখি শকুনি নামক এক ব্যক্তি আমাকে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে লেখা আছে

নমস্কার ।

জানি আমি আপনাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি কিন্তু আমার হাতপা বাধা একের পর এক খুন হচ্ছে আপনি কিছুই করতে পারছেন না। আমার ইচ্ছা থাকলেও আপনার সামনে এসে দেখা করার সৌভাগ্য হয়তো আমার এখন হবে না। আমি চাই আপনি আমাকে ধরুন। আপনি আমাকে ধরতে পারলে আমি কথা দিচ্ছি আমি নিজেকে শেষ করে দেবো।

ইতি শকুনি।

আমার খুব অবাক লাগলো এইটা দেখে যে এই প্রথমবার কোন ক্রিমিনাল নিজে থেকে বাশ নিতে চাইছে। আমার মনে হল যেন শকুনি নামক ব্যক্তি আমাকে বোকা বানাতে চাইছে। আমি চিঠিটা পড়া মাত্রই পবনকেও দেখালাম। পবন পড়ে বললো, “একটা মানুষের কত সাহস হতে পারে যে তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছে!” আমি বললাম, “আমার মনে হয় খুনি আমাদের খুব কাছেই আছে। হয়তো আমাদের দেখতে পাচ্ছে কিন্তু মুখটা আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে তাই বারবার আমাদের ঘোল খাইয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।” কিছুক্ষণ পরই একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো আমার ফোনে। আমি ফোনটা ধরা মাত্রই যে ফোন করেছে সে বলে উঠলো, “কিগো আমাকে চিনতে পারছো? আমি তোমার পরম বন্ধু।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কে?” তখন সে বলল “এ আবার কেমন কথা। এতো কিছু হয়ে গেল এখন জিজ্ঞাসা করছো আমি কে? আমি শকুনি।” আমি বললাম, “তুই আমাকে ফোন করেছিস কেন?” সে বলে, “ফোন তো করতেই হত নাহলে বোঝাপড়া করতাম কি করে?” আমি বললাম, “তুই কি চাইছিস?” সে তখন হাসতে হাসতে বললো, “এ আবার কেমন কথা। রক্ত চাইছি।” ফোন থেকে ওনার খুক খুক করে কাশির আওয়াজ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তারপরে শকুনি বলে ওঠে, “যদি পারো আমায় ধরে দেখাও। আমি তোমার খুব কাছেই আছি।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এইসব এত খুন কেন?” সে উত্তরে বললো, “তুমিই খুঁজে বার করো না।” এইটা বলে সে ফোন কেটে দিল। আমি আবার যখন ফোন করতে নিলাম দেখি ফোন সুইচ অফ। আমি যখন পবনকে ক্রিমিনালের ফোন করার কথাটা বললাম পবন আমায় বলে, “হয়তো যে ক্রিমিনাল সে আমাদের দেখাতে চাইছে যে সে কত বড় ক্রিমিনাল। আবার এটাও হতে পারে যে এসব কিছুই না। ও হয়তো আমাদেরকে বোকা বানাচ্ছে।” আমি একটু ভেবে বললাম, “না। সে সত্যিই চাইছে যেন আমরা তাদের ধরি। যার এত কনফিডেন্স সে কখনোই লোক দেখানো নাটক করতে পারেনা। ওর কথাবার্তা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছে ভয় বলে বস্তুটা ওর মধ্যে নেই। শকুনি যখন কথা বলছিল আমার মনে হচ্ছিল ওর মধ্যে কোন লুকানো ব্যথা, যন্ত্রণা আছে যার জন্য ও এত খুন করছে।” পবন আমার কথা শুনে বলল “হ্যাঁ হতেও পারে। ওর চিঠিতে লেখা সাজানোর ধরন দেখেও আমার মনে হয়েছিল ও হয়তো কোন কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে এইসব কাজ করছে। তখন ওটা নিয়ে অতোটা মাথা ঘামাই নি। এখন তুমি বলাতে ওই ভাবনাটা মাথায় চলে এল।” আমি বললাম, “সবই বুঝতে পারছি। কিছুটা খুনের মোটিভ বুঝতে পারা গেলও ক্রিমিনাল কোথায় আছে সেটাইতো বুঝতে পারছিনা? আমাদের চোখের সামনে পর পর এত খুন হয়ে যাবে আর আমরা চুপ করে বস থাকব তা তো আর হয় না।”

আমরা দু’পুরবেলা রমেশের বাড়ি গেলাম। সত্যিই দেখলাম খুব নৃশংস ভাবে দেবায়নকে খুন করা হয়েছে। মৃতদেহের উপর একটা সাপের ছবি খোদাই করে দিয়ে গেছিল আর ছুরি দিয়ে শকুনি বলে তার কপালে লিখে দিয়েছিল। রমেশের বাবা আমায় কাঁদতে বলল, “আমারি আপনাকে আগে থেকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলা উচিত ছিল। আমি আমার এক ছেলেকে হারিয়ে ফেললাম।”

আমি বললাম, “আপনি না বললেও আপনার ছেলে আমাকে কালকে এসে সমস্ত ভৌতিক ব্যাপার গুলো বলেছে এবং আমাকে দিয়ে কথা দিয়ে নিয়েছে যে আমি যেন তার খুনের রহস্য ভেদ করি। আচ্ছা আপনার ছেলের কি কোন শত্রু ছিল?”

সে বললো, “না আমার ছেলে এমনি তো খুব শান্ত স্বভাবের ছিল। কারোর সঙ্গে মিশতো না। সেরকম ভাবে কথাবার্তাও বলত না।”

আমার ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি নিশ্চয়ই কিছু একটা চেপে যাচ্ছেন। আমি বাড়ি গিয়ে সারাদিন এই নিয়েই ভেবে যাচ্ছিলাম যে ক্রিমিনালটা কোথায় থাকতে পারে? হঠাৎ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল আমরা প্রিয়াঙ্কার ঘর থেকে একটা খবরের কাগজ পেয়েছিলাম কিন্তু ওইটার সঙ্গে আমরা কেসের কোন কানেকশন পাইনি। হয়তো খবরের কাগজের মধ্যে দিয়ে আমাদের খুনি কিছু দেখাতে চাইছে? আমি পবনকে বললাম, “আমাদের বাড়িতে যত জমানো কাগজ আছে সব এক জায়গায় নিয়ে এসে জড়ো কর।” পবন জিজ্ঞাসা করল, “কেন?”

আমি বললাম, “কারণ আছে তাই আনতে বলছি। ঝট করে নিয়ে আয় দেখি।” আমার কথা পবন আবার ফেলতে পারেনা তাই এক কথায় দু’মিনিটের মধ্যে বাড়ির যত জমানো কাগজ ছিল সব নিয়ে হাজির। আমি কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখলাম ঠিক যেদিন রমেশের স্ত্রীয়ের মৃত্যু হয়েছিল তার আগের দিনের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে।

বিজ্ঞাপনে লেখা আছে, ‘যদি কেউ কি করে অদৃশ্য হতে হয় শিখতে চান তাহলে আমার কাছে আসুন। খুব দায়িত্ব সহকারে শেখানো হবে অদৃশ্য হওয়ার উপায়। টিউশান ফি হিসেবে প্রতি ছাত্রকে এক দিনের ক্লাসে ৫০০০০ টাকা অগ্রিম জমা করতে হবে।’

আমি পবনকে বললাম, “এবার বুঝলি কেন আমি তোকে বলি খবরের কাগজে খবরের থেকে বিজ্ঞাপন পড়াই বেশি জরুরি। বিজ্ঞাপনই সব খবর দেয়। মনে আছে কিছুদিন আগেই আমরা একটা অদৃশ্য হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। তুই দেখে বললি এসব টাকা মারবার ছল। আমি তার উত্তরে বলেছিলাম পুরোপুরি ধাপ্পাবাজ নাও হতে পারে। কিছুটা সত্যিও হতে পারে‌। তুই তো আমার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেছিলি।” পবন বলল, “হ্যাঁ সত্যি তো এসব টাকা রোজগার করার ফন্দি।” আমি বললাম, “সবই আস্তে আস্তে তুই বুঝবি। সত্যিই হয়তো উনি অদৃশ্য হওয়ার উপায় জানেন। ভাগ্যিস কাগজের সব বিজ্ঞাপনগুলো লাল দাগ দিয়ে রাখি। না হলে তো এত বড় জিনিস মিস করে যেতাম।”

পবন কিছুই বুঝতে পারেনা আমি কি বলছি। আমি ফোন করে কালীচরণ বাবুকে বললাম, “আজ রাত্রে একটু আমরা আপনার বাড়ি যাবো।” কালীচরণ বাবু এককথায় “হ্যাঁ” বললেন। হঠাৎ পিছন থেকে একটা ছুরি মারার শব্দ ভেসে এলো। তারপর যতবারই আমি কালীচরণ বাবুকে ফোনে ডাকছিলাম সে কোন উত্তর দিচ্ছিল না। আমি পবনকে বললাম, “একটা মস্ত বড় বিপদ হয়ে গেছে। আমার মনে হল কালীচরণ বাবুকে কেউ খুন করেছে।”

তার কিছুক্ষণ পরই আমরা কালীচরণ বাবুর বাড়ি গেলাম। বাড়ি গিয়ে দেখলাম সিঁড়ির সামনে কালীচরণ বাবুর মৃতদেহ পড়ে আছে। সেই একই ফরম্যাটে খুন করা হয়েছে। মৃতদেহের উপর একটা সাপের ছবি খোদাই করে দিয়ে গেছিল আর ছুরি দিয়ে শকুনি বলে তার কপালে লিখে গেছিল। রমেশ ও রমেশের মা মৃতদেহর সামনে বসে কান্নাকাটি করছিল। আমার মনে খালি এটাই খচ খচ করছিল যে প্রথম খুনটার ফরমাট দ্বিতীয় ও তৃতীয় খুনটার থেকে আলাদা কেন? তাহলে কি দু’টো খুন এক লোক করেছে আর একটা খুন অন্য লোক করেছে? এই তিনটে খুনের মধ্যে কি কোন কানেকশন আছে? হঠাৎ ভাবতে ভাবতেই আমি কারোর একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার, চলাফেরার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে একটু কাশির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। রমেশ ও তার মাতো ভূত, ভূত বলে ওখান থেকে পালায়। কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে একটা চেয়ার উঁচুতে উঠতে শুরু করে। সেই চেয়ারটা আমাদের দিকে অ্যাটাক করে। আমি চিৎকার করে বলি, “এখানে যা হচ্ছে আমি কিন্তু তাতে ভয় পাচ্ছি না।” পবন ভয় পেয়ে বলছে, “এসব কি বলছো তুমি?” আমি উত্তরে বললাম, “একটু সময় যাক সব বুঝতে পারবি। এখন চল এক জায়গায়, যাওয়ার।” পবন বুঝতে পারছিল না আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমি পার্কস্ট্রিট চত্বরের রয়েল ভ্যালি বাড়িটায় এলাম। পবন আমায় জিজ্ঞাসা করল, “আমরা এখানে কেন এলাম?” আমি বললাম, “একটু ভেবে দেখ। অদৃশ্য হওয়ার প্রশিক্ষণ তো এখানেই দেওয়া হয়।” পবন বলল, “হ্যাঁ। তুমি এখানে কি করবে? তুমি অদৃশ্য হওয়ার উপায় শিখবে নাকি?” আমি বললাম, “দেখই না কি করি?”

ভিতরে ঢুকে দেখলাম আমার মত বহু লোক এখানে এসেছে অদৃশ্য হওয়ার উপায় শিখতে। আমরাও তাদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে পরলাম। লাইন শেষ হওয়ার পর আমার থেকে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা ৫০০০০ টাকা নিল। সেই মহিলা বললো, “দুজন লোক একসাথে ঢুকতে পারবে না।”

তাই আমাকে একাই একটা অন্ধকার ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। সেই ঘরের ভিতরে একটা লোক বসেছিল। আমি ঘরে ঢুকতেই সেই লোকটা আমাকে দুটো আলাদা আলাদা ড্রাগস দিল। যার মধ্যে প্রথম ড্রাগসটা অদৃশ্য হতে সাহায্য করে এবং দ্বিতীয়টা অদৃশ্য অবস্থা থেকে ফিরতে সাহায্য করে। সে একবার আমাকে পরীক্ষা করেও দেখতে বললো। সত্যিই আমি যখন প্রথম ড্রাগসটা খেলাম আমি হাওয়ার মধ্যে ভেসেছিলাম। কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না! এমনকি যদি আমি কোন চেয়ার, টেবিল উপরে উঠাই, দেখে মনে হচ্ছিল কোন এক অদৃশ্য ছায়া ওটাকে উঠাচ্ছে। আবার যেই আমি দ্বিতীয় ড্রাগসটা খেলাম আমি অদৃশ্য অবস্থা থেকে ফিরে এলাম।

আমি ওনাকে নমস্কার জানিয়ে চলে এলাম। পবন কিছুই বুঝতে পারে না আমি এসব কেন করছি? পবন আমাকে বাইরে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা, “করলো তুই এসব কেন করছিস?”

আমি বললাম “একটু অপেক্ষা কর। সব বুঝতে পারবি।”

বাড়ি গিয়ে আমি রমেশকে ফোন করলাম। যতবারই ফোন করছিলাম ফোনটা ও ধরছিল না। আমার মনে কু ডাকছিল যে রমেশেও হয়তো মারা যাবে। আমি বার বার ফোন করেই যাচ্ছিলাম। একবার রমেশের মা ফোন ধরলো। ফোন ধরে খুব কাঁদতে কাঁদতে রমেশের মা বললো, “রমেশেকেও কেউ একজন খুব নৃশংস ভাবে খুন করেছে।” এই কথাটা শুনে আমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় রমেশের খুনের জন্য। আমার খালি মনে হচ্ছিল যদি আমি যদি আরেকটু সতর্ক থাকতাম তাহলে হয়তো ওকে মরতে হতো না। আমি হন্তদন্ত হয়ে রমেশের বাড়ি গেলাম। রমেশের বাড়ির দরজায় খট খট করতেই রমেশের মা খুব দুঃখের সাথে দরজা খোলে। আমি বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই রমেশের মৃতদেহ আমার চোখে পরলো। আবার সেই এক ফরম্যাটে খুন। আমার ছোটবেলায় রমেশের সঙ্গে কাটানো সব সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়ছিল। সেই একসঙ্গে খেলা করার, মারামারি করার, স্কুল পালিয়ে সিনেমা চলে যাওয়ার সব ছবিগুলো আমার মনে বার বার ভেসে আসছিল। আমি মন থেকে স্থির করে নিয়েছিলাম আজ আমি রহস্যের পর্দা ফাঁস করবোই। রমেশের খুনের প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে। আমি পুরো বাড়িটা খুঁজে দেখলাম কোন ঘর খালি পড়ে আছে কিনা কারণ অদৃশ্য মানুষ নিশ্চয় কখনো না কখনো অদৃশ্য অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে। যদি সে এ বাড়িতেই থেকে সব কিছু নজর রাখে তাহলে সে এমন একটা ঘরে থাকবে যেখানে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। খুঁজতে খুঁজতে দোতলার বারান্দার সামনে একটা ঘর দেখতে পেলাম যেখানে মনে হল কেউ থাকে না।

আমি রমেশের মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই ঘরটা কিরম ফাঁকা পড়ে আছে। এই ঘরটায় কেউ থাকে না?” সে তখন বললো, “হ্যাঁ আগে এখানে থাকা হতো। বেশ কিছু দিন ধরে আমাদের মনে হচ্ছে রাত্রে কেউ এই ঘরে হাঁটাচলা করছে, কথা বলছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মাঝে মাঝে কাশির আওয়াজও শোনা যায়। কখনো কখনো আবার এটাও দেখা গেছে যে চেয়ার টেবিল নিজে থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে, দরজা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা একবার আমাদের পুরুতমশাইকে ডেকে পুজো করিয়েছিলাম কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এতে তো ভূতের উপদ্রব কমেই নি উল্টে বেড়েছে।”

আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এই মানুষরূপী অদৃশ্য ভূত নিশ্চয়ই এই ঘরেই রাত্রে থাকে। আমি তখনই প্ল্যান করেনি আজ রাত্রে হাতে নাতে সেই মানুষ রূপী অদৃশ্য ভূতকে ধরে কঠোর শাস্তি দেবো।

সেদিন রাতে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল, মেঘ ডাকছিল। দেখে মনে হচ্ছিল আকাশ ভগবানের রূপ নিয়ে পুণ্যের আলো ফেলছে পৃথিবীতে। এই পুণ্যের আলো সমস্ত অন্ধকার ধুয়ে সাফ করে দেবে। আমি আগে থেকেই রমেশের মাকে বলে রেখেছিলাম যে আমরা আজকে রাতে যাবো। এত বৃষ্টি পড়ছিল বলে আমরা ছাতা নিয়ে গেছিলাম। যেহেতু রমেশের মা আগে থেকেই জানতো আমরা আজ রাতে আসবো তাই সে দরজাটা খোলাই রেখেছিল। আমরা রাত্রি সাড়ে বারোটায় ওনার বাড়ি গেছিলাম। আমরা দোতলার ওই ঘরটায় গেলাম যেই ঘরটায় কেউ থাকে না। আমি লুকিয়ে বাইরে একটা চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ টানা ওই ঘরটার দিকে নজর রাখলাম। অনেকক্ষণ পর প্রায় রাত্রি দেড়টায় যখন লোক ঘুমিয়ে পড়ে ভিতরে একটা লোক রমেশের বাড়ির আলমারি থেকে বেশ কিছু নতুন জামা কাপড় পড়ে তাদের বাড়ির বিছানায় ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এইটা তো আমি সিওর ছিলাম যে কখনো না কখনো তো অদৃশ্য মানুষ অদৃশ্য অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবেই। সেটা হওয়া সবচেয়ে বেশি সম্ভব ছিল রাত্রি বেলায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে ওই লোকটাকে গিয়ে অ্যাটাক করলাম।

পবন তো বুঝতেই পারেনি যে এরকম ফাঁকা ঘরে কি করে একটা লোক উদয় হলো? আমি তারপর ওই লোকটাকে বললাম, “আপনি আর বাচতে পারবেন না। আপনাকে ধরে ফেলেছি। আপনি সত্যি কথা বলুন কেন করলেন এত খুন?”

সে তখন বলল, “বেশ কিছু বছর আগের কথা। আমি তখন আমার স্ত্রীকে নিয়ে সুখে সংসার করতাম। আমার হাতে কোনো চাকরি ছিল না। একদিন ফেসবুক খুলে দেখলাম একটা গাড়ির কোম্পানি গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভার খুঁজছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আমি খুব ভালো গাড়ি চালাতে পারতাম তাই কিছুদিনের মধ্যে কাজটাও পেয়ে গেছিলাম। সেই কোম্পানিটা চালাতেন রমেশ, কালীচরণ বাবু, দেবায়ন মিলিত হয়ে। ওনাদের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ওনারা আমার বাড়িতে আসতেন। একটু চা টা খেতেন। গল্পগুজব হতো। আবার চলে যেত। আমার প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল দেবায়ন যেন আমার স্ত্রীয়ের দিকে একটু খারাপ চোখে তাকাচ্ছে। যেহেতু আমি ওদের সঙ্গে কাজ করতাম আমি ওদেরকে কিছু বলতে পারতাম না। মোটামুটি এক সপ্তাহ পর থেকে ওরা আমাকে ব্যাগে করে বিভিন্ন জিনিস দিতো গাড়ির মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার কোন একটা লোককে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আমাকে নিষেধ করে দেয়া হয়েছিল ব্যাগটা খুলে দেখতে। একদিন আমার মনে সন্দেহ জাগলো যে ওই ব্যাগে কি থাকতে পারে যেটা ওনারা এত সুরক্ষিত ভাবে পাঠাচ্ছেন। পরে আমি একদিন ব্যাগটা খুলে দেখি ওই ব্যাগের ভিতরে বহু ড্রাগ রাখা আছে। আমি ওনাদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এই ব্যাগে ড্রাগস কি করে এলো? ওনারা বললেন, “আমাদের ইচ্ছে হয়েছে তাই তোকে দিয়ে ড্রাগ পাঠাচ্ছি। তুই তো সামান্য ড্রাইভার। যা বলবো তাই করবি।” আমি তখন কাজটা ছেড়ে চলেও আসতে পারিনি কারণ আমার হাতে দু’বেলা খাওয়ার মতই তখন পয়সা ছিল না। কিছুদিন পর ওনারা আমার স্ত্রীকেও বাধ্য করে অশ্লীল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে। আমার স্ত্রী করতে না চাইলে ওনারা ব্ল্যাকমেল করেছিলেন আমাকে খুন করে দেবে। আমাকে যখন আমার স্ত্রী এই ব্ল্যাকমেলের কথা জানায় আমি পুলিশের কাছে গিয়ে সব সত্যি বলে দি। পুলিশরা ওনাদের ধরার বদলে আমাকেই ড্রাগস পাচার করার, আমার স্ত্রীকে বাধ্য করে অশ্লীল ব্যবসায় যুক্ত করার এবং একটা খুব ভালো কোম্পানির নামে মিথ্যে অভিযোগ করার কেসে জেলে পাঠিয়ে দেয়। কিছুদিন পর রমেশ, দেবায়ন, কালীচরণ বাবু জেলে এসে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। তখনই বুঝতে পারলাম পুরোটাই সাজানো প্ল্যান। কিছুদিন পর আমাকে পুলিশের লোকরা এসে বলে আমার স্ত্রী নাকি আত্মহত্যা করেছে। আমি বিশ্বাস করিনি যে আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করতে পারে। আমি জানতাম আমার স্ত্রীকে কেউ খুন করেছে। আমাকে যখন পুলিশরা আমার স্ত্রীয়ের মৃতদেহ সৎকারের কাজে নিয়ে গেছিল আমার পাশের বাড়ি একজন বন্ধু আমাকে লুকিয়ে বলেছিল আমার স্ত্রীকে রমেশ, দেবায়ন, কালীচরণ বাবু মিলে হত্যা করেছে। সে নাকি তখন জানলা বন্ধ করতে

গিয়েছিল। ওই জানলা দিয়ে আমার বাড়ির সামনের ঘরটা দেখা যায়। জানলা বন্ধ করতে গিয়ে তার চোখে পড়ে যায় আমার স্ত্রীকে খুন করার দৃশ্য। আমি তখন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে কাজ আইন করতে পারে না বা এক কথায় ক্ষমতা থাকলেও করে না সেই কাজ আমি করবো। আমি এই অপরাধীদের শাস্তি দেবই। কিছুদিন পর জেল থেকে লুকিয়ে পালিয়ে আসি।”

“তারপর আমি প্ল্যান করি অদৃশ্য হয়ে যারা আমার স্ত্রীকে হত্যা করেছে তাদের সবাইকে আমি শাস্তি দেবো। তখনই আমার চোখে পড়ল কাগজের বিজ্ঞাপন যেখানে লেখা আছে অদৃশ্য হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমি সেখানে গিয়ে অদৃশ্য হওয়ার জন্যও অদৃশ্য অবস্থা থেকে ফেরার জন্য দু’টো ড্রাগস্ নিয়ে এলাম। ফেসবুক ঘেঁটে আমি রমেশের ঠিকানা বের করলাম। তারপর একটা সময় বুঝে অদৃশ্য অবস্থায় ঢুকে পড়লাম ওদের বাড়ি। ভয় দেখাতে শুরু করলাম রমেশের বাড়ির সবাইকে। আমি চেয়েছিলাম যখন আমার প্রতিশোধের আগুন নিভে যাবে তখন আমি যেন ধরা পড়ি। তবে আমার সর্বশেষ ইচ্ছে ছিল এটাই যে আমাকে এমন একজন মানুষ ধরুক যে আসল সত্যের কদর করতে পারে। রমেশের ফেসবুকে আপনার ছবি দেখলাম। ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখলাম আপনি অনেক কেসের সমাধান করেছেন। অনেকেই আপনার ব্যাপারে খুব ভালো রিভিউ দিয়েছে। আস্তে আস্তে আপনার পাড়ার কিছু লোকের থেকে, অফিসের সহকর্মীদের থেকে খোঁজ নিয়ে এটুকু বুঝতে পারলাম আপনি খুব অনেস্ট। রমেশের বাড়িতে যেদিন অদৃশ্য অবস্থায় ঢুকেছিলাম রমেশের মুখ থেকে শুনেছিলাম যে ও প্ল্যান করছে আপনাকে ওর জন্মদিনে ডাকবে। তখনই সেরকম ভাবে গুছিয়ে প্ল্যান করে নিলাম যাতে আপনি আমাকে আপনার বুদ্ধি দিয়ে ধরতে পারেন ও আমিও আমার স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারি।”

আমি একটু ওনাকে থামিয়ে বললাম, “তাহলে আপনি রমেশের স্ত্রীকে খুন করলেন কেন?” উনি বললেন, “আমি তো ওনাকে খুন করিনি। আমি যেদিন অদৃশ্য অবস্থায় ওদের বাড়িতে ঢুকেছিলাম সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম রমেশের স্ত্রীর অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সবসময় সে অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে ফোনে কথা বলতো। মাঝে মাঝে সেই পুরুষের সঙ্গে দেখাও করতে যেত। এই সব কারণেই রমেশের সঙ্গে সব সময় ওর স্ত্রীর মনোমালিন্য হতো। রমেশের স্ত্রী খুব একরোখা মেয়ে। যা বলবে সেখান থেকে সে এক চুলও নড়বে না। এই বেপরোয়া স্বভাবের জন্য রমেশ তার স্ত্রীয়ের ওপর খুব অত্যাচার করা শুরু করে। মাঝে মাঝে তো মারধর করে ঘরবন্দি অবস্থায় রেখে দিত। রমেশের বাবাও এই সম্পর্ক কখনো মেনে নিতে পারেনি যেহেতু এই মেয়ে মুসলিম, এর উপর খুব অত্যাচার করা শুরু করে। কিছু কিছু খোঁজ আমি পাড়ার লোকের থেকেও পেয়েছিলাম। যেদিন আপনাকে রমেশের জন্মদিনের জন্য ডাকা হয় সেদিনই ওর স্ত্রী এত অত্যাচার না সহ্য করতে পেরে সুইসাইড করে। আমি শুধু ওটা দেখে ছাদ থেকে মৃতদেহটার উপর আরো একটু বেশি আঘাত করে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দি যাতে আপনার মনে সন্দেহ জাগানো যায় ও আস্তে আস্তে আপনি এই কেসের সাথে জড়িয়ে পড়েন।” তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে উনি বললেন, “আমি না চাইলে আপনারা কিন্তু আমায় ধরতে পারতেন না। আমি যদি আরেকটু সতর্ক থেকে রোজকার মত আজ রাতে অদৃশ্য অবস্থা থেকে না বেরোতাম তাহলে তো আপনারা আমায় খুঁজেই বার করতেই পারতেন না। আমিই চেয়েছিলাম আপনার মত অনেস্ট একজন মানুষের কাছে ধরা দিতে। আমি আসলে আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আজ রাত্রে। আমি জানতাম আপনি রাত্রেই আসবেন আমার ঘরে তাই যখন আপনি আমাকে ধরলেন আমি একটুও ভয় পাইনি, অবাক হইনি। আপনি যদি আজ আমাকে নাও ধরতেন আমি নিজেই নিজেকে কাল সকালে শেষ করে দিতাম। মৃত্যুর আগে এইটা ভেবেই খুব ভালো লাগছে যে আমি আমার মনের সমস্ত জ্বালা, বেদনা কষ্ট একজনকে বলে যেতে পেরেছি।” আমার এইসব শুনে মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল। যদিও আইনের চোখে উনি অপরাধী, আমার চোখে উনি একজন হিরো হয়ে থাকলেন। আমি ওনাকে কিছুক্ষণ পর বললাম, “আমি আসলে সত্যটা বের করার জন্যই রহস্যের সমাধান করি। বাকিটা আমি ঈশ্বরের হাতেই ছেড়ে দেই তাই আমি আপনাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবো না।” উনি তাও বললেন “আমার আর বেঁচে থেকে কি লাভ? জীবনের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেছে। এখন আমি যদি বেঁচে থাকি সেটা সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। আমাদের মত মানুষদের সব লোকেরা পাগল বলে ভাবে। শুধু মৃত্যুর আগে এটাই চাইবো আপনি যেন সারাজীবন এতটাই অনেস্ট আর সৎসাহসী থাকেন।”

তারপর আমার বারংবার না করা সত্বেও সে ছুটে গিয়ে দোতলার ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে যায়। এরকম ভবেই হয়তো একটা মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করল। পাপতো আর এখন ছোট জায়গায় আবদ্ধ নেই যে ধুলাম আর মুছে গেল। এখন পাপ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পবন এবার পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। পবন আমাকে বললো, “তুমি গ্রেট। তুমি ছাড়া এই কেসটার কেউ সমাধান করতে পারতো না।”

আমি বললাম, “এটা ভুল কথা যে আমি ছাড়া কেউ কেসটার সমাধান করতে পারতো না। যদি ওই অদৃশ্য ব্যক্তি আমাদের না দেখা দিতো তাহলে আমার পক্ষে কোনোদিনই এই কেসটার সুরাহা করা সম্ভব হতো না।”

এই অদৃশ্য মানুষটা চিরকাল আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে শুধুমাত্র তার পাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার জন্য। এইভবেই আমার জীবনে একজন ভিলেন হিরোতে পরিণত হল।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post সাদা কালো ডাইরী| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | গৌরব চন্দ্র| Bengali Detective Story
Next post শব্দভেদী| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | হীরক সানা| Bengali Detective Story