Getting your Trinity Audio player ready...
|
বেশ কিছুদিন হলো রিনি ওর বাপের বাড়ি গেছে।
রঞ্জন বাড়িতে একাই। রঞ্জনের বাবা মা গত হয়েছেন দেখতে দেখতে তাও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। না, এখনও রিনি আর রঞ্জুর মানে রঞ্জনের কোনো সন্তান হয় নি। রঞ্জু এখন কয়েকদিন ধরে বাড়িতে একাই থাকে। সকালে উঠে নিজের প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে অফিসে যায়, সারাটাদিন একপ্রকার কাজের মধ্যেই কেটে যায়। রিনিকে ফোন করে, কথাবার্তা হয় ঠিকই কিন্তু রঞ্জু বুঝতে পারে রিনি ইদানিং ওকে কেমন যেন এড়িয়ে চলে। নিজে থেকে ফোন করে কখনো রঞ্জুর খোঁজখবর তেমন নেয় না। অথচ এর কোনো কারণ রঞ্জু হাজার ভেবেও খুঁজে পায় না। সেদিন ছিল শনিবার, প্রতিদিনের মতো ডিনার সেরে বই নিয়ে রঞ্জু শুতে গেলো। এ অভ্যাস ওর অনেকদিনের। পড়তে পড়তে কখন যে চোখ লেগে আসলো বুঝতে পারে নি। কিন্তু একটা অদ্ভুত শব্দে ওর হালকা ঘুমটা ভেঙে গেল। সারা ঘর জুড়ে একটা ঝম্ ঝম্ শব্দ। আলোটা তখনো জ্বলছিল, তবুও কোথাও তেমন কিছু চোখে পড়লো না। সারারাত একপ্রকার প্রায় জেগেই কাটিয়ে দিলো ও। এরকম প্রায় পরপর বেশ কয়েকদিন ধরে ঘটলো। এদিকে রিনিকে এসব নিয়ে তেমন কিছু জানায়নি রঞ্জু। এখনও রিনি তেমন আর খোঁজখবর নেয় না রঞ্জুর। বাড়ি আসার কথা বললে রঞ্জুকে নানান বাহানা দিয়ে এড়িয়ে চলে। যাই হোক, কদিন ধরে রঞ্জু আলাদা ঘরে শুতে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই সেই শব্দটা যেন ওর পিছু ছাড়ছে না।
আজ প্রায় তিন চারদিন হলো এই শব্দের দাপাদাপি। এখন সত্যি সত্যিই রঞ্জুর ভয় ভয় লাগে। বাধ্য হয়ে ক’দিন ধরে রঞ্জু ডাইনিং-এ শুতে যায়। তবুও ঘুম আসে না কিছুতেই। রিনির সাথে রঞ্জুর ক্রমাগত বাড়তে থাকা দূরত্বটা ওকে এখন ভাবায়। স্মৃতিপটে ভিড় করে, এই কয়েকবছরের সংসারে ওদের দুজনের মধ্যে সুখী বৈবাহিক দম্পতির তথাকথিত কোনো সম্পর্ক গড়ে না ওঠার কথা। এর মধ্যে ইদানিং আবার এসবের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ঐ ঝম্ ঝম্ শব্দ!গাঢ় থেকে আরও গাঢ় হয়ে উঠছে ক্রমাগত ওদের দূরত্ব আর শব্দটার আধিপত্য, সমানুপাতিক হারে।
শরীরটাও কদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না রঞ্জুর। অফিস যায় ঠিকই কিন্তু কাজ এগোতে চায় না। সারা শরীরে একটা অদ্ভুত ক্লান্তি। এইবার রিনি বাপের বাড়ি যাওয়ার আগে থেকেই মাথা ঝিমঝিম ব্যাপারটা রঞ্জুর ছিল। রিনি সকালে উঠে রঞ্জু যখন ব্রাশ করে, তার ফাঁকে চা করে ফেলতো। রঞ্জু ফ্রেশ হয়ে এলেই ওর হাতে তুলে দিত চায়ের কাপ। কিন্তু নিজে খেতো না চা। যাইহোক রঞ্জুর শরীরটা আজ আর সত্যিই ভালো নেই। তাই অফিস থেকে আজ একটু আগেই বাড়ি চলে এসেছে।
কি মনে হলো আজ রিনিকে ফোন করলো রঞ্জু।
ফুল রিং হলো অনেকবার, কিন্তু রিনি রিসিভ করলো না। রাস্তা লাগোয়া দখিনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে কিছুক্ষণ পর রঞ্জুর চোখ গেল বারান্দার মেঝেতে। দেখলো একটা খাম। রঞ্জুকেই পাঠিয়েছে কেউ। খামটা খুলতেই চিঠিটার প্রতিটি শব্দ ওর চোখে যেন আলপিনের মতো বিঁধতে লাগলো। চিঠিটা আসলে রিনির লেখা। চিঠিতে রিনি জানিয়েছে যে; ও আর রঞ্জুর সাথে সংসার করবে না, এই নামহীন আবেগহীন সম্পর্কটা ও আর বয়ে নিয়ে চলতে পারছে না! অবশ্য রিনির অন্য কোনো কাছের মানুষ আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে একথা অক্ষরে অক্ষরে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে রিনি আজ: কোনোদিনই রঞ্জুকে পছন্দ করেনি ও, আসলে রঞ্জুর সাথে নাকি ওর স্ট্যাটাসের বিরাট ফারাক, ওর থেকে আরও অনেক দামী পাত্র জোগার করার যোগ্যতা রিনির আছে। বিয়ে করেছিল রিনি, শুধুই রিনির পারিবারিক চাপে।
তাই এবার এ সম্পর্কের ইতি ঘোষণা করতে চায় রিনি। দু’দিন পর, ও ওর বাড়ির লোকজন নিয়ে গিয়ে ওর ব্যবহার্য আর কিছু পছন্দের জিনিস নিয়ে আসবে। চিঠিতে সেই তালিকাও পাঠায় রিনি।
এদিকে রঞ্জুর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বুঝতে পারছে যে, সম্পর্কটা আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আবারো বেশ কয়েকবার ফোন করে রিনিকে, কোনো সাড়া মেলে না। এমনকি রিনির আত্মীয়দেরও ফোন করে রঞ্জু, কিন্তু তারাও কেমন যেন ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে।
রঞ্জুর কাছে গোটা ব্যাপারটা আরও যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অগত্যা সে রিনির পাঠানো তালিকা অনুযায়ী জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করে। এইসময় রঞ্জুর হঠাৎ চোখে পড়ে ও যে দিকে ঘুমাতো খাটের প্লাইয়ের ওপরটা লাল, যেন কেউ আলতা বা সিঁদুর মাখিয়ে রেখেছে, শুধু ঐ একটা দিকেই। যাই হোক কোনোভাবে জিনিসগুলো একজায়গায় জড়ো করে রঞ্জু। এছাড়াও আরো দুটো অদ্ভুত জিনিসও পায়, ঐ জিনিষদুটো আলাদা করে সরিয়ে রাখে রঞ্জু। রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে ও। সেই শব্দটা আজ আরো আরো অনেক যেন বেশি করে হচ্ছে।
রিনি ওর জিনিসপত্র নিয়ে যায়। না, রঞ্জু কোনো একবারের জন্যও আটকায়নি রিনিকে। রঞ্জু বুঝতে পেরেছে যেখানে মানুষের থেকে জিনিসের গুরুত্ব বেশি, সেখানে সম্পর্কের গভীরতা ঠিক কতটুকু! ও আজ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে, রিনি তালিকা দেখে জিনিস মেলানোয় মত্ত। একসময় রিনি ওর লোকজন নিয়ে চলে যায়। ফাঁকা ঘর, ঘরের কোণে জমাটবাঁধা এ ক’বছরের স্মৃতি সব আরো বেশি করে তাড়া করে থাকে রঞ্জুকে। আজ এসব কিছুর জন্য অফিসে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি রঞ্জুর। বিকেলে ওর এক পরিচিত মানুষের কাছে যাবে বলে স্হির করে রঞ্জু। ঐ ব্যক্তির সাথে অফিসের কাজের সূত্রেই আলাপ হয়েছিল। কেন জানে না আজ ওর হঠাৎ করেই ঐ ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে।
যখন ঐ ব্যক্তির বাড়িতে পৌঁছয় তখন প্রায় সন্ধ্যা। রঞ্জুকে দেখে ঐ ব্যক্তি আপ্লুত ও অবাক হয়। এর আগে বহুবার ওকে ওনার বাড়িতে আসতে বললেও রঞ্জু ঐ পথে পা বাড়ায়নি! আজ এমনসময় রঞ্জুকে আসতে দেখে উনি অবাক হলেও সাদরে ওকে ঘরের ভেতর ডেকে নিয়ে নিজের কাছে বসান।
কথায় কথায় রঞ্জু ওনাকে প্রায় পুরো ঘটনা খুলে বলে। বিশেষত সেই ঝম্ ঝম্ শব্দ, প্লাইয়ের ওপরে সেই সন্দেহজনক লাল দাগ, আর সেই জিনিস দুটোর কথা। এগুলো শুনে উনি কি বুঝতে পারেন রঞ্জু জানে না, তবে উনি ওকে জিনিস দুটো ওনার কাছে নিয়ে আসার জন্য বলেন। রঞ্জু রাজি হয়। বাড়ি ফিরে আসে। না, আজ আর যায় নি ও ঐ ভদ্রলোকের কাছে, এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে, তার ওপর সারাদিনের এসব টানাপোড়েন! শুয়ে পড়ে রঞ্জু। যথারীতি ওর সঙ্গ দেয় সেই পিছু না ছাড়া শব্দটা।
পরের দিন বিকেলে রঞ্জু যায় ওনার বাড়িতে। সাথে করে নিয়ে যায় জিনিস দুটো। আসলে লোকটার কেমন একটা অদ্ভুত শক্তি আছে সবাই বলতো!
রঞ্জুও যে তা একেবারেই জানত না তেমনটা নয়।
অফিসের বেশ কিছু কাজও উনি হাসিল করে দিয়েছেন অনেকেরই। যাই হোক রঞ্জুর কাছ থেকে জিনিস দুটো নিতেই ওনার পুরো ঘটনাটা বুঝে উঠতে আর বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না! রঞ্জুকে উনি জানান যে সর্বশক্তিমানের অশেষ কৃপায় রঞ্জু বেঁচে গেছে। না, এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও। উনি রঞ্জুকে একটি জিনিস দেন এবং বাজার থেকে আর একটা জিনিস ওকে জোগার করতে বলেন। এই দুটো জিনিসের সংমিশ্রণ বিশেষ পদ্ধতিতে সারাবাড়ির ভেতরে দেবার কথা বলেন। আরো বলেন সমস্ত জানলা খুলে রাখতে সারারাত। বলেন যে রাতে বাসনপত্র ফেলার মতো প্রচন্ড শব্দ হতে পারে, কিন্তু ও যেন কোনমতেই ভীত হয়ে না পড়ে!
পরের দিন গভীর রাতে রঞ্জু ঐ ব্যক্তির কথা মতো সমস্ত কাজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। শুধু তাই নয়, উনি যা বলেছিলেন ঠিক তেমনি প্রচন্ড শব্দ হয়, বাসনপত্র ফেলার মতো!
পরের দিন ভোরবেলায় ঐ মিশ্রণ, আর আগে পাওয়া সেই জিনিসদুটো নিয়ে গিয়ে রঞ্জু প্রবাহিত জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসে। এরপর বিকেলে ও ঐ ভদ্রলোকের কাছে যায়। উনি বলেন:
“দেখো বাবা! তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট। টগবগে রক্ত তোমার শরীরে। কিন্তু জানো তো? আমাদের এই সাদা চোখের জগতের বাইরেও একটা জগত আছে; সেটা কেউ মানে, কেউ আবার মানে না! তোমার স্ত্রী কোনোদিনই সত্যি তোমার ছিল না। নিজের অমতে ওর পারিবারিক চাপে তোমার সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সঙ্গী ছিল ওর বাড়ির লোকের প্রতি জমাটবাঁধা অভিমান। আবার অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ও তোমাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্যও করতে পারেনি! কিন্তু ঐ জমাটবাঁধা অভিমান ওর মনটাকে দিনের পর দিন হিংস্র করে তুলেছিল। মন চেয়েছে মুক্তি, মাথা চেয়েছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বরাবর বজায় রাখতে। তাই সুকৌশলে অলৌকিকতার আশ্রয় নেয় রিনি। তুমি যে দুটি জিনিস আমার কাছে নিয়ে এসেছিলে তার মধ্যে একটি ছিল এক অতিসাধারণ জলের বোতল, যার মধ্যে অর্ধেক জল নেই। আসলে ঐ জলটা প্রতিদিন চায়ের সাথে একটু একটু করে তোমায় মিশিয়ে দিত রিনি, যা তুমি ঘুণাক্ষরেও টের পাও নি;অথচ রিনি কিন্তু নিজে চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল বেশ কয়েকমাস ধরেই, সেকথা তুমিই আমায় বলেছো। ঐ মন্ত্রপূত জলটা ছিল বিষাক্ত, যার অর্ধেক তুমি অজান্তেই নিজের ভেতরে নিয়ে নিয়েছো। তাই তোমার এই টলমল ভাব। এই গেল শারীরিক দিক।
এবার আসি তোমার পাওয়া আরেকটি জিনিস।
ঐটি দিয়ে রিনি চেয়েছিল তোমাকে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভীত ও বিধ্বস্ত করে তুলতে। ঐ জিনিসটা আসলে এক অপঘাতে মৃতার কেশাগ্রগুচ্ছ, যেগুলো ও এক দুষ্টু লোকের থেকে কোনো না কোনো সূত্র মারফৎ সংগ্রহ করেছিল ঐ বোতলের জলের মতো। প্লাইয়ের লাল দাগও কোনো অলৌকিক উপায়ে প্রাপ্ত সিঁদুরের। যাইহোক, এতকিছু কান্ড ঘটানোর মূলে ছিল রিনির একটাই উদ্দেশ্য, তোমার চাকরিটা নিয়ে নেওয়া। এমন করে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে তিলে তিলে তুমি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে, আর তোমার সমযোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও রিনির চাকরি না পাওয়ার আক্ষেপটা মিটে যেত। আর এসবের পেছনে পুরোপুরি সমর্থন ও মদত ছিল রিনির বাড়ির লোকের। তাই যতবারই তুমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছো, তারা এড়িয়ে গেছে। আর যে শব্দটা তুমি সারারাত ধরে শুনতে সেটা ঐ অপঘাতে মৃতা অশরীরীর হেঁটে বেড়ানোর শব্দ। তবে আর ভয়ের কিছু নেই, ঐ অশরীরী চলে যাওয়ার আগে বাসনের শব্দের আস্ফালনে তার চলে যাওয়া জানান দিয়ে গেছে। আর তুমিও এসবের থেকে এখন পুরোপুরি বিপদমুক্ত। শুধু তাই নয়, রিনিও খুব তাড়াতাড়ি তোমার থেকে বিবাহিত সম্পর্কের পরিপূর্ণ ইতি চেয়ে ডিভোর্সের চিঠি পাঠাবে।”
রঞ্জন বাড়ি চলে আসে। আজ সত্যি সত্যিই গোটা বাড়িটা অনেক হালকা লাগছে। শুধু একটা কথাই রঞ্জুকে ভাবাচ্ছে; ‘জমাটবাঁধা অভিমান এতটা অভিশপ্ত হয়ে উঠতে পারে কখনো!’ এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ও ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতে পারে না। পরের দিন উঠতে উঠতে বেশ বেলা হয়ে যায়। কাল রাতে ঐ ঝম্ ঝম্ শব্দটা আর শুনতে পায়নি রঞ্জু। ফ্রেশ হয়ে চায়ের কাপটা সবে হাতে নিয়েছে রঞ্জু, এমন সময় কলিংবেলের ডাক:”আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।” বেশ কয়েকবার বেল বাজবার পর গেটটা খুলতেই এক অচেনা ভদ্রলোক:
“দাদা! আমি কোর্ট থেকে আসছি…..।”
সমাপ্ত
(অভিশপ্ত অভিমান” পুরো গল্পটাই কাল্পনিক।
বাস্তবে কেউ কোনো মিল খুঁজে পেলে তা কাকতালীয় এবং সেজন্য লেখক কোনোভাবেই দায়বদ্ধ নন।)