Getting your Trinity Audio player ready...
|
ডাইনিং হলের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটায় সময় দেখাচ্ছে সকাল ৬ টা বেজে সাতচল্লিশ। ধ্রুব এখনো ঘুমোচ্ছে দেখে দাদাকে আর সকাল সকাল ঘুম থেকে ডাকল না লাবণ্য। বিছানা ছেড়ে উঠে চুপিচুপি দরজার পেছন থেকে উঁকি মেরে দেখল, পিসিমা এখন পুজো আচ্চা নিয়ে ঠাকুরঘরে ব্যস্ত আর দাদু সবেমাত্র নিজের ঘরে সকালের চা’য়ে আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছেন। লাবণ্য সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে উঠতে লাগল। উপরে কিছুটা উঠে এলে বাতিল জিনিসপত্র বোঝাই করে রাখার জন্য এ বাড়িতে একটা পুরনো চিলেকোঠা আছে, একথা ওর অজানা নয়। দাদুর মুখে শুনেছে, এই ঘরটার ভেতর নাকি ওদের বংশের পূর্বপুরুষদের ব্যবহার্য অনেক পুরনো আর বাতিল জিনিসপত্র ঠাসা রয়েছে। তাই এই ঘরটার প্রতি ওদের দুই ভাই-বোনের অদম্য কৌতুহল। এবার পুজোর ছুটিতে যখন পুরুলিয়ায় ওদের দাদুর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে আসার প্ল্যান হয়, তখন ধ্রুব আর লাবণ্য আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যে, এবার অন্তত ওরা চুপিসারে একবার চিলেকোঠার ঘরটায় গিয়ে খুঁজে দেখবে ওখানে কী কী পুরনো জিনিস আছে। কিন্তু আজ সকাল সকাল ধ্রুবর ঘুম না ভাঙ্গায় অবশেষে লাবণ্য ঠিক করল, এখন একবার ও একা গিয়েই চিলেকোঠার ঘরটা চুপিচুপি ঘুরে আসবে।
দরজায় বাইরে কোন তালা লাগানো ছিল না। লাবণ্য পুরনো কাঠের দরজাটা খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে এল। এই বাড়িটার বয়স প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি। ঔপনিবেশিক কায়দায় তৈরি ভাস্কর্যের এই বাড়িটার আনাচে কানাচে আজও লেগে রয়েছে প্রাচীন একটা ঐতিহাসিক গন্ধ। এই চিলেকোঠার ঘরটা বোধহয় খোলা হয়নি অনেক বছর। ঘরের ভেতর ডাঁই করা রয়েছে একগাদা বাতিল আর প্রাচীন জিনিসপত্র। কী নেই সেখানে – চেয়ার, টেবিল, কাঁচের আয়না, ল্যাম্প, ঘড়ি থেকে শুরু করে অজস্র বই, ফার্নিচার, ওয়াকিং স্টিক, টুকিটাকি ভাঙ্গাচোরা জিনিস থেকে বড় একটা টিনের বাক্স পর্যন্ত। বহুদিন ব্যবহার না করার ফলে তাদের উপর ধুলোবালি আর মাকড়সার জালের সাম্রাজ্য গজিয়ে উঠেছে। লাবণ্য অবাক চোখে সেইসব জিনিস দেখতে লাগল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, প্রত্যেকটা জিনিসই বেশ দামি আর সাবেকি। সেন পরিবারের রুচিবোধ আর আভিজাত্য যে পুরুলিয়ার মানবাজার অঞ্চলের লোকেদের মুখে মুখে ঘোরে, সেটা ছোট থেকেই শুনে আসছে ও। স্কুলে ইতিহাস ওর পছন্দের বিষয় হওয়ায় এইসব পুরনো জিনিসের মধ্যে দাঁড়িয়ে এবার মনে মনে বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করল লাবণ্য। ধুলোমাখা ভাঙ্গা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল ও। বেলজিয়াম কাঁচ দিয়ে তৈরি বেশ পুরনো আমলের কারুকাজ করা দামি আয়না, সময়ের অত্যাচারে শুধু এখন তার জৌলুস খানিকটা কমে এসেছে। লাবণ্য আয়নাটার দিকে তাকিয়ে খোলা চুলটা বিনুনি করে বাঁধতে থাকল।
হঠাৎ ওর বাঁ-পাশে উঁচুমত একটা বাক্সের উপর থেকে টিকটিক করে একটা টিকটিকি ডেকে উঠতেই সেদিকে চোখ গেল লাবণ্যর। বিনুনি বাঁধা শেষ করে এবার ও দুরুদুরু বুকে এগিয়ে এসে বাক্সের উপর থেকে ঢাকাটা সরাল। একটা বেশ বড় মত লোহার বাক্স। একটা ছোট্ট তালা সেটার গায়ে আটকান আছে। এদিক ওদিক তাকাতেই বাক্সটার পাশে রাখা একটা পুরনো ফুলদানির ভেতর থেকে ছোট্ট একটা ধাতুর কিছু জিনিস চকচক করতে দেখল ও। হাতে নিয়ে দেখে, সেটা একটা চাবি। কী মনে হতেই চাবিটা নিয়ে সেটা বাক্সের তালাটার মধ্যে ঢুকিয়ে অল্প চার মারতেই খুলে গেল সেটা। গোল গোল চোখে বাক্সের ডালাটা উঠিয়েই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল লাবণ্য। এতবড় বাক্সের মধ্যে শুধু তিনটে জিনিস যত্ন করে রাখা আছে – একটা হলুদ হয়ে আসা ছোট নোটবুক, একটা আড়বাঁশি আর পুরনো দিনের ট্রানজিস্টার রেডিওর মতো দেখতে একটা চৌকো যন্ত্র। এই জিনিসগুলো কার? সামান্য ইত:স্তত করে বাক্সের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হলুদ হয়ে আসা নোটবুকটা তুলে নিয়ে সেটার মধ্যে চোখ বোলাতে লাগল লাবণ্য। সমস্ত নোটবুক জুড়ে অদ্ভুত অদ্ভুত কীসব ছবি আঁকা, এখানে ওখানে উদ্ভট ভাষায় কয়েকটা ছড়া লেখা রয়েছে। নোটবুকটার অবস্থা এতটাই শোচনীয়, যে সেটার বেশিরভাগ লেখারই পাঠোদ্ধার করা বেশ মুশকিল। মলাটের উপর আবছা কালিতে একটা নাম লেখা রয়েছে, দেখতে পেল ও। সত্যজিৎ বিশ্বাস। এই নামটা তো লাবণ্য এর আগে দাদু বা বাবার মুখে শোনেনি। কে এই ভদ্রলোক? উনি তো এই পরিবারের কোন পূর্বপুরুষ নন। তাহলে ওনার এই জিনিসগুলো এই বাড়ির চিলেকোঠায় এল কীভাবে? এইসব ভাবতে ভাবতে পাতা উল্টে নোটবুকটার শেষ পৃষ্ঠাটায় এসেই চোখ আটকে গেল লাবণ্যর। নোটবুকটায় শেষ এন্ট্রি ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯। পৃষ্ঠার শুরু আর শেষে দুটো ছোট ছোট ছড়া লেখা আছে, যার পাঠোদ্ধার করা লাবণ্যর পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু পৃষ্ঠার মাঝখানে সেই একই হাতের লেখায় একটা নাম লেখা দেখে মুহূর্তে লাবণ্যর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এই ক্ষয়িষ্ণু নোটবুকটার মধ্যে ঝাপসা কালিতে লেখা আছে ওর দাদার নামটা, ‘ধ্রুব সেন’, আর তার পাশে একটা সাল – ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯। লাবণ্যর সমস্ত শরীর ঘেমে উঠল। নোটবুকটা বাক্সে ঢুকিয়ে রেখে একবার বাকি জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে এল ও। এই জিনিসগুলো একবার ওর দাদাকে দেখান প্রয়োজন। সত্যজিৎ বিশ্বাস নামের এই অজ্ঞাত পরিচয় ভদ্রলোকের নোটবুকে ১৯৪৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর যেখানে শেষ এন্ট্রি, সেখানে শেষ পৃষ্ঠায় ওই একই হাতের লেখায় ভবিষ্যতের আজকের তারিখ আর ওর দাদার নামের উল্লেখ থাকাটা যতটা আশ্চর্যের ঠিক ততটাই রহস্যময় মনে হল লাবণ্যর।
হাওড়ার সেন্ট অ্যাগনেস কনভেন্ট স্কুলে ক্লাস টুয়েলভে পড়ে ধ্রুব আর সেই স্কুলেই ক্লাস নাইনের কোটায় এই বছর পা দিয়েছে ওর বোন লাবণ্য। ধ্রুব আর লাবণ্যর বাবা ধৃতিমান সেন হাওড়ার একটা নামী সফটওয়্যার কোম্পানির হেড, আর ওদের মা সুচন্দ্রা ওই কোম্পানিতেই অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে রয়েছেন। ব্যস্ততার হাতছানি সামলে সারাদিনে কাজের চাপে ছেলে মেয়েকে খুব একটা সময় দিতে পারেন না সেন দম্পতি। টুইঙ্কেল নামে একটি মেয়েকে রাখা হয়েছে যে বাবা-মা এর অনুপস্থিতিতে হাওড়ার এই নামকরা ফ্ল্যাটটায় দুই ভাই-বোনের যত্ন নেয় আর ওদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে আবদার মেটানোর চেষ্টা করে। ধ্রুব আর লাবণ্য তাই মনে মনে টুইঙ্কেল দিদিকে বেশ পছন্দ করে। ওর ভরসায় ছেলে-মেয়েকে রেখে তাই নিশ্চিন্তে অফিসের কাজ সামলাতে পারেন সেন দম্পতি।
সেপ্টেম্বর মাস পড়তে না পড়তেই সমস্ত শহর আগমনীর মেজাজে মেতে উঠতে শুরু করেছে। শেষ ক্লাস হয়ে ধ্রুবদের স্কুলেও পুজোর ছুটি পড়ে গেল। টুইঙ্কেল কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়ি যাবে, এমনটা ওর মাকে বলতে শুনেছে লাবণ্য। এই সুযোগে! লাবণ্য বায়না ধরল এবারের পুজোর ছুটিটা ও আর দাদা পুরুলিয়ার দাদুর বাড়িতে গিয়ে কাটাতে চায়। পিসেমশাই মারা যাওয়ার পর থেকে বিধবা পিসিমা বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রবাবুর সাথে এই বাড়িটায় এসে থাকতে শুরু করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে পিসিমার রান্নার হাত চমৎকার। অমন উপাদেয় মুড়িঘন্ট যে ওরা কতদিন খায়নি, সেটা ভাবতেই যেন জিভে জল এসে গেল লাবণ্যর। ধৃতিমানবাবু ভেবে দেখলেন, টুইঙ্কেল যতদিন না ফিরে আসছে, ততদিন বাড়িতে লাবণ্য আর ধ্রুবকে একা রেখেই অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে, তার থেকে বরং ওরা দুজন পুরুলিয়ায় ধৃতিমানবাবুর বোন আর বাবার কাছে গিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না। পুজোর ছুটিটা ওরা মজা করে কাটিয়ে দিতে পারবে, আর টুইঙ্কেল ফিরে এলে আবার ওদের গাড়ি করে হাওড়ায় ফিরিয়ে আনবেন ধৃতিমানবাবু।
এরপর আর বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি ওদের। কলকাতা থেকে পুরুলিয়ার দূরত্ব মোটামুটি ১২৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি। গতকাল সকাল সকাল ওদের দুজনকে হাওড়া থেকে ট্রেনে চাপিয়ে পুরুলিয়ার বিখ্যাত সেন বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই আবার বিকেল বিকেল কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়েছেন ধৃতিমানবাবু। পুজোর সময়টায় অফিসে কাজের বেশ চাপ থাকে, তাই মনে মনে বাবা আর বিধবা বোনের সাথে এই সেন বাড়িতে কয়েকটা দিন হইহই করে আনন্দে কাটিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, সে উপায় নেই ধৃতিমান সেনের।
প্রায় অনেকগুলো বছর পর আবার পুরুলিয়ায় পা রাখল ধ্রুব আর লাবণ্য। এর আগে একটা পারিবারিক রিইউনিয়নে কয়েকদিনর জন্য বাবা-মা এর সাথে এখানে এসেছিল ওরা, লাবণ্য তখন একেবারেই ছোট। ধ্রুবর তখন ক্লাস ফাইভ। আশেপাশের মনোরম পরিবেশের শোভা দেখতে দেখতে পুরনো স্মৃতিগুলো যেন মনের কালকুঠুরির অন্ধকার ফুঁড়ে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠতে লাগল ধ্রুবর চোখের সীমান্তে।
সেইবার দাদুর মুখে অনেক রহস্যময় গল্প শোনার পর এখান থেকে ফিরে বাবার কাছে রক ক্লাইম্বিং শিখবে বলে বায়না ধরেছিল ধ্রুব। পুরুলিয়ার মনোমুগ্ধকর পাহাড়গুলোর খাঁজে খাঁজে পা রেখে উপরে উঠে যাওয়ার মধ্যে যে একটা অদ্ভুত শিহরণ আছে, সেটা এখন ও বেশ বুঝতে পারে। যদিও কয়েক বছর আগেই একবার রক ক্লাইম্বিং-এর জন্য পুরুলিয়ায় আসতে হয়েছে ওকে, কিন্তু সেটা একান্তই পাহাড় চড়ার নেশার স্বার্থে, দাদুর সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার সুযোগটা আর হয়ে ওঠেনি । কলকাতার যে ট্রেনিং সেন্টারে ধ্রুব প্রশিক্ষণ নেয় সেখানের সফল রক ক্লাইম্বারদের মধ্যে এখন ও অন্যতম সেরা ছাত্র।
সেই বছর এখানে এসে দুটো পাহাড় চড়বার সৌভাগ্য হয়েছে ধ্রুবর। তার মধ্যে প্রথমটা হল এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ জয়চণ্ডী পাহাড়। খাড়া খাড়া উঁচু পাথর পর্বতারোহীদের জন্য ভীষণ মাত্রায় আনন্দদায়ক। ধ্রুব ছোটবেলায় বাবার কাছে গল্প শুনেছিল, এই পাহাড়টার নাম দেবী চণ্ডীর নামানুসারে করা হয়েছিল আর তাঁকে উৎসর্গ করেই একটি মন্দির এই পাহাড়ের শীর্ষে তৈরি করা হয়। এই জয়চণ্ডী মন্দিরে পৌঁছতে এবং দেবীর কাছ থেকে আশীর্বাদ নিতে একজন ভক্তকে প্রায় ৪০০ ধাপের সিঁড়ি ভেঙে সেখানে উঠতে হয়। প্রতিবছর জয়চণ্ডী পাহাড়ের পর্বতমালায় স্থানীয় কারিগরদের প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য ‘জয়চণ্ডী পাহাড় পরায়ণ উৎসব’ নামে একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়। সারা দেশ থেকে পর্যটকরা এই উৎসবের অমোঘ আকর্ষণে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে। দ্বিতীয় যে পাহাড়টায় ধ্রুব সফলভাবে উঠতে পেরেছিল, সেটা হল পুরুলিয়ার আরও একটি জনপ্রিয় আকর্ষণ – অযোধ্যা পাহাড়। এই পাহাড়গুলো ডালমা পর্বতমালার একটি অংশ এবং এর সাথে পৌরাণিক কাহিনীও জড়িয়ে রয়েছে। ধৃতিমানবাবুর মুখে এই পাহাড়ের অনেক গল্প শুনেছে ধ্রুব, বিশ্বাস করা হয় যে, ভগবান রাম আর সীতা তাদের নির্বাসনের সময় এখানেই দিন কাটাতেন। জায়গাটায় এসেই ধ্রুব এই স্থানের মাহাত্য বুঝতে পেরেছিল। অযোধ্যা পাহাড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বন্যজীবনের পাশাপাশি দুর্দান্ত একটা ট্রেকিং স্পট। জায়গাটার চারদিকে গভীর বনজঙ্গল আর বেশ কয়েকটা হ্রদ গোটা অঞ্চলটাকে ঘিরে রয়েছে। ধ্রুব বেশ বুঝতে পারল কেন অযোধ্যা পাহাড়কে পাখি আর পর্যবেক্ষকদের স্বর্গরাজ্য বলা হয়। গোরশাব্রু আর মায়ুর পাহাড়গুলোর দিকেও কড়া নজর রেখেছিল ও। ধ্রুব মনে মনে ঠিক করল, এবার একবার লাবণ্যকে নিয়ে বেড়িয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের কাছেই তুরগা বাঁধ আর বামনি জলপ্রপাতটা ওকে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে। আর তাছাড়া সেইবার ট্রেকিং-এ এসে পুরুলিয়া জেলা থেকে প্রায় ৫৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গাজাবুরু পাহাড়ে ক্লাইম্বিং করাটা বাদ পড়ে গিয়েছিল, অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষদের জন্য এটা একটা আদর্শ জায়গা। গাজাবুরু পাহাড়ের রুক্ষ আর শক্ত ঢালগুলো এটাকে একটা আকর্ষণীয় অ্যাডভেঞ্চার স্পট হিসাবে তৈরি করেছে যেখানে পর্যটকরা এসে ইচ্ছেমতো রক ক্লাইম্বিং, ট্রেকিং, ক্যাম্পিং বা পিকনিক করে যেতে পারে। তাই এই জায়গাটার উপর ধ্রুবর অনেকদিনের নজর।
দাদার মতো লাবণ্যর আবার এই রক ক্লাইম্বিং খুব একটা ভাল লাগে না। প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ জড়ান জায়গাগুলো ওকে ভীষণভাবে টানে। এখানে আসার আগে জায়গাটা নিয়ে বাবার কাছ থেকে বই চেয়ে বেশ কিছুটা আভাস পেয়েছে ও। এই পুরুলিয়া সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য, সুউচ্চ পাহাড়ি সৌন্দর্য্য, মন্দির, বাঁধ, ইতিহাস আর সংস্কৃতির মিশেলে তৈরি একটি মনোমুগ্ধকর জেলা; অবস্থান আর সহজলভ্যতার কারণে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে এটা। পরিবহণের বিভিন্ন ধরণের মাধ্যমের সাহায্যে সহজেই দেশের বেশিরভাগ অংশের সাথে পুরুলিয়া থেকে এখন যোগাযোগ করা যায়। জায়গাটায় আসার পর থেকেই মনে মনে বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছিল ওরা। গতকাল রাতে খেতে বসে দাদুর কাছ থেকে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানের গল্প শুনেছে ধ্রুব আর লাবণ্য। ছোটবেলার থেকে বড়বেলার বেড়ানোতে বোধশক্তির যে একটা আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়, সেটা এখানে আসার পর থেকেই টের পাচ্ছে লাবণ্য।
সেপ্টেম্বর মাস পড়তে না পড়তেই গোটা পুরুলিয়া সেজে উঠতে শুরু করেছে আগমনীর উচ্ছ্বাসে। বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক উৎসব, নাচ, গান, বিভিন্ন রকম জলে খেলার প্রতিযোগিতা প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে তার দাদুর এলাকায় যে বেশ ধুমধাম করে পুজো হয়, সেটা শোনার পর থেকেই এখানে আসার লোভটা সামলাতে পারেনি ওরা। এছাড়াও আরো একটা জিনিসের প্রবল টানে ধ্রুব আর লাবণ্য বলা যায় পুরুলিয়া চষে ফেলার জন্য একরকম মুখিয়ে রয়েছে। এই জায়গাটা ঝুমুর, টুসু, ভাদু প্রভৃতি লোক সংস্কৃতির গানের সাথে সাথে ‘ছৌ নাচের’-ও জন্মস্থান। এই জিনিসটার সম্পর্কে জানার ইচ্ছে ওদের জন্মেছে গতকাল রাত থেকেই। গতকাল রাতে খেতে বসে দাদুর মুখে এই ব্যাপারটার সম্পর্কে শোনার পর থেকেই দুই ভাইবোনের মনটা বড্ড আনচান করছিল। গতকাল রাতে শুয়ে শুয়ে তাই ওরা অনেক্ষণ পর্যন্ত কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে, সেটা নিয়ে আলোচনা করেছে।
ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে এল লাবণ্য। ধ্রুব খাটের এককোণায় বসে কয়েকটা বই ঘাঁটছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশে লাবণ্যকে দেখতে না পেয়ে অগত্যা ও ঠিক করল, দাদুর স্টাডিরুমের দেরাজ থেকে পুরুলিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটা বই নিয়ে এসে পড়ে ফেলবে। এখানে বেশ কয়েকটা নামকরা জায়গায় ওদের এখনো ঘুরতে যাওয়া বাকি। দেরাজের বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে দুটো বইয়ের বিবরণ পড়ে মনে মনে বেশ খুশি হল ধ্রুব। বইদুটো পুরুলিয়ারই দুজন বিখ্যাত লেখকের বই – একজনের নাম মবিনুল হক আর একজনের শ্যাম সুন্দর বেসরা। ধ্রুব বইদুটো বগলদাবা করে এনে নিজের ঘরে বসল। বইদুটোর বর্ণনা এতটাই চমকপ্রদ আর আকর্ষণীয় যে, একমনে পড়তে পড়তে যেন সেই বইগুলোর মধ্যেই হারিয়ে গিয়েছিল ধ্রুব। লাবণ্যকে দেখে সামান্য গলা খাঁকরানি দিয়ে বলল, “সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলি, বোনু? আয়, আয়, বোস – এই দ্যাখ আমি কী পেয়েছি!”
লাবণ্য দাদার প্রশ্নের কোনরকম উত্তর না দিয়ে গম্ভীর মুখে চুপচাপ খাটের একটা পাশে এসে বসল। ধ্রুব ওর দিকে না তাকিয়ে শ্যাম সুন্দর বেসরার বইটা নাকের সামনে খুলে ধরে একটানা বলে যেতে লাগল, “দ্যাখ বোনু, এই বইটা আজ সকালে দাদুর ঘর থেকে খুঁজে পেলাম। গোটা পুরুলিয়া ট্যুর নিয়ে একটা কমপ্লিট ডেসক্রিপসন দেওয়া রয়েছে। কাল দাদু বলল না যে পরশু থেকে আমরা এলাকাটা ঘুরে দেখতে পারব, তাই তার আগে কয়েকটা জায়গা সম্পর্কে একটু ডিটেলে জেনে নেওয়াটা প্রয়োজন। যেমন ধর, ৫০ একর জায়গার উপরে বিস্তৃত একটা বিশাল হ্রদের নাম সাহেব বাঁধ, পরিযায়ী পাখিদের জন্য এটা একটা চৌম্বকক্ষেত্র। শীতের মরসুমে পাখিরা বালুচিস্তান আর সাইবেরিয়া থেকে নাকি এই সুন্দর জায়গাটায় উড়ে আসে। ওই জায়গাটায় গেলে আমরা নানা ধরণের পাখি দেখতে পারব। এই অত্যাশ্চর্য হ্রদটা উনিশ শতকে তৈরি হয়েছিল, যদিও এখন এটা জাতীয় হ্রদ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কাশ্মীরের মতো আমরা এখানেও পোষাক ভাড়া করে শিকারায় চড়তে পারব, বুঝলি? তারপর এই দ্যাখ, মূল শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে সুরুলিয়া নামে একটা জনপ্রিয় ইকো পার্ক আছে। এই ইকো পার্কটা কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত, পার্কটিকে হরিণ পার্কও বলা হয় কারণ এখানে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা রয়েছে। শুধু হরিণ নয়, আরো অনেক রকম পাখি আর অন্যান্য প্রাণীও দেখতে পাবো আমরা এখানে। ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা সোজা চলে যাব দোলডাঙ্গায়, কংসাবতীর তীরে অবস্থিত একটা জলাশয় দেখতে। তোর অনেক দিনের ইচ্ছে বোটিং করা, দাদুকে রাজি করিয়ে আমরা ওখানে বোটিং করে ছোটখাট একটা পিকনিক অ্যারেঞ্জ করে নিতে পারব, কাছেই একটা খুব সুন্দর পিকনিক স্পট রয়েছে …” বলতে বলতে এবার চোখ তুলে লাবণ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল ধ্রুব। লাবণ্যর চোখ মুখে যেন একটা চাপা উৎকন্ঠা অনেক্ষণ ধরেই খেলে বেরাচ্ছে। ধ্রুব বেশ বুঝতে পারল, ওর বোন নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু একটা দেখে এমন গম্ভীর হয়ে গেছে, এতক্ষণের বলে চলা একটা শব্দও লাবণ্যর কানে প্রবেশ করেনি। ধ্রুব সোজা হয়ে বসে বইটা বন্ধ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার বলতো, সকাল থেকে তুই এমন চুপচাপ? কিছু হয়েছে নাকি?”
লাবণ্য এবার চোখ তুলে ওর দাদার মুখের দিকে তাকাল। মনের মধ্যে যে চাপা উদ্বেগটা এতক্ষণ ধরে ছুটোছুটি করে চলেছে, সেটার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি নেই। লাবণ্য ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে দাদার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদা, তুই সত্যজিৎ বিশ্বাস বলে কাউকে চিনিস?”
বোনের মুখে নামটা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল ধ্রুব। সত্যজিৎ বিশ্বাস! হ্যাঁ – ঠিক তাই তো – এই নামটার সাথে গতকাল রাতে ঘুমের আড়ালে সামান্য পরিচয় হয়েছে ধ্রুবর, একটা দুঃস্বপ্নের প্রেক্ষাপটে। একটা কালো শক্ত সামর্থ্য ছায়াশরীর গতকাল রাতে ঘুমের মধ্যে ধ্রুবর গলা চেপে ধরেছিল। প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে, এমন সময় আরেকটা ক্ষীণ গলার স্বর পেছন থেকে লোকটার নাম ধরে ডাকতেই সে ধ্রুবর গলাটা ছেড়ে দিয়ে মুহূর্তে অন্ধকারের মধ্যে মিশে পালিয়ে গেল, আর তারপরেই ডাইনিং-থেকে ভেসে আসা গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের ঘন্টার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে ধ্রুব ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে। নিছক একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ব্যাপারটায় আর আমল দেয়নি ও, কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে তো লাবণ্যর সাথে ওর এইমাত্র কথা হল, ও তো একবারের জন্যও নামটা নিজে মুখে উচ্চারণ করেনি। তাহলে লাবণ্য এই একই লোকের নামটা শুনল কার কাছে?
ধ্রুব চুপ করে কিছু ভাবছে দেখে লাবণ্য ওকে একটা ঠেলা দিল। চটকা ভেঙ্গে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে ডানদিকে আর বাঁদিকে মাথাটা ঘোরাল ধ্রুব। লাবণ্য বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, “আমার সাথে চুপিচুপি চিলেকোঠার ঘরটায় চল দাদা, তোকে একটা জিনিস দেখানোর আছে!” ধ্রুব আর কিছু বলল না। বইটা খাটের উপর নামিয়ে রেখে চুপচাপ বোনকে অনুসরণ করল।
চিলেকোঠার ঘরটায় ঢুকে বেশ অবাক হয়ে যায় ধ্রুব। এই ছোট্ট ঘরটা যে এত রকমের পুরনো সব বাতিল জিনিসপত্রে ঠাসা রয়েছে, এটা আজ এখানে এসে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হত না ওর। এই ঘরটার কথা ও বাবা, পিসিমা আর দাদুর মুখে অনেকবার শুনেছে। কেন কে জানে, এই ঘরটার কথা তুললেই ওর দাদু বা পিসিমা দুজনেই কেমন যেন অদ্ভুতভাবে এড়িয়ে যান, এটা ধ্রুব বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারে। তাই এই ঘরটার রহস্য উন্মোচন না করা অবধি ওর মনে শান্তি নেই। একটাই ছোট্ট কাঁচের জানলা-তার ডানদিকের একটা ভাঙ্গা অংশ দিয়ে সকালের কড়া রোদ তির্যকভাবে একটা মাঝারি মাপের টিনের বাক্সের উপর এসে পড়েছে। লাবণ্য এবার বাক্সটার সামনে দাঁড়িয়ে ধ্রুবকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল। বাক্সটার ডালাটা অল্প খোলা। কাছে এসে সেটার ভেতর উঁকি দিতেই জিনিস তিনটে চোখে পড়ল ধ্রুবর।
ছোট্ট ট্র্যানজিস্টারের মতো দেখতে জিনিসটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে করতে ধ্রুব বিড়বিড় করে বলল, “হুম, এই যন্ত্রটা তো অনেক বছরের পুরনো মনে হচ্ছে! এখন মনে হয় এটা আর চলে টলে না। কিন্তু এমন অদ্ভুত দেখতে জিনিস তো আমি এর আগে দেখিনি। এটা কার হতে পারে?”
দাদার কথার কোন জবাব না দিয়ে বাক্সের ভিতর হাত ঢুকিয়ে এবার একটা হলুদ হয়ে আসা ছোট নোটবুকটা বার করে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে দিল লাবণ্য। ধ্রুব অবাক চোখে সেটার পাতাগুলো উলটে উলটে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করল, সমস্ত নোটবুক জুড়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ছবি আঁকা রয়েছে, সাংকেতিক ভাষায় এখানে ওখানে উদ্ভট কয়েকটা ছড়াও লেখা রয়েছে। সময়ের ঘর্ষণে নোটবুকটার অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে সেটার বেশিরভাগ লেখারই পাঠোদ্ধার করা বেশ মুশকিল। কিছু বুঝতে না পেরে চোখ কুঁচকে নোটবুকটার মলাটের উপর চোখ বোলাতেই আবছা কালিতে একটা নাম দেখতে পেয়েই মুহূর্তে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল! এই নামের ব্যক্তিটির সাথে কাল রাতে দুঃস্বপ্নের মধ্যে আচমকাই পরিচিত হয়েছে ধ্রুব, তারপর সকালে লাবণ্যর মুখে এই নামটা শুনে এই চিলেকোঠার ঘরে ছুটে আসা – এইসব কী নিছক কাকতালীয়? পুরনো সেই হলদে নোটবুকটা হাতে নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ধ্রুব।
কে এই সত্যজিৎ বিশ্বাস? এই নামটা তো ও এর আগে দাদু বা বাড়ির কারুর মুখে শোনেনি। উনি যদি এই পরিবারের কোন পূর্বপুরুষ না-ই হয়ে থাকেন, তাহলে ওনার এই জিনিসগুলো এই বাড়ির চিলেকোঠায় এল কীভাবে? এইসব ভাবতে ভাবতে পাতা উল্টে নোটবুকটার শেষ পৃষ্ঠাটায় এসেই চোখ আটকে গেল ওর। নোটবুকটায় শেষ এন্ট্রি ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯। পৃষ্ঠার শুরু আর শেষে দুটো ছোট ছোট ছড়া লেখা আছে, যার পাঠোদ্ধার করা লাবণ্যর পক্ষে অসম্ভব হলেও ধ্রুব কিছুটা বুঝতে পারল। সেগুলো কয়েকটা গানের সুরের নোটেশন, কিন্তু স্পষ্টভাবে সাজান নেই। এবার পৃষ্ঠাটার মাঝখানে সেই একই হাতের লেখায় একটা নাম দেখতে পেয়ে থমকে গেল ধ্রুব। এই প্রাচীন নোটবুকটার মধ্যে ঝাপসা কালিতে লেখা আছে ‘ধ্রুব সেন ‘, আর তার পাশে একটা সাল – ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯। ধ্রুবর হঠাৎ মনে হল, ও বোধহয় এবার কোন একটা শক্ত রহস্যের বেড়াজালে আটকে পড়তে চলেছে! কাল রাতে ওই ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আজ এখন অবধি রহস্য যেন ক্রমাগত আরও জট পাকাতে লেগেছে। এই সত্যজিৎ বিশ্বাস নামের অজ্ঞাত পরিচয় মানুষটার নোটবুকে শেষ এন্ট্রি যেখানে ১৯৪৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর, সেখানে সেটার শেষ পৃষ্ঠায় ওই একই হাতের লেখায় ভবিষ্যতের আজকের তারিখ আর ওর নিজের নামের উল্লেখ থাকাটা কী নিছকই কাকতালীয়? নাকি এর পেছনে অন্য কোন গভীর রহস্য আছে?
লাবণ্য এবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কীরে, কিছু বুঝতে পারছিস, দাদা? এত পুরনো একটা নোটবুকে তোর নাম থাকাটা কী করে সম্ভব? তার মানে কী আমাদের পরিবারে এই একই নামের আরও কোন ব্যক্তি আছে যার কথা আমাদের বলা হয়নি? দাদুকে একবার চুপি চুপি এর মানেটা জিজ্ঞেস করলে হত না?”
ধ্রুব কটমট করে ওর বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখনই না! এই ঘরটায় আসতে আমাদের বরাবর বারণ করা হয়! কেন? এখানে আসলে কী আমরা কিছু জানতে পেরে যাব? কোন গোপন জিনিস বা কোন গোপন মানুষের কথা? এই সত্যজিৎ নামের মানুষটাই বা কে? যতক্ষণ না এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাচ্ছি, দাদুকে কিচ্ছু জানান যাবে না।” বলে চারপাশের জিনিসগুলো রোদের আলোয় ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিতে লাগল ধ্রুব।
আড়বাঁশিটায় চোখ যেতেই ধ্রুব সেটার দিকে হাত বাড়াল আর তখনই ওর মনে হল, জিনিসটা যেন এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল, বাঁশিটা যেন নিজের থেকেই সুড়ুৎ করে ওর হাতের মুঠোয় চলে এল। ধ্রুবর সমস্ত শরীর জুড়ে এবার একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। গত কয়েকমাস হল, বাঁশি শেখার দিকে একটা ঝোঁক গেছে ধ্রুবর। বলা ভাল, কতকটা ওর বাবার কাছ থেকেই এই নেশাটা পেয়েছে ও। ধ্রুবর বাবা ধৃতিমান সেন ছোটবেলা থেকে বেশ ভাল বাঁশি বাজাতেন, কয়েকটা প্রতিযোগিতায় পুরষ্কারও পেয়েছিলেন। তারপর সংসারের আর অফিসের চাপে শখের ইচ্ছেটা নিয়ে আর এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি তিনি। ছোট থেকেই তাই ধ্রুব বাবার কাছে বেশ কয়েকজন শিল্পীর নাম শুনেছে, যাদের বাঁশির যাদুতে মুগ্ধ হয়েছে গোটা ভারত, তাদের মধ্যে পান্নালাল ঘোষ, রাজেন্দ্র প্রসন্ন, রঘুনাথ শেঠ, শঙ্কর রাও আর হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি ধ্রুবর খুব ভাল লাগে। বেশ কয়েকমাস হল ও বাবার পুরনো আড়বাঁশিটা নিয়ে অল্প বিস্তর সুর তোলার চেষ্টা করছে। একটু আগে তাই নোটবুকটার শেষ পাতায় নোটেশনের আকারে লেখা কয়েকটা সুর দেখেই ধ্রুবর মনে প্রথম খটকাটা জেগেছে। বাঁশিটা হাতে নিয়ে সেটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল ধ্রুব। বেশ পুরনো হয়ে গেলেও এটার সমস্ত গায়ে কাঠের উপর যে সূক্ষ কারুকাজ করা আছে, সেটাই বাঁশিটাকে যেন একটা অদ্ভুত মাত্রায় নিয়ে গেছে – বাঁশিটার সমস্ত গায়ে যে কারুকাজ করা, তার সমস্তটা জুড়েই ছোট ছোট মানুষের করোটির চিহ্ন আঁকা আর অদ্ভুত হরফে বেশ কিছু অক্ষর খোদাই করা আছে। বাবার কাছে ধ্রুব শুনেছে, মূলত ছয় ধরণের বাঁশি এখন পাওয়া যায় – সরল, আড়, টিপরাই, সানাই, ডিন আর মোহন বাঁশি; কিন্তু এই অদ্ভুত দেখতে বাঁশিটা বর্তমান আড়বাঁশিগুলোর তুলনায় অনেকটাই লম্বা আর আকার আয়তনে বেশ আলাদা। ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু চিন্তা করল, তারপর টুক করে বাক্সের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নোটবুকটা বার করে শেষ পাতাটা খুলে সেটা চোখের কাছে এনে চোখ কুঁচকে পড়তে লাগল। নোটেশনগুলোর কয়েকটা ধ্রুবর চেনা হলেও এইভাবে সুর সাজানোর পদ্ধতি ও এর আগে কোথাও দেখেনি! এই বাঁশিটার খোঁজ কী ওর বাবা জানতেন না? কই, এরকম কিছুর কথা তো বাবার মুখে কোনদিনই শোনেনি ধ্রুব বা লাবণ্য। মনে মনে এবার বাঁশিটা বাজানোর জন্য অদ্ভুত একটা টান অনুভব করতে লাগল ও। লাবণ্য চুপচাপ ওর দাদাকে লক্ষ করছিল। ধ্রুব চুপচাপ বাঁশিটা হাতে নিয়ে ভাঙ্গা জানলাটার কাছে গিয়ে একবার চোখ বুজে নোটবুকের শেষ পৃষ্ঠায় লেখা সুরের সারমর্মটা বুঝে নিল। তারপর একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বাঁশির প্রথম ফুটোয় ঠোঁট রেখে একটা শক্তিশালী ফুঁ দিল ও।
একটা তীব্র আর তীক্ষ্ণ যান্ত্রিক শব্দে কানে তালা লেগে গেল লাবণ্যর। ধ্রুবও ততক্ষণে বাঁশিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দুহাতে কান চেপে ধরেছে। এমন অদ্ভুত তীক্ষ্ণ শব্দ যে কোন বাঁশির থেকে বেরতে পারে, এটা ওর একেবারেই ধারণা ছিল না! কোনমতে সামলে উঠতে না উঠতেই এবার আরও একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে ধ্রুব আর লাবণ্যর সমস্ত শরীরে একটা হিমশীতল শিহরণ খেলে গেল। টিনের বাক্সটার মধ্যে থেকে এবার ঝিরঝির করে একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গের শব্দ কানে আসছে। সেই অদ্ভুত দেখতে ট্র্যানজিস্টারটা এবার হঠাৎ নিজে নিজেই বেজে উঠল। সেটার মধ্যে থেকে ঝিরঝির শব্দটা থেমে গিয়ে একটা গম্ভীর আর উদ্বিগ্ন গলায় কেউ যেন বলে উঠল, “ধীমান – তুই কোথায়? যেখানেই আছিস তাড়াতাড়ি চলে আয় প্লিজ – আমি এখানে লুকিয়ে রয়েছি – তুই না আসলে ও আমাকে মেরে ফেলবে – হ্যালো – হ্যালো…শুনতে পাচ্ছিস?”
ধ্রুব আর লাবণ্য কাঠ হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সকাল থেকে একটার পর একটা যে অদ্ভুত জিনিসগুলো ওদের সাথে ঘটে চলেছে, সেগুলোর পরিষ্কার ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটা ওদের কাছে ধোঁয়াশার মতোই থেকে যাবে। ভয়ার্ত মুখে দাদার দিকে তাকাল লাবণ্য। ট্র্যানজিস্টারটার ভেতর থেকে তথনও একটানা সেই গলার স্বরটা “হ্যালো – হ্যালো ‘করে চলেছে! বিস্ময়ের প্রথম ধাপটা কাটিয়ে উঠে এবার চুপিচুপি বাক্সটার ভেতর উঁকি দিল ধ্রুব। চৌকো জিনিসটার পেটের মধ্যে একটা ছোট ডিসপ্লে। ঘরের ভিতর আাসা রোদের আলোয় ও দেখতে পেল, একটু আগে দেখা বাঁশিটার গায়ে আঁকা ছোট ছোট করোটির চিহ্নগুলো এখন সেই ডিসপ্লেটার গা বেয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। বুকে খানিকটা সাহস এনে এবার ধ্রুব বলে উঠল, “ইয়ে – আপনি কাকে চাইছেন? আপনার পরিচয়?”
ধ্রুবর গলার স্বর শুনে এবার কন্ঠস্বরটা কিছুক্ষণের জন্য থামল। ডিজিটাল করোটিগুলোর গতিটাও যেন কিছুটা কমে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে আবার গলাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল, “তুমি কে হে? আমি ধীমানকে খুঁজছি! ওর মেশিনটা তুমি পেলে কোথায়? কে তুমি?”
ধ্রুব এবার কিছুটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি-আমরা মানে আমি আর আমার বোন পুজোর ছুটিতে পুরুলিয়ায় দাদুর বাড়ি বেড়াতে এসে চিলেকোঠার ঘরে এই জিনিসটা খুঁজে পেলাম। কিন্তু এটা তো অনেক পুরনো আর খারাপ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে! আপনি তাহলে এটাতে যোগাযোগ করতে পারছেন কী করে?”
ধ্রুবর কথা শুনে কন্ঠস্বরটা এবার বিশ্রী খ্যাঁতখ্যাঁক শব্দ করে হেসে উঠে বলল, “পুরুলিয়ায় দাদুর বাড়ি বেড়াতে এসেছ? চিলেকোঠায় খুঁজে পেয়েছ? হা-হা-হা! বাহ্, বেশ ভাল গল্প ফাঁদতে পার তো হে ছোকরা! তোমার নাম কী? তুমি ধীমানের জিনিসটা নিয়ে কী করছ? ওকে শিগগির আসতে বল, আমার হাতে বেশি সময় নেই – ও আমাকে খুঁজছে – আমি এখানে কোনমতে গা ঢাকা দিয়ে আছি – ধীমানকে জায়গাটার ঠিকানা জানান খুব প্রয়োজন – এই সময় একমাত্র ওর উপর আমি ভরসা রাখতে পারি – ”
ভদ্রলোকের কথা শুনতে শুনতে লাবণ্য কিছু ভাবছিল। ধ্রুবর জামার হাতাটা টেনে কানের কাছে মুখ এনে এবার ফিসফিস করে বলল, “দাদা – ধীমান মানে কী আমাদের বড়দাদুর কথা বলতে চাইছেন উনি?”
তাইতো! এই কথাটা এতক্ষণ ধ্রুবর মাথাতে আসেনি কেন? একটা গলা খাঁকরানি দিয়ে ধ্রুব বলল, “দেখুন, আপনি কে বা আপনি কোন বিপদের কথা বলছেন আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু ধীমান মানে আপনি কী ধীমান সেনের কথা বলতে চাইছেন? কিন্তু উনি তো অনেক বছর আগেই মারা গেছেন –”
ধ্রুবর কথা শেষ হওয়ার আগেই যান্ত্রিক আওয়াজটা এবার ওকে ধমকে উঠে বলল, “তুমি আচ্ছা বেয়াদপ ছোকরা তো! আমার সাথে অনেক আগে থেকেই কথা বলে সব ঠিক করে রাখা আছে – পুলিশের লোক আমাকে পাগলা কুত্তার মত খুঁজে বেরাচ্ছে – ধীমান আমাকে কথা দিয়েছে – সবার চোখ এড়িয়ে আমাকে কোন সুরক্ষিত জায়গায় পৌঁছে দেবে – নয়তো আমি ওদের শরীরকে আবার বাঁচিয়ে তুলে অন্ধকারের সাথে লড়াই করতে পারব না – আমার এত বছরের সাধনা — না! এ হতে পারে না! আজ সন্ধেতেই ধীমান এসে আমাকে এখান থেকে বার করে নিয়ে যাবে কথা দিয়েছে – আর তুমি বলছ ও অনেক বছর আগে মারা গেছে? হা-হা-হা! তুমি আমার সাথে মশকরা করছ ছোকরা? তুমি জান তুমি কার সাথে কথা বলছ? আমার নাম সত্যজিৎ বিশ্বাস!”
নামটা শোনা মাত্র ধ্রুবর সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। গোটা ঘরে একটা পিন পড়লেও যেন তার শব্দ শোনা যাবে। এই লোকটাই তাহলে সেই সত্যজিৎ বিশ্বাস যে কাল থেকে ধ্রুব আর লাবণ্যকে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চাইছে নানাভাবে? উনি কী জানেন না যে আজ প্রায় সত্তর বছর হতে চলল ওদের প্রপিতামহ শ্রী ধীমান সেন পরলোকগত হয়েছেন? কী চান উনি?
বুকে যতটা সম্ভব সাহস এনে দৃঢ় গলায় ধ্রুব বলল, “দেখুন সত্যজিৎ বাবু – আপনার কোথাও একটা বিরাট গন্ডগোল হয়েছে – আমরা পুরুলিয়ায় ঘুরতে এসে চিলেকোঠার ঘর থেকে আপনার এই জিনিসটা পেয়ে –”
কন্ঠস্বরটা আরো বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “পুরুলিয়ার তুমি কী জানো হে ছোকরা? আমার থেকে ভাল এই এলাকা কারুর নখদর্পণে নেই – আর তাই আমি যেখানে লুকিয়ে আছি, পুলিশ আমার টিকিটাও ছুঁতে পারবে না – কিন্তু আমার – আমার খুব বিপদ – আমাকে ও ছাড়বে না – মন্ত্রটা পরীক্ষা করার এর থেকে ভাল সুযোগ আমি আর পাব না – ধীমানকে যেখান থেকে হোক আংটির খবরটা দিতে হবে – ওটা ও ছাড়া আর অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না – খুব গোপনীয় ব্যাপার – খুব –”
সত্যজিৎবাবুর কথা এবার একবর্ণও বুঝতে পারল না ধ্রুব আর লাবণ্য। লোকটার কী মাথায় গন্ডগোল আছে? এসব কী বলে চলেছেন উনি? কীসের মন্ত্র? কীসের আংটি? বড়দাদু কী তবে ভদ্রলোককে চিনতেন?
ধ্রুব এবার একটু কড়া গলায় বলল, “বড়দাদুকে মানে ধীমানবাবুকে আপনি কীভাবে চেনেন?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর যান্ত্রিক কন্ঠস্বরটা বলে উঠল, “ধীমান পাঠশালায় আমার সহপাঠী ছিল। সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। আমি যখন পড়াশুনা ছেড়ে দেবীর আরাধনায় সমস্ত জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছি, তখন ধীমান ছাড়া আর কেউ আমার পাশে থেকে আমাকে সাহস দেয়নি! বরং বলা চলে, ধীমানের জন্যই আজ আমি আমার সাধনায় সিদ্ধ হতে পেরেছি। উপযুক্ত দিনক্ষণ বুঝে বুকে সাহস এনে একটার পর একটা শবদেহের উপর বসে আমি বহু বছর ধরে সাধনা করে আসছি – আমার গোপন ডেরার খোঁজ একমাত্র জানত ধীমান। ও আমাকে সবরকম ভাবে সাহায্য করেছে। ও খুব ভাল ইলেকট্রনিক্সের কাজ জানে – যে ট্র্যানজিস্টারটা দিয়ে আমি এখন কথা বলছি এটা ধীমানই আমাকে নিজের হাতে বানিয়ে দিয়েছে – এই যন্ত্র দিয়ে আমি তেনাদের সাথে কথা বলতে পারি যাদের অস্তিত্ব এই মনুষ্য সমাজে চিরটাকালই রহস্যের ঘেরাটোপে আটকে থেকে গেছে। ধীমান সব জানত, কিন্তু কোনোদিনও আমার বিরোধীতা করেনি। আমার গুরুদেব বৈদ্যবাবার কাছেও ওকে নিয়ে গিয়েছি কয়েকবার – কিন্তু ইদানিং ওর ব্যবহারে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতা দেখতে পাচ্ছি – আরে বাবা – মানুষগুলো না মরলে আমি পরীক্ষা করব কীভাবে যে আমার মহাসঞ্জীবনী মন্ত্রটা কাজ করছে কিনা – আমার এত বছরের সাধনা – মৃত মানুষ আবার বেঁচে উঠবে – হেঁটে চলে বেরাবে – কথা বলবে – খিঁক খিঁক
খিঁক-!” বিশ্রী একটা শব্দ করে হেসে উঠল গলাটা।
ধ্রুব আর লাবণ্যর তখন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! সকাল বেলাতে এত আলোর মধ্যে দাঁড়িয়েও গলগল করে ঘামতে লাগল ওরা – দুজনের কারুর মুখেই কোন কথা নেই!
অপর প্রান্ত থেকে এবার হঠাৎ দুম দুম করে একটা শব্দ শোনা গেল। আর তার কিছুক্ষণ পরেই ওপাশ থেকে ভেসে এল একটা কর্কশ আর তীক্ষ্ণ জান্তব চিৎকার! সেই চিৎকার এতটাই বিভৎস যে সেটা শুনলে নিমেষে গায়ের রক্ত জল হয়ে যায়। সত্যজিৎবাবুও এবার মনে হয় একটু ভয় পেয়েছেন। কন্ঠস্বরটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফিসফিস করে বলল, “আমি জানি না – আমার কথাগুলো তোমাকে বলা উচিৎ কিনা – কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কাছে আর কোন উপায় নেই! আমি জানি না ধীমান কোথায় – তুমিই বা কে – কিন্তু আমার হাতে বেশি সময় নেই – আমার আংটিটার ঠিকানা ধীমানকে জানান প্রয়োজন, নয়তো আমার এতদিনের সাধনা বৃথা হয়ে
যাবে -”
কন্ঠস্বরটা থামতেই সেই তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজ আর দুম দুম করে শব্দটা আবার শোনা যেতে লাগল। লাবণ্যর তখন ভয়ে মুখটা ছোট্ট হয়ে এসেছে। ধ্রুব যতটা সম্ভব গলার স্বর শান্ত রেখে বলল, “সত্যজিৎবাবু, আপনি যে ধীমানবাবুকে খুঁজছেন – তিনি আমার প্রপিতামহ – আমার নাম ধ্রুব সেন। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি খুব বিপদের মধ্যে আছেন – আপনি চাইলে আমাকে বলতে পারেন, আমি যতটা সম্ভব আপনাকে সাহায্য করব -”
লাবণ্য ভয় পাওয়া চোখে ওর দাদার দিকে তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়তে লাগল।
কন্ঠস্বরটা এবার সাপের মতো হিসহিস করে বলল, “তুমি আমাকে বোকা পেয়েছ ছোকরা? ধীমানের ছেলে ধীরেন্দ্রর বয়স এখন মোটে তের বছর – যাই হোক – আমার এখন বেশি কথা বলার সময় নেই। এসব কথা কাউকে বলা যায় না। গুরুর বারণ আছে – কিন্তু আমি একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছি – আর তার জন্যই হয়তো আজ আমাকে – ধীমান ছাড়া অন্য কাউকে আমি ভরসা করতে পারি না – তুমি পুরুলিয়া কতটা চেন? কী কী নদী আছে এখানে জান?”
ধ্রুব একবার লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “জানি। কংসাবতী, কুমারী, শিলাবতী – উমম্ – দারকেশ্বর, দামোদর – আর সুবর্ণরেখা। আর তাছাড়া প্রথম ভারতীয় হিসেবে মিহির সেন ইংলিশ চ্যানেল পার করলেন – তিনিও পুরুলিয়ার লোক – সম্ভবত ১৯৫৮ সালে -”
ধ্রুবর কথা শেষ হওয়ার আগেই কন্ঠস্বরটা বলে উঠল, “এক মিনিট – কত সাল বললে? ১৯৫৮? মজা করছ ছোকরা? আজকের তারিখ ১৩ই সেপ্টেম্বর – ১৯৪৯!”
ধ্রুব বিড়বিড় করে বলল, “এ কীভাবে সম্ভব! আজকের তারিখ তো ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯!” বলতে বলতে গলাটা সামান্য কেঁপে গেল ধ্রুবর!
কন্ঠস্বরটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠল, “হা ঈশ্বর! সব মায়ের খেলা! আমি জানতাম শেষ সময়ে মা আমাকে নিরাশ করবেন না – তিনি – তিনি আমাকে রক্ষা করবেন – আমার এত বছরের সাধনা – আমি জানি না কীভাবে এটা সম্ভব – কিন্তু এটা মায়ের চমৎকারীত্ব ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। শোনো হে ছোকরা, তুমি যে-ই হও না কেন – এটুকু বুঝে নাও আজ এই মহান সন্ধিক্ষণে অতীত আর ভবিষ্যৎ একই সরলরেখায় মিশে গ্যাছে – আমি – আমি পেরেছি!”
ওপাশ থেকে সেই তীক্ষ্ণ জান্তব আওয়াজটা আবার ভেসে এল। কেউ যেন শক্ত হাতে একটা লোহার দরজায় কোন ভারী ভোঁতা জিনিস দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে! সত্যজিৎবাবু যে ভীষণ ভয় পেয়ে আছেন এটা বেশ বুঝতে পারল ধ্রুব। লাবণ্য ততক্ষণে গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, ধ্রুব সেটা দেখতে পেয়ে ওর হাত ধরে টেনে থামাল। দাদুর বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটায় পা দেওয়ার পর থেকে যা যা ঘটে চলেছে, সেসব ধ্রুব বা লাবণ্যের বোধবুদ্ধির বাইরে। তবু ধ্রুব এটুকু বুঝতে পারল, যে এই সত্যজিৎ বিশ্বাস নামের লোকটা বদ্ধ উন্মাদ – সম্ভবত তান্ত্রিক গোছের কেউ হবে – কোন গোপন জায়গায় সাধনার জন্য লুকিয়ে রয়েছেন – কেউ হয়তো তাকে ভয় দেখাচ্ছে – দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে এই বাক্সটা চিলেকোঠার ঘরটায় বন্ধ হয়ে ছিল – হয়তো এই বাক্সটা কেউ খোলেনি বলে এত বছর ধরে উনি কারুর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন নি! কোনভাবে আজ ধ্রুব আর লাবণ্য এই যন্ত্রটার সংস্পর্শে আসার পর লোকটার সাথে অদ্ভুত ভাবে একটা যোগাযোগ ঘটে গেছে। বাইরের পৃথিবী যে এত বছর এগিয়ে গিয়েছে, সেটা হয়তো উনি এখনও জানেন না! ওনার চিকিৎসার প্রয়োজন। দাদুকে বললে দাদু হয়তো চিনতে পারবেন সত্যজিৎ বিশ্বাসকে! কিন্তু উনি এখন আছেন কোথায়? আর ওই অদ্ভুত শব্দটাই বা কোন জন্তুর? আর কাল রাতে দেখা ওই স্বপ্নটা? সেটারই বা কী মানে? অনেকগুলো প্রশ্ন ধ্রুবর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
গলাটা পরিষ্কার করে ধ্রুব বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি আপনি বিপদে আছেন – আপনি দয়া করে আপনার ঠিকানাটা আমাকে বিশ্বাস করে বলুন, আমি যতটা সম্ভব আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা-”
ধ্রুবর শেষ কথাগুলো যেন কানেই গেল না সত্যজিৎ বিশ্বাসের। তার আগেই আবারও সেই ভয়ংকর তীক্ষ্ণ চিৎকারটা ভেসে এল। কন্ঠস্বরটা এবার খানিকটা চঞ্চল হয়ে উঠে বলল, “আমার গোপন ডেরার ঠিকানা ধীমান জানে – পারলে ওর কাছে জেনে নিও – আমার হাতে সময় খুব কম – আমি – আমি শেষবার একটা ভয়ংকর পরীক্ষা করেছি বুঝলে – যে শবটাকে আমি বাঁচিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম সেটা বিলাস ভদ্রের – কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার – ওকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে ধীমানই সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। শবসাধনা করার জন্য আমাকে দিনরাত এক করে মহাকালীতলা শ্মশানে বা আমার এই গোপন ডেরার সারাক্ষণ পড়ে থাকতে হত, কাজেই আমার পরীক্ষার গিনিপিগগুলো জোগাড় করার জন্য আমার একটা লোকের দরকার ছিল – এমন একজন যে চোখের নিমেষে মানুষের মাথা দেহ থেকে আলাদা করে দিতে পারবে – একজন ঠান্ডা মাথার খুনি! ধীমান তো এখন সরকারের নাম করা উকিল – ওকে বলাতে ও প্রথমে রাজি হয়নি। পরে বন্ধুর করুণ চোখের দিকে তাকিয়ে শেষমেশ রাজি হল। বিলাসকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার পর ওকে দিয়ে আমার সাধনার বাকি শবদেহগুলো জোগাড় করতে লাগলাম। ধীমান সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকত, কাজেই ও বেশি সময় দিতে পারত না! এদিকে হারানো বাচ্চাগুলোকে খুঁজতে পরিবারের লোকেরা পুলিশে যায় – ব্যস – ব্যাটারা আদাজল খেয়ে আমার পেছনে এঁটুলির মতো লেগে গেল – আমি পালিয়ে বেরাতে বেরাতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এদিকে আমার সাধনার সমস্ত শবদেহ মোটামুটি জোগাড় হয়ে গেছে – দরকার একটা শেষ দেহ!
বিলাসটাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাটা আজকাল বিপজ্জনক – পুলিশের চোখে ধরা পড়ে গেলে ব্যাটা আমার এতবছরের সাধনা পন্ড করে দিতে পারে। আমি এবার একটা অন্য উপায় ফাঁদলাম। এক অমাবস্যার রাতে খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বিলাসের মুন্ডুটা আস্তে আস্তে একটা ড্যাগার দিয়ে কেটে ওর ধড় থেকে আলাদা করে দিলাম – তারপর ওর দেহের উপর বসেই শুরু করলাম আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা। কিন্তু সাধনার পদ্ধতিতে আমার ছোট্ট একটা ভুল হয়ে গেল – আজ এতদিন ধরে সেই ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে আমাকে! বিলাসের শরীরটা আর আগের মতো বেঁচে ওঠেনি – ওর শরীরটায় পিশাচ বাসা বেঁধেছে – আমাকে মেরে ফেলতে চায় – এ সাধনা বড় ভয়ংকর! একচুল এদিক ওদিক হলেই সব শেষ – আমি লুকিয়ে রয়েছি একটা পুরনো গুমঘরে- ধীমান ছাড়া আর কেউ এই জায়গার ঠিকানা জানে না – আমি ওকে বলেছিলাম আমাকে বৈদ্যবাবার কাছে নিয়ে যেতে – উনিই একমাত্র আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন! আজ সন্ধেতে ধীমানের আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল – কিন্তু – কিন্তু – পিশাচটা ঠিক আমার গন্ধ শুঁকে শুঁকে এখানে চলে এসেছে – আমাকে মেরে ফেলবে -”
ধ্রুব আর লাবণ্য এবার ওখানে দাঁড়িয়েই ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল। একবার মনে হচ্ছে ছুটে পালিয়ে যাবে, কিন্তু পরক্ষণেই টের পেল ওদের পাগুলো যেন কেউ শক্ত লোহার পেরেক দিয়ে মেঝের সঙ্গে আটকে দিয়েছে, ওই জায়গা ছেড়ে ওদের নড়ার এতটুকুও ক্ষমতা নেই! সমস্ত চিলেকোঠার ঘরটা যেন চাপ চাপ ধোঁয়ায় ভরে গিয়ে একটা বিভৎস হত্যাপুরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ঘোর লাগা চোখে লাবণ্য আর ধ্রুব হাঁ করে তাকিয়ে আছে চৌকো যন্ত্রটার দিকে, ডিজিটাল করোটিগুলো ততক্ষণে কন্ঠস্বরটার তালে তাল মিলিয়ে ছোট্ট ডিসপ্লেটা জুড়ে আবার ছুটোছুটি শুরু করেছে।
সত্যজিৎবাবুর কন্ঠস্বরটা যেন এখন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। গুমঘরের লোহার দরজায় যে জিনিসটা এতক্ষণ ধরে ধাক্কা দিয়ে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে, সেটা যে কী বিভৎস আর ভয়ানক জীব – সেটা তার শরীরী জান্তব ভাষাতে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একবার হাতের মুঠোয় পেলে সে জানোয়ার যে সত্যজিৎবাবুকে ছিঁড়ে খাবে, সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না দুই ভাই-বোনের! এখন ওদের ঠিক কী করণীয়, সেটা ঠাওর করতে না পেরে চুপচাপ নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়েই দরদর করে ঘামতে লাগল ধ্রুব আর লাবণ্য।
কন্ঠস্বরটা এবার মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ধ্রুব সেন – আমি জানি না আমার তোমাকে বিশ্বাস করা উচিৎ কিনা – ধীমানের সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না – কিন্তু আমার হাতে আর বেশি সময় নেই – যেকোন মুহূর্তে বিলাসের পিশাচটা দরজাটা ভেঙ্গে ফেলবে – আমার কাছে এখন তুমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন রক্ষাকর্তা নেই – তোমার নামটা আমি আমার নোটবুকে লিখে দিলাম – সাথে একটা মন্ত্র – আমার মন্ত্রপুত আংটিটা আমি এই ট্র্যানজিস্টারের মধ্যে লুকিয়ে দিলাম – আমার মৃত্যুর পর আমার দেহ খুঁজে না পেলেও এই আংটিটা পাবে – রাত বারোটার পর এই আংটি ডান হাতের মধ্যমায় পরিধান করে মন্ত্রটা আউরালেই আমি আবার জেগে উঠব – নতুন শরীরে – আমার সাধনা সফল হবে – আমি আবার বেঁচে উঠব – মৃত্যুকে আমি হার মানাব- কিছুতেই জিততে দেব না – কিছুতেই না – হা হা হা!…”
গুড়ুম করে একটা ধাতব শব্দ হল, লোহার দরজাটা বোধহয় হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। লাবণ্যর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ধ্রুব কান খাড়া করতেই বুঝতে পারল, ওপাশের গুমঘরটার ভেতর যেন একটা ছোটখাট কালবৈশাখী বয়ে যেতে শুরু করেছে – শোঁ-শোঁ করে তীব্রভাবে হাওয়া বইছে। তীক্ষ্ণ একটা জান্তব চিৎকারে ওদের কানে তালা লেগে গেল, আওয়াজটা যেন ওদের থেকে হাত দুয়েকের মধ্যেই হল – আর পরক্ষণেই ওদের কানে ভেসে এল মানুষের গলায় এক অমানুষিক চিৎকার – সেই চিৎকারে গোটা চিলেকোঠার ঘরটা যেন লাবণ্য আর ধ্রুবর চোখের সামনে থরথর করে কেঁপে উঠল। হঠাৎ আবার একটা ঝিরঝির করে শব্দ শোনা গেল চৌকো যন্ত্রটায় – তারপর ফস্ করে ডিসপ্লের জ্বলতে থাকা আলোটা নিভে গেল। সবকিছু চুপচাপ – আবার আগের মতোই স্বাভাবিক। ধ্রুব এতক্ষণে ঘোর কাটিয়ে উঠে চারদিকে চোখ মেলে তাকাল। মাথাটায় দপদপ করে একটা যন্ত্রণা হতে শুরু হয়েছে। লাবণ্য তখনও একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে যন্ত্রটার দিকে। ধ্রুব কিছু বলল না; টলতে টলতে গিয়ে হাতের চাপে চিলেকোঠার ভাঙ্গা জানলাটা খুলে দিল। বাইরে তখন শরতের মিষ্টি রোদ উঠেছে; জানলা দিয়ে আসা রোদের আলোয় ভেতরের অলৌকিক পরিবেশটা কেটে গিয়ে গোটা ঘরটার চেহারা যেন নিমেষে বদলে গেল।
সিঁড়ির দিক থেকে পিসিমার গলা শুনে চমক ভাঙ্গল লাবণ্যর। পিসিমা খেতে ডাকছেন। নিচে ডাইনিং হলের ঘরটা থেকে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটায় ঢং ঢং করে বারোটা বাজার ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেল ধ্রুব।
দুপুরে খেতে বসে ধ্রুব একটা কথাও বলল না। ওর মাথার মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেগুলো পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি নেই। লাবণ্যর শরীরটা বিশেষ ভাল নেই, চিলেকোঠার ঘর থেকে ফিরে ধূম জ্বর এসেছে ওর। কোনরকমে অল্প করে ভাত খাইয়ে একটা ওষুধ দিয়ে ওকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন পিসিমা। খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন ধীরেন্দ্রবাবু বারান্দায় রাখা আরামকেদারাটায় গা এলিয়ে বসলেন, ধ্রুব চুপিচুপি এসে দাদুর সামনে দাঁড়াল। ভ্রূ কুঁচকে উনি জানতে চাইলেন ধ্রুব কিছু বলতে চায় কিনা। খানিকটা ইতস্তত করার পর মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা প্রথম প্রশ্নটা দাদুর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে বসল ধ্রুব, “সত্যজিৎ বিশ্বাস – কে?”
ধীরেন্দ্রবাবু সবে আরাম করে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে সেটায় টান দিচ্ছিলেন, ধ্রুবর প্রশ্নটা শুনে বিড়ির ধোঁয়ায় একটা জোরদার বিষম খেলেন ভদ্রলোক। কাশতে কাশতে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ধ্রুবকে মাথা থেকে পা অবধি ভাল করে দেখে নিয়ে বেশ সন্দিগ্ধ গলায় বললেন, “এই নামটা – তুমি কার কাছে শুনলে?”
ধ্রুব কিছু বলল না। আজ সকালের সেই ভয়াবহ ঘটনাটা বেমালুপ চেপে গিয়ে প্যান্টের পেছন পকেট থেকে সত্যজিৎ বিশ্বাসের নোটবুকটা দাদুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই যে – আজ সকালে আমি আর বোনু চিলেকোঠার ঘরটায় গিয়েছিলাম, সেখানেই একটা টিনের বাক্সের মধ্যে এটা খুঁজে পেলাম। উনি যদি আমাদের বংশের কোন পূর্বপুরুষ না হয়ে থাকেন, তাহলে ওনার জিনিসগুলো আমাদের বাড়ির চিলেকোঠায় অমন যত্ন করে লুকিয়ে রাখা রয়েছে কেন?”
ধ্রুবর হাতে ধরা হলুদ নোটবুকটার দিকে চোখ যেতেই ধীরেন্দ্রবাবু মনে মনে একবার যেন শিউরে উঠলেন। মুখের চারদিকে একটা দুশিন্তার কালো মেঘ যেন জমাট বাঁধতে শুরু করেছে তাঁর। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বেশ ঠান্ডা গলায় উনি বললেন, “দাদুভাই, তুমি এখনও খুব ছোট। আমাদের পরিবারের একটা কলঙ্কিত ইতিহাস আছে, ইনফ্যাক্ট সব পরিবারেরই থাকে! সেরকম আমাদের পরিবারের ইতিহাসে এই নামটা খুব অস্বস্তিকর – সত্যজিৎ বিশ্বাস। কতগুলো বছর যে আমাদের এই নামটার পেছনের মানুষটার কার্যকলাপের জন্য ভুগতে হয়েছে, সেকথা ভাবলে আমার আজও শরীরটা শিউরে ওঠে। আজ গেছ, ভাল, কিন্তু আর যেন কখনও তোমাকে বা দিদিভাইকে ওই চিলেকোঠার ঘরটায় যেতে না দেখি, ওখানে যাওয়া বারণ আছে। বাক্সটায় তালা দেওয়া ছিল, সেটা তোমরা খুললে কী করে?”
ধ্রুব মনে মনে প্রমাদ গুনল। নামটা শোনার পর থেকেই দাদু যেরকম খাপ্পা হয়ে উঠলেন, তাতে ওর মনের অন্ধকার দূর হওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই। এই নামটা শোনা মাত্র দাদু এমন ভাবে ভয় পেয়ে গেলেন যেন কোন বিভৎস অভিশাপ এই গোটা সেন পরিবারকে একটা নিকষ কালো আতঙ্কের আলখাল্লায় ঢেকে রেখেছে। কী এমন কলঙ্কিত ইতিহাস জুড়ে আছে এই সেন পরিবারের সঙ্গে? কই ওর বাবাও তো কোনদিন এই ব্যাপার নিয়ে ওদের কিছু জানায় নি!
ধ্রুব মরিয়া হয়ে বলে উঠল, “দাদু, তুমি যখন বারণ করলে, আমরা কেউ আর ওই চিলেকোঠার ঘরে যাব না। বোনু একটু সুস্থ হলে ওকেও আমি বারণ করে দেব। কিন্তু দাদু, আমি এই সেন পরিবারের সেই কলঙ্কিত ইতিহাসের কথাটা একবার জানতে চাই। আমার ভীষণ আগ্রহ হচ্ছে। নোটবুকটার শেষ পৃষ্ঠায় আমার নাম লেখা। তাই ইতিহাসের এই মুছে যাওয়া অধ্যায়টা যতক্ষণ না আমি জানতে পারছি, ততক্ষণ আমার শান্তি নেই। তুমি প্লিজ আমায় প্রথম থেকে সবটা খুলে বল, দাদু!”
ধ্রুবর করুণ গলার আবেদন শুনে ধীরেন্দ্র সেনের মন কিছুটা নরম হল। নিভে আসা বিড়িটায় কয়েকটা বড় বড় টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে উনি বলতে লাগলেন, “দাদুভাই, আজ যে কথাগুলো তোমাকে বলতে চলেছি, মনে রেখ, এটা আমাদের পরিবারের একটা গোপনীয় ব্যাপার। দিদিভাই বাচ্চা মেয়ে, ওর কানে যেন এসব কথা না যায়। কিছু জিনিসকে উপভোগ করতে হলে উপযুক্ত বয়সের দারস্থ হতে হয়, সে বয়স ওর এখনও হয়নি। যে সময়ের কথা আমি বলতে চলেছি, সেই সময়ের সমাজ আর রাজনৈতিক রূপরেখা বর্তমানের সমাজের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। সদ্য স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস তখন ক্ষমতার কেন্দ্রে, গোটা পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারের মাটিতেও কংগ্রেস সরকার নিজের আধিপত্য তৈরি করে নিয়েছে। সেই সময় মানভূমের বাংলাভাষীদের নিজের ভাষা কেড়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছিল তৎকালীন বিহার সরকার কংগ্রেস; জোর করে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে উঠল সমস্ত মানভূমবাসী। শুরু হল ভাষার অধিকার বজায় রাখার এক কালজয়ী আন্দোলন। এই আন্দোলন তৎকালীন রাজনীতিতে এতটাই আলোড়ন তৈরি করেছিল, যে তার জেরে ১৯৪৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে যেতে বাধ্য হয়। পুরলিয়াতে তৈরি হয় লোক সেবক সংঘ।
এদিকে ঘটে আরেক কান্ড! ১৯৫২ সালের জনগণনা রিপোর্টে একটা ব্যাপার পরিষ্কার ভাবে উঠে আসে যে, ধানবাদ থেকে টাটা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের মাতৃভাষা বাংলা। যদিও পরে সেই রিপোর্ট পাল্টে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তার বদলে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাতৃভাষা হিসেবে হিন্দিকে তুলে ধরা হয়। পরে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলা-বিহার অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব রেখেছিলেন বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ আর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি গৃহীত হল।
বঙ্গ-বিহার সংযুক্তি কার্যকর হবে একথা ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা মানভূমবাসী। বিক্ষোভের ঊষাকালে লোকসেবক সংঘের নেতৃত্বে শুরু হয় বঙ্গ সত্যাগ্রহ আন্দোলন। ১৯৫৬ সালের ২০শে এপ্রিল তিনশোরও বেশি মহিলা সহ ১০২৫ জন ভাষা সত্যাগ্রহী পায়ে হেঁটে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। টানা ১৮ দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে ৭ই মে তারা কলকাতা পৌঁছান। কিন্তু সেখানেই ঘটে বিপদ; একে একে গ্রেফতার করা হয় পুরুলিয়ার ভাষা সৈনিকদের, যদিও পরে তাদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আন্দোলনের কিংবদন্তী নেত্রী ছিলেন লাবণ্য প্রভা ঘোষ। আমার দিদিভাই-এর জন্মের সময় ওর নামটা ওই ভদ্রমহিলার স্মরণেই রেখেছিলাম আমি। লাবণ্যদেবীকে পরে তিনবার গ্রেফতারও করা হয়েছিল। আচ্ছা, দাদুভাই, তুমি এই লাবণ্য প্রভা ঘোষের স্বামী অতুল চন্দ্র ঘোষের নাম শুনেছ?”
ধ্রুব এতক্ষণ মন দিয়ে ওর দাদুর কথা শুনছিল। দাদুর প্রশ্নটা শুনে খানিক্ষণ ঠোঁট কামড়ে কিছু ভেবে নিয়ে বলল, “উমম্ – অতুল চন্দ্র ঘোষ – এই নামটা সম্ভবত ইতিহাস বইতে পেয়েছি – বোনুর প্রিয় বিষয় – ও থাকলে আরো ভাল বলতে পারত। ওনাকেই কী ‘মানভূম কেশরী ‘নামে ডাকা হত?”
ধীরেন্দ্রবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, একদম ঠিক কথা। অতুল চন্দ্র ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা থেকে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাছাড়া তিনি নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্তের সাথে সাথে ‘শিল্পপাশ্রম’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। বলতে পার, তিনিই ছিলেন ‘বঙ্গভুক্তি আন্দোলন’-এর প্রধান স্থপতি। ব্রিটিশ রাজত্বকালে অনেকদিন তিনি একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার পর তিনি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা ‘মুক্তি’-র সম্পাদনা করতেন। এই সত্যজিৎ বিশ্বাস অতুলবাবুর দূর সম্পর্কের ভাগ্নে ছিল। অতুলবাবু আর আমার বাবা ধীমান সেন অনেকগুলো বছর একসাথে আইন নিয়ে চর্চা করেছেন। সত্যজিৎ বাবার পাঠশালার সহপাঠী ছিল। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই একরোখা। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে পড়াশুনা করার একটা আগ্রহ ছিল ওর। অনেক ছোটবেলায় এক সাম্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের বাবা-মা কে হারায় সত্যজিৎ, আর তারপর অতুলবাবুর তত্বাবধানে ওনার বাড়ির কাছে চেলিয়ামা গ্রামে একটা ছোট বাড়িতে নিজের পড়াশুনা নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে ও। পুরুলিয়া অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় একটা গ্রাম এই চেলিয়ামা। গৌরবময় ইতিহাসের অনেক প্রাচীন নিদর্শন এই গ্রামে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। দাদুভাই, এই অঞ্চলে অসংখ্য যে সব মন্দিরগুলো রয়েছে, সেগুলো ভাল করে দেখলে বুঝতে পারবে, তাতে ১৭০০ শতাব্দীর পুরনো সমস্ত স্থাপত্য আর বিস্ময়কর ভাস্কর্যকে কী আশ্চর্য নিঁখুত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাই হোক, পাঠশালায় পড়ার সময় থেকেই ধীরে ধীরে সত্যজিৎবাবুর সাথে আমার বাবার একটা গাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ছোট থেকে বেশ বুদ্ধিমান হলেও নিজের মুখচোরা স্বভাবের জন্য সত্যজিৎ ওর জীবদ্দশায় আর একটিও বন্ধু করে উঠতে পারেনি, বাবা-ই ছিল ওর সমস্ত কর্ম থেকে দুস্কর্মের একমাত্র সঙ্গী।
সত্যজিৎ বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে চারদিকের রাজনৈতিক পরিবেশকেও বেশ দ্রুত বদলে যেতে দেখছিল। অতুলবাবু আর লাবণ্যদেবী তখন সক্রিয় ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। ওঁদের খোঁজে পুলিশ এসে প্রায়শই জিজ্ঞাসাবাদ করে যেত। অতুল চন্দ্র ঘোষকে দেশের স্বাধীনতার জন্য এভাবে লড়তে দেখে সত্যজিৎ-এর মনেও বিপ্লবের নতুন রং লাগে। আমরা মানুষেরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নানা রকমের মতের সম্মুখীন হই। এদিকে বাড়তে থাকা তীব্র আন্দোলনের চাপে প্রত্যাহার করে নেওয়া হল বঙ্গ-বিহার সংযুক্তি বিল। প্রচুর আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত মানভূম জেলার অবলুপ্তি ঘটে। ১৯৫৬ সালের পয়লা নভেম্বর ধানবাদ, বোকারো প্রভৃতি এলাকাকে বাদ দিয়েই নব কলেবরে গঠন করা হয় পুরুলিয়া জেলা।
নতুন পুরুলিয়া জন্ম নেবার ঠিক নয় বছর আগের কথা। সেই বছর চেলিয়ামা গ্রামের বিখ্যাত জোড়া অশ্বত্থতলার নীচের বেদিতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন বৈদ্যনাথ নামের এক বিশালদেহী জটাধারী সিদ্ধপুরুষ। তিনি কোথা থেকে এসেছিলেন, তা কেউ জানত না। যেমন তার টুকটুকে গায়ের রং, তেমনই তাঁর চোখের তেজ। স্থানীয়রা বলত, বৈদ্যবাবা যে সে সাধারণ সন্ন্যাসী নন, তিনি পিশাচতন্ত্রে দীক্ষিত এক অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন সিদ্ধপুরুষ। সেই অশ্বত্থতলার বেদীর পাশে সিঁদুর মাখিয়ে একটা বেশ বড় ত্রিশূল গেঁথে রাখতেন তিনি। পাশেই জ্বলত বিরাট একটা ধুনী। জনা পাঁচেক সাধুবাবা দিনের বেলায় সেখানে এসে আড্ডা দিত, গল্প করত। তাদের কারুর মাথায় লম্বা আবার কারুর মাথায় ছোট জটা। প্রত্যেকেরই লালচে গেরুয়া পোশাকে আপাদমস্তক মোড়া থাকত। যে সকল স্থানীয় মানুষেরা বিশ্বাস নিয়ে তাদের জীবনের নানা রকম সমস্যা সমাধান করতে আসত, তাদের সব সমস্যা নির্দ্বিধায় সমাধান করে দিত বৈদ্যবাবার অনুগামীরা। শোনা যায়, প্রতি অমাবস্যায় তিনি মহাকালীতলা শ্মশানে সমস্ত দেহ লাল কাপড়ে ঢেকে মাথার লম্বা জটা কাঁধ ছাড়িয়ে ছেড়ে নদীর জলে ভেসে আসা মৃতদেহের উপর বসে কর্ণপিশাচীর শবসাধনা করতেন। এলাকার সমস্ত মানুষ বৈদ্যবাবাকে বেশ সমঝে চলত, দুম করে তাঁকে ঘাঁটানোর খুব একটা সাহস পেত না কেউ। একদিন ঘটনাচক্রে এই বৈদ্যবাবার সাথে পরিচয় হয় সত্যজিৎ-এর, আর তারপরই বৈদ্যবাবার মুখে জীবণের কয়েকটা কঠিন সত্যি শুনে যেন রাতারাতি মানুষটার মতিভ্রম ঘটল। পড়াশুনার সমস্ত বিষয়ে জলাঞ্জলী দিয়ে দিনরাত ও এসে বৈদ্যবাবার শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য তাঁর পায়ের কাছে পড়ে থাকতে লাগল। আমার বাবাও দু-একবার তাঁর সন্নিকটে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বৈদ্যবাবার এক একটা কথার গূঢ়তা অনুধাবণ করতে সত্যজিৎ নিজের জীবন বাজি রেখে দিল। তন্ত্র মন্ত্রের দিকে ওর ঝোঁক তখন এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে, যে প্রিয় বন্ধু বারণও তখন তার কানে পৌঁছত না। সত্যজিৎ-এর মাথায় খুন চেপে গেল, তাকেও এই কর্ণপিশাচী সাধনায় দীক্ষিত হতে হবে – তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে সে – তন্ত্রের শক্তি নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে সে সেটা মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনে ব্যবহার করতে পারবে। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে সাহায্য করতে সম্মত হন। সত্যজিৎ তল্পিতল্পা গুটিয়ে এসে হাজির হয় বৈদ্যবাবার কাছে, তাকেও শেখাতে হবে এই গুরুমন্ত্র। সত্যজিৎ-এর জেদ দেখে প্রথমে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি, পরে অবশ্য তার সাহসের বেশ কয়েকটা শক্ত শক্ত পরীক্ষা নেওয়ার পর ওকে নিজের শিষ্যরূপে গ্রহণ করতে রাজি হন বৈদ্যবাবা।
এরপর শুরু হয় সাধনার এক কিম্ভূত অধ্যায়। দিনরাত এক করে বৈদ্যবাবার পায়ের কাছে পড়ে থেকে সত্যজিৎ অনেক গূঢ় আর গোপন তন্ত্রবিদ্যার অনুশীলন করতে থাকে। পুরুলিয়া জেলার ঝালদা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে একটা বাঁধ আছে, মুরুগুমা বাঁধ – এটা এমন একটা জায়গা যেখানে একইসাথে সুন্দর সূর্যোদয় আর মায়াময় সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। স্থানীয় লোকেরা বৈদ্যবাবা আর সত্যজিৎকে এই জায়গায় বসে একটানা অনেক মাস ধরে ধ্যান করতে দেখেছে। বৈদ্যবাবা সেখানে বসে একটা আড়বাঁশি বাজাতেন। সেই বাঁশির শক্তি নাকি এতটাই ভয়ানক ছিল যে, তা বাজিয়ে তিনি যেকোন মৃত মানুষের আত্মাকে ডেকে এনে বশীকরণ করতে পারতেন। যদিও সেসব লোকমুখে প্রচলিত কথা। তো যেটা বলছিলাম, গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করত বোধহয় জটিল কোন যাদুটোনার বিদ্যা বৈদ্যবাবা গোপনে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন সত্যজিৎকে।”
ধীরেন্দ্রবাবু থামলেন। হাতের বিড়িটা শেষ এসেছিল। পকেট থেকে প্যাকেটটা বার করে আরেকটা বিড়ি বার করে ধরালেন। ধ্রুব এতক্ষণ ধরে মন দিয়ে দাদুর কথাগুলো শুনছিল। এবার শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদু, এই যে তন্ত্রের ক্ষমতা বা বিন্যাস – এই ব্যাপারটা তোমার জানা থাকলে সেটা নিয়ে আমাকে একটু বলতে পারবে? আমার একেবারেই এই জিনিসটার ব্যাপারে কোন আইডিয়া নেই।”
ধ্রুবর প্রশ্ন শুনে ধীরেন্দ্রবাবু ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলেন। তারপর বিড়িতে একটা লম্বা টান মেরে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “হুম! কম বয়সে এই জিনিসটা নিয়ে আমিও অল্পবিস্তর পড়াশুনা করেছি। তন্ত্রের শক্তি বা মাহাত্য বোঝার মত বয়স তোমার এখনও হয়নি। এই জিনিসটার গভীরতা বুঝতে গেলে এখনও তোমাকে অনেকটা পড়াশুনা করতে হবে। বর্তমান দিনে এই জিনিসটার গুরুত্ব একেবারেই কমে এসেছে, অথচ যদি ঠিকঠাক অনুশীলন করা যায়, তবে এই বিদ্যা মানুষকে তার অন্তিম সীমায় পৌঁছে দিতে সক্ষম। যাই হোক, ব্যাপারটা সম্বন্ধে সংক্ষেপে তোমায় বলি, শোনো। এই তন্ত্র- ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ কিন্তু বেশ গভীর। তন্ত্র হল একটা বৃহৎ আর অতিপ্রাচীন গুপ্ত বা বলা ভাল লুপ্তপ্রায় বিষয়। মুক্ত বিশ্বকোষে বলা আছে, অন্যান্য পথের মতো তন্ত্রও হিন্দুসমাজে প্রচলিত ঈশ্বর উপাসনার একটি পথবিশেষ। এছাড়া শিব আর মহাশক্তির উপাসনা সংক্রান্ত শাস্ত্রগুলোকেও আমরা তন্ত্র সাধনার বিষয় হিসেবে ভাবতে পারি। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব হল শিব আর মহাশক্তির দিব্যলীলা। তন্ত্রে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আর রীতি-নীতির বর্ণনা রয়েছে তার উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অজ্ঞানতা আর পুনর্জন্মের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া।”
ধ্রুব বুঝতে পারল এই আধুনিক জগতের পেটের মধ্যে এমন আরও একটা গুপ্ত জগৎ রয়েছে যেটা নিয়ে সাধারণত বাইরে চর্চা করা হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা জটিল আর একান্তই গোপনীয়। দাদুর কথা খুব মন দিয়ে শুনতে শুনতে ধ্রুব প্রশ্ন করল, “আচ্ছা দাদু, এই তন্ত্রসাধনার বিষয়টা ঠিক কত পুরনো?”
আরাম কেদারাটায় হেলান দিয়ে খোলা জানলাটার দিকে তাকালেন ধীরেন্দ্রবাবু। কিছুক্ষণ মনে মনে উত্তরটা ভেবে নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, “বাবা চিরকাল চেয়েছিলেন যাতে আমি এই পথ থেকে দূরে সরে থাকি। তাই ইচ্ছে থাকলেও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিষয়টা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাইনি। কিন্তু বিষয়টার উপর আমার আগ্রহ ছিল অসীম। মূলত খ্রিস্ট্রীয় প্রথম সহস্রাব্দের দিকে তন্ত্র সাধনার প্রথম বিকাশ ঘটেছিল। তখন অল্পবিস্তর চর্চা চলত, কিন্তু সবটাই প্রায় গোপনে। অবশেষে গুপ্তযুগের শেষভাগে এই প্রথার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। মূলত বৌদ্ধধর্মের হাত ধরেই এই তন্ত্রশাস্ত্র পূর্ব এশিয়া আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে। এই তন্ত্রবিদ্যা সাধারণত গুরু শিষ্য পরম্পরার চলে আসে, এটা অনেক প্রাচীন একটা গুপ্ত বিদ্যা। প্রাচীন ভারত থেকে বহু মূল্যবান পুঁথি চীনা পরিব্রাজকরা তাঁদের দেশে নিয়ে চলে গেছেন। গুরু পরম্পরা বিদ্যা হওয়ার কারণে এই শাস্ত্রের কোন বিশেষ শাখার প্রকৃত গুরুর খোঁজ পাওয়া খুব কঠিন। কেবল দীক্ষা নিলে তবেই গুরুর থেকে শিষ্য এই শাস্ত্র সম্পর্কে সহজে নানান কৌশল শিখতে পারেন। ভারতের আদি আর অকৃত্রিম তন্ত্র সাধনার জায়গা হল নীলাচল পর্বত, যা ‘কামাখ্যাধাম’ নামে পরিচিত। “একটু হেসে ধীরেন্দ্রবাবু বললেন, “তন্ত্র এমনই একটা শাস্ত্র যার মাধ্যমে নিজেকে অনুসন্ধান করা যায় -নিজের অন্তরের ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যায়। আশা করি বিষয়টা তুমি বুঝতে পারছ।”
ধ্রুব ঘট করে একবার ঘাড় নেড়ে বড় বড় চোখে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদু, এই তন্ত্র শব্দের মানে কী?”
ধীরেন্দ্রবাবু বললেন, “তন্ত্র শব্দটার অর্থ ‘ব্যাপক’। সংক্ষেপে বললে, তন্ত্র হচ্ছে সৃষ্টির পরিচালনার নিয়ম। মহাদেব বা শিবের ডমরু থেকে এই তন্ত্রের উৎপত্তি। সতী বা দেবী দূর্গার দশ হাতে আছেন দশ মহাবিদ্যা। এই দশ মহাবিদ্যার উপর ভিত্তি করেই অনেকটা তন্ত্রশাস্ত্র গড়ে উঠেছে। দাদুভাই, তন্ত্রের বিষয়টা বুঝতে গেলে তোমাকে এর ব্যাপারে গভীর অধ্যয়ন করতে হবে কারণ এর ক্ষেত্র অনেকটাই বিশাল আর বিস্তৃত। সাধারনভাবে বললে, তন্ত্র অসীম জ্ঞানের আধার। সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধনার রিসার্চ করে দেখা গিয়েছে, যা অবিদ্যাকে গ্রাস করে তাই হল ‘জ্ঞান’। তন্ত্রসাধনা সাধারণত এই জ্ঞানচক্ষু উম্মোচন করে সৃষ্টির কারন বুঝতে সাহায্য করে। এক কথায় বললে, এই তন্ত্র সৃষ্টি, স্থিতি আর বিনাশের পরিচালনা শক্তি। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই তিন শক্তির পরিচালনার নিয়ম সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করে তন্ত্র। এছাড়া এই তন্ত্রের সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন মন্ত্র, নানারকম যন্ত্র। এই তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে সাধক সৃষ্টির রহস্য জেনে পরমানন্দ অনুভব করে। লোকমুখে শোনা, বৈদ্যবাবার নাকি এই বিশেষ ক্ষমতা ছিল যা দেখেই সত্যজিৎ আকৃষ্ট হয়ে সমস্ত জাগতিক হাতছানি পেছনে ফেলে নিজেকে তন্ত্র সাধনায় ডুবিয়ে দিয়েছিল।”
ধ্রুব ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “হুম! এখন ব্যাপারটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি। আচ্ছা দাদু, এই তন্ত্রসাধনা কী বিজ্ঞান ভিত্তিক নাকি পুরোটাই কোন কুসংস্কারের চাদরে ঢেকে রাখা হয়?”
ধীরেন্দ্রবাবু মিটমিট করে হেসে বললেন, “তন্ত্র সাধারণত প্রাকৃতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তার কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মাকে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে পুজো করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, তাকে নিয়ে দিনরাত সাধনা করতে চায়। পাশাপাশি, একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত যদি চৈতন্যময়ী শক্তিকে মেনে চলে তাহলে সেই চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধন হবে। এইখানেই মূলত বিজ্ঞান আর তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।”
ধ্রুব চুপ করে ভাবতে থাকল। ধীরেন্দ্রবাবু বলতে লাগলেন, “আমার যতদূর মনে আছে, চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবীরা হলেন দূর্গা, কালী, বাসুলী, তারা আর হ্যাঁ-শিবানী। কিন্তু এই তন্ত্রসাধনার কেন্দ্রে রয়েছেন অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে মা কালীর কাছ থেকে। আবার শিবের পৃথক নিজস্ব শক্তিও রয়েছে। এই ঘটনার কারণ হল, তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তি লাভ করে সাধারণত নারীশক্তির থেকে। তাই মনে করা হয় শিব তাঁর শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌরীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্ব-মহিমায় বিদ্যমান। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- প্রাকৃতিক শক্তির সাধনা করে ‘শিবত্ব’ লাভ করা তথা সর্বশক্তিমান হওয়া। সত্যজিৎও এই পথের বিমুখ ছিল না। তন্ত্রসাধনার গূঢ় কৌশল আয়ত্ব করার পর যে কোন সাধকের মতিভ্রম হতে বাধ্য। আর ঠিক এই দোটানার সুযোগ নিয়েই অনেক সাধক তন্ত্রসাধনার সহজ পথ ছেড়ে নানান জটিল আর ভয়ংকর পথে পথ চলতে শুরু করে। সেটাই ডেকে আনে তাদের কাল!”
ধ্রুব প্রশ্ন করে, “আচ্ছা দাদু, নারীশক্তির থেকে পুরুষের কাছে শক্তি সরবরাহের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না!”
ধীরেন্দ্রবাবু আরাম কেদারাটায় একটু সোজা হয়ে বসে বললেন, “দাদুভাই, আমরা জানি ঈশ্বর নিরাকার। তাঁর কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই। তন্ত্রমতে তাই এই নারীকেই জগতের আদি কারণ বলে মনে করা হয়, এই নিরাকার রূপহীন ঈশ্বরকে যখন নারী রূপে কল্পনা করা হয় তখন তাঁর মাহাত্ম্য ক্ষুন্ন হয় না। কাজেই ভক্তের মানসিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করেই এই মাতৃমূর্তির কল্পনা করা হয় তন্ত্রশাস্ত্রে।
আসলে কী জান দাদুভাই, এই তন্ত্র একটা খুব জটিল বিষয়। সাধারণত মনে করা হয় এর উৎস লুকিয়ে ছিল অনার্য উপাসনা পদ্ধতি আর বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে। তন্ত্রের উদ্ভব আর বিবর্তনে সমাজতত্ত্ব আর রাজনীতির জগতে অনেক মত পোষণ করার প্রবণতা সাধকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কী, তন্ত্র সম্বন্ধে তোমাকে সংক্ষেপে কিছু বলা আমার মতো অর্বাচীনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এর ইতিহাসের বিস্তৃতি বিশাল! সচরাচর গোপন শাস্ত্র হিসেবে ধরা হয় বলে সাধারণ মানুষ আগ্রহী হলেও এ বিষয়ে কৌতূহল নিবারণ করার মতো কোন বিশেষ পান্ডুলিপি বা গ্রন্থ পাওয়া যায় না, কারণ অসংখ্য সাধক ও বিদ্বানের বহুধাবিভক্ত চর্চা ও অভ্যাসের দৌলতে এই তন্ত্রসাধনা নতুন নতুন কলেবরে বিস্তার লাভ করে।”
ধ্রুব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, “দাদু, আমি বাবার মুখে ইষ্টদেবতার ব্যাপারটা শুনেছি, কিন্তু এর মানেটা বুঝতে পারিনি। এই সাধনার ক্ষেত্রেও কী এরকম ইষ্টদেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়?”
ধীরেন্দ্রবাবু ফতুয়ার পকেট থেকে আবার বিড়ির প্যাকেটটা বার করে সেখান থেকে আরেকটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললেন, “হুম! খোকা ঠিক কথাই বলেছে। এই তন্ত্রশাস্ত্রেও বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা আছেন। বিভিন্ন দেবতার যেমন নিজস্ব বিশেষ বীজমন্ত্র আছে, তেমনি বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়ারও বিশেষ বীজ আছে। যতদূর আমার বিদ্যে বলে, উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, যেমন ধর, কালিকার বীজ একাক্ষর, তারার বীজ ত্র্যক্ষর আর উমম্ – হ্যাঁ – বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর। যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতেই দেওয়া রয়েছে। দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা আর বজ্রবৈরেচনী বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী। হিন্দু শাস্ত্রে ‘গ্রহণ’ নিয়ে অনেক বিধি-নিষেধ প্রচলিত থাকলেও তান্ত্রিক মতে কিন্তু এই তন্ত্র সাধনার যাবতীয় সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত সময় চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ। সমস্ত তান্ত্রিক তাঁদের তন্ত্র সাধনা আর গুপ্ত সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য বছরের পর বছর ধরে গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন।”
ধ্রুব ফস্ করে জিজ্ঞেস করে বসে, “কেন? গ্রহণের সময়েই কেন?”
— “তন্ত্র শাস্ত্রে এমন কিছু সাধনার উল্লেখ আছে, যাতে সিদ্ধি লাভ করতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম আর কঠোর সাধনা করতে হয়। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় সেই সাধনায় বসলে খুব সহজে আর অল্প সময়ের মধ্যে সাধনায় ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়। শিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু তাকে বীজমন্ত্র উপদেশ দেন। এই বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা বিশেষে আলাদা আলাদা হয়। এই বীজমন্ত্রগুলো ভীষণ গোপনীয় তাই সাধকেরা তাদের গোপন রাখার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ আর তার নতুন অর্থ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকারী ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন। একে আদিম ক্ল্যাসিফায়েড কোডিং প্রসেসও বলা যায়।”
ধীরেন্দ্রবাবুর কথা শেষ হতেই চমকে উঠল ধ্রুব। হলদে নোটবুকটার শেষ পৃষ্ঠায় এমনই কিছু সাংকেতিক শব্দ আর চিহ্ন ব্যবহার করে কিছু লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। তার মানে কী, সত্যজিৎ বিশ্বাস যে গূঢ় আর গোপন বিষয় নিয়ে চর্চা করছিলেন, সেই বীজমন্ত্র এমন সাংকেতিক ভাষায় নোটবুকে লিখে রেখেছিলেন? কিন্তু কেন? দাদুর কথা অনুযায়ী, গুরুর বারণ ছাড়া এই বীজমন্ত্র বাইরে কোথাও প্রকাশ করার নিয়ম নেই। তাহলে কী ওই অদ্ভুত শব্দগুলো বড়দাদুর জন্য তৈরি করা হয়েছিল? তিনিও কী তবে এই শাস্ত্রের গোপন দিকগুলো জানতেন?”
ধ্রুবর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরেন্দ্রবাবু বললেন, “কী ভাবছ, দাদুভাই?”
ধ্রুব গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলল, “না – ওই সত্যজিৎ বাবুর কথা ভাবছিলাম। আচ্ছা, বড়দাদুও কী এইসব ব্যাপার নিয়ে চর্চা করতেন?”
ধীরেন্দ্রবাবু তুম্বো মুখে বললেন, “না! বাবা কোনদিনও ওইসব ব্যাপারে চর্চা করেন নি, উনি নানারকম ইলেকট্রনিক্স জিনিস বানাতে পারতেন। সেইসময় সরকারের জাঁদরেল উকিল হিসেবেও বাবার বেশ নাম ডাক ছিল। কিন্তু কেন কে জানে, তিনি তাঁর বন্ধুকে সবরকম ভাবে সাহায্য করতেন, উৎসাহ দিতেন… যতক্ষণ না সেটা ক্ষতিকারক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে… যাক সে কথা – চিলেকোঠার ঘরে ওই টিনের বাক্সটার মধ্যে একটা ছোট ট্র্যানজিস্টার আছে দেখতে পাবে, বাবা ওটা নিজে হাতে বানিয়ে সত্যজিৎকে উপহার দিয়েছিলেন। ব্যাটা সেটার মধ্যে দিয়ে নাকি বিভিন্ন মৃত মানুষদের আত্মার সাথে যোগাযোগ করতে পারত। যদিও এর সত্যতা নিয়ে আমার মনে যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। এই জিনিসের চর্চা যে তাঁর গুণমান বন্ধুটিকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছিল, এটা বাবা বুঝতে পেরেছিলেন। ভাব একবার, সেই সময় যখন এত টেকনোলজিক্যাল উন্নতি হয়নি – তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে বাবা ওরকম একটা যন্ত্র বানাতে পেরেছিলেন। দীক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পর সত্যজিৎ ওই জোড়া অশ্বত্থতলায় ঘাঁটি গেঁড়ে বসল। জীবন ইক্যুয়ালসটু নানা ধরণের সমস্যা! তা বলে লাগাতার সমস্যায় ভুগতে কার ভাল লাগে! গ্রামবাসীরা অনেকেই তাই তাদের নানারকমের সমস্যার নানা সমাধান খুঁজতে সত্যজিৎ-এর কাছে পরামর্শ নিতে আসত। আর সত্যজিৎও ওর অনুশীলন করা মন্ত্রগুণে তাদের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করত – মন্ত্রে বিশ্বাস রাখলেই আমাদের ৯০ শতাংশ সমস্যা দূর হয়ে যায় – সেটা মানসিক হোক বা অলৌকিক। এরপর থেকেই সত্যজিৎ চেলিয়ামা গ্রামে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। রাতের পর রাত শ্মশানে বসে শান্ত মনে সে মন্ত্র জপ করত। সঙ্গে থাকত একটা মন্ত্রপূত ত্রিশূল। পরণে থাকত একটা লাল টকটকে আলখাল্লা। পাশেই একটা বড় কুন্ডের মধ্যে ধূপ জ্বলত সারারাত। গ্রামের অনেকেই এরপর সত্যজিৎকে সিদ্ধপুরুষ নামে আখ্যা দিতে শুরু করল।”
ধ্রুব কথার মাঝখানেই বলে উঠল, “আচ্ছা দাদু, এই যে বৈদ্যবাবার কথা বলছ, উনি কী খুব বড় একজন সাধক ছিলেন?”
একটু হেসে ধীরেন্দ্রবাবু বললেন, “বাবা এক-দুবার সত্যজিৎ-এর সঙ্গে ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। উনি নাকি কাউকে একঝলক দেখেই সে কোথায় থাকে, কী করে, তাঁর কাছে কোন সমস্যা নিয়ে এসেছে, কেন এসেছে – সব কথা গড়গড় করে বলে দিতে পারতেন। পরে সত্যজিৎ বাবাকে বলেছিল, এই সাধকবাবা ‘নাথ’ সম্প্রদায়ভুক্ত একজন সন্ন্যাসী। খুব ছোট বেলায় তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন। যখনের কথা বলছি, তখন তাঁর বয়স দাঁড়িয়েছে ছাপান্ন। তিনি নাকি ভারতের অসংখ্য তীর্থস্থান ঘুরে অনেক নামকরা সাধকদের সংস্পর্শে এসে তাঁদের কাছ থেকে তন্ত্রসাধনার নানান গোপন কৌশল শিখেছিলেন, কালক্রমে যা তিনি তাঁর শিষ্য সত্যজিৎকে শিখিয়েছিলেন। চেলিয়ামা গ্রামে উনি বছর তিনেক ছিলেন, তারপর সেখান থেকে তিনি কোথায় যে গেলেন, সে কথা আর কেউ জানে না। বৈদ্যবাবা চলে যাওয়ার পরই তাঁর জায়গা দখল করে বসে সত্যজিৎ বিশ্বাস। মহাকালীতলা শ্মশানে এরপর সে শুরু করল শব সাধনা। এতদিন ধরে যা যা বিদ্যে সে শিখেছিল, সব কিছু একত্র করে স্বাধীনভাবে সে তন্ত্রসাধনায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। ব্যস্ততার জন্য ওই কয়েকটা বছর বাবার সাথে সত্যজিৎ-এর একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, কিন্তু আবার কিছু বছর পর বাবা-ই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ততদিনে সত্যজিৎ পূর্ণমাত্রায় একজন সাধক হয়ে উঠেছে, চোখের তেজ আর শরীরী ভাষাতেও এসেছে বিরাট বদল। বাবা তাঁর বন্ধুর চরিত্রে এমন দৃঢ়তা দেখে যতটা না বেশি খুশি হলেন, তার থেকে ভয় পেলেন বেশি…”
ধ্রুব চোখ উঠিয়ে জানতে চাইল, “কেন? কী এমন ভয়ানক জিনিস নিয়ে চর্চা করছিলেন সত্যজিৎ বিশ্বাস?”
— “দাদুভাই, তন্ত্রশাস্ত্রে যতগুলো বিশিষ্ট দেবদেবীর সাধনার কথা বলা আছে, তাদের মধ্যে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দশ মহাবিদ্যার সাধনার উপরে। এই দশ মহাবিদ্যার কিংবা কোনও উপদেবীর অথবা কোনও যোগিনীর সাধনা করলে আকাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় খুব অল্প সময়ে। শোনা যায়, দেবীকে মাতৃরূপে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করলে তিনি সাধককে সন্তানের মতো রক্ষা করার আর পালন করার সমস্ত দায়িত্ব নেন। দেবীকে একবার বন্ধুর মতো পাশে পেলে সংসারক্ষেত্রের কোন বাধাই আর তার কাছে বাধা বলে মনে হয় না। এই দেবী অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বিষয়ে সাধককে জ্ঞানদান করেন, যদি সাধক সিদ্ধিলাভ করে তাকে পত্নীরূপে সাধনা করেন।
দাদুভাই, এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, এই তন্ত্রসাধনায় জাগতিক সমৃদ্ধিলাভের জন্য অনেক উপদেবতার সাধন প্রণালী বর্ণনা করা আছে। তবে এ সাধনায় আধ্যাত্মিক পরমার্থ লাভ হয় না। এই উপবিদ্যার সাধনা মূল ব্রহ্মবিদ্যালাভের সাধনা থেকে অনেক সহজসাধ্য, বেশ অল্পদিনের মধ্যেই এর মাধ্যমে সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব। সত্যজিৎ ঠিক এই পন্থা গ্রহণ করেছিল। অলৌকিক ক্ষমতালাভের জন্য তন্ত্রে শব সাধনা, পাদুকা সাধনা, কর্ণপিশাচী দেবতার সাধনা ছাড়াও ভূতপ্রেত পিশাচ সাধনার কথাও বলা আছে।”
ধীরেন্দ্রবাবুর কথা শুনে এবার ধ্রুব একটু যেন চমকে উঠল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কর্ণপিশাচী সাধনা – কী?”
ধীরেন্দ্রবাবু বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “কর্ণপিশাচী হল উপদেবতা। ঠিক দেবতার স্তরে নয়, তবে এরা দেবতাদের মতো অনেক শক্তিই ধারণ করে। একটা জিনিস ভাল করে বুঝে নাও দাদুভাই। এরা কিন্তু অপদেবতা নয়। ভূত-প্রেত-পিশাচকে বলা হয় অপদেবতা। যাই হোক, তন্ত্রশাস্ত্রে প্রচলিত আছে, এই দেবীর সাধনায় আপেক্ষিক সর্বজ্ঞতা লাভ হয়। অপর পক্ষের মনে ঠিক কী চিন্তা চলছে কিংবা সে কী জন্য এসেছে – প্রশ্নকারীর প্রশ্নের এইসব উত্তর দেবী অন্যের অগোচরে সাধকের কানে কানে জানিয়ে দেন। যেমন, প্রশ্নকর্তার কী নাম, সে কোথা থেকে আসছে, কী উদ্দেশ্যে, কী প্রশ্ন নিয়ে, কবে কী হবে, কী করলে ভাল হবে এই সব আর কি।”
ধীরেন্দ্রবাবু থামতেই ধ্রুব জ্বলজ্বলে চোখে বলে উঠল, “বুঝেছি! বৈদ্যবাবাও নিশ্চয় এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাই তিনি কাউকে দেখে এমন নিঁখুত ভাবে তার গোপন উদ্দেশ্য বলে দিতে পারতেন। আর কালক্রমে তাহলে তাঁর কাছ থেকেই সত্যজিৎবাবু এই সাধনার সাথে পরিচিত হন, তাই না?”
ধীরেন্দ্রবাবু খুশি হয়ে বললেন, “একদম তাই!”
ধ্রুবর মনে অনেক্ষণ ধরে একটা প্রশ্ন ঘুরছিল। আজ সকালে ওই অদ্ভুত চৌকো যন্ত্রটার ওপাশে যে ভয়ংকর জন্তুটার অস্তিত্ব সে টের পেয়েছে, সেটা মনে পড়লেই ভয়ে ওর সারা গা শিউরে উঠছে। কোনরকমে একটা ঢোঁক গিলে ও প্রশ্ন করল, “আচ্ছা দাদু, এই কর্ণপিশাচী উপদেবতা – কেমন দেখতে তুমি জান?”
খোলা জানলাটা দিয়ে তখন অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। বাইরে আলো নিভে আসবে আর কিছুক্ষণ পরেই। এখানে বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে। খোলা জানলাটা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছে একটা বেশ বড় আকারের বাদুড়। ঝটপট করে ডানা মেলে সেটা ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে উড়ে বেরাচ্ছে। ধীরেন্দ্রবাবু কালো লোমশ জন্তুটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন, “কর্ণপিশাচীর আকার নিয়ে তন্ত্রশাস্ত্রে খুব অদ্ভুত একটা বর্ণনা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেবীর দেহ কৃষ্ণবর্ণ, তিনটে চোখ রক্তাভ, আকার খর্ব্ব, উদর বৃহৎ আর জিহ্বা বন্ধুকপুষ্পের মতো অরুণবর্ণ। দেবীর চারটে হস্ত, এক হস্তে বরমুদ্রা, দ্বিতীয় হস্তে অভয়মুদ্রা আর অপর দুই হস্তে দুটো নরমুন্ড আছে। তাঁর শরীর থেকে ধুম্রবর্ণের জ্যোতি বেরিয়ে আসে। ইনি উর্দ্ধবদনা, জটাভারমন্ডিতা এবং চঞ্চল প্রকৃতির। বলা হয়, এই কর্ণপিশাচী দেবী সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞা ও তিনি শবদেহের হৃদয়ে বসবাস করেন। সত্যজিৎ একটা ব্যাপার বেশ ভাল বুঝতে পেরেছিল, যে এই কর্ণপিশাচী দেবীর সাধনায় সিদ্ধিলাভ হলে সাধক যখন মনে মনে কোনও প্রশ্ন করেন, তৎক্ষণাৎ দেবী সাক্ষাৎ এসে তাঁর প্রশ্নের সঠিক আর যথার্থ উত্তর দিয়ে যান। ক্ষমতার পথে এ জিনিস যেকোন মানুষের কাছেই লোভনীয়। আরো একটা বিষয় কী জান, দেবীসাধনায় সিদ্ধ সাধক তাঁর পিঠে উঠে ভূত, ভবিষ্যৎ এইসব বিষয় দর্শন করতে পারে, এমনকি বর্তমানও। তুমি বেদব্যাসের নাম শুনেছ আশা করি?”
ধ্রুব মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ – মহাভারত লিখেছিলেন উনি।”
— “রাইট! শোনা যায়, এই কর্ণপিশাচী দেবীর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে অল্প সময়েই সর্বজ্ঞতা লাভ করেছিলেন মহাভারতের রচয়িতা মহামতি বেদব্যাস। তারপর থেকেই তন্ত্রসাধনার জগতে এই দেবীর বিপুল পরিমানে সাধনা করার পথ উন্মুক্ত হয়ে যায় সাধকদের কাছে।”
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি। সত্যজিৎ বাবুর এরপর কী হল?”
ধীরেন্দ্রবাবু খানিক্ষণ চুপ করে থেকে গোটা ঘটনাটা যেন মনে মনে সাজিয়ে নিলেন। তারপর বলতে লাগলেন, “দাদুভাই, তোমায় তো আগেই বলেছি যে সত্যজিৎ-এর মাথাটা বেশ পরিষ্কার ছিল। বিয়ে বা সংসারের পথে ওর কোন মোহমায়া ছিল না। পরিবর্তে নতুন নতুন তান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়ে চর্চা করতে বেশি ভালবাসত ও। গুরুর শিখিয়ে দেওয়া পথে শব সাধনার স্তরগুলো কাটিয়ে উঠে এবার ওর মাথায় একটা অন্য ভূত চাপল। এসব সব কথাই বাবার মুখে শোনা। ভদ্রলোকের বয়স যখন সাঁইত্রিশ, তখন সত্যজিৎ-এর একটা নতুন জিনিস পরীক্ষা করার ইচ্ছে জাগে। একদিন স্বপ্নে নাকি কর্ণপিশাচী দেবী ওকে নির্দেশ দেন, যে বারোটা রাশির বারোটা শবদেহ একত্রিত করে তার উপর বসে যদি সে সফলভাবে সাধনা করতে পারে, তাহলে সে এই জগৎ সংসারের সবথেকে শক্তিশালী তান্ত্রিক হয়ে উঠবে। ক্ষমতার লোভ বড় মারাত্মক, বুঝলে দাদুভাই! এই লোভের বশেই শেষপর্যন্ত নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল সত্যজিৎ। আচ্ছা দাদুভাই, আমাদের বাংলায় যে বারোটা রাশি আছে, তাদের মধ্যে সবথেকে শক্তিশালী কোনগুলো তুমি বলতে পারবে?”
ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে না বলে। হালকা উত্তুরে বাতাসে তখন জানলার পাল্লাটা হাওয়ায় অল্প অল্প দোল খাচ্ছিল। ধীরেন্দ্রবাবু সেদিকে চেয়ে ধোঁয়া টেনে বললেন, “আমাদের রাশি চক্রে মোট বারোটা রাশি আছে – মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ আর মীন। এই এক একটা রাশির ক্ষমতা আবার এক এক রকম। এই বারোটা রাশির মধ্যে সব থেকে ক্ষমতাবান হল চারটে রাশি। জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রাকৃতিক উপাদান বলতে সাধারণত জল, বায়ু, অগ্নি আর পৃথিবীকে বোঝায়। এমন যে চারটে রাশি এই চার উপাদানের প্রতীক, জ্যোতিষ শাস্ত্রে তাদেরকেই সবথেকে শক্তিশালী রাশি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই বারোটা রাশির মধ্যে সবথেকে ক্ষমতাশালী চারটে রাশি হল — মেষ, বৃশ্চিক, কুম্ভ আর মকর। সত্যজিৎ ওর পরীক্ষা শুরু করল এই চারটে রাশিযুক্ত চারটে গ্রামের বাচ্চাকে একের পর এক নৃশংস ভাবে খুন করে। মোট বারোটা মৃতদেহ জোগাড় করতে পারলে তবেই ও এই শব সাধনায় সফল হতে পারবে।
এরপর চেলিয়ামা গ্রাম থেকে একের পর এক শিশু নিঁখোজ হতে থাকে। সমস্ত গ্রামে হুলুস্থুল পড়ে যায়। পুলিশ হন্যে হয়ে ছেলেধরার খোঁজ করতে থাকে, কিন্তু তাদেরকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ক্রমাগত অমাবস্যার রাতে এক এক করে গ্রাম থেকে নিরুদ্দেশ হতে থাকে একটা করে শিশু। আশেপাশের সমস্ত গ্রামে এক ভয়ানক ত্রাস জন্ম নেয়। স্থানীয় লোকেরা সন্ধের পর ঘর থেকে বেরনো বন্ধ করে দেয়। গ্রামের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা পরামর্শ দেয়, গ্রামে অপদেবতার কুনজর পড়েছে। অনেকে আবার বলাবলি করতে থাকে প্রতি অমাবস্যার রাতে গ্রামের সীমান্তের ঘন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে এক বিশালদেহী দানব। তার বিরাট বড় শরীর, ভাঁটার আগুনের মতো গনগনে চোখ, হাত আর পায়ে বড় বড় হিংস্র নখ। সে নাকি সবসময় ক্ষুধার্ত থাকে। প্রতি অমাবস্যায় একটা করে নর শিশুর রক্ত না পান করলে সে শান্ত হয় না। অবশেষে এই সংকট মোচন করতে গ্রামের লোকেরা এসে ধরল সত্যজিৎকে। এই বিপদে একমাত্র তিনিই তাঁদের রক্ষা করতে পারেন। সত্যজিৎ মনে মনে হাসছিল। গ্রামের সীমান্তের জোড়া অশ্বত্থতলার বেদীতে বসে থাকা ধ্যানমগ্ন সত্যজিৎ-এর উপর ঘুণাক্ষরেও কেউ সন্দেহ করল না। দিন দিন গ্রামে আতঙ্কের ছায়া যেন আরও তীব্র হয়ে উঠতে লাগল।
এদিকে ঘটল আরেক ঘটনা। আমি তখন সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছি। আগেকার সময়ে ছেলে মেয়েদের অনেক কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রথা ছিল সেটাতো তুমি জান। বাবা তখন কাজের সূত্রে কলকাতায় ছিলেন। সেখানে লাবণ্য প্রভা দেবীর এক মাসতুতো বোনের সাথে বাবার আলাপ হয়। বিনোদিনী। এক স্বদেশী তাঁতকলে তাঁত বোনার কাজ করত। বাবা তার সাথে আমার বিবাহের ঠিক করেন। এরপর স্বভাবতই সত্যজিৎ-এর সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। বাবা কলকাতায় কাজ মিটিয়ে পুরুলিয়া ফিরে আসেন। আন্দোলনের মাঝে তখন অতুলবাবুর মৃত্যু ঘটেছে, তার মৃত্যুর পর লাবণ্যদেবী ‘মুক্তি’ পত্রিকার সম্পাদনা করতে থাকেন ও মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে উৎসর্গ করে দেন। বাবা এখানে ফিরে আসার পর চেলিয়ামা গ্রামের ঘটনা শুনতে পেয়ে তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না, যে এই সমস্ত কিছুর পেছনে আসল মাথাটা কার। এরপর সত্যজিৎ-এর সাথে বাবার বেশ কিছু কথা কাটাকাটি হয়। তন্ত্রসাধনার পরীক্ষার জন্য একটার পর একটা নিরীহ শিশুকে এভাবে নরবলি দেওয়ার ব্যাপারটাকে বাবা কোনমতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু এবারেও সত্যজিৎ-এর হিপনোটিজম্-এর কাছে বাবাকে হার মানতে হল। তাঁর চারিত্রিক গঠনে বন্ধুর প্রতি অপত্য স্নেহের এই দুর্বলতাই আস্তে আস্তে বাবাকে তাঁর কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তের দিকে ঠেলে দিতে থাকে। সব বুঝতে পেরেও শেষমেষ বাবা সত্যজিৎ-কে সমর্থন করতে বাধ্য হন। বন্ধুত্ব বড্ড আজব জিনিস, বুঝলে দাদুভাই। তো যাই হোক, এরপর বাবার প্রশ্রয়ে কিনা জানা নেই, চেলিয়ামার আশেপাশের সব গ্রাম মিলিয়ে নিরুদ্দেশ শিশুর সংখ্যা হয়ে দাঁড়াল আট। একটু জলের বোতলটা দাও তো দাদুভাই।”
ধ্রুব হাঁ করে দাদুর কথাগুলো গিলছিল। চমকে উঠে জলের বোতলটা দাদুর দিয়ে এগিয়ে দিয়ে ছোট্ট করে বলল, “তারপর?”
ধীরেন্দ্রবাবু ঢকঢক করে গলায় জল ঢেলে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর গলার স্বর নামিয়ে আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, “সত্যজিৎ-এর তন্ত্রসাধনায় সাহায্য করার জন্য বাবাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বন্ধুর যাবতীয় কুকীর্তি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইনের চাদরের আড়ালে ধামাচাপা দিতে হয়েছে। সরকারের নামকরা উকিল ছিলেন বলে এই কাজে খুব একটা অসুবিধে বাবার হয়নি। তখন কলকাতায় দাপিয়ে বেরাচ্ছিল এক কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার – কী যেন নাম – হ্যাঁ – বিলাস ভদ্র। সে এগারোটা খুন আর তিনটে ধর্ষণের অভিযোগে যাবজ্জীবন জেল খাটছিল। বন্ধুর কথায় তাকে কায়দা করে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন বাবা। সত্যজিৎ-এর গোপন ডেরার খোঁজ একমাত্র বাবার কাছে ছিল। তিনি বিলাসকে নিয়ে গেলেন বন্ধুর কাছে। বিলাসকে দেখে সত্যজিৎ বেশ খুশি হল। এমন একজন শক্ত মনের মানুষকেই সে এতদিন ধরে খুঁজছিল। বিলাস এরপর সত্যজিৎ-এর কাছেই থাকতে শুরু করে – ওর ফাই ফরমাশ খাটত, ওর হয়ে কাজ করত। বাবা যদিও মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু মনে মনে তিনি যেন সবসময় একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগতেন। এবার শুধু চেলিয়ামা নয়, আশেপাশের বেশ কিছু গ্রাম থেকে যে সব শিশুগুলো গায়েব হতে শুরু করে, তাদের মধ্যে একটা ব্যাপারে মিল ছিল – তাদের প্রত্যেকের বয়স আঠারো বছরের নীচে ছিল আর তাদের প্রত্যেকের রাশি ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এগারো নম্বর শিশুটার বেলায় এবার একটা ছোট্ট ভুল করে বসে সত্যজিৎ। বিলাসকে দিয়েই ও আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে রাশি বিচার করে বেছে বেছে আঠারো বছরের নীচে শিশুদের ধরে আনাত, তারপর তাদের আটকে রাখত একটা গোপন জায়গায়।”
ধ্রুব মনে মনে কিছু ভাবছিল। এবার হঠাৎ বলে উঠল, “সেই গোপন জায়গাটা কোথায়, তুমি জান?”
ধীরেন্দ্রবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “বাবা আর বিলাস ছাড়া সে জায়গার খোঁজ বাইরের কেউ একটা জানত না। তবে আমি পরে জানতে পেরেছিলাম। যাই হোক সেকথায় পরে আসছি। সত্যজিৎ-এর এগারো নম্বর শিকার হয় যে শিশুটি, সে আবার বাবার কোর্টের স্নেহভাজন একজন সহকর্মীর ছেলে ছিল। সত্যজিৎ এটা জানত না। কিন্তু এইবার তার এই অপকর্মের সময় তাকে দেখে ফেলে স্থানীয় কিছু লোকেরা। লোক্যাল থানায় সত্যজিৎ-এর বিরুদ্ধে তন্ত্রসাধনা করতে গিয়ে একটি ১৪ বছরের নাবালককে চুরি করে তাকে খুন করার অভিযোগ জানায় তারা। এই ঘটনার পরে সেখানে পুলিশ আসলে তারা গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে। পুলিশের সামনেই ওই জোড়া অশ্বত্থতলার বেদীর সামনে আর সত্যজিৎ-এর চেলিয়ামা গ্রামের বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা। সত্যজিৎ বিলাসকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে দূরে কোথাও গা ঢাকা দিল। স্থানীয় সূত্রে খবর, বেশ কয়েকদিন ধরেই অভিযুক্ত সত্যজিৎ আর বিলাস নাকি তাদের গ্রামে ঘাঁটি গেঁড়ে তান্ত্রিক সেজে নানা ধরনের কেরামতি দেখাত। কখনও কালী, কখনও শীতলা, কখনও মনসার মতো দেবদেবী নাকি তার উপর ভর করত। ভর হলে সত্যজিৎ নাকি নানান ভবিষ্যদ্বাণী করত। অনেকের নাকি সে সব সমাধান মিলেও যাচ্ছিল। তো যাই হোক, ধীরে ধীরে নানারকমের সমস্যা নিয়ে তার কাছে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে, যেমনটা চেলিয়ামা গ্রামেও হয়েছিল। বাচ্চাটার বাবা মানে আমার বাবার সহকর্মী বাসুদেব হালদার থানায় অভিযোগ করেন, তন্ত্রসাধনায় এমনই কিছু কেরামতি দেখাতে গিয়ে সত্যজিৎ তাঁর ১৪ বছরের শিশুটিকে চুরি করে নিয়ে খুন করেছে। কেউ কেউ আবার বলছিল, বাচ্চাটাকে প্রসাদ দেওয়ার নাম করে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ডেকে নিয়ে এসে ভারী কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করে মেরে তাকে অজ্ঞান করে নরবলি দিতে চেয়েছিল সত্য তান্ত্রিক। আবার কেউ কেউ বলেছে, শিশুটিকে মেরে আবার তাকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করার জন্য নানান যাগযজ্ঞের আয়োজন করেছিল ওরা।
এই ঘটনা শুনেই ছুটে আসেন বাবা। সহকর্মীর ছেলের এ হেন বিপদ দেখে বাবা বুঝতে পারলেন, যে বন্ধুকে সমর্থন করতে গিয়ে কী বিরাট ভুল করে বসেছেন তিনি। নিজের কাছের মানুষের উপর যখন নির্মম আঘাত নেমে আসে, মানুষ তখন তার ক্ষতিটা অনুভব করতে পারে। বাবা জানতেন সত্যজিৎ সেই ছোট ছোট ছেলেগুলোর মৃতদেহ নিয়ে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। তিনি এবার নিরুপায় হয়ে লাবণ্য প্রভা দেবীর শরণাপন্ন হন। এমনিতেই সত্যজিৎ-এর প্রতি লাবণ্যদেবী কোনদিনই সেরকম সহায় ছিলেন না, আর এই ঘটনার পর সমস্ত পুরুলিয়ার রাজনৈতিক জগৎ উত্তাল হয়ে ওঠে। বাবা অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে নিজের মনকে শক্ত করেন। এই সুযোগে যদি এখনই সত্যজিৎ-কে আটকান না যায়, তবে পরবর্তীকালে এই তন্ত্রসাধনার জন্য আরও কত যে প্রাণ যাবে, একথা ভেবেই শিউরে উঠলেন বাবা। অবশেষে লাবণ্যদেবীর নির্দেশে পুলিশের কাছে নোটিশ যায়, সত্যজিৎ-এর নামে শ্যুট অ্যাট সাইটের অর্ডার দেওয়া হয়।”
ধীরেন্দ্রবাবু থামলেন। বাইরে তখন আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসছে। ধ্রুবর ততক্ষণে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। কিছু কিছু ঘটনা এখন ওর কাছে যেন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে আসছে। একটা ঢোঁক গিলে ধ্রুব প্রশ্ন করল, “তারপর কী হল?”
— “সত্যজিৎ যে পরীক্ষাটা করতে চাইছিল, তার জন্য মোট বারোটা রাশির বারোটা শিশুর মৃতদেহের প্রয়োজন ছিল। তবেই সে অমাবস্যার রাতে তাদের উপর বসে শবসাধনা করতে পারবে। বাবাকে একবার কথায় কথায় সে বলেছিল, সে নাকি মৃত মানুষদের বাঁচিয়ে তোলার জন্য মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্রের অধ্যয়ন করছিল। কিন্তু চারিদিকে পুলিশের কড়া নজর বাড়িয়ে দেওয়ার পর শেষের শিকারটা করতে সত্যজিৎ-কে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তাছাড়া বিলাসকে নিয়েও বোধহয় ইদানিং কোন একটা মানসিক টানাপোড়েনে ভুগছিল সত্যজিৎ। বিলাসের গলা কাটা দেহটা আবিষ্কারের পর বাবা বুঝতে পারেন যে উপায় না পেয়ে অবশেষে বিলাসকে খুন করে তাকে যোগ করে মোট বারোটা শবদেহের উপর বসে শব সাধনা করছিল সত্যজিৎ। বিলাসের বয়স বা রাশি কোনটাই সাধনার প্রক্রিয়ার সাথে মিলছিল না, কাজেই এখানেই পরীক্ষায় সে একটা ছোট্ট ভুল করে বসে। আর এইসব ক্ষেত্রে একবার ভুলচুক হওয়া মানেই সাক্ষাৎ মৃত্যু। বাবা গোপনে অনেক চেষ্টা করার পর সত্যজিৎ-এর সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি তাকে কথা দেন, সেদিন সন্ধেবেলায় পুলিশের চোখের আড়ালে তাকে গোপন জায়গা থেকে বার করে বৈদ্যবাবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন ; একমাত্র ওখানেই সে সুরক্ষিত থাকবে। সত্যজিৎ বাবাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বাবা গোটা একটা পুলিশবাহিনী নিয়ে সেখানে পৌঁছবার অনেক আগেই সত্যজিৎ-এর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেছে! অযোগ্য পাহাড়ের থেকে কিছু দূরে জঙ্গলের সীমান্তে একটা প্রাচীন আর ভগ্নপ্রায় গুমঘর ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, একসময় এই গুমঘর রাজাদের শস্যভাণ্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হত। কিছু জলের পাইপের টুকরো পাওয়া গিয়েছিল আশেপাশে। আবার স্থানীয় মানুষেরা মনে করে, এটা আদতে একটা গুমঘরই ছিল। এখানে কয়েদিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। একসাথে অনেকগুলো বর্শা পুঁতে রাখা হত গুমঘরের মেঝেতে। পাঁচিলের বাইরে দিয়ে গুমঘরের ভিতরে নিক্ষেপ করা হত হতভাগ্য কয়েদিদের। মেঝেতে পুঁতে রাখা খাড়া বল্লমে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হত তাদের। একটা সময় পর সেটা পরিত্যক্ত স্থানে পরিণত হয়েছিল। সত্যজিৎ ওর লুকিয়ে থাকার জায়গা হিসেবে এই গুমঘরটাকেই বেছে নেয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বিশাল লোহার দরজাটা যেন কোন শক্তিশালী প্রাণী আঘাত করে করে ভেঙ্গে ফেলেছে। পুলিশেরা চারিদিক সার্চ করে ঘরের মেঝে থেকে বেশ কিছু ছোট ছোট বাচ্চার খুলি, হাড়গোড় আর সত্যজিৎ-এর মাঝখান থেকে আড়াআড়ি ভাবে চিরে আলাদা করে দেওয়া মৃতদেহটা আবিষ্কার করে। সমস্ত জায়গাটা চাপ চাপ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। দেখে মনে হয়, যেন বিশালদেহী কোন হিংস্র দানব তার তীক্ষ্ণ জান্তব নখে বিঁধিয়ে সত্যজিৎ-কে ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিয়েছে। শেষে বন্য প্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে বলে সত্যজিৎ-এর কেসের ফাইলটা ক্লোজ করে দেওয়া হয়।”
ধীরেন্দ্রবাবু থামতেই জানলার বাইরে থেকে ক্যাঁ-ক্যাঁ করে বিশ্রী শব্দে একটা পাখি ডেকে উঠতেই চমকে সেদিকে ঘাড় ঘোরাল ধ্রুব। ধীরেন্দ্রবাবু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ওর মুখের দিকে, কিন্তু তাঁর চোখের দৃষ্টি যেন আটকে আছে অনেক দূরে, অনেক গভীর কোন ষড়যন্ত্রের অন্ধকারে। মোহাচ্ছন্নের মতো ফিসফিস করে তিনি বলে চললেন, “বৈদ্যবাবা চেলিয়ামা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে তাঁর প্রিয় শিষ্য সত্যজিৎ-কে একটা আড়বাঁশি আর একটা গোলাপি পাথরের আংটি দিয়ে গিয়েছিলেন। বাবার কাছে শোনা, এই আংটির পাথরটা মন্ত্রপুত ছিল, তিনি সেটা নীলাচল পাহাড়ে সাধনায় নিবিষ্ট এক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। রাত বারোটার পর সেই আংটি ডান হাতের মধ্যমায় পরিধান করে সেই মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র আউরালে নাকি মৃত মানুষের আত্মা নব কলেবরে আবার নতুন করে বেঁচে ওঠে। যদিও এসব শোনা কথা। সেই গুমঘর থেকে সত্যজিৎ-এর মৃতদেহের সাথে সাথে বাবার দেওয়া সেই ট্র্যানজিস্টার, মন্ত্রপুত আড়বাঁশি আর এই হলদে পুরনো নোটবুকটা খুঁজে পেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু আংটিটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাবা তখন বন্ধুর এরূপ নৃশংস হত্যাকান্ডে শোকে পাথর হয়ে গেছেন। সত্যজিৎ-কে প্রাণে না মেরে তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আইনের হাতে সারেন্ডার করাতে চেয়েছিলেন বাবা। কিন্তু তার আগেই কী থেকে কী হয়ে গেল! বাবা বন্ধুর স্মৃতি রক্ষার্থে ওই জিনিসগুলো এনে আমাদের উপরের ওই চিলেকোঠার ঘরটায় যত্ন করে রেখে দিলেন। ব্যস্, তারপর থেকেই বাড়িতে শুরু হয়ে যায় নানান ভৌতিক উপদ্রব। জায়গার জিনিস জায়গায় পাওয়া যেত না, পাওয়া যেত অন্য জায়গায়। রাত বিরেতে যখন তখন আলো নিভে যেত। চিলেকোঠার ঘর থেকে নানান ভুতুড়ে শব্দ আসত। বাবা রাতে মাঝে মাঝেই এরপর ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। বন্ধুর এই পরিণতি তিনি যেন আর মেনে নিতে পারছিলেন না। দিনরাত সত্যজিৎ-এর কথা ভাবতেন। বাবা ধীরে ধীরে কাজে যাওয়া বন্ধ করে নিজেকে গৃহবন্দী করে নেন, আস্তে আস্তে অবসাদ গ্রস্থ হয়ে পড়েন। আমি তখন সদ্য তোমার ঠাকুমাকে বিয়ে করে কাজের সন্ধান করছি। একদিন সকালে বাবার ঘরের দরজা ভেঙ্গে সিলিং থেকে ওনার ঝুলন্ত ডেডবডিটা আবিষ্কার করলাম। বাবার এ হেন অপঘাত মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেন না আমার মা। রাতারাতি স্ট্রোক হয়, মাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই সব শেষ। একটা গোটা রাতের মধ্যে আমি অনাথ হয়ে গেলাম। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়ির সেই ভুতুড়ে জিনিসপত্র সাময়িক কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। একটার পর একটা দিন কাটতে থাকে। তোমার পিসি রুক্মিণীকে বিয়ে দিই কলকাতার এক নামী ব্যবসায়ী দীনেশ বসুর সাথে। যদিও অনেক ছোটবেলায় দেখেছ, কিন্তু তোমার পিসেমশাই যে কতটা ভালমানুষ ছিলেন সেটা তোমরা দু-ভাই বোনই খুব ভালভাবে জান। তোমাদের ঠাকুমা মারা যাওয়ার কিছু বছর আগে বেশ কিছুদিনের জন্য আমার এখানে বেড়াতে এসেছিল রুক্মিণী আর দীনেশ। এবার ঘটল আরেক বিপদ। আবার সেই পুরনো ভৌতিক জিনিসপত্র ঘটতে শুরু করল। খেতে বসলেই কে যেন খাবারের থালায় চাপ চাপ রক্ত মাখিয়ে দিয়ে যায়, ধুলোবালি- কাঁকড় ছুঁড়ে মারে, ঘরের চারিদিকে পড়ে থাকে মাংসের হাড় কিংবা মাছের কাঁটা। একদিন সকালে ছাদে পায়চারি করার সময় পায়ে একটা মাছের কাঁটা বেঁধে দীনেশের। প্রথমে আমল না দিলেও সেইদিন রাতে ধূমজ্বর আসে ওর। ডাক্তার ডাকা হয়। কিন্তু কোন লাভ হল না। রাতারাতি ধনুষ্টঙ্কারে জলজ্যান্ত প্রাণটা আমাদের সকলের চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল।
এরপর তোমার ঠাকুমার কথায় আমি একজন বড় ওঝাকে ডেকে আনি। তিনি সব ঘটনা শুনে বেশ বড়সড় একটা যজ্ঞের আয়োজন করেন। তারপর মৃত সত্যজিৎ-এর ওই জিনিসগুলো মন্ত্র দিয়ে বন্দী করে একটা টিনের বাক্সে তালা বন্ধ করে চিলেকোঠার ঘরে আটকে রাখা হয়। তাই ওই ঘরে ঢোকা বা ওই বাক্স খোলা আমাদের পরিবারের বারণ আছে। রুক্মিণী মাঝে মাঝে ঘর পরিষ্কার করার জন্য দরজা খোলে আবার আটকে দেয়। গতকালও ঘরটা পরিষ্কার করার জন্যই খোলা হয়েছিল, তারপর হয়তো আর সেটা আটকাতে ভুলে গেছে। দাদুভাই, এই নোটবুকটা আমাকে দিয়ে দাও, আমি ওই সব কিছু কাল সকাল সকাল গিয়ে কংসাবতীর জনে বিসর্জন দিয়ে আসব। নেহাত বাবার বারণ আছে তাই, নয়তো এইসব অভিশপ্ত জিনিস বাড়িতে রাখতে আমি একদমই সায় দিইনি। কিন্তু আর না। কাল সকাল সকাল গিয়ে ওগুলো বাড়ি থেকে দূর করে দিয়ে আসব আমি।”
ধীরেন্দ্রবাবু থামলেন। তাঁর চোখের কোণায় যেন একটু জল চিকচিক করছিল। ধ্রুব এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবার মাথা নামিয়ে কিছু চিন্তা করে নিয়ে বলল, “আচ্ছা দাদু, যে মহা সঞ্জীবনী মন্ত্রের কথা তুমি বললে, সেটা দিয়ে কী সত্যিই মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা যায়?”
ধীরেন্দ্রবাবু একটু অদ্ভুত চোখে তাঁর নাতির দিকে তাকালেন। তারপর খাড়া নাকটা দুবার টেনে চোখের মোটা চশমাটা নাকের উপর গুঁজে বাঁকা শরীরটা তিরের মতো সোজা করে বসে পকেট থেকে আরেকটা বিড়ি বার করে সেটা ধরিয়ে অল্প হেসে বললেন, “দাদুভাই, তোমরা ছোটবেলায় আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের গল্প পড়েছিলে, মনে পড়ে? একটা গুহার মধ্যে ধনরত্ন গচ্ছিত রেখেছিল ডাকাতের দল। একটা পাথরের দরজা দিয়ে সেসব লুকোন ছিল, যা সাধারণের মানুষের দ্বারা খোলা সম্ভব ছিল না। তো এই দরজা খোলার একটা মন্ত্র ছিল, কী বলতো?”
— “এটা তো সবাই জানে। চিচিং ফাঁক!”
— “রাইট! এই মন্ত্র উচ্চারণ করলেই সেই মনি-রত্ন ভান্ডারের দরজা খুলে যেত। তো আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের জন্যও এরকম একটা দরজা আছে। সেই দরজা খোলার জন্য শারীরিক শক্তি কোন কাজ করতে পারে না। কিন্তু শব্দশক্তি বা মন্ত্রশক্তি মননশক্তির একাগ্রতার সাহায্যে এই অসাধ্য সাধন করতে পারে। এইরকম দুটো মন্ত্র আমাদের কাছে খুব পরিচিত। একটা হচ্ছে ‘গায়ত্রী মন্ত্র’, আর অন্যটা হল ‘মহামৃত্যুঞ্জয় বা মহাসঞ্জীবনী মন্ত্র’। আধ্যাত্মিক জগতের প্রবেশদ্বার উন্মোচনের জন্য এই মন্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয়।
যে মন্ত্রের ক্ষমতা নিয়ে সত্যজিৎ নতুনভাবে পরীক্ষা করতে চেয়েছিল, সেই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রটি ‘মহামুনি মার্কন্ডেয় উদ্গীত’ নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, চন্দ্রদেব একবার প্রজাপতি দক্ষের অভিশাপের কবলে পড়েছিলেন। তখন ঋষি মার্কেন্ডেয় প্রজাপতি দক্ষের কন্যা সতীকে এই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র দান করেন। আবার অনেকের মতে এটি একটি বীজ মন্ত্র। এই মন্ত্রের দ্রষ্টা হচ্ছেন ঋষি কহোল। ঋষি কহোল শিব সাধনায় এই মন্ত্র পেয়েছিলেন। কেউ কেউ আবার মনে করেন, এই মন্ত্র স্বয়ং মহাদেব ঋষি শুক্রাচার্য্যকে গোপনে জানিয়েছিলেন। শুক্রাচার্য্য আবার ঋষি দধিচীকে এই মন্ত্র দিয়েছিলেন।
বুঝলে দাদুভাই, এই মন্ত্র মহাশক্তিশালী, তাই একে সবসময় গোপন রাখা হত। আজ আর অবশ্য এই গোপনীয়তা নেই। এখন ঘরে ঘরে এই মন্ত্র সিডি ক্যাসেটের দৌলতে গান হয়ে ঘুরছে। যদিও আমার মনে হয়, এতে সবার মঙ্গলই হচ্ছে। এই মন্ত্রকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। কেউ একে বলে ‘রুদ্র মন্ত্র’ আবার কেউ বলে ‘ত্র্যম্বকম মন্ত্র’, কেউ কেউ আবার এটাকে ‘মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র’ বলে ধারণা করেন, আবার বাকিরা একে ‘মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র’ বা ‘মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র’ বলে চেনে। বেদে দুই-তিন জায়গায় এই মন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। “হাতের উপর বসে থাকা একটা মশাকে চটাস শব্দে মেরে জায়গাটা চুলকোতে চুলকোতে ধীরেন্দ্রবাবু একটু ব্যাঙ্গের সুরে বললেন, “দাদুভাই, একটা মজার ঘটনা বলি। কিছুদিন আগে একটা বাংলা খবরের কাগজে পড়ছিলাম, দিল্লির একটা বিখ্যাত সরকারি মেডিকেল কলেজে এই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র নিয়ে নাকি গবেষণা করা হচ্ছে। সেখানে মুমূর্ষু রোগীকে এই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠ করে শোনান হচ্ছে। এর ফলে নাকি মৃত্যুপথযাত্রী রোগী আবার জীবনপথে ফিরে আসবে। হুঁ! এইসব মহাপন্ডিতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, এঁরা মন্ত্রের যথাযথ উদ্দেশ্য আর শক্তি সম্পর্কে একদমই সচেতন নন। এতে করে মন্ত্রের প্রতি আমাদের বিশ্বাস হারাচ্ছে। দাদুভাই, একটা কথা আছে বুঝলে, যে ভূতে বিশ্বাস করে, তাকেই কিন্তু ভূতে ধরে। তোমার যদি মন্ত্রে বিশ্বাস থাকে তবেই তোমার এই মন্ত্রে কাজ হতে পারে, নতুবা নয়। আমরা অনেকেই লক্ষ করেছি, মৃতব্যক্তির বুকের উপরে একটা গীতা রেখে দেওয়া হয় আর তার সাথে মৃত্যুপথযাত্রীর কানে হরে-কৃষ্ণ মন্ত্র শোনান হয়। এতে নাকি তাদের বিষ্ণুলোক প্রাপ্তি হবে। সব বুজরুকি! এদের উচিত গীতার বাক্যকে বেঁচে থাকাকালীন উপলব্ধি করা আর নিজের জীবনে গীতার বাণী মেনে চলা। “বলে দাদু দু’হাত জড়ো করে কপালে ঠেকালেন।
ধ্রুব বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল, “তার মানে মন্ত্রে বিশ্বাস থাকলে তাহলে সেই মন্ত্র দিয়ে আধ্যাত্মিক জগতের দ্বার উন্মোচন করা যেতে পারে, তাই তো?”
— “অবশ্যই পারে! বলা হয়, এই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র যথার্থ উপায়ে জপ করতে পারলে তা আমাদের মানসিক আবেগ আর শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খুবই উপকারী। এমনকি দীর্ঘ-জীবন, অমরত্ত্ব, মোক্ষ লাভ এসবও ঘটে যেতে পারে। পুরাণ মতে, এই মন্ত্র মুনি-ঋষিরা ব্যবহার করতেন। দক্ষরাজ কন্যা সতী প্রজাপতি দক্ষের অভিশাপে যখন চন্দ্রদেব অর্থাৎ তার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়েন, তখন এই মন্ত্র জপ করায় চন্দ্রদেব শিবের মস্তকে স্থান পেয়েছিলেন। অকাল-মৃত্যুর হাত থেকে এই মন্ত্র গোটা জীবজগৎকে রক্ষা করতে পারে। আবার উল্টোদিকে, এই মন্ত্র যদি ভুলভাবে উচ্চারণ করা হয়, তবে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। এই মন্ত্র জপের সময় বিভিন্ন বিভূতি আমাদের শরীরের উপরে ভর করে, যা যজ্ঞ করার ফলে তৈরি হয়। এই মন্ত্র আমাদের চেতনা শক্তির সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে দেয়। প্রকৃতির নানান ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শরীরকে রক্ষা করে। বার বার এই মন্ত্র জপ করলে আমাদের একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়, ফলে যেকোন বিষয়ে সহজেই জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয়। এছাড়াও আরোগ্য লাভ, জীবনীশক্তি পুনরুদ্ধারে ধাত্রী-মায়ের মতো কাজ করে এই মন্ত্র। তবে তুমি যেটা জানতে চাইছিলে, এই মন্ত্র জপ করে মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে যাবে কিনা, আদতে এমন ভাবার কোন মানে নেই। এই মন্ত্র জপ করে কিন্তু চন্দ্রদেব মহাদেবের মস্তকে স্থান পেয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি শিব লোক প্রাপ্ত হয়েছেন। আমরা যা কিছু ভাবনা চিন্তা করি, সেটাই আমাদের মানসিক শরীর গঠনের উপাদান। অর্থাৎ আমরা যদি ত্র্যম্বকের বা ত্রিকালেশ্বরের অর্থাৎ মঙ্গলময়ের চিন্তা করি, আর পৃথিবীর বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য প্রার্থনা করি, অমৃতের পথে যাবার জন্য লোভগ্রস্থ হয়ে পড়ি, তবে আমরা সেসব লাভ করতে সক্ষম হব। দাদুভাই, একটা কথা তোমায় বলে রাখি যেটার অর্থ আরো বড় হলে জীবন তোমায় শিখিয়ে দেবে। স্থূল শরীর ত্যাগের পরে আমরা সবাই মানস শরীরে অবস্থান করি। মানস শরীর ত্যাগের পরে আমরা বিজ্ঞানময় শরীরে অবস্থান করি, অর্থাৎ আমরা স্থূল শরীরে থেকে যে চিন্তা করেছিলাম, সেই মতো আমরা মানস শরীর প্রাপ্ত হব। আবার যে জ্ঞান সংগ্রহ করেছিলাম, সেইমতো আমরা বিজ্ঞানময় শরীর প্রাপ্ত হব। এই মন্ত্রের সঠিক অর্থ জানা যতটাই সহজ ঠিক ততটাই কঠিন একে অনুশীলন করা। এই মন্ত্রের উদ্দেশ্য যদি আমরা সঠিক ভাবে বুঝতে পারি আর আত্মস্থ করতে পারি, তবে আমরা অবশ্যই অমরত্ত্ব লাভ করতে পারব বলেই আমার ধারণা। মন্ত্র কোন ভেলকি নয়। মন্ত্র মনকে ত্রাণ করে। যাঁরা জগৎ সংসারে এই মন্ত্রের মধ্যে সঠিক ভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরেছেন, তারা অবশ্যই এই মন্ত্রের মাহাত্ম্য উপলব্ধি পেয়ে করতে পেরেছেন। যাই হোক, আজ তোমার এই পর্যন্ত জানলেই হবে। এর থেকে বেশি জানার দরকার নেই।”
ধ্রুব দাদুর দিকে তাকিয়ে একবার মাথা দোলাল। কথার মাঝেই পিসিমা এসে দাদুকে এককাপ ধোঁয়া ওঠা গরমগরম চা দিয়ে গেল। লাবণ্য এখনো ঘুমোচ্ছে দেখে পিসি আর ওকে ডাকেনি। আলোচনায় বাধা পড়ায় ধীরেন্দ্রবাবু কিছুক্ষণের জন্য কথার খেই হারিয়ে মনে মনে চুপ করে কিছু ভাবছিলেন। ধ্রুব হাতের হলদে নোটবুকটা একবার ভাল করে দেখে নিয়ে সেটা দাদুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা দাদু, একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না। নোটবুকটার শেষ পৃষ্ঠায় যে আমার নামটা লেখা রয়েছে, সেটা তবে…”
চায়ে চুমুক দিয়ে মুখে একটা স্বস্তির শব্দ করে ধীরেন্দ্রবাবু বললেন, “ও কিছু নয় – ওসব সত্যজিৎ-এর হাবিজাবি সব লেখা। হয়তো তোমার নামটা ও লেখেনি, হয়তো অন্য কারুর কথা লিখেছিল, বরং বলা ভাল, ওই নামটা দেখেই তোমার জন্মের সময় আমি নাম রেখেছিলাম ‘ধ্রুব সেন। ‘এটা নিছক একটা কাকতালীয় ব্যাপার। তুমি বা দিদিভাই আর এটা নিয়ে বেশি ভেবনা। দিদিভাইয়ের জ্বরটা তাড়াতাড়ি সেরে গেলেই মঙ্গল, পুজোর সময় – বাচ্ছা মেয়ে। আর হ্যাঁ, ওকে কিন্তু এসব কিছু বোলো না, কেমন? আর তোমাদের ওই চিলেকোঠার ঘরটায় যাওয়ার আর প্রয়োজন নেই। আজকের রাতটা কাটলেই কাল জিনিসগুলোর সদগতি করে দিয়ে আসব।” বলে নোটবুকটা ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন ধীরেন্দ্রনাথ সেন।
ধ্রুব মুখে কিছু বলল না। দাদুর শেষের কথার যুক্তিটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কীকরে পারবে? আজ সকালে চিলেকোঠার ঘরে ও আর লাবণ্য যে ভয়ানক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল, সেটার ব্যাখা যে ওর দাদুর কাছেও নেই, এটা বুঝতে পেরেই চুপ করে বসে থাকল ধ্রুব। জানলার বাইরে থেকে তখন দলে দলে পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে তাদের বাসার দিকে উড়ে চলেছে।
নিজের ঘরে খাটের উপর চোখ চাপা দিয়ে শুয়েছিল ধ্রুব। পাশেই ওর বোন লাবণ্য অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সন্ধের পর ওকে আরো একটা জ্বরের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। রাতে একবার মা ফোন করে ওদের খবর নিয়েছেন। সকালের কথা বা বোনের শরীর খারাপের কথা বলে আর মাকে বিব্রত করতে চায়নি ধ্রুব। রাত এখন কত কে জানে। আজ সকাল থেকে পরপর যা ঘটে চলেছে মাথার মধ্যে সবটা সাজানোর চেষ্টা করছিল ও। সত্যজিৎবাবুর কথা, তার সাধনার কথা, দাদুর বলা তন্ত্রসাধনার কথা সবকিছু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল ওর। এইসব ভাবতে ভাবতেই বোধহয় হালকা একটু তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল, হঠাৎ ডাইনিং হলের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ঢং ঢং করে বেজে উঠতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল ধ্রুবর। বারোটা বাজল। কানটা একটু খাড়া করতেই এবার হালকা মিষ্টি শব্দটা ধ্রুবর কানে ধাক্কা দিল।
একটা মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ সুরে খেয়াল বাঁশি বেজে চলেছে কোথাও। ধ্রুব ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসতেই টের পেল, বাঁশির শব্দটা আসছে উপরের চিলেকোঠার ঘরটা থেকে। আশ্চর্য! এত রাতে ওই ঘরে কে এমন মিষ্টি সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে? ধ্রুব একবার বোনের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাল। না, কোন বিকার নেই সেখানে। ধ্রুব এদিক ওদিক দেখে পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নামল। দাদু আর পিসিমণির ঘর থেকে এখন আর আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে না, চারিদিক ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। সমস্ত বাড়িটা যেন নিশ্ছিদ্র কালো আলকাতরার মতো অন্ধকারের সাম্রাজ্যে ডুবে রয়েছে। ধ্রুব খুব সন্তর্পণে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোতে লাগল। দাদুর ঘর থেকে নাক ডাকার শব্দটা এখন বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। বাইরে কোথাও একটানা ঝিঁ-ঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। চারিদিকে আর কোন শব্দ নেই। বাড়ির সমস্ত আবহাওয়া যেন গুমোট মুখে থম মেরে রয়েছে। শুধু চিলেকোঠার ঘর থেকে সেই মিষ্টি বাঁশির শব্দটা আরো স্পষ্টভাবে ধ্রুবর কানে ভেসে আসতে লাগল। সুরটার মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত আকর্ষণ রয়েছে, সেটা যেন ধ্রুবর কানের কাছে ফিসফিস করে ওকে উপরের দিকে উঠে আসতে বলছে। ধ্রুব মন্ত্রমুগ্ধের মতো সিঁড়ির দিকটায় এগিয়ে যেতে লাগল। চিলেকোঠার ঘরটা থেকে এখন একটা ক্ষীণ হলুদ আলোর রেখা বেরিয়ে এসে সিঁড়ির উপর পড়েছে, যেন ধ্রুবকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই সেটা এই অতল অন্ধকার ফুঁড়ে ধ্রুবর সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। সেই অমোঘ আর অপার্থিব বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে মোহাচ্ছন্নের মতো এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল ধ্রুব। ওইতো চিলেকোঠার ঘরটা দেখা যাচ্ছে। ভেজান দরজার ফাঁক দিয়ে একটুকরো হলদে আলোর রেখা ধ্রুবকে সেইদিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।
দরজাটা অল্প ঠেলা দিতেই ক্যাঁচ করে পুরনো কাঠের দরজাটা খুলে গেল। একটা মাংসপচা ভ্যাপসা গন্ধ ধ্রুবর নাকে এসে লাগল। সমস্ত ঘরটা যেন ধোঁয়ায় ভরে আছে, ঘরের হলুদ বাল্বটা টিমটিম করে জ্বলছে। পা টিপে টিপে ঘরের ভেতরটায় ঢুকে এল ধ্রুব, আর তারপর সামনের দিকে তাকাতেই ওর হৃদপিন্ডটা একলাফে গলার কাছে এসে দুমদুম করে আলজিভে ধাক্কা মারতে লাগল। ওখানে ওটা কে? টিনের বাক্সটার খোলা ডালার সামনে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে একটা উলঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ নারীমূর্তি। আকারে খর্ব্ব, একমাথা বড় বড় চুলের গোছা ঘাড় ছাপিয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। সামনের দুটো কালো কালো হাতে আড়বাঁশিটা ধরে একমনে সে সেটা বাজিয়ে চলেছে। কী তীক্ষ্ণ অথচ কী সুরেলা সেই বাঁশির আওয়াজ, শুনলেই যেন মাথার মধ্যে চলতে থাকা সমস্ত চিন্তা নিমেষে থিতিয়ে গিয়ে মন শান্ত করে দেয়। ঢুলু ঢুলু চোখে ধ্রুব অবাক হয়ে দেখল, নারীমূর্তিটার কোমরের কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছে আরো দুটো হাত। সেটা দেখেই শব্দ করে আঁতকে উঠল ও। মুহূর্তে সেই আওয়াজ শুনে ছায়াশরীরটার বাঁশি বাজান বন্ধ হয়ে গেল; আর তারপরেই নিমেষে ঘাড় ঘুরিয়ে সেটা ধ্রুবর দিকে তাকাল। এমন ভয়ংকর হিংস্র মুখ ধ্রুব এর আগে জীবনে কোনদিন দেখেনি। সে মুখের ভাষা বর্ণনা করার সাধ্য শব্দে কুলোবে না। শরীরটার মুখে তিনটে বড় বড় চোখ, সে তিনটে জবাফুলের মতো টকটকে লাল। যেন এক তীব্র হিংস্রতা সেই চোখের কোটর থেকে ফুটন্ত লাভার মতো গলগল করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হাঁ করা মুখের থেকে বেরিয়ে আছে তিনহাত লম্বা একটা বিশাল বড় জিভ, চোয়ালের দাঁত বসে সেই রক্তাভ জিভ কেটে সেখান থেকে টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত মেঝেতে ঝরে পড়ছে। কোমরের কাছ থেকে বেরনো হাতদুটোর মধ্যে একটায় ধরা রয়েছে একটা ছোট নরমুন্ডুর করোটি, দেখে মনে হয় সেটা চোদ্দ-পনের বছরের কোন বাচ্চার। আর তার ডান হাতের বড় বড় নখের আঙ্গুলের ফাঁকে ঘরের টিমটিমে হলুদ আলোয় জ্বলজ্বল করছে একটা গোলাপি পাথরের গোল আংটি। সমস্ত গা থেকে একটা উজ্জ্বল জ্যোতি বেরচ্ছে তার। ধ্রুবকে দেখে নারীমূর্তিটা হঠাৎ তীব্র খ্যানখেনে শব্দে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। সে হাসির শব্দ শুনে নিমেষে ধ্রুবর গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল, ওর সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। নারীমূর্তিটা তখন দুলতে দুলতে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে আসছে। পাশেই ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় মাটিতে পড়ে রয়েছে সকালের দেখা সেই অদ্ভুতুড়ে চৌকো ট্র্যানজিস্টারের মতো দেখতে প্রাচীন যন্ত্রটা। সেটা ভাঙ্গা অথচ সেটার ডিসপ্লে জুড়ে এবার কালো কালো করোটিদের দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হল। গমগম করে এবার সেটার পেট থেকে সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে ধ্বনিত হতে লাগল ওর নামটা। ধ্রুব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তীব্র যন্ত্রণায় ওর মাথার ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোনমতে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে টলতে টলতে দু’হাতে কানদুটো চেপে ধরে ওখানেই হাঁটু গেঁড়ে মাটিতে দড়াম করে আছড়ে পড়ল ধ্রুব।
ঘরের ভিতরটা বড্ড গুমোট। রাত এখন কত কে জানে। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল লাবণ্যর। শরীরটা আজ দুপুর থেকেই বড্ড দুর্বল। চাদরটা টেনে নিয়ে কোনমতে পাশ ফিরতে গিয়ে লাবণ্য টের পেল ওর বুকের উপর ভারী কিছু একটা যেন চেপে বসেছে – দম আটকে আসছে ওর! গায়ের সমস্ত শক্তি একত্র করে জিনিসটা দুহাতে ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে দস্তুর মতো হাঁপাতে লাগল লাবণ্য। কালো কালো লোমশ মতো ওটা কী চেপে বসেছিল ওর বুকে? বেড়াল টেরাল নাকি? কিন্তু বেড়াল তো হালকা প্রাণী, কেমন তরতর করে গাছ বেয়ে উপরে উঠে যায়। যে জিনিসটা লাবণ্যর বুকে চেপে বসেছিল সেটা আকারে ছোটখাট হলেও বেশ শক্তপোক্ত আর ভারী। জলতেষ্টায় গলাটা শুকিয়ে গেছে। পাশ ফিরে খালি বিছানায় চোখ যেতেই নাইটল্যাম্পের আলোয় এবার একটু শিউরে উঠল লাবণ্য। পাশে দাদা নেই! তার বদলে দাদার শোওয়ার জায়গাটায় সমস্ত বিছানার চাদর জুড়ে লেগে রয়েছে চাপ চাপ তাজা লাল রক্তের ছোপ। এবার ভয়ে রিতীমতো আঁতকে উঠল লাবণ্য। এত রাতে দাদা কোথায় গেল! ওর বিছানায় এত রক্ত এল কোথা থেকে? তবে কী রাতদুপুরে অনুসন্ধান করতে আবার চুপিচুপি ওই চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে ঢুকল ওর দাদা? সর্বনাশ! লাবণ্যর সারা শরীর শিউরে উঠল। আজ সকালে ওই ঘরে সে আর তার দাদা যা যা ঘটতে দেখেছে সেসব স্বপ্ন না সত্যি, সেটা লাবণ্য ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারছিল না! কিন্তু ঘটনাটা এতটাই স্পষ্ট আর ভয়ানক যে সেটা মনে পড়লেই সমস্ত শরীর বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত খেলে যায়। লাবণ্য পা টিপে টিপে টলতে টলতে বিছানা থেকে নামল। আরে, ডাইনিং হল পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ির উপরটায় একটা আবছা আলো জ্বলছে কেন? ওই দিকটাতেই তো সেই চিলেকোঠার ঘরটা! তার মানে কী ওর ধারণাই সত্যি! এই মাঝরাতে চুপিচুপি ওর দাদা ওই চিলেকোঠার ঘরটায় গিয়ে ঢুকেছে? কী সাংঘাতিক! লাবণ্যর আর পা চলছে না; তবুও ও কোনমতে শরীরটা টানতে টানতে নিয়ে হলদে আলোর রেখা বরাবর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল।
কিছুদূর উঠতেই লাবণ্যর কানে একটা চাপা আর অস্পষ্ট গোঙ্গানির শব্দ ভেসে এল। চমকে উঠল ও। এ কী! এটাতো ওর দাদার গলা! তার মানে কী ওর দাদার কোন বিপদ হল? লাবণ্যর শরীরে তখন যেন একটা অদৃশ্য শক্তি ভর করেছে। তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে চিলেকোঠার দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে দিল লাবণ্য।
সমস্ত ঘরটা ভরে আছে একটা মাংসপচা ভ্যাপসা গন্ধে। চাপ চাপ ধোঁয়াশার স্তর ভেদ করে ঘরের ভেতর থেকে বেজে আসছে একটা যান্ত্রিক গলার গমগমে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ! লাবণ্যর সারা শরীর শিউরে উঠল। কিছুটা এগিয়ে আসতেই ধ্রুবকে দেখতে পেল ও। চিলেকোঠার ছাদের দেওয়ালের গায়ে টিকটির মতো পা আটকে উবু হয়ে বসে আছে ধ্রুব। শরীর একদম উলঙ্গ, সেখানে ছিঁটেফোটা পোশাকের চিহ্নমাত্র নেই। চোখ দুটো অসম্ভব ফোলা, সে দুটো টকটকে লাল। জিভটা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। উপরের পাটির দাঁত চেপে বসে সেটার গোড়ার দিকটা কেটে গিয়ে মেঝেতে টপটপ করে তাজা লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। লাবণ্য সেদিকে তাকিয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে আঁতকে উঠল। ধ্রুব এবার একটা কান্ড করল। মুখে একটা জান্তব গোঙ্গানির শব্দ করতে করতে দুহাতের বড় বড় নখগুলো দিয়ে ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে সারা গায়ে জোরে জোরে চুলকোতে শুরু করল। এত জোরে জোরে ও চুলকোতে লাগল যে নখের খোঁচায় দেহের ছাল-চামড়া উঠে গিয়ে মাংস বেরিয়ে পড়ল। সে এক রক্তারক্তি কান্ড। ধীরে ধীরে চামড়ায় নখ ঘষার গতি বাড়িয়ে দিল ও। লাবণ্য বড় বড় চোখে লক্ষ করল, ধ্রুবর ডানহাতের মধ্যমায় ঘরের টিমটিমে হলদে আলোয় জ্বলজ্বল করছে একটা গোলাপি পাথরের গোল ধাতুর আংটি!
লাবণ্য আর সহ্য করতে পারল না। ধ্রুবর এই রূপ দেখে ও চিৎকার করে কেঁদে উঠল, “দাদা – এই দাদা – তুই ওখানে ওইভাবে কী করছিস – এ কী হল তোর!”
লাবণ্যর চিৎকার শুনে চুলকানো বন্ধ করে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল ধ্রুব। ওর দুটো গনগনে লাল চোখে ফুটে বেরচ্ছে তীব্র জিঘাংসা! দাঁত মুখ খিঁচিয়ে প্রচন্ড বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে এবার ধ্রুব দেওয়াল থেকে লাফ মেরে নীচে নেমে এল। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে মেঝে থেকে তুলে নিল একটা জংধরা ভাঙ্গা কাঁচির ফলা। লাবণ্য তখন নিজের জায়গায় স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে। সামনে যে বিভৎস মানুষটা দাঁড়িয়ে রয়েছে এটা কিছুতেই তার দাদা ধ্রুব সেন হতে পারে না!
ধ্রুব আর দেরি করল না। চকিতে তীক্ষ্ণ ফলাটা নিয়ে ছুটে এসে লাবণ্যর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টাল সামলাতে না পেরে দাদার উলঙ্গ শরীরটা জড়িয়ে ধরে দড়াম করে মেঝেতে আছড়ে পড়ল লাবণ্য। ওর মাথাটা শক্ত মেঝেতে ঠুকে গিয়ে সেখান থেকে গলগল করে রক্ত বেরতে লাগল। ধ্রুব সেটা দেখে ঘর কাঁপিয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করে একটা বিশ্রী শব্দে হেসে উঠেই লাবণ্যর মুখটা একহাতে জোরে চেপে ধরে আরেকহাতে ভাঙ্গা কাঁচির ফলাটা আমূল বসিয়ে দিল বোনের পেটে। গলগল দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। যন্ত্রণায় কাটা মুরগির মতো ছটফট করে গোঙ্গাতে লাগল লাবণ্য। ধ্রুব গায়ের জোরে লাবণ্যর মুখটা চেপে ধরে ক্রমেগত ওর বুকে, পাঁজরে, তলপেটে লোহার ফলাটা ঢুকিয়ে ফালাফালা করে দিতে লাগল। দাদার শক্ত হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর কয়েকবার বৃথা চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল লাবণ্য। কয়েকবার কেঁপে উঠে আস্তে আস্তে স্থির হয়ে এল ওর শরীরটা।
ধ্রুব লাবণ্যর ঠান্ডা রক্তাক্ত দেহটার উপর থেকে ছিটকে গিয়ে মেঝেতে ব্যাঙ্গের মতো উবু হয়ে বসে জিভ বার করে হাঁপাতে লাগল। ওর সমস্ত শরীর ততক্ষণে ঘেমে উঠেছে। একদৃষ্টে কিছুক্ষণ ওর বোনের ক্ষত বিক্ষত শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকল ধ্রুব। তারপর হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে এসে লাবণ্যর শরীরের ক্ষতস্থান থেকে আঁজলা ভরে তাজা রক্ত নিয়ে সেটা দু’হাতে পান করতে লাগল। তাজা রক্ত ওর চোয়ালের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। একবার খ্যাঁ খ্যাঁ করে পিশাচের মতো হেসে উঠল ধ্রুব। তারপর লাবণ্যর শরীর থেকে দু’হাতে রক্ত মাখিয়ে নিয়ে সারা গায়ে ঘষে ঘষে মাখতে লাগল। তারপর হাঁটুমুড়ে উঠে এসে বসল লাবণ্যর ক্ষত বিক্ষত পেটের উপর। চোখ বুজে সোজা ভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে দুলেদুলে একটানা উচ্চস্বরে আউরে যেতে লাগল মহা সঞ্জীবনী মন্ত্র!
ঢংঢং করে ডাইনিং-এর গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটায় একটা বাজল। লাবণ্যর কড়ে আঙ্গুলটা একবার নড়ে উঠল কী?
পরদিন সকালে চিলেকোঠার ঘর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শুনে ছুটে এসে যখন ধীরেন্দ্রবাবু আর রুক্মিণীদেবী লাবণ্যর ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত দেহটা সেখানে আবিষ্কার করল, ততক্ষণে বাইরে ভোরের আলো ফুটে গেছে। ধ্রুব তখনও উলঙ্গ হয়ে বোনের ঠান্ডা নিথর শরীরটার উপর সারা গায়ে রক্ত মেখে বসে একটানা ক্লান্ত স্বরে আউরে চলেছে একটা মন্ত্র, “বর্গাদ্যাং বর্ণংহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম… বর্গাদ্যাং বর্ণংহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম… বর্গাদ্যাং বর্ণংহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম…!” ভাঙ্গা জানলাটার বাইরে থেকে আসা কাঁচাসোনা রোদের আলোয় ওর ডান হাতের মধ্যমায় চকচক করছে বৈদ্যবাবার নীলাচল পাহাড় থেকে নিয়ে আসা গোলাপি পাথর বসান সেই অভিশপ্ত গোল আংটিটা।
পরিচিতি:
আকাশদীপ গড়গড়ী,
জন্ম ১৯৯৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের উওর ২৪ পরগনার নৈহাটীতে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে এম.এ। কর্পোরেট জবের পাশাপাশি একটি শর্টফিল্ম প্রোডাকশন হাউসের সাথে যুক্ত রয়েছেন। সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে সাহিত্য চর্চা। লেখালেখির সূত্রপাত বার্ষিক স্কুল ম্যাগাজিনে ছোটোগল্প থেকে। এরপর ফেসবুকের জগতে ও আরো নানান ম্যাগাজিনে আত্মপ্রকাশ। তার লেখা বড়ো গল্প, ছোটগল্প, কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাহিত্য আর শারদীয়া পত্রিকায় ও বেশ কিছু গল্প আর কবিতা সংকলনের গ্রন্থে। তার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাসের নাম ‘মিসিং-লিংক’।