Getting your Trinity Audio player ready...
|
“নমস্কার, আমি সৌগত পাল। ‘ভূতের রাজা দিলো বর’ গ্রুপে এটা আমার প্রথম লাইভ আসা। ছোটবেলা থেকেই ভৌতিক গল্পের প্রতি আমার একটা ভীষণ আকর্ষণ আছে। অনেক গল্পের বই পড়েছি। তবে গল্প লেখার কথা যদিও কোন দিনও ভাবিনি। এই গ্রুপে যোগ দিয়েছি এই দুই মাস মত হল। এখানে যারা যারা গল্প লেখেন, আমি এই কদিনে তাদের অনেক গল্পই পড়েছি। ভীষণ ভালো লাগে। সময় কাটানোর একটা দারুণ ঠিকানা এই ‘ভূতের রাজা দিলো বর’ গ্রুপটা। তারপর যখন দেখলাম যে এখানে লাইভ এসে নিজের ভৌতিক বা অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়, তখনই ভাবলাম যে একদিন আমিও এসে বলবো কিছু।” – এই ভাবেই সৌগত শুরু করলো প্রথমবার তার ভৌতিক গল্প বলার পালা। গ্রামের স্কুল থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলকাতার এক প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনারিং-এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌগত। মেস ভাড়া করে একাই থাকে সে।
সৌগত শুরু করলো তার গল্প। “সকলেই জানেন যে গ্রামের দিকে অনেক রকম ভৌতিক কাহিনী শোনা যায় বিভিন্ন ঘরবাড়ি, মন্দির কিংবা গাছপালা ঘিরে। এই রকমই আমাদের গ্রামে ছিল এক ভগ্নপ্রায় শ্মশানের অংশবিশেষ। যেখানে আমার জন্মেরও অনেক আগে থেকেই মরা পোড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে মন্দিরের ভেতরে কোন মূর্তি ছিল না। গ্রামের অনেকেই রাতের বেলায় ওর পাশের রাস্তা দিয়ে আসতে যেতে ভয় পেয়েছে। কখনও কাউর হাঁটা চলার শব্দ, কখনও কথা বলার শব্দ, আরও নানান শব্দ অনেকেই নাকি শুনেছে। অথচ সেই শ্মশানের চারিপাশের অনেকটা এলাকা জুড়ে কোন জনবসতি নেই। তাই রাতের বেলায় পাশের পথটা জুড়ে সঙ্গী থাকতো শুধুই অন্ধকার, ছোটখাটো গাছপালা ঘেরা জঙ্গল আর অজানা এক ভয়। খুব প্রয়োজন না হলে, আমরা সকলেই রাতের দিকে ওই পথ এড়িয়েই চলতাম। কিন্তু একদিন আমায় বাধ্য হয়ে আসতে হল। আর সেদিনই আমি অনুভব করলাম ভয় কি জিনিস। আজ সেই গল্পই আপানদের শোনাবো। তখন আমি একাদশ শ্রেণীতে পড়ি। সাইকেল চালিয়ে অনেকটা দূরে একজনের কাছে ফিজিক্স পড়তে যেতাম সন্ধ্যে বেলায়। প্রায় অর্ধেক সময়ে পৌঁছে যেতে পারতাম, যদি ওই শ্মশানের পাশ দিয়ে যাতায়াত করতাম। ভূত-টুতে আমি ওত বিশ্বাস করি না। তবে ওই রাস্তা ধরে গেলে পোকামাকড়, সাপখোপেরও ভয় থাকে। তাই রাতের দিকে ওই পথ এড়ানোই ভালো। কিন্তু সেদিন ইন্ডিয়া পাকিস্তানের ফাইনাল ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। তাই বাড়ি ফেরার প্রচণ্ড তাড়া ছিল। ভয়-টয় ভুলে সেদিন তাই ঠিক করলাম শ্মশানের পাশ দিয়েই যাব। জোড়ে সাইকেল চালিয়ে আসছিলাম আমি একাই। শ্মশানের কাছাকাছি আসতেই এমন একটা কাণ্ড ঘটলো, যা আগে কোন দিনও ঘটেনি আমার সাথে। সাইকেলটার পিছনের টায়ারটা পাংচার হয়ে গেলো। এখন অগত্যা আমায় বাকি পথটা হেঁটেই যেতে হবে। মনের মাঝে তখন ভয়ের থেকে বেশী রাগই হচ্ছিল। তখন রাত প্রায় আটটা হবে। চারিপাশে যেন একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার। চাঁদের অল্প আলো আছে যদিও, কিন্তু এই শ্মশানের অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতায় সেই স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না যেন ঢাকা পরে গেছে। চারিপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। দু-একটা জোনাকির দেখাও মিলছে না। কোন এক অদৃশ্য মায়াজাল যেন আমার আসার অপেক্ষায় চুপটি করে বসে আছে ওই শ্মশানের চারিপাশের জঙ্গলের মধ্যে। যত এগোতে থাকলাম, মনে হতে লাগলো যেন আমার পুরো শরীরটা ভারী হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে হাত, পা গুলো যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। আমার চলার গতি মন্থর হতে থাকলো। হঠাৎই পাশের জঙ্গল থেকে কোন এক বিষধর সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ যেন কানে এলো। আমি তখন মন্দিরের একদম সামনে এসে গেছি। হঠাৎই আমার খুবই ঠাণ্ডা লাগছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আর মনে হল, ওই মন্দিরের ভেতর থেকে কেউ যেন আমায় খুবই ক্ষীণ অথচ মিষ্টি স্বরে ডাকছে। আমার নাম ধরে ডাকেনি, কিন্তু কি একটা শব্দ বা কথা শুনেছিলাম তা মনে পড়ে না। তবে সেই কণ্ঠে যেন এক তীব্র আকর্ষণ ছিল। পর-মুহূর্তেই একটা পায়ের শব্দ পেলাম পিছন থেকে। আর সেই শব্দে যেন আমার ঘোরটা কাটল। তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে চাইতেই অন্ধকারে শুধু দুটো জ্বলন্ত চোখ দেখতে পেলাম। আশ্চর্য রকম লাল দুটো চোখ আর সম্পূর্ণ আঁধারে ঢাকা একটা লম্বা শরীর যেন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। অথচ, আমি পিছন ফিরে তাকাতেই, সেটা কোথায় হারিয়ে গেলো। এবার আমি প্রচণ্ড ভয়ে, কাঁপতে কাঁপতে, শরীরের সমস্ত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, হাতে ওই সাইকেল ধরেই প্রাণপণে প্রায় মিনিট দুয়েক ছুটলাম। আমার বারবার মনে হচ্ছিল যেন আমি ভুল পথে চলেছি। এই পথের কোন শেষ সীমা নেই। কিন্তু তবুও আমি ছুটে চলেছি। কিছু দূর এগোনের পর আবার দূরে রাস্তার আলো দেখতে পেলাম। মন থেকে আমার ভয়টা একটু হলেও যেন দূর হল। সেদিন বাড়ি ঠিকঠাক পৌঁছে গেলেও খেলাটা আমি আর উপভোগ করতে পারিনি। রাত থেকেই হঠাৎ ধুম জ্বর এসেছিল আমার। টানা প্রায় তিন দিন পর একটু সুস্থ হয়েছিলাম। আর কোন দিনও ওই পথের মুখোমুখি হয়নি। তবে সেদিন আমার সাথে ঠিক কি ঘটেছিলো এবং কেনই বা ওরকম অনুভূতি হয়েছিল, তা আমি জানিনা। হয়তো সবটাই মনের ভুল অথবা কিছু একটা অলৌকিক ব্যাপার বা নেগেটিভ এনার্জি সেখানে নিশ্চয়ই ছিল। যাই হোক, আমার গল্প আজকে এখানেই শেষ করছি। আপনাদের কেমন লাগলো আমায় জানাবেন। নমস্কার।” – এতক্ষণ সৌগত টানা বলে গেছে তার গল্প। আসলে প্রথম দিন বলে একটু হলেও নার্ভাস ছিল সে। তাই কে কি কমেন্ট করছিল, সেদিকটায় খেয়ালই করেনি সৌগত। এবার সে কমেন্টসগুলো পড়ে বেশ অবাক হল। আসলে যারা এই লাইভটা দেখছিল, তারা যতটা না সৌগতর গল্পটা এনজয় করছিল, তার থেকে হয়তো অনেক বেশী এনজয় করেছে সৌগতর ব্যাকগ্রাউন্ডে ঘটে চলা ভৌতিক কার্যকলাপ। অনেকেই কমেন্ট করেছে যে সৌগতর পিছনে জানলার পর্দাটা হাওয়াতে ঠিক সেই সময়টুকুর জন্যই উড়ছিল, যখন ওই শ্মশানের ঘটনাটা সে বলছিল। সৌগত নিজের ভিডিওটা একবার পুরোটা চালিয়ে দেখে এবং এই ঘটনাটি দেখে সে ভারী আশ্চর্য হয়ে যায় এই ভেবে যে, কাকতালীয় ভাবেই ভৌতিক গল্পের সাথে সাথে তার আশেপাশের পরিবেশেও সেই ভৌতিক আবহটা যেন নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পর-মুহূর্তেই সে ভাবল, জানালা দিয়ে এতটা জোড়ে হাওয়া দিলো যে পর্দাটা উড়ে গেলো, অথচ সে নিজে সেটা টের পেলনা কেন? তার গায়ে এসেও তো সেই বাতাস লাগার কথা। যাই হোক, খামোখা নিজেকে ভয় দেখানোর কি মানে? এই ভেবে নিজেরই হাসি পেল সৌগতর।
একটা মাস কেটে গেছে। সে আবার ‘ভূতের রাজা দিলো বর’ গ্রুপের এডমিনের সাথে কথা বলে আবারও একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতা শোনানোর কথা জানালো। অনেকেই তার আগের বারের ভিডিওর কথা মাথায় রেখেছে। ফলে এই নিউজটা গ্রুপে দেওয়ায় অনেকেই বেশ এক্সাইটেড, সেটা দেখা গেলো। ফলে সৌগতর গল্প বলার ইচ্ছে এবং উৎসাহ দুটোই তখন তুঙ্গে। আবারও রাত ৯টা বাজতেই সৌগত শুরু করলো তার দ্বিতীয় লাইভ প্রোগ্রাম। “আজ আমি আপনাদের শোনাবো আমারই এক বন্ধুর কিছু ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। অভিষেক, মানে আমার সেই বন্ধুটি কিছুদিন হয়েছিল একটি মেস বাড়ীতে উঠেছিল। আসার আগেই একজনের কাছে শুনেছিল, ওই বাড়িটা ভালো নয়। অনেকেই আগে ভয় পেয়েছে। অভিষেক খুবই ডানপিটে ছেলে ছোট থেকেই। এসব শুনে ও আরও বেশী করে ওই বাড়িটাতেই থাকতে চাইলো। কয়েকটা দিন পরই, হঠাৎই এক রাতে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। সে তার স্টাডি টেবিলটাতে বসে পড়ছিল। তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। হঠাৎই তার ঘরে জ্বলতে থাকা টিউব লাইটটা ঠিক ওই হরর মুভিগুলোর মতই বেশ কয়েকবার জ্বলে নিভে উঠলো।” আর ঠিক এই সময়েই সৌগতর পিছনে জ্বলতে থাকা এল.ই.ডি লাইটটাও যেন কয়েকবার কেঁপে উঠলো। অথচ এতক্ষণ কিন্তু সেটা ঠিকই ছিল। সেটা দেখেই আবারও লোকজন কমেন্ট করতে শুরু করেছে। আজ সৌগত নিজেও একবার লাইটের দিকে তাকায় এবং তারপর আবার তার বন্ধুর গল্পটা বলতে শুরু করে। “আমি জানিনা যে ভৌতিক গল্প বলতে গেলেই কেন এরকমটা হচ্ছে আমার সাথে। যাই হোক, এই লাইট কেঁপে ওঠাটাও নিতান্তই কাকতালীয়। যেটা বলছিলাম, তারপরই অভিষেকের ঘরে থাকা কিছু জিনিস আচমকাই মেঝেতে পরে যেতে থাকে। অথচ কোন হাওয়া বাতাস কিন্তু ছিল না তখন। যেমন তার টেবিলে থাকা পেন দানি, জলের গ্লাস, মোবাইলের চার্জার ইত্যাদি। একসাথে কিন্তু নয়, কিছুক্ষণ পরপর ওগুলো পড়তে থাকে। অভিষেকের এবার যেন মনে একটু ভয় লাগে।” আবারও এই কথাগুলো যখন সৌগত বলছে, একই ভাবে তার টেবিল থেকেও কিছু জিনিস পড়ে যায় মেঝেতে। এরপর তার পিছনে জানলার সামনে থাকা একটা ছোট ফুলদানি যখন হঠাৎই মাটিতে পড়ে, তখন সৌগতর সমগ্র মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠে। সে লাইভে বলে যে “আজ আমি ভিডিওটা এখানেই বন্ধ করছি। কারণ আমি নিজে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছি। বুঝতে পারছিনা এসব কি হচ্ছে আমার সাথে। আমায় ক্ষমা করবেন। আপনাদের না হয় কাল আবার গল্প শোনাবো।” এই কথা বলে সৌগত ভিডিওটা বন্ধ করে। অথচ, এরপর সারারাত কিন্তু আর কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটেনি। সকালে উঠে ‘ভূতের রাজা দিলো বর’ গ্রুপে তার ভিডিওটা খুলতেই দেখতে পেল প্রচুর কমেন্টস ভরে গেছে এবং প্রত্যেকেই জানতে চাইছে যে তার বন্ধুরই বা কি হল এবং সৌগতর ঘরে যা যা ঘটছে, তা কি শুধুই একটা সমাপতন, নাকি তার ঘরেও সত্যি কোন অলৌকিক ব্যাপার আছে। সৌগতর এই লাইভের খবর রীতিমত ভাইরাল হয়ে গেছে এক রাতেই। নিজেকে একজন ছোটখাটো সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে সৌগতর। গ্রুপ এডমিন তাকে মেসেজে বলে আবারও আজ রাতে লাইভ করতে।
সৌগত আবারও লাইভে আসে। আজ দর্শক সংখ্যা প্রায় কয়েক হাজার। সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, আজ কি ভৌতিক ঘটনা ঘটে সেটা দেখবার জন্য। সৌগত শুরু করলো। “সেদিন রাতে অভিষেক শুধু একটা পোড়া গন্ধ পেয়েছিল। আর সেরকম কিছু ঘটেনি। কিন্তু পরের দিন রাতে আবারও সেই একই সময়ে লাইটগুলো জ্বলে নিভে ওঠে এবং তারপরই পুরো অন্ধকার হয়ে যায়। আবারও সেই পোড়া গন্ধ এবং আগের রাতের থেকেও তা তীব্র। অভিষেক ফোনের আলোটা জ্বালায় এবং রান্না ঘর থেকে যেন কিছুর একটা শব্দ পায় সে। ভয়ে ভয়ে সে এগোয় সেই দিকে। এক মুহূর্তের জন্য মোবাইলের আলোয় সে কোন এক ব্যক্তির পোড়া একটা হাত দেখতে পেল। তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড এক আতঙ্কের ঢেউ সারা শরীরে খেলে যায় তার এবং মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেটি তোলার পরই কারেন্ট এসে যায় এবং রান্নাঘরে আর কিছুই দেখতে পায়না সে।” এতক্ষণ সকল দর্শক কোন রকম অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য না করলেও, সৌগতর কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের লাইট সম্পূর্ণ নিভে যায়। মোবাইলের সামান্য আলো এসে এখন পড়েছে সৌগতর মুখে। সৌগত হাতে একটা ছোট টর্চ নিয়ে বলতে লাগলো “আমি সত্যি জানিনা এখন আমার সাথে অলৌকিক কিছু ঘটবে কিনা, তবে যতক্ষণ সম্ভব আমি ভিডিওটা অন রাখছি।” এই বলেই তৎক্ষণাৎ সৌগত বারান্দাটার দিকে তাকায়। আবার ফোনের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সে বলে “আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা আমি জানিনা, তবে ওইদিক থেকে যেন একটা আওয়াজ পেলাম, আমি চেষ্টা করছি আপনাদেরকে দেখানোর।” এই বলে সৌগত বারান্দার দিকে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। মোবাইলের ক্যামেরায় টর্চের গোলাকার আলোতে সকল দর্শক দেখতে পেল একটা কালো, লম্বা সাপের মত জিনিস সেখানে থাকা টেবিলের নীচে ঢুকে গেলো। এরপরই আবার কারেন্ট এসে যায়। সৌগত ক্যামেরাটা এখনও ধরে আছে। এরপর নিচু হয়ে সে দেখে সবাইকে বলে যে সেখানে কিছুই নেই। এরপর সে জানায় তার সমগ্র শরীরে এখন কাঁপুনি দিচ্ছে। তার পক্ষে এখন আর কন্টিনিউ করা নয়। তাই আগামীকাল আবার গল্পটা বলার চেষ্টা করবে সে।
এই দুই দিনেই সৌগতর লাইভের কথা হুহু করে ফেসবুকে ছড়িয়ে যায়। ‘ভূতের রাজা দিলো বর’ গ্রুপের সদস্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আর সকলের মনেই একটাই প্রশ্ন এখন – সৌগতর ঘরে কি সত্যি কোন ভৌতিক কাণ্ড ঘটছে? যদি তাই হয় তবে শুধুমাত্র তার গল্প বলার সময়েই তা ঘটবে কেন? যাই হোক, সকল দর্শকের কাছে ব্যাপারটা যথেষ্ট উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। আজ আবার সৌগত এসে গেছে লাইভে। “দেখুন গত দুই দিন ধরে আমার সাথে যা ঘটে চলেছে, যার সাক্ষী আপনারাও – সেই সকল ঘটনার কোন সঠিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। এমনও নয় যে সারাক্ষণ আমি এসব অনুভব করছি বা দেখতে পাচ্ছি। শুধুমাত্র গল্প বলার সময়ই এসব ঘটছে। তাই আমি আজ অভিষেকের গল্পটা শেষ করবো। জানিনা, হয়তো এই গল্পটাই অভিশপ্ত। যাই হোক, এরপর দিন অভিষেক রাত দশটায় ডিনার করে শুয়ে পড়ে। ঘুমটা ভেঙে যায় একটা মেয়ের আর্তনাদে। উঠেই দেখে ঘড়িতে ঠিক সাড়ে এগারোটা। সেই উগ্র পোড়া গন্ধটা আবারও নাকে আসছে। কিন্তু কই, কেউ তো আর চিৎকার করছে না। এবার তার চোখ গেলো আবারও রান্না ঘরটার দিকে। কিছুতে আগুন লেগে গেলো নাকি? সেরকমই কম্পমান আলো যেন বেড়িয়ে আসছে ঘরটা থেকে। অন্ধকারের মধ্যেই ছুটে রান্না ঘরের দিকে যায় অভিষেক। আর দেখে একটা শরীর সম্পূর্ণ জ্বলছে আগুনে। চোখ দুটো-ঠিকরে যেন বেড়িয়ে আসছে বাইরের দিকে। মুখের চামড়া গলে গলে পড়ছে। আর দু –পাটি দাঁত যেন এক পৈশাচিক হাসি হাসছে তার দিকে চেয়ে। অভিষেক অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার যখন জ্ঞান ফেরে, তখন ভোরের আলো চোখে এসে পড়েছে। সামনে যদিও কোন পোড়া দেহ আর দেখতে পায়না সে। সেদিনই বাড়িটা ছেড়ে দেয়। পরে জানতে পারে যে বাড়ির মালিক তার বউকে ওই রান্না ঘরে গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেড়েছিল। আর তারপর থেকে ওই ঘরে যেই ভাড়াটে আসে, সেই ওই একই রকম দৃশ্য দেখতে পায়। এই ছিল আমার বন্ধু অভিষেকের গল্প।” এই পর্যন্ত বলা শেষ হতেই আচমকাই বারান্দার আলোটা নিভে যায়। তাই সেদিকেই তাকায় সৌগত। সকলেই তখন কমেন্ট করে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে। কিছু বলতে যাবে সৌগত, সঙ্গে সঙ্গে একটা সজোরে কাঁচ ভাঙার শব্দ আসে। যারা লাইভটি দেখছিল। তারাও সেই শব্দ শুনতে পায়। ক্যামেরাটা অন রেখেই সে এগোতে থাকে বারান্দাটার দিকে। সকলেরই যেন হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। না জানি কোন বীভৎস দৃশ্য অপেক্ষা করে আছে সকলের জন্য। বারান্দায় পৌঁছাতেই ভয়সূচক এক আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো সৌগতর মুখ থেকে। ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত একটা বিড়ালের দেহ বারান্দার বড়ো জানলায় কেউ ছুড়ে মেড়েছে। সেই জন্যই কাঁচ ভাঙার শব্দ পাওয়া যায়। ক্যামেরাটা বিড়ালটার দিকে ঘোরাতেই সবাই দেখতে পেল সেই বীভৎস দৃশ্য। চারিপাশে ছোট বড়ো কাঁচের টুকরো পরে, আর বিড়ালটার দুটো চোখ যেন কেউ খুবলে নিয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শরীরটা। সৌগতর কথা বলার মত ক্ষমতা নেই। সে শুধু বলে “এই জানলার ওপারে কিছুটা জঙ্গল আর একটা বড়ো পুকুর আছে। এখানে কেউ এসে এরকমটা করবে – এটা সম্ভব না। আমি আজকের মত এখানেই ভিডিও বন্ধ করলাম, না হলে জানিনা আর কি কি ঘটবে এই ঘরে। ভালো থাকবেন সকলে। নমস্কার।”
রাতে শুতে যাওয়ার আগে সৌগত নিজের ভিডিওর কমেন্ট বক্সটা এবং ইনবক্সটাও চেক করলো। হাজার হাজার কমেন্টস-এ আর মেসেজে ভেসে যাচ্ছে তার প্রোফাইল। সত্যি, মাত্র এই তিন দিনেই যেন তার জীবনটাই পাল্টে গেলো। কত মানুষ তাকে চিনে গেলো। তার ভিডিও নিয়ে লোকজনের মধ্যে এখন কত উন্মাদনা। সৌগতর বন্ধুর গল্প কি সত্যিই অভিশপ্ত? নাকি তার ঘরে সত্যি কোন অলৌকিক বা ভৌতিক শক্তির বসবাস আছে? দর্শক ভার্চুয়ালি যা কিছু দেখছে, তার কতটা সত্যি? কতটা মিথ্যে? – আসলে এসব বিচার করে লোকজন ওত ভিডিও দেখে না। সৌগতর ভিডিওতে এমন কিছু একটা সবাই খুঁজে পেল, যা সাধারণের থেকে আলাদা। ঠিক সেই কারণেই তার এতো চাহিদা। আর সত্যি বলতে, এমনটাই তো সৌগত চেয়েছিল। তাইতো এতো নাটক, এতো কাণ্ড ঘটানো। ঘুমোতে যাওয়ার আগে তাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে।
প্রথম দিন যখন নিজের জীবনের সত্যি একটা ঘটনা বলার সময় পর্দাটা উড়ে গিয়ে ভৌতিক একটা আবহের সৃষ্টি করে, আর সেটা দেখে যখন দর্শকরা মজা পায়, ঠিক সেই সময়তেই দুষ্টুমি করার বুদ্ধিটা খেলে যায় সৌগতর মাথায়। সে চায় এরকম ঘটনা ইচ্ছাকৃত ভাবে সাজাতে, যাতে দর্শক মনে করে এটা সত্যি কোন ভৌতিক ঘটনা। সেইমত ভেবেই অনেক ছোটবেলায় শোনা একটা গল্পে কিছুটা রঙ চড়িয়ে নিজের মত করে সাজিয়ে নেয় সে। অভিষেক নামে একটা কাল্পনিক বন্ধুকে তুলে এনে সেই গল্পে বসিয়ে দেয় সৌগত এবং বাকি নাটকটাও সাজিয়ে ফেলে। যে সমস্ত ভৌতিক ক্রিয়াকলাপ ঘটেছে, তা সমস্ত কিছুই তার ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধির দ্বারা। ঘরের লাইট জ্বলা, নেভা কিংবা ছোট ছোট মোটরের সাহায্যে জিনিসপত্র সঠিক সময়ে ফেলে দেওয়া – এসবই একজন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনারিং পড়া ছেলের কাছে খুব কঠিন কাজ নয়। মাইক্রোকন্ট্রোলার ব্যবহার করে সব কিছুই আগে থেকে প্রোগ্রামিং করা ছিলো, যাতে গল্প বলার টাইমিং-এর সাথে পরপর ঘটনাগুলো সিঙ্ক্রোনাইজ হয়ে ঘটতে থাকে। তারপর সেদিন, প্লাস্টিক সাপগুলোর মতই দেখতে একটা রবোটিক সরীসৃপ প্রাণী এতটাই রিয়ালিস্টিক বানিয়েছিল যে, সামনে থেকে দেখলেও যে কেউ চমকে উঠবে। পরের দিনের ঘটনাটা বলা যেতে পারে একদম মাস্টার স্ট্রোক ছিল। সেই দিন সকালে মর্নিং ওয়াক করার সময়তেই রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়া ওই বিড়ালটার ক্ষতবিক্ষত দেহটা দেখতে পায় সৌগত। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় বুদ্ধিটা খেলে যায় তার। কিছু ভাঙা কাঁচের টুকরো আগে থেকেই জোগাড় করে নেয়। কারণ সে ক্যামেরাটা এমন ভাবে ধরেছিল যে জানলার কাঁচটা সরাসরি কাউর চোখে পড়বে না। আর কাঁচ ভাঙার শব্দটা তো জাস্ট একটা সাউন্ড ইফেক্ট। কিন্তু দিনের পর দিন এরকমটা চলতে থাকেল, তার বুজরুকি ধরা পড়ে যাবে। এই আশঙ্কাতেই গল্পটা তাকে শেষ করতেই হল। তবে পরের গল্প শোনানোর ছকটা খুব জলদিই কষে নিলো সৌগত।
আচ্ছা, তার শোনা আর কি কোন ভূতের গল্পের ভালো প্লট আছে? নাকি বইটই ঘেঁটে খুঁজতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মাথায় এসে গেলো অপূর্বর কথাটা। যে আজ প্রায় ছয় বছর হল, এই পৃথিবীতে নেই। হ্যাঁ, এই কথাটা মাথায় আসতেই সৌগতর মুখে যেন একটা হাসি খেলে গেলো। অপূর্ব মানে সৌগতর নিজের ছোট ভাই, যে ছাদ থেকে পড়ে ছয় বছর আগেই মারা গিয়েছে। তাকে নিয়ে কিছু ভৌতিক গল্প বানালে কেমন হয়? সেই মত করেই সৌগত আবারও তার ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে নিজের ঘরে সব সেটআপ করে ফেললো ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করার জন্য।
‘ভূতের রাজা দিলো বর’ গ্রুপ থেকে হাজারো রিকোয়েস্ট আসতে থাকার পর, অবশেষে আজ আবারও সৌগত হাজির তার ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতে। “আসা করি সবাই ভালো আছেন। আমি জানিনা আজ আবারও ভৌতিক কিছু ঘটবে কিনা। তবে প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, ওই গল্প শেষ করার পর থেকে আজ পর্যন্ত কিন্তু কোন অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি আমার ঘরে। আজ আমি আপনাদের আমার ভাইয়ের কথা বলবো। খুবই মর্মান্তিক, তাই এটা বলবো কিনা সেই নিয়ে একটু দ্বন্দ্বে ছিলাম। যাই হোক, আজ বলি আপনাদের সেই ঘটনা। ওর যেদিন মৃত্যু হল, ঠিক সেই দিনটায় প্রতি বছর ও আসে আমার কাছে। প্রথম বছর খুবই ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু তারপর আর ভয় লাগেনা। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই পাঁচ বছর আগে যেদিন ও প্রথমবার এলো আমার সাথে দেখা করতে। আসলে আমায় ও খুব ভালোবাসতো জানেন। সেদিন রাতে সবে আমার ঘুমটা এসেছে। আমি অন্য পাশ ফিরে শুতে গেছি পাশবালিশটা টেনে, অমনি আমার হাতটা একটা বাচ্চা ছেলে গায়ে ঠেকে। লাফ মেড়ে উঠে বসি আমি। ঘর অন্ধকার ছিল। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের আলোটা ফেলতেই দেখলাম কেউ নেই।” এই বলে সৌগত নিজের ভাইয়ের ছবির ফ্রেমটা তুলে ধরল ক্যামেরার সামনে। “এই হল আমার ভাই। তখন আমার আর ভাইয়ের একটা ফটো একসাথে, একই ফ্রেমে ছিল। আমি লাইটটা অফ করে শুয়েছি, আর ফ্রেমটা টেবিল থেকে অদ্ভুত ভাবেই পড়ে যায় মেঝেতে। আমি আবার উঠি এবং অন্ধকারের মধ্যেই মনে হল একটা বাচ্চা ছেলে যেন ছুটে চলে গেলো ঘরের বাইরে। এবার আমি খুব ভয় পেলাম। ততক্ষণে বাবা, মা সবাই ঘুমিয়ে গেছে। লাইটটা জ্বালিয়ে মেঝের দিকে চোখ যেতেই ভয়ে আমার রক্ত যেন জল হয়ে গেলো। দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলের রক্তাক্ত পায়ের ছাপ লেগে আছে।” এতটা বলা হয়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলের পাশে রাখা সৌগতর ভাইয়ের ছবিটা অকারণেই মেঝেতে পড়ে যায়। যেটা দেখে সকল দর্শক খুবই রোমাঞ্চিত হয় ঠিকই, কারণ তারা তো এরকমই কিছু একটা এক্সপেক্ট করে বসে আছে। কিন্তু আজ সৌগতর চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপটা যেন দ্বিগুণ। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে একটু নীচের কমেন্টস গুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল সে। বেশীর ভাগ দর্শকই দুটো প্রশ্ন করে চলেছে। আজই কি তার ভাইয়ের মৃত্যু দিন? আর অপূর্বর মৃত্যুটা হয়েছিল কি ভাবে? সৌগত একটু ভাবল, আর তারপরই তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে থাকলো। আজ, হ্যাঁ আজকের দিনেই তো ঠিক ছয় বছর আগে তার ভাই অপূর্বর মৃত্যু হয়েছিল। এদিকে টেবিলের ওপরে থাকা ফটোর ফ্রেমটা তো আজ পড়ার কথা ছিলনা। বরং একটা ছায়া সেই সময় তার পিছনের দেওয়ালে পড়ার কথা ছিল। সেরকমই ব্যবস্থা করেছিল সৌগত। কিন্তু কই কেউ তো সেটা দেখতে পেল না।
যাই হোক, আবার বলতে শুরু করলো সে। “অপূর্বর মৃত্যু আজকের দিনেই হয়েছিল। অপূর্বকে জন্ম দেওয়ার পরই আমাদের মা মারা যায়। সেই শোক আমার বাবা মেনে নিতে পারেনি। আমি আর বাবা দুজনেই মনে করতাম অপূর্ব আমাদের পরিবারের জন্য শুভ না, ও অপয়া। তাই ছোট থেকেই বাবার স্নেহ বা দাদার ভালোবাসা – কোনটাই সে পায়নি। আমাদের দিদাই তাকে পরম যত্নে, ভালোবাসায় বড়ো করছিল। খুব রাগ হত ওর ওপর জানেন। একেই তো মাকে মরতে হল ওর জন্য। তার ওপর দিদার ভালোবাসাটাও পুরোপুরি কেড়ে নিলো। বাবাও কীরকম একটা হয়ে গেলো। একদিন আমরা বাড়ির ছাদে খেলতে গিয়েছিলাম। আমাদের ছাদটা ঘেরা ছিল না। হঠাৎই পিছন ফিরে দেখি অপূর্ব ছাদের একদম ধারে এসে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক হয়ে কি একটা ভাবছে। আমার মাথায় যেন এক পৈশাচিক বুদ্ধি খেলে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, আমি যদি ওকে এখন আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দি ছাদ থেকে, তবে তো কেউ বুঝতেও পারবে না। ভাববে খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে। তবে বিশ্বাস করুন ও নীচে পড়ে গিয়ে যে আর কোন দিনও উঠবে না, সে কথা আমার মাথায় একবারও আসেনি। আমি ভেবেছিলাম, হাত, পা ভেঙে যাক, কিংবা মাথাটা ফেটে গিয়ে কিছু মাস বিছানায় শুয়ে থাকবে। আর সেইটুকু বদলা নিয়ে আমার কিছুটা হলেও মনে শান্তি আসবে। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে ওর পিছনে গিয়ে বললাম – কীরে ভাই পড়ে যাবি তো, এইদিকে আয়। এই বলে ওর হাতটা ধরে নিজের দিকে না টেনে, হাল্কা করে উল্টো দিকে ধাক্কা দিলাম। পর-মুহূর্তে একটা ভারী জিনিস মাটিতে পড়ার শব্দ হল। নীচে তাকিয়ে দেখালাম, ওর মাথাটা একটা আধ টুকরো ইটের কোনায় লেগে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। জানেন মজার ব্যাপার হল আজ পর্যন্ত কেউ জানেনা যে সেদিন ভাইয়ের মৃত্যুটা শুধু অস্বাভাবিকই ছিল না, ওটা একটা মার্ডার ছিল। হ্যাঁ, আমি আমার ভাইকে খুনই করেছিলাম।” – এই কথা বলেই সৌগতর ঠোঁটের কোণে যেন একটা শয়তানের হাসি ফুটে উঠলো।
এবার তার ঘরের লাইটটা নিভে গেলো। আর তখনই সৌগতর মনে হল, এই অন্ধকারের মধ্যে কেউ যেন তার পিছনে এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণ সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কাউর পায়ের শব্দে যেন সৌগত স্বাভাবিক হল। এতক্ষণ সে যা বলে যাচ্ছিলো, সেই কথাগুলো সে আদেও বলতে চায়নি। তাকে দিয়ে যেন কেউ বলিয়ে নিচ্ছিল সেগুলো। নিজের কথার ওপর যেন কোন কন্ট্রোলই ছিল না সৌগতর। তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে তাকালো সে। তখনই আবার ঘরের লাইটটা জ্বলে ওঠে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায়না। অথচ, মেঝের দিকে তাকিয়ে সৌগতর দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হল। কোন এক বাচ্চার রক্তে ভেসে যাওয়া পায়ের ছাপ। এসব সত্যি কি করে হচ্ছে? সৌগতর মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার চোখ গেলো ফোনটার স্ক্রিনে। সকলেই এখন কমেন্ট করে বলছে সৌগতকে পিছন ফিরে চাইতে। তার মানে দর্শকরা কি পিছনে কাউকে দেখতে পাচ্ছে? সারা শরীরে এখন তার প্রচণ্ড এক ভয়ের স্রোত আছড়ে পড়েছে। সকল দর্শক এখন পুরো ঘটনাটাই লাইভ দেখতে পাচ্ছে। তারাও যেন তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে বসে আছে। পিছনে তাকাল সৌগত। এও কি সম্ভব? ছয় বছর আগের মৃত ভাই এখন সৌগতর সামনে দাঁড়িয়ে। মাথার একটা দিক পুরো থেঁতলে গিয়ে ঘিলু বেড়িয়ে এসেছে। সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এই অবস্থায় অপূর্ব বলে উঠলো “দাদা, কেন মেরে ফেললি আমায়?” সৌগত চেয়ার থেকে যেন ছিটকে গেলো। আর তার হাতটা লেগে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা পড়ে যেতেই ক্যামেরাতে আর কিছু ধরা পড়লো না। কিন্তু ফোনে ফেইসবুক লাইভটা তখনও চলছিল। দর্শকরা তাই এখন শুধুই অডিওটা শুনতে পাচ্ছে। “আমায় ছেড়ে দে ভাই। আ….আ….আমায় ক্ষমা করে দে। আ….আ….আমি ভুল করেছি। আআআ……।” এরপর শুধুই ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট একটা শব্দ শুনতে পায় ফেইসবুক লাইভটায় থাকা সকল দর্শক। ‘ধপাস’ – একটা ভারী জিনিস ওপর থেকে মাটিতে পড়ার শব্দ।