গাছ ভাঙা গুঁড়ি | ভয়ের দেশ |মৃত্যুঞ্জয় শীল| Bengali Horror Story
0 (0)

রাম রতন শও-এর খাল পারে কাঠ চেরাইকলের বয়েস প্রায় ৫০ বছর হোল। দুই ছেলে গগন আর সাওন বেওশার হাল ধরায় এখন সে কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু ওদের ওপর তো পুরোপুরি ভরসা করা যায়না। তবুও এখন সে কাঠের পাঠাতনে পারা নরম তুলোর গদিতে বসে রাম ভজন গায়, আর হনুমান চালিশা পরে। বাড়ি থেকে বড়িবহু, মানে গগনের স্ত্রী, রুটি-সবজি আর সুজি কি হাল্বা পাঠিয়ে দিলে, বুড়ো বড় তৃপ্তি করে খেয়ে দুপুরে শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নেয়। সান্ধায় একটু সিদ্ধি সেবন করে ছেলেদের সঙ্গে বাড়ি ফেরে। বয়েস হোলে কি হবে, বুড়োর নজর কিন্তু সব দিকে। তার নজর এড়িয়ে এক ইঞ্চি কাঠও কল থেকে কেউ নিতে পারেনা। তাছাড়া, সমস্ত দেনা পাওনার হিসেব রাখা, নতুন গুঁড়ি এসে পরলে নিজেই দাঁড়িয়ে তা চেড়াই করানো, মাল কিনতে আসা খদ্দেরের সঙ্গে আসা কাঠ মিস্ত্রির কমিশনের হিসেব করা, কাঠ চেরাইয়ের করাতে তেল মাখিয়ে ধার দেওয়া, এ সবকিছুই কাজই এখনও বুড়োর নখ দর্পণে। বেটাদের দিয়ে কাঠের গুঁড়ি তোলায়, আর বলে “নিজে হাতে কাজ না করলে বেওশার মায়া জম্মায় না বেটা। লোগকা উপর যাদা ভরসা করলে নাফার মুখ দেখা যায় না।”

সেই বিশ সাল আগে স্ত্রী যম্নাদেবী গত হবার পর সে একা হাতেই বেওশা ও ছেলেদের বড় করেছে, তাদের শাদী করিয়েছে, নিজে একবার কর্পোরেশন ভোটেও লড়েছে। তবে এখনকার নোংরা রাজনীতি তার আর ভাল লাগেনা। এক কথায় সে এখন নির্ঝঞ্ঝাট জীবন পছন্দ করে। বেটারা অনেক করে বললেও পুরনো ভাড়া বাড়ী ছেড়ে নতুন ফ্লাট কিনে সে উঠে যায়নি। বড় বেটা বলেরো গাড়ি কিনেছে। ছোট বেটা বুলেট বাইক। বুড়ো অবশ্য হেঁটে যেতেই ভালবাসে। সে বলে “গাড়ী শরীরে আয়েশ আনে। পয়দল চলনেসে তবিওতভী তন্দ্রস্ত থাকে।” গাড়ী চাপলে সে পেছনের সিটের নিচে জুতো ছেড়ে পা গুটিয়ে, গুটি সুটি মেরে বসে, আর এ সি চালু থাকলেও জানলার কাঁচ নামিয়ে দেয়।

বছর পাঁচেক আগে একবার কালীপূজোয় জ্বলন্ত উড়ন তুবড়ি পরে, পাশের কাঠগোলায় আগুন লাগে মাঝরাতে। অল্প সময়েই আগুন ছড়িয়ে পরে রাম রতন শাওএর কাঠ চেরাইকলে। খবর পেয়ে পরদিন ভোরে যখন ছেলেদের নিয়ে সে দেখতে আসে, তখন অবশ্য সব শেষ। চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি রাম রতন। অতীতে বেটারা বহুবার বলেও তাদের বাবুকে ফায়ার ইনস্যুরেন্স করাতে রাজী করাতে পারেনি। সে বলে, “ইসব মাল্কা সাহি ভাও ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে বাতানেসে ইনকাম ট্যাক্সবালকো পাত্তা চল-জায়গা। জেইসা চলতা হায় চালনে দো বেটা।” সে বার লোকসানের বহর প্রায় লাখ তিরিশে পৌছয়। সব তো আর সাদা খাতায় ওঠেনা। রাম রতন বুকে পাথর চাপিয়ে আর মুখে তুলো গুঁজে সব মেনে নেয়। বহুত পরিশানিসে কিশেনগঞ্জের খেতি জমিন বেচে কোনোভাবে বছর দুয়েক বাদে কাঠকল আবার চালু করে রাম রতন। সেবার দেওয়ালিতে সে বড় করে ধনতেরাশ পুজো করে আর মহল্লায় সবাইকে লাড্ডু বিলি করে। যতই হক, একটা চালু বেওশা ভেঙ্গে পরলে তাকে দাঁড় করানো’ত আর মুখের কথা নয়। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। সে জানে যে কাঠ ছেড়াই বেওসাতে নাফা যাদা হনেসে ভি ঝঞ্ঝট অনেক। একে’ত গুঁড়ি সরকারী অক্সানে কেনার ঝক্কি অনেক, আর দামও বেশী পরে। ধান্দা করে জঙ্গলের কাটা গুঁড়ির চোরা চালানকারিদের কাছে কালো বাজারে কিনতে পারলে তবেই দু পয়সা থাকে। এরপর আছে ভিজে গুঁড়ি আর ঘুণ খাওয়া গুঁড়ির ঝামেলা। এই বয়েসে ঝুট ঝামেলা আর ভালো লাগেনা রাম রতনের। “বেটারা এবার বেওসার হাল ধরলে ভালো হয়,” সে ভাবে।

যাহোক করে বেওশাটাকে রাম রতন মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করছিলো, কিন্তু বিধি হল বাম। বছর পরতে না পরতেই কোথা থেকে কওন এক কোরনা বিমারী এসে জুটল। বেটারা ঘর থেকে বেরুতেও দেয়না। মুখ ঢেকে রাখতে হয়। ইদানীং বেটারা কাঠকলে কি করে তা কিছুই বলেনা। খালি বলে, “বাবু তুম আভী ঘরপে আরাম করো, পচাস সাল বহুত মেহনৎ কিয়েহো।” ঘরে দুই লছমী বহুরা তো তাকে চক্ষে হারায়। মাথায় করে রাখে। তাকে মেয়ে না থাকার দুঃখ বুঝতেই দেয়না। পারলে তো তারা বাবুকে খাইয়ে দাইয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়। তার এখন শুধু একটাই দুঃখ, “বেটারা মুখ থুবড়ে পরা কাঠকলকে কি করে দাঁড় করাবে?” বহু টাকার মাল তার চোখের সামনে দাউ দাউ করে জ্বলে ছাই হয়ে গেছিলো। এদিকে লকডাউন না কি একটা অশান্তি চালু হয়েছে, সাবাইকে কাম ধান্দা ফেলে নাকি ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হবে। সে বলে, “আরে জোআন মদ্দ বেটারা সারাদিন ঘরে বসে থাকলে কি আর ঘরে শান্তি থাকে? তা ছাড়া ঘরে বসে তো আর পয়সা আসে না।” সে ভাবে, “কতদিন হয়ে গেল কেউ তার কাঠকলের খবর নিতেও যায়নি।” এদিকে ঘরের জমানো টাকাও শেষের দিকে। দিন চলা দায় হয়ে উঠেছে। তবে সে জানে সে কাঠকলে গুঁড়ির জোগাড় হোলে, নতুন করে মাল কাটা শুরু হবে। আবার খরিদ্দার আসবে। লাছমীদেবী মুখ তুলে চাইবেন। আজকাল তাই রাতে বুড়োর চোখে আর ঘুম নেই। রাতে সে জেগে জেগে একাই বক বক করে।

সেদিন শেষ রাতে বুড়ো একটা স্বপ্ন দেখল, একটা বিশাল গাছ ঝড়ে দুলে দুলে তার ঘরের ভেতর ঢুকে আসছে। ঘুম ভেঙে সে ভয়ে গোঁ গোঁ করে উঠে বসলো। বুঝতে পারলো, ভোর হয়ে গেছে, জানলার বাইরে আকাশটা বেশ মেঘলা করেছে, ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরছে আর হাল্কা ঝোড়ো হাওয়াও দিচ্ছে। ছোট নাতীটা ক্লাস সিক্সে পরে। সে জানালো, টিভির সামাচারে নাকি বলেছে যে আজ ভয়ঙ্কর তুফান আসছে। কি বেশ তার নাম, আমপান্না না কি। বুড়োর বুক দুর দুর করে উঠলো। কাঠকলের টিনের চালা না উড়ে যায়। চিন্তার তার আর শেষ নেই। আজ বুধবার। যেদিন কাঠকলে আগুন লেগে ছিল সেদিনও বুধবারই ছিল। “কি জানি, আজ নসীবে কি আছে?” এই ভেবে সে চোখ কচলে উঠে বসলো। হটাৎ তার মনে হোল, স্বপ্নে সে যম্নাকেও দেখেছে, গাছের নীচে দাড়িয়ে হাসছে। সেই আগের দেখা যম্না, মাথায় এক ঢাল চুল, মাঙ ভরা টকটকে কমলা রঙের সিন্দুর, উল্কি আঙ্কা ভরাট হাতে এক গোছা রঙ্গিন লাল কাঁচের চুড়ি আর কমলা রঙের জরিতে বোনা নতুন শাড়ী। বুড়োর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আর যাই হক, এসব কথা তো আর ছেলে-বহুদের কাছে বলা যায়না। শরম লাগে। আজ যম্না পাসে থাকলে সে হয়ত অনেকটা সামলে নিতো।

বেলা করে চায়ে নাস্তা সেরে রাম রতন জানলা দিয়ে এক দৃষ্টে উত্তাল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। বড় অসহায় লাগছে তার। সবাই ঘরেই আছে যদিও। এদিকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে তুফান আর বারীশের ঝাপটাও ভয়ঙ্কর ভাবে বাড়তে থাকল। জানলা দরজা সবই প্রায় বন্ধ। কিন্তু ঝড়ে এমন ধাক্কা মারছে যে মনে হয় যেন জানলা দরজা সব ভেঙ্গে দেবে। দুপুরে গরমাগরম খিছ্রি আলু সবজি খাওয়া শেষ করে সবাই যখন সবে একটু বসেছে, সবারই মনে হল যেন দশটা হাতি এক সাথে বাড়ীর জানলা দরজা, এমনকি দেওয়াল ধরে একসঙ্গে ধাক্কা দিচ্ছে। সারা বাড়ীটা থর থর করে কাঁপছে। পোষা টিয়া পাখীটা খাঁচায় ঝটপট করছে। নাতী দুটো তার বুকে মুখ গুজে ভয়ে কাম্পছে। রান্নাঘরে বাসন-কোসন পরার আওয়াজ পেয়ে সাবাই ছুটলো। কিছু বোঝার আগেই হটাৎ ঝপ করে বিজলীটাও চলে গেলো। বেলা মাত্র দুটো বাজে। কিন্তু চারিধার বিলকুল আঁধারে ছেয়ে গেছে। বাইরে তুফান দেখে মনে হচ্ছে বাড়িটাই বুঝি উপড়ে ফেলে দেবে। বহুরা বার বার মোমবাতি জ্বালাবার চেষ্টা করলো বটে, কিন্তু হাওয়ার দাপটে নিভে যাচ্ছে। বুড়ো উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো, কিন্তু মাথায় চক্কর খেয়ে আবার বসে পড়লো। এদিকে পায়ের নিচে ভিজে ঠেকল। বোঝা গেলো, বাইরে থেকে বাড়ীতে রাস্তার জল ঢুকছে। খাল ধারের এলাকা একটু নিচু কিনা। চারিধারে শঙ্খধনি আর মানুষের ভয়ার্ত চিৎকারে ভরে উঠেছে। বেশ গা ছম ছমে একটা ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অনেক কষ্টে একটা মোমবাতি জ্বেলে সাবাই যখন খাটে উঠে বসলো, সারা ঘরে বাসন কোসন নৌকার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। সাবার ছাড়া জুতো গুলোও জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। খালের নোংরা জলের দুর গন্ধে ঘরে টেঁকা যাচ্ছেনা। গরমে পাখা বন্ধ থাকায় আরও কষ্ট হচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে, বুড়ো হনুমান জোরে জোরে চালিশা আওড়াতে শুরু করলো।

ওদিকে ঝড়ের দাপট কমতে কমতে প্রায় রাত দশটা বাজল। বারীশ কিন্তু পুরো দমেই চলছে, মনে হয় সারা রাতই চলবে। এদিকে, টিভি বন্ধ। ফোনে নেট কনেক্সনও নেই। শহরটা মনে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টায় একশো বছর আগে ফিরে গেছে। রাতে মুড়ি বাতাসা জলে দিয়ে খেয়ে সবাই শুতে গেলে কি হয়, পাখা বিনা কি আর ঘুম আসে? বুড়োর কিন্তু একটাই চিন্তা – “এতক্ষণে নিশ্চয় কাঠকলের টিনের চাল উড়ে গেছে।” বাইরে থেকে থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসা অ্যাম্বুলেন্স বা পুলিশের গাড়ীর হুটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিজলী আসার কিন্তু কোন নামগন্ধ নেই। দু এক বার চিক চিক করে চিরতরে বিদায় নিলো। বড় বেটা ১৯১২ তে সাপ্লাইকে ফোন করার চেষ্টা করলো বটে কিন্তু ফোনের রিসিভার নামানো। বোঝাও যাচ্ছেনা কখন বিজলী আসবে। রাত প্রায় একটার পর বারীশ কিছুটা কমে এলো। সাথে সাথে কমে এল রাম রতনের চোখের ভুরুর দুশ্চিন্তার ভাঁজও। বাড়ীতে জল খল খল করলেও, সারা দিনের শরীর ও মনের ক্লান্তিতে সবাই যে যেখানে পেরেছে শুয়ে পরেছে, অকাতরে ঘুমচ্ছে। এদিকে রাম রতনের পঞ্চাশ বছরের বেওশার বুদ্ধি কিন্তু বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়াতে বেশ খুলতে শুরু করেছে। সে বিছানায় উঠে বসলো। ভাবলও বটে যে বেটাদের একবার সে ডাকে। কিন্তু না, সে ঠিক করলো কাল সকালেই সে ওদের সাথে কথা বলবে। উত্তেজনায় সারা রাত প্রায় জেগেই সে কাটিয়ে দিলো। ভাবল যে, “এবার হয়তঃ লছমী দেবী মুখ তুলে চাইলেও চাইতেও পারেন।”

পরদিন ভোর হতে না হতেই, রাম রতন বেটাদের ঘরের সামনে গিয়ে প্রচণ্ড হইচই জুড়ে দিলো। বলতে লাগলো, “আরে বেটা, তোরা কি ঘুমিয়েই জীবন কাটিয়ে দিবি? কাঠকল টা কি আমার একার?” বেটারা সবাই হন্তদন্ত হয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এলো। তারা বুঝতে পারছে না যে বাড়ীতে কি ডাকাত পড়েছে? রাম রতন বেটাদের নিয়ে সন্তর্পণে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। প্রায় ঘণ্টাভর গোপন মন্ত্রণা চলার পর যখন তারা ঘর থেকে বেরুলো, বাড়ীর সবাই চায়ের পর্ব সেরে নাস্তার চিন্তায় বেস্ত। কিছু বোঝার আগেই চা বিস্কুট খেয়ে গগন আর সাওন মুখ মাস্কে ঢেকে বাইকে চেপে ভিজে শান্ত সকালে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে কেমন একটা মায়াবী রুপালী নরম আলোয় ঢেকে গেছে। হয়তঃ প্রকৃতি দুর্যোগ চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে শান্ত হয়ে পরেছে, এই রুপালী নরম আলো তারই বহিঃপ্রকাশ।

সারা অঞ্চল জলে থৈ থৈ, চতুর্দিকে ট্রান্সফরমার, বিজলীর পোস্ট আর তার ছিঁড়ে রাস্তায় গড়াগড়ি, আশেপাশের বেশ কিছু বস্তী বাড়ীর টিনের ও খোলার চাল উড়ে গেছে; সেসব ঘিরে মানুষজন জটলা করছে, কিন্তু রাস্তা ঘাট জনমানবহীন, আকাশের মুখ ভার তবে একটা উজ্জ্বল রুপোলী আলোয়ে চারিদিক ঝলমল করছে। মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন বহুদিনের জমে থাকা ক্রোধ উগ্রে ফেলে স্বস্তির নির্মল হাসি হাসছে। সাবধানে জল ঠেলে সামান্য এগোতেই তাদের বাবুর কাকভোরে উঠে হল্লা মাচানর কারণটা দুই ভাইয়ের কাছে খুবই পরিষ্কার হয়ে গেলো। তারা এও বুঝল যে বাবুর কালা বাল বিনা কারণে সফেদ হয়নি। এবার কিন্তু মোটর সাইকেল নিয়ে আর এগোনো মুশকিল। খাল পারের সবটা রাস্তা জুড়ে বিশাল বিশাল গাছ শিকর উপড়ে মুখ থুবড়ে এক্কেবারে জমিনপে গির-পরি। একটা দুটো নয়, অসংখ্য নানান কিসিমকা পের। আনন্দে তাদের চোখ চিক চিক করে উঠলো। কোনও কষ্টে পাস কাটিয়ে তারা কাঠকলের পৌঁছে দ্যাখে টিনের চাল উড়ে না গেলেও তার একটা ধার খুলে ঝুলছে। অনেক কসরত করে তার ওপর কাঠ চাপিয়ে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে তারা যখন বাড়ী ফিরল বেলা তখন দু প্রহর। ফেরার পথে তারা বেশ কিছু চেনা জানা লোকজনের সাথে তারা কথা বলে ফিরল। রাম রতন বেটাদের পথ চেয়ে ঘরের সামনেই একটা চারপায়াতে বসে ছিল। তাদের সব কথা শুনে তারও দু চোখ চিক চিক করে উঠলো। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে ছেলেদের জড়িয়ে ধরল। ভাত ডাল আলুভাতে আর ডিমের কারি খেয়ে তারা একটু বিশ্রাম করে যখন বিকেলে ছাতে উঠল, তাদের বাবু তাদের অপেক্ষাতেই বসে ছিল। বাপ বেটারা তাদের গম্ভীর আলোচনা যখন শেষ করলো, পশ্চিম আকাশে শুকতারা জ্বল জ্বল করছে। নিচে নেমে ডাল রুটি সবজি আর ছাতুকা ভাপ টিফিন কৌটোয় ভরে দুই ভাই মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। জানিয়ে গেলো আজ রাতে ফিরবে না। কাল সকালে ফিরতে দেরি হতে পারে। কাঠ কলের ব্যাপারে কিছু বাইরের কাজ আছে। কেউ যেন চিন্তা না করে।

বাইরে বেরিয়ে তারা দেখে লছমী দেবী তাদের ওপর খুবই দায়ালু। রাস্তা খালি করতে কেউ করাত দিয়ে ভেঙে পরা গাছের গুঁড়িগুলোকে কেটে রাস্তার ধারে খালের পারে ফেলে রেখে গেছে। পরে এসে হয়তঃ নিয়ে যাবে। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে তারা কাঠকলে ঢুকে পড়লো; এরপর লকডাউন চালু হবে কিনা। রাত বারোটার পর একটা লরি কথামতো গেটের বাইরে নিঃশব্দে ভুতের মত এসে দাঁড়ালো। সঙ্গে ছ’জন জোয়ান মদ্দ কুলী। দুই ভাই তাড়াতাড়ি করাত শাবল আর রশি নিয়ে ড্রাইভারের কেবিনে উঠে পড়লো। বাকি রাতটা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা মাফিকই কাটলো। কারোর একটা অদৃশ্য মায়াবী হাতের যাদুতে যেন সব কিছু ছবির মতো ঘটে গেল।

পরেরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় রাম রতন মুখে গামছা বেঁধে কাঠকলের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। গেট খোলাই ছিল, যেমন থাকে। ভেতরে অফিসটা বন্ধ্যই রয়েছে। মনে হয় এর মধ্যে কেউ অফিসের তালাটাও খোলেনি। ভেতরে কোন জনমনিষ্যি নেই। কেমন একটা ভৌতিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। “বেটা লোগ শায়েদ আভিতক লটে নেহি। রাতভর ঘুম্রাহা হায়। মেহনৎকা কাম তো জরুর হোগা, ” এই ভেবে বুড়ো চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। শাল, সেগুন, শিশু, জাড়ুল, নীম, আম, জাম, কাঁঠাল, আরও কত কি গাছের সদ্য কাটা গুঁড়ি লাদাই করা থাকতে দেখে তার মন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, সে এখন থেকে ঘরে থেকে আরাম করতেই পারে। কারণ, তার বেটারা এখন তার বেওসার হাল ধরতে শিখে গেছে। দু হাত তুলে সংকটমোচন হনুমানজিকে সে প্রণাম জানালো। ভাবলো, “ভগবান জিসকো দেতা হ্যাঁয়, বিলকুল ছপ্পড় ফাঁড়কেই দেতা হ্যাঁয়। বেওশা মানেই মউকা।” মনটা তার নেচে উঠলো এই ভেবে যে, আবার তার সাধের কাঠকল আগের মতই রমরমিয়ে চলবে। এবারে সে পেছনের খালি জমিতে একটা ছোট্ট দোতালা বাড়ী বানাবে। নিচনে দপ্তরখানা আর উপরমে আরামখানা। মানে এক ছিলিম আফিং মেরে একটু ধুমকিতে তাকিয়া নিয়ে বসে রামভজন গাওয়ার ঠেক আর কি। গত বছর বেশ কিছু টাকা মহাজনের কাছে কর্জ হয়ে গেছে। এবার সে মিটিয়ে দেবে। আর হাঁ, দুই বহুরানীকে সে চাঁদির পাঁয়জোর আর বিছে হার গড়িয়ে দেবে। আরেকটা সুপ্ত ইচ্ছেও তার আছে, জমানার নামে কিছু টাকা দিয়ে সে বদ্দিনাথধামে একটা নাম লেখা পাথর বসাবে।

হঠাৎ একটা দাঁড়কাকের কর্কশ ডাকে রাম রতনের সম্বিত ফিরল। আরে, দুই বেটা কে তো বহুক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এরা দুই ভাই গেল কোথা। মনে পরল, “ওরা অবশ্য বলেছিল যে সকালে ফিরতে দেরী হবে। হতে পারে ওরা দুসরা কই মহল্লায় নতুন মালের খোঁজ পেয়েছে। আরে এইতো ওদের খাটার বয়েস। এত উতলা হোলে কি চলে?” নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলো রাম রতন। আরও কিছুক্ষণ এদিক সেদিক করে, বাড়ীর দিকে হাঁটা মারল সে। বাড়ী ফিরে রাম রতন দেখলো ঘরের জল নেমে গেছে, বিজলীও এসে গেছে। বহুরা বেসন মাখছে, লাড্ডু বানাবে বলে। কিন্তু না বেটারা ফিরেছে না তারা ফোন করেছে। বড় নাতিটা ফোনে অনেকবার চেষ্টা করেছে। বলছে নাকি, নেটওয়ার্ক এরিয়ার বাইরে আছে। চুড়া নারিয়েল কেলা আর লাড্ডু দিয়ে নাস্তা করতে করতে রাম রতন ভাবল মহল্লায় একবার সে পয়েদল ঘুমে বেটাদের খোঁজ খবর করবে, কিন্তু কোন দিকে যাবে তাই সে ভাবতে লাগলো। বহুরা বলল “সামতকতো দেখিয়ে বাবুজি।”

সত্যিতো, এতো বেস্ত হবার কোন কারণই নেই। আসলে যম্না চলে যাবার পর থেকে রাম রতন বেশ ভীতু হয়ে পরেছে। এদিকে বেলা গড়িয়ে বিকেল হল। বেটাদের কোন খোঁজ নেই। অনেকক্ষণ বসে বসে রাম রতনের সন্ধ্যের দিকে চোখটা একটু পরে এসেছে। একটু বাদেই লকডাউন চালু হবে। রাস্তা ঘাট বেশ ফাঁকা। চতুর্দিকে কেমন একটা মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা। হটাত একটা বুলেট মোটর সাইকেলের আওয়াজে ধড়ফড় করে উঠে বসলো রাম রতন। সে ভুল শোনেনি। বাড়ীর নিচেই এসে থামল বাইকটা। এক লাফে খাট থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে দেখল সে। নাঃ, কেউ কোত্থাও নেই। যতদূর চোখ যায় কথাও কোন বাইকের দেখা নেই। তবে কি ভুল শুনল সে। হতাশ হয়ে ফিরে এসে সে আবার শুয়ে পরল।

রাত কটা? জানেনা রাম রতন। মাথায় একটা মায়া মাখানো কোমল হাতের স্পর্শে আর কাঁচের চুড়ির ঠুং ঠ্যাং শব্দে তার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে দেখে যে বড়িবহু তাকে খেতে ডাকছে। খাওয়ার ইচ্ছে তার মোটেই নেই। এদিকে পিছু পিছু ছোটিও এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনেরই চোখের চাহুনিতে অসহায় জিজ্ঞাসা ভরা। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর অবশ্য রাম রতনেরও জানা নেই। তার গলাটা কান্নায় ধরে এসেছে। গলার মধ্যে একটা ডেলা পাকছে। নিজেকে বড় অসহায় বোধ হচ্ছে। হটাত সে স্থির হয়ে কি যেন ভাবতে লাগলো, মনে হয় সে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। হাঁ, সে ঠিকই শুনেছে। একটা বুলেট বাইকের শব্দ বাড়ীর দিকে এগিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে বাড়ীর সামনে এসে থামল। এবার কোন ভুল নেই। রাম রতন এক লাফে খাট থেকে নেমে, এক ছুটে বারান্দায় গিয়ে মাথা ঝুলিয়ে দাঁড়াল। তার কৌতূহলী চোখ দুটো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারিদিক দেখতে দেখতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরলো। সেখানে দাঁড়িয়ে আরও দু জোড়া ভয়ার্ত ভাবলেশহীন চোখ। এবার রাম রতন আর পারলো না। বহুদের হাত ধরে হাউ হাউ করে সে কান্নায় ভেঙে পরল। আশ্চর্যের বিশয় যে বহুদের চোখে কিন্তু জল নেই। জমে থাকা ক্রোধানল তাদের চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। কিছুতেই তারা এই পরিস্থিতিকে ক্ষমা করতে পারছে না। রাম রতন বলল আজকের রাতটা দেখে কাল ভোরেই সে পুলিশ থানায় যাবে। বহুরা যে যার ঘরে ফিরে গেলো। বাকি রাতটা রাম রতন ভেবে ছিল জেগেই কাটিয়ে দেবে। সে জানেনা কখন ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। স্বপ্নে সে দেখল যে বেটারা বাড়ী ফিরেছে। বহুরা তাদের লাড্ডু খিলাচ্ছে। বাড়ীর সামনে দাঁড়ানো খোলা ট্রাকে লাদাই করা সদ্য কাটা গাছের গুঁড়ি লোহার চেন দিয়ে বাঁধা।

হটাত আবার তার কানে গেলো বুলেট বাইক থামার আওয়াজ। ধরমরিয়ে উঠে বসলো রাম রতন। চোখ কচলে বুঝল যে বেশ বেলা হয়েছে। বাইরে উজ্জ্বল সকাল। কিন্তু নিচে কাদের যেন অচেনা গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তবেকি বেটারা ফিরল? লাফিয়ে নামলো রাম রতন। গায়ে ফতুয়াটা লাগিয়ে হন হন করে নিচে নেমে এলো। দু’জন অচেনা মানুষ খাবার ঘরে চেয়ার টেনে বসে পরেছে। তাদের ঘিরে বহুরা বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। তাকে দেখে সেই দু’জন তাদের পরিচয় দিয়ে জানালো যে তারা পুলিস থানা থেকে এসেছে। গত রাতে কাটা গাছ সরাতে গিয়ে ইজারাদারের লোকেরা দেখেছে দুটি মৃতদেহ ভাঙা গুঁড়ির নিচে চাপা পরে রয়েছে। তাদের সঙ্গে করাত শাবল আর রশিও পাওয়া গেছে। পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখে তারা বাড়ীর ঠিকানা খুঁজে বার করেছে। এখন কেউ গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করলে তারা ময়নাতদন্তে পাঠাবে।

চেয়ার ছেড়ে রাম রতন ধীরে ধীরে দেওয়াল ধরে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো। তার অসহায় স্থির দৃষ্টি তখন দেওয়ালে টাঙানো যম্না দেবীর ফ্রেমে বাঁধানো ছবির ওপর। কিছু বোঝার আগেই তার পা দুটো থর থর করে কাঁপতে লাগলো। মেঝেতে পরে যাবার পূর্ব মুহূর্তে দুই বহু এসে তাকে বসানোর চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হল না। সংজ্ঞা হারানোর আশঙ্কায় দুই পুলিস অফিসার ঝটপট তাকে তাদের বাইরে রাখা বুলেট বাইকে তুলে, তাদের দুজনের মাঝে বসিয়ে ছুটল হাসপাতালে।

এমারজেন্সি ওয়ার্ডের বেডে যখন রাম রতনকে শোয়ানো হোল, সে ততক্ষণে তার প্রিয় কাঠ কলের তালা বন্ধ অফিসে, গগন সায়নের পাসে বসে, বাইরে লাদাই করা, কাল রাতে সদ্য কাটা আর ঝড়ে ভেঙে পরা গাছের গুঁড়ির হিসেব নিচ্ছে। হাঁসতে হাঁসতে বেটাদের সে বলছে, “ইসবার দেওালিমে সবকো যাদাই লাড্ডু বাঁটনে পারেগা বেটা, শুভ লাভ হোগা। মাগার ইনসিওরেন্স কোম্পানিকো মাত বাতানা বেটা, মুঝে ফায়ার ইনসিওরেন্স নেহি চাহিয়ে। বেমতলব ইঙ্কম ট্যাক্স বালোকো সব কুছ পাতা চাল যায়গা।”

কথা শেষ না হতেই রাম রতন খেয়াল করলো যে বেটারা ঘরে নেই, সে একা। অবাক হয়ে হয়ে সে ভাবল যে দরজা তো বন্ধ, কিন্তু ওরা বেরোল কি করে? ভাবতে ভাবতে সে বুঝতে পারেনি কখন সেও তালাবন্ধ দরজা ভেদ করে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। বাইরে এসে সে দেখে পুলিশের ভ্যান, খোলা ট্রাক, ক্রেন, লোক লস্করে মাঠ ভরে গেছে। একজন পুলিশ অফিসার বলছে, “উঠাও সব চোরিকা মাল, সব শালা চোরনে মরচুকা হায়, নেহিতো সবকইকো পাকারকে লে যাতা।” রাম রতন একটু সরে অফিসের পেছনে লুকবার চেষ্টা করতে গিয়ে পুলিশ অফিসারকে মৃদু ধাক্কা মেরে ফেললো। ভাবল আর বাঁচার উপায় নেই। কিন্তু নাঃ, অফিসার কিছু বুঝতে পারলো বলে মনে হলনা।

উপায়ন্তর না দেখে, রা্ম রতন বাড়ীর উদ্দেশে রওনা দিলো। ভাবল, “এতক্ষণে বহুরা শায়েদ লাড্ডু বানানা চালু কর দিয়া। ইসবার সবকো লাড্ডু বাটনে পারেগা। জয় হানুমানজী কি।” ভাবার আগে পৌঁছেও গেলো মুহূর্তের মধ্যে। বাড়ীর সামনে এসে রাম রতন অবাক হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো না বাড়ীর সামনে এত ভিড় কিসের? ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখে যে একটা লরিতে ফুলের মালা গলায় দিয়ে শুয়ে আছে তারই দুই বেটা আর মাঝখানে সে নিজে। লরির পাসে রাখা ছোটা বেটার বুলেট বাইক আর রাস্তার অপারে বড় বেটার লাল রঙের বলেরো। সে ভাবল, “বহুরা কান্নাকাটি করছে ঠিকই কিন্তু এই কাঠ কল তো এবার ওরাই চালাবে।” একটু মুচকি হাঁসলো রাম রতন। সে নিশ্চিন্ত হ’ল আরও এই ভেবে যে সে তো মদ্ধিখানে রইলই। আর বেটারা দুজনে তার দুপাশেই শুয়ে আছে। লরি ধীরে ধীরে ভীর ঠেলে আর কান্নার রোল ফেলে এগিয়ে চলল। সে ভাবল, “এবার তার যম্নার কাছে যাওয়া আর কেউ আটকাতে পারবে না।”

শরীর মন দুটোই বেশ হাল্কা লাগছে রাম রতনের। আফিঙের আর দরকার পরবে না।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post অদৃশ্য শক্তি | ভয়ের দেশ |এস এম ফাহিম| Bengali Horror Story
Next post জমিদার বাড়ির সুন্দরী ভূত | ভয়ের দেশ |রাকিবুল হাসান| Bengali Horror Story