মায়া | ভয়ের দেশ |মুনিরা কায়সান| Bengali Horror Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

এবারও কিছু anti depressant প্রেসক্রাইব করলেন ডা.জোন্স। ভদ্রলোক হাসিখুশি, মাথায় টাক। একগুচ্ছ চুল মাথার পেছনে বেঁচেবর্তে আছে। তিনি রোগীর সব কথা খুব মন দিয়ে শোনেন এবং ভাব দেখান রুগীর পছন্দমত ওষুধ লিখছেন। আসলে তার ভাবনাটাই আসল। সব ডাক্তার তাই করেন তবে তিনি অভিনয়টা ভাল করেন এটাই তফাত। আর ব্রাজিলিয়ান কফির কথা বলে সব রুগীকেই এক কাপ ইন্সট্যান্ট কফি খাওয়াতে ভুলে যান না। মানসিক রুগীদের সবাই নির্বোধ ভাবে যখন তখন ডা. জোন্সকেই কেন শুধু দোষ দেয়া।

শাহেদ আজ প্রায় একবছর তার পেশেন্ট। রুগীর হিস্ট্রি অনেক খুঁটিয়ে তার কাছ থেকে আদায় করেন জোন্স তাই এই ভাবনা হওয়া স্বাভাবিক তিনি সব সমস্যার ওষুধ দেবেন। তবে তিনি শাহেদকে প্রতিবার নানাভাবে কাউন্সেলিং করে বাড়ি পাঠান আর সাথে থাকে প্রায় একধরনের প্রেসক্রিপশন। এবার ও তার ব্যতিক্রম হল না।

“তারমানে তুমি বলছ সে এখনো তোমার কোন ক্ষতি করেনি কিংবা তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি??” চশমার গোল কাঁচে তার গোল মুখ খুব অদ্ভুত লাগে শাহেদের।

“ড. আমি বহুবার এই কথাটা বলেছি আপনাকে আর এখন আমি বিরক্ত এই উত্তর দিতে দিতে। না করে নি। সে শুধুই আয়নায় দেখা দেয়। সেই ভীষণ বিষণ্ণ চেহারা। রুগ্ন শরীর। ফ্যাঁকাসে ঠোঁটে রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। চুল গুলো মৃত মানুষের মত প্রাণহীন আর হাতের নখ মরে গেছে। তাকে দেখামাত্র ঘরটা কবরের মত শীতল হয়ে যায়। আর সে শুধু আমার ঘরের আয়নায় দেখা দেয় তা নয় সব খানে যেখানে যত প্রতিবিম্ব তৈরি হওয়া সম্ভব, এমন কি রাস্তায় পড়ে থাকা বৃষ্টির পুরনো জল ও বাদ যায়না৷ আর যখনি দেখি তাকে, আমার হিমশীতল অনুভূতি হয় যেন আমি মরে যাচ্ছি। তার চোখ!! উফ! আমি বোঝাতে পারবনা কতটা করুণ সে চাহনি। আর নতুন কি জানার আছে ডক্টর? আমি সত্যি দিন দিন ধৈর্য হারাচ্ছি। মরে যেতে ইচ্ছে হয়।”

জোন্সের আগ্রহ কিন্তু মরে গেলনা। সে আগের চেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে প্রশ্ন করতে থাকল।

“তোমার বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্রই এমন দেখলে, তাইতো??”

শাহেদ হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।

“কোনদিন একটা কথাও বলেনি, কোন দিন তোমার ক্ষতি করার চেষ্টাও করেনি। তুমি বলছিলে সেই আত্মাটি পুরুষ আর বয়স ষাটের ঘরে। তোমাদের জাতীয়তা মানে বাঙালি আর কি। এই পর্যন্ত ঠিক তো??”

শাহেদ এবারো শুধু মাথা নেড়েই জবাব দিল। জোন্স কথা বলে বলে মাথার পোকা নড়িয়ে দেয়।

“তোমার কখনো সন্দেহ হয়নি তো যে সে intersex হতে পারে??” রসিকতার সুর জোন্সের কথায়।

ভীষণ বিরক্তি চেপে গুড ইভনিং বলে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল শাহেদ।

বলা হয় বাংলাদেশের সব খারাপ কিন্তু নিউইয়র্কের মত জায়গাতেও আজেবাজে লোক ভরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেও। শাহেদের তাই মনে হয় মাঝে মাঝে। তবে নিরপেক্ষভাবে ভাবতে গেলে জোন্স তার রুগীর দুশ্চিন্তার বোঝা হালকা করতেই এসব কথা বলেন প্রায়ই। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট তাই করবেন। তবে তাতে শাহেদের বিরক্তিই বাড়ে শুধু। জোন্স সমকামী একথা জানার পর থেকে নিরপেক্ষ ভাবনাটা আর আসছেই না। নাহ এখনো দেশের মাটিটা ঝাড়তে পারেনি শাহেদ।

(২)

জোর বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সামনের রাস্তাটা। জানালার শার্সিতে বৃষ্টি জলরঙ ছবি আঁকতে ব্যস্ত। শাহেদ একদৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আর শুনছে বৃষ্টির শব্দ। আলো জ্বালছে না সে, কারণ সেই মৃত চেহারা বারবার সে দেখতে চায়না। জানে সে আছে। সবসময় আছে। তবু না দেখাতেই স্বস্তি। প্রথমবারের কথাটা এখনো মনে আছে দুঃস্বপ্নের মত।

বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিল সে শেষরাতে। সেটা বছর খানেক আগের কথা। মনে হয়েছিল মাথার উপর থেকে ছায়াটা হঠাৎ নেই। প্রায় বিশ বছর দেশের বাইরে তবু এমন কোনদিন মনে হয়নি। কেমন জড় পদার্থের মত শরীর টেনে বেসিনের সামনে গেল। নিজের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখল সে, তবে সেটা ছিল তার পিছে থাকা ভয়ানক বিষণ্ণ মূর্তিকে দেখে। ছিটকে এসেছিল সে। প্রচণ্ড আতঙ্কে প্রায় জমে গেছিল। কাঁপা হাতে এলাকে ফোন দিয়েছিল। এলা তার দীর্ঘদিনের বান্ধবী, উইকএন্ড কাটাতে গেছিল সে। জড়ানো কণ্ঠে ফোন ধরে বসেছিল এলা হতবুদ্ধির মত। আর ফিরে এসেছিল ভোর মেলাবার পরপর প্রায় দশ কিলো রাস্তা ড্রাইভ করে। এলোমেলো এলা ভোরের সূর্যের মত তার রাতের কুয়াশার স্মৃতি যেন মুছে দিতে চাইল ভালবেসে। স্বস্তিটা ক্ষণিকের ছিল। বেডরুমে যাবার পথে করিডোরের আয়নায় চোখ পড়তেই সেই দুঃস্বপ্ন জেগে উঠল আবার। তার চিৎকারে এলা ছুটে এসেছিল। শাহেদ এরপর থেকে প্রতিটা আয়নায় শুধু নিজেকে একলা করে চেয়েছে, আর পায়নি কোনদিন। কতদিন কত রাত এলা আর শাহেদ নিজেদের ভবিষ্যৎ ভেবেছে আয়নায় তাকিয়ে, এলার পিঙল চুলে মুখ ডুবিয়ে আয়নায় এলার বোজা চোখ দেখতে শাহেদ হিমালয় দেখার অনুভূতি পেত। এখন সব আয়না পর্দা ঢাকা।

এলা আছে। সব জুড়ে আছে। তবে দুঃস্বপ্নের সাথে লড়াই করে ক্লান্ত শাহেদ আগের মত নেই। সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল মানুষ কেমন সকালের শিউলি ফুলের মত মরে গেছে।

(৩)

ঘরটা বিশাল। বাঙালি জমিদাররা শুধু খাবার ব্যাপারে শৌখিন এটাই জানত সদানন্দ। তারা শিল্পের সমঝদার হবে এটা যেন কল্পনাতীত ব্যাপার। ঘরের বিশালত্ব আর আভিজাত্য দেখে আরও গুটিয়ে গেছে কৃশকায় সাদামাটা সদানন্দ।

রূপোর হুকোদানি সাজাচ্ছে পেয়াদা। ভারিক্কি শরীর তার। ভ্রুক্ষেপ ও করছেনা সে। নিজমনে কাজ করে যাচ্ছে।

মাথার উপরে বিশাল পাখা টানা হচ্ছে। দখিনের বাতাসে ঘরটা এমনিতেই ঠাণ্ডা হয়ে আছে। ঘুমে জড়িয়ে আসছে সদানন্দের চোখ।

সামনের কাঠের টেবিলটায় রাখা ঘরে বানানো সন্দেশ, কাঁচা আমের শরবত। রাত থেকে বদহজম হচ্ছে তার। রুচি নেই তবু সন্দেশটা দেখে খিদে জেগে উঠছে। মুখে তুলতে যাবে ঠিক এমন সময়েই ঘরে ঢুকলেন মুসলেম উদ্দিন চৌধুরী। সন্দেশটা মুখে দেয়া হলনা।

ঠাণ্ডা রুমটা অগত্যা গরম বোধ হতে লাগল সদানন্দের। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিল সে। মুসলেম উদ্দিন প্রজা-দরদী জমিদার কিন্তু তার চেহারার আভিজাত্য অন্যের মধ্যে সমীহ ভাব জাগায়।

“খাও, সন্দেশটা খাও মিয়া।”মুসলেম উদ্দিনের গুরুগম্ভীর স্বর।

সে মাথা নিচু করে খাচ্ছে।

“তুমি জোড়পুকুরের সাথের দালানে থাকবা। পাশেই রূপসী নদী। ওখানে বজরা সাজানো থাকে। চাইলে যখন খুশি ঘুরবা। শুধু কাজটা সুন্দর চাই। ছবির মাপ কেমন হইব জানো??,” হুক্কায় টান দিচ্ছিল চৌধুরী সাহেব।

“জ্বি। সামনের হলঘরে টানানো হইব।,” মিনমিনে স্বরে উত্তর তার।

“কি সব ফুল পাতা দিয়া নাকি রঙ বানাও। বাগানে সব পাইবা। আর যা লাগে হাসেম তো আছেই। ওরে বলবা। ও সব ব্যবস্থা কইরা দিব,” বলে চৌধুরী সাহেব হলঘরের দিকে চলে গেলেন। সদানন্দের মত নিচু জাতের সামান্য আঁকিয়ের জন্যে এটা অনেক বড় পাওনা।

(৪)

মুসলেম উদ্দিন এত অবাক এই জীবনে হননি। এমন অবাক আরও একবার হয়েছিলেন অবশ্য। বিয়ের রাতে স্ত্রীকে দেখে। এত রূপ কোন নারীর হতে পারে তা তার ধারণাতেই ছিলনা। তার একমাত্র কন্যা মেহের অবিকল তার মায়ের মত।

সদানন্দের আঁকা বিশাল জলরঙ ছবিটা হলঘরে টানানো হয়েছে। বিকেলের শেষ আলো ভারী পর্দার ফাঁক গলে হলঘরের দেয়ালে পড়ছে…. আর দেয়ালে সদানন্দের জলরঙের ছবিটাতেও যেন এক চিলতে বিকেল নামল। জোড়পুকুরের এক কোণে কড়ই গাছের বিশাল ডাল নেমে পুকুরের এ পাড় আগলে আছে। তাতে পা ডুবিয়ে বসে আছে এক নারী। নারীর ঘন চুলে কাঁঠালচাঁপা। তার মুখে পড়ছে বিকেলের আলো। কি অদ্ভুত ছবি। এই ছবির সামনে দাঁড়ালে যেন কাঁঠালচাঁপার গন্ধ লাগে নাকে। অদ্ভুত অনুভূতি হয়। নারীর মুখটা মেহেরের। মুসলেম চৌধুরী কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন…। সদানন্দ মুহূর্তের জন্যে নিজেকে স্রষ্টার জায়গায় বসিয়ে দেখছিল নিজের সৃষ্টিকে। এত সুন্দর নারী তো তার সৃষ্টি।

সদানন্দ ফিরছিল তার বাড়িতে। আকাশে আজ ভরা পূর্ণিমা। তার চামড়ার থলিতে চৌধুরী সাহেবের দেয়া পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া মহামূল্যবান উপঢৌকন। রূপসী নদীর সাথে জোছনার ভাব খুব। এক জোছনায় ছবির নারী বাস্তব হয়ে এসেছিল তার কাছে। তার কাজল টানা চোখে ছিল পরম কৌতূহল। কিন্তু সদানন্দের ঘোর লেগে গেছিল..। সে ভেবেছিল স্বর্গের ইন্দ্রাণী। এটা তার কাছে স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন থেকে বেরুতে চায়নি।

সে রাতে রূপসী নদীতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সাঁতার জানা সদানন্দ কেন পানিতে ডুবে গেল আর কেন তার লাশ কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তা কেউ জানেনা। এই খবর সোনাপুরের নিস্তরঙ্গ জীবনে ঢেউয়ের মত ছিল। তবে সেই ঢেউ শান্ত হয়ে গেল মাস খানেকের মধ্যেই। জমিদারের বাড়িতে অবশ্য সে ঢেউ প্রলয় নিয়ে এসেছিল। শেষ বিকেলের অষ্টাদশী হারিয়ে গেল বিষ সেবনে।

তখন সূর্য তার আলো নিয়ে খেলছিল হলঘরে টাঙানো নারীমূর্তির সাথে।

(৫)

“শাহেদ, তুমি জোন্সের appointment টা মিস করলে কেন?” এলার কণ্ঠে ভীষণ মায়া।

“ভাল লাগেনা ওই লোকটাকে। ওর থেরাপিতে আমার কোন লাভ হচ্ছে বলে মনে হয়না,” হতাশা গোপন থাকছে না শাহেদের কণ্ঠে।

“আমি গিয়েছিলাম জোন্সের ওখানে। তুমি না যাওয়ায় ফোন করল। তার একটা কথা ভাল লেগেছে আমার। বলছিলেন schizophrenic দের genetic influence থাকে। তোমাদের ফ্যামিলিতে কারো এসব ছিল? জানো কিছু?”

“সেভাবে ভেবে দেখিনি তো। আমার দাদাকে তো চোখে দেখিনি। তিনি মারা যাবার পর আমার জন্ম। তবে তার ব্যাপারে শুনেছি দিব্যি ভাল মানুষ ছিলেন। শেষ বয়সে তার কি হয়েছিল জানিনা। দরজা আটকে ঘরে বসে থাকতেন। কথা বলতেন না কারো সঙ্গে। একদিন ছাদে উঠলেন। তারপর ছাদ থেকে পড়ে মারা গেলেন। সবাই বলাবলি করে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল কারণ তার মত ব্যক্তিত্বের সাথে আত্মহত্যা ব্যাপারটা ঠিক যায়না। কোন এক অদ্ভুত কারণে দাদা চাইতেন না বাবা বিয়ে করুক। মার কাছে শোনা। সেসময় খুব কম বয়সে বিয়ে দেয়ার নিয়ম থাকলেও বাবার বিয়ে হয়েছিল অনেক দেরিতে। দাদার মৃত্যুর পর। আমার দুঃসম্পর্কের এক দাদী বিয়ে করিয়েছিলেন বংশরক্ষার জন্যে। আমার জন্মের পর থেকে তাকে দেখতাম তিনিও দাদার মত বদ্ধ ঘরে বাস করতেন। লোকজন পছন্দ করতেন না। শুধু আমিই বাবার ঘরে যাবার অনুমতি পেতাম। বাবা আমায় কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন। তারপর আমেরিকা চলে এলাম পড়তে। আগে যাওয়া হত। এখন আর যাইনা। বাবা মেনে নিতে পারেন নি তোমার সাথে সম্পর্কের ব্যাপারটা।”

শাহেদ থেমে সামনের কফি কাপটা হাতে নিল।

“তোমার বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল?” এলা প্রশ্ন করল।

“না। পাগল হয়ে গেছিলেন শেষের দিকে। বদ্ধ উন্মাদ। গায়ে কিছু রাখতেন না। দরজা নক করলে তেড়ে আসতেন। কিছুই খেতে চাইতেন না। শেষে নাকে নল দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছিল। সার্বক্ষণিক লোক রাখা হয়েছিল তাকে দেখার। তারপর একদিন মাঝরাতে সুযোগ বুঝে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। তার লাশ রূপসী নদীতে পাওয়া গেছিল। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেছে এই নদী। হাশেম কাকা জানিয়েছিল সব ফোন করে।”

এলা শুনছিল কেবল।”কোনদিন তো এসব বল নি।”

“আসলে তোমার ব্যাপারটা মেনে না নেয়ায় ও বাড়ির সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিলাম মনে মনে। খোঁজ রাখতাম না।”

“তাহলে জোন্সের ধারণা অমূলক নয়। genetic influence থাকতে পারে। তবে নেক্সট উইকের appointment মিস করবেনা বলে দিলাম।”

এলা রান্নাঘরে চলে গেল।

(৬)

প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ঘুম ভাঙল শাহেদের। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। এলা জেগে গেছে।

“এলা আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, ”শাহেদ ভয়ে তোতলাচ্ছে।

এলা কিছু বলছিল না। সে চুপ করেছিল। আর শাহেদকে জড়িয়ে ধরেছিল..

“আমি সেই ঘরটায় বসেছিলাম। চারপাশ অন্ধকার। বাবার কোলে বসে আছি। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। দেয়াল জোড়া আয়নায় সেই ভয়ানক মূর্তি। আমি চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বেরুলাম। এলা জান? আমার এখন মনে পড়ল বাবার সেই ঘরেও কোন আয়না ছিলনা। দাদা বেঁচে থাকতেও সেই ঘরে থাকতেন। তবে কি তারাও আমার মত সেই লোকটিকে দেখতেন?”

এলা জবাব দিতে পারল না। সে শাহেদকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। বাইরে ভোর হচ্ছে, আঁধার কেটে যাচ্ছে। এলা বিশ্বাস করে এই আঁধারটাও ঠিক কেটে যাবে।

(৭)

রূপসা নদীতে সাহাবউদ্দিন চৌধুরীর লাশ পাওয়া গেছে। হাশেম অবশ্য খুশি হয়েছে। বেঁচে থেকে নরক যন্ত্রণা পাবার চেয়ে মরে গিয়ে ভাল হয়েছে। অনেক দিন আগে রূপসায় আরও একজন এমন মরে গেছিল। সদানন্দ ছেলেটার মুখ বুড়ো হাশেম এখনো ভুলতে পারেনা। এত মায়া। ছেলেটাও মরে গেছিল শান্ত নদীতে। সেদিন অনেক রাত অবধি ঘুমোতে পারেনি হাশেম। তার এই হাতে অনেক পাপ কাজ হয়েছে কিন্তু এই নিষ্পাপ ছেলের মায়া কাটাতে পারেনি সে। জীবন্ত মানুষের চেয়েও হাত পা বেঁধে মেরে ফেলা মানুষের জন্যে কেমন মায়া হয়। এত মায়া কেন দুনিয়ায়- ভেবে অবাক হয় হাশেম। তার হাতের বিড়ি শেষ ততক্ষণে। কাঁঠাল গাছের আধো ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে সে। তার মায়া হয় বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকা শাহেদ এর জন্যে। নিজের কোলে পিঠে মানুষ করা ছেলেটা আজ ভোর থেকেই আর ঘুমোতে পারবেনা। যেমন পারেনি ছোটসাহেব তার বাবা মুসলেম চৌধুরীর মৃত্যুর পর থেকে। খুব স্পষ্ট মনে আছে তার সেই দিনটার কথা।

মুসলেম উদ্দিন চৌধুরীর মৃতদেহ ঘিরে ভিড় জমার আগেই তা সরিয়ে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছিল হাসেম। ভোর হবার আগেই দাফনের কাজ শেষ হয়ে গেল। ছোটসাহেব খবর পেয়েই এসে গেলেন। গ্রামে অনেক কথা ছড়িয়ে গেল। কেউ অভিশাপের কথাও বলল। কেউ বলল আত্মহত্যা। কেউ বলল খুন। তবে হাশেম জানত উত্তরটা। যেমন সে জানে কেন বড় সাহেব আর ছোট সাহেব আয়না দেখতেন না।

এখন তার মায়া হচ্ছে। অনেক বছর আগে বিধর্মী ছেলের জন্যে যে মায়া হয়েছিল তার সে মায়াটা আবার জন্ম নিচ্ছে এ বাড়ির একমাত্র জীবিত বংশধরের জন্যে। এই বংশ কি তবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? কিংবা বেঁচে থাকতে হবে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে?? হাশেম আর ভাবতে পারল না।

(৮)

“এখন কেমন লাগছে জনাব শাহেদ?”

শাহেদ ক্লান্ত চোখ টেনে খুলল। চারপাশে হালকা নীল রঙের আভা তার কারণ দরজা, জানালা এমনকি জানালার পর্দাতেও নীল রঙের ছাপ।

কথা বলছিলেন ডা. সিমন প্যাট্রিক। ভীষণ সুদর্শন মানুষ। শাহেদ উঠে বসল।

“তোমাকে আজ আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হচ্ছে। তবে আমি বেশ খারাপ লোক। রুগীকে সহজ ভঙ্গিতে দুঃসংবাদ দেয়ার ক্ষেত্রে আমার সুনাম আছে। দুর্নাম ও বলতে পার। আমি চাই আমার রুগী মিথ্যে আশা নিয়ে দুদিন বেশি না বেঁচে খারাপ সময়ের মুখোমুখি হোক এবং বেঁচে থাকুক জয়ী হয়ে।”প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস সিমন এর কণ্ঠে।

শাহেদ বেশ ঘাবড়ে গেল।

“শাহেদ তুমি আর তোমার বান্ধবী যে গাড়িটায় ফিরছিলে সেটার ছবি দেখাচ্ছি।”

শাহেদের সব মনে পড়ল এখন। তারা দু’জন ফিরছিল টেক্সাস থেকে। তাদের শখের গাড়িটা accident করল মাঝ রাস্তায়। সে আর এলা ছিটকে গেছিল। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার।

সিমন একটা দোমড়ানো গাড়ির ছবি দেখাল। এটা তাদের টেসলা। নীল টেসলা।

“আগেই বলি তোমার বান্ধবী ভাল আছে। তার মাথায় একটু চোট লেগেছে। মাথার ভেতরে কোন রক্তক্ষরণ হয়নি। তাকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। কিন্তু গাড়িটা দেখ। তোমাদের বাঁচার কথা ছিল না।”সিমন থামলো।

“আপনি এত ভূমিকা না করে আসল কথাটা বলুন ডক্টর, ”শাহেদ অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

“তোমার স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি হয়েছে। আর তার কারণে আমরা ধারণা করছি তোমার ইনফার্টিলিটি ডেভেলপ করবে, ”খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল সিমন।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেল শাহেদ। তবে তারচেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পাবে এলা।

“আসলে আমি ধারণা করে মিথ্যে আশা দিতে পারছিনা। তবে মিরাকল হতেই পারে। আইভিএফ খুব ভাল অপশন হতে পারে”

সিমন চলে গেল। নীলাভ ঘরটায় এক সমুদ্র শূন্যতা নিয়ে বসে রইল শাহেদ।

পাশ ফিরে জানালায় চোখ পড়তেই সে চমকে উঠল। সেই ছায়ামূর্তিটা নেই…

(৯)

এলা আর শাহেদ বসেছিল নীল হ্রদটার পাশে। এলোমেলো বাতাস উড়িয়ে নিতে চাচ্ছিল যেন তাদের দু’জনকে। মাঝে বেশ কটা বছর পেরিয়ে গেছে।

তবে খুব অদ্ভুতভাবে যেদিন থেকে শুনেছিল সে ইনফার্টাইল হয়ে যাবে সে মুহূর্ত থেকে আর দেখা দেয়নি ছায়ামূর্তি। শাহেদ ধরে নিয়েছে তার ইনফার্টিলিটির সাথে এটার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। যার বংশরক্ষার উপায় নেই তার হয়ত মুক্তি ঘটে এই মানসিক অত্যাচার থেকে। শাহেদ এখন ভাল আছে। অনেক বেশি ভাল। তবে এলা বাচ্চার জন্যে অনেক বেশি অস্থির। তার অস্থিরতা মাঝে মাঝে স্পর্শ করে শাহেদকে।

“জান এলা?? আমি তখন খুব ছোট। আমাদের বাড়ির হলঘরে অসম্ভব সুন্দর একটা পেইন্টিং আছে। এটা দাদার সময়ে এক হিন্দু চিত্রকরের আঁকা। কি যে অদ্ভুত সুন্দর তুমি ভাবতেও পারবেনা। এক পরমা সুন্দরী নারী পা ডুবিয়ে বসে আছে দীঘির জলে। তার এলোচুল ছড়ানো। মুখে পড়ছে শেষ বিকেলের আলো। সেই নারী আমার একমাত্র ফুপু মেহের।

“বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বলেছিলে।” এলা বলল।” কেন মারা গেলেন, জান কিছু?”

“না। দাদা এ নিয়ে কোন কথাই বলতেন না। গ্রামে অনেকেই এসব নিয়ে কানাঘুষো করত।”

“হঠাৎ এসব কথা কেন শাহেদ?”

“যতবার আমি খেলতে খেলতে থমকে যেতাম পেইন্টিংটার সামনে, কাঁঠালচাঁপার গন্ধ পেতাম কেন জানিনা। আজ পাচ্ছি হঠাৎ। এতদিন পর তাই এত কথা মনে পড়ে গেল। সব ভ্রম অবশ্যই। নিউইয়র্কে কাঁঠালচাঁপা আসবে কোথা থেকে। তবে কি জান এলা, কোন দিন খেয়াল করিনি বা তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি, আমি সেই খারাপ সময়টায় কাঁঠালচাঁপার গন্ধ পেতাম সবসময়। এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম, আলাদা করে মনে পড়ত না।”

“যা ভাবছ তাই হয়ত। সব তোমার মনের ভুলই হবে।”

তবে এলা আজ অনেক বেশি খুশি। এটা শাহেদের জন্যে তার সারপ্রাইজ। সে এক্ষুণি জানাবে তাকে খবরটা। এলার ডক্টর জানিয়েছেন IVF করা যাবে। আগে শাহেদের একটা ঝামেলা ছিল। এখন আর নেই। অবশ্যই সে আশা রাখতে পারে।

ঠিক সে মুহূর্তে হ্রদের জলে যেখানে শাহেদের ছায়া পড়ছিল তার পিছে জেগে উঠছিল অনেক দিনের পুরনো ছায়ামূর্তি। আগের মতই বিষণ্ণ যার দৃষ্টি।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মাথাবিহীন লাশ | ভয়ের দেশ |মোঃ নাফিস উল্লাহ| Bengali Horror Story
Next post মারিয়মের গল্পটা | ভয়ের দেশ |ভাস্কর মণ্ডল| Bengali Horror Story