সেদিন সকালে মধু’র সাথে কথা হচ্ছিল। আমার কলেজতুতো বন্ধু। ওই যা হয়, এলোমেলো একগুচ্ছ বকুনি, তারপর এ কথা সে কথার পর আসল কথাটা পাড়লাম।
-হ্যাঁ শোন যে জন্য ফোন করা।
-তাইতো বলি, কবি তো এমনি এমনি আমায়, কল করবে না!
-ওহ! শোন না।
-নে বল।
-হুম, তোর জানা শোনা কোনও ভুতুড়ে প্লেস আছে?
-হি হি হি হি হি, কোনও প্লানচেট করবি?
-না রে, গল্প লিখবো।
-গাঁজা জানিস?
-মানে?
-না বলছি, গাঁজাটা ধর, এমনিই অনেক প্লট পেয়ে যাবি।
-ওহ, একটুও যদি সিরিয়াস হোস!
-হলাম, বল।
-শোন না, কলেজে থাকতে একদিন সব প্যারানরমাল সব গল্প হচ্ছিল। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।
-এস ডি ‘র ক্লাস টা হলো না, স্যার কোথাও আটকে গেছিলেন, সব মনে আছে, বল…।
-তুই বলেছিলি, তোর ছোট মাসির বাড়ির কাছের একটা ঘটনা। ওই গোবর ডাঙা না কোথায়?
-গোয়ালবেড়িয়া। গোয়ালবেড়িয়া চারুমোহন মেমোরিয়াল হাই স্কুলের ঘটনা। সে তো বহু বছর আগের কথা রে…।
-হুমম, একবার ঘুরে আসা যায় না ওখান থেকে?
-ওয়েট ওয়েট, ধীরে বৎস, ওটা বছর কুড়ি আগের ঘটনা, ভুতের পুনর্জন্ম হয়ে গেছে আর আমার ছোট মাসিরাও ওই গোয়ালবেড়িয়া তে এখন আর থাকে না, উলুবেড়িয়ায় বাড়ি করে উঠে গেছে।
-আচ্ছা। মানে লবডঙ্কা!
-দেখ… তুই যখন একান্তই বলছিস, আমি এক কাজ করতে পারি।
-হুমম।
-কাছেই, ৫৮ গেট। বাংলো জাতীয় পেয়ে যেতে পারি। তোকে নিয়ে এই এক দেড় দিনের ছোট্ট ট্রিপে ঘুরিয়ে আনতে পারি। আর যদি পাও তার দেখা…!
-কার কথা বলছিস?
-অশরীরী… হি হা হা হা হা হা! তো প্রথমে ৫৮ গেট বন বাংলো প্লাস সেখান থেকে দ্যা হন্টেড প্লেস গোয়ালবেড়িয়া চারুমোহন মেমোরিয়াল হাই স্কুল।
-ওহ! গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!
-দাঁড়াও পথিক বর, সব ঠিকঠাক খোঁজ নিয়ে খবর দিচ্ছি, ভেরি শুন।
না, মধু নিরাশ করে নি। ঠিক দেড় দিনের দিন ফোনটা পেলাম সামনের রবিবার রওনা হওয়া যায়। ৫৮ গেট বন বাংলো। ভুতের দেখা যদি নাও মেলে, বন বাংলো নিরাশ করবে না। ইদানিং, উলুবেড়িয়ার মতো মফস্বল গুলোও কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে উঠেছে। ধোঁয়া – ধুলো – জ্যাম। সেখান থেকে দুটো দিন নির্ভেজাল ছুটি। নদী – সবুজ গাছপালা-ডিয়ার পার্ক – ধান ক্ষেত। ভাবলেই মনটা ভালো হয়ে যায়।
* * *
রবিবার সকালে সোয়া আটটা নাগাদ রওনা হলাম। শীতের শুরু। নভেম্বর মাস। গ্রামের দিকে আবার ভালো ঠাণ্ডা পড়ে। দোনামোনো করে ট্রাঙ্ক থেকে মাফলার আর হালকা শান্তিনিকেতনী চাদরটা হাত ব্যাগে ভরে নিলাম। গরুহাটার মোড়ে পৌঁছে দেখি, মধু বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে সিগারেট টানছে। রোদ চশমায় ঢাকা চোখ। গোলগাল চেহারা, আকাশী ফুলস্লিভ শার্ট। আমায় দেখে ঝলমলে হাসি তে মুখ ভরে গেল।
-আহা, শর্ট ঝুল পাঞ্জাবী আর জিনসে, তোকে তো ঠিক কবি কবিই লাগছে!
-অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম?
আমার কথায় ও কান না দিয়ে বললো,
-চা খাবি? আয় …।
বলে, তিনমাথা গরুহাটার’র মোড়ে, শিরিষ গাছের নিচের চা দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। আমি পিছু পিছু। ঠিক এই সময় একটা সি টি সি বাস ঢুকে পড়ল স্ট্যান্ডে। আমি সামলে উঠে পড়লাম। বেশ ভিড় ভর্তি। মধু দোকান থেকে দৌড়ে কোনো রকমে বাদুড় ঝোলা হলো। আমি শেষের রো তে জায়গা পেলাম কোনক্রমে। মধু আমার সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে।
-ভাবতেই পারছি না, আমরা ভুত দেখতে চলেছি!
-তুই ই তো বললি, নাও পেতে পারি তার দেখা।
-হুম কিন্তু, উইক এন্ড টুর টা সলিড। জানিস এই ভুতুড়ে গল্পে একটা এডাল্ট এলিমেন্ট অ্যাড করে দিতে ও পারিস। ধর…।
মধু কী বলছে আমি শুনতে পেলাম না। বাসের হর্নে চাপা পড়ে গেল। শুধু ওর গাঢ় সিগারেটের গন্ধ আর ‘এডাল্ট এলিমেন্ট ‘কথাটা মনের মধ্যে ঘুরতে লাগলো। নানা স্টপেজে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বাস চলেছে। মধু আমার পাশে বসতে জায়গা পেয়ে গেল। একটু বাজার ছাড়িয়ে গিয়েই, সবুজ ধান ক্ষেত নীল আকাশ, ছোট ছোট ঘর বাড়ি আর দিগন্ত জোড়া মাঠ।
এরপর ক্রিম পাউরুটি গলধ:করন করতে করতে, যেটা জানা গেল, বেশ কিছু বছর আগে, গোয়ালবেড়িয়া চারুমোহন মেমোরিয়াল হাই স্কুলে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। একটা মুসলিম ছাত্রী ও এক হিন্দু শিক্ষকের প্রেম। পরে লোক-জানাজানি। তখন যে কোনও প্রণয় সম্পর্ক কে শাসন যোগ্য অপরাধ ভাবা হতো। কোনও কারণে শিক্ষক সরে আসেন সম্পর্ক থেকে ও মেয়েটি আত্মহত্যা করে হোস্টেলের ছাদ থেকে পড়ে এবং আজও মেয়েটিকে স্কুলের ছাদ ও চিলেকোঠায় হাঁটতে দেখা যায়। পিছনের মাঠ থেকে ছেলেরা বল কুড়োতে এসে, লম্বা চুলের এক মেয়েকে আজও হাঁটতে দেখে। কিন্তু, এই ভুতের গল্পের কথা কাউকে বলা যাবে না। আমরা একটা সার্ভে করতে এসেছি, এই যা। স্কুলের এই ঘটনা কেউ প্রচার করতে চায় না। হোস্টেল ও সেই থেকে উঠে গেছে। স্কুলের গেট কিপার কে নানা অছিলায় রাজি করানো গেছে এবার ভাগ্যের ব্যাপার।
গা – ছম – ছমে গল্প আর ছুটির মেজাজে বাস ছুটে চলে। ততক্ষণে একটা চিলেকোঠা, বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে আলো, বই এর স্তূপ আর বেঞ্চের পাশে পিছন ঘুরে এক মেয়েকে দেখি। লাল জামা, লম্বা চুল ঝুলছে। ছোট থেকেই কোনো গল্প শুনেই ছবি হয়ে যায় আমার মনে। বাস্তবে হয়তো নাও মিলতে পারে সেই ছবি।
* * *
৫৮ গেটে যখন নামলাম তখন ন’টা পঁয়ত্রিশ। থিকথিকে ভিড়। স্থানীয় হাট বসেছে ব্রিজের উপরে। আর কী নেই সেখানে! আনাজ – মাছ – বই – জামা – শাড়ি – ফ্রক ধূপ – চুড়ি থেকে শুঁটকি। বাজার পার হয়ে একটা দুটো পানের গুমটি ও কয়েকটা চাউমিনের দোকান, ভাত পাওয়া যায় – বোর্ড ঝুলছে। আর একটা পার্টি অফিস। ইন্দিরা গান্ধীর ছোট্ট আবক্ষ মূর্তি। একটা লাল মোরাম পাতা রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলাম। দুই পাশে আকাশমণি গাছ আর ঝাউবন। রাস্তার সমান্তরালে এইবার নদীটাকে চমৎকার দেখাচ্ছে। বাজার থেকে খানিকটা সরে এসে নদী তীরের নির্জনতা গভীর হলো। গাছের ছায়ায় একটা দুটো নৌকা সারানো হচ্ছে। হোটেল সানভিউ নাম লেখা দোতলা বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। নিচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা চারপাশ। পিছনে ঘন জঙ্গল ও আগাছা। রিসেপশানে ভদ্রলোক কালো মাঝবয়সি, চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে কথা বলেন। আমারা দোতলার ঘরে গেলাম। জানালা খুলেই সবুজ ঝাউবন আর কিচমিচ পাখির ডাক। বিছানায় শরীর এলিয়ে মধু বলল,
-চান খাওয়া সেরে, একটু গড়িয়ে নিই। বিকেল করে গোয়ালবেড়িয়া চারুমোহন মেমোরিয়াল হাই স্কুল। কালকের জন্যে ডিয়ার পার্ক ও আশ্রম।
একটা ঝিমধরা গ্রাম্য নদী তীর। দিনের বেলা তেই ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে। ছোট ব্যালকনি থেকে দেখছি একটা মেয়ে ছাগল চরাচ্ছে, চারপাশ নির্জন। মেয়েটি উবু হয়ে বসে। কী করছে? ঘাস কাটছে? চারপাশে জঙ্গল আর নৈশব্দ। হঠাৎ খেয়াল হলো মেয়েটি লাল জামা পরা। আর আশ্চর্য দীর্ঘ খোলা চুল পিঠে ফেলা। আমার মনে হলো মেয়েটি জানে, আমি ওকে লক্ষ করছি। এক্ষুনি ও আমার দিকেই চাইবে। চাইবেই। ও কোন কাজ করছে না। রুমে মধু ও নেই। বাথরুমে জলের শব্দ পাচ্ছি। মেয়েটি মুখ তুলছেনা, কারণ ওর শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, হাড় – পাঁজর গুঁড়িয়ে গেছে। আমি অবশ হয়ে আসা হাত পা নিয়ে অপেক্ষা করছি এক ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার জন্যে। সামান্য সোজা হয়ে বসে, একটা অদ্ভুত সুর করে ডাকতে থাকে মেয়েটি। উউউউউউউ…..। আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাগলগুলো একে একে মেয়েটির কাছে ফিরে আসে।
একটা দরজা খোলার শব্দ হয়। মধু মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। আমার সম্বিত ফেরে।
-যা, স্নান সেরে নে।
দুপুরে, উচ্ছে আলু ভাজা – সবজি পোস্ত – মুসুর ডাল – রুই মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম আমরা। একটু গড়িয়ে চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে নদীর তীরে, তারপর একটা সাইকেল রিক্সা নিয়ে গোয়ালবেড়িয়ার দিকে রওনা হলাম।
* * *
শীতের বিকাল। গাছে গাছে ঝলমলে রোদ। বাজার হাট ছাড়িয়ে পড়তে আদিগন্ত খোলা মাঠ আর ধানক্ষেত। রাস্তার দু’ধারে ঝাউ আর অকাশমনি গাছের সারি। গোয়ালবেড়িয়া জায়গাটা একটা ছোট বাজার মতো। সাকুল্যে গোটা দশেক চালা দোকান। ওরই একটা তে মধু ‘র পূর্ব পরিচিত এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় অপেক্ষা করছিলো। হাসিখুশি মুখের কোঁকড়া চুলের স্বতঃস্ফূর্ত চেহারার ছেলের ডাক নাম ভোলা। আমরা একটা চায়ের দোকানে বসে, গেট কিপারের অপেক্ষা করতে থাকি। ভোলা ছেলেটির সাথে মধু বেশ গল্পে মেতে ওঠে। আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর থেকে নানা পি এন পি সি। কাঠের সরু নড়বড়ে বেঞ্চে বসে কাঁচের গ্লাসে দুধ চা খাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি আসন্ন মুহূর্তের। গ্লাসটা শেষের দিকে, একজন মাঝবয়সি টাক মাথা লোক দোকানে এসে দাঁড়ালো। সারা মুখে বিরক্তি।
-কে সৌম্য বাবু? আজ এই ছুটির সময় আপনাদের কী কাজ স্কুলে? গেট কিপার বলে কী আমার ছুটি নয়!
ভোলা একগাল হেসে এগিয়ে এলো।
-আরে, পঞ্চানন দা তুমি যে কী বলো…!
-ধ্যাত, থামো তো আমার বাগানে জল দেওয়া ছিলো, কত্ত কাজ…!
মধু এগিয়ে এসে ঠাণ্ডা শক্ত মুখে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট পঞ্চানন বাবুর পকেটে গুঁজে দেয়। ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। সব কথা থেমে গিয়ে হাত কচলাতে শুরু করেন পঞ্চানন বাবু।
-চলুন, কী সার্ভে নাকি লাগবে… গেট খুলে দিচ্ছি রুম কিন্তু খুলতে পারবো নি।
-ঠিক আছে, ওতেই হবে।
আমি দোকান থেকে সরে এসে রাস্তার ধারে দাঁড়াই। পঞ্চানন বাবুর পিছন পিছন চলি। চালা দোকান গুলোর শেষে, একটা খোলা মাঠের মধ্যে গোয়ালবেড়িয়া চারুমোহন মেমোরিয়াল হাই স্কুল। সামনে এক ছটাক বাঁশ বন ও হোগলা বন। পিছনে যতদূর চোখ যায় মাঠ। হেলে পড়া সূর্যের আলো তে থমথম করছে। একটা শেষ বিকালের পাখি একঘেঁয়ে ডাকছে। আমার বোধহয় এখানে না এলেই হয়তো ভালো হতো। পিচ রাস্তা থেকে খানিকটা গিয়ে, যখন বড় স্কুল ফটকের ছোট সাইড গেটটা খোলা হচ্ছে, দেখলাম স্কুলের পাশে ঘাস জমিতে কতকগুলো কালো ছাগল চরছে। দড়ি গুলো খোলা। আমার বুকটা হিম হয়ে আসে। চারপাশ জনশূন্য।
-আসুন।
-হ্যাঁ, আচ্ছা এগুলো কার ছাগল?
আমার ফিসফিসে কথার উত্তর না দিয়ে, বড় কোল্যাপসিবেল গেটটাও খুলে দেয়। আমি কিছুটা থতমত হয়ে নির্জন বিশাল স্কুল বিল্ডিংটা দেখতে থাকি। একতলা গুলো খুব পুরনো। জানালা ও দরজার মাথা গুলো গোল। এখানে ওখানে চুন সুরকি খসে পড়ছে। বিরাট প্রাঙ্গণে ঘাস আর বিরাট অশ্বত্থ গাছটার পাতা উড়ে উড়ে পড়ছে। ক্রমশ দোতলা তারপর তিনতলা। সিঁড়ি তে পায়ের শব্দ পাচ্ছি অন্যদের। লম্বা শূন্য করিডোর ধরে একটা প্যাসেজে এসে পোঁচ্ছাই। গা ছমছমে নিঃশব্দ।
-এই যে মশাই, চিলেকোঠায় যাবেন না।
আমি চমকে উঠি। বড়ো বড়ো লাল চোখে পঞ্চানন বাবু ধমকান। আমি একটু ঘাবড়ে মাথা নাড়ি। প্যাসেজের শেষে গ্রিলের রেলিং থেকে মাঠের ওপার থেকে আসা আজান শোনা যায়। কী মন কেমন আর্তনাদের মতো। ওই তো ছাগলগুলো মাঠে চরছে। নিশ্চয়ই আশেপাশে সেই মেয়েটি ও আছে। আমার বুক হীম হয়ে আসে। নিজেকে বোঝাই, গোটা দেশে কী একটাই ছাগল চরানো মেয়ে আছে?
পাশেই একটা সিঁড়ি ইঁট দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাই কী চিলেকোঠা যাবার পথ! আমি চারপাশটা ভালো করে দেখে নিই। না পঞ্চানন বাবু নেই। আমি সন্তর্পণে পুরনো ইঁট সরিয়ে, মাথা নিচু করে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি। ধুলোর চাদর সিঁড়ির সব ধাপে। অবশেষে আবার একটা করিডোর আর চিলেকোঠা ঘর সংলগ্ন ছাদ। আশ্চর্য ব্যাপার হল করিডোরে তেমন ধুলো নেই। চিলেকোঠার ঘরের তালা মরচে ধরা। একটু টান দিতেই খুলে গেলো। ঢাঁই করা পুরনো নতুন বই খাতা। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বেঞ্চ ছড়ানো। আশ্চর্য রকমের পরিষ্কার মেঝে। ঘরের মধ্যে তেমন আলো নেই। জানালার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে যেটুকু। আমি সাহস করে ঘরে ঢুকলাম বই গুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ পিছন থেকে মধু সুর করে বললো,
-মারিয়ম খাতুনের প্রেমের কেচ্ছা খুঁজতে এয়েচো?
-না, পারলৌকিক অভিজ্ঞতা নিতে এসেছি।
ওর দিকে না তাকিয়ে বললাম। ও একই ভাবে বললো,
-সেটা কিরকম জিনিস?
-মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়? কী করে? কেনই বা তারা দেখা দেয় না ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করা। লেখালেখি করা আরকি। যেমন মারিয়ম কেমন করে প্রেমে প্রতারিত ও অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করলো এসব।
-আপনি সত্যি লিখবেন?
-মানে? তুই আপনি বলছিস হটাৎ?!
পিছনে ফিরে যা দেখলাম, তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। মধু একটা নীল সাদা স্কুল ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় হিজাব। আর শরীরটা মেঝে থেকে খানিকটা উপরে উঠে আছে। আমি চিৎকার করে মেঝেতে বসে পড়ি। গাঢ় লাল চোখ করে মধু আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েলি গলায় বলে,
-শুনুন, মারিয়ম কোন হিন্দু শিক্ষকের প্রেমে পড়ে নি। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। মারিয়মের গরীব পরিবারে তারা আট ভাইবোন। বাবা তার বিয়ে ঠিক করলো এক জরি ব্যবসায়ীর সাথে। মারিয়মের উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়া হবে না। বাল্যবিবাহের শিকার হতে হবে তাকে। শ্যামসুন্দর বাবু তার প্রতিবাদ করে, বাড়িতে কথা বললেন। হিতে বিপরীত হলো। বিয়ে ভাঙচি দিয়েছেন এই অপবাদে পাড়ার গুণ্ডা মাতব্বররা স্যার কে মারতে মারতে আধমরা করলো। লজ্জায় অপমানে মারিয়ম, এই চিলেকোঠার সিলিং থেকে, ওড়না দিয়ে…। লিখবেন সত্যিটা? লিখবেন তো?
আমার সামনে সিলিং থেকে বিস্ফারিত চোখে মারিয়ম ঝুলছে। উউউউউউউ….। একএকটা আর্তনাদ মেশানো ডাক আসছে মাঠ থেকে।
-কী রে, তুই মেঝেতে বসে কেন? কার সাথে কথা বলছিস? তুই একা একা চলে এলি দোকান থেকে। আমি ওদিকে ভোলার সাথে গল্প করছি।
ফাঁকা চিলেকোঠায় মৃদু আলোয় দুর থেকে আজানের স্বর আসছে।