আসাদ অস্বস্তিবোধ করলো খুব।
তার উরুর গোড়ায় কিছু একটা কামড় দিচ্ছে। চুলকানিযুক্ত কামড়। এই কামড়ে ব্যথা কম, চুলকানি বেশী হয়। ব্যথা সহ্য করা যায়, চুলকানি যায়না। কিছু একটা কী, ভেবে পাচ্ছেনা সে। পিঁপড়া অথবা ছারপোকাও হতে পারে। টিচার্স রুমের সবগুলো চেয়ার বেশ ফকফকা, পরিষ্কার। শুধু তার চেয়ারটাই পুরাতন। পায়া একটা নড়বড়ে।
আসাদ চোখ কুঁচকে হাতের দুই আঙুল কপালে চেপে মাথাব্যথার ভান করলো।
নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বাচ্চা নয়। এদের সামনে উরুর গোড়ায় হাত দিয়ে চুলকানো ভয়ংকর বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার। কপালে হাত দিতে দেখেই একজন ছাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে ইতিমধ্যে, ‘স্যার, বউয়ের কথা মনে পড়ছে?’
কপালে হাতের সাথে স্ত্রীর কী সম্পর্ক আসাদ বুঝতে পারেনা। এই গ্রামের প্রতিটা মানুষ অপ্রাসঙ্গিক কথা বেশী বলে। এবং কাশে। অকারণেই কাশে। বাচ্চাকাচ্চারাও শিখেছে দু’টি। গ্রামের নাম ঘুড্ডি।
গ্রামে হাইস্কুল একটাই। শিক্ষকতা করতে এসেছে আসাদ প্রায় একমাস হলো এখানে। একমাসেও কাউকে ঘুড়ি বানাতে কিংবা উড়াতে দেখেনি। তবে ওর বাসার সামনের তালগাছে অসংখ্য লাটাই বাঁধা দেখেছে। শুধু লাটাই। সুতোয় ঘুড়ি নেই।
‘স্যার’
আসাদ কপাল থেকে হাত সরালো। চুলকানি নেই এখন। ডাকছে ওই ছাত্রীটা। নাম কী মনে করতে পারছেনা আসাদ। এই মেয়েটি অতিরিক্ত কথা বলে। মশকরা করে। আসাদকে শিক্ষক বলেই মনে করেনা।
‘তোমার নাম কি?’
‘আঁখি…’
‘হ্যাঁ আঁখি, বলো’
‘আপনার শরীর খারাপ লাগলে ছুটি দিয়ে দেন। এটা লাস্ট ক্লাস। ছুটি দিলে উপকার হয় একটু।’
‘বই উলটাও।’
আঁখি কপালে দুইটা ভাঁজ ফেলে বই উলটালো। আসাদ এখনো নতুন। এমন কিছু করা যাবেনা যেটা হেডমাস্টারের চোখে পড়ে। এমনিতেই ইংরেজি আর অংক শিক্ষক আসাদকে দু’চক্ষে দেখতে পারেনা। আসাদের জায়গায় দু’জনই তাদের আত্মীয় ঢুকানোর চেষ্টা করেছিলো। অপছন্দ করার কারণ আছে বৈকি।
ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার পথে পারমিতাকে ফোন দিলো আসাদ। এই গ্রামে নেটওয়ার্ক ভালো নেই। পারমিতা ভয় পাচ্ছে।
‘পারু…’
‘হ্যাঁ বলো’
‘গতকালও হাত দেখেছো জানালায়?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভয় পেও না। এসব ভ্রম। বুঝলে?’
‘হ্যাঁ।’
আসাদ হতাশ হলো। গতকাল রাতেও একই ঘটনা ঘটেছে পারমিতার সঙ্গে। রাতে খেয়েদেয়ে শুয়েছিলো সে। বিছানার ডানপাশেই জানালা। আগে খোলা রাখতো সবসময়। এখন বন্ধ। পারমিতার চোখ বুজে এসেছিলো। হুট করেই চোখ গেলো জানালায়। কাঁচের জানালায় একটা থাবা বসানো। ভেজা ময়লা হাত। পাঁচটা আঙুল বসে আছে কাঁচে। পারমিতার বুক ধক করে উঠলো। উঠে বসতেই হাতটা উধাও। আসাদ অভয় দিলো। ছয়তলা বিল্ডিং এর জানালায় রাত সাড়ে দশটায় কারোর হাত দেখা যাবেনা। তাছাড়া ওই এরিয়ার সিকিউরিটি ভীষণ টাইট। নয়তো আসাদ একা বউকে শহরে রেখে এই এতদূর গাঁয়ে আসতে পারতো নাকি।
ফোন রাখার পর আবার চুলকানি টের পেলো আসাদ। কপালের রগ ফুলে উঠলো ওর। ঠিক করলো, বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে প্যান্ট খুলে উরুর গোড়ায় ইচ্ছামতন চুলকাবে। নখের আঁচড় বসিয়ে ক্ষত করে ফেলবে। যদিও হেডমাস্টারের ওখানে নিমন্ত্রণ আছে আজ। ফিরতে রাত হবে।
আসাদের বাসাটা টিনশেড।
বাসা থেকে হেডমাস্টারের বাসা দশ মিনিটের পথ। এই বাসাটাও হেডমাস্টারের। ভাড়া দেওয়ার জন্য হয়তো বানিয়েছিলেন। এই গ্রামে ভাড়ায় থাকার মানুষ নেই। হেডমাস্টার আপাতত এই বাসাটাকে তার অতিথিদের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন। সুন্দর করে সাজানো গোছানো। ডান আর বাম পাশে খানিকটা জঙ্গল। পেছনে একটু এগোলেই বড় একটা খাল, সামনেও জঙ্গল। জঙ্গল কেটে পায়ে হাঁটার একটা পথ বানানো হয়েছে।
সাপ-জোঁক দেখা যায় মাঝে মাঝে, আর মশা তো আছেই। দিনেও কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। তাও আসাদ সন্তুষ্ট। এতটুকুন পাবে কল্পনাও করেনি সে। যখন প্রথম শুনলো এই গ্রামের কথা, পারমিতা চিন্তায় অস্থির। কোথায় থাকবে, কেমন হবে মানুষজন। আপাতত একটা চিন্তা দূর হয়েছে, শুধু মানুষজন জানা বাকি।
মানুষজন মোটামুটি যেমন হয় গ্রামের, অমনই। মিশুক। সহজ সরল। আসাদের ধারণা পুরো গ্রামে তাকে অপছন্দ করে দুইজন মাত্র মানুষ। ইংরেজি আর অংক শিক্ষক। রাত নয়টার দিকে আসাদ টের পেলো, সংখ্যাটা দুইজন নয়- সম্ভবত তিনজন। আসাদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো জানালায়। একটা মহিলা, জানালায় বাইরের দিকে পা ঝুলিয়ে বসে মাথা দুলিয়ে কিছু খাচ্ছে। চকচকে নতুন শাড়ি পরনে, মাথায় ঘোমটা। মাত্র ফিরেছে বাসায় আসাদ। চমকে উঠে দুইবার জিজ্ঞেস করলো,
‘কে, কে ওখানে?’
মহিলা পেছন ফিরে তাকালো। হাতে পেয়ারা। আসাদের একমুহূর্তেই মনে হলো, জিজ্ঞেস করা উচিৎ হয়নি। যদি জিজ্ঞেস না করতো তবে কখনোই ওই মহিলা পেছন ফিরে তাকাতোনা। এই রাত দুপুরে তার নির্জন বাড়ির জানালায় পা দুলিয়ে বসে কোনো মনুষ্য পেয়ারা খাবে না নিশ্চিত, তাও একটা মহিলা।
‘পেয়ারা খাবি?’
আসাদ দুই পা পিছিয়ে গেলো। মহিলা উঠে ঘোমটা ফেলে দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো। আসাদের দম আটকে আসছিলো। পারমিতার হাসৌজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আসাদ প্রথমে বিস্মিত ক্ষনিকপর দারুণ আনন্দিত হলো। দম ছেড়ে বললো,
‘তুমি কোত্থেকে? গড! স্ট্রোক করে বসেছিলাম আর একটু হলে। বাসা চিনলে কি করে?’
পারমিতা কোমরে আঁচল বেঁধে নাক কুঁচকে বললো, ‘এটাকে বাসা বলে? ছিঃ’
‘ছিঃ বলো না, এই গাঁয়ে এটাই অনেক। তুমি একটা ফোন টোন করবা তো আসার আগে।’
‘বাব্বাহ! যা নেটওয়ার্ক তোমার গাঁয়ের। তাছাড়া ফোন করলে সারপ্রাইজ হতো?’
‘বিশেষ কোনো দিন আজ?’
পারমিতা ঠোঁট টিপে হাসলো। ঝপাট শব্দে জানালা বন্ধ করে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে বললো, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি বলবোনা আজকের দিনটা কেন স্পেশাল। ওটা তুমি মনে করবা। মনে না করতে পারলে কাল সকালেই উঠে ব্যাগ গোছগাছ করে চলে যাব আমি।’
‘চাপ দিওনা গো’
পারমিতা খিলখিল শব্দে হেসে উঠলো। আসাদের ইচ্ছে করলো ধপাস করে বিছানায় পারমিতার পাশে শুয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভোর অবধি আর না ছাড়তে। এক মুহূর্তের জন্যও না।
আসাদ বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। পারমিতা নিজে রাঁধলো। আসাদকেও আরেকবার খেতে বসতে হলো ওর সাথে। খাওয়া শেষে পারমিতা বললো, ‘একটু হেঁটে আসি চলো…’
আসাদ আঁতকে উঠলো, ‘না। সাপ আছে খুব।’
পারমিতা তবু জেদ করলো। একপ্রকার টেনে বের করলো আসাদকে বাসা থেকে। আজকে বিশেষ দিন। পারমিতা বেশ পাগলামো করবে। আরশির জন্মদিনেই পারমিতা এমন পাগলামো করে। প্রায় দুই ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর আসাদ টের পেলো আজ আরশির জন্মদিন। কিভাবে ভুলে যায় সে এই দিনটা?
পারমিতা ভুলেনা কখনো। তার ছোট্ট বাচ্চাটা। তুলতুলে। এই এতটুকুন। স্নিগ্ধ একটা মুখ ছিলো আরশির। ছয়দিনের আয়ু নিয়ে এসেছিলো মেয়েটি। সপ্তম দিন মৃত বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে পারমিতা আসাদের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলেছিলো, ‘মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায় আসাদ?’
বাচ্চা শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলো আসাদের কোলেই। তবু আসাদ সামলে নিয়েছে নিজেকে। পারমিতা পারেনি আজো। আর বাচ্চাও নেয়নি। আসাদ ভারী অবাক হয়েছিলো। চেষ্টাও করেছিলো। পারমিতা অনড়। প্রতি বৎসর এই দিনটা এলেই এত বেশী সুখী মনে হয় ওকে। আসাদ আবছা অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে পারমিতার হাত ধরে বললো, ‘আমরা এবার একটা বাচ্চা নিই পারু?’
জঙ্গলের সরু পথে জমাট অন্ধকার। থেকে থেকে অজানা অচেনা কিছু পোকা মাকড়ের ডাক। গাছের পাতার সরসর শব্দ। পারমিতা হুট করে আসাদের কাঁধে মাথা রেখে বললো, ‘আর হাঁটতে ইচ্ছে করছেনা। বাড়ি ফিরবো।’
আসাদ বাড়ির পথ ধরলো। একহাতের সবগুলো আঙুল পারমিতার হাতের আঙুলের ফাঁক বুজে। পাশের জঙ্গল থেকে একটা শেয়াল ডেকে উঠলো হঠাৎ। আসাদ চমকালোনা, অভ্যস্ত হয়েছে বেশ একমাসেই। পারমিতা চমকালো। হাত মুঠো করলো শক্ত করে। আসাদ অভয় দিলো, ‘ওগুলো শেয়াল। একটা ডেকেছে। দেখবে, এখন আরো ডাকবে।’
কথা শেষ হওয়ার পর পরই বিপরীত পাশের জঙ্গল থেকে আরো ক’টা শেয়াল ডেকে উঠলো মুহুর্মুহু। পারমিতা এবার চমকালোনা। হেসে উঠলো বরং। এই নির্জন রাত্তিরে পারমিতার হাসির শব্দ কিভাবে যেন বেশ মানিয়ে গেলো।
বাসায় ঢুকে দুইটা কয়েল জালিয়ে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লো দুইজন। বাইরে একটা প্যাঁচা ডেকে চললো অনর্গল। প্যাঁচার ডাক অশুভ। পারমিতার মুখে মেঘ জমলো হুট করে। আসাদের দিকে মুখ করে শুয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘আজকে আমায় ভীষণ ভালোবাসবে তুমি। বাসবে তো?’
আসাদ চোখে একদলা মায়া নিয়ে হাত বাড়ালো।
‘নক নক’
পারমিতা হকচকিয়ে উঠে সামলে নিলো নিজেকে। শাড়ি ঠিক করলো। আসাদ কাপড় পরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো দরজার কাছে। রাত একটায় ওর দরজায় নক করার কথা না কারোর। নয়টার মধ্যেই গ্রামের সবাই শুয়ে পড়ে। ওর বাড়ির আশেপাশে দিনেও মানুষ ঘেঁষেনা খুব প্রয়োজন না হলে।
দরজা খুললো আসাদ। হেডমাস্টার দাঁড়িয়ে। হাসি হাসি মুখ করে সামান্য কেশে বললো, ‘তোমার বউ এসেছে। তুমি যেমন পাগল, তোমার বউও তেমন। সারপ্রাইজ দেবে বলে এই রাত করে শহর থেকে চলে এসেছে। কি সাহস কি সাহস!’
আসাদ চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইলো হেডমাস্টারের দিকে। হেডমাস্টারও চোখ কপালে তুললেন, ‘এ কে?’
আসাদ পেছনে তাকালোনা। সে জানেনা বিছানায় কে বসে আছে অপ্রস্তুত অবস্থায়। সে জানতে চায়না। তার বউ পারমিতা মাত্রই এসেছে শহর থেকে। বাইরে দাঁড়িয়ে। কার ঠোঁটে চুমু খেয়েছে এতক্ষণ আসাদ জানেনা। জানতেও চায়না কখনো। আসাদের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।
‘স্যার আমার দোষ নাই। আসাদ স্যার আমারে ফুসলায়ে এখানে আনছে।’
ক্লাসে বেশী কথা বলে, ওই মেয়েটির আওয়াজ মনে হচ্ছে আসাদের। কি যেন নাম। আঁখি। আঁখি কথা বলছে কোথা থেকে। আশ্চর্য! আসাদকে পেছনে তাকাতে হলো ভয়ে ভয়ে। আঁখি বসে আছে মশারি টাঙানো বিছানার ভেতর। জামা আধেক খোলা। বুকে ওড়না দিয়ে কোনোরকমে ঢাকা। মুখে শক্ত করে কাপড় বাঁধার অস্পষ্ট দাগ। হেডমাস্টার রাগে ফোঁস করে উঠতেই আসাদ দরজা খুলে দৌড়ালো সামনে।
জঙ্গলের সরু পথে, দুইপাশে আগাছা। কাটাওয়ালা আগাছাও বোধহয়। আসাদের পা কাটছে, ছিঁড়ছে। আসাদ খালি পায়ে দৌঁড়ালো সরু পথ যতদূর যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে ধপাস করে পড়লো কোথাও। ভেজা জবুথুবু পলিথিনে মুখ গুজে, জমাট গন্ধ, নিছক অন্ধকারে হয়তোবা। চোখের পাতা বুজার সময়ও পায়নি। আসাদ হতবাক হলো। ময়লা আবর্জনার মধ্যে একটা কালো জানালা দেখতে পাচ্ছে সে। কাঁচের জানালা। আসাদ ভেজা নোংরা পলিথিনের ভেতর দিয়ে হাত বাড়ালো।
আঁখি চোখ বুজলো।
অথৈ কাঁধের সাহায্যে আলতো ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করলো, ‘স্যার যদি জানে চিঠি আমরা লিখছি, তখন…’
আঁখি ভ্রু কুঁচকালো। অথৈ মেয়েটার বোধবুদ্ধি একটু কম। টেরও পায়না তার ঘনিষ্ঠতম বান্ধবী মূলত অনেকের থেকে আলাদা। আলাদা হওয়ার মধ্যে সুখ নেই, কষ্ট আছে। এই যে আঁখি চোখ বুজে আছে, সে মূলত এখানে নেই। সে এখন আছে একটা পিঁপড়ার ভেতর। লাল পিঁপড়া। কামড়ালে বেশ জ্বালা করে, চুলকায়। লাল পিঁপড়াটা এখন হাঁটছে স্যার যে চেয়ারে বসে আছেন ক্লাসরুমে, তাদের সামনে… ওই চেয়ারের পেছনের ডানপাশের পায়ায়। আঁখি চাইলেই যে কোনো ক্ষুদ্র পোকা মাকড়ের ভেতর ঢুকে যেতে পারে। এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা ওর। প্রথমবার টের পেয়েছিলো যখন ওর বয়স নয়।
একটা প্রজাপতি দেখে হুট করেই যেন কি হলো ওর। চোখ বুজে ধপাস করে পড়লো সে ঘরের চৌকাঠে। শরীরটা পড়লো বটে, চোখ খুলতেই টের পেলো ওজন একদম হালকা হয়ে এসেছে ওর। সে উড়ছে। এই যে ডানা, আর এতগুলি চোখ। আঁখির মাথা ঘুরাতে লাগলো। দুই পার্শ্বের দুই রকম বস্তু একই সময়ে একইসাথে দেখতে পাচ্ছে সে। পরে জেনেছিলো এর নাম পুঞ্জাক্ষি।
সেই থেকে শুরু। সমস্যা একটাই। ছোটখাটো পোকামাকড়ের ভেতর ঢুকতে পারলেও বড় কোনো প্রাণীর ভেতর ঢুকতে পারেনা। বহুবার চেষ্টা করেও মোতালেব নানার গোয়ালঘরের বড় গরুটার ভেতর ঢুকতে পারেনি। সবচেয়ে সহজ হয় পিঁপড়ার ভেতর ঢুকা। এই যে এখন ঢুকেছে। আঁখির মনে দুষ্টুমি চেপেছে।
স্যারের নাম আসাদুল্লাহ খান।
মানুষটার প্রতি স্যার স্যার ফিলিংস আসেনা আঁখির। এত কম বয়স। অথচ বিবাহিত। আঁখির ভারী অভিমান হয়। এখন সে আসাদুল্লাহ খানের সঙ্গে খানিক ফষ্টিনষ্টি করবে। লাল পিঁপড়াটা পায়া বেয়ে উপরে উঠলো। প্যান্টের উপর কিছুক্ষণ হেঁটে জিপারের ক্ষুদ্র ফুটো দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। আঁখি লজ্জায় মুখ চাপলো। পিঁপড়া বলেই মুখ চাপতে গিয়ে একটু আঁচড় কেটে দিলো উরুতে।
আসাদুল্লাহ নড়ে উঠেছেন। হি হি। আঁখির প্রচণ্ড হাসি পেলো। কিন্তু সে এই ব্যাপারটা মানুষ হয়ে উপভোগ করতে চায়। পিঁপড়া থেকে বের হয়ে আসলো ক্ষণিকের ভেতর। অথৈ বই খুলে ভারী বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছে নিচে। আঁখি ধাক্কা দিলো কাঁধ দিয়ে,
‘মজা দেখ। আসাদুল্লাহ খানের চুলকানি হবে। কিন্তু সে চুলকাতে পারবেনা। কেন পারবেনা জানিস?’
অথৈ হি হি করে হেসে উঠলো মুখ টিপে। সে জেনে ফেলেছে কেন পারবেনা চুলকাতে। অথৈকে যতটা বোধবুদ্ধিহীন ভাবে আঁখি, সে সম্ভবত তা নয়। আঁখি মুখটিপে হাসি চাপলো। আসাদুল্লাহ খান ইতস্তত করে পা নাড়াচাড়া করে কপাল চুলকাচ্ছেন। অথৈর চিঠি লেখা শেষ।
চিঠিটা শুরু হয়েছে ভয়ানক নোংরা কিছু শব্দ দিয়ে। এক পৃষ্ঠার এই চিঠিটা অথৈ বামহাতে লিখলেও প্রতিটা শব্দ বের হয়েছে আঁখির মাথা থেকে। চিঠি আসাদুল্লাহ খানকে দেয়া হবে খুব কৌশলে। চিঠি পড়ার পর আসাদুল্লাহ খানের কি অবস্থা হবে, সে নিজ চোখে দেখবে। প্যাঁচা হয়ে।
আসাদুল্লাহ স্যারের বাসার সামনের তালগাছে একটা প্যাঁচা বসে রোজ রাতে। আঁখি বিষয়টা নিজ চোখে দেখেছে কয়েকমাস আগে। তখন বাসা খালি ছিলো। আর প্যাঁচাও ছিলো দু’টো। আঁখি চড়ুই হয়ে একটু উড়ছিলো ওইপাশের জঙ্গলে। প্যাঁচা দু’টোকে দেখে তখন সে। তারপর চট করে একটা প্যাঁচার ভেতর ঢুকে পড়ে। ঢুকার পর পরই বুঝতে পারে, ভুল প্যাঁচার ভেতর ঢুকেছে সে। একরাশ বিষণ্ণতা চেপে ধরে আঁখিকে। প্রথমবারের মতোন জানা হয় পাখিরাও বিষণ্ণ হয়। প্যাঁচাটা বিষণ্ণ ছিলো কেননা সে শীঘ্রই মরতে যাচ্ছে। পাখিরা জেনে ফেলে কখন মরবে সে। জানার পর তাকে উড়াল দিতে হয় কোনো এক গহীন অরণ্য উদ্দেশ্য করে। সব ছেড়ে। আঁখির কান্না পেলো এত। বের হয়ে আসলো সে। প্যাঁচা থেকে বের হলেও পুরো এক সপ্তাহ লেগেছিলো এই বিষণ্ণতা থেকে বের হতে। তারপর একদিন শুধু দেখতে গিয়েছিলো সে তালগাছটা। বাকি প্যাঁচাটা বসে আছে একা। প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ঢুকেনি আঁখি ওই প্যাঁচার ভেতর। আজ ঢুকবে।
আঁখি অপেক্ষা করছে। প্যাঁচার ভেতর।
আসাদুল্লাহ স্যার এখনো ফিরছেনা। কোথায় গিয়েছে কে জানে। আঁখির কষ্ট হচ্ছে খুব। প্যাঁচাটা সঙ্গীকে ভুলতে পারেনি এখনো। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে মাঝে মাঝে। শুকনো পাতা ভাঙার মচমচ শব্দে আঁখি ফিরে তাকালো। আসাদুল্লাহ স্যার ফিরছেন জঙ্গলের মাঝখানের সরু পথ দিয়ে। কাঁধে কেউ একজন।
আঁখি অবাক হলো। একটা মেয়েকে কাঁধে তুলে নিয়ে বাসায় ফিরছেন আসাদুল্লাহ স্যার। মেয়েটা কে? আসাদুল্লাহ স্যারের বউ না তো! কিন্তু বউ এত বাচ্চা হবে? একটা পিচ্ছি মেয়েকে কাঁধে নিয়েছেন আসাদুল্লাহ। মেয়েটির বয়স অনুমান করলো আঁখি। চৌদ্দ। বাসার কাছাকাছি আসার পর আসাদুল্লাহ স্যারের কাঁধের দিকে তাকিয়ে আঁখি ঢোক গিললো। মেয়েটি লাল রঙা থ্রি-পিস পরে আছে। আঁখি চিৎকার করতে গিয়েও করলো না। আসাদুল্লাহ স্যার খোদ আঁখিকেই কাঁধে চেপে বাসায় ফিরেছেন।
আঁখি তার দেহটা জঙ্গলের এইপাশে আগাছার ভেতর ঢেকে রেখে এসেছিলো। আসাদুল্লাহ স্যার কি করে খুঁজে পেলো। একটা অনর্থ হতে যাচ্ছে। আঁখি প্যাঁচা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলো। এবং তক্ষুনি টের পেল সে বের হতে পারছেনা। আসাদুল্লাহ স্যার চোখ মুখ বেঁধে রেখেছেন আঁখির অচেতন শরীরটার। কেন এমন করছেন স্যার! আঁখির সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ভয়ে। প্যাঁচাটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো আঁখি দরজা অবধি। ধড়াম করে দরজা বন্ধ হলো ভেতর থেকে।
উড়ন্ত আঁখি দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আসাদুল্লাহ স্যার তার শরীরটার সঙ্গে কি করবেন? ওহ খোদা!
আঁখির কান্না পেল। চিৎকার করলো সে। ডানা ঝাপটালো। সমস্ত বাড়ির আশপাশ উড়লো অনেকক্ষণ। তারপর ক্লান্ত হয়ে তালগাছে গিয়ে বসলো। শুকনো পাতা ভাঙার শব্দে ফিরে তাকালো। কেউ একজন আসছে আসাদুল্লাহ স্যারের বাসা উদ্দেশ্য করে। হাতে হারিকেন। হেডমাস্টার! আঁখির কলিজায় পানি এলো। হেডমাস্টার দরজায় নক করলেন।
‘নক নক’
পারমিতা ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে তাকালো।
কাঁচের জানালার ওইপাশে রাতের রাস্তা। পিচ রাস্তার পাশে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর জিরাফের গলার মতোন সোডিয়াম লাইটগুলো স্থির তাকিয়ে আছে মাথা নিচু করে। জানালার কাঁচে কারো হাতের ছাপ নেই। পারমিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
আসাদ গ্রামে গিয়েছে পর্যন্ত কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। পারমিতা মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভীতু। কখনো একা থাকেনি। আসাদকে ছাড়া এমুহূর্তও থাকতে পারেনা সে। আসাদও পারেনা। এখন পারছে। পারমিতাকে একা শহরে রেখে গ্রামে চলে যাওয়া, বিষয়টা যথেষ্ট আন-রোমান্টিক হলেও বড্ড বাস্তব। পারমিতা সামলে নেবে সব। কিন্তু এই হাতটা ঘুমাতে দিচ্ছেনা পারমিতাকে। আজকে বিকেলেও হাতটার কথা ফোনে বললো আসাদকে সে। আসাদ বরাবরের মতোন অভয় দিলো। সব ভ্রম। এইরকম সেইফ এরিয়ায় ছয়তলা বিল্ডিং বেয়ে কে উঠে জানালার কাঁচে থাবা বসাবে? তাও শুধুমাত্র একটা মানুষকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে।
ঠাস শব্দে কেঁপে উঠলো পারমিতা।
তড়িৎ গতিতে জানালার দিকে তাকালো। তারস্বরে চিৎকার দিতে গিয়েও কেন যেন চিৎকার বের হলো না মুখ থেকে। একটা ময়লা হাত। আবর্জনায় মাখো মাখো। পারমিতা ঘন ঘন চোখের পাতা ফেললো। বিছানার পাশে আগে থেকে রাখা হকিস্টিকটা হাতড়ে নিয়ে মুঠো করে ধরলো দুই হাতে। জানালায় থাবা বসানো হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। বাল্বের আলোয় হাতের আঙুল একটার গোড়ায় চকমক করে উঠতেই পারমিতা হকচকিয়ে গেলো পুরোপু্রি। প্রচণ্ড সাহস জুগিয়ে দুই পা এগুতেই হাত থেকে হকিস্টিক পড়ে গেলো ওর। এ যে আসাদের হাত। বিয়ের সময় পারমিতার নিজের পরিয়ে দেওয়া রিংটা চকমক করছে। পারমিতা দৌড়ে গেলো জানালার কাঁচে। কাঁচের উপর রাখা হাতে হাত রাখতেই কাঁচ ভেদ করে হাতটা ছুঁতে পারলো পারমিতা। কি অদ্ভুত! কি অদ্ভুত!
হেঁচকা টান দিতেই আসাদ গলগলিয়ে বের হয়ে এলো কাঁচ থেকে। পারমিতা তারস্বরে চিৎকার করলো এইবার। সাউন্ডপ্রুফ রুমে চিৎকার কিছুক্ষণ এদিক ওদিক বাড়ি খেয়ে শান্ত হয়ে গেলো আবসেরাফ। আসাদ দাঁড়িয়ে। সারা গায়ে কাঁদা, ভেজা পলিথিন লেগে আছে কাঁধে, পিঠে, গলার কাছে। পারমিতার বমি এলো গন্ধে। আসাদ চোখ বড় করে ফিসফিস করে বললো, ‘আমায় বাঁচাও পারমিতা। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’
পারমিতার মুখ থেকে কথা সরছে না। অনেক কষ্টে কণ্ঠে জোর আনলো সে। বললো, ‘কারা?’
‘ঘুড্ডি। ওরা। একজনকে রেইপ করেছি আমি। আমায় মেরে ফেলবে।’
পারমিতা হা করে তাকিয়ে রইলো। আসাদ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো। পারমিতা অবাক চোখে দেখলো আসাদ পিছু হটছে। অদৃশ্য কেউ তাকে পেছন থেকে কলার ধরে টানছে। আসাদ পিছু হটতে হটতে জানালার কাঁচের কাছে পৌঁছুলো। সামনে হাত বাড়ালো। পারমিতাকে ছোঁয়ার ইচ্ছা। পারমিতা তাকে আটকে রাখুক এখানে। পারমিতা দৌড়ে এলো ওই হাত ধরতে। তার আগেই চট করে জানালার কাঁচে পেছন থেকে আসা হ্যাঁচকা টানে মিলিয়ে গেলো আসাদ টুপ করে। যেভাবে গলিয়ে বের হয়েছিলো ঠিক ওইভাবেই। পারমিতা ধপাস করে বসে পড়লো মেঝেতে।
আসাদের ভয়ানক বিপদ।
থানা পুলিশ এইসব বিশ্বাস করবেনা। পারমিতাকে পৌঁছুতে হবে ঘুড্ডি গ্রামে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য! কাঁচের জানালায় একটা হাত দেখে ভয়ে চুপসে যাওয়া মানুষটি এই রাত্তিরে শুধুমাত্র একটা পার্স হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলো রেলস্টেশন উদ্দেশ্য করে। রাতের ট্রেনে গ্রামে যাবে পারমিতা। আসাদ বিপদে আছে। ভয়ানক বিপদ।
হুঁইশেল দিয়ে ট্রেন ছুটলো। পারমিতা জানালায় চোখ রাখলো। আসাদের ফোন বন্ধ। খুব জলদি পৌঁছুনো দরকার। আসাদের জানা দরকার, একটা ভয়ানক গোপন কিংবা প্রায়শ্চিত্ত।
আসাদ টের পেল কলার চেপে হ্যাঁচকা টানে তুলছে কেউ তাকে।
সে মুখ দেবে উপুড় হয়ে পড়েছিলো ময়লা আবর্জনার ভেতর। জঙ্গলের সরু পথ ধরে কেউ একজন তাকে ছেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। আসাদের পানির তৃষ্ণা পেল। সে খসখসে স্বরে বললো, ‘পানি, পানি…’
দুইপাশের জঙ্গল থেকে শেয়াল কুকুর একসঙ্গে চিৎকার দিলো। হুক্কা হুয়া আর ঘেউ ঘেউ মিলেমিশে যেন বিদ্রূপ করলো আসাদের পানির তৃষ্ণাকে। আসাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলো। কে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছেনা কিছুই। চাপা ঘর্ঘর শুনতে পেল আসাদ। পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে যেন দুনিয়ার হিংস্র পশু একত্রিত হয়েছে আজ। পিছু নিয়েছে ওর। টুকরো টুকরো করে ছিঁড়বে ওরা আসাদের শরীরের প্রতিটা অংশ।
আসাদ প্রাণপণে চেষ্টা করলো ঘাড় ছাড়িয়ে নিতে। শরীরের নাড়াচাড়া দেখেই বোধহয় অজ্ঞাত ব্যক্তি জোরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে আসাদকে ফেলে দিলো তালগাছের গোড়ায়। ওই যে সামনে আসাদের টিনশেড বাসা। একটু আগে ওখানেই আসাদ আঁখির কচি শরীর নিয়ে খেলেছে ইচ্ছে মতন। যদিও অচেতন শরীর। তবু বাড়তি সতর্কতা হিসেবে চোখ মুখ হাত পা বেঁধে।
আসাদ কাতর স্বরে বললো, ‘পানি পানি…’
অজ্ঞাত ব্যক্তি বড্ড নরম স্বরে বললো, ‘এখানে কোথাও পানি নেই আসাদ।’
পারমিতা! ওহ খোদা! এ পারমিতা। আসাদ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। পারমিতা পাশে বসলো আসাদের। এতক্ষণ ছেঁচড়িয়ে আসাদকে টেনে আনায় একটু ক্লান্ত সে। আবছা অন্ধকারেও ওর চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেল আসাদ। ক্লান্ত এই চেহারায় ভয় নেই, আশংকা নেই, দুঃখবোধ নেই। এ কোন পারমিতা! আসাদ হাত বাড়ালো। পারমিতা বাড়ানো ওই হাতের অনামিকা থেকে রিং খুলে নিতে নিতে বললো,
‘আজকে তুমি আবার এসেছিলে আমার কাছে। কেন বুঝতে পারছোনা, তোমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত আমার কাছে নয়। প্রকৃতির কাছে।’
‘আমি কোনো অপরাধ করিনি পারমিতা।’
‘ধর্ষণ করেছো।’
‘আমি জোর করিনি। সে বাধাও দেয়নি। ধর্ষণ নয় এটা।’
‘সে অচেতন ছিলো। তাছাড়া একটা সাত দিন বয়সী বাচ্চার কনসেন্ট তুমি কিভাবে নেবে?’
আসাদ থতমত খেলো। আঁখি নয়, আরশির কথা বলছে পারমিতা। তাদের কন্যা সন্তান। মাত্র সাতদিনের বয়স নিয়ে এসেছিলো ভয়ংকর পৃথিবীতে। আসাদ ঢোক গিললো। পারমিতার জানার কথা নয় এই সত্য। পারমিতা ডুকরে কেঁদে উঠে বললো,
‘শুয়োরের বাচ্চা। মাত্র সাত দিন বয়স ছিলো ওর। তুই কি করে পারলি এইটুকুন সন্তানের সঙ্গেও এমন করতে?’
আসাদের সমস্ত শরীর ভেজা। ঠাণ্ডা লাগার কথা হলেও আসাদ টের পেল তার গরম লাগছে। শুয়োরের বাচ্চাদের কারণে অকারণে গরম লাগে। মাতাল লাগে। অল্পবয়সী নারী শরীর দেখলে আসাদ ঘোরে থাকে। এই উত্তাল স্বাদ কখনোই পারমিতার স্বেচ্ছায় পেতে দেওয়া শরীরে পায়নি সে। তাছাড়া পারমিতা পরিপূর্ণ যুবতী। আসাদের আগ্রহ অন্য কোথাও! কমবয়সী। বাচ্চা, শিশু, বালক, বালিকা, কিশোরী। এখনো যার স্তন গজায়নি। এখনো যার শরীরে কোথাও লেগে উঠেনি লৈঙ্গিক অনুভূতির পরশ।
কাঁচে বসা আসাদের থাবায় যে অস্থির প্রায়শ্চিত্তের গল্প লুকোনো ছিলো, পারমিতা খুঁজে পেয়েছে ট্রেনে চড়ার আগে। পেডোফাইলদের হাতে নিজের সন্তানও নিরাপদ নয়।
পারমিতার অশ্রুসজল চোখ দুটো ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে এখন। হেডমাস্টার এগিয়ে আসছে জঙ্গলের সরু পথ দিয়ে। সঙ্গে গ্রামের কিছু লোকজন। আঁখির বাবা আর ভাইটাও আছে দলে। সবার হাতে হারিকেন আর একটা করে লাঠি। আসাদ গুঙিয়ে উঠলো ভয়ে। পারমিতার হাত চেপে ধরলো। পারমিতা সহজ স্বরে বললো,
‘ভয় পেওনা। এরা কেউ তোমায় মারবেনা। এদের ওই ক্ষমতাই নেই। এরা তোমায় পুড়াবে, পিটাবে, শেয়াল কুকুর দিয়ে খাওয়াবে তোমার শরীর। ভোরে তুমি আবার জেগে উঠবে। এখানে আসার আগে আমি অনেক কিছু জেনেছি। যাদের দেখছো, ওরা কেউ বেঁচে নেই। যক্ষ্মায় মারা গিয়েছে সেই কবে। তুমিও যেমন রোজ কষ্ট পেয়ে মরো। আমরা যারা মানুষ, আমাদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। কাউকে শাস্তি দেয়ার বিষয়ে আরো বেশী দুর্বল। একজন জঘন্য অপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে পারি মৃত্যুদণ্ড। একবার মরে যায় লোকটি। হাজারটা মানুষের প্রচণ্ড ব্যথা বেদনার জন্য দায়ী মানুষটি একবার মরে যায়। দিস ইজ নট ফেয়ার। প্রকৃতি নিঃসন্দেহে দারুণ বিচারক। তুমি শতকোটি বার মরবে। প্রকৃতি তোমায় নির্বাসন দিয়েছে। তুমি হচ্ছে ওই ঘুড়ি, যাকে সারা দিন ইচ্ছেমতোন উড়ানো হবে। সন্ধ্যে হলে লাটাই গুটিয়ে নামানো হবে। ছেঁড়া হবে। ভাঙা হবে। ফের উড়ানো হবে।’
আসাদ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পারমিতার দিকে হাত বাড়ালো আবার। হেডমাস্টার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে আসাদকে। জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলে অভুক্ত হিংস্র পশু গিজগিজ করছে। চাপা ঘর্ঘর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। আসাদের প্রচণ্ড চিৎকার অগ্রাহ্য করে পারমিতা এগুলো স্টেশন উদ্দেশ্য করে। তার কাজ শেষ। দুই পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালো। সামনে একটা চৌদ্দ পনের বৎসর বয়সী কিশোরী দাঁড়িয়ে। কি মিষ্টি একটা মুখ। পারমিতা হাঁটু-গেড়ে বসে গালে হাত রেখে অশ্রুসজল চোখে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার নাম কি গো?’
কিশোরী ভারী অবাক হলো। কোনো এক অদ্ভুত কারণে এই মানুষটির ভেতরে ঢুকতে পারছে সে। ঢুকেই কিশোরীর কান্না পেল। এইরকম চূর্ণ- বিচূর্ণ কষ্টের সম্মুখীন এর আগে কখনোই হয়নি। একটু কাছে এগিয়ে এসে পরম মমতাময়ী দুঃখবতী নারীটির গালে হাত রাখলো কিশোরী। দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, ‘আপনার একটা দারুণ সংসার হবে তারপর। আমি আসবো আপনার কাছে। আবার। আপনি আমার নাম রাখবেন, আঁখি।’
পারমিতা আঁকড়ে ধরলো কিশোরীকে। পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। পারমিতা ট্রেনে উঠে পড়লো। বর্গাকৃতির ছোট্ট জানালায় চোখ রাখলো বাইরে সে। স্টেশনে কিশোরী দাঁড়িয়ে। একটা হাত উঁচু তার। ওই হাতে ছয়টা আঙুল।
তিন বৎসর পর।
বাচ্চার ডায়াপার বদলানো দেখে হতাশ হলো পারমিতা। এ কেমন মানুষ! সামান্য ডায়াপার বদলাতে পারেনা। আজব! ধমক দিলো সে, ‘হাবীব… আজকেও একই কাজ করেছো তুমি। উল্টো পরিয়েছো। বলি, সামান্য ডায়াপারের কোনদিক উল্টো বুঝোনা তুমি?’
হাবীব ক্লান্ত স্বরে বললো, ‘আমি পারছিনা। তুমি ওখানে বসে বসে খালি অর্ডার দিয়ে যাচ্ছো। এসে হাত লাগালেও তো পারো।’
‘মাটি কাটছো তুমি গর্দভ?’
হাবীব বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো। পারমিতা চেয়ার থেকে ছেড়ে উঠতে গিয়েই ফোনে রিং হলো। চট করে ফোন কানে নিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ বলো’
ওইপাশ থেকে ভেসে এলো একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর, ‘গতকালও হাত দেখেছো জানালায়?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভয় পেওনা। এসব ভ্রম। বুঝলে?’
‘হ্যাঁ।’
পারমিতা ফোন রাখলো। হাবীব চোরা চোখে তাকিয়ে বললো, ‘তিন বৎসর হলো বিয়ের। একমাস পর পর এই একই হ্যাঁ হ্যাঁ কার সঙ্গে করো খোদা জানেন। আমাকে তো কিছু বলোও না। আমি বাবা কিছু জানিনা। অন্যকোথাও সম্পর্ক থাকলে ডিভোর্স টিভোর্স দেওয়ার থাকলে আঁখি আমার কাছেই থাকবে তা কিন্তু আমি আগেই বলে রাখলাম।’
পারমিতা শব্দ করে হেসে ফেললো। তারপর পা টিপে টিপে এসে হাবীবের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তোমার ঘাড় থেকে নামছি না গো। বাচ্চাকে ছাড়া থাকতে পারাবা না, আমায় ছাড়া পারবা বুঝি?’
‘তা আর বলতে…?’
পারমিতার ভ্রু কুঁচকে এলো কপট রাগে। দুই হাতে গলা টিপে ধরার ভঙ্গি করলো সে। ঠিক তক্ষুনি বাচ্চার আদুরে শব্দ ভেসে আসলো বিছানা থেকে। দুইজন একসঙ্গে তাকালো। বাচ্চা ছোট ছোট তুলতুলে হাত পা ছুঁড়ে খিলখিল করে হাসছে এইদিকে তাকিয়ে। হাবীব আর পারমিতাও হেসে উঠলো শব্দ করে। হাবীব বাচ্চার একপাশে উপুড় হয়ে শুয়ে নরম গালে আঙুলের মাথা আলতো দেবে জিজ্ঞেস করলো,
‘ওলে আমাল আম্মুতা… কেন হাসে আমার আম্মু, কেন?’
বাচ্চা তার ছোট্ট ডানহাত উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা হাবীবের গালে আলতো করে লাগিয়ে হেসে উঠলো আবার। পারমিতা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। বাচ্চার তুলতুলে হাতটা যেন স্নিগ্ধ শিমুল তুলো। আর তুলোয় প্যাঁচানো নরম নরম পাঁচটা আঙুল। উহু পাঁচটা নয়, ছয়টা। অতিরিক্ত আঙুলটা ভোরবেলার সূর্যের মতোন বৃদ্ধাঙ্গুলির পাশে প্রবল আগ্রহে উঁকি দিচ্ছে।