পথ কোথায় যে শুরু আর কোথায় যে আমার শেষ তা বোধহয় আমি নিজেও জানিনা। আর আমার এই চলার গতিময়তা কতভাবে, কতরূপে সেটাও আমার জানা নেই। কবে যে কে আমায় প্রথম টেনে আনল, কে জানে। আমি চলেছি এঁকেবেঁকে – গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, চলেছি এক শহর থেকে অন্য শহরের বুক চিরে। আমার উপর দিয়ে হাজার হাজার লক্ষকোটি বছর ধরে চলেছে গাড়ি-ঘোড়া-মানুষ আর যা তোমরা দেখতে পাওনা বা বলা ভালো দেখতে চাও না সেই অশরীরী মানুষের দল। কতভাবেই না আমায় সাজাতে চায় সবাই – আমার বুকে প্রায় প্রতিদিনই কেউ এসে বড় বড় গর্ত খুঁড়ছে আর কত কি যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, সে বিশাল বিশাল পাইপ, তার আরও কত কি তার হিসেব নেই – আর বার বার একই ভুল, আমি বুঝতে পারি কারণ যে যায়গায় দুদিন আগে কেটেছিল সেখানে আবার কেটে ফেলে – আমার যে কি কষ্ট হয়, কি যন্ত্রণা হয় বুঝতেই চায়না – আমার বুক-ফাটা কান্না ওদের কানে পৌঁছায়না। কিন্তু আমার দুঃখ কষ্ট শুধুমাত্র বোঝে ঐ অশরীরীর দল – ওরা যে আসে যায় আমি বুঝতে পারি শুধু ওদের ফিসফিস করে কথা বলায় – কারণ ওরা চলে আমার ওপরের হাওয়ায় ভেসে, আমায় কোনো আঘাত না করে। কতশত ঘটনার সাক্ষী আমি – আমার ওপর কত মানুষের কান্না ঝ’রে পড়ে, আঘাত পায় কত মানুষ আর কত ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে – জানো তখন আমার বুক যেন ভেঙে যায়, সহ্য করতে পারিনা। একেক সময় মনে হয় যে সব ধ্বংস হয়ে যাক আর আমি মাটিতে মিশে যাই। তবে একেক সময় এমন সব ঘটনা ঘটে, যে আমি তাজ্জব হয়ে যাই, আমার বুকে দোলা লাগে আনন্দে। আর এইসব ঘটায় ঐ অশরীরীর দল। দেখেছি ওরা কত মানুষের ভালো করতে চায় আর করেও – আর হ্যাঁ, বেছে বেছে, সবার নয়। আর কেন যে এমন বেছে বেছে করে তা ওরাই জানে। এইতো সেদিন, খুব বেশি দিন আগে নয় – সালটা বোধহয় ১৯৭৮ -এর দিকেই হবে –
তর্ক
শীতের বিকেল। সন্ধ্যে যেন ঝুপ করে নেমে আসে। কি করে যেন খেলবার সময় ছোটো হয়ে যায়। আধো অন্ধকারে আজ শীর্ষ, ঋজু, বাবাই, পল্লব, টুটুনরা খেলার শেষে বসেছে এক গভীর আলোচনায়। আর সেটা হলো ভুত – প্রেত নিয়ে। তর্ক জমে উঠেছে। শুধু একজন নেই আজ – দেব মানে দেবর্ষি।
– তোরা কি জানিস আমি নিজে চোখে দেখেছি ভুত আর সেটা আমার মামাবাড়িতে – আরে সেই যে টাকিতে, বললো শীর্ষ।
– কেমন দেখতে রে সেই ভুতটা? ট্যারা না চোখই নেই! – ঋজু এ কথা বলতেই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো টুটুন
– এই কি হল তোর? বিপ্লব এগিয়ে গেলো টুটুনের দিকে।
– দ্যাখ তবে, বলেই ওর হাতটা দেখালো।
সবাই ঝুঁকে দেখলো টুটুনের হাতে কালশিটে পরে গেছে আর তা হয়েছে বাবাইটার ভয়ে ওর হাতটাকে খামচে ধরার জন্য। বেচারা বাবাই। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে।
– ওরে ভুতের নাম শুনেই এই! দেখলে কি করবি রে? ঋজু হাতটা বাবাই-এর কাঁধে রাখলো।
বাবাই প্রায় কান্না ভেজা গলায় ‘সরি’ বলে জড়িয়ে ধরলো টুটুনকে।
এরা সব সবে ষোলো পেড়িয়ে সতেরোয় পা রাখা কিশোরের দল। মাধ্যমিকের তৃতীয় ব্যাচ। ক্লাস ইলেভেনে পড়ে।
– আরে আজ দেব নেই কেন? ওতো না খেললেও আসে – আজ ও নেই কেন? – হঠাৎ শীর্ষের কথায় সবাই খানিকটা অবাকই হলো!
– দ্যাখ গিয়ে বই মুখে বসে আছে হয়তো – পল্লব বলে উঠলো।
– হতেই পারে আর এতে ওকে দোষও দেওয়া যায়না, ওর জীবনের ইতিহাস আমাদের অনেকের থেকেই আলাদা – ঋজুর কথায় সবাই সম্মতি জানালো।
দেবর্ষি
জীবনসংগ্রাম কাকে বলে কিছুটা হলেও বোঝা যেতো দেবর্ষিকে দেখলে। দেবর্ষির মাধ্যমিক পাশের পরেই ওর বাবা সামান্য সরকারী চাকুরি থেকে অবসর নেন আর দেবর্ষির শুরু হয় সংগ্রাম। কারণ ওর বাবার চাকুরি যতদিন ছিল ততদিন ওদের দু’বেলা দু’মুঠো ভাতডালের অভাব ছিলনা, ছিলনা পড়াশোনার চিন্তা। ওকে চারটে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে কিছুটা হলেও বাবাকে সাহায্য করতে হতো। সে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা – আজ দেবর্ষি প্রতিষ্ঠিত। সেদিনের কথা ভাবতে থাকে দেবর্ষি আর এই ভাবনাটা ওর জীবনে ঘুরে ফিরেই আসে – – – –
বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম আর যুক্তির বাইরে কোনোকিছু মেনে নেওয়া আমার স্বভাবে ছিলনা। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি আর বিজ্ঞানকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি, তাই বন্ধুদের ঐ ভুত-প্রেত, লৌকিক – অলৌকিক আলাপ আলোচনাকে খণ্ডন করতাম যুক্তি দিয়েই। কিন্তু আজও কোনো উত্তর নেই আমার কাছে সেদিনের ঘটনার যা আমারই জীবনে ঘটেছিল, আর কাউকে বলতেও পারিনি – আর বলবই বা কি করে! আমি নিজেই যে তার কোনো উত্তর জানিনা, শুধু এটুকু জানি যে সেদিন ঐ ঘটনা না ঘটলে আজ আমি থাকতাম না বা
যুক্তির ঊর্ধ্বে
১৯৭৮। আমরা থাকতাম সন্তোষপুরে। সে সময়’লোডশেডিং’ একটা বহুল প্রচলিত শব্দ। এমনকি স্কুলের পরীক্ষাতেও ওটা প্রায়ই দেওয়া হতো রচনা লিখতে। আমার এক খুড়তুতো দিদি সদ্য বিয়ে করে আমাদের পাড়াতেই ভাড়া নিয়ে এসেছে। আমার মা প্রায়শই এটা-ওটা রেঁধে বেড়ে দিদিকে নিজেই দিয়ে আসতেন। সেদিন মায়ের শরীরটা একটু খারাপ ছিল, তাই আমি মাঠ থেকে বন্ধুদের সাথে একটু খেলেই বাড়ীতে ফিরতেই বললো
‘দেবু যা না বাবা মীনুকে এই টিফিনকারিটা একটু দিয়েই তুই পড়াতে চলে যা’।
‘মা আমারতো এমনিতেই আজ একটু দেরি হয়ে গেছে, এখন আবার মীনুদির বাড়ি যেতে হলে আরও দেরি হয়ে যাবে। আজ না হয় নাইবা দিলে’- একথা মাকে বলা মানে জানি মা কষ্ট পাবেন। তাই আর কথা না বাড়িয়ে কোনোমতে হাত পা ধুয়ে একটু কিছু মুখে দিয়েই মায়ের দেওয়া ঐ টিফিন-কারি নিয়ে পড়লাম বেড়িয়ে মীনুদির বাড়ির দিকে। আমাদের বাড়ি থেকে বড় রাস্তা পেড়িয়ে ডানে বাঁয়ে তিনটে গলি পেরলেই ওর বাড়ি – মানে ওরা যেখানে ভাড়া থাকে সেই বাড়ি। শীতের বিকেল, ঝুপ করে ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। গলিতে ঢোকার মুখেই চারিপাশের যে দু’চারটে বিজলিবাতি জ্বলছিল, নিবে গেল ঝুপ করে সব আলো – লোডশেডিং! এই যা! আশেপাশের দোকানে আলো জ্বলবে মোমবাতির। তাতেতো কিছু দেখা যাবেনা। আর আমি মাত্র একবারই এসেছি মীনুদির বাড়িতে, গলিটার আন্দাজও তেমন নেই। বড্ড ভুল হয়ে গেছে টর্চ না এনে। আসলে তখন এতো তাড়াতাড়ি করলাম। হঠাৎ দেখলাম একটা আলো – একদম গোল মানে বৃত্তাকার আলো আমার সামনে সামনে চলছে! এমন বৃত্তাকার আলো মানে তো কেউ ওপর থেকে ফেলছে, কিন্তু তা কি করে হয়, ওপরে তো খোলা আকাশ, দু একটা টিমটিমে তারাও দেখা যাচ্ছে। তাহলে কে, কে এই আলো নিয়ে চলেছে! ডানে বায়ে, সামনে পিছনে – কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে নাতো! আর তেমন কেউ আলো দেখালে সেটা একটু ডিম্বাকৃতি হয়ে পড়তো। তবে কে? খানিকটা যেন ঘোর লাগলো। পা মেলালাম ঐ আলোর সাথে।
একি! এ যে কাঠের পাটাতন! এসব কি? এমন দু তিনটে করে পাটাতন পেরোলাম ঐ আলোর সাথে আর এভাবে দুটো গলি পেরোতেই আলো নিভে গেল। আর সামনে দেখলাম মীনুদির বাড়ির গেট। কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দিতে লাগলাম।
দরজা খুলতেই দেখলাম মীনুদি হাতে হ্যারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমায় দেখে অবাক। আরও ভয় পেয়ে গেল আমায় অমন হাঁপাতে দেখে। আমি ঘরে ঢুকে চেয়ারটায় কোনোমতে বসে এক গ্লাস জল চাইলাম।
মীনুদি জলের গ্লাসটা দিয়েই প্রশ্ন করলো’ তুই এই অন্ধকারে ঐ গলি দিয়ে এলি কি করে ভাই? আমাদের গলিতে জলের পাইপ বসছে-বড় বড় গর্ত করে, তুই এমন হাঁপাচ্ছিসই বা কেন? টর্চ ছাড়াই বা কেন বেরোলি? এখনতো যে কোনো সময় লোডশেডিং হচ্ছে – বল আমায়’
কি করে এতো প্রশ্নের উত্তর দিই। আর আমিতো আমাতে নেই। মাথা গুলিয়ে গেছে। হাত পা কাঁপছে। শুধু ভাবছি কে দেখালো ঐ আলো? কেন দেখালো? ঐ আলো না দেখালে আমার অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটতোই আজ। ভাবতে পারছিনা, একদম ভাবতে পারছিনা – আমার বিজ্ঞান, আমার যুক্তি-তর্ক সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে – সব কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে – জ্ঞান যখন এলো, দেখলাম ঘরে শুয়ে আর দু তিনটে মুখ আমার ওপর ঝুঁকে রয়েছে – সবার ঐ একই প্রশ্ন – যা আমার আজও অজানা!
পথ দেখলে, কেন বলেছিলাম যে মাঝে মাঝে আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি ঐ অশরীরীর দল কাউকে বাঁচায়! আর হ্যাঁ এও দেখেছি ওরা বেছে বেছে ভালো মানুষদেরকে বাঁচায় – আমিতো জানি ঐ দেবর্ষি খুব ভালো, আমিতো চিনতে পারি – কারণ আমি যে বুক পেতে ওদেরকে বড় করি! কি চিনতে চাও না কি এমন সব মানুষদের?