অমৃত পুত্র | ভয়ের দেশ |নুজহাত ইসলাম নৌশিন| Bengali Horror Story
1 (1)

Getting your Trinity Audio player ready...

মরে গেলো!

একদম মরে গেলো! এত সহজে কেউ মরে যায়? স্রেফ একটা ধাক্কার মতো… না নাহ – এখন কি হবে? আরে এত সহজে কেউ মরে নাকি! এই তো একটু আগেও বাড়ি মাথায় তুলে কি তুমুল চিৎকার করছিলো মানুষটা। আর এখন – নিঃসাড় হয়ে টেবিলের পায়ার কাছে আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে। মরে পড়ে আছে। কপালের ডান পাশে ক্ষীণ রক্তধারা সাদা পাঞ্জাবিতে গড়িয়ে আলাদা ডিজাইন হয়ে যাচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবিতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে বড় বড় বলের সৃষ্টি হচ্ছে। আচ্ছা কয়টা বল হতে পারে?

গড়িয়ে পড়ে থাকা লোকটা কি কি যেন বলছিলো- স্টুপিড, ইডিয়ট আর বাস্টার্ড। ওই শেষ শব্দটাই মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল। নয়তো আমি তো ধাক্কা দিতাম না। লোকটা রেগে গেলেই ইংরেজি গালি ঝাড়ত। তা ঝাড়ুক যত ইচ্ছে, কিন্তু ওই শব্দটা – বাস্টার্ড, হা কানে বড্ড বেশি লেগেছিল। আর কান থেকে একদম মাথায় লিটল বয়ের মতো ফেটে পড়ল।

‘দু পয়সার মুরোদ নেই। এই সেলিম মামা না থাকলে না কপালে দুমুঠো খাবার জুটতো না। পেটে লাথি পড়ত। লাথি-

স্টুপিড, ইডিয়ট, বাস্টার্ড – বেজন্মা কোথাকার।’

ইশ্! লোকটা বাস্টার্ড এর বাংলাও বলে দিল। এতটুকু কি আর আমি জানতাম না।

কই থেকে যে কি হয়ে যায়। বিশ্বাস করুন আপনারা -আমার একদমই ইচ্ছা ছিলো না। অন্নদাতাকে কে চায় দুনিয়া থেকে সরাতে। আর ধরতে গেলে কাজটা আমার ও না। মানে যেটা আপনারা খুন বলে ধরে নিয়েছেন। আর খুন যদি ধরেই থাকেন আমার তো কিছু করার নাই। আপনাদের মন আপনারা যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন। সে স্বাধীনতা পুরো মাত্রায় পাঠকের আছে। আমি শুধু আমার গল্পটা বলে যাচ্ছি।

যা বলছিলাম – টেবিলের পায়ার কাছে মামাকে মানে আমার আশ্রয়দাতাকে পড়ে থাকতে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভয় হয়েছিল কুকুরের তাড়া খাওয়া মানুষের মতো। মনে হচ্ছিল ছুটে পালাই। কিন্তু বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। মাথা আমার অবশ্য অতিদ্রুতই ঠাণ্ডা হয়েছিল।

বোকার মতো পালালে দোষটা আমার ঘাড়েই পড়ত নিঃসন্দেহে। অপরাধ করে পালিয়েছ তো নিজের কবর নিজে করেছ। পালানোটাই যে দোষ। আমি পালাই নি। মৃত মামার দেহের কাছে বসে ছিলাম এক ঘণ্টা। অবাক লাগছে না? এক ঘণ্টা শুধু তার মৃত দেহের পাশে বসেছিলাম – নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম সত্যি মরল তো। তার মৃত্যু নিশ্চিত করে – আমি আশ্রয়দাতা মামার নন্দন মায়া থেকে বের হয়েছিলাম। খবরটা প্রচার করতে। আমি এখন প্রচারক কি না! এবং একই সাথে প্রতারক ও।

খুব কাছের বন্ধুদের আমি খবর দিই নি। দূর সম্পর্কের ফর্মালিটি বন্ধুদের আমি খুঁজে নিয়েছিলাম। যাদের সাথে বছরে এক কি দুই বার দেখা হয়। আমার কাছের বন্ধুরা জানত মামা লোকটার সাথে আমার পক্ষ থেকে বিষময় সম্পর্ক ছিলো। যত স্নেহ করুক না কেন- পারলে স্নেহ, আমিষ সব কিছু উজাড় করে দিক আমি থাকে সহ্য করতে পারতাম না। একদমই না। সাধে কি বলে পালা কুকুর বেইমানি করে না কিন্তু রক্তের সম্পর্ক বেইমানি করে। আমিও করেছি। করতে বাধ্য হয়েছি।

নন্দন মায়া থেকে বের হয়ে ফিরোজের কাছে গিয়েছিলাম। আমার দূর সম্পর্কের এবং কাজের বন্ধু।

‘মারা গেছেন? কিভাবে?’

‘ওই যে হুট করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। পড়ে যাওয়ার সময় টেবিলে মাথায় বাড়ি খেয়ে –’

ফিরোজ আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। মৃত্যুটাই বড় কথা, উপলক্ষ গৌণ। কিন্তু ভিতরে ভিতরে হৃদপিণ্ড মনে হচ্ছিল ঢাক বাজাচ্ছে তখন। এত শব্দ ও যন্ত্রটা করতে পারে! অবাক হয়েছিলাম। নিজের শরীরে এই হৃদপিণ্ড এতদিন চুপ করে ছিল আর আজ কি পাপের সাক্ষী দিতে জেগে উঠেছে নাকি!

বেশি বড়লোকদের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক খারাপ থাকে। সেলিম মামার একটু বেশিই ছিলো। তাকেও আমি দোষ দিই না। বড়লোক আত্মীয় স্বজন হাতের কাছে পেলে গরিব আত্মীয়গুলো কেমন বেহায়া মতো হয়ে যায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি। মামার কাছে মানুষ হওয়ার সুবাদে কত কিছু দেখলাম, শিখলাম। অবশেষে মামার উপরই প্রয়োগ করলাম। বেইমান আর কাকে বলে।

আমার কাজের জন্য আমার কোনো অনুশোচনা নেই। তবে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক খারাপ থাকায় আমার সুবিধাই হয়েছে। তাদের খবর দেওয়া হয়েছিল তারা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অনিচ্ছাকৃত লৌকিক দুঃখ প্রকাশ করে ভদ্র ভাবে বলে দিয়েছে আসতে পারবে না। কতটা নিঃসঙ্গ ছিলেন বুঝতে পারছেন আপনারা? কেউই আসলো না তার তথাকথিত কাছের মানুষরা! টাকা টাকা করে লোকটা আর কাউকে গ্রাহ্যই করত না – আর ফলাফল দূরত্ব। যাহোক এসবে আমার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। কবর দেওয়ার কাজটা দূর সম্পর্কের বন্ধু আর স্থানীয় মসজিদের ইমাম নিয়ে হয়ে গিয়েছিল।

‘আহা গো, মাটির মানুষ ছিলো একখান।’ স্থানীয় মসজিদের ইমাম মনে হয় কথা গুলো মন থেকেই বলছে। অবশ্য সেলিম মামা ইমামের মেয়ের বিয়েতে নগদ এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। ধার না, একেবারেই। মাটির মানুষ এই কারণেও বলতে পারে।

মৃত মানুষ দোষ গুণের বাইরে। মরার পর তার নামে ভালো ভালো কথা বলতে হয়। সেলিম মামার একটা ভালো গুণ তিনি দূরের মানুষকে দিলখুলে সাহায্য করতেন আর কাছের মানুষকে ধুর ধুর করতেন। এটা অবশ্য ভালো খারাপ মিলিয়েই বললাম। আলো থাকলে তো অন্ধকার থাকবেই। ব্যাপারটা এরকমই।

গল্পের যেখানে শেষ হওয়ার কথা দুঃখজনক হলেও সত্যি – গল্পের এখান থেকে শুরু। আর শুরু আমার ভয় যাত্রার। ভাবছেন ভূতের গল্প ফাঁদছি? মোটেও না। একদম যা সত্যি – চোখে দেখা, কানে শোনা এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা তাই বলছি। সত্যি বই মিথ্যা নয়।

শুরু করি আমার ভয় যাত্রার গল্প।

কবর দিয়ে আসার পর আমি টেবিলের পায়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম কিন্তু দেখছিলাম না। অকারণেই তাকিয়ে ছিলাম। মাঝে মাঝে তো আমাদের এরকমই হয়েই যায় – তাই না?

সেই রাতে এত ভালো ঘুম হয়েছিল। ঘুমের মধ্যেই মনে হয়েছিল আমার বাকি জীবন না ঘুমালেও হয়ত চলবে। কিন্তু এই ঘুমের ভাবনা যে সত্যি হবে কে জানত। কেউ জানত না। আমিও জানতাম না।

সেলিম মামা মরার পর পুরো তিন তলার মালিক আমিই বলতে গেলে। স্ত্রী – পুত্রের কোনো ঝামেলা তার ছিল না। সব মিলিয়ে অলিখিত মালিক আমিই। কিন্তু বিপত্তি তো আছেই – আমার মতো বাস্টার্ডকে সম্পত্তি, বাড়ি, ব্যবসা লিখে দেওয়ার মানে হয় না। মরার আগেই উইল করে গিয়েছিলেন তার সমস্ত সম্পত্তি সুফিয়া সদন অনাথ আশ্রমে দান করে দেওয়ার কথা। ওই সিনেমার মহৎ মানুষেরা যা করে আরকি। আর আমার জন্য ছিলো সাইকেলের একটা দোকান। ভাবা যায়?

জানি আপনারাও সেলিম মামাকে সাপোর্ট করবেন। অপদার্থ ভাগ্নে কে কবে কোন মামা সব দিয়ে দিয়েছে। ভাত – কাপড়ে রেখেছেন তাই তো বেশি। কিন্তু আমাকে রাখার দায়টা তার কাঁধে বর্তায়।

সেলিম মামা আর আমার মা ছোটবেলায় অনাথ হয়। তারপর সেলিম মামা নিজের হাড়ভাঙা খাটুনিতে এই জায়গায়। আর নিজের উন্নতির জন্য আমার মাকে বলতে গেলে সস্তায় তার ব্যবসার লম্পট পার্টনারের কাছে একরকম বিয়ের নামে বেচে দিয়েছেন। আর আমার লম্পট বাবার লাম্পট্য আর মায়ের উপর অত্যাচার এত বেড়ে গিয়েছিল যে আমার মা শেষ-মেশ নন্দন মায়ার তিনতলা থেকে লাফ দিতে বাধ্য হয়। আর তিন বছরের বাচ্চা আমি সিন্দাবাদের ভূতের মতো মামার ঘাড়ে চড়ে বসি।

অনুতাপ এবং অনুশোচনা বোধের ডোজ মামার বেশি মাত্রায় জেগে উঠেছিল- তাই না আমি আশ্রয় পেয়েছিলাম।

মা যতদিন বেচেছিল ততদিন আমার নাম ছিল পীযূষ। পীযূষ মানে জানেন? নিশ্চিত জানেন না। ‘পীযূষ’ মানে অমৃত। হাহ, জীবন্ত এক বিদ্রূপ নামটা তাই না? গরলে ভরা জীবনে নাম রেখেছে অমৃত!

মা মরে গেল আর আমার নামটা রাতারাতি বদলে গেল।

‘এ্যা – পীযূষ! এটা কোনো নাম হলো রে?’

আমি অসহায় চোখে বলেছিলাম, ‘আমার তাহলে কোনো নাম থাকবে না?’

‘থাকবে না কেন– ওই রাজু – ফাজু কিছু একটা রেখে দিলেই হবে। অমৃত কোন নাম নাকি!’

ওই অবজ্ঞার মতো আমার জীবনটাও বদলে গেলো রাতারাতি। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথেই।

ভূতের গল্প গুলোতে মৃত মানুষের আত্মাই হোক আর ছায়া মানুষই হোক সেই পদার্থ রাতে আসে। আমার বেলায় উল্টোটা হল।

প্রথম মামাকে দেখতে পাই – তার মৃত্যুর সাতদিন পর। একদম গুণে গুণে সাতদিন পর। ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করব, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পরে ভাবলাম থাক। মরে গেলে আর থাকা না থাকা সমান। ভালো – মন্দে তখন কিছু যায় আসে না।

সেলিম মামা উৎপাতের মতো দিনেই না তারপর রাতেও থাকা শুরু করলেন। ভাবছেন তাতে ভয় পেয়েছি? মোটেও না। আমার ভয় অন্য জায়গায়।

ঘুমাতে গেলেই ভয়টা তাড়া করে। প্রবল একটা আতঙ্ক – এই বুঝি গলা টিপে ধরল! প্রায় তিন মাস ধরে দিনে -রাতে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কেউ গলা টিপে ধরবে এই ভয়ে হয়ত দিন পার করা যায় কিন্তু ঘুমানো যায় না।

প্রথম দিন মামা এসে তেমন কিছু বলেনি। সরি, মামার ছায়া। কেমন একটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিলো যেন ব্যবসায় বড় ধরনের মার খেয়েছেন।

প্রথমে ছায়া মামা সেলিম তালুকদারকে চোখের ভুল বলেই ধরে নিয়েছি। কিন্তু বিকেলেও যখন দেখি একই জায়গায় বসা তখনই খটকা লাগল। দুপুরে আসলো ভালো কথা এতক্ষণ বসে থাকা কেনো? কিন্তু লোকটার নিজের বাসা যখন – তখন আসতেই পারে। খটকা লাগলেও আর খোঁচাখুঁচি করলাম না। বসেই তো রয়েছে, আচ্ছা থাকুক।

কিন্তু বসে থাকলে তো সমস্যা ছিল না। সমস্যা শুরু হল যখন রাতে ঘুমাতে গেলাম তখন দেখি আমার মাথার পাশে চেয়ার নিয়ে বসা। ছায়া শরীর চেয়ার টানাটানি করতে পারে সেটা প্রথম জানলাম তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর।

সারাদিনে যেহেতু কথাবার্তা হয়নি আবার আমার শোয়ার ঘরে মাথার পাশে বসা। ভদ্রতা করে কিছু বলতেই হয়। তাই বললাম, ‘তারপর কি মনে করে?’

‘তুই আমায় মারতে পারলি?’

গলার স্বরটা শুনে বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। এ গলার স্বর মনে হচ্ছে কোন শূন্য থেকে ভেসে আসছে আর কী হতাশা গলায়।

‘কেন মারলি আমায় রাজু?’

‘আপনাকে আমি মারি নি। আপনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আর তারপর তো –’

ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোকে বাস্টার্ড বলে ছিলাম তারপর তুই আমায় একটা ধাক্কা দিয়েছিলি।’

গলার স্বরে জোর দিয়ে বললাম, ‘মরে গিয়ে কি আপনার এসব মনে আছে। যতসব ভুলভাল বকছেন মামা। যান ঘুমান। আমি ঘুমাব – আপনার মরার পর সব সামলাতে অনেক ধকল গেছে, দয়া করে ঘুমাতে দিন।’

মৃত মামাকে কথাগুলো যত সহজে বলে ফেলেছি, জীবিত মামাকে কথাগুলো বলা ততটাই কঠিন আমার কাছে।

তারপর তিন মাস যাবত একই দৃশ্য। একই কথা। প্রতি রাতে একই ঘ্যান -ঘ্যান ‘আমায় কেন মারলি রে? আমি তো তোকে…’

কি চায় লোকটা? বেঁচে থাকতে শান্তি দিল না আর মরে গিয়ে মূর্তিমান টেপ রেকর্ডে রূপান্তর। ওহ্, অসহ্য।

শান্তিতে ঘুমানোর জন্য রাত দশটায় নিজের রুমের দরজা ছিটকিনি লাগিয়ে আবার লক করে শেষ রক্ষা হল না। ঠিক রাত এগারোটা তেত্রিশে চেয়ারে বসা।

ভয়ের সাথে বাস করতে করতে এক সময় হয়তো ভেঙে যায় নয়ত যা ঘটমান তা স্বাভাবিক লাগে। আমার স্বাভাবিক লাগছে না, অস্বস্তি হয়। একজন মানুষ মরার পরে হাহাকারের মতো একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে – প্রতিদিন। ‘আমায় মারলি কেন রাজু?’

উফ! কেন মারলাম সে কি জানে না? নাকি তার কাছে স্বাভাবিক লাগে সব! বাস্টার্ড – প্রতিঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরে বেড়ায় বিদেহী আত্মার মতো। আর কি চায়? কি চায় আসলে?

আমার মা অসাধারণ রূপবতী এক নারী। এতটুকু স্মৃতিই মনে আছে আমার। তার দেওয়া নামটাও আমার রইল না। মামা সব বদলে দিল। ছয় বছরের একটা বাচ্চাকে গিনিপিগ বানিয়ে ক্রমাগত এক্সপেরিমেন্ট করেছে।

নাহ্, আদর যত্নের কোন কমতি হয় নি। চাহিবার মাত্র সব হাতের মুঠোয়। এসব কি শুধু স্নেহের বশে – আমার তো তা মনে হয় না। যদিও তার ছায়া আত্মা প্রতিদিন তার স্নেহের ফিরিস্তি শোনায়।

মরার পর সেলিম তালুকদার বেশ নমনীয় হয়ে গেছেন। প্রথমদিকে মনে হতো গলা টিপে ধরবে এখন আর ভয় লাগে না। ভয় যাত্রা সমাপ্ত। কিন্তু বিবেক মামা ছাড়বে কেনো, প্রতিদিন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, ‘মেরে কি লাভ হল তোমার? লোভের জন্য মারলে?’

এযে মহা যন্ত্রণা। বিবেক মামা আর সেলিম মামা ক্রমাগত দায়িত্ব নিয়ে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

এই তো সেদিন ছায়া সেলিম তালুকদারের উপর রাগই উঠল। পেয়েছে কি? আমি রিমান্ডের আসামি নাকি?

‘কেনো মারলাম জানো না? ন্যাকা সাজছো এখন? আমার মায়ের সর্বনাশ তো তুমি করেছো – টাকার লোভে লম্পটের হাতে তুলে দিয়েছিলে – মনে পড়ে না?এই যে সম্পদের পাহাড় এ আমি তোমাকে ভোগ করতে দিবো না। কখনো না। এই জন্য তোমায় –’

মরার পর মানুষের শরীর ভেঙে যায় কি না জানি না। কিন্তু মামার শরীর বেশ ভেঙে গিয়েছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে ক্লান্ত শূন্য গলায় বলল, ‘এগুলো আগে বললি না কোনোদিন। আমি তোকে সব লিখে পড়ে দিতাম। মারার কি দরকার ছিলো!’

হা হা হা। মরার পর ও কি ধুরন্ধর! সব অনাথ আশ্রমে উইল করে এখন বলছে তখন নাকি আমায় লিখে দিতো। ‘মিথ্যেবাদী কোথাকার! উইলটা তাহলে কি শুনি? এই যে আগুনে পুড়লাম আপনার সামনে।’

আগুনে উইল পুড়ার সাথে সাথে মামার স্বপ্ন ও পুড়ে দিয়েছিলাম। তার চোখে মুখে ছিল স্বপ্ন ভঙ্গের তীব্র যন্ত্রণা। আত্মার স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণায় আমার একটুও কষ্ট হয়নি, একটুও না।

এই যে এতক্ষণ ধরে গল্প বললাম – না না শেষ হয়নি এখনো। এই যে গল্প বলছি, আপনারা আমাকে খুব পিশাচ টাইপ কিছু ভাবছেন। ভাবারই কথা। ভাবুন সমস্যা নেই। আমি আমার গল্প বলে শেষ করি।

আমার মামা যেহেতু অল্প বয়সে মা – বাবা হারিয়েছিলেন সেহেতু তার মনের একটা কোমল দিক ছিল এতিম, অনাথদের জন্য। হা হা হা – অনাথবন্ধু নাম দিলে ভালো হয় এমন চরিত্রের। যাইহোক, অনাথবন্ধু ওরফে আমার মামার ইচ্ছে ছিল তার নিজ হাতে গড়া সুফিয়া সদন অনাথ আশ্রমে এমন একটা পরিবেশ করবেন যেন বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলি কেউকেটা হয়ে উঠে। আমার বলার ভাষা শুনে আপনারা হয়তো ধরতে পারছেন আমি তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কতটা বিরক্ত। অনাথ তো অনাথই থাকে – মায়ের আদর না পেয়ে কে কেউকেটা হয়েছে কবে!

মামার আত্মা যেমন ঘুরে তেমন মায়ের আত্মা ও মাঝে মাঝে এখন আসে। আগে অবশ্য কখনো মায়ের আত্মা আসেনি। ওই মামা মরার পরই হুটহাট আসে। চুলে বিলি কেটে দেয় – আর রাজ্যের কত গল্প গুনগুনিয়ে করে। আচ্ছা, জীবিত এবং হতাশ মা তো কখনো এরকম করেনি। সে ছিল বোবা প্রতিমা। তার পিঠ জুড়ে থাকত বেল্টের দাগ। তার গোটা জীবনটা ছিল ট্র্যাজেডি সেখানে আলাদা গল্প জন্ম নেয় না।

এইসব বেল্টের দাগ দেখে আমার অনাথ বন্ধু মামা বলেছিলেন, ‘আহা! এরকম তো সংসারে হয়েই থাকে। থাক আমার কাছে দু এক দিন। তারপর চলে যাস। শত হলেও জামাই। আর ছেলেদের একটু আধটু দোষ ধরতে নেই।’

তার ব্যবসায়ের পার্টনার ওরফে আমার বাবার দোষ তার কাছে একটু এবং আধটু! মজা না অনেক?

আমার মা শুধু বলেছিল, ‘তোমার এত বড় বাসা এখানে একটা রুম দাও। আমি অমৃতকে নিয়ে থাকি। ওর বাবার ছায়ায় থাকলে ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাবে।’

‘এসব তোর ভুল ধারণা। ছেলে বাপের কাছে না থাকলে মানুষ হয় না। কিছুদিন থাক, সমস্যা নেই।’

‘কিন্তু এত বড় বাসায় একটা রুম দিলে তোমার কম পড়বে না তো – ‘‘ইই – এসব আমার করা। বাপের সম্পত্তি না।’

এরপর হয়তো আর কথা চলে না। কিন্তু মার খেতে খেতে সহ্য সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া মা বলেছিলেন, ‘টাকার লোভে তুমি ওই লম্পটের কাছে বিয়ে দিয়েছ। বুঝি না আমি কিছু? আমার জীবন তুমি নষ্ট করেছ। মায়ের পেটের ভাই হয়ে এমন করলে। ছিঃ।’

উত্তরে মামা বলেছিলেন, ‘নিমকহারাম।’

ডাহা নিমকহারাম আমি। ঘরের খেয়ে ঘরেই ফুসস।

মায়ের মৃত্যুর পর সেলিম তালুকদারকে একটা বড় সাইজের দৈত্য মনে হত। তবে এই দৈত্য আমার কোন ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেনি। সে ছিল আমার ইচ্ছে পূরণের দৈত্য। তাতে কি – আমার তো মা ছিল না। চাওয়া মাত্র পাওয়ায় কি মায়ের জায়গা দখল করতে পারে?

ছায়া মা বেশ হাসি খুশি। ইদানীং বেশির ভাগ রাতে মাথার কাছে ছায়া মা থাকে। উইল ছেঁড়ার পর থেকে মামার আসা যাওয়া কমে গেছে।

‘মা জানো, তোমার ভাইয়ের তো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি।’

‘ধুর, হতচ্ছাড়া। আমার বড় ভাই – তোর মামা হয়। এভাবে বলতে হয় নাকি।’

‘বেশ করেছি। লোকটা যখন বেঁচে ছিল তখন ও সহ্য হয়নি আর এখন যখন মারা গেছে – কি বলবো, এখন আরও বেশি অসহ্য লাগে।’

‘ছিহ্, এসব বলতে নেই। লোকটা লোভী, স্বার্থপর কিন্তু তোর জন্য তো কিছু কম করে নি।’

‘কিছু যায় আসে না তাতে। তার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে সে আমার জন্য করেছে, যে তোমার কষ্ট বুঝেনি –’

‘থাক না, ভাইজান অনুতপ্ত। আমার সাথে তো এখনো দেখা করল না। সেলিম ভাইকে বলিস আমি মাফ করে দিয়েছি।’

‘তুমি করেছ, কিন্তু আমি তো করিনি।’ আমি ওকে – কথা শেষ হওয়ার আগে ছায়া মা মিলিয়ে যায় আবছায়ায়।

কয়েকদিন ধরে বেশ ভেবেছি। আচ্ছা এমন ও তো হতে পারত অনাথ আশ্রম চালানোর দায়িত্ব আমার কাঁধে দিত, আমি তো উইলটা সম্পূর্ণ না পড়েই জ্বালিয়ে দিয়েছি। মনের একাংশ বলছে- ক্ষমা, ক্ষমা। আরেক অংশ বলছে- অত মহৎ হয়ে কোন আলু ভাজা তুমি ভাজবে! তাই তো, তাই তো। দ্বিতীয় অংশটাই ঠিক। আমি কখনো ক্ষমা করবো না, কখনো না।

উৎপাত আবার এসে হাজির। তবে গ্যাপ দিয়ে আসছে এবার। আতিথেয়তা দেখাব নাকি? এখন আর এসে আগের মতো ঘ্যান ঘ্যান করে না। ছায়ার শরীর এবং গলার জোর কোনোটাই নেই। কি নিয়ে লড়বে?

বুঝলি আমি ভেবে দেখলাম, আমার অন্যায় হয়েছে। পাপের সাজা মরেও কমছে না। আত্মাটা বুঝলি ভারী হয়ে কোথায় আটকে আছে। তোকে গালি দিলাম – কি আর চেয়েছিলি, হাজার খানেক টাকা। কিন্তু মাথাটা এত গরম ছিল – তোর খবিশ বাবা আমার ব্যবসার ভরাডুবি হাল করে ছেড়েছে। তার উপর তুই টাকা টাকা করছিলি তারপর কি থেকে কি হয়ে গেলো যে। আমার মনেই ছিল না তুই বড় হয়েছিস। তুই রেগে আমায় একটা ধাক্কাই তো দিয়েছিলি। আর তো কিছু করিস নি – নাহ্, তোর উপর আমার কোনো রাগ নেই।’

আমি হাতে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। কতদিন পর কাঁদছি? অনেক বছর পর, অনেক বছর।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 1 Average: 1]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কুয়াশার ধোঁয়াশা | ভয়ের দেশ |সুব্রত দত্ত| Bengali Horror Story Previous post কুয়াশার ধোঁয়াশা | ভয়ের দেশ |সুব্রত দত্ত| Bengali Horror Story
Next post অর্ধেক দাদু অর্ধেক বঙ্গবন্ধু | ভয়ের দেশ |কবির কাঞ্চন| Bengali Horror Story