আলোআঁধারি ও মায়াকানন | ভয়ের দেশ |সৈকত সাহা| Bengali Horror Story
0 (0)

নদীয়ার দাসপাড়ার “চিত্রপট” নাট্যগ্রুপ কালীপুজো উপলক্ষে এবারে এক নতুন নাটক আনতে চলেছে যার নাম “আলোআঁধারি ও মায়াকানন।” দাসপাড়ার এই থিয়েটার দলটি গত পাঁচবছরে বেশ নাম করেছে। নিজেদের জেলা তো বটেই, এমনকি পাশাপাশি জেলাগুলিকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে ওদের নাটক মঞ্চস্থ করে। জনাকয়েক তরুণ ছেলেমেয়ে আর কিছু মধ্যবয়স্ক লোক এই গ্রুপটাকে চালায়।

আর কদিন পরই ওদের নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে। তাই এখন জোরকদমে চলছে মহড়া। দিনরাত এক করে চলছে নাটকের প্রস্তুতি। এবারের নাটকটি সম্পূর্ণ আলাদা। যেহেতু সামনেই কালীপুজো, আর ওদের নাটকটা মঞ্চস্থ হবে ভূত-চতুর্দশীর দিন। তাই নাটকের বিষয়ে একটা ভৌতিক ব্যাপার থাকছেই। ওরা এর আগে বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে কিছু নাটক করেছে। সে সব নাটক খুব বড়ো সাফল্য না পেলেও, অনভিজ্ঞ দল হিসাবে ওরা যা করেছে তার কৃতিত্ব নেহাত কম নয়। কল্যাণী শহরে ওদের নাটক দেখে কলকাতার বিখ্যাত নাট্যদল “জাতিস্মর” এর নাট্যকার শ্রী অভয়প্রসাদ মিত্র ওদের সাথে একবার কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন। ওদের নাটকের মূল লক্ষ্য হল নাটকের মধ্যে দিয়ে বাংলার মানুষের কথা তুলে ধরা। মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল চিত্রপটের নাটক মানেই সামাজিক কোনো বিষয়। তাই কিছুটা নাটকে পরিবর্তন আনতে আর কিছুটা দর্শকে চমক দিতেই তাদের এই নতুন প্রচেষ্টা।

এবারে নাটকটিতে ওরা বাংলা সাহিত্যের কোনো বিখ্যাত লেখকের নাটককে নাট্যরূপ দিচ্ছে না। এ নাটকটি ওদের দলের তরুণ সদস্য বিভাসের লেখা। বিভাস কল্যাণী ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র। প্যারানরমাল বিষয়ে ইন্টারেস্টেড বিভাস তাই অলৌকিক বিষয় নিয়ে নাটক হতে চলেছে জেনে নাটক লেখার গুরুদায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। বিভাসের ভৌতিক বিষয় নিয়ে লেখা নতুন কিছু নয়। এর আগেও অনেক প্রতিযোগিতায় ও ভৌতিক গল্প লিখে পুরষ্কার নিয়ে এসেছে। তাই এবারেও ওর থেকে ভালো কিছুই আশা করে সবাই। ওর লেখা নাটক নিশ্চয়ই হতবাক করে দেবে সবাইকে।

দেখতে দেখতে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিন প্রায় এগিয়ে আসছে। হাতে মাত্র আর চারটে দিন। উন্মাদনা আর প্রস্তুতি তুঙ্গে। কারও যেন দমফেলার ও অবকাশ নেই। হেমন্তের ঠাণ্ডা বাতাস শীতের আভাস দিলেও, ওরা যেন প্রত্যেকেই গ্রীষ্মের তপ্ত বালুরাশির মতো উত্তেজনায় ফুটছে। এরমধ্যেই আচমকাই এক দুঃসংবাদ আসে। নাটকের জন্য সাজসরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্ট হয় বিভাসের। খবর শোনামাত্রই হসপিটালে ছুটে যায় ওরা সবাই। পরদিন দুপুরবেলা লৌকিক জগতের মায়া কাটিয়ে বিভাস পাড়ি দেয় না ফেরার দেশে। মৃত্যুর আগে বিভাস বলে যায় তার জন্য যেন ওরা নাটক বন্ধ না করে দেয়। আর এবারের শোটাও যেন হয়। এটাই তার শেষ ইচ্ছে।

কারও যেন আর নাটক করারই ইচ্ছে নেই। এটাই তো স্বাভাবিক। যে বিভাস ওদের নাটকের উদ্যোক্তা সেই আজ নেই, অথচ দুদিন আগেও সে সবাইকে উজ্জীবিত করতো। ভুল ঠিক করে দিতো, আজ কে এসব করবে? তবু বিভাসের যেহেতু শেষ ইচ্ছে ছিল ওদের নাটক হবে, তাই ওদের যত কষ্টই হোক ওদের নাটক মঞ্চস্থ করতেই হবে। বিভাসের এ নাটকে একটি ছোট্ট রোল রয়েছে। তাই বিভাসের জায়গায় ওদের পাড়ারই একটি ছেলেকে নেওয়া হল। তাকেই ওই দিনদুয়েকেই কোনোরকমে তার রোলটা বুঝিয়ে দেওয়া হল।

অবশেষে উপস্থিত সেই দিন। আজই নাটক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ঠিক সন্ধ্যে ছ’টায়। প্রত্যেকের মন ভারাক্রান্ত হলেও মুখ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। হাজার হোক অভিনেতা তো, কষ্টকে লুকিয়ে রাখাই যে কাজ। কান্না পেলেও আজ যে কাঁদা বারণ।

গ্রিনরুমে চলছে সাজসজ্জা। নাটকের খসড়ার পাতায় চোখ সবার। যে যার পার্ট একবার দেখে নিচ্ছে শেষ লগ্নে। বাইরে হলে গমগম করছে লোক। মঞ্চসজ্জার কাজ প্রায় শেষ। আর কিছু পরেই সরে যাবে পর্দা, হালকা নীলচে আলোয় শুরু হবে “চিত্রপট” নাট্যদলের নাটক “আলোআঁধারি ও মায়াকানন।”

ঘড়িটি সন্ধ্যে ছ’টা। ধীরে ধীরে সরে গেলো পর্দা। শুরু হল চিত্রপটের নাটক। গোটা মঞ্চে তৈরি হয়েছে ভৌতিক আবহ। হলে বসে থাকা দর্শক যেন এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারছেনা মঞ্চ থেকে। গোটা হল বিস্মিত ওদের অভিনয়ে।

দেখতে দেখতে দুঘণ্টার নাটকের একঘণ্টা তিরিশ মিনিট অতিক্রান্ত। আর মাত্র কিছুক্ষণ, তারপরেই নাটকের যবনিকা পতন। এবারের আসতে চলেছে বিভাসের পার্ট। তবে বিভাস তো নয়, আজ বিভাসের জায়গায় পার্ট তো করবে অন্য কেউ।

কিন্তু এ কী! কে আসছে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে। মঞ্চে থাকা চিত্রপটের দুই সদস্য সুশোভন, রাজীব যেন নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা। এ যে হুবহু বিভাস, নাটকের খসড়াতে ছিল মৃত্যুর পর মায়াকাননে উপস্থিত হবে এক ব্যক্তি;যে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসবে। আর সেই ব্যক্তির ভূমিকাতেই তো ছিল বিভাস। কিন্তু বিভাস এখানে কী করে আসবে? ও তো নেই আর। দিনতিনেক আগে তো মারা গিয়েছে। ওরা মানে সুশোভন আর রাজীব ওর গাড়ির ব্রেকফেল করিয়ে ওকে মারে। ওদের আক্রোশের কারণ ছিল একটাই। সবাই শুধু বিভাসকে নিয়েই মেতে থাকতো। আর বিভাস ওদের দু’জনকে একটু ভুল হলেই সবার সামনে বকতো। একবার তো ওদের নেশা করার কথাও ওদের বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিল। তবে দিন সাতেক আগে যখন ওদের নাটকের মহড়ার সময় ভুল হয়ে যাওয়ার বিভাস বলে ওদের দু’জনকে বার করে দেওয়ার দরকার দল থেকে। তখনই ওরা ঠিক করে, আর নয় এবার ওকেই দল থেকে চিরতরে সরাবো। কথামতো কাজও সারে ওরা। লোক লাগিয়ে ওর গাড়ির ব্রেকফেল করিয়ে ওকে খুন করে।

আর তারই কী প্রতিশোধ নিতে সত্যিই এল বিভাস? না না, তা হতে পারেনা। ক্রমশ সামনে এগিয়ে আসছে বিভাস। ওরা পিছোচ্ছে। হঠাৎ করেই বিভাস ওর দুটো হাত দিয়ে চেপে ধরলো সুশোভন আর রাজীবের গলা। ওরা যেন শত চেষ্টা করেও বাধা দিতে পারছে না বিভাসকে। অসম্ভব জোরে চেপে ধরে আছে ওদের গলাদুটো বিভাস। সামনের সারিতে বসে থাকা দর্শকরা ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়লো শরীর দুটো। পড়ে গেলো মঞ্চের মেঝেতে। মৃত বিভাসকে স্বচক্ষে নাট্যমঞ্চে দেখতে পেলো চিত্রপট ও তার দর্শকমহল।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post অর্ধেক দাদু অর্ধেক বঙ্গবন্ধু | ভয়ের দেশ |কবির কাঞ্চন| Bengali Horror Story
Next post কালো বেড়ালের কবলে | ভয়ের দেশ |ময়ূরিকা মিত্র| Bengali Horror Story