– তে-সুকো ইয়া-মা-মটো এ আবার কেমন নাম রে?
– জাপানি রিসার্চার মধুছন্দাদি।
– কবে আসছে?
– পরের হপ্তাতেই তো আসবে, দু’সপ্তাহ থাকবে। পিওর জাপানি। অন্য কিছু বলে না।
– বাপরে।
– বাপরে ফাপরে বললে চলবে না। তুমি আমাদের পুরনো লোক। তোমাকেই আপ্যায়ন করতে হবে। ওপরে তেমনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
– আর তোমরা? আমি ছাই জাপানি জানি নাকি?
– আমরা তো কাজের সময়টা ওর সাথে থাকব। তুমি জাপানি কেন বলবে? সে দোভাষী আছে।
এই রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ক্লার্ক হবার সুবাদে অনেকের সাথেই ভালো সম্পর্ক আমার। আমি মানে মধুছন্দা বিশ্বাস। আর যার থেকে একটু আগে এই ভীষণ খবরটা পেলাম তার নাম নীরা রয়। বয়স অল্প। তার ডিপার্টমেন্টেই তো আলো করে আসছেন বিদেশী স্কলার। ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের কথায় গত দশ বছরের ইতিহাসে এ প্রথম নয়। আগেও অনেকে এসেছেন। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড আরও যেন কোথা কোথা থেকে যেন। বাকি দেশের নামগুলো মনে করতে পারল না মধুছন্দা। কিন্তু এবার জাপান। এটা তার বিলক্ষণ মনে আছে। বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়েছে। মা এর সাথে সুখী সংসার আমার। গত দশ বছর এই ইনস্টিটিউটে লেগে আছি। সব থেকে অভিজ্ঞ রয়ে গেছে বলতে এই মধুছন্দাদি। তাই এ দায়িত্ব আমারই ঘাড়ে দিয়ে সবাই নিশ্চিন্ত। আগে কখনও এরকম দায়িত্ব পাইনি। বা বলা ভালো নিতে হয়নি। অলোকদা ছিল। সেই সামলাত সব। আগের মাসেই সে রিটায়ার করেছে। একটু নার্ভাস লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটু নার্ভাস আমার লাগছে না। অনেক বেশিই লাগছে। অলোকদার সময় যারা এসেছে তারা প্রত্যেকেই ইংলিশ জানত। এ অং বং চং কী বলবে! কে জানে! দোভাষী মাধ্যমে মানুষের সাথে কথা হয় নাকি! কানেক্ট হবে কীভাবে! আপ্যায়নই বা কি করব! তারপর কি বুঝতে কি বুঝব চাকরী যাবে মায়ের ভোগে।
যথা দিনে যথা সময়ে তিনি এসে হাজির। হাজরার মোড়ে বাসে চেপ্টে থাকা অবস্থায় ফোনটা বেজে উঠল আমার। ইচ্ছে করে দেরী করেছিলাম আমি। রান্নায় একটা পদ বেশী বানিয়েছি আজ। বড়ী দিয়ে উচ্ছে ভাজা। অনেকেই সবসময় বলে তোমার হাইটে শাড়ীটা ঠিক… কুর্তি পরলে দারুণ মানায়। সেই সব শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আজ শাড়ীই পরলুম। হালকা হলুদ রঙের একটা পিওর সিল্ক। ভেতরে বেগুনী রঙের নকশা। এরকম নতুন কত কত শাড়ি বান্ডিল হয়ে পড়ে আছে। আমার ভাঙা বিয়ে সাক্ষী দিচ্ছে না ভাঙা শাড়ীগুলো। প্রথম প্রথম মা লুকিয়ে দিত। আজকাল টেনে নিয়ে নিয়ে পরি। রোজ নতুন নতুন শাড়ী! বিয়ে ভাঙার পরেও!ঈর্ষা আর সান্ত্বনা মেশানো কলিগদের মুখগুলো বড়ই উপভোগ করি আমি। এ সব করতে গিয়ে অবধারিত দেরী হয়েই গেল। জানতাম পরে বেরোলে বাসে ভিড় হয়। ভিড়ে চাপাচাপি হওয়া তাও ভালো। এটা বাঙ্গালির অভ্যাসের মধ্যে পড়ে। কিন্তু দোভাষী আর অং বং চংয়ের মাঝখানে চাপাচাপি! না বাবা আগে অন্য কেউ সামলাক। তাদের এক্সপেরিয়েন্স দেখে নিয়ে নয় মাঠে নামা যাবে। বসন্তকে আগের দিন সব বুঝিয়েই এসেছি আমি। ২ নম্বর আর ৩ নম্বর গেস্ট রুমটা খুলে দেবে। আর সব ব্যবস্থা তো করাই আছে।
পৌঁছে দেখি ইন্সটিটিউটে হুলস্থূল পরে গেছে। তেনাকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। বাকি ক্লার্কেরা সেখানেই ভিড়েছে। রোজের কাজ করার জন্য কেউ নেই। আমি খাতা খুলে কাজ শুরু করলাম। দুপুর বেলায় সবার সব উত্তেজনা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কেউ রিসার্চ রুমের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে না। তাই গেস্ট রুমে ফেরার সময় আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। এবং করতে হবে তার জাপানি খাবারের ব্যবস্থা। সঙ্গে একজন যুবক। অনুবাদক। নাম পথিকৃৎ সেন। দরজায় হালকা ঠোকা দিয়ে বললাম –
– আসব … আমি মধুছন্দা বিশ্বাস।
যুবকটি ওঁকে এই কথাটাই ওদের ভাষায় বলে দিল। উনি হেসে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানালেন আর কিছু একটা বললেন। যুবকটি উত্তর দিল –
– উনি আপনাকে বলছেন যে দেখা হয়ে ভালো লাগল। স্যার আপনার কথা ওঁকে বলেছেন।
– আসুন আমার সাথে…
বলে ওঁদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম কোলকাতার রাস্তায়। গাড়ির ব্যবস্থা ইন্সটিটিউট থেকেই করে দিয়েছে। তেসুকোর বয়স বেশী হবে না। পরনে অ্যাশ রঙের একটা স্যুট। ওঁরা পেছনে জাপানিতে গুজ গুজ করছে। প্রথমে একটা জাপানী সহযোগিতায় চলা এনজীও তে গেলেন। পাশে একটা বৌদ্ধ মনাস্ট্রি। ঠিকানা অনুযায়ী ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দিল। ওরা কয়েকটা বস্তির দেখাশুনা করে। আমরা ভেতরে গেলাম না। পথিকৃৎ বলল ডোনেশন দেবেন। বস্তির একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে করে বেরিয়ে এলেন উনি। আমি অবধারিত ভাবে আশ্চৰ্য হলাম। মেয়েটিকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আমরা গাড়ীতে উঠে বসলাম। পথিকৃৎ আমাকে ডেকে বলল –
– মধুছন্দাদি উনি জিজ্ঞেস করছেন এখানে আদৌ কোন জাপানি রেস্টুরেন্ট আছে কিনা!
– ওঁকে বলো কোলকাতায় সব আছে। কোলকাতা সবার। আর তুমিও বুঝি এখানকার নও?
– আমি ব্যাঙ্গালোরে থাকা বাঙালি। মাঝে সাজে আসি।
যুবকটিকে উনি আবার কিছু একটা বললেন। শোনার পর যুবকটি বলল –
– উনি বলছেন উনি জানেন কোলকাতার মানুষেরা খুব ভালো হয়। আর উনি অন্য কোথাও গেলে সেখানকার খাবার খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। তাই কার্যত না খেয়েই থাকতে হয় ওঁকে। একমাত্র আপনারাই আমাকে জাপানি খাবারের কথা বললেন…
– ওঁকে বল আমরা বাঙ্গালিরা সর্বভুক হলেও কোথাও গেলে বাঙালি খাবারই খোঁজে…
রেস্টুরেন্টে পৌঁছে ঢোকার মুখে জাপানি ভদ্রলোক হঠাৎহঠাৎ থেমে গেলেন। আমি অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মনে হল উনি যুবকটিকে আমার কাছে পাঠালেন। সে বলল –
– উনি জিজ্ঞেস করছেন আশেপাশে বাঙালি হোটেল আছে কিনা…থাকলে উনি আমাকে আর আপনাকে খেয়ে নিতে বলছেন। উনি বলছেন উনি একাই লাঞ্চ সেরে নিতে পারবেন।
– নানা তা কেন?
– মধুছন্দাদি কেন না করছেন … জাপানি খাবার আপনি খেতে পারবেন?
– না কিন্তু একটা দায়িত্ব তো আছে … তুমি যাও না গিয়ে খেয়ে এসো। এগিয়ে গিয়ে ডানদিকেই একটা ভালো মোঘল রেস্টুরেন্ট আছে। চলবে তো?
– একদম। দৌড়বে। আসি তাহলে … সামলাতে পারবেন তো আপনি? আমি খেয়েই চলে আসছি।
– আচ্ছা। একটুখানি সময় তো, আমি শুধু পাশে বসে থাকব। ও পারব, পারব।
মুখে যতই পারব পারব বলি না কেন, বুকটা কেমন যেন ধুকপুক করছে। হোটেলের দরজার সামনে তখনও উনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওঁওঁর কাছটাতে গিয়ে আমি হেসে দাঁড়ালাম। এ ছাড়া আর যে কোন ভাষা আমার জানা নেই। ইশারা করে ওঁকে ভেতরে যেতে বললাম। উনিও কি জানি কি বুঝলেন হোটেলের দরজা খুলে ইশারায় আমাকেই প্রথমে ঢুকতে বললেন। আমি হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে ভেতরে ঢুকলাম। বাহ একটা জিনিস ভালো এখানকার ওয়েটাররা জাপানি ভাষা জানে। আমরা বসতেই ওয়েটার এসে ওঁওঁর সঙ্গে জাপানিতে কি সব কথা বলল। ওঁদের হাতে মেনু-কার্ডও ছিল। উনি বোধহয় অর্ডার দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর টেবিলে কিছু খাবার এনে রাখল ওরা। আজব ব্যাপার আমার সামনেও একটা বাটি করে কি যেন দিয়ে গেল। ওঁওঁর মুখ দেখে বুঝলাম উনিই অর্ডার করেছেন। উনি বললেন –
– স্যুপ … জাপানীস স্যুপ।
ইশারায় বোঝালাম আমি খাব না। আমার পেট ভর্তি। তাও আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন দেখে চামচে করে একটু মুখে নিলাম। খুব একটা খারাপ নয়। এবং আমার একটু আগে বলা কথাটাও মিথ্যে। আমার বেশ জোরেই খিদে পেয়েছে। আমি মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম যে আমার বেশ লেগেছে। উনিও খেতে শুরু করলেন। কিন্তু বাইরে এসে দেখি পথিকৃৎ এখনও এসে পৌঁছয়নি। ওঁকে গাড়িতে বসতে বললাম। যদিও সেটা ইশারায়। রাস্তায় কুলফিওলা দাঁড়িয়ে আছে দেখে সাধ হল। আর পেট পুজোটাও আজ তেমন হয়নি। ইন্সটিটিউট থেকে যদিও একটু পরেই বাড়ি চলে যাব। আর সে রকম কোনও কাজ নেই। কুলফিওলাকে একটা কেশর কুলফির অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় পাশে দেখি সেই জাপানি ভদ্রলোক। একটা আঙ্গুল দেখিয়ে কুলফি চাইলেন। প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে আমি কুলফিওলাকে বললাম আরেকটা কুলফি বানিয়ে দিতে। দেখলাম আমার কুলফি খাওয়ার পদ্ধতিটা মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করছেন। আমিও ইশারায় বোঝাতে লাগলাম এই সহজে গলে যাওয়া বস্তুটিকে কীভাবে গলাধঃকরণ করতে হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম যেহেতু আমি তাদের জাপানিজ খাদ্যটিকে প্রত্যাহার করিনি তাই ভদ্রতার খাতিরে উনিও কোনও ভারতীয় খাবার খেতে চাইছেন। যদিও আমারই তাকে বলা উচিৎ ছিল।
পথিকৃৎ ফিরে এলে আমরা গাড়ীতে উঠলাম। পথিকৃৎকে বললাম –
– ওঁকে বল হোটেলে আমি কথা বলেছি চারটের আগে অর্ডার করলে এরা ইন্সটিটিউটে হোম ডেলিভারি দিয়ে যাবে … রোজ রোজ আর ওঁকে এতদূর আসতে হবে না।
– বাঁচালে…
এক একটা মুহূর্ত কেমন যেন চুম্বকের মত হয়। এই কিছুক্ষণ আগে ঘটা কয়েকটা মুহূর্তও ঠিক সেরকম ছিল। গাড়িতে বসে কেমন একটা অনুভূতি হতে লাগল আমার। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন বাস হওয়া সত্ত্বেও অনুভূতি মেলে কীভাবে! যদি তা নাই হবে তাহলে উনিই বা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? না না খুব বড় একটা ভুল হচ্ছে আমার। আবার। নিজের মনকে বার বার নিজে হাতে গুঁড়িয়ে ভেঙে দেবার অধিকার নেই আমার।
ফিরে গিয়েই ছুটলাম প্রিন্সিপালের ঘরে।
– আসব স্যার …
– হ্যাঁ, হ্যাঁ মধুছন্দা এস … সব ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ সব ঠিকই আছে। কিন্তু স্যার আপনি ওঁওঁর দেখাশোনার দায়িত্বটা যদি অন্য কাউকে দিতেন… কাল তো সকাল আটটা নাগাদ রিসার্চের কাজ শুরু হবে, আসলে অত সকালে আমার পক্ষে আসাটা একটু অসুবিধা। জানেনই তো বাড়িতে আমার একটা সমস্যা আছে।
– আচ্ছা সে নয় বসন্তকে বলে দিচ্ছি… সকালবেলা ক্লার্কদের তরফ থেকে কাউকে একটা তো থাকতে হবে।
– অনেক ধন্যবাদ স্যার।
রাতে তখনও ঘুম আসেনি। মোবাইলে টুকটাক কি সব দেখছি। হঠাৎ রুমেলাদির ফোন। ইনি গেস্ট রুমের ইন-চার্জ। কিন্তু ইনি আবার আমাকে কেন ফোন করছেন! তাও আবার এত রাতে! ফোনটা ধরতেই উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
– হ্যালো মধুছন্দা বলছ… নতুন যিনি এসেছেন, উনি তো প্রচণ্ড অসুস্থ। এখানে কিছু উল্টোপাল্টা খেয়ে ফেলেছেন বোধহয়। ডক্টর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিন্সিপাল স্যার ফোন ধরছেন না। যাক তুমি অন্তত…
– দিদি তুমি বসন্তকে ফোন করে ডেকে নাও। নাম্বার আছে? আর পথিকৃৎ কোথায়?
– পথিকৃৎ মানে ওই ট্রান্সলেটর, না না ও তো সামনে ওর পিসির বাড়িতে চলে গেছে। এখানে নেই। আর বসন্তটাও তো ফোন ধরছে না।
– আমি ওকে পাঠাচ্ছি। তুমি রাখো।
– ডক্টর নিয়ে যখন গেস্ট বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছলাম ফোন করে রুমেলাদিকে বাইরে ডাকলাম। বললাম –
– তুমি ডক্টর সাহাকে ভেতরে নিয়ে যাও। ইনি আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর। বলতেই রাজি হয়ে গেলেন।
– আসুন ডাক্তারবাবু।
ওঁরা ভেতরে যেতে ভাবলাম না আমার যাওয়াটা ঠিক নয়। তারপর কি যেন মনে হল ভাবলাম রুমেলাদি তো আছে! আর অসুস্থ মানুষকে দেখতে না যাওয়া তো অভদ্রতা। আর ওঁওঁর অসুস্থতার কারণটা তো রাস্তার কুলফি! কেন যে আজই আমার খেতে ইচ্ছে হল! কাল প্রিন্সিপালকে যদি বলে দেন। ভাবতে ভাবতে ভেতরে ঢুকে গেলাম। জানলার সামনেটা দাঁড়িয়ে দেখলাম লোকটা বেশ অসুস্থ। কিছু পরে ডক্টর সাহা বেরিয়ে এলেন। বললেন –
– ওষুধ দিয়ে গেলাম। কালকের দিনটা রেস্ট নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রুমেলাদি ডক্টর সাহাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। আমি ওদের পেছন পেছন যেতে গিয়েও মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম। ঘরে ঢুকে ওষুধটা বের করে এগিয়ে দিলাম ওঁওঁর দিকে। ওঁওঁর চোখে একটা অনন্ত কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। যেন কত কিছু বলছে আমাকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়ে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম। উনি গ্লাসটা হাতে নিতেই বেরিয়ে এলাম ঘরটা থেকে।
একদিন পর আমার দোতলার অফিসে হঠাৎ এসে হাজির পথিকৃৎ। বলল –
– উনি আপনাকে ধন্যবাদ বলেছেন। আর জিজ্ঞেস করেছেন আজ কি যাবেন সেই রেস্টুরেন্টটাতে?
– না গো আজ অনেক কাজ আছে। আজ হবে না।
এরপর হপ্তা খানেক আর দেখা হয়নি ওঁওঁর সাথে। হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয় যাতায়াতের পথে দেখা হতেও তো পারে। ওঁদের রিসার্চ রুমটা চারতলায়। যেখানে আমায় কখনই উঠতে হয় না। দোতলায় ল্যাপটপ আর কাগজের স্তূপের পেছনেই দিন কাটে আমার। এক দণ্ড নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আজ হঠাৎ ফেরার সময় বসন্ত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল আমার দিকে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে বলল, বিকেল চারটের মধ্যে বুকিং করতে সে ভুলে গেছে। সকালে উনি বলে রেখে ছিলেন যে আজ গিয়ে খাবেন না। কাজ থাকবে সেই রাত পর্যন্ত। এবার কি হবে মধুছন্দাদি – বলে বসন্ত দাঁড়িয়ে রইল আমার মুখের গোড়ায়। আমি বললাম –
– আমি কি করব বসন্ত। তুমি কোনভাবে অ্যারেঞ্জ করতে পারছ না?
জাপানি খাবারের একটা নাম আমি জানতাম। যেটা সেদিন ওঁকে খেতেও দেখেছিলাম। সুশি। হোম ডেলিভারির জন্য অনেক খুঁজেও বাঙালী হাজার ব্যঞ্জনের মধ্যে তাকে পাওয়া গেল না। যদিও আটটা বেজে যাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে। যখন জানলাম এখনও কোনও ব্যবস্থা করা যায়নি। উনি নাকি নিজেই ব্যবস্থা করে নেবেন। কিন্তু কি করে! কিছু চেনেন এখানকার! কেন জানি না রেসিপিটা বের করে ফেললাম। ভাতেরই তো কিছু একটা ব্যাপার। কিন্তু বানাতে তো সুশী ম্যাট লাগবে। মা পিঠে বানাচ্ছিল। হঠাৎ মাথায় খেলে গেল কটা পিঠে দিয়ে এলে অন্তত …
যখন পৌঁছলাম তখন রাত হয়ে গেছে। রুমেলাদিকে ফোন করেই যাচ্ছি ধরার নাম নেই। ভেবেছিলাম আগে জানব ব্যবস্থা হয়েছে কিনা না হয়ে থাকলে রুমেলা দির হাতে দিয়েই চলে যাব। চারদিক অন্ধকার, ফাঁকা ধু ধু করছে ইন্সটিটিউটের এই দিকটা। এদিকে মা ফোন করে বলছেন কে যেন দেখা করতে এসেছে তাড়াতাড়ি যেন চলে আসি। কিন্তু এখন যাবই বা কি করে! টিফিনকারী হাতে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মিনিট দশেক তো হবেই। হঠাৎ দেখলাম গেট দিয়ে তিনিই ঢুকছেন যার জন্য আমার আসা। এবার কি হবে! প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়লাম আমি। কিন্তু সমস্তটা কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতায় পড়ে নিলেন উনি। হাত বাড়িয়ে কৌটোটা চেয়ে নিলেন। একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। খুলে দেখলাম দুটো কুলফি প্যাক করিয়ে এনেছেন। এখন আমার খেয়াল হল ঠিকই তো কাল তো ১৮ ই মার্চ। উনি চলে যাবেন। তাহলে কি উনি আমার বাড়ী গিয়েছিলেন! অদ্ভুত একটা মুগ্ধতা ঝরে পড়ছে ওঁওঁর দৃষ্টিতে। আজ আর চোখ সরানোর ক্ষমতা ছিল না আমার। এরপর দুটো চারটে শব্দ বললেন উনি। গভীর একটা চাহনি। যার আক্ষরিক অর্থ আমি জানতাম না। কিন্তু কেন জানি না মনে হল সবটা বুঝতে পারলাম।
– ওয়াতাশী ওয়া, আণাটা ও আইশতেইমাশু…
আমি ফিরে এলাম। কথাটা মনে বার বার বিড় বিড় করে বলতে বলতে ফিরে এলাম। ফোনও ঘাঁটলাম একটুও কিছু পেলাম না। এই কদিনে একটা পি.ডি.এফ বই থেকে কিছু শব্দ শিখেছিলাম। কিন্তু বইতে বা মোবাইলে উচ্চারণ থেকে এভাবে তো পাওয়া মুশকিল। মানেটা যা অনুভব করলাম সেটা ঠিক কিনা তো জানতে হবে। ফিরে পথিকৃৎকে একটা ফোন করলাম। তখনও বারোটা বাজেনি। ফোন করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বললাম –
– মধুছন্দা বলছিলাম… শোনো না একটা হেল্প করবে?
– হ্যাঁ বলো না…
– তোমাদের মুখে জাপানী শুনে শুনে জাপানী শেখার ইচ্ছে হয়েছিল জানো তো … নেট থেকে ঠিক পুরোটা… জুড়ে জুড়ে…
– আমাকে বল না হেল্প করে দিচ্ছি…
– মীজূ মানে কি জল?
– হ্যাঁ। একদম ঠিক।
– কোণীচূয়া মানে হাই তাই তো?
– হ্যাঁ এটাও ঠিক …
– ওয়াতাশী ওয়া, আণাটা ও আইশতেইমাশু … মানে কি আমি তোমাকে…
– একদম ওটার মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি।
থ্যাঙ্ক ইউ বলে আমি ফোনটা রেখে চুপ করে বসে রইলাম।