মোবাইল স্ক্রিনে ল-ইয়ার মিঃ বসুর নামটা বারে বারে ভেসে উঠছিল, মেহুল লক্ষ করেনি, তা তো নয়। দেখে না দেখার ভান করছিল। তারপর মোবাইলটা উল্টে রেখে রান্নাঘরের জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে রাস্তার যতদূর চোখ যায় লোকজনের দেখা তেমন নেই, কেবল মাঝে মাঝে ফেরিওয়ালার হাঁকডাক কানে আসে তার। এখন লক-ডাউন পিরিয়ড চলছে, তাই এত শূন্যতা, ব্যস্ত শহর ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে চলছে, এমনটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এই সময় তার বাড়িতে ঠিক ভিন্ন একটা ছবি, যা বিবাহিত জীবনে গত দু’বছরে আগে কখনও দেখেছে কিনা তার মনে পড়ছে না। ঘরে যেন বসন্ত উড়ে বেড়াচ্ছে, রঙিন প্রজাপতির ডানায় ভর করে। একবার মেহুল ভাবল, তার কোন ভ্রম হচ্ছে না তো, পর মুহূর্তে ভাবল, না তা হবে কেন? এর আগে তো কখনও হয়নি।
– ‘আদিত্য, আমাদের এবার একটা ডিসিশন নিতেই হবে, এভাবে দু’জন আর কতদিন এক ছাদের তলায় বাঁচব, মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার মনে হয়, তোমারও তাই হয়। তাই বলছিলাম যে তোমার পরিচিত কোন ল-ইয়ার থাকলে, দু’জনে গিয়ে আলাপ-আলোচনা করা যেতেই পারে।’ কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে একটু থামল, আদিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে। আদিত্য বোধহয় প্রস্তুত ছিল না, তাই ঠিক কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছিল না, শুধু একবার মেহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে, পলকে চোখ নামিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। একটু আগে আকাশ জুড়ে তারাদের মিছিল দেখেছিল কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে, আর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আকাশের মুখ ভার, স্লাইডিং দরজা টেনে ড্রয়িং হলের লাইট নিভিয়ে বেডরুমে গেল।
মেহুল ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল বেণী করছিল। আদিত্য তার সামনে আয়নার দিকে তাকিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘কাল অফিস থেকে ফিরে ল-ইয়ারের ডিটেলটা তোমাকে জানাচ্ছি।’ কথাটা শোনা মাত্রই মেহুলের সারা শরীর জুড়ে একটা হিমবাহ ঘোরাঘু্রি করতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে মনে হতে লাগল ঘরের মধ্যে অক্সিজেন কমে আসছে, আর ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বিছানায় গেল। বালিশের পাশে ডান হাত মুঠো করে ওর পছন্দের ফ্লোরাল প্রিন্টের বেডশিট আঁকড়ে ধরল। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারল, তার চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে বালিশ ছুঁতে চাইছে। কথাটা প্রথম ও বলেছে, আদিত্য কোনও বাঁধা না দিয়ে ওর কথায় সম্মতি দিয়েছে, তাহলে কেন এত কষ্ট। আর এটাও তো ঠিক সম্পর্কটা কোনওভাবেই এক্জিড করছিল না, শুধুই বয়ে বেড়ানো। এভাবে দু’জনের গুমড়ে বাঁচার থেকে দু’জনের মুক্ত গগনে উড়তে বাধা কিসের, তাই তো সে নিজে থেকে কথাটা বলেছে।
‘শুনুন মিস মিত্র, আপনি আপনার স্যারকে বলে দিন যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আমি ওঁকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করে নেব।’ ওপাশ থেকে কিছু বলার পর, আদিত্য আবার বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ, আমার মিসেস হয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন তাই মিঃ বসুর কল রিসিভ করতে পারেনি। ঠিক আছে আমি বলে দিচ্ছি।’ পরের কথাগুলো হঠাৎ কানে গেল মেহুলের। মনে মনে ভাবতে লাগল’ তাহলে কি আমার মনের ভুল, যা ঘটার তা কি ঘটতেই চলেছে, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এতটাও ভুল আমি করতে পারি!’
– ‘কোনও কাজে ব্যস্ত আছ কি? এদিকে একটু আসবে?’
– ‘হ্যাঁ, এই আসছি।’ কাছে এসে বলল, ‘মেহুল, ডাকছিলে?’
– ‘হুম, কাল রাতে অনেকক্ষণ জেগেছিলাম। ঘুম আসছিল না, ভাবলাম অনেকদিন তো রং – তুলি নিয়ে বসা হয় না, সেগুলো কি অবস্থায় আছে, তাও তো জানি না, তারপর কাবার্ড খুলে দেখি, তুমি সব যত্নে রেখে দিয়েছ, সেগুলো না বের করে ভাবলাম পেনসিল স্কেচ করি, দেখি কতটা এগোতে পারি? দেখো তো কেমন হয়েছে? মেহুলের দিকে ছবিটা এগিয়ে দিতেই চমকে ওঠে, কারণ সে তো আদিত্যর ডাক শুনে অন্য কথা ভাবছিল, তারপর ছবিটা দেখে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না, শুধু বলল, ‘এত সুন্দর ছবি আঁকো তুমি, মাঝে মাঝে ছুটির দিন, ল্যাপটপ দূরে সরিয়ে আঁকা নিয়ে বসতে পার তো।’ ‘জান আমিও ভাবিনি পারব, ভাবছি এই ছবিটা বাঁধিয়ে আমাদের বেডরুমে রাখব।’ মেহুল মনে মনে হাসল, আর ভাবল, কি হবে আমার এই ছবি বেডরুমে রেখে, আর কয়দিন পর তো, ভাবতে ভাবতে থমকে গিয়ে, আবার ভাবল, আদিত্যর এত খেয়াল, আমি ব্যালকনিতে হেলান দিয়ে বই পড়তে পড়তে কখন দু’চোখের পাতা এক করে ফেলেছিলাম আর ও আমাকে না ডেকে চুপিসারে মোবাইলে ছবি তুলে, তা দেখে এত সুন্দর ছবি এঁকেছে। যদি একসঙ্গে থাকা না হয় তবে আমি এই ছবিটা সঙ্গে নিয়ে যাব।’ ‘তোমার পছন্দ হয়েছে মেহুল?’ মেহুল মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘খুব পছন্দ হয়েছে গো।’ ‘যাক বড় শান্তি পেলাম জানো, দু’দিন আগে বিকেলের দিকে আমি কাজের ফাঁকে ব্যালকনির দিকে যেতেই দেখি তুমি গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেছো। এত স্নিগ্ধ আর মায়াবী লাগছিল যে, মোবাইলটা নিয়ে আবার গেলাম ফোটো তুললাম, আর ভাবছি, এই বুঝি চোখ খুলে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলবে, এটা কি হচ্ছে। না তার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে পেরেছি। তখন তো ভাবিনি ছবি আঁকার কথা। কাল রাতে হঠাৎ ছবি আঁকার কথা মাথা আসতেই এই ছবিটার কথা মনে পড়ল।’ ‘ঠিক আছে, এবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে টেবিলে এসো, আমার ব্রেকফাস্ট রেডি, চলে এসো।’
পাস্তা প্লেটে সার্ভ করতে করতে আবার সেই এক চিন্তা মেহুলের মনের ভিতর তোলপাড় করে যাচ্ছিল, নিজেকে সামলে দু’টো প্লেট হাতে নিয়ে টেবিলের কাছে গেল,’ এসো তাড়াতাড়ি, সবসময় ঠাণ্ডা খাওয়ার খাও, এখন বাড়িতে আছ, এসো তো।’ ‘আসছি রে বাবা, এই তো একটা মেলের রিপ্লাই করে এখুনি আসছি। তুমি শুরু করো।’ কাঁটা চামচ দিয়ে পাস্তা নাড়াচাড়া করতে করতে সেই এক চিন্তা, যে মানুষটা আমার এত খেয়াল রাখছে, সত্যিই কি কোনও ভালোবাসা নেই।’ কি গো এখনও শুরু করোনি, ঠাণ্ডা হয়ে গেল তো’, চমকে উঠল মেহুল, ‘হুম এই তো, দেখ সব ঠিক আছে কিনা, একটু অন্যরকম ভাবে করার চেষ্টা করলাম।’ ‘আরে আমার ফেভারিট পাস্তাটা তুমি ভালোই করো, এতে কোনও সন্দেহ নেই, নেহাত অফিসের কাজের চাপে কোনোদিন বলা হয়নি।’ মেহুল অবাক হল, সে তো ভাবে খাওয়ারটা খেতে হয়, তাই খায়।’ আজ আরও ভাল লাগছে, আসলে অফিসে কোনওরকম মুখে দিয়ে মানে ল্যাপটপে চোখ রেখে খাওয়ার কি আর স্বাদ ভালভাবে নেওয়া যায়।’ মেহুল হালকা হাসল। মনে মনে ভাবল, এখনও তো ল-ইয়ার বারবার ফোন করছিল আর আমি ধরছিলাম না, সে কথা বলছে না তো, ভুলে যাওয়ার কথা তো নয়।
কিছু কথা না শোনাই ভাল, বরং যে ভালটুকু পাওয়া যায় তাকেই না হয় ক্ষণিকের জন্য আপন করে নিই, সেটুকুই সারাজীবনের বেঁচে থাকার রসদ হয়ে থাকবে।’ আজ একটু বাজার যাব, তুমি বলে দিও কি কি আনতে হবে, এরপর আবার ক্রাইসিস হবে, যতই নেতা-মন্ত্রীরা বলুক না কেন, আসল ছবিটা বাজারে অন্যরকম। একটু আগে পিয়ালের সঙ্গে কথা হল, ও সব বলল তো।’ – ‘হুম, তেমন কিছু লাগবে না, একটু দাঁড়াও লিস্ট করে দিচ্ছি, বেশিক্ষণ বাইরে থাকার দরকার নেই, অবস্থা তো তেমন ভাল না।’ মেহুল সব দেখে লিস্ট করে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিল। আদিত্য চলে যেতেই, মেহুল মনের ঘরে কড়া নাড়ল। এই যে দুজনে দুজনের মধ্যে একটু আধটু কথা বলা, কিছুটা সময় কাটানো, এর আগে কোনোদিন হয়নি। বিয়ের পর যখন নবদম্পতি তখনো ছুটির দিনে নিছক কেজো কথা কিছুই হয়নি, মেহুল চেষ্টা যে করেনি তা তো নয়, কিন্তু বিপরীত মানুষটার থেকে যে কোন সাড়া পায়নি, তারপর একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছে।
একটু পরে আদিত্য ফিরে এসে দেখে সেই একভাবে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে কি যেন দেখছে, এতটাই বিভোর যে ব্যাগটা নিচে রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওকে দেখল কিন্তু মেহুল কিছু বুঝতেই পারল না। ওকি সত্যি কিছু দেখছে নাকি কোনও এক চিন্তায় এতটাই মগ্ন থাকে যে পারিপার্শ্বিক দিকগুলো নজর এড়িয়ে যায়। সেটা বেশ কয়েকদিন ধরে আদিত্যর নজরে এসেছে। ও কি মুক্তির অপেক্ষায়, তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলাও তো সম্ভব নয়, কিছুদিন তো আমাকে সহ্য করতে হবে তোমাকে। এইসব নিজের মনে বলতে লাগল আদিত্য। অনুভব করল, বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠল, তাহলে কিসের এত অবহেলা, কেন এত অবজ্ঞা, নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করল আদিত্য। ল্যাপটপে চোখ রাখল, একটু বাদে রান্নাঘর থেকে ঠুকঠাক শব্দ আসতেই বুঝতে পারল, মেহুল ফিরেছে তার কর্মযজ্ঞে। ওকে সাহায্য করা দরকার, একা হাতে বেশ কিছুদিন যাবত করে চলেছে, রমাদি নেই প্রায় দিন পনেরো। কোনোদিন ওকে দেখলাম না তেমন রাগ করে আমায় কিছু বলতে। কেবল ওই রাতে দেখেছিলাম অতটা কঠিন হতে, বলিষ্ঠ গলায় নিজের মতামত জানাতে। আমিও অবাক হয়েছিলাম। তারপর কতটা দিন গড়িয়ে গেছে, ল-ইয়ারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বেশ কয়েকবার হয়ে গেছে। সেখানে কথা বলার সময় বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কতটা বুদ্ধিমতী ও তারপর যখন দুই পক্ষের অভিভাবকদের মুখোমুখি হলাম তখন ও সবাইকে সামলে নিল। মেল বক্সের টুং আওয়াজে আদিত্য আবার ল্যাপটপে চোখ রাখল।
আজকাল মেহুল আদিত্যর আচরণে প্রতি মুহূর্তে অবাক হচ্ছে, দুপুরের খাবার সার্ভ করছে। আবার বিকেলের চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছে। এতটা খেয়াল রাখতে মানে আন্তরিকতার ছোঁয়া আগে কখনও পায়নি। আদিত্য একজন স্বামী হিসেবে কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি এতদিন পর্যন্ত, সেখানে কোনও ফাঁকি দেয়নি। কিন্তু দাম্পত্যজীবনের রসায়ন দুজনের মধ্যে মনের লেনদেন সেটা কোনোদিন বুঝেই উঠতে পারেনি মেহুল। এই যে এখন যেমন কেজো কথার বাইরেও নানা কথা যা কিনা মেহুলের মনের ঘরে একরাশ পলাশের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর গুটিকতক প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে, এটা সাময়িক হলেও ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে কেন ছেড়ে যাব, আমি তো এসবই চেয়ে এসেছি এতটা কাল, পর মুহূর্তে আবার মনে হচ্ছে, এ তো ক্ষণিকের মায়াজাল, কোনও এক জাদু কাঠির ছোঁয়ায় সবকিছু অন্যগতিতে চলছে। ভাবতে ভাবতে বেলা-শেষের ম্লান হয়ে আসা গোধূলি আলোয় মুখ ধুয়ে যাচ্ছে, আর তার মন জুড়ে প্রশান্তি।
আদিত্যর মনে এক অপরাধবোধ কাজ করে, যতবার সে এর থেকে বেরনোর চেষ্টা করে ততবার আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে তার ফলস্বরূপ সংসারটা একপ্রকার তছনছ হতে চলেছে। পারবে কি সে শেষ রক্ষা করতে? একবার চেষ্টা করেই দেখি না! নিজের মনে কথাগুলো বলতে লাগল। এর জন্য যেমন মেহুলের বাবা-মা কষ্ট পেয়েছে, ঠিক তেমন তার বাবা-মা দোষারোপ করতে ছাড়েনি ওকে, নিজের সন্তানের থেকেও যে মেহুল তাদের কাছে বড় আদরের, ভরসা করে ওকে। এই বয়সে এসে তাদের ও ভীষণ আঘাত হানছি, এটা তো সত্যি। আমাকে পারতেই হবে, পারতেই হবে আমাকে, এক নিশ্বাসে নিজেকে বলল আদিত্য।
রাতে খাবার টেবিলে একথা সেকথার মাঝে আদিত্য বলল, ‘জানো তো মেহুল, আমাদের দু-বছরের দাম্পত্য জীবনে দু’জন দু’জনকে সেভাবে জানাই হয়নি, তুমি অবশ্য বহুবার আমাকে জানার চেষ্টা করেছ কিন্তু আমি কোনোদিন করিনি। এক প্রকার অন্যায় করেছি তোমার সঙ্গে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।’ মেহুল চুপ করে আছে, তবে কালবৈশাখীর দমকা হাওয়া বুকের ভিতর তোলপাড় করে দিচ্ছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন সব শেষ আদিত্য, পালতোলা নৌকো বহু চেষ্টা করেও যখন কূল খুঁজে পায় না, তখন এলেবেলে হয়ে যায়। আমাদেরও সংসারটা তাই হয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই আমি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আকাশের মুখ ভার, কেমন যেন থমথমে। ‘মনে হয় ঝড় উঠবে, আকাশটা এখন মেঘের দখলে।’ কথাটা আদিত্যের মুখ থেকে শোনার পর মেহুল মনে মনে বলল, আদিত্য বাইরের ঝড় দেখা যায় কিন্তু মনের ঝড়, সেটা যে তোলপাড় করে দিচ্ছে আমাকে প্রতিনিয়ত, সেটা কি একবারও নজরে পড়ছে না তোমার? ‘কি ভাবছ মেহুল’, ‘হুম, কই কিছু না তো, চলো ঘরে যাই।’ ‘তুমি যাও, আমি সিগারেট শেষ টান দিয়ে আসছি।’ মেহুল চলে যেতেই আদিত্য নিজের মনকে প্রস্তুত করতে শুরু করল, না আর নয়, আমাকে পারতেই হবে, এভাবে সব শেষ হতে দেওয়া যায় না।
রাত যত বাড়তে লাগল, মেঘেদের গর্জন বাড়তে লাগল আর সেই সঙ্গে দামাল হাওয়া, কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরের আলোর ঝলকানিতে মেহুলের মুখখানা বারবার আড়চোখে দেখছে আদিত্য।’ ঘুমিয়ে পড়লে মেহুল, আসলে এখন তো তেমন ব্যস্ততা নেই সকালে ওঠার তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলা যেতেই পারে, যদি তোমার ঘুম না পায়।’ ‘না, আমি ঘুমাইনি, তুমি কিছু বলবে, বলো আমি শুনছি।’ কি করে শুরু করবে আদিত্য বুঝে উঠতে পারছিল না,’ কলেজে আমার অ্যাকাউন্টেন্সিতে অনার্স ছিল, তারপর মাস্টার্স করব ঠিক করেছিলাম, এমন সময় আমার এক বান্ধবী বলল,’ প্রথাগত মাস্টার্স না করে তো এম.বি.এ তে চেষ্টা করতে পারিস তো, তারপর কোনও এম.এন.সি তে জব পেতে তোর খুব একটা অসুবিধে হবে না, আর যদি মাস্টার্স করতেই ইচ্ছে করে পরবর্তীতে ডিসট্যান্স এ করতে পারবি।’ একথা শুনে আমারও তখন ইচ্ছেটা বদলাতে আরম্ভ করল। গ্রাজুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাট এর প্রিপারেশন নিতে শুরু করলাম, আর নানা ভাবে সাহায্য পেতাম আমার সেই বান্ধবীর থেকে, ওর নাম তিয়াসা। মেহুল এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল তারপর নামটা শুনতেই মনের গহীনে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতার হাওয়া বয়ে গেল। মুখ ফুটে কিছু বলল না। আদিত্য লক্ষ করল তার কথা মেহুল মন দিয়ে শুনছে, আর ওর চোখ দু’টো বাইরের আলোয় কেমন মায়াবী ছায়া পড়ছে।’ তারপর মেহুল বলল, ‘ধীরে ধীরে ও আমার বিশেষ বন্ধু হয়ে উঠতে লাগল। মুখে কিছু না বললেও দু’জনের টিউনিং মিলত বেশ। নানা অছিলায় কলেজের পরও পড়াশুনার বাইরের গল্প চলত দীর্ঘক্ষণ। কখনও কখনও একে অপরের বাড়িও যেতাম। এরপর ক্যাটে বসলাম দুজনে, স্কোর কার্ড অনুযায়ী বিভিন্ন কলেজের খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করলাম, ওর বরাবর বাইরের রাজ্যের বিজনেস স্কুল পছন্দ, সেখান থেকে নাকি ক্যাম্পাসিং এর সুযোগ বেশি। আমি আবার মেছো-ভেতো বাঙালি, তাই রাজ্য ছেড়ে বেরনোর তাগিদ ছিল না।’
মেহুল লক্ষ করছিল, আদিত্য কথাগুলো বলার সময় মুখটার মধ্যে চাপা কষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিল, আবার সুন্দর মুহূর্তগুলো বলার সময় চোখের কোণে আনন্দের ঝিলিক দিচ্ছিল।’ আমি জোকার আই.আই.এম. এ অ্যাডমিশন নিলাম আর তিয়াসা গাজিয়াবাদের আই.এম.টি তে। প্রথম প্রথম একে অপরকে ছেড়ে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল, তারপর একটা সময় অভ্যাসে পরিণত হল। উইকএন্ডে কথা বলতাম, মেসেজ চলত। এরপর পড়ার চাপ, ক্যাম্পাসিং নিয়ে চিন্তা, ততদিনে বাবারও রিটায়ারমেন্টের দিন আগত তাই আমিও কেরিয়ার নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করলাম।’
‘ক্যাম্পাসিং-এ একটি ফাইন্যান্স কোম্পানিতে চাকরি পেলাম। পোস্টিং হল শিলিগুড়িতে। ওর ও ক্যাম্পাসিং-এ চাকরি, গুড়গাঁও-এ অফিস। আমি চলে গেলাম আবার একটি শহরে, বলা যেতে পারে পাহাড়ের দোরগোড়ায়, বাবা- মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বন্ধুরাও দু-তিন দিনের ছুটিতে বেড়াতে গেলে, আমার ফ্ল্যাটে একরাত কাটিয়ে তবেই বাড়ি ফিরত। এরপর কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল, মনে হল তিয়াসাকে প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। এক শুক্রবার রাতে ফোন করলাম, কয়েকটা কথার পর সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। ততদিনে আমি ব্যাঙ্কের পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করে ভাইভা দেওয়া হয়ে গেছে। কেবল কোথায় পোস্টিং হয় সেই অপেক্ষা। বিয়ের কথা শুনে প্রথমটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, শেষে উত্তর পেলাম। তিয়াসা সবসময় বন্ধুর মতো আমার সঙ্গে মিশেছে, তাছাড়া ওর এন.আর.আই পাত্র ছাড়া বিয়ের প্রশ্ন আসে না। ছাপোষা বাঙালির জীবনযাপন করবে না বলেই বাংলার বাইরে পড়াশুনো। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এত ভুল করেছি বুঝতে, তাও এত বছরেও বুঝে উঠতে পারিনি। নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছিল। আর কোনোদিন যোগাযোগ করিনি।’ কথাগুলো যখন শেষ করল, মেহুল লক্ষ করল আদিত্যর চোখের নিচে বিন্দু বিন্দু জল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললো, খানিক বাদে বলল, ‘আমার বাবা-মা কিছুদিনের মধ্যেই তোমার সঙ্গে বিয়ের কথা বলল, আমি তখনও সেই ঘোরের থেকে বের হইনি। আর তার ফলস্বরূপ আজ আমাদের সংসার ভেঙে যেতে চলেছে। তুমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য একজন ভিকটিমার। তাই তোমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি, গত দু’বছর যে অন্যায় হয়েছে তোমার সঙ্গে তার সব দায় আমার। আসলে তিয়াসার প্রত্যাখ্যান আমাকে নারী বিদ্বেষী করে তুলেছিল, মনে হত আমি একজনকে যোগ্য জবাব দিতে পারিনি। কিন্তু তুমিও নারী তাই তোমার জন্য এই অবহেলা আমার মনের যন্ত্রণাকে রিলিফ দিত, আমি তখন নিজেকে বলতাম, এই তো আমি পেরেছি, আমি জিতে গেছি, জিতে গেছি।
আজ সকালটা একদম অন্যরকম, ঝড় থেমে সারারাতের বৃষ্টি শেষে হলুদ রোদ মেহুলের চোখে পড়ছে, ‘আমি একভাবে তাকিয়ে দেখছিলাম। ও চোখ খুলতেই তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছাড়তে ব্যস্ত। আমি ওর কাছে গিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে বললাম, আজ থেকে সকালের চায়ের দায়িত্ব আমিই নিলাম, এই বলে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলাম।’