Getting your Trinity Audio player ready...
|
লালরঙের হুন্ডাইটা “শালিমার” এপার্টমেন্ট ছেড়ে যেতেই ননিতার চোখে জল গড়িয়ে নামল৷ ডানহাতের তালু দিয়ে চোখের দু’পাশ মুছেই চশমাটা ঠিক করে নিল৷ ততক্ষণে গাড়ি সোজা পাড়ার মুখ থেকে বাঁ দিক ঘেঁষে চলে গিয়েছে৷ বারশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটের নীল কাঁচের জানালার একধার থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব আড়ালে রেখেছে৷ বাইরে রোদ৷ পৌষ মাসের মকর সংক্রান্তির রোদ। বিকেল চারটে। রোদের উষ্ণতা বুকে মেখে ঘাসে ভরা মাঠ শুয়ে আছে৷ ছেলেরা খেলছে৷ এখানে ফুটবল এখনও খেলা হয়৷ গোল হলে চিৎকার ওঠে; সেন্ট্রাল রোডের চিত্তরঞ্জন কলোনির পাড়া রবিবারে জমজমাট থাকে৷ ননিতা জানালার ভিতর দিয়ে সব কিছু দেখছিল৷ বাঁদিকে সোফা আছে৷ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না৷ সোফায় বসে পড়ল।
সকালের প্রাতরাশ এখনও বাকী৷ স্নান হয়নি৷ অফিসে তিনদিনের ছুটি নেওয়া আছে৷ ঘরের দিকে তাকাল, শূন্য ঘর, ডাইনিং, ড্রয়িংরুম, বেডরুম, বিলাসবহুলতার জলছাপে ভিজে গিয়েছে দামী পেইন্ট করা ফ্ল্যাটের দেওয়াল৷ আনাচে কানাচে দামী ফটো-ফ্রেমে হাসির, আনন্দ, মজার বহু স্মৃতি ধরা রয়েছে৷ ননিতা সেই সব স্মৃতির ছবি দেখছে৷ হাসল৷
ননিতা আর নিবেদিতা, মা আর মেয়ে৷ নিবেদিতা আজ বাড়ি ছেড়ে চলে গেল৷ এটা আশ্চর্য কোন ঘটনা নয়, সাত মাস তাঁদের ভিতরে অসন্তোষ জমে ছিল। আলোচনা করেও সমাধান আসেনি৷ সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখবার জন্য, বিচ্ছেদ দরকার হয়ে পড়েছে৷ ননিতা বুকে পাথর রেখে, নিবেদিতাকে প্রস্তাব দিয়েছে৷ দুজনেই আত্মনির্ভর মহিলা৷ দুজনেই আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল৷ দুজনেরই মৌলিক কিছু মতাদর্শ আছে৷ দুজনেই নিজের আত্ম-নির্ণয়মূলক পদক্ষেপ নিতে ভয় পায়নি৷ দুজনেরই বিচ্ছেদ হতে অসুবিধা হল না৷
ননিতার চোখের জল নিবেদিতা দেখেনি৷ নিবেদিতার মনের ভিতর গোপন গহন মেঘপুঞ্জ জমেছে হয়ত! মা আর মেয়ের অনুভূতিরা একই ধাঁচের৷ নিজেরা নিজেদের দুর্বলতা বুঝলেও, নিজেরা নিজেদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়নি৷ দু’জনের মধ্যেই বাঁধো-বাঁধো ভাব রয়েছে৷ এই অস্থিরতার কেন্দ্রে নিজেদের লুকিয়ে রাখার তীব্র ইচ্ছা রয়েছে৷ মানুষ কিন্তু মানুষের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখলেও, নিজের থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতে পারে না৷
মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে, নিবেদিতার নম্বরটা দেখল। এত তাড়াতাড়ি সে হারবে না৷ নিবেদিতা যখন পেটে, তখন সমাজের অনেক অভিযোগ তাঁকে শুনতে হয়েছে৷ বাঙালি তখন যে দশকে ছিল, সেখানে অবিবাহিত মহিলা মানেই কুমারী হতে হবে৷ কুমারী মহিলার বিয়ের আগে সন্তানের জন্ম দেওয়াটা সামাজিক অপরাধ ছিল৷ ননিতা সেই রকম অবস্থা নিয়েই নিবেদিতাকে বড় করে তুলল৷
ননিতা একটি কর্পোরেট হাউজের এইচ আর৷ চাকরি জীবন তাঁর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের। কুড়ি বছর বয়সে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে৷ এক অনাবিল আনন্দ, সেই সব কথা ভেবেই বুক ভরে আসছিল৷ সন্তানের জন্মের প্রাক মুহূর্ত যতটা অনুভূতিময় হয়ে ওঠে; জন্মানোর পর ধীরে ধীরে ননিতাও তেমন ভাবেই মেয়েকে প্রস্তুত করেছে৷
এই বছরটা ভালো কাটেনি৷ সম্পর্কের রেখাচিত্রে পরিবর্তন এসেছে৷ ননিতার সম্পর্ক শুরু হয় অখিলেশ জৈনের সাথে৷ রাজস্থানে বাড়ি হলেও, অখিলেশ অনাথ৷ কলকাতায় নিজের মার্বেলের ব্যবসা আছে৷ বিদেশে মার্বেল পাঠিয়ে বাজারে যথেষ্ট সুনাম করেছে৷ সেই সূত্রেই ননিতার কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়।
সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক কারণেই দু’জন মুখোমুখি কথা বলত৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷ ধীরে ধীরে সম্পর্ক দৃঢ় হয়৷ ননিতা অনুভব করে, অখিলেশ ক্রমশই দুর্বল হয়ে উঠছে৷ সে নিজেও তাই হচ্ছে কী?
ননিতা এখন যেই বয়সে, সেখানে নতুন প্রেমে পড়ার উত্তেজনা থাকবার কথা নয়৷ অনেকে ভাবেন বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মনের ভিতরের অল্পবয়সী উত্তেজনার হরমোনাল ক্রিয়া বিক্রিয়া ভোঁতা হতে থাকে৷ মানুষের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিণত বোধের দিকে ধাবিত হয়৷ শুধু আবেগ দিয়ে সে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করতে চাইবে না৷ ননিতা উপলব্ধি করে অখিলেশের প্রতি যে আকর্ষণ, তার পিছনে শুধু আবেগ নেই৷ দীর্ঘ সময় একা পথ হাঁটতে হাঁটতে সে ক্লান্ত৷ পাশে পুরুষ মানুষের সঙ্গ থাকাটা, লড়াইকে প্রেরণা দেয়৷ অখিলেশ আর ননিতা পরস্পরের প্রতি সম্মান করে৷ অখিলেশকে ভালোবাসবার সূত্র এই সম্মান৷ দীর্ঘপথ একাই হেঁটেছে ননিতা৷ অখিলেশের সাথে তাঁর সম্পর্ক এক বছরের৷ এক বছরের সম্পর্ক তাঁর জীবনে অনেক পরিবর্তন এনেছে।
এইসব কথার তালে তালে, সময় সরণি বেয়ে অনেক কথাই স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করছে৷ ননিতা মুচকি হাসল৷ সে একাই মেয়েকে মানুষ করেছে৷ নিবেদিতার জীবনে এখন দু’টো অধ্যায়৷ এক অধ্যায়ের নাম ননিতা, আরেক অধ্যায়ে ননিতার অপমান৷ নিবেদিতা দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রতি ঝুঁকেছে৷ ননিতা মনে মনে বলল – আমি, সিঙ্গেল মাদার হিসেবে নিজের সবটুকু দিয়েছি৷ নিবেদিতার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি৷ আর নয়৷ নিজের জন্য বাঁচবো৷
২
– তুমি আমাকে আজও অচ্ছুৎ করে রেখেছ!
– সেটাই স্বাভাবিক নয়?
– স্বাভাবিক৷ তাও নতুন করে ভাবা যায় না?
– কেন ভাবতে বলছ?
– সব কিছু নতুন করে শুরু করতে চাইছি৷
– প্রস্থান, নতুন করে শুরু করে কী হবে?
– সবাই একসাথে থাকব৷ আমার উপর অভিমান করে অন্য একজনকে কষ্ট দিচ্ছো৷
ননিতা কথাটা শুনে স্মিত হাসল৷ বলল
– আমরা যে বয়সে এসেছি, অভিমান মানায় না৷
– অভিমান আসে অধিকার-বোধ থেকে৷ আমার উপর অধিকার-বোধ নেই বলছ?
– না পেতে পেতে মানুষের নিজস্ব বোধ হারিয়ে যায়৷ আমাদের তিরিশ বছর যোগাযোগ নেই৷
ওরা দু’জনে একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টে বসে আছে৷ ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা৷ আগের দিন নিবেদিতা বাড়ি ছেড়েছে৷ প্রস্থান দেখল, ননিতার চোখের তলায় এক রাতেই কালি পড়েছে৷ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল – আমরা বাকি সময় পাশাপাশি থাকতে পারি না?
ননিতা বলল – জীবনে পাশাপাশি থাকাটা, রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি বসবার মতন সহজ হলে ভালোই হত৷ সিট পাল্টানোর জন্য অজুহাত দেখাতে হত না৷ প্রস্থানের বয়স পঞ্চান্ন। পঁচিশ বছর বয়সে ননিতাকে ছেড়ে আমেরিকায় উড়ে যায়৷ ননিতার তখন মাত্র কুড়ি।
প্রস্থান বলল – আমার উপর তোমার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ চাইছি৷
ননিতা কফির কাপে চুমুক দিয়ে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল – উঠতে পারি আমরা?
– ননিতা, আমি কুড়ি বছর বাদে তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ ওরা বলল তুমি ওদের সাথে থাকো না৷
– প্রস্থান, অনেক দিনের কথা৷ এখন নাই বা আলোচনা করলাম৷
– এড়িয়ে গিয়ে, আমাদের মধ্যেকার তিক্ততা কমবে না৷ ননিতা আমি জানি, তোমার কাছে আমি অপরাধী৷
– কেউ যদি কথা না রাখে, অপরাধ নয়৷ আমাদের সম্পর্কটা কোনও বাধ্যবাধকতায় শুরু হয়নি৷
প্রস্থান পকেট থেকে সিগারেট বের করে, ঢুকিয়ে রাখল৷ চেইন স্মোকাররা, নন-স্মোকিং জোনকেও ধোঁয়া-বাস করে দিতে পারে! ননিতা বুঝতে পাচ্ছে৷
– তুমি এখানে উসখুস না করে, বাথরুমে স্মোক করে আসতে পারো৷
ননিতা কথাগুলো বলে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল৷
প্রস্থান বলল – তোমাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছি?
ননিতা হাসল৷ হাসির মধ্যেই অনেক কিছু ছিল৷
– একজনের সাথে দেখা করবার কথা আছে৷ যদিও খুব দূরে নয়৷
ননিতার দু’টো চোখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ প্রস্থানের চোখে বিগত ফেলে আসা স্মৃতি রোমন্থনের যন্ত্রণা৷
– ভুল করেছি৷
প্রস্থানের গলা ধরে এসেছে৷ ননিতা ফোনে এইরকম কণ্ঠস্বর শুনেছিল৷ এখানে আসবার কারণ, প্রস্থানের ভিতরে জ্বলতে থাকা কষ্ট৷ এই যন্ত্রণা ননিতাকেও কষ্ট দেয়৷ আজ থেকে দীর্ঘ তিরিশ বছর আগে প্রস্থান তাঁকে ছেড়ে রেখে চলে গিয়েছিল৷ সন্তানসম্ভবা ননিতা বাচ্চা নষ্ট করতে চায়নি৷ নিবেদিতার জন্মই এক মায়ের লড়াইয়ের গল্পের সূত্রপাত৷ সেই মায়ের পাশে কেউ ছিল না৷ একা একা নিজের আত্মসত্ত্বাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ যদিও নিবেদিতার যখন পনেরো বছর বয়স, প্রস্থান ফিরে আসতে চেয়েছিল৷ আমেরিকা প্রবাসী স্ত্রীর থেকে প্রস্থান ডিভোর্স পায়৷ নিবেদিতার পিতৃত্ব মেনেও নিয়েছে। শুধু ননিতা নিজেকে হারতে দেয়নি৷ লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েনি৷ প্রস্থানকে ফিরিয়ে দিল। সেই পনেরো বছর বাদে সময় তিন জনকে মুখোমুখি এনেছে, এখন পিছবার পথ নেই।
ননিতা বলল – আমি তোমাকে কোনও ভাবেই অপমান করতে চাইছি না৷ আবার এটাও সত্যি তোমার প্রস্তাব মেনে নিতে পারব না৷ আমি একা লড়তে লড়তে ক্লান্ত, তবুও লড়ব।
প্রস্থান বলল – আমরা এখনও পরস্পরকে ভালোবাসি৷
ননিতা থেমে গেল৷ বলল – ঠিক তাই কী?
– এমন কেন বলছ?
– যে মা, নিজের সন্তানের জন্য জীবনের সেরা সময় উৎসর্গ করেছে৷ নিজের নারী সত্ত্বাকে দমিয়ে মাতৃত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই মায়ের কাছে নিজের জন্য ভালোবাসার জায়গা কোথায়!
প্রস্থান বেয়ারাকে ডেকে অর্ডার দিতে গেল৷ ননিতা থামিয়ে দিয়ে বলল – এখন উঠি, কেউ অপেক্ষা করছে৷
– নিজের মেয়ের জন্য অন্তত আমরা একসাথে থাকতে পারি না?
– এই দশ বছর তোমরা দুজনে চুপিচুপি দেখা করতে৷ নিবেদিতা আমার থেকে লুকিয়েছে৷ আমি খবর পেয়েই যাই৷ ফোনে তোমাদের কথা শুনেছি৷ একমাস আগে নিবেদিতা আমার সাথে ঝগড়া করল তোমাকে নিয়ে৷ আজ আমি ওর কাছে মূল্যহীন! তোমরা একসাথে থাকতেই পারো, আমার অনুমতির দরকার নেই।
ননিতার গলা কান্নায় ধরে আসছে৷ চশমা খুলে, চোখ মুছে নিলও৷ বলল
– প্রস্থান, নিবেদিতা তোমার কথা শোনে৷ আমি চাইব তুমি ওর সাথে থাকো৷
ননিতা রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিক দিয়ে চলে যাচ্ছে৷ প্রস্থান দেখছে৷ রাস্তার এই দিক দিয়ে উল্টোদিকের দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায়৷ মানুষগুলো কাছে আসছে৷ মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে৷ প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্ত অবিরত অসীম আকর্ষণ-বিকর্ষণের খেলা চলছে চারিপাশে৷ ননিতাকে অনেক দিন আগে সত্যিই ভালোবেসেছিল প্রস্থান৷ অনেকদিন আগের ভালোবাসা শেষ দিন অবধি থেকে যাবে।
এখন ঘড়িতে সন্ধ্যা ছটা৷ রাস্তার দোকান গুলো বাঙ্ময় হয়ে উঠছে৷ শীতকালীন সন্ধ্যায় প্রস্থান নিজেকে রিক্ত, শূন্য মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করল৷ তার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সুনাম, প্রভাব, শ্রেণি সব আছে৷ ননিতা নেই৷ ওই যে রোগা ছেলেটি, যাকে নিয়ে নিবেদিতার সাথে দ্বন্দ্ব চলছে৷ সেই ছেলেটি ননিতার প্রেমিক৷ এতক্ষণ প্রস্থানের সাথে ননিতা ছিল, অথচ সেই পুরনো উষ্ণতা আজ হারিয়ে গিয়েছে! প্রস্থানের খুব কষ্ট হচ্ছে৷ কেন হচ্ছে? ননিতার চেয়ে সুন্দরি, সুঠাম মহিলা প্রস্থানের জীবনে এসেছে৷ অর্থবান আর ক্ষমতাবান পুরুষের জীবনে, নারীর অভাব থাকে না৷
ননিতা তাঁর কাছে সম্পূর্ণ নারী৷ মায়ের দায়িত্ব পালন করেছে৷ প্রস্থান ঋণী থেকে গেল ননিতার কাছে। সে ননিতার পাল্টে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না!
এখন এই প্রান্তে এসে নিজের জন্য বাঁচতে চাওয়ার মধ্যে অন্যায় নেই৷ ননিতা জীবনের এই স্তর অবধি প্রস্থানকে ছাড়াই এগিয়েছে৷ জীবনের যেই পর্বে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, পাশে ছিল না প্রস্থান। এখন ননিতা আর নিবেদিতাকে পাশে চাইছে৷ নিবেদিতার আপত্তি নেই৷ ননিতার ফিরে না আসাটাই স্বাভাবিক৷ ননিতা কেন ফিরবে? প্রস্থানের ভালোবাসার তোয়াক্কা এখন আর সে করে না৷
প্রস্থানের কয়েকদিন ধরেই শরীরে অস্বস্তি কাজ করছে৷ নিজেকে নিয়ে এখন আর সে ভাবে না৷ ননিতার এমন ভাবে দূরে সরে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না৷ আচমকাই বুকে ব্যথা অনুভব করল৷ ব্যথাটা বুকে আলপিনের মতন ফুটছে৷ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে প্রস্থান নিজের ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল৷
মারুতি সুজুকি সুইফট গাড়িটার ভিতর পাশাপাশি বসে আছে দুই প্রজন্মের মানুষ। নারী আর পুরুষ। ননিতা, অখিলেশ। ননিতার ঠোঁটে চুমু দিল। গভীর চুম্বন। গাড়ি পার্ক করা আছে, ময়দানের পাশেই। কাঁচ বন্ধ গাড়ির ভিতর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ। ঘামছে, অনেকদিন বাদে ছত্রিশ বছরের যুবকের হাত খুঁজছিল ননিতার স্তনের উষ্ণতা। দুজনের নিঃশ্বাস কাঁচ বন্ধ গাড়ির নীরবতাকে চৌচির করে দিচ্ছে। ময়দানের ময়দানবের মতন স্থবির হয়ে থাকা গাছের ডালে শীত, সন্ধ্যার বিষণ্ণতা।
অখিলেশ মুখ রেখেছে ননিতার দুটো স্তনের খাঁজে। কিছুক্ষণ বাদে শরীর ঠাণ্ডা হতেই, অখিলেশ মুখ তুলে পাশের সীটে নিজেকে সরিয়ে নিল।
বিষণ্ণ কণ্ঠে ননিতা বলল
– খুঁজে পেলে?
– কী?
– যা খুঁজছিলে।
– অনেক দিন আগেই পেয়েছি। তোমার মধ্যে আমার চাহিদা পেয়েছি বলেই তোমার কাছে ফিরে আসা।
– আমি অতীত।
– আমার বর্তমান।
– অতীত কখনই বর্তমান হতে পারে না অখিলেশ। আমাকে আঁকড়ে ধরে, নিজেকে ঠকাচ্ছ।
– রাতের আকাশে অনেক তারাই আমরা দেখি। অনেকেরই মৃত্যু ঘটেছে বহু বছর আগে। সেই সব অতীতই আমাদের কাছে বর্তমান, নয় কি? ননিতা, জীবন অনন্ত।
– এই সব কবিতার ভাষা।
– তুমি তো কবিতা পছন্দ করো।
– বাস্তব আর কবিতা আলাদা। কবিতা হচ্ছে ভাবনার সহচরী। ভাবনাই বাস্তবের সৃষ্টি করে।
-এখন আবেগে বলছ। তুমি পঁয়ত্রিশ, আমি পঞ্চাশ। আমার মেয়ের বয়ফ্রেন্ড তোমার বয়সের কাছাকাছি।
অখিলেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বলল
– ননিতা তোমার কাছে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছি। আমার জীবনে অনেক নারীই এসেছে, তাঁদের সবাইকে আমি সম্মান করি। তুমি তাঁদের থেকে আলাদা।
– কেন?
– তুমি যে জীবনবোধ নিয়ে বেঁচে আছ, আমিও সেই জীবনবোধ পছন্দ করি। তুমি আমাকে ভালোবাসতে নাও পারো।
অখিলেশের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল – আমরা বাকি জীবন ভালো বন্ধু হয়ে থাকলাম।
৩
নিবেদিতা শেষ পর্যন্ত ফোন করল৷ ননিতা ফোন ধরতেই উল্টোদিকে নিবেদিতার কণ্ঠ; অনেকদিন বাদে শুনতে পেল৷ ননিতার দু’টো চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে৷ নিবেদিতাই কাঁপা গলায় প্রথমে বলল
– আমাকে ভুলেই গিয়েছো৷
ননিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল৷ বলল
– তোরা ভালো আছিস?
– বাপির বুকে স্টেন্ট বসেছে৷ সবকিছু এ্লোমেলো লাগছে মা, আমি পারছি না৷
– এটাই আসল জীবন৷ দূর থেকে আমাদের যেটা সাজানো গুছানো বলে মনে হয়, আসলে তার ভিতরে এলোমেলো আছে সবকিছু৷
– আমি আর পারছি না মা৷
– জীবনে সব কিছু জিততে সবাই পারে না৷ তাই বলে জিতবার মানসিকতা হারাতে নেই৷ বাপীর পাশে থাকো৷ নিজেকে একা ভেবো না৷
– তুমি আমাদের সাথে থাকতে পারো না মা?
– আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাইনি৷
– মিথ্যা কথা৷ সেই দিন তুমি বাপির সাথে দেখা করবার পর, অখিলেশ জৈনের গাড়িতে উঠলে৷ বাপি তোমার জন্যই গিয়েছিল৷ ফিরিয়ে দিলে৷
ননিতা কিছুক্ষণ চুপ করে বলল
– তোমার বাবাকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, যেইদিন তোমার বাবা ফেলে পালিয়ে যায়৷
– বাবা বাধ্য ছিল৷
– এই বাধ্য থাকবার বকলেস গলায় ঝুলিয়ে, আর কতবার নিজের অন্যায়, দুর্বলতাকে জাস্টিফাই করবে তোমার বাবা! তারপরেও বহুবার তার সাথে দেখা করতে যাই, দেখা করেনি৷ তার বিয়ের খবর পেয়েছিলাম, মন, শরীর সব কিছু পর্যদুস্ত৷ সিঙ্গেল মাদারের অনেক জ্বালা৷ আমি সমাজের রীতি ভেঙেই তোমার বাবার সাথে লিভ ইন করতাম৷ কথা ছিল, আমেরিকা থেকে ফিরেই বিয়ে করবে৷
– যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি৷
– প্রস্থান আমাকে এড়িয়ে গিয়েছে৷ জীবন যুদ্ধের অনেকটা পথ একাই হেঁটেছি৷ বাকিটাও একাই হাঁটব৷
– মা ফিরে এসো৷
ননিতা এই প্রথম নিবেদিতার গলায় কান্নার শব্দ পেল৷ নিবেদিতা বলল
– ফিরে এসো মা৷
– অখিলেশ আমার উপর বিশ্বাস করেছে৷ আমিও ওকে ভালোবাসি৷ আমি কখনওই ওকে ছাড়তে পারব না৷
– মা, বাপি আমাদের অস্বীকার করেনি৷ সে বাধ্য হয়ে ভুল করেছিল৷ তুমি নিজের সুখের জন্য আমাদের ছেড়েছো৷
ননিতা থেমে গেল৷ ওর চোখে এক সপ্তাহ আগে প্রস্থানকে দেওয়া কথাটা মনে ভাসতে শুরু করেছে৷ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেঁস্তোরার বাইরে, পার্কস্ট্রিটের শীত সন্ধ্যায়, আকাশের মোহহীন আলো ফুরিয়ে আসছে৷ ননিতা তখনই প্রস্থানের প্রস্তাব শেষবারের মতন মেনে নিল৷ প্রস্থান হাতজোড় করে বলল “ননিতা, কথা দাও – তুমি কখনওই নিবেদিতাকে জানতে দেবে না, আমি আমার পিতৃত্ব মানতে চাইনি৷ আমি চেয়েছিলাম তুমি বাচ্চা নষ্ট করো৷ তোমার জেদেই তুমি নিবেদিতাকে পৃথিবীতে এনেছ৷ তোমার সাথে আমার ছাড়াছাড়ির আসল কারণ, নিবেদিতার পৃথিবীতে চলে আসা৷”
ননিতা প্রস্থানের চোখে অসহায়তা দেখছে৷ জীবনের শেষ প্রান্তে প্রস্থানের বেঁচে থাকবার অবলম্বন, ননিতার নিবেদিতা৷ হ্যাঁ, ননিতা জিতেছে৷ নিবেদিতাই স্বীকৃতি৷ যে সন্তানকে পৃথিবীর অস্তিত্বময় পটভূমিকা থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল; প্রস্থানের জীবন সেই সন্তানের অস্তিত্বরই প্রতিচ্ছায়া হয়ে থাকবে! নিবেদিতা কখনও হারবে না৷ নিবেদিতারা হারতে পারে না৷ নিবেদিতাদের সাথে ননিতারা ছায়া হয়ে থাকে৷ মা হয়ে মেয়ের এই জয়ী হয়ে ওঠার মুহূর্ত উপভোগ করছে৷ এই যুদ্ধ ননিতার, যোদ্ধা ননিতা, জয়ের মুকুট নিবেদিতার জন্য তোলা থাক৷
ননিতার জীবনের গল্প প্রেমের গল্প হতে গিয়েও ব্যর্থ! এখানে প্রেম ভেঙে গিয়েছে, বারংবার৷ মিছরির দানা ভাঙতে ভাঙতে যে গুঁড়ো থাকে, তাকে মিছরিই বলা যায়৷
ননিতা বলল – প্রস্থানের উপর আমার রাগ নেই৷ আমি অখিলেশের সাথে জীবন কাটাব৷ আমরা অবশ্য আলাদাই থাকব ঠিক করেছি৷
– বাপীর বুকে স্টেন্ট বসেছে। এই সময়…
– আমার থেকেও বাপীর পাশে তোমার থাকাটা খুব দরকার।
নিবেদিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। বলল – আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি তোমায় ঘৃণা করছি মা৷ আমার লজ্জা লাগছে তুমি আমার মা৷