অনুভব আজ তার সল্টলেক সেক্টর ফাইভের অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু বাদ সাধল এই বৃষ্টি! বেরনোর মুখে যদি এভাবে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, তাহলে কারই বা ভাল লাগে! সুতরাং তাড়াহুড়ো করা বৃথা। তাই, দিনের অবশিষ্ট কাজটুকু শেষ করে বিগড়ে যাওয়া মন-মেজাজ নিয়েই সে ধীরে ধীরে তার ডেস্ক ছেড়ে উঠে এল। লিফ্ট লবিতে তখন অফিসের অনেকেই জড়ো হয়েছে – বাড়ি ফেরার তাগিদ। সকলের সঙ্গে সে লিফটে করে নেমে অফিস বিল্ডিং-এর নিচে রিসেপশন লবিতে এসে দাঁড়াল।
আজ একটা বিশেষ উপলক্ষ রয়েছে তার বাড়িতে। বিয়ের ঠিক সাত মাসের মাথায় আজ রাত বারোটায় অন্তরা পঁচিশ পেরিয়ে ছাব্বিশে পড়বে! তাই সে তার স্ত্রীর জন্য একটা ভাল উপহার কিনতে সিটি সেন্টার যাওয়ার প্ল্যান করেছিল। কিন্তু রঙিন বসন্তের শুষ্ক দিনের এক সন্ধ্যায় এই অনভিপ্রেত বৃষ্টিটা শহরের রাস্তাঘাট অলি-গলি ঘরবাড়ি মাঠ-ময়দানগুলোর সাথে তার সব পরিকল্পনায়ও জল ঢেলে দিল!
অনুভব এক বিখ্যাত সফ্টওয়্যার কোম্পানির অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে ম্যানেজার-পদে চাকরি করে। খুব বেশি উচ্চাভিলাষী নয় সে, বরং তার ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা অনেকটা শহুরে নিঃস্পৃহতার মত – একটা নাগরীয় জীবন, ধুলোবালি বিহীন ঝকঝকে তকতকে কর্মস্থান, অল্প কায়িক পরিশ্রমে সাফল্য আর উপর্যুপরি পারিশ্রমিক; সবেতেই থাকা চাই পরিমার্জিত সফিস্টিকেশন, বেশ একটা বিদেশ-বিদেশ ব্যাপার! বর্ধমানের এই শহুরে ছেলেটি সবসময়ই চেয়ে এসেছে কলকাতা মহানগরীর ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ পরিকাঠামো ও পরিমণ্ডল।
অন্যদিকে, অন্তরা তার জীবন ও কেরিয়ার নিয়ে যথেষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল। সে বরাবর একজন ভাল ছাত্রী। তার স্কুলিং কলকাতায় হলেও গ্র্যাজুয়েশন করেছে সে দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে। বি. এ. পাশ করার পর ইন্ডিয়ান আর্টস্ অ্যান্ড হিস্ট্রি নিয়ে মাস্টার্স করার ইচ্ছে ছিল তার। প্রধানত অধ্যাপনার কাজে তার ঝোঁক আগাগোড়া।
এরই সঙ্গে তার মনের গহিনে সুপ্ত অভিলাষ ছিল ইউনিভার্সিটির একজন বিখ্যাত মানুষকে আপন করার; তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল তার কল্পনার জগৎ, তার স্বপ্নের নগরী, তার সুগভীর প্রেমের আখ্যান। বয়সে বছর তিনেকের সিনিয়র সেই দাদা ছিল অন্তরার কাঙ্ক্ষিত পুরুষ, যাকে নিয়ে সে আপন মনেই নিজের একটা পৃথিবী বানিয়ে নিয়েছিল সেই সময়ই!
কিন্তু ঠাকুরদার চরম অসুস্থতা তাকে তার কোনও স্বপ্নই পূরণ করতে দেয়নি! সম্পূর্ণ অযাচিতভাবেই অনুভবের সঙ্গে গত জুলাইতে তার বিয়ে হয়ে যায়, হঠাৎ করেই। রাজি না থাকা সত্ত্বেও অন্তরাকে মৃত্যুশয্যায় শায়িত তার ঠাকুরদার অন্তিম ইচ্ছে পূরণ করতে হয় এই বিয়েতে মত দিয়ে। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল, মারা যাওয়ার আগে বংশের একমাত্র নাতনির বিয়ে দেখে যাবেন। একজন বয়স্ক মৃত্যুপথযাত্রীর একরকম বলা যায় শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্যই কেবলমাত্র বাড়ির লোকেদের উৎসাহে সাত-তাড়াতাড়ি বিয়েটা সারা হয়।
তবে, অনুভব ও অন্তরার সম্পর্কের মধ্যে কোনোদিনই স্বামী-স্ত্রীর ভিতরকার বৈবাহিক রসায়ন তৈরিই হয়নি!
বিয়ের পর থেকেই ওদের মধ্যে বিশেষ বনিবনা নেই; লোকসমাজে বাবা-মায়েদের এবং নিজেদের সম্মানরক্ষার তাগিদেই কেবলমাত্র ওরা ভালভাবে থাকবার চেষ্টা করে যায়! অনুভব গত সাত মাস ধরে বহুবার নানাভাবে চেষ্টা করেছে অন্তরাকে স্ত্রী হিসেবে পেতে। কিন্তু অন্তরা ততবারই তার থেকে আরও দূরে সরে গিয়েছে। ও নিজের জীবন নিয়ে এতটাই স্বপ্ন বিভোর ও আত্মকেন্দ্রিক যে, বিয়ের পর অনুভবের এই অকস্মাৎ সান্নিধ্যটাকে যেন মেনেই নিতে পারেনি! ওর একটা বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, এই বিয়ের কারণেই তার আকাঙ্ক্ষাগুলোর দ্বাররুদ্ধ হয়ে গিয়েছে! অন্তরার মনের ঐ ধারণা ওদের মধ্যে আস্তে আস্তে এক গভীর ব্যবধান গড়ে তুলেছে।
তথাপি ওদের বাইরে অভিনয় করে যেতে হয় ভাল থাকার। আস্তে আস্তে সেই অভিনয় ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়া ওদের পক্ষে ভীষণ অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিল। ওরা দু’জনেই এর থেকে স্থায়ীভাবে নিস্তার পেতে চাইছিল!
টানা একঘণ্টা মুষলধারে নামার পর বৃষ্টিটা যখন একটু ধরে এল, অনুভব তখন অফিস ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে বেরিয়ে ফুটপাথের দেবদারু গাছগুলোর সারণি ধরে কোনওরকমে বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচিয়ে লাফ দিতে দিতে ইলেকট্রনিক সিটি বাসস্টপের শেডের তলায় এসে দাঁড়াল। পরনের জামা ও প্যান্ট বিশেষ ভেজেনি, তবে জুতোর ভিতর জল ঢুকে মোজা জোড়া খানিকটা ভিজে গেছে বলে ঠাহর হচ্ছে!
রাস্তায় মানুষের ঢল দেখে বোঝাই যাচ্ছে, বাস নেই বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। তবে সল্টলেকে এ-আর নতুন কী! বৃষ্টি হলেই রাস্তায় জল জমে যায়, আর গণপরিবহন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। অজস্র বহুজাতিক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিতে কর্মরত হাজার হাজার মানুষ তখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রাস্তার জমা জলের তোয়াক্কা না করে ছুটতে থাকে এ-মাথা ও-মাথা।
সিটি সেন্টার-গামী বাসের অপেক্ষায় না-জানি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! বাড়ি ফেরার বাসও কী পাওয়া যাবে এখন? সন্ধ্যের মধ্যে যখন বাড়ি ফেরা হলই না, তখন অ্যাপ-ক্যাব ভাড়া করে সিটি সেন্টার হয়ে বাড়ি যাওয়াটাই শ্রেয়, একেবারে অন্তরার জন্য গিফট কিনেই বাড়ি ফেরা যাবে।
মাথার চুল ও ঘাড়ের ছিটেফোঁটা জল ঝাড়তে ঝাড়তে অনুভব এবার তার স্মার্ট-ফোনটা বের করল, উদ্দেশ্য, একটা উবার কিংবা ওলা ভাড়া করা। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! একটাও অ্যাপ-ক্যাব পাওয়া গেল না! অবিশ্যি সেটাই স্বাভাবিক এ সময়। সেক্টর ফাইভের সব অফিস ছুটি হওয়ার পরের ভিড়টা জমায়েত হতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে, তার উপর আচমকা বৃষ্টিতে অবস্থা আরও সঙ্গিন করে তুলেছে!
হঠাৎ সে পিছনে কীসের একটা আওয়াজে ঘুরে তাকাল; রাখালদা আর মঞ্জুদি একসাথে ঘরের জল ছেঁচে বের করে ফেলছে পাশের রাস্তায়। রাখালদা এই বাসস্টপে ফুটপাথের উপর খাবারের দোকান চালায়, ওর স্ত্রী মঞ্জুদি রান্না করে আর খদ্দেরদের রেখে যাওয়া এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে-মেজে রাখে, আর ওরা দু’জনে ফুটপাথেই দোকান লাগোয়া ওদের একচালা ঘরে তিন-বাই-ছয়ের খাটিয়ায় রাত কাটায়!
প্রতিদিন দুপুরে এই ফুটপাথের রাখালদার দোকানেই লাঞ্চ সারে অনুভব। নিজের কর্মজীবনে সন্তুষ্ট হলেও বৈবাহিক জীবনের দাম্পত্য-সুখ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অনুভূতিটা তার হৃদয়ে বড় নাড়া দেয়! ওদের সঙ্গে কথা বলার মধ্য দিয়ে যদি সেই সম্পর্কে উন্নতির রসদ পাওয়া যায় – এই আশায় সে ওদের সঙ্গে গল্পও করে। অদ্ভুত পারদর্শিতায় ওরা দু’জন মিলে সংসার চালায়– অভাব অনটনের মাঝেও ওদের ঠিক চলে যায়, হাসিমুখে দোকান চালায়! কী অসাধারণ সামঞ্জস্য দু’জনের; অনুভবের মাঝে মাঝে রাখালদাদের দেখে হিংসে হয়!
এই এখন যেমন ওরা একসাথে মিলে হাঁড়ি-কড়াই দিয়ে ঘরের জল ছেঁচে বের করছে; মুখে কিন্তু হাসি লেগেই রয়েছে দু’জনেরই, খুনসুটিও করছে দু’জনে!
হঠাৎ অনুভবের দিকে চোখ যেতেই রাখালদা হাসিমুখেই বলে উঠল, ‘আজ এ’কাজেও দু’জনেই হাত লাগিয়েছি গো দাদাবাবু! আমাদের সংসারের নৌকায় জল ঢুকে গেছে; সে-জল এই বেলা ছেঁচে না ফেললে ও-বেলা তোমাদের খাওয়াব কী? আর, তোমাদের খেতে না দিতে পারলে আমাদের নৌকা যে ভেসে যাবে!’
ওদের ঘর হচ্ছে এই অঞ্চলে সব ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রথম শিকার – ঝড় হলে চাল উড়ে যায়, বৃষ্টি হলে ঘরে জল জমে যায়, রোদ উঠলে গরমে থাকা দায় হয়ে ওঠে ওদের পক্ষে! যেমন, আজও এই একঘণ্টার বৃষ্টিতেই ওদের একচালা ঘরে জল ঢুকে গেছে!
অনুভব স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। সত্যিই তো, রাখালদাদের কী আছে সম্বল বলতে? ফুটপাথের উপরে অস্থায়ী ভাতের হোটেল? তার পাশে একখানা একচালা ঘর? সামান্য বৃষ্টি হলেই যে-ঘরে জল জমে যায়, ঝড় হলেই চাল উড়ে যায়?
নাকি কয়েকশো চাকরিজীবী বাঁধা খদ্দের, যারা শুধুমাত্র ওদের দোকানে খেতে আসে আর সারা বছরে হাতে-গোনা কয়েকটা দিনে যৎসামান্য অর্থসাহায্য করে?
নাকি রয়েছে সরকার থেকে পাওয়া হকার মাসোহারা, দাক্ষিণ্যস্বরূপ অনুদান, লোকাল গুণ্ডাদের তোলাবাজি, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, পুলিশি জুলুম, ধার-দেনা?
এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাখালদা প্রতিদিন দোকান খোলে, হাসিমুখ নিয়ে মঞ্জুদি খদ্দের সামলায়, দিন শেষ হলে দোকান গুটোবার পর আরও একটা দিনের অপেক্ষায় রাত কাটায়, আর ছুটির দিনগুলোতে ওরা অফিসের দিনের জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে। তাহলে কোন সম্পদে ওরা ধনী?
ওদের দেশের বাড়ি আর তৎসংলগ্ন জমি রেললাইনের তলায় চাপা পড়ে গেছে বহুদিন। অবশিষ্ট শরিকি জমিজমা নতুন এক্সপ্রেসওয়ে খেয়ে নিয়েছে। যদিও সে সবের বিনিময়ে ওরা বিস্তর টাকা-পয়সা পেয়েছিল, কিন্তু সেই টাকা অজস্র শরিকের মধ্যে ভাগ হতে হতে রাখালদার হাতে যা এসেছিল, তাতে সে সল্টলেক সেক্টর ফাইভে ইলেকট্রনিক সিটি বাসস্টপের পাশে একটা ভাতের হোটেল খুলতে পেরেছে মাত্র! তবে কী এমন সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে ওদের দখলে?
রাখালদার মুখে ‘সংসারের নৌকা’ কথাটা অনুভবের কানে গিয়ে লাগল; ওটা এমন একটা নৌকা, যাতে করে স্বামী ও স্ত্রী – এই দু’জন মাঝি দু’পাশে বৈঠা বাইতে বাইতে বৈবাহিক জীবনের উপাদানগুলো বয়ে নিয়ে চলে। সেই উপাদানগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে ভালবাসা, বিশ্বাস, সম্মান, মর্যাদা, দায়-দায়িত্ব, তেমনই আছে আমিত্ব, অহমিকা-বোধ, সংশয়, পারস্পরিক উদাসীনতা। যাদের নৌকা বাওয়াটাই প্রধান দায়, তাদের নৌকায় প্রথম উপাদানগুলো থাকে। আর, যারা সম্পদে ধনী, তাদের নৌকায় বোঝাই থাকে পরের উপাদানগুলো!
সেই কারণেই এমন বিপন্ন জীবন কাটিয়েও রাখালদা-মঞ্জুদি দিব্যি আছে! আর, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ থাকা সত্ত্বেও অনুভব ও অন্তরার বিবাহিত জীবনটা এমন ছন্নছাড়া! সে খুব ভাল বুঝে গেল, পেট চালানোর বোঝাটাই সংসার চালায়; সে-বোঝা না থাকলে সাংসারিক সুখ লাভ হয় না।
অনুভব রাখালদা-মঞ্জুদিদের ঐ জল ছেঁচে ফেলা পুরোটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, সেই সঙ্গে ওদেরকেও বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভাল করে দেখল। ওদেরকে তো সে রোজই দেখে, কথাও হয়, কিন্তু আজ যদি বৃষ্টি না আসত, আর তার ফলে রাখালদাদের ঘরে জল না ঢুকত, তাহলে তো আর এতকিছু ভাবনা তার মনেই আসত না! তার অপূর্ণ ইচ্ছে, অপরিণত আকাঙ্ক্ষা, অপ্রাপ্ত চাহিদা – সবই কেমন আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে ওদের দেখে!
মনে মনে নিজেই নিজেকে বোঝাল সে, তারা যে অভিনয় করছে সকলের সামনে, সেটা অবশ্যই নির্ভেজাল বাস্তব হতে পারে আরেকটু চেষ্টা করলেই; মোমের শিখায়ও তো বরফ গলে! আজকের উপলক্ষ একটা খুব ভাল সুযোগ, যেখানে অন্তরার মনে জায়গা করে নেওয়া যেতে পারে।
শেষে সে নিজের মনে জোর এনে সিদ্ধান্ত নিল, আজ অন্তরার জন্মদিনে শুধু দামি উপঢৌকন নয়, তাকে সে উপহার হিসেবে দেবে তার ভালবাসার মানুষ, যাকে সে সব ভুলে কাছে টেনে নিতে পারবে। আসল সুখ তো সেখানেই, যেখানে ভালবাসা দিয়ে মানুষকে আপন করে নেওয়া যায়, সেটা বিবাহ হোক বা বন্ধুত্ব। নৌকাটাকে তো চালাতেই হবে, আজ থেকেই! নৌকাটা চালানোটাই তো আসল কাজ, বাকি সব তো আপনিই হয়ে যাবে। এত অল্পেতে ধৈর্য হারালে চলবে কী করে?
প্রথম পদক্ষেপ তাকেই নিতে হবে, লোকসমাজে চালিয়ে যাওয়া অভিনয়কে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে।
“তোমায় হৃদ-মাঝারে রাখব, ছেড়ে দেবো না…”
* * *
অন্তরা বেশ কিছুক্ষণ যাবত উসখুস করার পর এবার উঠে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নিল।
সামনের টেবিলে বসে নিবিষ্ট মনে হাক্কা নুড্লস খাচ্ছে যে লোকটি, তাকে সে খুব ভালভাবে চিনতে পেরেছে – তার দিল্লির কলেজ জীবনের ক্রাশ দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য!
আজও গাল-ভর্তি চাপদাড়ি, ঠোঁটের উপরে অবিন্যস্ত গোঁফ, উসকোখুসকো চুল, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর দীর্ঘদিনের না-ধোওয়া জিনস; পাশের চেয়ারে ছেঁড়া কভারে মোড়া গীটারখানা রাখা, সাথে একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ। তবে ওর সব কিছুতেই কেমন একটা যেন মলিন ভাব, ছন্নছাড়া গোছের পরিধানে যেন অপরিচ্ছন্নতা ফুটে বেরচ্ছে!
অন্তরা নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে সেই লোকটির টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু তার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, নুড্লস থেকে মনোযোগ সরাচ্ছে না! এমনকি সাউথ সিটির এই ফুড কোর্টের দিকে দিকে ছড়িয়ে থাকা মানুষজনের পানেও তাকাচ্ছে না সে খাওয়ার ফাঁকে।
একটা খুব বড় নিঃশ্বাস নিয়ে গলা-খাঁকারি দিয়ে অন্তরা প্রথম কথা বলল, ‘দিব্যেন্দুদা, কেমন আছ?’
লোকটি হকচকিয়ে গিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে অন্তরাকে দেখে রীতিমত ভয় পেয়ে গেল! চামচের নুড্লসটুকু মুখে নিতেই বিষম খেল সে, তারপর কাশতে আরম্ভ করল।
অন্তরা অপ্রস্তুত হয়ে ‘সরি-সরি’ বলে একটা জলের গ্লাস এগিয়ে দিল ওর দিকে। এক ঢোকে পুরো জলটা খেয়ে লোকটি থতমত মুখে অন্তরার দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
অন্তরার ওকে দেখবার পর থেকেই বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গিয়েছিল, সাথে একটা ভয় মিশ্রিত আনন্দের অনুভূতি জাঁকিয়ে বসেছিল তার মনে! এতদিনকার পুরনো ভালবাসা – জীবনের প্রথম প্রেম, যাকে সে নিজের জীবনে খুব কাছ থেকে পেতে চেয়ে এসেছে, যার প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার আদব-কায়দা তার মনের ভিতর উঁকি দিয়েছে এ’কটা বছরে, যার গাওয়া গান তার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে গেঁথে গিয়েছে, সেই দিব্যেন্দুদাকে হঠাৎ দেখে তো এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
দিব্যেন্দু দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে অন্তরার সিনিয়র ছিল। খুব ভাল গান-বাজনা করত, একটা ব্যান্ডও ছিল ওর। গানের পারফরম্যান্সের জন্যই সে বিখ্যাত ছিল। তবে পড়াশুনায়ও যথেষ্ট ভাল ছিল, কেবলমাত্র বদভ্যাস বলতে কোনও ইভেন্ট বা পারফরম্যান্সের আগে এক-দু’ ছিলিম গাঁজা টানতই টানত!
অন্তরার ওর সব কিছুই দারুণ ভাল লাগত, সে রীতিমত দিব্যেন্দুর ফ্যান হয়ে গিয়েছিল, তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল সে সময়! অবশেষে একদিন সে তাকে প্রপোজ করে বসল। পুরো ইউনিভার্সিটিতে রটে গেল ঘটনাটা। অন্তরাও ফেমাস হয়ে গেল দিব্যেন্দুর গার্লফ্রেন্ড হিসেবে। ওরা মনস্থির করেই নিয়েছিল বিয়ে করবে বলে। কিন্তু অন্তরার ঠাকুরদার মরণাপন্ন অবস্থা এবং পর্যায়ক্রমে অনুভবের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তার জীবনটা সম্পূর্ণ অন্যদিকে ঘুরে গেল!
কয়েক মুহূর্তের হতভম্বতা কাটিয়ে দিব্যেন্দু অবশেষে অন্তরাকে একটা পরিচিত হাসি দিয়ে পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করল। অন্তরার সারা শরীরে বয়ে চলেছে একটা অদ্ভুত শিহরণ – রোমহর্ষক অনুভূতি নিয়ে যেন মনের কোণে কিছু একটা হারানো প্রাপ্তির কামনা উঁকি দিচ্ছে! এই ‘কিছু একটা’ নিঃসন্দেহে বহুদিনের পুরনো প্রেম, জৌলুস অনুজ্জ্বল হলেও সেই একই স্নিগ্ধতা নিয়ে হাজির তার সামনে।
বহু প্রচেষ্টায় আত্মসংবরণ করে অন্তরা দিব্যেন্দুর মুখোমুখি চেয়ারে বসল। তার স্নায়ু সূত্রে উত্তেজনা প্রবাহ তখনও কিন্তু কমেনি, তবে তা অনেকটা সংযত, তার অধীনত।
‘আমি ভাল আছি রে’, বলল দিব্যেন্দু, ‘তোর খবর কী? শুনলাম, বিয়ে করে নিয়েছিস।’
অন্তরা এ-কথায় অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তা করেছি বটে।’ তারপর সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তুমি করোনি?’
দিব্যেন্দু কিন্তু অপ্রস্তুত হল না, চমকে উঠল না, বিষমও খেল না; ফর্কে একটুখানি নুড্লস তুলে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে জবাব দিল, ‘আমি বিয়ে করে কী করব বল, নিজেকেই সামলাতে পারছি না, সাথে আরও একজন!’
অন্তরা লক্ষ করল, দিব্যেন্দুর ভাব-ভঙ্গিমা অনেকটা বদলে গিয়েছে, বেশ আড়ষ্টতা চলে এসেছে তার আচার-ব্যবহারে, আগের মত অতটা উৎফুল্ল নয়। একটা প্রাণোচ্ছল মানুষ কীসের একটা জড়তায় যেন আবদ্ধ হয়ে রয়েছে!
অবাক হয়ে অন্তরা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন, নিজেকে সামলাতে পারছ না কেন?’ একটু থেমে আবার সে একই কণ্ঠে বলল, ‘তুমি ইদানীং করছ কী? দেখে তো মনে হচ্ছে, গান-বাজনা এখনও চালিয়ে যাচ্ছ। নিশ্চয়ই তোমাদের ব্যান্ড আজকাল খুব বিখ্যাত হয়ে গেছে, নানান জায়গায় প্রোগ্রাম-টোগ্রাম করে বেড়াচ্ছ, টিভি-নিউজ পেপারে ইন্টারভিউ-টিউ বেরচ্ছে! শুধু ভারতেই তোমাদের শো হয়, না বিদেশেও যাও শো করতে?’
কথাগুলি শুনতে শুনতে দিব্যেন্দু খাওয়া থামিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অন্তরার মুখের দিকে। ধীরে ধীরে তার মুখটা করুণ হয়ে গেল!
অন্তরা ব্যাপারটা লক্ষ করে ফের জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ব্যান্ডের কী খবর, চলছে তো ঠিকঠাক?’
এইবারে দিব্যেন্দু তার দু’হাত মাথার পিছনে গুটিয়ে নিল, দু’চোখ বন্ধ, যেন কিছু একটা ভাবছে গভীরভাবে। অন্তরা উদ্গ্রীব হয়ে আছে তার কাহিনী শোনার জন্য, উত্তেজনায় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, বুকের ধুকপুকুনিটা আরও বেড়ে গেল বুঝি!
বেশ কিছুক্ষণ ঐভাবে থাকার পর দিব্যেন্দু চোখ মেলল, চরম হতাশার স্বরে বলল, ‘আমার আর কিছুই নেই, অন্তরা, আমি শেষ, আমার সব শেষ!’
অন্তরা হতবাক-কণ্ঠে বলল, ‘এ-কথা কেন বলছ গো, দিব্যেন্দুদা? তুমি ইউনিভার্সিটিতে সুপারস্টার ছিলে, তোমার কত অনুগামী ছিল, ফ্যান ছিল, কত লোকে তোমায় ভালবাসত!’ তারপর সে আবদারের ভঙ্গিতে দাবি করল, ‘আমায় সব খুলে বলো তো, তোমার সাথে কী হয়েছে? আগে বলো, তুমি এখন কী করো।’
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিব্যেন্দু আরম্ভ করল তার কাহিনী, ‘তুই যে বছর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলি, সে বছরই আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েও আর পড়াশুনা করিনি, ব্যান্ড, গান-বাজনা নিয়েই থাকতাম। এসব তো তুই জানিসই! স্টেজ শো, লাইভ পারফরম্যান্স – এগুলো ভালই চলছিল। টাকাপয়সাও আসছিল ভালই।
এরপর তোরা পাশ করে বেরিয়ে গেলি, আর এদিকে আমাদের শো চলতে থাকল। হঠাৎ দলে ভাঙন দেখা দিল, খ্যাতি আর টাকার ভাগাভাগি এবং সেইসঙ্গে আমার আত্ম অহঙ্কার সব শেষ করে দিল নিমেষে! সে সময় নিজেকে খুব বড় ভাবতাম, “রি-ইনফোর্সড” ব্যান্ড যে একটা দল, শুধুমাত্র দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য নয় – এটা তখন মাথাতেই আসেনি! যখন সামলাতে গেলাম, দেখি, আমি নিজেই সবকিছু হাতের বাইরে করে ফেলেছি! সবাই ছত্রখান হয়ে গেল, দল আর রইল না। গীটারের স্ট্রিংগুলো একবার ছিঁড়ে গেলে আর জোড়া লাগানো যায় না, গেলেও সেটা থেকে সুর বেরোয় না।
চার-পাঁচ বছর ধরে শুধু স্ট্রাগ্লই করে চলেছি, এর দরজা-তার দরজা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যাতে একটা ভাল ব্রেক পাই; কিন্তু সবখানেতেই কেবল “না” শুনতে শুনতে মনটা কেমন যেন নেগেটিভ হয়ে গেছে, বুঝলি?’
সামান্য বিরতি দিয়ে আবার মুখে একটা মুচকি হাসি টেনে দিব্যেন্দু অন্তরাকে শুধাল, ‘আমার কথা তো শুনলি, এবার তোরটা বল।’
অন্তরা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দিব্যেন্দুর কথা শুনছিল। এবার তার নিজের কাহিনী বলবার পালা। সে যে দিব্যেন্দুকেই ভালবেসেছে আগাগোড়া, কোন পরিস্থিতিতে সে বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছে, বিয়ের পরও যে সে মোটেও সুখী নয় – সবই জানাল তাকে। অবশেষে একটু বিরতি নিয়ে সে দিব্যেন্দুকে বিয়ে না করার জন্য সরি বলল।
দিব্যেন্দু এবার ধীর-স্থির কণ্ঠে অন্তরাকে বোঝানোর সুরে বলল, ‘যা করেছিস, ভালই করেছিস। তুই বলছিস অনুভবের মত একটা সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলেকে বিয়ে করেও তুই সুখী নোস। নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে দেখ তো, আমায় বিয়ে করে সুখী হতে পারতিস তুই? আমার শুধু একটা উজ্জ্বল অতীত রয়েছে, যা স্বপ্নের মত ছিল, আর স্বপ্নের মতই কেটে গিয়েছে। আজ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার ভবিষ্যৎ কী, আমি নিজেও জানি না!’
অল্প বিরতি নিয়ে ফের সে বলতে লাগল, ‘আমি জীবনে প্রচুর লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি, চূড়ান্ত ফ্রাস্ট্রেশন আমার আদ্যোপান্ত ঋণাত্মক করে তুলেছে, আমার আর ঘুরে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই! কারও জন্মদিন, কোনও অ্যানিভার্সারি, কোথাও গেট-টুগেদার পার্টিতে গীটার বাজিয়ে গান গেয়ে কি আর সংসার চালানো যায়? বিকেলে ঐ করে যা উপার্জন করেছি, তা দিয়ে এখানে একটু ভাল খেয়ে গেলাম; না-জানি আবার কবে আসা হবে।’ দিব্যেন্দুর কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস।
সবশেষে সে অন্তরাকে বলল, ‘আমাদের ভালবাসাটা ক্ষণিকের আবেগ ছিল, কিন্তু সেটার কোনও রেজ়াল্ট্যান্ট ছিল না, ছিল না কোনও ভবিষ্যৎও। আজ বাড়ি ফিরে এই বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ায় ব্যালকনিতে বরের সাথে বসে চা খা, দু’জনে মিলে প্রাণ খুলে গল্প কর, আমার কথাও বলিস, দেখবি, খুব ভাল লাগবে। মনে রাখিস, কেউ কারও আপন হয় না, আপন করে নিতে হয়। এভাবেই একদিন তোদের ভিতরকার দূরত্বও মিটে যাবে।’
দিব্যেন্দু উঠে দাঁড়াল, ‘আরও একটা কথা জানাই’, গীটারখানা তুলে নিয়ে শান্তিনিকেতনী ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল সে, ‘আমার কাছে যা পয়সা ছিল, তাতে এক প্লেট হাক্কা নুড্লসই অ্যাফোর্ড করতে পারতাম, তোকে আর কিছু অফার করলাম না বলে কিছু মনে করিস না। বাকি টাকাটা মায়ের ওষুধ কিনতেই খরচ হয়ে যাবে!’
দিব্যেন্দু চলে গেল। যাবার সময় একবারও পিছন ফিরে তাকাল না সে, যেন অন্তরাকে সুখী জীবনের শুভেচ্ছা জানিয়ে মানুষের ভিড়ে মিশে গেল!
এরপরই হঠাৎ অন্তরা অঝোরে কেঁদে ফেলল!
“আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তা-ই, তুমি তা-ই গো…”