ঐ শ্ব রি ক প্রে ম| প্রেমে পড়া বারণ | আশিস চক্রবর্তী| Bengali Love Story
0 (0)

বাজারে থেকে বাড়িতে ফিরে তড়িৎবাবু, গিন্নিকে হেঁকে ডেকে বাড়ি তোলপাড় করে বললেন– কই গো, গেলে কোথায়? দেখো আজ কি এনেছি!! তারপর বাঁকানো ট্যাবড়ানো আঁশ বাটিতে চুনোমাছ কটা ব্যাগ থেকে ঢেলে রাখলেন।

সেদিকে একবার চোখ বুলিয়েই সুর চরমে তুলে গিন্নি বললেন– এটুক এটুক মাছ এখন কুটবে কে? হাঁটুর ব্যথা নিয়ে পিড়ি পেতে আঁশ বটি ধরে বসবার এখন আর জো আছে? মাঝে মধ্যেই এমন ছেলেমানুষি কান্ড করো না, দেখে পিত্তি জ্বলে যায়। তা আনলেই যখন কেটে কুটে আনলেই তো পারতে!

তড়িৎবাবু আর তার স্ত্রী মায়া এমনি ভাবেই, তাঁদের বিবাহের দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে চলেছেন। একসময় তড়িৎবাবু রেলের কর্মচারী ছিলেন। পাঁচ বছর হল রিটায়ার্ড হয়েছেন। পেনশন এর টাকায় দুজন মানুষের দিব্বি চলে যায়। একমাত্র কন্যা সুতপার বিয়ে হয়ে গেছে অনেক বছর হল। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে ঘর করছে সে। আগে ঘন ঘন আসত। এখন ছেলের স্কুল, তাই আর তেমন আসা হয় না। তারপর কলকাতা থেকে জামাই বাবাজির অফিস বদলি হয়ে গুজরাট চলে গেছে। দূরত্বের কারণেই যখন তখন আসা হয়ে ওঠে না।

দুপুর বেলা চুনো মাছের ঝোল ঢেলে ভাত খেতে খেতে তড়িৎবাবু বললেন – আজ তোমার বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। তোমাকে বিয়ে করার পর শ্বশুর বাড়ী গিয়ে উঠলে ঠিক এমনটাই রেঁধে খাইয়ে ছিলেন শাশুড়ি মা। রাঁধতেন বড়ো ভালো। বড়ি ভাজা দিয়ে লাউ, পাকা চাল কুমড়োর ঘন্ট, সে সময় বাঙালির খাওয়া দাওয়ার ধরণটাই ছিল আলাদা। সে সব রান্না কোথায় যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। খাওয়া দাওয়াটা দিনকে দিন শর্টকাট হয়ে যাচ্ছে।

দুপুরে ভাত ঘুমে যেতে যেতে তড়িৎবাবুর স্ত্রীর চল্লিশ বছর আগের একটা ঘটনা স্মৃতিতে জেগে ওঠে।

তড়িৎ তখন সদ্য রেলে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি নিয়েছে। উপায় ছিল না। পিতৃহারা সংসারের মুখে জরুরী সামগ্রী তুলে দেবার জন্য সেই একমাত্র অবলম্বন। তার মত একজন ব্রাইট স্টুডেন্টকে প্রায় বাধ্য হয়েই নিতে হয় তার বাবার চাকরীটা। আর মায়া চ্যাটার্জী, সে নিজে তখন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। প্রখ্যাত স্বর্ণ ব্যবসায়ী অপরেশ চ্যাটার্জীর আদুরে কন্যা। কয়েক বছরের প্রেমকে পরিণতি দিতে আচমকাই বিয়ে করেন তড়িৎকে। তারপর নিজের বাড়িতে এসে জানালে রাঘব বোয়াল তাঁর পিতা চুনো পুঁটি তড়িৎকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেছিলেন। অসবর্ণ বিবাহে তাঁর কোন রকম মত ছিল না। আজীবন তড়িৎকে তার যোগ্য সম্মান দেননি। হার হাভাতে ঘরের ছেলে হিসাবেই জেনেছে। আঘাত আর সম্ভ্রম এই ভয়ে সমাজকে আড়াল করে সমস্ত সম্পত্তি ছোট ছেলে সমরেশের নামে উইল করে সস্ত্রীক বারাণসী চলে গিয়েছিলেন। আর কখনও ফেরেননি। সারাদিনের উপোস আর বেলা বয়ে যাওয়ায় সেদিনই প্রথম আর শেষ জামাই আদরের খাওয়া খেয়ে ছিল তড়িৎ। চুনো মাছের তরকারি, লাউ আর পাকা চালকুমড়োর ঘন্ট। এত অপমান সহ্য করেও তড়িৎ সেদিন হাসি মুখেই পাত পেড়ে খেয়ে মায়ের রান্নার সুখ্যাতি করেছিল। অপমান ভুলে সে রান্নার স্বাদ আজ অবধিঅবধি মনে রেখেছে তড়িৎ। বাপের বাড়ি সম্পর্ক ছিন্ন হলে তার আর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মেডিক্যালের খরচ টানবার সামর্থ্য তড়িৎ এর ছিল না। তা ছাড়া নতুন সংসারের হাল টানতে টানতে বেলা কবে বয়ে গেল টেরই পায়নি। স্বেচ্ছায় চুনোপুঁটির জীবন বেছে নিয়েছিল সে। কথাগুলো মনে আসতেই চোখের দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে ওঠে। পাশ ফিরে দেখে তড়িৎ অঘোরে ঘুমাচ্ছেন।

সন্ধেবেলা ঘরের আলো হঠাৎ নিভে গেল। মায়াদেবী দেখলেন আশে পাশের ঘরে দিব্বি আলো জ্বলছে। নাম ধরে অনেক বার তড়িৎবাবুকে ডেকেও কোনও সাড়া পেলেন না। হাতের কাছে কোনও টর্চ বা মোবাইলের আলোটাও না পেয়ে, হাতড়ে হাতড়ে এঘর সে ঘর ঘুরে শেষটায় বসার ঘরে এসে দেখলেন সেখানে একটা মোমবাতি মিহি শিখা ছেড়ে পুড়ছে। তীব্র অন্ধকারে সে আলোর মহিমাই আলাদা। কে জ্বালাল সে আলো? তড়িৎ এর উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। কারণ এত বছরের জীবন যাপনে ওর ঘামের ঘ্রাণটুকু মায়া দেবীকে ফাঁকি দিতে পারে না। মায়া দেবী মিচকি হেসে বুঝলেন এটা তড়িৎ এর কারসাজি। কিন্তু ওর উদ্দেশ্যটা কি? হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। চোখে একটা ধাঁধার মতো দেখে চোখ খুলে মায়া দেবী দেখলেন ওপর থেকে তার সর্বাঙ্গে ঝরে পড়ছে সুগন্ধি গোলাপের রক্তিম পাঁপড়ি। নিচের দিকে তাকাতেই দেখলেন টেবিলে সাজানো রয়েছে হার্ট শেপের একটা বৃহৎ কেক। তড়িৎবাবু ছুটে এসে তার গিন্নিকে আলিঙ্গন করে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন– আজ আমাদের চল্লিশতম বিবাহ বার্ষিকী, মনে আছে? এদিনটা আমার জীবনের সেরা দিন ছিল। তোমাকে সম্পূর্ণরূপে পাওয়ার।

মায়া দেবী চোখের কোন থেকে আনন্দ অশ্রু মুছে আরও শক্ত করে ধরলেন তড়িৎবাবুর দেহ তারপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন — আমি আজও তোমার জন্য এই পৃথিবীর সকলকে ছাড়তে রাজি আছি ডিয়ার। সেদিনের তোমার অপমানটা আমাকে আজও জ্বালা দেয়।

তড়িৎবাবু বন্ধন ছাড়িয়ে মায়া দেবীর কপালে একটা স্নিগ্ধ চুম্বন এঁকে বললেন — তোমাকে পাওয়ার আনন্দে এতটাই মাতোয়ারা ছিলাম, কারো কোনও মান অপমান আমার হৃদয়ে প্রবেশ করেনি ডিয়ার। কারণ হৃদয় জুড়ে আছ শুধু তুমি। এরপর হাত ধরাধরি করে দুজনে কেকের সামনে গিয়ে কেক কেটে একে অপরের মুখে দিয়ে উইশ করলেন। তড়িৎবাবু ছুটে গিয়ে মোবাইল ফোনে গান ধরলেন “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে / ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনা …”

সোফার এক পাশে দুজনে বসে,মায়া দেবী তড়িৎবাবুর বুকে মাথা রেখে সুরে সুরে গাইলেন সে গান। আর আস্তে আস্তে চলে গেলেন অতীতচারণে। বললেন –আমাকে প্রথম কি গিফট দিয়েছিলে, তোমার মনে আছে? তড়িৎবাবু চোখ বুঝে বললেন — হুম, খুব মনে আছে। তোমাকে দেখার পর বিনিদ্র রজনীতে লেখা এক রাশ কবিতা লেখা, আমার ডাইরি। আর তুমি দিয়েছিলে মেরুন রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি। যা এখনও যত্নে তোলা রয়েছে।

— হম, সেটা দেবার জন্য আমি বাস ভাড়া বাঁচিয়ে পায়ে হেঁটে কলেজ যেতাম।

— এ আকর্ষণ কি তোমার কেবল এ জন্মেরই মনে হয়?

— উঁ হুঁ। জন্ম জন্মান্তরের। সেই প্রাচীন গিরি গুহা থেকে বর্তমান কাল অবধিঅবধি। অনেক অবতারে। আমি আশাবাদী ভবিষ্যতেও আমরা ফিরে আসব। রূপ অন্য হলেও চলবে, শুধুমাত্র তোমাকে চাই।

হঠাৎ মায়া দেবী সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললেন– আচ্ছা এসব আমাদের এখন কি শোভা পায়?

তড়িৎবাবু বললেন – কোন সব?

এই যে এই বুড়ো বয়েসে পাগলের মতো বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন!! — সলজ্জে বললেন মায়া দেবী।

— বৃদ্ধ!! কাকে বলো তুমি বৃদ্ধ! নিজেকে?  ডিয়ার বয়স একটা সংখ্যা আর সেটা শুধু শরীরের, আর প্রেম এর তো বাস সেই আদি কাল থেকেই মনের ভেতরে। তার তো কখনও বয়েস বাড়ে না। অন্ততঃ আমার তো না। আর তোমার সার্টিফিকেট আমি দিচ্ছি আজও আমি তোমাকে বুড়িয়ে যেতে দেখিনি, তোমার হার্টবিট এখনও আমার সেই আগের মতোই ঠেকে। আচ্ছা তোমাকে একটা প্রশ্ন করি, এই একটা জীবন প্রেমের জন্য কি যথেষ্ট?

মায়া দেবী তড়িৎবাবুর চোখের গভীরতায় নজর ফেলে বললেন — মৃত্যু তো শরীর কাড়বে, কিন্তু আত্মা! সে তো তোমার হয়ে গেছে। ইদানিং বড়ো ভয় হয় জানো তুমি আমাকে কিংবা আমি তোমাকে ফেলে মরণকে আপন করে নেব কীভাবে?

এক গাল হেসে তড়িৎবাবু বললেন — চলো না বেড়িয়ে পড়ি?

— এই রাতে? কোথায়?

— পাকিস্তানের গিলগিট- বাল্টিস্তান প্রদেশের হুনজা উপত্যকায়।

— কেন? ওখানে কি আছে?

— কাল মধুর চা এর দোকানে কাগজে পড়ছিলাম, ওখানে মানুষের গড় আয়ু প্রায় দেড়শো বছর। ওখানকার আবহাওয়া জলবায়ু, সতেজ খাওয়া দাওয়া আর যোগ ব্যায়ামের ফলে ওরা বয়েসকে ধরে রেখেছে। ষাট বছরের মেয়েকে তিরিশ বছরের বলে চালিয়ে দেয়া যায়। আশি বছরে সন্তান জন্ম দেয়ার কাহিনীও রয়েছে। ভাবতে পারো, এরকমটা হলে এখনও তোমাকে আমি কত বছর প্রেম করে যেতে পারব?

— যা! এও আবার হয় নাকি? কাগজের লোকেরা কাগজ বিক্রির জন্য ওসব লেখে।

— বিশ্বাস হল না? কাল আমি কাগজ এনে দেখাব।

— ঠিক আছে তা হবেখন। চলো রাত বাড়ছে খেতে এসো। আজ তোমার প্রিয় মেনু হয়েছে, পনির, সোনামুগের ডাল, আর গোল করে কাটা বেগুন ভাজা। ভেবেছিলাম খেতে বসে এক বাটি পায়েস এগিয়ে, আমি তোমায় সারপ্রাইজটা দেবো। তুমি যে ভেতরে ভেতরে এত সব প্ল্যান করে রেখেছিল, আমি টের ও পাইনি। যাও এবার হাত মুখ ধুয়ে এসো।

–সব না হয় বুঝলাম। পনির পেলে কোত্থেকে? আমি তো আনিনি!

— দু দিন ধরে দুধ জমিয়ে রেখে আজ তা দিয়ে পনির করেছি, মার কাছে শেখা সব।

— ও আচ্ছা। ফ্রিজের ভেতরটা একবার দেখো তো!

–কেন? আবার কি এনেছো? রাতে কিন্তু আমি আইসক্রিম খাব না। কাশিটা বাড়ে।

— আরে তা নয় রে বাবা, দেখোই না, পদ্ম পাতায় মোড়া।

— হ্যাঁ পেয়েছি। কিন্তু কি আছে এতে?

— রজনীগন্ধার মালা, একটু চুলে দিয়ে এসো। আর হ্যাঁ ডাল শুদ্ধ ফুলগুলো শোবার ঘরের ফুলদানিতে গুঁজে দিও। সেই প্রথমদিনের কথা মনে পড়বে।

— ধ্যাৎ, তুমি না!!!

তড়িৎবাবুর কাক ভোরে ওঠা অভ্যেস। সে অভ্যেস আগে না থাকলেও মায়া দেবী এখন একই সঙ্গে ওঠেন তারপর বাড়ির সামনে যে ছড়ানো ঘাসের উঠোন, সেখানে দুজনে প্রাণায়াম করেন। আজ সকালে গিন্নির হাত ধরে তড়িৎবাবু বলেন — জানো কয়েকদিন ধরে আয়নায় নিজেকে দেখলে কেমন চেনা চেনা লাগে! মায়া দেবী সজোরে হেসে বললেন– পাগল টাগল হলে নাকি? নিজের মুখ নিজের চেনা লাগবে না!

— না না সে নয়। তুমি বুঝলে না। আয়নায় নিজের মুখটা দেখলে তাতে অন্য কারো মুখের ছাপ মনে হয়। যে ছাপটা পরে সেটা খুব চেনা মনে হয়। ঘন্টাখানেক আয়নায় চেয়েও ঠিক ধরতে পারলাম না।

— বুড়ো বয়েসে চোখে ছানি টানি পড়লে ওরকম মনে হয়-তুমি বরং এক কাজ করো, এমাসের পেনশনটা পেলে একটা চোখের ডাক্তার দেখিয়ে নাও। আর আজকাল যা কাগজে আজগুবি খবর পড়ছ তাতে এরকম একটা হবার বাকি ছিল- হেসে বললেন মায়া দেবী।

— এই তো! তুমি ঠাট্টা করছ!! সকাল সকাল আমি মিথ্যা বলব? আর এতটাও বুড়িয়ে যায়নি। দিব্বি এখনও চোখের দৃষ্টি আছে। — একটু অভিমানের সুরেই বললেন তিনি। তারপর উঠে গিয়ে যেতে যেতে বললেন – নিজের চেহারাটা একবার দেখো, ওটাতেও আমার কেমন একটা চেনা ছাপ লাগছে।

এরপর বাথরুমে ঢুকে দরজা দিলেন। মায়া দেবী এতক্ষন মজার ছলে কথাটা নিলেও এখন একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ওর আবার শরীরটরির খারাপ হল নাকি! নিজের গাল কপাল ঠোঁট কানের পাশ দুটোই হাত বুলিয়ে নিজের মনেই বললেন — কই না তো! আমার চেহারা ঠিকই তো আছে।

তারপর দ্রুত পায়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। মাথা থেকে পা অবধি নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন। প্রতিদিন এর জীবন যাত্রায় নিজেকে আর খুঁটিয়ে দেখা হয় না। তবে বিগত কয়েকটা মাসে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন হয়েছে সেটা আজ সময় করে চেয়ে লক্ষ্য করলেন। সামনের পাক ধরা চুলগুলো ক্রমশ উঠে গিয়ে একটা টাক যেন ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। কপালটা চওড়া হয়েছে এবং তাতে ভাঁজ। ভুরু জোড়া আগের তুলনায় বেশ পুরু হয়েছে। চোখ ঘোলাটে, গালের ডান দিকে একটা জড়ুলের মতো বাড়ছে। সেটা গত কয়েক দিন আগেও তিল সমান ছিল। আজ হঠাৎ একটা মটর ডালের দানার সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁট একটু নিচের দিকে ঝোলা। থুতনির মাঝ খানটায় চেরা দাগ। মায়া দেবীর সে পরিবর্তন আজ স্পষ্ট ভাবে লক্ষিত হয়। ঠিক যেন কারো একটা মুখের সাথে হুবহু মিল। তাঁকে উনি চেনেন খুব ভালো করে আর কাছ থেকে চেনেন, কিন্তু কিছুতেই মনে আসছে না। না হাজার চেষ্টা করেও না। একটু সরে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে তাকালেন আয়নায়। না তিনি ভুল দেখছেন না। আগের মতোই একই প্রতিচ্ছবি। এটা কি কোনও অসুখ? শারীরিক কোনও দুর্বলতা তো তিনি অনুভব করেননি। তড়িৎও আজ ওই একই কথাই বলেছে। তারও অনুভূতি একই রকম। ব্যাপারটা কি? মনের অসুখ নয় তো? মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার নয় তো? অর্থাৎ একই মানুষের দ্বৈত সত্তা উপলব্ধি। তাবলে একই সঙ্গে দুজনের একই সমস্যা? না না কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

খেতে বসে তড়িৎবাবু বললেন — আজ তোমাকে একটু অন্যমনস্ক লক্ষ্য করছি, কিছু কি ভাবছ?

উত্তরে মায়া দেবী বললেন — তোমার সকালের কথাটাই ভাবছি। জানো আমরাও একই রকম অনুভব হল। আজ তুমি যখন বাথরুমে গেলে আমি সারাক্ষন আয়নায় চেয়ে চেয়ে কাকে যেন দেখলাম কিন্তু চিনতে পারলাম না।

— হুম। মানে মুখে অন্য কারো ছাপ। বেশ কয়েকদিন এরকম হচ্ছে। ঘুম টুম কম কিংবা অন্য কিছু ..

কথাটা শেষ না হতেই মায়া দেবী বললেন – হ্যাঁ গো তুমি না হয় একবার তিমির ডাক্তারের কাছে যাও, গিয়ে বলো। কোনও বড় অসুখ করার আগে এসব দেখিয়ে নেওয়া ভালো।

তড়িৎবাবু বললেন — আমিও তাই ভাবছি।

সন্ধ্যে বেলা তড়িৎবাবু তিমির ডাক্তার এর কাছে গেলেন। তারপর বেশ অনেক রাত করে ফিরে এলেন। মায়া দেবী কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকলে, তড়িৎবাবু বললেন– সবটা শুনে তিমির ডাক্তার অন্য ডাক্তার এর ঠিকানা দিলে। বললে এ তার কাজ নয়। সবটাই মনের ব্যাপার। ঘাবড়ে যাবার মতো কিছু না। তবে দুজনেই একবার এই ডাক্তারের কাছে যাওয়ায় ভালো।

মায়া দেবী আঁচলের খুটে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন — সে আবার কোন ডাক্তার?

–মনোবিদ,-বিদেশ থেকে মাসে একবারই আসেন। তিমির ডাক্তার আমাদের হয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ফিক্সড করে রাখবে বলেছে। সামনের মঙ্গলবার।– বললেন তড়িৎবাবু।

তারপর নির্দিষ্ট দিনে ট্যাক্সি করে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। তড়িৎবাবু লক্ষ্য করছিলেন ড্রাইভারটি রাস্তা ফাঁকা পেলেই লুকিং গ্লাসে মাঝে মধ্যেই দুজনকে দেখছে। কারণ তিনি জানতে চাননি, মনের মধ্যে তখন অন্য কিছু চলছে। ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছে ওখানেই রিসেপশনের অল্প বয়স্ক মেয়েটি এবং অন্যান্য রুগী এমনকি একবার চা দিতে আশা ছোকরাটাও আড়চোখে যে ওঁদের দিকে চেয়েছিল, সেটাও তিনি লক্ষ্য করেছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ওঁওঁদের ডাক পড়ল। দরজা ঠেলে ভেতরে দুজনে ঢুকতেই ডাক্তারবাবু একবার মায়া দেবীর দিকে আর একবার তড়িৎবাবুর দিকে স্থির ভাবে চাইলেন। এটাও তড়িৎবাবুর নজর এড়াল না। টেবিলে একটা সরু লম্বা ফলকে লেখা রয়েছে ডক্টর অমিতেশ সান্যাল। তারপর দু লাইন জুড়ে ছড়ানো ডিগ্রি। ডাক্তারবাবু একটু হেসে বললেন — বসুন। বলুন পেসেন্ট কে? আর সমস্যাটা কি?

তড়িৎবাবু বললেন — আজ্ঞে স্যর পেশেন্ট আমরা দুজনেই।

তারপর গরগর করে নিজেদের সমস্যার কথা বলে গেলেন। মায়া দেবীও মাঝখানে কয়েকটা কথা জুড়ে দিলেন।

ডাক্তারবাবু সমস্ত শোনার পর গাল প্রসারিত হাসি ছেড়ে বললেন — প্রেমের বিয়ে নিশ্চয় আপনাদের? তা কত বছর হল দুজন একসঙ্গে?

তড়িৎবাবু বললেন — আজ্ঞে হ্যাঁ। এই চল্লিশ বছরের বিবাহ বার্ষিকী গেল সবে।

— হুম, আপনাদের আমি কোনও ওষুধ দেব না। বরং আপনাদের স্টাডি করব। কালটিভেট করব। দারুন ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট মশায় আপনারা দুজনে। এটা কোনও রোগ নয়। স্রেফ নির্ভেজাল প্রেম, একে অপরের প্রতি অত্যাধিক প্রেমে পাগল হলে এরকম হয়। এই সব নিয়েই তো আধুনিক গবেষণা চলছে। বিদেশ তোলপাড় — বললেন ডাক্তার বাবু।

–কিছুই তো বুঝলাম না স্যার। তবে এখনও দুজন দুজনকে প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবাসি, এটা ঠিক ধরেছেন। বললেন তড়িৎবাবু।

–হুম.. আর ওখানেই তো পোঁতা রয়েছে আপনাদের সমস্যার বীজ। এভাবে বললে আপনাদের না বোঝারই কথা। এর জন্য কয়েকটা তথ্য আপনাদের দেবার প্রয়োজন। মন দিয়ে শুনবেন, একবার কি হল এক মেয়ে তার প্রেমিককে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ল। কারণ দুজনে একই রকম দেখতে বলে দু পক্ষেরই আত্মীয় বন্ধু বান্ধব দাবি করে। মেয়েটি তার বাবার মুখে শুনেছিল তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তার বর্তমান পরিবার। মেয়েটি ভয় পেয়ে যায় যে সে তার প্রেমিকের হারানো বোন নয় তো? শেষটায় ডি এন এ টেস্ট করিয়ে রেজাল্ট দেখে স্বস্তি আসে। না, কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই ওদের মধ্যে। তবে এরকম হবার কারণ কি? তারা একই রকম দেখতে কেন? এই বিষয়টিকে খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মনোবিদ জাস্টিন লেহমিয়ার তার “টেল মি হোয়াট ইউ ওয়ান্ট” নামক বইতে। তিনি বলেছেন আমরা যে রকম ঠিক সেই রকম জীবন সঙ্গীর প্রতি বেশি আকর্ষিত হই। তাই সামান্য চেহারা মিল থাকলে সেই আকর্ষণ আরও বাড়ে। অবশ্য সম্পূর্ণ ব্যাপারটা অবচেতন মনেই ঘটে থাকে। এর আরও একটা কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ছোট থেকেই ছেলে মেয়েরা তার মা বাবার কাছ থেকে ভালোবাসা যেভাবে পায়, অবচেতনে সেরকম একটা ছবি থেকে যায়। বড় হয়ে সেরকম একটা জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী খুঁজে পেতে চায়। কাজেই বাবা মায়ের মুখের আদলে কাউকে পেলে আকর্ষণ বাড়ে। এদিকে ছেলে মেয়ের মধ্যে বাবা মা এর চেহারার মিল থাকে। সুতরাং দুজনের চেহারাটা প্রায় কাছাকাছি হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বিশ্বে এরকম উদাহরণ অনেক আছে।

তড়িৎবাবু মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন — কিন্তু এসবের সাথে আমাদের সম্পর্ক কি?

ডাক্তারবাবু বললেন– সে প্রসঙ্গে আসছি। আপনারা কি জানেন আপনাদের দুজনের চেহারার অদ্ভুত ভাবে মিল রয়েছে। যেটা বলছেন আয়নায় চেয়ে দুজনেই কার যেন মুখের ছাপ লক্ষ্য করেও ধরতে পারছেন না সেটা আসলে একে অপরের ছাপটাই দেখছেন। কিন্তু আপনার চেতনায় তা ধরা দিচ্ছে না।

তড়িৎবাবু আর মায়া দেবী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে বললেন — এ কি করে সম্ভব?

ডাক্তারবাবু হেসে বললেন– অফুরন্ত প্রেম। অবশ্য এর জন্য কিছু কথা আপনাদের শোনা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। স্বামী স্ত্রী দুজনের একই রকম দেখতে হয়ে যাবার পিছনে রয়েছে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেওয়া। সারাজীবনে দুজনেই একই পরিমাণ সুখের আর একই পরিমাণ দুঃখের, আবেগের দিন কাটিয়েছেন। এর ফলে সেই আবেগ আপনাদের শরীর, সর্বোপরি মনের ওপর প্রভাব ফেলেছে। মানুষের জীবনের ইতিহাস লেখা থাকে তাদের মুখে। আর এই কারণেই একই সময় কাটানো স্বামী স্ত্রী এক রকম দেখতে হয়ে যায় নিজের অজান্তে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মানুষের ইমিউনিটি সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা। দীর্ঘ দিন বিবাহিত দম্পতি একই খাদ্যাভ্যাস, একই রুটিন, একই শরীর চর্চার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে দুজনেরই ইমিউনিটি সিস্টেম একই হয়ে যায়। তার ফল শরীরে, মুখের অবয়বে পড়ে।

আর সব চেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল যদি দুজনের সম্পর্ক মধুর প্রেমময় হয় তাহলে এই মুখের মিল আরও তাড়াতাড়ি ঘটতে থাকে, যেটা আপনাদের দুজনের মধ্যে ঘটেছে বলেই আমার মনে হয়।

কথা বলা শেষ করে ডাক্তারবাবু গ্লাসে ঢাকা জল, সম্পূর্ণ গলায় ঢাললেন। থ হয়ে ডাক্তার বাবুর দিকে চেয়ে রয়েছেন দুজনেই। এই অবস্থায় দুজনকে দেখে ডাক্তার বাবু বললেন – আপনার জায়গায় আমি থাকলে আমিও বিশ্বাস করতাম না। তবে আপনাদের বিশ্বাস যোগ্যতা আনার একটা উপায় বাতলে দিতে পারি।

— কি সেটা? জিজ্ঞাসা করলেন তড়িৎবাবু।

–আপনি এখনই বাড়ি ফিরে আপনার বিয়ের পুরনোন ছবিগুলো বার করুন। তারপর সেগুলো প্রথম থেকে দেখা শুরু করে বর্তমান কাল অবধি যত ছবি তুলেছেন কালক্রমে দেখুন আশা করি পরিবর্তনটা চোখে পড়বে। আপনাদের কোনও ওষুধ বা প্রেসক্রিপশন এর প্রয়োজন নেই। আসুন। আর হ্যাঁ আমি পরে এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। আপনার ফোন নাম্বারটা রিসেপশনে দিয়ে যাবেন।

দুজনে এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। তারপর “আপনার ফিসটা” -বললেন তড়িৎবাবু।

ডাক্তারবাবু মিচকি হেসে বললেন –লাগবে না। আপনার কোনও চিকিৎসা আমি তো করিনি। কেবল গল্প শুনিয়েছি।

তড়িঘড়ি ট্যাক্সি করে দুজনে বাড়ি ফিরে এলেন। পথে ফিরতে ফিরতে এবার তড়িৎবাবুর মাথায় খেলে, কেন সকলে দুজনকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। ঘরে ঢুকেই দুজনে সোফায় বসে সারাজীবনের ছবি একের পর উল্টে চললেন। প্রথমে বিয়ের ছবি, সুতপার জন্ম, সুতপার প্রথম স্কুলে যাওয়া উল্টে চললেন সুতপার বিয়ে –না কোথাও চেহারার মিল নেই। দুজনে দু রকম দেখতে। এরপর এর ছবি গুলোই সুতপা আর নেই দুজনের একাকীত্ব এর জীবন। কিছু ছবি পাল্টাতেই, হ্যাঁ এবার যেন দেখলেন তড়িৎবাবুর ডান গালে মোটা জড়ুলের দাগের মতো মায়ার গালে কালো তিলের সবে মাত্র ছোপ এসেছে। আরও কয়েকটা ছবি সরাতেই সেই ছোপ গাঢ় হয়ে বড় আকার নিয়েছে। তার সঙ্গে তড়িৎবাবুর মাথার সামনের মতো মায়া দেবীর ও চুল ওঠা শুরু। আস্তে আস্তে ছবি সরাতেই কপালের ভাঁজ, ঘোলাটে চোখ, গাল, নাক এমনকি চিবুকের দু ভাগের খাঁজটাও এসে গেছে মায়া দেবীর। এ সমস্ত দেখে দুজনেই অবাক হয়ে গিয়ে দাঁড়ায়, খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুজন দুজনকে পরীক্ষা করে লাফিয়ে ওঠে, দমফাটা হাসি, হেসে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। এরপর ছেলে-মানুষের মতো আনন্দে গড়াগড়ি খায়। তড়িৎবাবু চিৎকার করে বলেন — আমাদের এক জন্মের প্রেম সার্থক হয়েছে মায়া, তাই ভগবান ও আশীর্বাদ স্বরূপ দুজনের চেহারা এক করে দিয়েছেন। আশ্চর্য, আশ্চর্য,আমাদের ভালোবাসা!!

মায়া দেবী তড়িৎবাবুর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। কতক্ষন জানেন না। ফোনের জোরাল শব্দে ঘুমটা ভেঙে। উঠে দেখেন সুতপার ফোন। পাঁচ মিনিট কথা হয়। ফোন রেখে তড়িৎবাবুর কাছে ফিরে এসে বললেন– সামনের সোমবার ওরা আসছে।

তড়িৎবাবু মেঝে থেকে উঠে বললেন — তাহলে তো হাতে সময় অনেক কম।

মায়া দেবী কিসের জন্য সময় কম বুঝতে না পেরে বললেন – সময় কম মানে?

— বুঝবে বুঝবে সারপ্রাইজ!

সুতপা সপরিবারে নিৰ্দিষ্ট দিনে এসে পৌঁছল। অথচ সকাল থেকে তড়িৎবাবুর পাত্তা নেই। মা কে জিজ্ঞাসা করলে বললেন — সেই তো সকালে বেরিয়েছে। দেখ এক্ষুনি এসে পড়বে।

বেলা গড়িয়ে যায়, তড়িৎবাবু উধাও। ঘরে খাওয়া নাওয়া বন্ধ। চারিদিকে ফোন করেও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

জামাই পুলক শেষটায় পুলিশে খবর দেওয়ার তোড়জোড় করলে দেখা যায় একই-রিক্সায় চেপে বাম গালে হাত রেখে তড়িৎবাবু ফিরছেন। বাড়ির সামনে এলে তড়িৎবাবুকে,চিন্তিত সবাই নানা ধরনের প্রশ্ন করে। উনি ভ্রূক্ষেপ না করে রুমালে ঢাকা আধখানা মুখ নিয়ে মায়া দেবীর হাত ধরে ভেতরের ঘরে চলে যান। পিছন পিছন সকলে প্রবেশ করে তারপর ঢাকা মুখ সরালে সুতপা দেখে বলে — বাবা – মা, তোমাদের তো যমজ ভাই বোনের মতো দেখাচ্ছে। এসব মিরাকেল কি করে হল?

তড়িৎবাবু গাল ফাঁক করে হেসে বললেন- দেখ না কেবল এই বাম পাটির উপরের দাঁতটা মায়ার নেই বাদ বাকি সব আমার মতো। তাই আমিও ভাবলাম এই অমিলটুকু থাকবে কেন? তাই ভোর হতে যদু ডাক্তারের কাছে লাইন দিয়ে আমার ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতটা তুলে ফেললাম। এখন আর কোনও তফাৎ নেই। ঠিক করিনি?

মায়া দেবী আঁচলে মুখ ঢাকলেন। জামাই, মেয়ে নাতি সমেত সকলে সমস্বরে হেসে হ্যাঁ বলে মাথা নাড়লে।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post চোখের দীঘিতে ভিজাবে বলে এতো আয়ো জন| প্রেমে পড়া বারণ | কহিমুল হাসান| Bengali Love Story
Next post গল্পের শেষ পাতা – আমি সেই কমললতা| প্রেমে পড়া বারণ | প্রিয়ব্রত দাস| Bengali Love Story