বাস স্টপেজে ধুলো উড়িয়ে এসে থামল ১২এ বাসটা৷ ঐ যে বাসের গেটটার ডানদিকে তিন নম্বর জানলাটায় মাথা ঠেকিয়ে বসে এক অষ্টাদশী কন্যে, ওটা সৌমিলি৷ পাশে মধ্যবয়স্কা মহিলা, সৌমিলির মা, সোমাদেবী৷ এই বাসে উঠলেই কেন আজকালকার ছেলেমেয়েদের হেডফোন জোড়া কানে গুঁজতে হয়, এই নিয়ে চিরাচরিত এক আপত্তি ছিল সোমাদেবীর, পাত্তা না পেতে পেতে এখন তা স্তিমিত৷ তাই সোমাদেবীর চোখ আটকে এক ম্যাগাজিনে, আর সৌমিলি? উঁহু, সে আজ ক্যাচি পপ রক শুনছে না তার ক্রিম কালারের হেডফোন কানে গুঁজে, সৌমিলির কানে আজ বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, “মন রে মোর পাথারে, হোসনে দিশেহারা… নিবিড় ঘন আঁধারে…”, কীসের আঁধার? কীসের দিশেহারা? আপনি ওর গল্পটা শুনতে না চাইলেও, আমি আজ বলব আপনাকে, বুঝলেন? কারণ ওর গল্পটা মন দিয়ে শোনেনি কখনও কেউ, অন্তত এখনও অবধি না, পরে হয়তো শুনবে, আপাতত আপনি শুনুন৷
এই যে সৌমিলিকে দেখছেন, মেয়েটি পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই, প্রতিবার টপারের জায়গাটি তোলা থাকে ওর জন্যই৷ গানও করতে পারে, মন্দ না৷ স্বভাব শান্ত, বিনীত, ঠান্ডা৷ আর এই অতিব সাধারণ টিপিক্যাল বাঙালী মেয়েটির ভেতরেই রয়েছে এক অসাধারণত্বের খনি, খনিটির শ্রেষ্ঠ সম্পদ ওর কল্পনা, যার কোনও সীমা নেই, যখনই সৌমিলি চোখ বোজে, ওর কল্পনা বৃষ্টি ফোঁটার মত গড়িয়ে যায় অনেক অনেক দুরে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে স্বপ্নের দোরগোড়া, চেখে আসে সাফল্যের স্বাদ, স্পর্শ করে মনগড়া এক প্রেমিককে৷ মনগড়া এক প্রেমিক, সে কী রকম? সেই লম্বা চওড়া, অ্যাবসআঁটা, গাদা গাদা টাকা আর বাইকওয়ালা? উঁহু… সৌমিলির প্রেমিককে ও দেখতে পায় না, সেখানেই আটকে যায় ওর কল্পনা, ও শুধু অনুভূতি দিয়ে বোঝে যে সেই প্রাণপুরুষ ভারী স্নিগ্ধ, ভারী উজ্জ্বল, ভারী টানটান তার সততা, দীপ্ত এক হাসি নিয়ে সে সৌমিলির দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে, যে যে দিকগুলো এতদিন কেউ খেয়াল অবধি করেনি সৌমিলির, সেইগুলোই খেয়াল করে সেই প্রাণপুরুষ, যেভাবে কখনও ভালোবাসেনি কেউ সৌমিলিকে, সেভাবেই ভালোবেসে তার সকল ক্ষত জুড়িয়ে দেয় ছেলেটি৷ সৌমিলি তার কল্পনাশক্তিটুকুর সবটা একত্র করেও দেখতে পায় না ছেলেটার চোখ, নাক, মুখ, চেহারা৷ তাই মুখচোরা, আপাত প্রেমবিরোধী সৌমিলির চোখ খোঁজে সেই নায়ককে… খুঁজে খুঁজে বিফল হয়, ক্লান্ত হয়, হালও ছেড়ে দেয়৷ ওর জীবনে পুরুষ আসে অনেকই, আর কেবলই প্রমাণ করে যায় বারেবারে, কল্পনা আর বাস্তবের ফারাক বিস্তর৷ সৌমিলির ক্লান্তি আজ এসে ঠেকেছে তলানীতে৷ কৈশোরের শরীরিবৃত্তি যেন পাশ ছেড়ে উঠে গেছে তার, কল্পনার সেই নিগুড় জগতের মায়াবী আলোয় কেউ আর সৌমিলির ঠোঁটে চুমু দিয়ে যায় না৷ আর সৌমিলি বুঝতে পারে, মন থেকে প্রেমের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এলে, ভাবা যায় না এসব কিছুই৷ ঠিক মধ্যরাতে ঘরের ডিমলাইটের আলোর ভারে চোখজোড়া ঝিমিয়ে এলে, সৌমিলির কাছে সরে আসত সেই প্রাণপুরুষ, তার চোখ, চিবুক ছুঁয়ে আদর করে দিত, ঠোঁট ডুবিয়ে দিত তার রূপ ওথলানো কায়ায়…, এখন আর সেসব ভাবতে পারে না সৌমিলি, পুরুষজাতির ওপর জমে থাকা রাগটা তার বেড়ে গেছে ইদানীং অনেকটা, আর সৌমিলি খুব টের পাচ্ছে যে সে আর কারোর সঙ্গের খোঁজ করে না মনে মনে, ও বুঝতে পারছে যে পুরুষের প্রতি তার এ হেন রাগ না কমলে, উজাড় করতে পারবেই না সে নিজেকে, কল্পনাতেও না৷ ভালোবাসতে কী ভয় পাচ্ছে ও এবার? টার্মটা কী যেন? হুম্, ফিলোফোবিয়া, দ্য ফিয়ার অফ লাভ৷ আপনাকে বলি তবে আরেকখান কাহিনী, এই ফিলোফোবিয়া কী করে সৌমিলির মাথা নষ্ট করতে শুরু করল, সেই কাহিনী৷
সৌমিলির বয়স যখন খুব কম, তখন কাকার প্রেম নিয়ে নিত্য ঝামেলা হত ওর যৌথ পরিবারে, রোজ মানে রোজ, আর সেই ঝামেলা কতদূর গড়াতো মাঝে সাঝে, তা জানে বুঝি শুধুই সৌমিলি৷ কর্মরতা মা, সার্ভিসম্যান বাবার গণ্ডিতে সৌমিলির বন্ধু বলতে ছিল একখান হৃষ্টপুষ্ট ডায়েরি, যার পাতায় পেনের আঁচড়ের চেয়ে চোখের জলের ছাপ থাকত অনেকটা বেশি৷ কাকার এই প্রেম নিয়ে নিত্য অশান্তি তার আর ভালো লাগত না, কাকা তার ভারী প্রিয় মানুষ, আবার দাদুভাইও চোখের মণি, প্রেমের মত এক বিষাক্ত জাদুবল তার এই দুই প্রিয় মানুষকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, এ তার বড় অপ্রতিভ লাগত… তখন থেকে এক মস্ত দেওয়াল গড়ে নিয়েছিল সৌমিলি মনে মনে, বিরুদ্ধ শব্দের ইঁট একের পর এক সাজিয়ে এমন এক প্রাচীর তৈরি করে ফেলেছিল যার এপারে প্রেমের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ৷ প্রাচীরের এপারের কল্পনা জগতে কিন্তু সীমা টানেনি সৌমিলি, কৈশোরের চৌকাঠ পেরোতেই সেখানে ভিড় করেছে হাজারও কৌতুহল, হাজারও নতুন চেতনা, তবে তার সবটা একান্তই নিজের ছিল সৌমিলির, শুধু গোল বাঁধল সেবারেই যখন রাঘব এসে সৌমিলির মনের সেই প্রাচীরের বেশ কয়েকটি ইঁট সরিয়ে বেপাত্তা হয়ে গেল…৷ রাঘব, টল ডার্ক হ্যান্ডসামের এক অনবদ্য এপিটোম এই রাঘব নামের যুবক৷ পরিচয়? লাইব্রেরিতে৷ ঐ যে বলেছিলাম, সৌমিলি টিপিক্যাল বাঙালী মেয়ে, বইয়ের নেশা থাকাটাই তো স্বাভাবিক৷ সৌমিলির উইকেন্ড বলতে লাইব্রেরির কাঠের বেঞ্চ আর গন্ডা গন্ডা বই, যে বই ওর বাড়িতে নেই, সে সব বই৷ বাড়িতে কাকিমার অতিব তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ শোনার চেয়ে লাইব্রেরির মৌনতাটাই বেশি প্রিয় তখন সৌমিলির৷ বয়স? হবে তখন ওই সতেরো টতেরো৷ বেশিদিন আগেকার কথা তো নয়৷ সেদিন পেঁয়াজ-খোসা রঙা একটা সালোয়ার পরেছিল সৌমিলি, হাতের নিখুঁত সুন্দর নখগুলোয় প্রায় একই রঙের নেইল পলিশ৷ সৌমিলির চুলটা অদ্ভুত সুন্দর থাকথাক, চেহারা খুব ছিপছিপে… তা নয়, বরং বেশ অ্যাথলেটিক অ্যাপিল আছে গড়নে৷ মুখশ্রীতে মায়া বড় বেশি আর চোখগুলো? চোখগুলোতে দুঃখের এমন গভীর এক হ্রদ, যে কেউ সেখানে হারিয়ে যেতে ভয় পাবে৷ সেদিন ভারী মায়াময় দেখাচ্ছিল সৌমিলিকে, কাকিমার মুখঝামটা শুনে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেছিল বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে, তাই চোখগুলোও যেন আরও মায়াবী লাগছিল ওর৷ রাসকিন বন্ডে মন বসছে না ওর, এ বই সে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে লাইব্রেরি হলটার ও প্রান্ত থেকে এ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে৷ বইয়ের তাকে আড়াল হয়ে থাকে এদিকটা৷ সবুজরঙা টেবিলটায় ঘাড় ঝুঁকিয়ে বসে এক ২২-২৩ বছর বয়সী সুপুরুষ তরুণ, সৌমিলির মনের বাঁধন নিমেষে শিথিল হতে শুরু করেছে, ভালো লাগা এমনই বুঝি? এমনই শিহরণ হয় নাকি? না, না, না, চেনে না, জানে না, এ আবার কেমন অনুভূতি৷ সৌমিলি মূহুর্তে চটি ফটফটিয়ে লাইব্রেরির দরজার একদম বাইরে… পার্ক আছে ওখানে একটা, সৌমিলি ওড়না সামলে খুঁজে নিয়েছে একটা খালি দোলনা৷ সৌমিলি বসতে বসতেই এক গম্ভীর কন্ঠস্বর বলে উঠল, “রোজ আসা হয় বুঝি?”, সৌমিলি হতভম্ব হয়ে পিছনে ঘুরতেই সেই যুবক৷ “না, রোজ না… এই উইকেন্ডে, একটু আধটু…”, সৌমিলি কিন্তু মিসুকে, স্বচ্ছন্দ৷ যুবক এসে বসেছে পাশের দোলনায়, “এখানেই থাকা হয়, কাছাকাছি?”
“হুম্, ওই উল্টোদিকের গলিটা ধরে হেঁটে গিয়ে মেইন রোড ধরে মিনিট পনেরো-কুড়ির হাঁটা পথ… আগে লাইব্রেরিতে দেখিনি তো আপনাকে?”,
“শিফ্ট করেছি, সপ্তাহ তিনেক হল, বাবার বদলির চাকরি… চেনা, জানা তো কেউ নেই, তাই ভাবলাম কাছাকাছির কোনও লাইব্রেরিতেই ঘুরে আসি৷”
“বেশ করেছেন… কী করা হয়?”
“এই, চাকরির সন্ধান চলছে, তোমার?”
“টুয়েলভে উঠেছি…”
“সর্বনাশ, লোকজন দেখলে তো মারধর করবে রীতিমত, বাচ্চা মেয়ের সাথে বসে বসে আলাপ করছি৷”
“বাচ্চা নই আমি মোটেও৷ আর আপনিই বা কত আর বড় হবেন…”
“তোমার চেয়ে অনেকটাই বেশি৷ নামটা কী?”
“সৌমিলি…”
“আমি রাঘব৷ রাঘব মুখার্জ্জী৷”
“সৌমিলি চক্রবর্তী…”
“অচেনা, অজানা লোকজনদের এমন পুরো নামধাম বলে দিও না… হে হে৷”
“আপনিও তো বললেন৷”
সৌমিলি দেখছে রাঘবের বুদ্ধিদীপ্ত চোখগুলো ক্লান্তিহীন, অপলক দেখে চলেছে সৌমিলিকে৷ সেদিন গল্প চলল আরও অনেকক্ষণ, অনেকটা সময় ধরে৷ গল্প করতে করতে কখন বসন্তের বিকেল গোধূলিতে মিশে গেছে, ওরা খেয়ালই করেনি৷
“উঠি এবার… আর দেরী করলে বাড়িতে বকবে৷”
“এগিয়ে দিয়ে আসব, সৌমিলি?”
“না, ঠিক আছে, আমি একা যেতে পারব৷”
“সিওর তো?”
“হুম্, সিওর৷”
সেদিন সৌমিলি বাড়ি ফিরে মন বসাতে পারল না রেওয়াজে৷ এত যত্নে গড়া প্রাচীরটা কয়েক ঘন্টায় ভেঙে দিল এক অচেনা যুবক? উঁহু, প্রাচীরটা যুবক ভাঙেনি, সে কেবল ইঁট সরিয়েছে এদিক ওদিক, প্রাচীর তো ভেঙেছে সৌমিলি নিজেই৷ তারই মনে হয়েছে যে এমন বন্ধু এর আগে কখনও হয়নি তার৷ কী যেন আছে রাঘবের বাচনভঙ্গিতে, একটা ভীষণ পুরুষালী গাম্ভীর্য, কিঞ্চিৎ পৌরুষ মেশা অহংকার, কিন্তু তা ভারী তীক্ষ্ণ, কাছে ডাকতে পারে বড্ড তাড়াতাড়ি৷ আর এক অদ্ভুত সুস্পষ্টতা আছে ওর কথাগুলোয়, কোনও পর্দা নেই৷ বন্ধুত্বের এক গভীর ভরসা আছে ওর হাসিটায়৷ ব্যাস, সেই সন্ধ্যে থেকে সৌমিলির ডায়েরিতে ধুলো জমতে শুরু করল বইয়ের তাকে এককোণে পড়ে থেকে থেকে৷ কোনও এক মানুষের মধ্যে দিনলিপি লিখতে পারলে, একতাড়া কাগজ আর কার দরকার পড়ে?
লাইব্রেরিতে এখন নিত্য যায় সৌমিলি, তবে লাইব্রেরি ঠিক না বলে, ওই পার্কটাকে নির্দেশ করাই ভালো৷ কারণ সৌমিলি যায় ওই পার্কেই, বিকেল মেশা গোধূলিগুলো ওর আর রাঘবের নামে বিকিয়ে গেছে যেন, ওরাই রাজ করে ওই সময়ে৷ এখন ওরা বেস্ট ফ্রেন্ডস৷ এর চেয়ে বেশি দরকারই বা কী সৌমিলির? এই বেশ আছে৷ মাঝে মাঝে অবশ্য দ্বন্দ লাগে রাঘবের সাথে, দ্বন্দ মিটতে লেগে যায় মোটামুটি দিন তিন-চার, ততদিন লাইব্রেরি ভ্রমণ স্থগিত থাকে সৌমিলির৷ মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে তখন এই কিশোরী৷ খাওয়া দাওয়া টঙে তুলে, ঘুম মাটি করে কেবলই ভাবে ওপার থেকে আসবে বোধ হয় কথা বলার অনুরোধ, আসবে বোধ হয় গলে যাওয়া কন্ঠের ক্ষমা প্রার্থনা৷ সে আর আসে না৷ সৌমিলি শেষ মেশ দ্বিধাহীন সুরে ক্ষমা চেয়ে নেয়৷ কারণ অভিমান ধরে রাখতে ভারী কষ্ট হয় যে মেয়েটার৷ গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে চাপ চাপ একাকীত্ব৷ এই এত বড় পৃথিবীটায় রাঘব ছাড়া কে বা আছে ওর? কেউ না, কেউ না৷ তাই হারাতে চায় না সৌমিলি এই হঠাৎ পাওয়া হীরের টুকরোটাকে, যত্ন করে আগলে রাখে যেভাবে পারে৷ তাই ও ক্ষমা চেয়ে নেয়… “রাঘবদা, সরি, তুমি কী সত্যি আর কথা বলবে না আমার সাথে?”
“বলব সৌমি, কিন্তু এই বাড়াবাড়িগুলো মানায় না তোকে৷ ছোট হয়ে ছোটর মত আচরণ করবি এ তো নতুন কথা নয়, তবে এতটা করিস না৷”
উচ্ছেভাতে গেলার মত গিলে নেয় সৌমিলি কথাগুলো, শুধু শেষ পাতের মিষ্টির আশায়৷ সে মিষ্টির খোঁজ করতে গিয়েই প্রথম ঠোক্করটা লাগল ওর…
“রাঘবদা…”
“হুম্?”
দিনের শেষ আলোর ছায়া এসে পড়ছে রাঘবের টিকালো নাকে, চোখগুলো কী ভীষণ আলোময়৷
“বলছি… প্রেমটেম কর না তুমি?”
“পাকা পাকা কথা জিজ্ঞেস করিস না তো৷”
“বল না! কাউকে ভালো টালো লাগে না…?”
ঠিকই ধরেছেন, সৌমিলি প্রশ্নটা করেই ছিল উত্তরে ওর নিজের নামটা শোনার জন্য৷ কিন্তু মজার বিষয় কী বলুন তো? আমরা ভাবি এক, আর হয় আর এক৷ আমরা সাজাই নিজের চাল, আর বিধাতা হেসে সেই চাল নিজের কবলে নিয়ে নেন এক নিমেষে৷ আমাদের অজান্তেই সেই লেখক কলম হাতে লিখে চলেছেন আমাদের জীবনের উপন্যাস, পরের পৃষ্ঠায় কী চমক, আর তা আনন্দের নাকি দুঃখের, সে কথা জানি না আমি, আপনি কেউই৷ যাই হোক, রাঘব এই প্রশ্নের উত্তরে সপ্রতিভ হেসে বলল,
“কলেজের বান্ধবী, জানিস তো? ঐশী৷”
“ঐশী? ভারী মিষ্টি নামখানা…”
সৌমিলি ভীষণ পটুকন্ঠে ঠেলে সরাচ্ছে গলার কাছে উঠে আসা কান্নার দমক৷
“হুম্… ভীষণ পিছনে লাগে, জানিস? মানে সে অদ্ভুত মানুষ আর কী৷ আমার সানগ্লাস টেনে নিয়ে ক্যেত মেরে আবার ছবি দেবে জানিস তো?”
“হিহিহি… তাই বুঝি?”
এ হেন অভিনয় যেন কোনও শত্রুকেও না করতে হয়, এই প্রার্থনাই করছিল সৌমিলি৷
“তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবোখণ৷”
“উঁহ্, সে আর বলতে? আচ্ছা, খুব সুন্দরী গো?”
“কলেজে সবার ক্রাশ ছিল, গাদা গাদা প্রোপোজাল রিজেক্ট করে, আমার মত পাগলের কাছে এসে উঠল শেষে… ভাব একবার?”
এ কথা সৌমিলিকে অবাক করে না, ভাবায় না একটুও৷ রাঘবকে পলকে ভালোবেসে ফেলা যায়৷ রসিকতা, বুদ্ধিদীপ্ততা, ভরসার এক আশ্রয়, তার কাছে কার না জায়গা পেতে ইচ্ছে করবে, শুনি?
“হেহে… মোটেও পাগল না৷ ঐশীদি একদম ঠিকঠাক মানুষ বেছে নিয়েছে, যাই বল৷”
“ধুস্… ভাও খাওয়াস না৷”
“বৈকি!”
কান্নার তোড়ে সেই রাতে বালিশটা ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছিল সৌমিলির৷ সান্ত্বনা দিতে সৌমিলি ভারী ওস্তাদ, সে নিজেকে বোঝাচ্ছিল, বন্ধুত্বই সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধন, এর চেয়ে সুখের আর কিছু নেই৷ সাফল্যও অর্জন করেছিল সুখী থাকতে৷ রাঘব আর সৌমিলির বন্ধুত্ব রয়েই গেল তাই৷ ঠিক যেমনটা ছিল৷ রাঘবের দোষ বলতে ইগো, আর রাজার মত মেজাজ৷ সৌমিলি কিন্তু তার এই সবে ধন নীলমণি বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে দিব্যি অ্যাডজাস্ট করে নিত সে সবের সাথে৷ মাঝে মাঝে উঠত ঐশীর কথা, কিছুক্ষণের জন্য অন্তরের দহনে পুড়ত সৌমিলি, আর বাইরের হাসিখানার জোয়ারে কেবলই সেই দহনের জ্বালা জুড়িয়ে নিত ও নিজেই৷
ঋতুরাজ বিদায় নিয়েছেন প্রকৃতির মঞ্চ থেকে৷ গ্রীষ্ম এসে হাজির সেখানে৷ বেলা বেড়ে যায় এ সময়৷ অনেকক্ষণ গল্প করতে পারে সৌমিলি রাঘবের সাথে৷ কিন্তু আজ রাঘব নেই… এর পর এক, দুই, তিন করে পর পর সাতদিন রাঘব নেই, কোথাও নেই৷ সৌমিলির ঘুম উড়ে গেছে, হাসি মুছে গেছে, রাঘবদা কী আর আসবে না? চলে গেল নাকি অন্য কোথাও? বলে গেল না তো?
অষ্টম দিনে অকাল বৃষ্টির মত কোত্থেকে থমথমে আকাশ-বরণ মুখ নিয়ে হাজির হল রাঘব৷ সৌমিলি তার অভিমানের ঝুলি খোলার আগেই রাঘবের মুখ দিয়ে যে কথা গুলো বেরোলো, সেগুলো শুনে সৌমিলি বুঝতে পারল না ওর কেমন অনুভূতি হওয়া উচিৎ৷
“সৌমিঃ.. ঐশী আমার সাথে আর নেই৷ কেন নেই, আমি জানি না৷ পোষাল না ওর৷ জানতামই এমনটা হবে৷”
সৌমিলি প্রথম কাঁদতে দেখল রাঘবকে৷ ঐ দীপ্ত মুখে এমন ঘনঘটা মানায় না একটুও৷ তাই সৌমিলির নতুন অধ্যায় শুরু হল, দাঁড়ান দাঁড়ান, প্রেম শুরু হচ্ছে না ওদের৷ সৌমিলি সুযোগ নিতে চায়নি, পারে না৷ তাই ঠিক করল নিজের বন্ধুত্বের সবটা দিয়েই ফিরিয়ে দেবে রাঘবদার সেই চিরাচরিত, উচ্ছ্বল, রসিক ব্যক্তিত্ব৷ সৌমিলি জানত ঐশীকে ঠিক কতটা ভালোবাসত রাঘব, সৌমিলি সে ভালোবাসা চেয়েও পায় না, আর ঐশী হেলায় তা পেয়েও ফিরিয়ে দিল৷
সৌমিলির দায়িত্ব হয়ে গিয়েছিল রোজ পার্কে বসে রাঘবকে গান শোনানো, তা শুনে কখনও রাঘবের ঠোঁটে হাসি ফুটত, আবার কখনও রাঘবের চোখে জল আসত৷ কিন্তু ওদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল অসাধারণ রকমের গভীর৷ দুজনেরই আর দুজনকে ছাড়া দিন কাটে না৷ ঝগড়া হয়ই, কিন্তু সে তো সব বন্ধুত্বেই হয়৷ ভুলের মধ্যে যতটুকু করে ফেলল সৌমিলি, তা হল একদিন গানের শেষে সাহসে ভর করে ফেলে বলে ফেলল… “রাঘবদা, আমার তোমাকে ভালো লাগে৷”
“হুম্ তা ভালো তো, আমি তো খারাপ না যে খারাপ লাগবে৷”
“না, সেটা না…”
“সৌমি, তুই আমার থেকে অনেকটা ছোট, এখন ওসব নিয়ে ভাবিস না৷ আছি তো আমরা৷”
“আচ্ছা…”
ঠিকই তো৷ আছে তো ওরা, এখন তাই ওসব থাক৷ বন্ধুত্বেই বেশ আছে৷ তাই সে কথা আর উঠল না৷৷ তবে সৌমিলির কোথাও একটা মনে হত বন্ধুত্বে সে অধিকারবোধ নেই, যা প্রেমে আছে… আর একজনকে অধিকার করার ক্ষমতাও কী সৌমিলির নেই? নাহ্, সে সবে দরকার কী বাপু, রাঘব থাকলেই হল৷ রাঘব ছিলও, কিন্তু পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে৷ ঝগড়াগুলো আস্তে আস্তে রাঘবের অস্ত্র হয়ে গেল যেন, রাঘবকে এমন রূঢ় হতে তো দেখেনি সৌমিলি? সৌমিলি অন্ধের মত হাঁতড়ে হাঁতড়ে কেবল ওর নিজের দোষ খুঁজতে লাগল৷ রাঘবের এমন চরম ব্যস্ততা সৌমিলি আগে দেখেনি, এরকম কাজের বহর যেন শুধু সৌমিলিকে এড়িয়ে যাওয়ারই নামান্তর, আর সৌমিলি… সে নিজেকে যতটা নীচে নামাতে পারে, ততটাই নেমে ক্ষমা চেয়ে যেত৷ রাঘব স্বেচ্ছায় বন্ধুত্বের ডোরটা ছিঁড়তে শুরু করেছিল, সৌমিলি একটু একটু বুঝতে পারছিল সেটা৷ লাইব্রেরি আসত না আর রাঘব৷ পরে জিজ্ঞেস করলে বলত, “ভালো লাগছিল না”৷ আর সৌমিলি? সে তো বন্ধুত্বের ওপর অর্ধেক বিশ্বাস এমনিই হারিয়ে ফেলেছিল৷ তার অবশিষ্টটুকু হারিয়ে ফেলল সেদিন…
“রাঘবদা, আমি তোমার থেকে বেশি তো কিছুই চাইনি৷ একটু সময়, একটু বন্ধুত্ব? আমাদের বন্ধুত্বের শুরুর দিনগুলো কী তুমি ভুলে গেলে? আমার দোষটা কী, বল না?”
“সৌমিলি, আবার শুরু করিস না, রোজ রোজ ভালো লাগে না!”
“রোজ রোজ আসোই তো না তুমি এখানে৷ রাঘবদা, তুমি বলেছিলে কিন্তু যে আমি তোমার বেস্টফ্রেন্ড, তাকে কেউ এভাবে ইগনোর করে?”
“উফ্ কী রিডিকিউলাস রে বাবা৷ একটা এইটুকু মেয়ে আমার বেস্টফ্রেন্ড হতে যাবে কোন সুখে? পাগলের মত কথা বলছিস এবার…”
“কিন্তু তুমি বলেছিলে…”
“আমার মনে পড়ছে না, মনে করতেও চাই না৷”
ব্যাস, ঐ শেষ৷ ডায়েরিটার ধুলো সরে গেছে আবার৷ আজ প্রায় ছ মাস হয়ে গেল ওদের যোগাযোগ নেই৷ কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে এখন দিব্যি হাসতে শিখে গেছে সৌমিলি৷ আবার মিশতে শিখে গেছে, কিন্তু মেশার গন্ডি টেনে রেখেছে, কারণ আবার এসব ঝামেলা তার চাই না৷ দুঃখের গান শুনলে সৌমিলি কাঁদে, কখনও আবার হাসে স্মৃতির জেরে৷ রেগে যায় বড্ড তাড়াতাড়ি৷ হাল ছাড়ে বড্ড তাড়াতাড়ি৷ হাঁপিয়ে যায়৷ ক্লান্ত হয়ে যায়৷ ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করে এক হোপলেস রোম্যান্টিক গল্প৷
তারপর? তারপর আর কী… পৃথিবীর গতি বজায় থাকেই, সৌমিলি আবার মন খুলে বাঁচতে শেখে৷ একা একা৷ নিজেকে ভালোবাসতে শেখে৷ না, আশা ফেরায় না৷ প্রেমে তার বিশ্বাস ফেরে না৷ কিন্তু সৌমিলি আর কাঁদে না, ও হাসে, গান গায়, বই পড়ে আবার৷ প্রশ্ন ওঠে মনে, মনে হয় কেন কেউ ওকে ভালোবাসতে পারে না… কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরটা যে খুব দরকারী, এমন মনে হয় না তার৷
এখন গানের ক্লাসের নতুন বন্ধু অর্জুনের সাথে দিব্যি আড্ডা দেয় মাঝে মাঝে৷ তখন কে বলবে এই মেয়ের কত রাত চোখের জলে গড়ায়৷ প্রেমের অনুভূতি হারিয়ে গেছে সৌমিলির, তাই আর কাউকে ভালো লাগে না ওর৷ সবাই বন্ধু, এমনই থাকুক… এটাই মনে হয়৷ নিছক বন্ধুত্বে কী ভীষণ শান্তি, তা সৌমিলি এখন বোঝে৷ ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডাতেই কেটে যায়, কই তাদের তো ঝগড়া হয় না? তাদের তো ইগোর লড়াই হয় না? আসলে দরকার নেই, দরকার লাগে না এত নিয়ম… দরকার লাগে না কোনও গন্ডি৷ মানসিকতার মিল, ওটাই আসল৷ আমার আপনার ধারণায় আঁটতে পারব না এসব কথা৷ কেউ বহু দিনের আপন হয়েও পর হয়ে যায়, আবার কেউ দুদিনের পরিচয়ে আপন হয়ে যায়৷ অর্জুন সেরকমই৷ রাঘবের মত নয়, সৌমিলির মতই একেবারে৷ আর হঠাৎ একদিন এই অর্জুনই বলল…
“সৌমিলি, তোমাকে কেমন যেন ভালোবেসে ফেলেছি৷”
নিভে যাওয়া বহ্নিশিখা কোথা থেকে যেন দপ্ করে জ্বলে উঠল৷ কোথায় গেল সৌমিলির ফিলোফোবিয়া? সৌমিলির সব ইন্দ্রিয় আজ অর্জুনের দলে, তাই বুঝি সৌমিলির ঠোঁট নড়ে উঠল… জবাব দিল,
“বেশ, থেকে যাব তোমার সাথে বাকি জীবন৷”
আজ কতদিন হয়ে গেল সৌমিলি আর অর্জুন একসাথে৷ সৌমিলির সেই কল্পনার প্রাণপুরুষ এতদিনে মুখ বিবর পেয়েছে, অর্জুনের চোখদুটো ভারী মানিয়েছে তার মুখে৷ এমনটাই, এমনটাই ছিল সেই প্রাণপুরুষ৷ সৌমিলির কল্পনা আবার ডানা পেয়েছে৷ সৌমিলি এত ভালো আগে কখনও থাকেনি৷ এমন ভালো তাকে কেউ বাসেনি৷ ঈশ্বর আর যাই হোন, একেবারে নির্দয় নন… পাতা ঝরার মরশুম পার হলে, তিনি সবুজের ব্যবস্থাও করেন৷
আমি জানি, ওরা এমন করেই থেকে যাবে৷ হেমন্তর রূক্ষতা, শুষ্কতা কাটিয়ে বসন্ত এসেছে বহুদিন পর৷ ওরা এমনই থাকুক৷ পৃথিবীর সব সৌমিলি এমন এক অর্জুন পাক৷ আপনারাও শুভেচ্ছা দেবেন, কেমন?