“খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি মনের ভিতরে খেলাঘর”…
গানটা গাইতে গাইতে হঠাৎ অর্চি শুনতে পেল
‘তুমি অনেক বদলে গেছ’!
কথাটা শুনেই অগাধ বিস্ময়ে তাকানোর পর অর্চি উত্তর দিল –‘না। বদল আমার হয়নি। বদল হয়েছে তোমার দৃষ্টিভঙ্গির ’।
অর্পিতা সস্নেহে একপ্রকার আনমনা হয়েই রইল। অর্চি বলে চলল… ‘কি জানো তো বহুদিন ধরে তুমি দেখছো, তাতে তোমার প্রথম দিনের দেখার মধ্যে যে না জানা, না বোঝা ও বিস্ময়মাখা কৌতূহল ছিল, আজ আর তা নেই। আজ তুমি আমার সবটা জেনে, বুঝে সয়ে গেছ। তাই মনে হল পরিবর্তন। আসলে ছোটোখাটো না দেখা ও না লক্ষ্য করা তুচ্ছ বিষয়গুলো আজ তুমি আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছ, তাই খুঁত বা ভুল বলে মনে হচ্ছে। আসলে সময়ের সাথে মানুষ বদলায়। সেটা সময়ের পরিবর্তন, মানুষের নয়। কথাগুলো বলতে বলতে অর্চি খেয়াল করে অর্পিতা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। এ কথাগুলো তাকে বড্ড ভারী করে তুলেছে। বুঝতে চাইলে খুব গভীর, কিন্তু না বুঝতে চাইলে কাব্যিক মনে হবে। যদিও তাতে আমার কিছু যায় আসে না,’ অর্চি বলল।
দিগন্তের ওপারে সূর্যের লাল রেশটুকু মিলিয়ে যাবার এমন গভীর মুহূর্তে হঠাৎ ট্রামের ঢং ঢং শব্দে ঘোর কাটল অর্পিতার। ‘সে না হয় হল। কিন্তু কালকের কথাটা কি মনে আছে?’ অর্পিতার কথাটা কেমন পানসে লাগল অর্চির। অর্চি ভেবেছিল এত গভীর কাব্য অনুসন্ধানের ঘোর কাটার পর আরও কোনও মূল্যবান বাক্যবিনিময় হবে। কিন্তু তা হল না।
কারণ অর্পিতা তো আর সেই আগের মতো নেই এটা ক্ষনিকের জন্য অর্চি বোধহয় ভুলে গিয়েছিল।
৫ বছর আগের এক বিষাদময় অভিজ্ঞতার দিন কাল। অর্চি ও অর্পিতার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ঐ দিন। এর জন্য একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে…
২০১০ সাল। হাওড়ার নামকরা নরসিংহ দত্ত কলেজের তিন তরুণ-তরুণী। উচ্ছাস আর উদ্দীপনায় ভরপুর এক যৌবনের সমাগম। অবনী নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মধ্যম মানের এক যুবক। অর্চি আর অর্পিতা দুজনেই সম্ভ্রান্ত ঘরের প্রতিশ্রুতিমান স্কলার। তাঁদের তিনজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব একটু অবাক লাগে। অবনী শহরতলির দাশনগরে থাকে। কারখানা আর ঘিঞ্জি জন-বসতির একফালি ঘরে বাস তার। অর্পিতা তাকে বন্ধু মনে করলেও স্টেটাস এ মেলে না বলে মাঝে মাঝে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। আর করবে নাই বা কেন, রূপের এমন ছটা যা অন্যকে উপহাস করার অধিকার দেয় বটে। যদিও অর্চিকে সে ভীষণভাবে চায়। অর্চিও তাকে ভীষণ ভালোবাসে।
ইংরেজি অনার্স এর একটা গ্ৰুপ ছিল। কলেজের বন্ধু-বান্ধব’দের একটা বড় গ্রূপের চালিকা-শক্তি ছিল অর্পিতা। সারা কলেজ তাঁর সাথে একটু মিশতে ও সান্নিধ্য পেতে কি না করেছে। একবার কলেজ এর বাৎসরিক অনুষ্ঠানে কলকাতার নামি ব্যান্ড এর গান গাইবার কথা, অথচ কোনও এক রাজনৈতিক দলের মিছিল এর জন্য রাস্তা ভীষণ ভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সেই ব্যান্ডের আর কলেজ এর অনুষ্ঠানে গান গাওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরা তাদের অসুবিধার কথা টেলিফোনে জানায়। কিন্তু কথা হল এত স্টুডেন্টদের চাওয়া কি একটা সরি বললেই মাফ হয়ে যায়, একথা কর্তৃপক্ষ জানত। কিন্তু কি বা করতে পারে?
অর্চি, অর্পিতা ও তাঁদের বন্ধুরা নিজেদের কাঁধে গুরুদায়িত্ব নিয়ে নিল। অবনী যে কলেজে কত ভালো গান গায়, তা কেউ না জানুক অর্পিতা ভালই জানত। খুব দ্রুত নিজেদের ইগোকে দূরে সরিয়ে অর্চি, অর্পিতা ও অবনী এই তিন বন্ধুর পারফরমেন্স দেখল নরসিংহ দত্ত কলেজ। প্রথমে ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি’, তার পর ‘তোমার খোলা হাওয়া’, এর পর ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ‘…
একটা গান সারা কলেজের পরিবেশকে নিমেষে বদলে দিল। করতালিতে কলেজ প্রাঙ্গন ফেটে পড়েছে। প্রিন্সিপাল মানব বাবু হঠাৎ স্টেজে উঠে অবনীর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিলেন, বুঝিয়ে দিলেন‘তুমি না থাকলে কলেজের মান কতথাকত না’…
অর্চি ধরল ‘ বন্ধু দেখা হবে ‘….
অর্পিতা ধরল লতা মঙ্গেশকরের অনবদ্য হিট গান।
দীপ্ত, সমর, পায়েল, হৃদয়, সংযুক্তা সবাই যোগ্য সংগত করল, না হলে এত বড়ো অনুষ্ঠান করাই যেত না। শেষে সকলের অনুরোধে সমবেত কণ্ঠে ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় ও সেই ‘… গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করল অর্চি রা।
গান শেষে গ্রিন রুমে অর্চি, অর্পিতা ও অবনী। অবনীর রবীন্দ্র সঙ্গীতের কালেকশন দেখে অর্পিতা বলেই ফেলল, ‘তু্ই পারিস বটে’?..
অবনী বলল, ‘কেন?’
‘আরে তুই তো প্রেমের গান না ভেবেই গরগর করে গেয়ে দিলি, তা হিয়ার মাঝে কে?’
বলল অর্পিতা।
‘ছাড় তো, তোদের কথা শেষ হলে আমি কিছু বলি।’ এই বলে অর্চি এগিয়ে এল। এখনও খাওয়া হয়নি। তাই তিনজনে মিলে টিফিন আনতে গ্রিন রুমের বাইরে এল।
কলেজ এর অনুষ্ঠান শেষে অবনী চলে যেতে অর্পিতা আর অর্চি একসাথে ফিরবে বলে অপেক্ষা করছিলো। অন্ধকার নেমে এসেছিল। দুজন কলেজ পড়ুয়া নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। অর্পিতা অর্চির সামনে এগিয়ে এল। নিস্তব্ধ রাস্তায় হালকা নিয়নের আলোতে দুটো মানুষের অন্তরঙ্গ মুহূর্তে কেমন এক অদ্ভুত হাওয়া বয়ে গেল। দুজনে টেরই পেল না। দুটো হাত পরস্পরের আরও কাছাকাছি এসে পড়েছে, খুব জোরে এক ঝটকায় অর্চি অর্পিতাকে কাছে টেনে নিয়ে আলিঙ্গন করতে থাকল। জীবনের প্রথম চুম্বন অর্চিকে আরও রোমান্টিক করে তুলল। অর্পিতা বাধা দেয়নি। হঠাৎ সাইকেলের বেল এর শব্দে তাদের সম্বিত ফিরল।
বাড়ি ফিরে অর্পিতা প্রেমের ছন্দে গুন গুন করে গান গাইতে লাগল। মা-বাবার খুব আদরের একমাত্র সন্তান হবার সুবাদে অর্পিতার কোন ব্যাপারেই কখনই তাঁরা বাধা দেয়নি। আজকের রাতটা বড় আনন্দে কেটে যাবে একথা অর্পিতা তাঁর মা কে বলেছিল। অর্পিতার মা মেয়ের এমন ফুরফুরে মেজাজ দেখে কিছু আন্দাজ করেছিল বোধহয়, তাই অন্য দিনের মতো আজ আর রাতে কিছুটা সময় মেয়ের সাথে গল্প না করেই চলে গেলেন।
১৩ই ফেব্রুয়ারী ২০১৩, বুধবার
সকালের রোদ একবারে সোনালী আলোর পসার নিয়ে অর্পিতার ব্যালকনিকে ভরিয়ে তুলেছে। ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হল আজ। মা কয়েকবার ডেকে ফিরে গেছে। হঠাৎ ক্যালেন্ডার এর পাতায় চোখ যেতেই মনে পড়ল আজ তো বেতার দিবস…
এই রে রেডিওর অফিসে তাঁর যাবার কথা। একটি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করে সে প্রথম হয়েছে, আজ বেতার দিবসে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেবে RJ রাধিকা। খুব দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল অর্পিতা। রাস্তায় ভিড় ছিল না। কলকাতার ঘুম ভেঙেছে অনেক সকাল। বেলার হালকা হাওয়া ও গাঢ় রোদে বেশ একটা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বেতার কেন্দ্র থেকে ফিরেই চলে গেল কলেজে। আগামী পরশু সরস্বতী পূজো। দৃপ্ত, হৃদয়, সংযুক্তা আগেই হাজির। অবনী আসেনি। অর্চি আসছে, অথচ অর্পিতা কেমন এক ভাবুক হয়ে রইল। অবনী আসেনি বলে কি তার এই ভাবনা…
যাইহোক সরস্বতী পূজার সব আয়োজন একসাথে কয়েকজন বন্ধুর দায়িত্বে ওরা করে ফেলল। অবনী এল একটু বৈকাল করে। উস্কোখুস্কো চুল, মুখে একরাশ ক্লান্তি কেমন যেন সব হারিয়ে এক পথিক তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে। মুখে গতকালের আনন্দটুকু নেই। কী হয়েছে জানতে গিয়েও অর্পিতা নিজেকে সামলে নিল। কলেজ জুড়ে সবাই অবনীর প্রশংসা করলেও একমাত্র অর্পিতা তাকে হেয় করে গেছে সবসময়।সংযুক্তা বলল ‘কি রে তোর কি হয়েছে?’
অবনী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল বোনের দুটো কিডনিই বিকল। কদিন ধরেই যন্ত্রণা হচ্ছে। আজ আর নিতে পারল না। হাওড়া হাসপাতালে ভর্তি করেছি। কিন্তু নতুন কিডনি ডোনার না পেলে কী যে হবে…
কাঁদতে থাকে অবনী।
অর্পিতা এর মাঝে বলে ওঠে, আমরা তোর বোনের জন্য একটা কিডনি ডোনার খুঁজব, পারলে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবো। টাকা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না বুঝলি….অর্পিতার মুখে শুধু গরিব মানুষের অপমান, হেয় করা দেখেই অভ্যস্ত ছিল অবনী। আজ হঠাৎ তার মুখে এই রকম সহানুভূতিশীল কথা শুনে একটু অবাক হয়ে গেল অবনী। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অর্চি, সংযুক্তার হাততালিতে মহলটা কেমন বদলে গেল। একটা দমবন্ধ করা ছটফটানির পর এমন মনোরম পরিবেশ আমরা কেউ ভাবিনি। ওহ বলা হয়নি আমি তোমাদের লেখক, বক্তা ও সব ঘটনার সাক্ষী। আমি ধৃতিমান। অবনীর সেদিনের সেই না চাওয়ার ও না পাওয়ার মাঝে অর্পিতার মনুষ্যত্ব নিংড়ে নেওয়া কথা অবনীকে বেশ তৃপ্ত করেছিল। সরস্বতী পূজার আগের দিন ছিল ভ্যালেন্টাইন্স ডে। প্রেমিক-প্রেমিকা তাঁদের এই দিন খুব রোম্যান্টিক করে কাটায়। অর্চি-অর্পিতা সেদিন নিজেদের সব না বলা কথা বলেছিল। আমি আবার অন্য জিনিস দেখেছিলাম। দুপুরে একটা সময় পূজার আয়োজন করতে করতে অবনী হঠাৎ প্রপোজ করে বসে অর্পিতাকে। অর্পিতা ভাবতেই পারেনি যে অবনী এমন কিছু করবে। আমি ভুলতে পারিনি সেই দৃশ্য।
বেলা দুটো হবে। সবাই লাঞ্চ খেতে চলে গেল।
অবনী গতকালের অর্পিতার তাঁর পাশে থাকার কথা ভুলতে না পেরে একটু সাহস নিয়েই অর্পিতার সামনে হাজির হয়ে বলে বসল, ‘তোকে আমি পেতে চাই। তুই জানতে চাইছিলিস না হিয়ার মাঝে কে, আজ তাই বলতে এসেছি। অর্থ দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে ঘর বাঁধবো, তোকে সুখী রাখব… বিশ্বাস কর তোর চোখে আমি আমার মরণ দেখতে পাই… i love you অর্পিতা…’
অর্পিতা এগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর বল্ ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াচ্ছিস?
নিজের দিকে দেখেছিস কখনও? কী আছে তোর? কাল একটু সহানুভূতি দেখিয়েছি অমনি ভেবে ফেললি ভালোবাসার কথা। ওরে আমি অমন সহানুভূতি গরিবদের দেখাই। তোর স্টেটাস ্কী?
থাকিস তো ঐ…
থাক সে কথা। শোন্ আমি অর্চিকে ভালোবাসি। আর সেও আমায়’….
সেদিন তাঁদের কথা শুনে ফেলে কাউকে বলতে পারিনি। নিজে প্রেমে পড়িনি, তাই বলে অবনীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সাক্ষী ছিলাম। বোনের চিকিৎসার সব টাকাপয়সা ও কিডনি ডোনার খোঁজা সব করেছিল অর্পিতা। হয়তো করুণা করেছিল সে। বোন সুস্থ হতে অবনী একটু স্থির হয়ে বসে ভবিষৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল, কয়েকবার তার প্রেমে আঘাত পাওয়ার বেদনা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। কলেজ শেষ করে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে সেলসের চাকরিতে ঢুকে গেল অবনী। অর্চি ও অর্পিতা দুজনেই চলে গেল বিদেশে বাকি পড়াশোনা শেষ করতে। দীর্ঘ ৫বছর পর দাশনগরে ফিরতে হঠাৎ তাদের দুজনের সাথে দেখা হয় জীবন যুদ্ধে লড়াই করা অবনীর। অবনীর অবস্থা এখন বেশ স্বচ্ছল। একমাত্র বোনের বিয়ে দিয়েছে স্কুল শিক্ষক অনাদি রায় এর সাথে। সুখেই আছে সে। বাবা মারা গেলেও মা’কে নিয়ে বেশ আনন্দেই আছে। এরিয়া সেলস ম্যানেজার পদে নামডাক হয়েছে, এককথায় বেশ ভালো আছে।
দরকার শুধু একটা সঙ্গী, ব্যাস আর কী চাই।
অর্পিতা ও অর্চির সাথে দেখা হতে সাময়িক না চেনার পরেই পরস্পর নিজেদের পুরানো স্মৃতির প্রসঙ্গ উঠতেই তারা যেন হঠাৎ কলেজ জীবনে ফিরে গেল। অর্পিতাকে দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে। যৌবনের রঙে সে আরও রঙিন হয়ে উঠেছে। অর্চি হ্যান্ডসাম। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি নিয়ে সাক্ষাৎ বিদেশী বাবু হয়ে ফিরেছে। অনেক দিন পরে তাদের দেখা হতে সবাই পরস্পরকে তুমি বলে সম্মোধন করল। আফটারঅল সবাই অ্যাডাল্ট এবং বহুদিন পরে দেখা হতে কেমন যেন তু্ইটা ঠিক এলনা অবনীর। অর্চি এখন যদিও অর্পিতাকে তুমি বলেই ডাকে। যাই হোক ৫বছর আগে যে কথা অবনী বলেছিল আজ আবারও একবার সে কথা বলার সাহস সে সঞ্চয় করেছে। অর্পিতাকে একটু আলাদা পেয়ে সে তার জন্য আজও পথ চেয়ে বসে আছে এ কথা জানায়। অর্পিতা তা শুনে ভীষণ রিঅ্যাক্ট করে এবং অবনীর ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে উপহাস করে। বুঝিয়ে দেয় অর্পিতা শুধু অর্চিস্মানের। অবনীর বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর স্বভাব আজও বদলায়নি। সে যেন ভুলে যায়, এ সম্পর্ক কখনই সম্ভব নয়।
অর্পিতা তাঁদের বিদেশ থেকে ফেরা উপভোগ করতে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়ে যে অবনীর সাথে বাদানুবাদ ভুলেই গিয়েছিল। অর্চির সাথে মল ও রেস্ট্রুরেন্ট ঘুরে দু দিন কেটেই গেল।
“২১সে জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার”…
ঝিলের পাড়ে এক যুবক মানুষের মৃতদেহ পাওয়া যায়। বেশ সুদীর্ঘ চেহারা, দামী পোশাক, হাতে গোল্ডেন রঙের টাইটান এর ঘড়ি। পোস্টমর্টেম এর আগেই জানা যায় ওটা অবনীর মৃতদেহ। অর্পিতার সাথে বাক্যবিনিময়ের ৩ দিন পর অবনীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিলো। পোস্টমর্টেম এ বিষ খাওয়ার কথা বললেও কেউ জানত না যে তাঁর বিষ খাবার কারণ।
অর্চি শুনেই ছুটে গিয়েছিলো, অর্পিতা যেতে পারেনি।
কোনও এক অপরাধবোধ তাকে অবনীর সামনে নিয়ে যেতে পারেনি। কেউ না জানুক অর্পিতা জানত বা বললে ভালো আন্দাজ করেছিল যে অবনীর আত্মহত্যার আসল কারণ। সে নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছিল, ভালো ভাবে কারও সাথে কথা বলত না। দীর্ঘ এক মাস এই ভাবেই চলল। প্রিয়তোষবাবু মেয়ের জন্য বিলেত ফেরত ডাক্তার আনলেন। কিন্তু কিছু উন্নতি চোখে পড়ল না। এমন ঘটনা ঘটবার পরে কলেজের সংযুক্তা, হৃদয়,দৃপ্ত দেখা করে গিয়েছিল অর্পিতা ও অর্চির সাথে, কেউ মেনে নিতে পারেনি। একমাস পরে সে যেন কেমন দিকভ্রষ্ট,প্রাণহীন জ্বড় পদার্থে পরিণত হয়ে গেল।
ভালো ভাবে কথা বলে না, খায় না, ঘুমায় না। বহু মনোবিদ, ডাক্তার দেখানো হলেও মানসিক ভাবে সে এমন বিপর্যস্ত হয় যে তাকে সুস্থ অবস্থায় ফেরানো একপ্রকার দুঃসাধ্য হয়ে যায়। পরিবারের সাথে কথা বলে অর্চি বহু চেষ্টা করে। নিজের নতুন চাকরিকেও বাজি রেখে অর্পিতার মনটা ভালো করতে কোথায় না গেছে, কি করেনি, তাও অর্পিতা কে সুস্থ জীবনে আনতে পারেনি। অর্চি এত ভালোবাসতো যে অর্পিতার জন্য সব সে করতে পারত, সেটা সে দেখিয়ে দিয়েছিল।
“৫ই জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার”
অনেক বছর কেটে গেছে। গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে। আজ ২০২১ এ এসেও অর্পিতার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি অর্চি। এখন অর্পিতা মাঝে মাঝে সুস্থ বোধ করলেও আবার কেমন একমনে বিড় বিড় করে। তবে কাকতালীয় ভাবে অবনীর মৃত্যুদিন ঠিক কেমন মনে রেখেছে। এটা ভাবতেই পারিনি অর্চি। একটা মৃত্যু সব কিছু ওলোটপালট করে দিল, অথচ তার মৃত্যুদিন অর্পিতা ভুলতে পারল না, এটা ভেবে বেশ অবাক হয় অর্চি।
যে রূপের বড়াই করত অর্পিতা আজ তার দিকে তাকানো যায় না। শীর্ণকায় চেহারা, রঙ-রূপ সব শুষে নিয়েছে। এই বয়সে বার্ধক্যের ছাপ। অবনীর আত্মহত্যা তাকে এমন ভাবে নাড়িয়ে দেয় যেন সে নিজেই তার আত্মহত্যার আসামী। অর্চি ভালোবাসে আজও তাকে, ভীষণ ভালোবাসে।
কি চেয়েছিলো অর্চি, কি না ভেবেছিল। সংসার করবে, জীবনটা এনজয় করে কাটিয়ে দেবে।
একটা ফ্ল্যাট, একটা ব্যালকনি থাকবে। বিদেশ থেকে ফিরে দেশেই চাকরি করে সেটলড করবে। অথচ কোন এক কালবৈশাখী ঝড় সব এলমেলো করে দিল। সুন্দর জীবন কেমন ছন্নছাড়া ও পানসে করে দিল। অর্পিতার প্রতি ভালোবাসার জন্য অন্য কাউকে বিয়ে করল না। তার ভালোবাসার সাথে, নিঃশ্বাস এর সাথে জড়িয়ে আছে শুধু একটা নাম অর্পিতা।
“সত্যি আমি বলতে পারি
সত্যি তুমি শুনতে পারবে?
পারবে না সেই হারিয়ে যাওয়া
দিনগুলোকে ফিরিয়ে দিতে।
যে দিন গেছে স্রোতের সাথে
মিলিয়ে গেছে তারার বাঁকে,
হারিয়ে যাওয়া কাহিনী আমার
ফিরিয়ে দিয়েছে আবার আমায়,
হালকা জলের জলছবি তার
এঁকে গেছে পাতায় পাতায়।
পথের শেষে কুড়িয়ে নিয়ে
গেছে স্মৃতির মণিমানিক্য।
তাও আছি নিয়ে আমি
তোমার স্পর্শের উষ্ণতা সেই,
দিনের আলোয় দেখে গেছি
না পাওয়া সেই স্বপ্নের জলছবি।”
হঠাৎ করে স্বরচিত কবিতা আউড়ে চলল অর্চি।
সাবলীল কথা ও সহজ মানে, অথচ কত কষ্ট ও দুঃখের সমাহার তা শুনলেই বোঝা যায়।
জাগরণে, স্বপ্নে আজও সে অর্পিতাকেই চায়। জানে অর্পিতা কোনও দিন স্বাভাবিক হবে না, সংসার করতে পারবে না, সারাক্ষণ এক অপার্থিব জগতের সাথে কথা বলে যায়। ভালো একটু বোধ করে তবে সেটা সাময়িক। মাঝে মাঝে এত প্রগাঢ় কথা বলে তখন পুরনো অর্পিতাকে খুঁজে পায় অর্চি। কিন্তু সেটা ক্ষনিকের জন্যই। সম্পূর্ণ সুস্থ সে হবেনা কোনোদিন। তাই এ জীবনে দেবার কিছু নেই তার। তবুও অর্চি তার অতীতের সুখস্মৃতি নিয়ে স্বপ্নের জলছবি এঁকেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায়। অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। দুজন মানুষ দিগন্তের ঐ শেষ আলোর সন্ধানে কেমন আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল, আর দূর থেকে শ্রমিক পাড়ার পাশ থেকে ভেসে এল -’আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বিন’….