পাতালপুরের রাজকন্যা| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | আফতাব হোসেন| Bengali Story for Matured
0 (0)

টুপ করে এক ফোঁটা পানি পড়ে কুলসুমের চোখের উপর। চোখ খুলে দেখে, ওর ছাপরা ঘরের টিনের চাল ঘেমে চুইয়ে পড়ছে পানি। এমনই আরও অনেক জায়গা দিয়ে পড়ছে। পাশে আড়াই বছরের ছেলে রশিদ কেঁদে কেঁদে একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। কুলসুম রশিদের ঘুমন্ত শরীরটাকে বুকে আগলে নিয়ে আর একটু সরে শোয়। আর কত সরবে? বাইরে তিনদিন ধরে এক নাগাড়ে পড়ছে বৃষ্টি। আষাঢ় মাস। সেই যে শুরু হয়েছে থামার নাম নেই। কেমন যেন শীত শীত করে কুলসুমের। বুঝি জ্বর আসছে আবার। ঠাণ্ডা মোটা কাঁথাটা গায়ে টেনে দেয় কুলসুম।

ছোট্ট এক কামরার ছাপরা ঘর কুলসুমের। কক্সবাজার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে। ছোট একটা খাট, খাটের পাশেই বেড়ায় দড়িতে ঝুলানো কিছু ময়লা কাপড়। ।স্যাঁতস্যাঁতে, ভেজা। আরেক পাশে মাটির চুলা, আগুন জ্বলেনি কাল থেকে। খাটের নিচে কিছু হাঁড়ি পাতিল, থালা বাসন, চাল ডালের কৌটা। সব খালি। এই একের ভেতরে সব ঘরে, চার বছর ধরে আছে কুলসুম।

হঠাৎ কোথাও বাজ পড়ল। ঠা ঠা শব্দে। ঝনঝন করে কেঁপে উঠল নড়বড়ে টিনের চাল। ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে আঁকড়ে ধরে রশিদ কুলসুমকে। ঘুমের মধ্যেই কুলসুমের ব্লাউজ-হীন বুক হাতড়ায় রশিদ। খাবারের খোঁজে। সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি ছেলেটার। পড়েনি কুলসুমেরও। পরশু ময়মুনা দু কৌটা চাল দিয়েছিল। কাল রাতে পান্তাটুকুও শেষ হয়েছে। যদিও বেশ ভরাট বুক কুলসুমের। সেখানে দু’বছর পরও সন্তানের জন্য খাবার থাকার কথা নয়। তবুও ঘুমের মাঝে দুহাতে খামচে ধরে চোঁচোঁ করে শুকনো বোঁটা চুষে চলে রশিদ। ব্যথায় টনটন করে ওঠে বুক। ছেলেটাকে জোর করে ছাড়িয়ে দিয়ে চিত হয়ে শোয় কুলসুম।

তেল চিটচিটে বালিশের তলা থেকে হাত বাড়িয়ে ছোট্ট একটা ফোন বের করে কুলসুম। বোতাম টিপে চোখের সামনে ধরে। না, আলো জ্বলছে। তবুও গত সাত দিনে একবারও বেজে ওঠেনি ফোনটা। কাল ময়মুনাকে ফোন দিয়েছিল। বন্ধ। বোধহয় কাজে গেছে। কাজে গেলে ফোন বন্ধ থাকে। আজ তো ফেরার কথা। নাকি আজও কাজ আছে? বেশ চালাক মেয়ে ময়মুনা। তাই ওর কাজের অভাব হয় না। শরীর ভালো যাচ্ছে না বলে ইদানীং কাজের ডাক তেমন আসে না কুলসুমের। একবার ভাবে, ফোন করি। আবার ভাবে, থাক, আর একটু দেখি। কাজ থেকে ফিরলে নিজেই আসবে। এই বিশাল রোহিঙ্গা শিবিরে ওই তো কুলসুমের একমাত্র প্রাণের বান্ধবী। ওর কষ্ট বোঝে। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ায়। কাজ জোগাড় করে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটাকে আবার বালিশের নিচে রেখে দেয় কুলসুম। আর অপেক্ষায় থাকে, কখন ফোনটা বেজে উঠবে।

বৃষ্টি ঝরে চলেছে অঝোর ধারায়। টিনের চালে খৈ ফোটা শব্দ। আশে পাশে অনেকগুলো কোলা ব্যাঙ ডেকে চলে এক নাগাড়ে। ব্যাঙের ডাক শুনতে শুনতে কুলসুম হারিয়ে যায় ছেলেবেলায়। বার্মার রাখাইন রাজ্যে তুলাতুলি গ্রামে ওদের দোতলা টিনের ঘর ছিল। বাবা ছিল প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার। জমিজমাও মন্দ ছিলনা। বাবা মার একমাত্র সন্তান কুলসুম। ও হওয়ার সময় মায়ের যে কী এক অসুখ হল? পেট কেটে ওকে বের করতে হয়েছিল। সেই থেকে মা’র আর কোনো ছেলেপুলে হয়নি। দাদী কত গুনগুন করত, আর একটা বিয়ে কর, ঘর ভর্তি ছেলেপুলে হোক। ওর বাবা হেসে বলত, মা, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে মানুষ করতে কষ্ট। আমার কুলসুম একাই একশ। ওকেই আমি মনের মত করে মানুষ করব।

যেদিন এমন খৈ ফোটা বৃষ্টি নামত, সেদিন দাদীও খৈ ভাজতে বসত। খৈ নিয়ে দাদী নাতনী দোতলায় উঠে, জানলা খুলে দিয়ে বৃষ্টি দেখত আর খৈ খেত। খেতে খেতে দাদী ওকে কত গল্প শোনাত। কেমন করে ডালিম কুমার পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে এসে রাক্ষসের হাত থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল। তারপর কেমন করে ডালিম কুমার আর রাজকুমারীর ধুমধামে বিয়ে হল। গল্প শুনতে শুনতে কতদিন কুলসুম দাদীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ডালিম কুমারকে স্বপ্ন দেখেছে।

বছর পাঁচেক আগের কথা। এক সকালে কুলসুম বাড়ির বাইরে টাট্টি করতে গেছে। হঠাৎ কী হল, চিৎকার চেঁচামেচি। গুলির শব্দ। কাঁচা টাট্টির টিনের দরজার ফুটো দিয়ে কুলসুম দেখে, একদল মানুষ। সাথে পুলিশ নাকি মিলিটারি? কাঁধে বন্দুক। ওর বাবাকে ঘর থেকে টেনে এনে বাড়ির উঠোনেই গুলি করে মারল। কুলসুম চিৎকার দিতেও ভুলে গেল। আরেক দল ওর মাকে টেনে এনে উঠোনের পরেই সব কাপড় খুলে ফেলল। তারপর ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে লাগল। যেভাবে এক তাল মাংসকে ছিঁড়েখুঁড়ে খায় হিংস্র কুকুরের দল। একের পর এক। কুলসুমের চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছিল। এক সময় দেখল, মায়ের শরীর নিথর হয়ে পড়ে আছে। বেচে আছে কী মরে গেছে বোঝা যাচ্ছিল না। তারপর মায়ের সেই নিথর শরীর হায়েনার দল গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল। ব্যথায় নাকি গুলির আঘাতে, মায়ের শরীর কয়েকবার কেপে উঠে স্থির হয়ে গেল। কুলসুম দাদীকে কোথাও দেখতে পেল না। ঘরের দরজা বন্ধ করে পিশাচগুলো কী যেন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিল। দেখতে দেখতে সেই আগুনের লেলিহান শিখা যখন আকাশ ছুঁলো। হঠাৎ বন্ধ ঘর থেকে আসা দাদীর চিৎকারে আকাশ ফেটে ফেটে চৌচির হয়ে গেল। আর পারল না কুলসুম, সেই চিৎকারে অজ্ঞান হয়ে টাট্টির মধ্যেই পড়ে রইল।

যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। তারপর কিভাবে রাতের আঁধারে গাঁয়ের একদল মানুষের সাথে নদী পার হয়ে বাংলাদেশে এলো, সে অন্য ইতিহাস। কুলসুম সে সব আর মনে করতে চায় না। এসে ঠাঁই হল এই কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে। ওদের গ্রামেরই আর একটি পরিবারের সাথে।

সেই পরিবারের কর্তা ফজুল্লাহ। ও ডাকত ফজুচাচা। তার পাঁচ সন্তানের সাথে দিন কেটে যাচ্ছিল কুলসুমের কোনোমতে। ফজুল্লাহ ছিল নেতা কিসিমের লোক। রিলিফ, রেশনের মাল ভালই পেত। খাওয়ায় কষ্ট ছিল না তেমন। দেখতে দেখতে কুলসুমের শরীরে, এখানে সেখানে, নতুন পাতা, কুঁড়ি, শেকড় গজাতে থাকে। কুলসুম নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়। হঠাৎ খেয়াল করে, ফজু চাচা আগের চাইতে একটু বেশীই আদর করেন। চুলের ফিতা, চুড়ি, এটা সেটা কিনে দেন। কুলসুম যেন ফজুচাচার মাঝে তার বাবাকে খুঁজে পায়।

রোহিঙ্গা শিবিরে একটা পরিবারের জন্য একটাই ঘর বরাদ্দ। সে যত বড় পরিবারই হোক। একটাই খাট, একটাই মেঝে। সেই খাটে ফজুচাচা, চাচী, দুই সন্তানসহ ঘুমায়। মেঝেতে বাকি তিন মেয়ের সাথে কুলসুম। এক গরমের রাতে, কুলসুমের ঘুম আসছিল না। বাবাকে খুব মনে পড়ছিল। হঠাৎ দেখে ফজুচাচা উঠে বাইরে গেলেন। বুঝি পেশাব করতে। ফিরে আসলেন চোরের মত। আস্তে করে দরজা বন্ধ করলেন। অন্ধকার চোখ সহা হয়ে গেলে অনেক কিছুই দেখা যায়। কুলসুম খেয়াল করল ফজুচাচা সবার মুখের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন দেখছেন। কুলসুমের মুখের কাছে আসতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। ঠোটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ থাকতে বললেন ফজুচাচা। চোখদুটো তাঁর রাতের শিয়ালের চোখের মত জ্বলছে। কুলসুম সেই চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফজুচাচা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিস করে বললেন,

–         খবরদার, কথা ক’বি না। মাইরা ফালামু।

কুলসুম ভয়ে আরও কুঁকড়ে গেল। এরপর যা হল, তা কুলসুম স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কোনদিন। ফজুচাচা এক হাতে কুলসুমের মুখ চাপা দিয়ে অন্য হাতে ওর সদ্য ফোটা ফুলের কুঁড়ির মতো বুক দুটো দুমরে মুচড়ে একাকার করে দিল। ছাগল যেমন কচি লাউয়ের ডগা পরমানন্দে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়, কুলসুমের চৌদ্দ বছরের শরীরটাকে সেভাবেই মহানন্দে চিবিয়ে চিবিয়ে খেল। কষ্টে, যন্ত্রণায়, ঘৃণায় কুলসুমের দুচোখ দিয়ে শুধু পানি গড়িয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারল না।

সেই থেকে শুরু। প্রায় রাতেই কুলসুমের উপর নরক নেমে আসত। ভয়ে কুলসুম কাউকে কিছু বলতে পারত না। একদিন চাচা চাচীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া। পাড়া প্রতিবেশীরা জড়ো হল। ঘরের ভেতর সালিশ বসল। কুলসুমকে ঘরের বাইরেই রাখা হল। সেই রাতেই কুলসুমের সাথে ফজু চাচার বন্ধু, পঞ্চাশ বছরের নাসিরদ্দীর সাথে বিয়ে হয়ে গেল। কেউ কুলসুমের কাছে কিছু শুনল না। কেউ তার মত নেয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করল না।

হালের গরু হাত বদল হওয়ার মত, কুলসুম ফজুল্লার হাত থেকে এলো নাসিরদ্দীর হাতে। নাসিরদ্দী ছিল লম্পট, বদমাশ কিসিমের লোক। লোকে বলত, আগের বউ ওর হাতেই মরেছে। প্রতি রাতে তাড়ি গিলে আসত। ঘন ঘন বিড়ি খেত। নাসিরদ্দীর মুখে বিড়ি আর তাড়ির ভকভকে গন্ধে বমি আসত কুলসুমের। প্রতি রাতেই মাতাল নাসিরদ্দী ঝাঁপিয়ে পড়ত কুলসুমের পুষ্ট শরীরের উপর। মনে ক্ষুধা থাকলেও শরীর পেরে উঠত না মাতাল নাসিরদ্দীর। তাড়ি, বিড়ির গন্ধ ছাপিয়ে কোনো কোনো রাতে কেমন করে উঠত কুলসুমের কিশোরী শরীর। মুখ, কান গরম হয়ে যেত। কাঁপন উঠত ওর রক্তে, বুকে, পেটে, আরও নীচে। কালবোশেখি ঝড় হঠাৎ থামার মতোই তখন হঠাৎ থেমে যেত নাসিরদ্দীর যত তর্জন, গর্জন। ঝড়ে উপড়ে পড়া কলা গাছের মতো গড়িয়ে পড়ে যেত নাসিরদ্দী কুলসুমের শরীরের উপর থেকে।  কুলসুমের শরীরে তখন কেবল শ্রাবণের মেঘ জমতে শুরু করেছে। সে মেঘের আর বৃষ্টি হয়ে ঝরা হত না। অতৃপ্ত শরীর নিয়ে বোবা চোখে ছাপরার চালের দিকে চেয়ে থাকত কুলসুম। সে চালের ফুটো দিয়ে দু এক ফোটা আকাশ দেখা যেত। কখনো সখনো একটা দুটা তারা। সেই তারার কাছে নিঃশব্দে জানতে চাইত কুলসুম,

–         দাদী, কোথায় তোমার ডালিম কুমার? কবে এই খোকলা রাক্ষসের হাত থেকে আমায় উদ্ধার করবে?

ডালিম কুমার না এলেও বছর ঘুরতে কোল জুড়ে এলো রশিদ। নাসিরদ্দীও একটু ভাল হল রশিদকে দেখে। তাড়ি খাওয়া কমিয়ে দিল। কুলসুম এই বাপের বয়সী লোকটার মাঝে কেবল ডালিম কুমারকে খুঁজতে শুরু করেছে, একদিন নাসিরদ্দী হারিয়ে গেল। আর ফিরে এলো না। কোথায় গেছে কেউ জানে না।

কুলসুম আবার মালিকানা বিহীন পতিত জমির মত হয়ে গেল। যার সবুজ ঘাসে, যে যখন পারে, যে ভাবে পারে, গরু ছাগলের মতো মুখ ডুবাতে চায়। ফজুল্লার বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল কুলসুম। চাচী দুরদুর করে তাড়িয়ে দিল। রশিদ হবার পর বুক দুটো খুব ভারি হয়ে গেছে। ব্লাউজ, কাপড় ছিঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। সবার শুধু সেদিকেই নজর। রিলিফের চাল আনতে গেলেও লোকগুলো বিনিময় চায়। এখানে সেখানে হাত দেয়। মরে যেতে ইচ্ছে করত কুলসুমের। রশিদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাও পারে না।

এভাবেই কুলসুম যখন চোখে অন্ধকার দেখছে, তখন ময়মুনার সাথে পরিচয়। একই পল্লীতে থাকে। মা বাবা ভাই বোনের সাথে। ওর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। ভাল কাপড় চোপড় পড়ে। টাকা পয়সার তেমন অভাব আছে বলে মনে হয় না। প্রথম দেখাতেই ময়মুনাকে কুলসুমের ভাল লেগে গেল। একদিন কুলসুম তার সব কাহিনী খুলে বলল ময়মুনাকে। ময়মুনার সাহায্য চাইল,

–         বইন, আমারে একটা কাম জোগাড় কইরা দিতে পারবা?

–         বার্মাইয়াগো এই দেশে কাম করার আইন নাই।

–         তুমি কোনো কাম করো না?

–         আমি যেই কাম করি, তুমি হেই কাম পারবা না।

–         ক্যান পারুম না? তুমি পারলে আমিও পারমু, পোলাডা লইয়া বাঁচতে তো হইবো।

–         তয় হোনো।

বলে ময়মুনা খুলে বলল সে কী কাজ করে। শুনে শিউরে উঠেছিল কুলসুম। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করেছিল,

–         পাপ হইবো না?

–         পাপ? কোনটা পাপ না কুলসুম? এই যে তোমার বাপরে মাইরা ফালাইলো, তোমার মায়ের ইজ্জত নিলো, তোমার দাদীরে জ্যান্ত জ্বালাইয়া মারল, এইটা পাপ না? এই যে আমাগো দ্যাশ থাইকা তাড়াইয়া দিল, এইটা পাপ না? এইযে তোমার বাপের মত ফজুচাচা, তোমারে নষ্ট করল, এইটা পাপ না? তোমার মত না নিয়া একটা বুইড়ার লগে বিয়া দিল, হেই বুইড়া তোমারে একদিনও সুখ দিতে পারল না, এইটা পাপ না? রিলিফের চাউল আনতে গেলে যে ব্যডারা অজায়গায় কু-জায়গায় হাত দেয়, সেইটা পাপ না? এই যে বাংলাদেশের পুলিশ টাকা খাইয়া আমাগো কামে যাইতে দেয়, আর যে ব্যডারা বৌ মাইয়া থাকতেও আমাগো কাছে আসে, এইটা পাপ না? খালি বাঁচার লাইগা আমরা করলেই পাপ?

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপায় ময়মুনা। অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল কুলসুম। তাই তো, এত পাপ চারিদিকে, এর মাঝে ও নিষ্পাপ থাকবে কেমন করে? রাজি হয়ে গেল। ঠিক হল, কাজ এলে রশিদকে ময়মুনাদের ঘরে রেখে কাজে যাবে।

ময়মুনাই ওকে ফোন, কিছু ভাল কাপড়, একটা বোরখা এনে দিয়েছিল। মনে পড়ে, প্রথম কাজের কথা। কুলসুমের কলজে শুকিয়ে কাঠ। ওকে বোরখা পড়িয়ে ঘণ্টা দুই গাড়িতে ঘুরিয়ে একটা সুন্দর বাড়িতে নেয়া হল। এত সুন্দরও বাড়ি হয়? যেন দাদীর বলা সেই স্বপ্নের ডালিম কুমারের রাজ প্রাসাদ। কী এক গন্ধে মৌ মৌ করছে চারিদিক। কুলসুমের মনে হয়েছিল, ও যেন দাদীর গল্পের সেই পাতালপুরের রাজকন্যা। উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে কুতুপালঙের রাক্ষস পুরী থেকে।

তাকে তুলে দেয়া হল এক মহিলার হাতে। মধ্যবয়সী। কেমন মা মা চেহারা। অথচ উৎকট কাপড় চোপড়। ফিনফিনে পাতলা শাড়ি। সে শাড়ির আড়ালে উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত যৌবন। মহিলা তাকে একটা ঘরে নিয়ে গেল। এত বড় ঘর সে দেখেনি জীবনে। কত কিছু আছে সে ঘরে। মখমল চাদরে মোড়া বিশাল এক খাট। আয়না লাগানো টেবিল। গদি মোড়া চেয়ার। আলমারি, রঙ্গিন বাতি, আরও কত কী। মহিলা তাকে সেই ঘরে লাগোয়া আরেকটা ঘরে নিয়ে গেল। ধবধবে সাদা পাথরের মেঝে। বলল,

–         এটা বাথরুম। মানে গোসলখানা। তুমি সাবান দিয়ে ভাল করে গোসল করে ঐ কাপড় গুলো পড়ে নাও।

কী ভাবে পানি ছাড়তে হয় দেখিয়ে দিল। যাবার আগে সব কাপড় খুলে গোসল করতে বলল। শুনে কুলসুমের কান গরম হয়ে যায়। সব কাপড় খুলে?

আরও বলল,

–         শোনো মেয়ে, এটাই তোমার প্রথম রাত। এখানে যারা আসেন, তারা অনেক বড় লোক। লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবে। যা বলবে, যে ভাবে বলবে, সব করবে। খুশি করতে পারলে অনেক টাকা পাবে। বুঝতে পেরেছ?

নীরবে মাথা হেলিয়েছিল কুলসুম। এর চেয়েও অনেক খোলাসা করে বলেছে ময়মুনা। কী হয় এই সব বাড়িতে। কী তাকে করতে হবে। কী ভাবে পুরুষ মানুষকে খুশি করতে হবে। আরও অনেক কিছু বলেছিল ময়মুনা। শুনে ভয়ে কাঁটা দিয়েছিল কুলসুমের। মানুষ এমন ভাবেও ওসব করে? কিছু করার নেই কুলসুমের। বেঁচে থাকতে হলে এ ছাড়া উপাও নেই। কুতুপালঙে শিয়াল কুকুরের কামড় খাওয়ার চাইতে অনেক ভালো। অন্তত পয়সা তো পাওয়া যাবে।

মহিলা চলে গেলে সেই পাথরের ঘরে ঢুকল কুলসুম। ভেতর থেকে ছিটকানি লাগিয়ে ভাবে, এত সুন্দরও গোসলখানা হয়? এখানে তো মাটিতে রেখেই ভাত খাওয়া যায়। চোখ বন্ধ করেই নিজেকে উন্মুক্ত করতে শুরু করে কুলসুম। শাড়ি, ব্লাউজ, সায়া, সব। এর আগে এ ভাবে কোনোদিন সব কাপড় গা থেকে খোলেনি। যে কুলসুম গোসল করে ভেজা কাপড়ের উপরেই শুকনো কাপড় পড়তে যেয়ে অর্ধেক ভিজিয়ে ফেলত। সেই কুলসুম আজ সম্পূর্ণ অনাবৃত। লজ্জায় চোখ খুলতে পারে না। পাছে নিজেই নিজেকে দেখে ফেলে!

হাতড়ে হাতড়ে কল খুলতেই বৃষ্টির মত ছাদ থেকে পানি পড়তে শুরু করে। চোখ বন্ধ করেই ভিজতে থাকে কুলসুম। হঠাৎ শৈশবে উঠোনে বৃষ্টিতে ভেজার কথা মনে পড়ে যায়। ভুলে গেল, ও এসেছে আজ নিলাম হতে। ওর শরীর বিক্রি হবে আজ পানির দামে। মনে হতেই দুচোখ ভরে ওঠে জলে। সে জল মিলেমিশে একাকার হতে থাকে ঝর্নার জলের সাথে। ও ভিজতেই থাকে। কেবলই মনে হয়, অনেক কাদা জমেছে ওর দেহে। অনেক কাদা ওর মনে। আজ ধুয়ে মুছে সব সাফ হয়ে যাক। সুগন্ধি সাবান দিয়ে রগড়ে রগড়ে নিজেকে পরিষ্কার করে। অনেকক্ষণ পর ওর শরীর ও মন ঠাণ্ডা হয়। আস্তে আস্তে চোখ খোলে কুলসুম। এতক্ষণ খেয়াল করেনি। বাথরুমের একটা দেয়াল পুরা আয়না দিয়ে বাঁধানো। সেই আয়নায় জীবনে এই প্রথম নিজেকে পূর্ণাঙ্গ রূপে দেখল কুলসুম। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারেনা। এত ঐশ্বর্য ওর শরীরে? সোনার বরন গায়ে মুক্তো দানার মত জমে আছে পানির ফোঁটা এখানে সেখানে। শরীরের খাঁজে, পাহাড়ে, উপত্যকায়। নিজেকে দেখে দেখে যেন সাধ মেটে না। মুক্তো দানাগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতেও ইচ্ছে করে না। ভাবে, কত পাব আজ এই মুক্তো দানার দাম?

এমন সময় বাথরুমের দরজায় নক হয়। সম্বিত ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি গা মুছে ওর জন্য আনা কাপড়গুলো পরে। এমন কাপড় পরা তো দুরের কথা, দেখেওনি জীবনে। কোথায় দেখবে কুলসুম শার্টিনের স্লিপিং গাউন? লাল স্লিপিং স্যুটে ওকে পরীর মত দেখায়। মনে মনে ভাবে, এক রাতের জন্য এত আয়োজন? তবে যে ময়মুনা বলেছিল কত ভয় ধরানো কথা? কেন জানি কুলসুমের আর কোনো ভয় করে না। এইটুকু জীবনে এই শরীর তো কম দেখল না! ফজুচাচা কিংবা নাসিরদ্দীর চাইতে বড় হায়েনা নিশ্চয়ই হবে না।

আবার হালকা নক হয় দরজায়। বুকের বোতাম লাগিয়ে নিজের ঐশ্বর্য ঢেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো কুলসুম। মাথাটা মুছতেও ভুলে গেল। তখনো ভেজা চুল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে জল। ঘরে ঢুকে চেয়ারে যাকে বসা দেখল, তেমন কাউকে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলনা মোটেই কুলসুম। এ যেন পূজার মণ্ডপে দেখা সাক্ষাত কার্তিক বসে আছেন। এতদিন বার্মিজ পুরুষগুলোর কুতকুতে চোখ, বোঁচা নাক, উঁচু চোয়াল আর ছোটখাটো শরীর দেখে মনে হত, পৃথিবীর তাবৎ পুরুষগুলো এমনই কুৎসিত। সুন্দর মানুষগুলো হয় রূপকথায় বাস করে কিংবা পূজার মণ্ডপে মূর্তি হয়ে বসে থাকে। নোংরামি আর পঙ্কিলতায় ভরা এই পৃথিবীতেও মানুষ যে এত সুন্দর হতে পরে, ধারনা ছিলনা কুলসুমের। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রঙ মানুষটার। যেন একটু ছুঁয়ে দিলেই রক্ত বেরিয়ে যাবে। বছর পঁচিশের বেশী হবে না বয়স। ময়মুনা বলেছিল, মধ্য বয়সী বিয়ে করা মানুষরাই এসব চায়। থাকে তাদের নানা রকম বিকৃত চাহিদা। হয় লম্পট প্রকৃতির। যে বসে আছে, তাকে আর যাই হোক, লম্পট মনে হচ্ছে না কুলসুমের। তাদের চোখ দেখলেই চেনা যায়। সামনে বসা লোকটার চোখে কোনো লাম্পট্য নেই, আছে রাজ্যের বিস্ময়। তখনই মনে হয়, এ আর কেউ নয়, সামনে বসে আছে দাদীর বলা গল্পের ডালিম কুমার। স্থান কাল পাত্র ভুলে অনিমেষে তাকে দেখতে থাকল কুলসুম।

–         এসো, খাটে বসো। তোমার কোনো ভয় নেই।

যেন দূর দেবলোক থেকে কথা বলল কেউ। কোনো পুরুষ মানুষের গলা এত মোলায়েম হয়? ও গুটি গুটি পায়ে এসে খাটের কিনারে বসল। ভেজা চুল যে ওর বুক পিঠের অনেকটাই ভিজিয়ে ফেলেছে খেয়াল করে না। লোকটি উঠে গিয়ে আলনা থেকে একটা শুকনো তোয়ালে এনে বলল,

–         ভেজা চুলগুলো মুছে ফেলো। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আর আমাকে ভয় পেও না। আমি কোনো জোর করব না।

বাবার পর এই প্রথম কোনো পুরুষ এমন মমতা ঢেলে কথা বলল কুলসুমের সাথে। কেন জানি খুব কান্না পায় কুলসুমের। মাথা মোছার বাহানায় অনেকক্ষণ তোয়ালেটা ধরে রাখে চোখের উপর। যেন ওর চোখের পানি দেখতে না পায় ডালিম কুমার।

কুলসুমকে খাটে বসতে বললেও ডালিম কুমার গিয়ে সেই চেয়ারে বসল। যেন সিংহাসনে আসীন হল ওর স্বপ্নের রাজপুত্র। জিজ্ঞেস করল,

–         কী নাম তোমার? মানে কী নামে ডাকব তোমাকে?

–         কুলসুম।

অস্ফুটে জবাব দেয় কুলসুম। যদিও ময়মুনা বারবার বলে দিয়েছিল, খবরদার, আসল নাম ক’বি না। তোর নাম চামেলি। যে ডালিম কুমারকে এতদিন শুধু স্বপ্নেই দেখেছে, তাকে সামনে দেখে কোন প্রাণে মিথ্যা বলবে কুলসুম? হোক না সে এক রাতের ডালিম কুমার।

এরপর অনেক রাত অব্ধি ডালিম কুমার এটা সেটা জানতে চায়। ওর জীবনের কাহিনী। খুঁটিনাটি। কত কী। কোন কৃত্রিমতা নেই। প্রশ্নগুলো খুব আন্তরিক মনে হয়। যেন রাজ্য জয়ের আগে রাজা জেনে নিচ্ছেন প্রজার মনের খবর। কুলসুম ছোট ছোট কথায় জবাব দেয় সব প্রশ্নের। শুধু দাদীর কাছে শোনা ডালিম কুমারের গল্প বাদে। এক সময় ডালিম কুমার জানতে চাইল,

–         শুধু আমিই প্রশ্ন করছি। তুমি তো কোনো প্রশ্ন করলে না। কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না আমার ব্যাপারে?

কেন করবে না? কুলসুমের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, ওগো আমার স্বপ্নের রাজকুমার, তোমার রাজ্যে রাজকুমারীদের তো অভাব হবার কথা নয়। তব কেন এসেছ এই ঘুঁটে কুড়ানির কাছে? শিয়ালে কুকুরে খুবলে খাওয়া এই শরীর কোন সুখ দিতে পারবে তোমাকে ? কেন এসেছ এই পাপের পথে? কেন এসেছ নিজেকে নষ্ট করে দিতে? এসব কথা যে কুলসুম শুধু ভাবতেই পারে, মুখে আনতে পারে না। আর ও তো অত সুন্দর করে কথাও বলতে পারে না। মাটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকল কুলসুম।

চেয়ারটা টেনে এবার কাছে নিয়ে এলো ডালিম কুমার। এইটুকু কাছে আসাতেই কুলসুমের বুকের ভেতর যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। বাঁশ পাতার মত থিরথির কাঁপতে থাকে কুলসুমের শরীর। ভয় হচ্ছিল, কাঁপতে কাঁপতে পড়ে না যায়।

–         তুমি কি এখনো ভয় পাচ্ছ কুলসুম?

খুব নরম গলায় জানতে চাইল ওর ডালিম কুমার। গলা শুকিয়ে গেছে কুলসুমের। ও জানে গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হবে না। তাই এদিক ওদিক মাথা নাড়ল।

–         তবে কাঁপছ কেন?

কী জবাব দেবে এর? ও কি নিজেই জানে বুকের ভেতর বইছে এ কোন কালবোশেখি ঝড়? এ কোন ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে ওর বুকের বাড়ি ঘর? কোন জবাব দেয় না কুলসুম।

–         তুমি কি জানো, কত সুন্দর তুমি?

এ কী হচ্ছে আজ? ও যে দেখতে সুন্দর, কত জনের কাছে, কত ভাবে, কতবার শুনেছে কুলসুম। একই কথা এই মানুষটার মুখে এত মধুর লাগল কেন? ওর সুন্দর শরীরের প্রতি পুরুষ মানুষের লালা ঝরা দৃষ্টিই দেখেছে শুধু। এমন মুগ্ধ হয়ে দেখেনি কেউ। ওর মনে হল, কান দুটা বুঝি পুড়ে যাচ্ছে তাপে। সে তাপ কান থেকে গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে বুকে। বুক থেকে পেটে। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল কুলসুম। মানুষটা কি আগুনের তৈরি? যখন ছুঁয়ে দেবে, পুড়ে যাবে না তো?

তবু জীবনে এই প্রথম প্রথম বারের মত কুলসুমের প্রতিটি লোমকূপ উদগ্রীব হল পূর্ণ সমর্পণের জন্য। তৈরি হল পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবার জন্য। মনে হল, শুধু এই একটি রাতের জন্যই জন্ম হয়েছে কুলসুমের। এই একটা রাতের জন্যই আরও হাজার বার জন্ম নেয়া যায়। কুলসুম চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে।

কতক্ষণ অপেক্ষা করে ছিল জানে না। কয়েক মিনিটি? কয়েক ঘণ্টা? কয়েক বছর? যেন থমকে দাঁড়িয়ে ছিল সময়। একটা আগুনের হাত স্পর্শ করে ওর কপাল। যত্নে সরিয়ে দেয় অযত্নে পড়ে থাকা কপালের চুল। ধীরে ধীরে সে হাত নেমে যায় কপাল থেকে গালে। গাল থেকে ঠোঁটে। ঠোট থেকে গলায়। আর নিতে পারে না কুলসুম। কারও ছোঁয়াও এত মধুর হয়? সে মধুর আবেশে ওর শরীর অবশ হয়ে নেতিয়ে পড়ে।

দুহাতে ধরে ফেলে ডালিম কুমার। আস্তে করে শুইয়ে দেয় নরম মখমল বিছানায়। দুটি অঙ্গার ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর কপাল, চোখের পাতা, কানের লতি, নাকের ডগা। ডালিম কুমারের হাত, ঠোঁটই শুধু গরম নয়। তাঁর নিশ্বাসেও যেন আগুন। সে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কুলসুমের মুখ, চোখ, গলা, সব। এক সময় দুটি অঙ্গার ঠোঁট নেমে এলো কুলসুমের শুকনো ঠোঁটে। কুলসুম প্রায় অজ্ঞান হতে হতে টের পেল, বুঝি বজ্রপাত হল! বিজলি চমকে গেল শরীরের প্রতিটি কণায়। জ্বলন্ত লাভা ছুটে গেল প্রতিটি শিরায় শিরায়। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে পুড়ে ভস্ম হতে থাকে ওর সোনার শরীর।

ঝড় উঠল কুলসুমের শরীরে। জীবনে প্রথম সুখের ঝড়। ভাসছে সুখের ভেলায়। সে ঝড়ে ওর শরীর উঠছে, নামছে। প্রচণ্ড ঢেউয়ের দোলায় দুলছে উথাল পাতাল। এ সুখের যেন শেষ নেই, এ দোলার যেন শেষ নেই। দুলতে দুলতে এক সময় তলিয়ে গেল কুলসুম সুখের অতল সাগরে। চলে গেল পাতালপুরীতে। ঘুমিয়ে গেল পাতালপুরের রাজকন্যা সোনার কাঠির ছোঁয়ায়। ঘুমন্ত সে রাজকন্যাকে ডালিম কুমার পঙ্খীরাজে বসিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূরে, আরও দূরে। সুখের ওপারে।

ঘুম ভেঙ্গে কুলসুম দেখল, কেউ নেই। কিছু নেই। খাটে শুয়ে আছে সে একা। আর খাটের পাশে টেবিলে চাপা দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা। তখনি কুলসুমের মনে হয়, এই পৃথিবীর কোনো কিছু সত্য নয়। কালকের রাত, সেই রাতের ডালিম কুমার, সে রাতের এক পৃথিবী সুখ, সব স্বপ্ন, সব মিথ্যা। সত্য শুধু এই পোড়া শরীর আর টেবিলে রাখা পাঁচ হাজার টাকা।

তারপর প্রায় দু’বছর চলে গেছে। এই দু’বছরে কত জায়গা থেকে কত কাজের ডাক এসেছে। কুলসুম চামেলি হয়ে হোটেলের কামরা থেকে বস্তি পর্যন্ত, কত জায়গায় গিয়েছে সে। কত মানুষ শকুন হয়ে সামান্য টাকার বিনিময়ে নিষ্ঠুর ঠোকরে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছে ওর কোমল শরীর। সেই বাড়ি থেকে আর ডাক আসেনি। পরে ময়মুনা বলেছে, ওখান থেকে শুধু জীবনে প্রথম রাতের ডাকই আসে।

কেন জানি হঠাৎ শরীর ভাঙ্গতে শুরু করে কুলসুমের। জ্বর আসে থেকে থেকে। কাজের চাহিদা কমে গেছে। কুলসুম জেনে গেছে, সে বাড়ি থেকে আর কোনোদিন ডাক আসবে না। তবু প্রতীক্ষায় থাকে। কুলসুম কিংবা চামেলি নয়, পাতালপুরের রাজকন্যা হয়ে। যদি কোনোদিন আবার ফিরে আসে, এক রাতের সেই ডালিম কুমার!

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post বন্য নয় অন্য প্রেম| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | পিয়ালী ঘোষ| Bengali Stories for Matured
Next post যখন ১৩টা বাজে| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Story for Matured