“বুঝলেন পোদ্দার দা, আজ বোধহয় বিস্ফোরণ হবে।”
পাশ থেকে মৃদু কন্ঠের ভীত ভাইব্রেশন শুনে অবিনাশ পোদ্দার একবার চট করে কাচের দেওয়ালের ওপারটা দেখে নিল। আবহাওয়ায় খুব উত্তেজনা রয়েছে মনে হচ্ছে। ভিতরে-বাইরে আনাগোনা হচ্ছে অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। এইবার গাড়োরিয়া কন্সট্রাকশনসের ব্যাক অফিস এক্সিকিউটিভ অবিনাশ পোদ্দার ওরফে ব্যাঁকার হার্টবিট হু হু করে বাড়তে শুরু করল। কার উপর আজ কোপ পড়বে কে জানে! অনিচ্ছা নিয়ে অবিনাশ স্যাট্ করে বাঁদিকটা দেখে নেয়। ভয়ে দাসবাবুর মুখটা শুকিয়ে যাওয়া লঙ্কার মত হয়ে গেছে! কাঁচের ঘর থেকে বেশ কয়েকবার দাসের নাম শোনা গেছে। আহা! এই বয়সে যদি বেচারার চাকরি চলে যায়, বউ-বাচ্চা নিয়ে বিরাট সমস্যায় পড়ে যাবে। তারপরেই অবিনাশের মনে পড়ল, ভিক্টিম সেও হতে পারে আর তার বয়সও পঞ্চাশ!!
অবিনাশ পোদ্দারের ঘুম ভাঙে ভোর পাঁচটায়। গড়িয়ার দু-কামরার ফ্ল্যাটে সে আর তার মা থাকে। বিশেষ পিছুটান নেই। তবুও সে ভোর পাঁচটায় ওঠে। এরপর আধাঘন্টা প্রাণায়াম করে (যার অধিকাংশই ভুলভাল)। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ওভেনের ওপর নিজেই ভাত চাপিয়ে স্নান-প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে। খাওয়া-দাওয়া, রেডি হওয়ার পর ঠিক ছ-টা পঞ্চান্ন নাগাদ মা-কে ঢিপ করে প্রণাম করে রওনা হয়ে যায়। যাওয়ার পথে বিপত্তারিণী মন্দিরে ঠিক একমিনিট চোখবন্ধ করে কিছু একটা বিড়বিড় করে, দু-টাকা প্রণামী দেয় (শনিবার পাঁচ টাকা দেয়, কারণটা সঠিক জানা যায় নি। উইকএন্ড বলে হবে হয়ত)।
সাতটা দশের গড়িয়া স্টেশন-সল্টলেক বাসের বেশির ভাগ লোকজনেরই মুখ চেনা। শোনা যায় কয়েকজন লোক (যারা এখনো শখ করে বা ঠেকায় পড়ে দম দেওয়া ঘড়ি ব্যবহার করে) অবিনাশকে দেখে ঘড়ির সময় ঠিক করে নেয়। এদিক থেকে জার্মান দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্টের সঙ্গে অবিনাশ পোদ্দারের বেশ মিল আছে, ইম্যানুয়েল কান্টকে দেখেও লোকজন ঘড়ি মিলিয়ে নিত। যাক গে, আমরা ফোকাস করব অবিনাশ পোদ্দারের ওপর। সাড়ে আটটায় অবিনাশ অফিসে ঢোকে। যদিও অফিস শুরু হয় ন’টায়। রিস্কটা অবিনাশ নেয় না। অফিসের আট-ন’ঘন্টা সময় ভয়ে ভয়েই কাটে। ‘এই ঝাড় খেলাম, এই ঝাড় খেলাম’ টাইপ একটা ভয়। তবে এই ধরনের ভয়ের একটা মজা আছে, কাজ ঠিকঠাক হলে মাঝেমধ্যে ব্যানার্জি দা ‘ভেরি গুড’ বলে পিঠ চাপড়ে দেয়। তখন এক ঝটকায় জীবনটাকে খুব সুন্দর বলে মনে হয়। তখন খোদ অবিনাশ, যার কিনা জন্ম থেকেই পেটের সমস্যা, সেই অবিনাশ নাকি অফিসের পর ফুচকা খেয়ে ফেলে। তবে একবার যখন অনেক দিন পর হাজার টাকা মত ইনক্রিমেন্ট হয়েছিল। অবিনাশ সে দিন ঝোঁকের মাথায় পাপড়ি-চাট খেয়ে ফেলেছিল, দু-দিন অফিস কামাই হয়ে গেছিল দুরন্ত আমাশার জন্য। অনেক কাজও পেন্ডিং হয়ে গেছিল। খুব ঝামেলা হয়ে গেছিল সেবার। তবে এই ধরনের ঘটনা এক-আধবারই ঘটে। অফিসের বেশিরভাগ সময়টা ভয়ে ভয়েই কেটে যায়। বাবা রে, ব্যানার্জি দা ভীষণ রাগী মানুষ! অফিসের অঘোষিত সম্রাট। ম্যানেজার বলে কথা! সকালবেলা এসে কোন কারণ ছাড়াই সবাইকে চমকে দেন যাতে নিজের ‘ম্যানেজার’ ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ থাকে। এই তো সেদিন অফিসে ঢোকার মুখেই রমাকান্তকে ধড়াম করে ঝেড়ে দিল কোন কারণ ছাড়াই। রমাকান্ত বেচারা তো হতবাক। পরে জানা গেল বাড়িতে বৌদির সাথে খুব ঝামেলা হয়েছিল। তবে চাকরি বড় বালাই, তাই কেউই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। কারণ, ব্যানার্জি আবার উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে তিলকে তাল করে চাকরি খেয়ে নিতে পারে। এর আগে এরকম ঘটনা ঘটেছে। অবিনাশও ঝাড় খায়, তবে সকালবেলার প্রাতঃঝাড়ন থেকে বাঁচতে আধঘন্টা আগে অফিসে ঢুকে পড়ে। সকালবেলাতেই যখন অফিস শুরু হয়েছে কী হয়নি সেই সময় এমপ্লয়িদের অপদস্ত করে ব্যানার্জি খুব মজা পায়। ঘটনার এফেক্ট হিসেবে ব্যানার্জির মুখে একচিলতে মোনালিসা টাইপ হাসি লেগে থাকে। এই ধরনের হাসিকে আমরা ‘প্রসন্নতার হাসি’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। সমস্ত অফিসেই কিছু তৈলাক্ত লোকজন থাকে, যাদের অদৃশ্য তেলের ঘানি থেকে তেল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এরা কখনো শিরদাঁড়া সোজা রেখে বসতে পারে না। দিন দিন এরা আরো বেঁকে যেতে থাকে, আর একসময় এদের মেরুদণ্ড বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যায়। ব্যানার্জির মধ্যেও অবিনাশ এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে।
শাটারটা জ্যাম হয়ে গেছিল। হ্যাঁচকা মেরে তুলতে গিয়ে হাতটা টনটন করে উঠল। শাটারটা তুলতেই দেখা গেল হুলো বেড়ালের থেকে একসাইজ ছোট দু-চারটে ধেড়ে ইঁদূর এদিক-ওদিক দৌড়ে পালাচ্ছে। ভেতরটা নিকষ কালো অন্ধকার। এদিক ওদিক বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভাঙাচোরা, বয়স্ক আসবাবপত্র পড়ে আছে। মোবাইলের ফ্ল্যাশটা অন করে অবিনাশ ভিতরে পা রাখল। দোকানের ভিতরে পা রাখা মাত্রই চারদিকটা কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করে। এক-দুই-তিন বছর করে অবিনাশ পঁয়ত্রিশ বছর পিছিয়ে যায়। ধীরে ধীরে বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া দোকানঘর অবিনাশের চোখে ভেসে ওঠে।
দোকানে ঢুকতেই দেখা যায় ডানদিকে একটা কাঠের টেবিল রাখা আছে। টেবিলের সামনে কাঁচাপাকা চুলের একজন ভদ্রলোক বসে আছে। সামনে ক্যাশবাক্স রাখা। ভদ্রলোকের নাম সুখময় পোদ্দার। এই দোকানের মালিক, এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ভাতের হোটেলের মালিক। মোট বারোজন কর্মচারী দোকানে। দুপুরের সময়। দোকানে ভিড়ভাট্টা প্রচুর। একজন লম্বামুখো লোক তদারকি করছে। মাঝে মাঝে হাঁক দিয়ে বলছে, “তিন নম্বর টেবিলে কাতলা, পেটির মাছ দিবি” অথবা “পাঁচ নম্বর টেবিলে সবজি দিয়ে যা, দুই নম্বরে এক্সট্রা ভাত লাগবে।❞ অবিনাশ কিছুতেই লম্বামুখোর নাম মনে করতে পারে না। পুরনো দোকানঘরের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে এইভাবে সুন্দর অতীতের ঘটনাগুলি এক এক করে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। একসময় অবিনাশ আগুন দেখতে পায়। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন। আগুন আর কালো ধোঁয়ার তুর্কিনাচ , ‘জল ঢাল, জল ঢাল’ চিৎকারের মাঝে অবিনাশ একবার ডানদিকে তাকায়, দেখা যায় সুখময় পোদ্দারের হাই পাওয়ারের মোটা কাঁচের চশমায় লাল-হলুদ লেলিহান শিখা রিফ্লেক্ট হচ্ছে। ভদ্রলোকের চোয়াল শক্ত। এতটা দেখার পর অবিনাশের অস্বস্তি হতে শুরু করে। তড়িঘড়ি সে দোকানঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। ব্রেনের অতীতচারী সুইচটাকে জোর করে অফ করার চেষ্টা করতে করতে দোকানের শাটারে তালা লাগায়। এরপর টুপিটা মাথায় দিয়ে আর ছাতাটা বগলদাবা বাড়ির পথে ধাবমান হয়।
মোট ছ-জন দগ্ধ হয়ে মারা গেছিল। অনেকদিন কোর্টকাছারি হয়েছিল। দোকানটা মেরামত করা হয়েছিল বটে কিন্তু আর কোনদিন চালু করা সম্ভব হয় নি। বছরখানেক পর সুখময় পোদ্দারের লিউকোমিয়া ধরা পড়ে। তখন তিনি মোটামুটি নিঃস্ব। চিকিৎসার জন্য অবিনাশের মা অর্থাৎ সুখময়ের স্ত্রী বহুবার দোকান বেচে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ‘রক্ত জল করে দোকান দাঁড় করিয়েছি’ এইরকম কিছু একটা বলে সুখময় বারবার সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। সুখময় যখন মারা যায় অবিনাশের তখন কুড়ি বছর বয়স। পরিবারের জমাপুঁজি তখন প্রায় শেষ। নিদারুণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা চলছে। এই চার-পাঁচ বছরে অবিনাশের অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এক্ষেত্রে ড্রাইভিং ফোর্সের কাজ করে। বাবা মারা যাওয়ার পরেও অবিনাশ দোকান বেচতে পারে নি। দুটি ফ্যাক্টর মূলত এখানে কাজ করেছিল। একটি হল দোকান বেচার প্রতি বাবার অনীহা। দোকান বেচে দিলে স্বর্গীয় সুখময় পোদ্দার পরপারে অসুখী থাকবেন এরকম একটা বিশ্বাস অবিনাশের মনে কাজ করেছিল (এবং এখনো করে)। আর দ্বিতীয়টি হল,
সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও দোকানে গিয়ে অতীতদিনের স্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগ, দোকান পরহস্তে চলে গেলে সেটা আর সম্ভব নয় । এত বছরে দোকান চালু করার কথা মাথায় যে একেবারেই আসেনি তা নয়, তবে সাহস আর পুঁজি দুটোই কুলোয় নি (পাঠকবৃন্দ মনে রাখবেন, এটা নিতান্তই অবিনাশের নিজস্ব উপলব্ধি, ইচ্ছে থাকলেই উপায় করা যেত, আসলে অবিনাশের সদিচ্ছের অভাব ছিল বলে মনে হয়)। কোনরকমে কলেজ পেরনোর পরই অবিনাশ চাকরিতে যোগ দেয়। প্রায় তিরিশ বছর ধরে সে মোট তিন জায়গায় চাকরি করেছে। দীর্ঘ তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে আধপোড়া দোকানের কোন একটা ঘুপচি কোণে বসে অতীতচারী হয়েছে, তবু পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে নি। জীবনের প্রতি সমস্ত মুগ্ধতা অবিনাশ হারিয়ে ফেলেছিল।
“পোদ্দার! পোদ্দার!” এরকম একটা আওয়াজ শুনে অবিনাশ তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে। আওয়াজটা আসছে ব্যানার্জির ওয়ার্কস্টেশন থেকে। অবিনাশকে লাফিয়ে উঠতে দেখে ব্যানার্জি ধমক দেয়, “এদিকে এসো।” ব্যানার্জির দিকে যাওয়ার সময় অবিনাশ প্রতি পদক্ষেপে বাড়তে থাকা হৃদস্পন্দন অনুভব করে! কেমন যেন হাত-পা শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। অবিনাশ ব্যানার্জির কাছে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়ানোর প্রায় পনের-কুড়ি সেকেন্ড পর ব্যানার্জি অবিনাশের মুখের দিকে তাকালো। দৃষ্টিতে কেমন একটা তাচ্ছিল্য। মুখ-চোখ কুঁচকে ব্যানার্জি জিজ্ঞেস করে, “এটা কী হল?” অবিনাশ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “কোনটা?” ব্যানার্জির প্রত্যুত্তর, “অ্যালোকেশনের ডেটাটা কোথায়?” অবিনাশ কম্পিত কণ্ঠে আত্মপক্ষ সমর্থন করে, “ওটা তো ঘোষের দেওয়ার কথা, বাকি সব ডেটা তো আমি রেডি করে দিয়েছি।” ব্যানার্জি চেঁচিয়ে ওঠে, “ঘোষ মাল্টিটাস্কিং করছে, ও আর কত কাজ করবে। এরকম চলতে থাকলে তোমাকে আর আর রাখা যাবে না।” বলেই ঠকঠক করে কী একটা টাইপ করতে শুরু করল। কথাগুলো শোনার পর অবিনাশের পা কাঁপতে শুরু করে। মাথার মধ্যে ইকো হতে থাকে, “তোমাকে আর রাখা যাবে না”, “তোমাকে আর রাখা যাবে না”। “কী হল এখনো দাঁড়িয়ে আছ?” ব্যানার্জির খিটকেল আওয়াজ শুনে অবিনাশের সম্বিত ফেরে। অবিনাশ দেখতে পায়, ব্যানার্জির ঠৌঁট কাঁপছে, মুখে বিরক্তি। মনে মনে খিস্তি করছে মনে হয়। অবিনাশ ফিরতে উদ্যত হয়। ব্যানার্জি বলে ওঠে, “কালকের মধ্যে অ্যালোকেশনের ডেটা রেডি করে,পেনড্রাইভে আপলোড করে আমাকে দেবে। প্রেজেন্টেশন আছে কাল। না হলে তোমার খবর আছে।”
এইসব শোনার পর অবিনাশের মস্তিষ্ক রক্তশুন্য হয়ে যায়। পা দুটো আরো বেশি করে কাঁপতে শুরু করে। কোনরকমে অবিনাশ নিজের ওয়ার্কস্টেশনের দিকে এগিয়ে যায়। যেতে যেতে একবার ঘোষের দিকে তাকায়, ঘোষ তার দিকেই তাকিয়ে আছে, মুখে কেমন একটা চোর চোর ভাব। আজ বোধহয় সে প্রচুর তেল ঢেলেছে। আর একবার ঘুরে ব্যানার্জির দিকে তাকায়। অদ্ভুত ব্যাপার, ব্যানার্জিও তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে, মুখে হালকা হাসি লেগে আছে। চোখাচোখি হতেই স্যাট করে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল। নিজের ডেস্কে ফিরে এসে অবিনাশ নিজের অনিশ্চিত ভবিতব্যের কথা চিন্তা করে। ‘যদি চাকরি চলে যায় তাহলে কী হবে?’ এই টপিকের ওপর সে ভাবনাচিন্তা শুরু করে। ভাবতে ভাবতে তার ব্রেইন অটোপাইলট মোডে চলে যায়। মাঝে মাঝে সে উঁকি মেরে ব্যানার্জির এরিয়াটা দেখার চেষ্টা করে। উচ্চঃস্বরে হাসির শব্দ আসছে। না না যেভাবেই হোক ডেটা রেডি করে দিতে হবে, দরকার পড়লে বাড়ি গিয়ে কাজ করতে হবে।( এখানে একটা বিশেষ প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে হচ্ছে। অবিনাশ পড়াশোনা বেশ ভালোই করেছে। ওই সবাই যেরকম করে। তবে ১৮৯৫ সালের ১১ই এপ্রিল স্বামী বিবেকানন্দ শশী মহারাজকে যে চিঠিটা লিখেছিলেন সেইটা বোধহয় অবিনাশ পড়ে নি। সেখানে স্বামীজি লিখেছিলেন, “…..Bullies are always cowards” অর্থাৎ যারা লোককে তর্জন করে বেড়ায় তারা চিরকালই কাপুরষ। চিঠিটা পড়লে সে এত সমস্যায় পড়ত না।)
অবিনাশ স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি একটা বেঞ্চের উপর থমকা মেরে বসে আছে। আবার স্টিলের বেঞ্চটা রয়েছে একটি বেসরকারি হাসপাতালের পাঁচতলায়। তার মাথা কাজ করছে না। ঘটনাটা ঘটেছে আজ সকালবেলায়। খাওয়া-দাওয়া সেরে সে বারবার ব্যাগের ভেতরটা বিভিন্নভাবে দেখে নিচ্ছিল পেনড্রাইভটা রয়েছে কিনা। চার-পাঁচবার দেখে নিশ্চিত হওয়ার পরে রোজকার মতোই ‘মা’ বলে ডাক ছাড়ে। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায় না। তার মনে খটকা লাগে, এরকম তো কোনদিন হয় না। অবিনাশ পাশের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু মাকে কোথাও দেখতে পায় না। এরপর আবার ‘মা, ও মা, তুমি কোথায়?’ বলে আবার চিৎকার করে। আবারও কোন সাড়া পাওয়া যায় না। এতক্ষণ পরে সে মেঝের দিকে তাকায়। সে দেখতে পায়, তার মা মাটিতে জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে।
ডাক্তারদের বক্তব্য, অবিনাশের মায়ের ম্যাসিভ হার্ডঅ্যাটাক হয়েছে। বাহাত্তর ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। তার আগে কিছু বলা যাবে না। অবিনাশের মস্তিষ্ক পুরোপুরি শূন্য হয়ে গেছে। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর অবিনাশ মায়ের ছত্রচ্ছায়ায় জীবনসংগ্রাম শুরু করে। নিদারুণ অর্থকষ্টে বা মনোকষ্টের মধ্যেও সে তার মাকে অটল-অবিচল দেখেছে। অবিনাশের কাছে তার মা অতিমানবী পর্যায়ের মানুষ। হাসপাতালের বেঞ্চে বসে সে নিজের হাতে চিমটি কাটে। যদি এটা দুঃস্বপ্ন হয়। এরপরেই ফোনটা বেজে ওঠে। অফিস থেকে দাস ফোন করেছে। নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়েই সে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে দাসের সন্ত্রস্ত কন্ঠস্বর শোনা যায়, “পোদ্দার দা, তুমি কোথায়, বেলা বারোটা তো বেজে গেল। কনফারেন্স তো শুরু হয়ে গেছে। অ্যালোকেশনের ডেটা তো তোমার কাছে। কনফারেন্সে ঢোকার আগে ব্যানার্জি তো খুব খিঁচ করেছে।” অবিনাশ তার কন্ঠস্বর শুনতে পায় কী পায় না। দাসকে গোটা বিষয়টা খুলে বলে। “ও হো, খুবই খারাপ খবর, ডাক্তাররা কী বলছে?” দাস দুঃখপ্রকাশ করে। “ব্যানার্জি দা কে ফোন করে বলে দিয়ো ব্যাপারটা। অ্যালোকেশনের ডেটা তো নেই ওর কাছে। গাড়োরিয়ার কাছ ও আজ ঝাড় খাবে মনে হয়।”
শরীরে একটা ঠেলা অনুভব করে অবিনাশের ঘুমটা ভাঙে। হাসপাতালের বেঞ্চে বসে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই নেই। একজন ভদ্রমহিলা তাকে ডাকছে। আধো ঘুমে অবিনাশ ভদ্রমহিলাকে চিনতে পারে না, খুব দ্রুত ঘুম কাটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বুলুপিসি তাকে ঠেলা দিয়ে ডাকছিল। বুলুপিসি তার স্বর্গীয় পিতৃদেবের একমাত্র বোন। কিছুক্ষণ তার সঙ্গে উদ্বেগের বিনিময় হয়। “যা বাবা। সকাল থেকে এখানে আছিস। এবার একটু বাড়ি যা। দুপুরে কিছু পেটে পড়ে নি। কিছু খাওয়া-দাওয়া করে নে। খোকা এসে পড়বে একটু পরে। তুই একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আয়।” বুলপিসির কণ্ঠস্বরে সিমপ্যাথি। অনেকবার পীড়াপীড়ি করার পর আর ‘এখুনি খোকা চলে আসবে’ বলে আশ্বস্ত করার পর (এখানে খোকা বলতে অবিনাশের পিসতুতো ভাইয়ের কথা বলা হচ্ছে) অবিনাশ কিছু সময়ের জন্য বাড়ি যেতে রাজি হয়। হাসপাতাল থেকে বেরনোর সময় অবিনাশ বুকপকেটে ভাইব্রেশন অনুভব করে। বুক পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখতে পায় স্ক্রিনে ‘Banerjee (Office)’ ভেসে উঠেছে। অবিনাশের বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কলটা রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে ওঠে,” হ্যাঁ, ব্যানার্জি দা, আপনাকে আমি জাস্ট কল করতে যাচ্ছিলাম।” তবে অবিনাশের কথা শেষ হওয়ার আগেই ব্যানার্জি কথার পিঠে কথা শুরু করে দেয়,“তুমি কমিটমেন্ট ফেইল করেছ পোদ্দার, তোমাকে নিয়ে আল্টিমেট ডিসিশন নিতে হবে। কাল তুমি অফিসে এসো।” বলেই ফোনটা কেটে দেয়। ততক্ষণে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। অবিনাশের মোটা কাঁচের চশমা ঝাপসা হয়ে আসে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য অবিনাশ তাড়াহুড়ো করে একটা শেডের নীচে যেতে উদ্যত হয় কিন্তু ঝড়জলে পিচ্ছিল রাস্তায় ভারসাম্য রাখতে পারে না, সজোরে ভূপতিত হয়। ফলস্বরূপ তার হাঁটুতে হালকা চোট লাগে, জামাকাপড় কাদাজলে নোংরা হয়ে যায়, চশমাটা ভেঙে যায়। দুজন লোক অবিনাশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। “দাদা, লাগে নি তো? এঃহেঃ, জামাকাপড় তো কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে…আসুন আপনি এখানটায় বসুন।” একটা দোকানের শেডের নীচে শুকনো জায়গায় লোকদুটি তাকে বসার জায়গা করে দেয়। ক্লান্ত অবিনাশ ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করে। টুকরো টুকরো প্রশ্ন ভেসে আসে,“একলা যেতে পারবেন দাদা?”,“বাড়ি কোথায় আপনার?”,“লাগে-টাগে নি তো?” একজন প্রশ্ন করে, “দাদা আপনার বাড়ি যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি করে দিই?” অবিনাশ কুণ্ঠিত হয়,“না না, প্রয়োজন নেই। আমি বাসে চলে যাব। আমার অসুবিধা হবে না।”
-“ঠিক আছে তাহলে আপনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। কোন অসুবিধা হলে আমাদের বলবেন।“
অবিনাশ ঘোলা চোখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ নিজের জীবনকে তার খুব তাৎপর্যহীন বলে মনে হয়। “ওয়ার্থলেস, গুড ফর নাথিং অবিনাশ পোদ্দার”- স্বগতোক্তি করে সে। অসময়ের বৃষ্টিতে চারদিক সাদা হয়ে গেছে। একটা ট্রাক ছুটে আসছে মোটামুটি স্পিডে। ওই ট্রাকের নীচে নিজেকে পিষে ফেলার ইচ্ছে প্রকাশ করে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। “ওয়ার্থলেস পোদ্দার, তুমি মরতেও পারবে না। তোমার সাহস নেই। যাও বাড়ি চলে যাও। তোমার বাকি জীবনটাও গুমরে গুমরে কাটবে। এই জগৎ-সংসারে তুমি একটা তামাশা ছাড়া কিছুই নও। ট্রাকের নীচে শরীর ছুঁড়ে দেওয়ার সাহস তোমার নেই।”
অবিনাশ অন্তর্ধ্বনি শুনতে পায়।
-“কে বললো তোমাকে? দেখো আরেকটা বাস আসছে। আমি এর তলায় ঝাঁপ দেব।” অন্তর্ধ্বনির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে সে।
তারপরের বাসটিও নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যায়। নিভৃত প্রাণের অপদেবতার ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়, “বলেছিলাম অবিনাশ। তুমি পারবে না। এই রাস্তা তোমার নয়। তুমি বাড়ি যাও।”
অবিনাশ নীরবে ফুঁপিয়ে ওঠে, “আমি কীভাবে এত স্বার্থপর হতে পারি। আমার মা হাসপাতালে…. ”
-“ভয় আর স্বার্থহীনতা সমতুল্য নয় অবিনাশ। মহান হওয়ার চেষ্টা কোরো না।” অন্তর্ধ্বনি পালটা যুক্তি দেয়।
অন্তর্ধ্বনির যুক্তিকে সে বিশেষ পাত্তা দেয় না। আরেকটা বাস দেখতে পেয়ে অবিনাশ ছুটে যায়। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় বাসের ড্রাইভার হঠাৎ ব্রেক কষে। চাকায় ‘কিচ’ করে একটা শব্দ হয়। কন্ডাকটর বাস থেকে নেমে চেঁচাতে শুরু করে, ‘এইট বি, যাদবপুর, গড়িয়া বাসস্ট্যাণ্ড….’। লোকজনের ওঠানামা শুরু হয়। অবিনাশ বাসে উঠে পড়ে। বহু লোকজনের কোলাহলের মাঝেও নিভৃত প্রাণের অপদেবতার তাচ্ছিল্যের হাসি শোনা যায়।
বাসে ভিড় রয়েছে। অবিনাশ ভিড় ঠেলে ভিতরে যাওয়ার প্রয়াস করে। পরের স্টপেজ প্রায় এসে পড়েছে। কিছু লোকজন বাসের গেটের দিকে আসার চেষ্টা করছে। অবিনাশের গতি ব্যাহত হচ্ছে। “উফফ্!” একজন মহিলা ককিয়ে ওঠে।
“দেখে চলতে পারেন না?” পিছন ফিরে সে দেখতে পায় একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা তার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ভদ্রমহিলার গায়ের রঙ হালকা ফরসা, গায়ে একটু ময়লাটে ধরনের শাড়ি, মাথায় কাঁচাপাকা চুলের মাঝখানে সিঁথি, সেখানে চিলতে সিঁদুরের আভাস। “অদ্ভুত লোকজন সব, দেখে চলাফেরা করে না। পা পাড়িয়ে দেয়…” গজগজ করতে করতে ভদ্রমহিলা নেমে যান। তবে অবিনাশ পিছিয়ে যেতে শুরু করে। এক-দুই-তিন-চার বছর করে প্রায় বত্রিশ বছর পিছিয়ে যায় সে। বত্রিশ বছর আগের কোন একটি দিনে অবিনাশ জীবনে প্রথমবার মরিয়া হয়ে উঠেছিল। মেয়েটার গায়ের রঙ ছিল হালকা ফরসা, শরীরে কিশোরীভাব, মুখশ্রী সুন্দর, একটা চাপা দাম্ভিকতা লেগে ছিল মুখশ্রীতে। মেয়েটি কোন জবাব দেয় নি। তাচ্ছিল্যভরে একবার তাকিয়ে চলে গেছিল যা সদ্যযুবা অবিনাশের মরিয়াভাব আরো বাড়িয়ে দেয়। পরদিন সে জীবনে দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো মরিয়া হয়েছিল। এই ঘটনার ফলাফল হিসেবে তারপরদিনই হঠাৎ সাত-আটজন গুণ্ডাপ্রকৃতির ছেলে তাকে ওই একই জায়গায় এবং একই সময়ে রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে মারধোর করে। সেইসময় কেউ একজন তার পাঁজরের নীচটাতে দৌড়ে এসে লাথি মারে। তারপর থেকে অবিনাশ সোজাভাবে চলাফেরা করতে পারে না, বাঁদিকে একটু বেঁকে চলাফেরা করে। তার ‘ব্যাঁকা’ নামটির উৎপত্তির দায় এই ঘটনাটির উপর বর্তায়। অবিনাশ বর্তমানে ফিরে আসে। ‘গুড ফর নাথিং’ অনুভূতিটা ‘গুড ফর নাথিং হোল স্কোয়ার’-এ গিয়ে পৌঁছায়। ভিড় বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে আবার নিভৃত প্রাণের অপদেবতার বক্র হাসি শুনতে পায়। দাঁতে দাঁত চেপে রাখে সে, আজ আরেকবার মরিয়া হওয়ার সময় এসেছে। আজ সে শুধু নিজের জন্য ভাববে, চূড়ান্ত স্বার্থপর হয়ে উঠবে, সমস্ত পিছুটান উপেক্ষা করবে। সেদিন অবিনাশ আর তার গড়িয়ার ফ্ল্যাটে পৌঁছায় নি। বাস থেকে যাদবপুর স্টেশনে নেমে পড়েছিল।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। একটা চলন্ত ট্রেনের শেষদিককার কোন একটি কামরায় অবিনাশ বসে রয়েছে। তার মনের মধ্যে দ্বন্দ আর ঘৃণা। ঘৃণাটা নিজের প্রতি। আজ এই নিয়ে সাতবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই ছন্দপতন ঘটিয়েছে তার ভয়। শেষ চারবার সে রেললাইনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছে। প্রত্যেক ব্যর্থ প্রয়াসের পর নিভৃত প্রাণের অপদেবতার ক্রূর হাসি আর বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে। অবিনাশও হাল ছাড়ে নি, তবে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কামরার ভিতরে নিবু নিবু আলো জ্বলছে, অবিনাশ ছাড়া আরো তিনজন লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। এদের মধ্যে দুজন লোককে দেখে মনে হচ্ছে মাদকাসক্ত। আরেকজন চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। তবে অবিনাশ এসব কিছুই লক্ষ্য করছে না। সে তার দ্বিধাবিভক্ত মনকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। ট্রেনের কামরার দেয়ালে এক জায়গায় কালো রং বা কয়লা জাতীয় কোন জিনিস দিয়ে লেখা আছে, ‘I am Nobody’. জায়গাটা অবিনাশের চোখে পড়ে। সে অস্ফুটে বলে ওঠে, “নো-বডিই বটে।” এরপর অবিনাশের শরীরে-মনে কী একটা চেগে ওঠে, খুব দ্রুত ট্রেনের দরজার দিকে চলে যায়, দু-সেকেণ্ড অপেক্ষা করে, ঠিক দু-সেকেণ্ড পর নিভৃত প্রাণের অপদেবতার হাসি শোনা গেল, সঙ্গে কী একটা যেন বলতেও যাচ্ছিল, তবে তা শোনার আগেই অবিনাশ চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেয়। এই ঘটনায় ট্রেনের ভিতরের পরিবেশের কোন বিশেষ পরিবর্তন হয় না। যে লোকটা চাদর মুড়ি দিয়ে বসে ছিল, সে ঘটনাটা দেখতে পায়। একটু নড়ে চড়ে বসে, তারপর চাদর ঢাকা দিয়ে টানটান হয়ে সিটের ওপর শুয়ে পড়ে। অবিনাশের দেহটা রেললাইনের একপাশের ঝোপঝাড় বেষ্টিত জঙ্গলাকীর্ণ ঢালু অঞ্চল বেয়ে, গড়িয়ে নীচের দিকে চলে যায়।
অবিনাশ চোখ মেলে। এক-দু সেকেন্ড পর আবার চোখ বন্ধ করে। তার মন ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। আবার সে চোখ খোলে। চোখ খুলেই সে অনন্ত তারকারাশি দেখতে পায়। বিপুল তারকাবেষ্টিত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সর্পিলাকার স্ট্রিং এবং তার রঙের জৌলুষ তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের কসমিক প্রভা তাকে পুরোপুরি আত্মবিস্মৃত করে দেয়। বেশ কিছুসময় পরে তার মনে হয় সে বোধহয় মারা গেছে। তারপরই শরীরে একটা চাপা ব্যথা অনুভব করে। নাহ্, তার মানে সে জীবিত রয়েছে। উঠে বসে অবিনাশ। সে একটি নির্জন জলাভূমির ধারে পড়ে রয়েছে। রেললাইনের ঢালু জায়গা বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এখানে এসে পড়েছে। কিছুক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। মাথাটা ব্যথা করছে। ফেটেছে মনে হয়। তবে একটা মনোমুগ্ধকর আবেশ সারা শরীরে ছুঁয়ে আছে। নিঃসন্দেহে অনন্ত নক্ষত্রবিথীর প্রভাব। এই সুবিশাল অনন্ত নক্ষত্ররাজি তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। কে অবিনাশ? কে ব্যানার্জি? কে দাস? কে ঘোষ? কে বত্রিশ বছর পূর্বের সেই ঈষৎ ফর্সা মেয়েটি? কে তার মা? কোন সুদূর অতীতে মহাশূন্যের কোন এক দুরুহ কোণের মৃত তারাদের ভগ্নাংশ স্পেস-টাইমের জটিল ফেব্রিক বেয়ে এই নিখিল বিশ্ব, এই সৌরজগত বা ওই বিশাল অনন্ত নক্ষত্ররাজি রচনা করেছে। আবার কোন এক সুদূর ভবিষ্যতে এই ক্ষুদ্র পৃথিবী বা ওই বিপুল নক্ষত্ররাজি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। তখন তাদের মৃত অংশবিশেষ স্পেস-টাইমের অন্য কোথাও রচনা করবে অন্য এক সৃষ্টি।
অবিনাশ ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে, ‘I am nobody.’
দুই দিন পর। সময় সকাল সাড়ে ন’টা। গাড়োরিয়া কনস্ট্রাকশনস্-এর অফিসে ব্যানার্জি এবং আরো দুই উচ্চপদস্থ কর্মচারী একটা কেবিনে বসে রয়েছে। তাদের আজকের পরিকল্পনা মোটামুটি রেডি। অবিনাশ পোদ্দারকে আজ তারা দারুণ ভয় দেখাবে। ‘তোমাকে আর রাখছি না’ বলে শুরু করবে, পনের-কুড়ি মিনিট অপদস্ত করার পর ‘যাও, এবারের মত ছেড়ে দিলাম, আর যেন না হয়’ বলে শেষ করবে। তবে একে আউট করা যাবে না। কারণ, এর দারুণ ওয়ার্কলোড নেওয়ার ক্ষমতা আছে। ভয়ে ভয়ে লোকটা অনেক কাজ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর কাঁচের দেয়ালের ওপারে অবিনাশকে অফিসে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ব্যানার্জি নিজেকে প্রস্তুত করে। ‘ব্যাণ্ডেজ বেঁধে সিমপ্যাথি গেইন করছে’ মনে মনে ভাবে সে। অবিনাশ কেবিনের সামনে এসে কাঁচের দরজায় টোকা দিয়ে তাদের দিকে তাকায়। ব্যাপারটা কেবিনের লোকজনের একটু অদ্ভুত লাগে। কারণ এত দিন ধরে অবিনাশ পোদ্দার কেবিনে ঢোকার সময় দরজাটা একটু খুলে, একটু সামনের দিকে ঝুঁকে, ‘আসতে পারি?’ বলে পারমিশন নিতো। অবিনাশকে ভেতরে ডেকে নেওয়া হয়। তবে ভেতরের লোকজন একটু হতভম্ব হয়। অবিনাশের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর চলাফেরার ভঙ্গিমার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেছে। অবিনাশ ছিল জবুথবু, জড়োসড়ো ভঙ্গিতে হাঁটাচলা করতো। চেয়ারে বসলে দুটি পা কাছাকাছি থাকতো আর হাত দুটো জড়ো করে কোলের উপরে রাখতো। আর আজ অবিনাশের চলাফেরায় কেমন যেন ঝেড়ে ফেলে দেওয়া ভাব। ওরা একটু অবাক হয়। অবিনাশ চেয়ারে বসে। বসার ভঙ্গিতেও বিশেষ পরিবর্তন ঘটেছে। সে চেয়ারে বসেছে মোটামুটি হাত-পা ছড়িয়ে। ব্যানার্জি নিজের হতভম্ব অবস্থাটা দ্রুত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। মুখটাকে যতটা সম্ভব কঠোর করে বলে, “অবিনাশ, তোমার ব্যাপারে ম্যানেজমেন্ট ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে। তোমাকে আর রাখা হচ্ছে না।” এরপর কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। অবিনাশের মুখ মোটামুটি ভাবলেশহীন। সে তাকিয়ে আছে সামনের কাপবোর্ডে রাখা ট্রফিগুলির দিকে। হঠাৎ দুম করে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে ব্যানার্জির সঙ্গে আই কনট্যাক্ট করে। ব্যানার্জির আত্মবিশ্বাসে ভাঁটা পড়ে কিছুটা। “আমি আজ রিজাইন দেব বলেই এসেছি” অবিনাশ নীরবতা ভঙ্গ করে। ব্যাগের ভিতর থেকে সে একটু মোটা, ভালো কোয়ালিটির এ ফোর সাইজের কাগজ বের করে। তাতে কী সব লেখা রয়েছে। এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে সামনের তিনজন ভদ্রলোকের বিস্ময়ের মাত্রা বাড়তে থাকে। কাগজটা টেবিলে রেখে অবিনাশ বলে, “এই আমার রেজিগনেশন লেটার।” ঘোর বিস্ময়ে ব্যানার্জি হাতে কাগজটা তুলে নেয়। দেখা যায়, ‘প্রিয় তত্বাবধায়ক মহাশয়’ দিয়ে একটি চিঠি শুরু হয়েছে। চিঠিটা পুরোপুরি বাংলায় লেখা। ব্যানার্জি রাগে চেঁচিয়ে ওঠে, “তুমি কী ইয়ারকি করছো এখানে! বাংলায় রেজিগনেশন লেটার! অফিসিয়াল মেইল দিয়ে রিজাইন করতে হয় তুমি জানো না!” ব্যানার্জির কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই অবিনাশ বলে ওঠে, “ডোণ্ট সাউট। এটাই আপনার খারাপ অভ্যেস। অফিসিয়াল মেইল আমি কিছুক্ষণ আগেই দিয়ে দিয়েছি। চেক করুন। এই চিঠিটা বাংলায় লিখতে ইচ্ছে হল তাই লিখলাম। আর নিজের মাতৃভাষাকে একটু ডিগনিটি দেওয়ার চেষ্টা করুন।” এইরকম উত্তর শুনে ব্যানার্জি এবং তার পারিষদগণ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর অবিনাশ কন্টিনিউ করে, “আমার যে পেণ্ডিং কাজগুলি পড়ে আছে সেগুলি আমি নোটিশ পিরিয়ডে কমপ্লিট করে দেব।” এরপর তিনজনকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে দিয়ে অবিনাশ কেবিনের বাইরে বেরিয়ে আসে। তাকে এখন হাসপাতালে যেতে হবে। তার মা বেশ কিছুটা সুস্থ হয়েছে। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বোধহয় ছুটিও দিয়ে দেবে। সে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়ে। গাড়োরিয়া কন্সট্রাকশন্স কোম্পানির তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী অবাক হয়ে তার বেড়িয়ে যাওয়া দেখে। তারা জানেও না যে দিন দুই আগে কোন এক নির্জন নয়ানজুলির সামনে অবিনাশ পোদ্দার বেমালুম ‘নো-বডি’ হয়ে গেছে। তবে অবিনাশ এইসময় একটা জটিল হিসেব করছে। বহু বছর চাকরি করে পি.এফ আর অন্যান্য যা টাকাপয়সা জমেছে, সেগুলি কাজে লাগিয়ে আবার সে হোটেলটা চালু করবে। তবে এইবার তার বিশেষ আধুনিকীকরণ করা হবে। সুখময় পোদ্দারের ভাতের হোটেল পরিণত হবে রেস্তোরাঁয়। নাম দেওয়া হবে ‘Nobody’s Place’. সুনীল আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ ভাসছে। অবিনাশ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘I am Nobody’.