দৃষ্টিভ্রম | কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | রিতেশ দাস| Bengali Story for Matured
0 (0)

                                                           ১

 নিস্তব্ধ রাত্রি। চারপাশের রাস্তায় কমলা হ্যালোজেনের আলো। মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা ভেদ করে পাড়ার কুকুরদের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। ওই দূরের ঝোপের আঁধারে সহস্রাধিক ঝিঝি পোকা নিজেদের  মাঝে আলাপ আলোচনা করছে। দূরের দুটো ফ্ল্যাটের মাঝে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি চাঁদের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকের সব ঘরগুলো অন্ধকার আলোর উৎস বলতে কেবল আমার ঘরটা। প্রতিদিনের মতো রাতের বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খাচ্ছি আচমকা সামনের ফ্ল্যাটের পুবের জানলায় আলোর শিখা দেখতে পেলাম। আমার প্রতিদিন রাতের বেলা দুটো আড়াইটে নাগাদ সিগারেট লাগে আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়েনি। ব্যাতিক্রমি কেবল আজকের ওই পুবের জানলায় আলোর শিখাটা। আমি সিগারেটে একটা টান দিয়ে সেইদিকে তাকিয়ে রয়েছি জানলার কাঁচের ওপারে একটা ছায়া দেখতে পেলাম। লম্বা কেশজুগলের আবছা স্পর্শে বেশ বুঝতে পারলাম সেটা একটি নারী মূর্তি। আমি কলকাতায় আসার পড়ে প্রায় বছর দুয়েক হল এই বাড়িতে উঠছি কিন্তু কোনোদিন কাউকে ওই সামনের পুবের ফ্ল্যাটের জানলায় দেখিনি। কৌতূহল আমার ছেলেবেলা থেকে বেশি তাই সিগারেটে টান দিতে দিতে সেইদিকে তাকিয়ে রয়েছি। আকাশে মেঘগুলো ধীরে ধীরে কখন যে সরে গেছে আমি খেয়াল করিনি। এখন যখন খেয়াল হল তখন দেখলাম আকাশে একাধিক নক্ষত্রের সমাগম। জানলার কাঁচের সাথে সাথে নীল পর্দাটা সরে যেতেই সেই নারী মূর্তির মুখটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল সেইসাথে থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা। মেয়েটির বয়স আন্দাজে ঠিক বলতে পারব না কিন্তু সে বেশ রূপবতী বলেই মনে হচ্ছে।  সিগারেটের একটা লম্বা ছাই ফেলে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মনে মনে তার সাথে মেয়েটির সৌন্দর্যের তুলনা না করে পারলাম না। সে যেন আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তারপর এক পলক শেষে এবার জানলাটা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর বন্ধ জানলার পর্দার আড়ালে মেয়েটির ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।।

রাতের ঘটনার কথাটা আমি আমার দুই সঙ্গীকে কিছুই বললাম না। আমি বাদে বাকি দুজন সকাল দশটায় কাজের জন্য বেরিয়ে পড়ে। আমার সাথে দেখা হয় বিকেলের সময় তাই বলার যে তেমন সুযোগ পেয়েছি তেমনটা নয়। আমরা তিনজন একসাথে একসময় কলেজে পরেছি সেইসময় তিনজনে মেসে থাকতাম তারপর চাকরী পেয়ে একটু রোজগার হতেই সোজা এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছি। আমরা তিন বন্ধুর মধ্যে আমি এখন বেকার আগের মাসেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। একটা নিউজ কম্পানিতে ছিলাম আর্টিকেল লিখতাম। কাজ হারিয়ে  এখন তাই আমার রাত জাগা আর দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার একটা বাজে অভ্যাস তৈরি হয়েছে। তবে এখন একটা ওয়েবসাইটের জন্য ঘরে বসেই আর্টিকেল লিখে অল্প বিস্তর রোজগার করছি তাই পুরদস্তুর বেকার আমাকে বলা চলে না। সকালে আজ আমার ঘুম ভেঙেছে এগারোটা নাগাদ। ব্ল্যাক কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছি সেই পুবের জানলায় দেখতে পেলাম  কালকে রাতের মেয়েটিকে। কাল রাতের আলোয় মুখটা তেমন স্পষ্ট ছিল না এখন দিনের আলোতে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ভেজা কেসজুগলে নীলচে তোয়ালে দিয়ে শুকনো করছে। আমার দিকে দৃষ্টি পড়তেই ঠিক কালকের মত পালিয়ে গেল। আমি সেইদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখলাম দূরের হলদে দেওয়ালে একটা রবিঠাকুরের ছবি হাওয়ায় দুলে দুলে উঠছে। হাতের সিগারেটটা কখন যে শেষ হয়ে গিয়েছে কে জানে!! আমার ফোনটা বেজে উঠতেই এবার ঘরের ভিতরে চলে এলাম। আমার পুরনো অফিস কলিগ জয়েন্ত ফোন করে আমাকে জানাল আমাদের পুরনো কোম্পানির ম্যানেজার নাকি বদলে গেছে নুতন ম্যানেজারের নাকি আমার আগের কাজগুলো খুব ভালো লেগেছে তাই তিনি আজকে সেকেন্ড হাফে একবার আমাকে দেখা করতে বলেছেন। উনি আমাকে মেল করেছিলেন আমিই দেখিনি ভাগ্য ভাল জয়েন্ত ফোন করে ব্যাপারটা আমাকে জানাল। সেই মেলের একটা কপি নিয়ে আমি স্নান খাওয়া সেরে একটা ওলা বুক করলাম। ফ্ল্যাটের নীচে গাড়িটা থামতেই দরজা খুলে ভিতরে দেখি সেই মেয়েটিকে। আমার হতচকিত ভাব দেখে ড্রাইভার বলল “দাদা আপনি শেয়ারে বুক করেছেন। আপনি বললে কেন্সেল করে দেব!!?”

 আমি ফোনের স্ক্রনে চোখ বুলিয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। হাতে সময় বেশি নেই তাই নতুন করে বুক করলে বেশি সময় লাগবে। ড্রাইভার বলল আমাদের দুজনের গন্তব্য নাকি একই “পার্কস্ট্রিট” তাই বেশি সময় লাগবে না। মেয়েটি জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বসেছি তার ঠিক উল্টোদিকের জানলায় আমার চোখ সোজা তার দিকে। মেয়েটির বয়স বছর পঁচিশ কি ছাব্বিশ হবে। গায়ের রঙ ফরসা , পরনে একটা সাদা রঙের শার্ট সেইসাথে একটা কালো রঙের চুস প্যান্ট। চুলগুলো খোলা কাঁধ অবধি সেইগুলো ঝুলছে। ঠোঁটে  বাদামি রঙের লিপস্টিক , চোখে আলতো করে লাইনার বোলানো।

আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে আমার দিকে ফিরে বলল “কাল থেকে দেখছি আমার দিকে খালি তাকিয়ে আছেন , মতলবটা কি বলুন তো আপনার!!?”

এমন সোজা অথচ বাস্তবিক প্রশ্ন শুনে প্রথমে আমি খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম।

-“ না মানে!! আসলে আমি তো মানে……………।“

আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বলল “ভালো লেগে থাকলে বলতে পারেন যে আমাকে দেখে আপনার ভালো লেগেছে বন্ধুত্ব করতে চান তাই বলে আমার দিকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার কেমন জানি লজ্জা লাগে।“ কথাটা বলে তার ঠোঁটের কোণে একটা আলগা হাসি দেখে আমি নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা খানিক কাটিয়ে বললাম “না আসলে কাল রাত থেকে বারবার আপনার সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে তাই মিলিয়ে দেখছিলাম যে সেই কালকের রাতের আপনিই কি এখন আমার সাথে গাড়িতে বসে রয়েছেন।“

-“যদি সেই একই ব্যাক্তি না হতাম তাহলে কি ওই একই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন!!?”

আমি খানিক ইতস্তত করে বললাম “না তা হয়তো দেখতাম না।“

আমাদের এই অল্প কথার মাঝেই গাড়ি পার্কস্ট্রিটে ঢুঁকে পড়েছে। গাড়ী এসে অক্সফোর্ড বূকের সামনে এসে দাঁড়াতেই সে গাড়ি থেকে নেমে গেল।

আমি জানলা থেকে বাইরে তাকিয়ে বললাম “আপনার নামটা!!?”

সে পিছনের দিকে ফিরে হাসতে হাসতে বলল “সেটা রাতের বেলা সিগারেট খেতে খেতে জানতে পারবেন।“

গাড়ি সামনের রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।  আমার মুখে আমার অজান্তেই একটা আলগা হাসি ফুটে উঠল। 

                                                         ২

অফিসের সকলেই আমার পূর্ব পরিচিত তাই সেখানে উপস্থিত হতেই সকলেই আমাকে দেখে আলগা অভিনন্দন জানাল। আমার টেবিলটা দেখলাম এখনো ফাঁকা অর্থাৎ সেখানে নুতন লোক নেওয়া হয়নি। মনে মনে সেটা দেখে বেশ খুশি হলাম। জয়েন্তকে দেখে হাত মিলিয়ে বললাম “কাজ হয়ে গেলে বিকেলে তোকে বিয়ার খাওয়াব।“

জয়েন্ত হাসতে হাসতে বলল “তাহলে এখনই বাড়িতে বলে রাখি কি বলিস!!? কাজ তোর হয়ে যাবেই। নতুন ম্যানেজার গুপ্তার মতো হারামি নয় , কাজের ব্যাপারে খুব কড়া লোক বাকি এমনিতে খুব মিশুখে। তাছাড়া তোর লেখার বেশ বড় ভক্ত বলেই মনে হয়।“

-“আচ্ছা তা আমার কথাটা কে মাথায় দিল !!?”

-“আরে মিস্টার সেন মানে আমাদের নুতন বস আগে যেখানে ছিলেন সেই কম্পানিতে থাকাকালীন তোর ওই আফ্রিকা সাফারির আর্টিকেলটা নাকি পড়েছিলেন তখন থেকেই তোকে নাকি তার মনে ধরেছে।“

কথা বলতে বলতেই মিস্টার সেনের সেক্রেটারি মিলি এসে আমাকে বলল “অনির্বাণদা স্যার তোমাকে ডাকছেন।“

মিলি আমার পূর্ব পরিচিত। আমাদের আগের ম্যানেজার গুপ্তার সময় থেকে রয়েছে। এই কেবিনটাও আমার পূর্ব পরিচিত। কেবিনের সামনে গিয়ে নক করতেই ভদ্রলোক বললেন “আসুন মিস্টার অনির্বাণ। টেক আ সিট।“

মিস্টার সেন বয়েসে প্রবীণ। আন্দাজে বছর পঞ্চাশ বয়েস হবে। মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। চোখে কালো রিমলেস চশমা, হাতে একটা ঘড়ি সেটা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে বেশ দামি। পরনে নীল রঙের সুট সেইসাথে একটা লাল টাই।

-“আপনি আমাকে ডেকেছেন এটা আমার সৌভাগ্য।“

-“নো নো মিস্টার অনির্বাণ ইটস মাই প্লেসার টু হ্যাভ উ। তোমার আর্টকেলের আমি বিশাল ফ্যান। তাই আমি যখন শুনলাম তুমি আগে এখানেই ছিলে তাই ভাবলাম যদি একবার অ্যাপ্রোচ করে তোমাকে ফেরাতে পারি। গুপ্তা ইজ সাচ এ ফুল তোমার মত একজনকে সে………………।“  কথাটা শেষ করার আগেই তিনি থেমে গেলেন তারপর আবার বলতে শুরু করলেন  “সে যাই হোক আমি চাই তুমি আবার জয়েন কর। আমাদের এমডি মিস্টার মল্লিকের সাথেও আমি কথা বলেছি তিনিও আমাকে তাই বলেছেন আর আগের চেয়ে স্যালারিতা একটু বাড়াতেও বলেছেন তিনি।“

-“আপনি আমাকে যেভাবে সম্মান দিচ্ছেন আমি তেমন বিরাট কেউ নই।“

-“তুমি যান না তোমার মধ্যে কি আছে। তা তুমি কি ঠিক করলে আমাকে জানিও দুদিন সময় দিলাম ভেবে দেখো।“

-“দুদিন সময় লাগবে না। আমি কালকেই জয়েন করতে পারব।“

-“ওয়ান্ডারফুল। আমি মিলিকে বলেও দিচ্ছি তোমার জয়েনিং লেটারটা তোমাকে মেল করে দিতে।“

মিস্টার সেন আমার সাথে হাত মিলিয়ে বললেন “তোমার আর্টিকেল আমার বেশ ভালো লাগে। কালকে থেকে কাজে লেগে পড়। সামনের ইসুতে তোমার কলামটা আবার চালু করে দেব।“

আমি যাওয়ার সময় সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। বাইরে বেরিয়ে আসতেই জয়েন্ত বলল “বলেছিলাম বিকেলের বিয়ারটা ফাইনাল।“

-“তোর ছুটি হতে এখনো অনেক দেরি আমি একটু ঘুরে আসছি।  ছটার মধ্যে রক ক্লাবের সামনে চলে আসবি।“

বাইরে বেরিয়ে আমার দুই সঙ্গী হিমাংশু এবং অভিককে ফোন করে বিকেলের পার্টিতে ডেকে নিলাম। পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে আগুন লাগিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। গন্তব্য অজানা তবু সময় কাটানোর জন্য ভাবলাম একটু ঘুরে বেড়াব। অক্সফোর্ড বুকের সামনে এসে সকালের ঘটনাটার কথাটা মনে পড়তেই মনটা কেমন যেন ম্লান হয়ে এলো। সময় কাটানোর জন্য ভাবলাম অক্সফোর্ড বুকের ভিতর গিয়ে একটু বই নাড়াচাড়া করব। ভিতরে ঢুকতেই দেখা সেই সকালের মেয়েটির সাথে।

আমাকে দেখেই হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল “কি আমাকে ফলো করছেন নাকি!!?”

-“যদি বলি তাই তাহলে কি পুলিশে দেবেন নাকি!!?”

-“না পুলিশে নয় তবে একটা গোয়েন্দা লাগাব ভাবছি।“

আমিও হাসতে হাসতে  বললাম “তা ফেলু মিত্তির নাকি ব্যোমকেশ!!?”

-“কাকবাবুর নাম শুনেছেন!!? আমি ওনার ফ্যান।“

-“ফেলু মিত্তির ব্যোমকেশ থাকতে কাকাবাবু প্রথম শুনলাম। যদিও কাকাবাবু আমারও পছন্দ তবে প্রথম সারিতে আমি ফেলু মিত্তিরকেই প্রেফার করি।“

-“শতকরা আশি ভাগ লোকেরই তাই পছন্দ।  আমার ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম জিনিস বেশি পছন্দ। তবে আপনি আর্টিকেল লেখেন ভেবেছিলাম আপনি হয়তো একটু অন্যরকম জিনিস পছন্দ করবেন।“

-“আমি আর্টিকেল লিখি সেই খবর কীভাবে পেলেন!!?”

-“আপনার আফ্রিকা সাফারির আর্টিকেলটা ভাল লাগবে না এমন লোক কমই আছে মিস্টার অনির্বাণ।“

-“আপনি তো দেখছি আমার ব্যাপারে সবই জেনে বসে আছেন। তা এবার কি আপনার নামটা জানতে পারি!!?”

-“দেবারতি সেন।“

-‘অনির্বাণ ঘোষ।“ আমরা দুজনে হাত মিলিয়ে এগিয়ে গেলাম। দেবারতি কিছু বই কিনল তারপর দুজনে মিলে পাশের একটি কফি শপে গিয়ে বসলাম।

আমি একটা ব্ল্যাক কফি এবং দেবারতি ভ্যানিলা মিল্কসেক অর্ডার দিল।  

-“ব্ল্যাক কফি চিনি ছাড়া খেতে আমি খুব কম লোককে দেখছি আসলে দেখিনি বলাটাই বোধ হয় ভালো হবে।“

-“তা আমি একটু হেলথ কনসাস বলতে পারেন। তা আপনার পেশাটা ঠিক কি তা জানা হলনা।“

-“আমি আসলে থাকি জামসেদপুরে এখানে এসেছি দিন তিনেক হল। আমার বন্ধু একটা ইভেন্ট মেনেজম্যন্ট কোম্পানি খুলেছে সেখানেই জয়েন করেছি।“

-“তা কলকাতা কেমন লাগছে আপনার!!?”

-“দেখুন কলকাতা আমার পূর্ব পরিচিত। আমার মাসির বাড়ি এখানে রয়েছে ওই মানিকতলার দিকে। তাই ছেলেবেলা থেকে আমার বেশ ভালই যাতায়াত রয়েছে।“

-“ তাই নাকি আমার মামাবাড়িও ওখানে। বাবা কলকাতায় চাকরী করতেন রিটায়ার করে চলে গেলেন দেশের বাড়িতে।“  

-“তা আপনি তাহলে পুরোপুরি কলকাতার!!?”

-“না আমি মায়ের সাথে পুরুলিয়াতেই থাকতাম তারপর যাদবপুর থেকে পড়াশুনা করার সময় থেকেই কলকাতায়। আমাদের আদি বাড়ি পুরুলিয়ায়।“

-“তা আপনি কি একাই থাকেন নাকি ফ্ল্যাটে!!?”

-“না না আমার দুই বন্ধুর সাথে থাকি। আপনি!!?”

-“আপাতত একা দেখি পড়ে যদি সঙ্গী জোটে। আজ তবে চলি এবার রাতের বেলা দেখা হবে আপনি বারান্দায় আর আমি জানলায়।“

আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম তার আগেই আমার থেকে নম্বরটা চেয়ে নিয়ে ফোনে টুকে  সে চলে গেল। আমার পকেটে ফোনটা বেজে উঠতেই দেখি জয়েন্ত তিনটে মিসকল করেছে। ফোনটা তুলেই দ্রুত ছুটে গেলাম রক ক্লাবের উদ্দেশ্যে।

                                                          ৩

-“আমাদের রক ক্লাবের সামনে দাঁড়াতে বলে বাবু নিজে হাওয়া।“

সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে  গম্ভীর গলায় বলল হিমাংশু।

অভিক বলল “আমাদের এইভাবে কথা দিয়ে বাবু লেট কি ব্যাপার জয়েন্তদা!!?”

জয়েন্ত বলল “যাক বাবু এসে পড়েছেন এখন তিনিই আমাদের সবটা খুলে বলবেন।“

আমি হাসতে হাসতে এসে বললাম “আরে ভেরি সরি রে। আসলে একটা কাজে আটকে পড়েছিলাম।“

-“তা কি কাজ জানতে পারি কি!!?”

-“ চল আগে ভিতরে চল বিয়ারে দুটো চুমুক দি তারপর সব বলছি।“ জয়েন্ত আমাদের থেকে বয়েসে বড় কিন্তু আমার সাথে একই অফিসে চাকরী করে বলে আমি জয়েন্তকে তুই করেই কথা বলি। কিন্তু অভিক আর হিমাংশু জয়েন্তকে দাদা বলেই সম্বোধন করে। অবশ্য জয়েন্ত আমাদের মত ব্যাচেলার নয় বৌ আর দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে একেবারে ফ্যামিলি ম্যান।   

রক ক্লাবে আমি এর আগে অনেক বার এসেছি। আগে একটা সময় প্রতিদিন এখানে না আসলে আমার রাতের ঘুম হতো না। তবে ইদানিং বেশ খানিকটা আসা কমিয়ে দিয়েছি। চারজনে চারটে বিয়ার অর্ডার দিলাম সেইসাথে চিকেন রেশমি কাবাব।

জয়েন্ত বলল “এবার বলতো ছিলি কোথায় এতক্ষণ!!?”

-“আরে দেবারতি বলে আমাদের সামনের হলুদ ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে এসেছে। সকালেই আলাপ হয়েছিল ওলাতে তারপর তখন অক্সফোর্ড বুকে দেখা হয়ে গেল তাই ওর সাথে একটু কফি খেতে গেছিলাম।“

-“আচ্ছা শুধু কফি নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে!!?”

আমার মুখটা একটা অজানা হাসির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে। সেই দেখে অভিক বলল “ব্যাপার আবার কি বাবুর মেয়েটিকে ভালো লেগেছে।“

-“আরে না না তেমন ব্যাপার নয়।“

জয়েন্ত বলল “আরে এতে লজ্জার কি আছে , তোর বয়েস কম হল নাকি!!? তাছাড়া এই বয়েসে এবার একটা প্রেম করবি তারপর বিয়ে করে সেটেল হবি এটাই তো স্বাভাবিক।“

হিমাংশু এবং অভিক দুজনেই জয়েন্তকে সমর্থন করল।

আমি বললাম “দেখ মিথ্যে বলব না মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু এখনই কীভাবে প্রেমে পড়ব বল!!?”

অভিক বলল “প্রেমে পড়তে সময় লাগে না। আমার সাথে চন্দ্রানির প্রেম মেট্রোর গেটের ধারে প্রথম আলাপেই শুরু হয়েছিল।“

জয়েন্ত বলল “তোর হয়েছিল বলে সবার হবে তেমন কথা নেই। অল্প সময়ের আলাপে যখন কফি খেতে রাজি হয়েছে তখন তোর ব্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে বলেই তো মনে হচ্ছে।“

-“হুম তা আছে বলে আমারও মনে হয়। তাছাড়া মেয়েটিকে খুব সুন্দর দেখতে আমাদের পাড়ায় থাকে দেখি যদি আরও আলাপ করার সুযোগ পাই।“

সবাই মিলে বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল “আজকের পার্টি অনির্বাণ এবং বৌদির প্রথম দেখার খুশিতে।“

বাড়ি ফিরতে সেদিন বেশ রাত হয়ে গেল। ডিনারটা আমরা তিনজনে রাস্তায় সেরে ফিরেছি তাই বাড়ি ফিরে যে যার নিজের ঘরে ঢুঁকে গেলাম। মাথাটা বড্ড ধরেছে তাই আজ আর ল্যাপটপে কাজ করতে বসতে ইচ্ছা করল না ভাবলাম একটু স্নান করে ঘুমিয়ে পড়ব। সেইমতো স্নান সেরে বিছানায় শুয়ে গান শুনছি। আমার ফোনটায় একটা মেসেজ ঢুকল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি দেবারতি আমাকে মেসেজ করেছে “কি আজকে জানলার বন্ধুকে সময় দেবেন না!!?”

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি দেবারতি পুবের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি মেসেজ করলাম “তা ফোন করব নাকি!!?”

সে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ফোন লাগাল। আমার ফোনটা বেজে উঠতেই আমি ধরলাম।

-“কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি!!?”

-“না না, ওই একটু শুয়ে ছিলাম। এখন রাত ১টা বাজে আমার আসার সময়তো ২টো।“

-“তা তারতারি ডেকে নিলাম অসুবিধা হল নাকি!!?”

-“তা কেন হবে!! আপনার মতো সঙ্গী পেলে বেশ ভালই লাগে। নিশুতি রাতে এমনিও সঙ্গী ভালো জোটে না।“  

-“তা আমাকে ভালো সঙ্গী বলছেন। তা কেমন সঙ্গী বানাবেন আমাকে!!?”

-“ঐ ধরুন নিস্তব্ধ রাতে যেমন চাঁদের সঙ্গী হয় ধ্রুবতারা সেইরকম।“

-“আমি তেমন সঙ্গী হতে পারব কিনা জানিনা তবে রাতের বেলা আপনার কাজের ব্যাঘাত ঘটাতে আমি বেশ পারব এইটুকু বলতে পারি।“

-“আপনার মতো মানুষের জন্য কাজের ব্যাঘাত ঘটে আমি তা মানি না।“

-“তা কেন!!? আমি কি এমন আলাদা শুনি!!?”

-“আপনি নারী , নারী মানেই সৃষ্টির উৎস। সেইসাথে আপনি রূপসী সেই হিসেবে সৃষ্টির আঙ্গিকে আপনার অবদান অন্যদের চেয়ে একটু যে এগিয়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই।“

-“তা আপনি কি কবিতা লিখতেও পারদর্শী নাকি!!?”

-“না তেমন নই তবে হেঁয়ালি করার একটা বাজে অভ্যাস আমার আছে।“

-“এইভাবে হেঁয়ালি করেন যখন তা কতজন প্রেমিকা পাতিয়েছেন শুনি!!?”

-“এইটা বলে আমাকে আপনি লজ্জা দিচ্ছেন। কারণ প্রেমিকা একজনও নেই বান্ধবীও যে তেমন আছে তা নয়।“

-“বাবা এতো সুন্দর হেঁয়ালি করেন মেয়েদের থেকে দূরে থাকেন ব্যাপারটা কি বলুন তো!!?”

-“ব্যাপারটা কিছুই না কাউকে যদি রবি ঠাকুরের লাবণ্য বলেন তবে সেই ব্যাক্তি যে “শেষের কবিতার” লাবণ্যের সাথে নিজের মিল খুঁজে আপনার বাক্যের সঠিক বিশ্লেষণ করবে সেটা আশা করা বর্তমান যুগে বৃথা।“

-“আচ্ছা বেশ বুঝলাম। তা আমি যদি বুঝি আমাকে কি দেবেন!!?”

-“ভেবে দেখতে হবে। তবে আপাতত আমাকে তুমি বললে ভালো হয়। আপনিটা কেমন যেন লাগে।“

-“আচ্ছা তাহলে আমাকেও তুমি বলতে হবে। রাজি!!?”

-“ঠিক আছে তবে তুমি বল এতো রাতে জেগে কেন!!?”

-“তোমার হেঁয়ালি শুনব বলে।“

-“ঠাট্টা করছ!!?”

-“না যদি বলি মস্করা তবে!!?”

-“তবে আর কি ফেলু মিত্তির আর কাকাবাবুর একটা ক্ল্যাস লাগল বলে।“  

-“কাকাবাবুকে এতটা হেয় করছ দেখবে একদিন কাকাবাবু ফেলু মিত্তিরকে ছাপিয়ে যাবে।“

-“আচ্ছা আমি হেও করলাম তোমাকে কে বলল!!?”

-“করলে তো তোমার গলার সুরে মনে হল।“

-“আরে আমার গলাটায় ওইরকম ফেলু মিত্তিরের ফ্যান তাই বলে একটু বড়াই করলাম বলে দোষ!!?”

-“কাকাবাবু পড়ে দেখেছ কোনোদিন!!?”

-“পড়েছিলাম একটা গল্প ভালো কিন্তু ফেলুদা আরও বেশি ভালো বলেই আমার মনে হয়েছে।”

-“আমি যদিও ফেলুদা পুরোটা পরেছি। তোমাকে একটা কাকাবাবু সমগ্র দেব একবার পড়ে দেখো।“

-“আচ্ছা দিও পড়ব।“

– “ ফুটবল দেখ!!?”

-“বাঙ্গাল হয়ে ফুটবল দেখব না সেটা আবার  হয় নাকি!!

-“তার মানে ইস্টবেঙ্গল।“

-“এই তুমি মাচা নাকি!!?”

-“দেখ মাচা বলে খোটা দেবে না। তোমরাতো লোটা।“

-“থাক অনেক হয়েছে। বুঝেছি আমাদের মধ্যে বেশ একটা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাপার আছে।“

-“তা আছে এখন দেখতে হবে কে জেতে।“

-“প্রতিদ্বন্দ্বীতা ভালো তবে সেখানে হার জিত না থাকাই ভালো।“

-“তা বটে। চালো আজ ঘুমালাম কাল কথা হবে। গুড নাইট।“

-“গুড নাইট।“

                                                           ৪

সকালে উঠে অফিসের কাজে বাড়িয়ে পড়লাম। যদিও কফির কাপ আর সিগারেট হাতে বারান্দায় বসেছিলাম কিন্তু দেবারতির জানলায় পর্দা ছাড়া কিছু দেখতে পাইনি। আজকে তিন বন্ধু একসাথে দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। মাঝের এক মাসের ছুটিতে অভ্যাস যে বদলেছে তা আজকে আমার মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। ওলাতে বসে তিনজনে অফিস যাচ্ছি। অভিকের অফিস ধর্মতলায় আর হিমাংশুর সেন্ট্রাল আভিনিউ আর আমার পার্কস্ট্রিট তাই একটা ওলাতেই তিনজনে চলেছি। রাস্তায় যেতে যেতে অভিক বলল “কালকে রাতে ঘুম হয়নি নাকি রে অনি বার বার হাই তুলছিস!!?”

-“আরে না রে এই একমাসে রাতে জেগে থাকার একটা বাজে অভ্যাস তৈরি হয়েছে।“

হিমাংশু বলল “সেই রে রাতের বেলা নুতন প্রেমিকার সাথে প্রেম করলে কি আর ঘুম হয়!!?”

-“এই কি যাতা বলছিস।“

-“এই দেখ অনি মিথ্যে বলবি না। আমি সকালে তোর ফোন থেকে একটা ফোন করতে গিয়ে দেখলাম কালকে রাতে ৩টে অব্দি দিব্বি প্রেম করেছিস। তোর ফোনের কল লিস্ট নিশ্চয় মিথ্যে বলবে না।“

আমার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। সেই দেখে অভিক বলল “আরে প্রেম করছিস আমাদের বলতে ক্ষতি কি!! ভয় নাকি!! দেখ ভাই আমার কিন্তু প্রেমিকা সেট বিয়ের বেশি বাকি নেই। বাকি রইল হিমাংশু ওকে  নিয়ে তুই চিন্তা করিস না ওকে পাত্তা দেবে না কোনো মেয়ে।“

কথাটা বলেই অভিক হাসতে লাগল। আমিও ওর সাথে তাল দিলাম।

হিমাংশু একটুও না রেগে বলল “আচ্ছা হেসে নে যেদিন পটাব না দেখে নিবি শালা।“

সেন্ট্রাল আভিনিউতে গাড়ি পৌঁছে গিয়েছে তাই এমজি মেট্রোর কাছাকছি হিমাংশু নেমে গেল। কথা থাকল বিকেলে আজকে বাড়িতেই আড্ডা হবে।

অভিককে ধর্মতলা নামিয়ে দিয়ে আমি চললাম পার্কস্ট্রিটের উদ্দেশ্যে। পার্কস্ট্রিটের দিকে গাড়ি ছুটে চলেছে  আমি জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে মনে বার বার দেবারতির মুখটা আমার মনে পড়ছে। তাহলে সত্যিই কি আমি প্রেমে পরেছি নাকি এটা কেবল দেবারতির সৌন্দর্যের চাকচিক্যের মোহ!! মনে বার বার তবে কেন তার মুখটা ভেসে উঠছে!! এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে আফিসে এসে  পৌঁছেছি আমার খেয়াল নেই। ড্রাইভারের ডাকে আমার তন্দ্রা ফিরতে আমি গাড়ি থেকে নেমে অফিসের ভিতর প্রবেশ করলাম। অফিসে সারাটা দিন কাজের ফাঁকে অনেকবার দেরবারতির কথা আমার মনে পড়েছে , অনেকবার ইচ্ছা করেছে একটা মেসেজ করতে কিন্তু নিজেকে সামলে আমি তাকে কোনো মেসেজ করিনি। অফিস শেষে বাড়িতে ফিরে দেখি অভিক ডিমের ডেভিল বানাচ্ছে আর হিমাংশু টেবিলে বসে সেলাড কাটছে। আমাকে দেখে দুজনেই বলল “আজকে ভালো দামি হুইস্কি এনেছি তোর পছন্দের আয়  তারতারি ফ্রেস হয়ে নে।“

আমি ফ্রেস হয়ে ডাইনিং টেবিলের একপাশে জানলার ধারে বসেছি। আমার উল্টোদিকে হিমাংশু আর অভিক মুখোমুখি বসেছে। তিনজনে মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে গল্প করছি। কথাগুলো সেই কলেজের দিন থেকে শুরু করে আমাদের মেস জীবন ছাড়িয়ে অবশেষে বর্তমানের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠল।  সময়টা রাত ১২টার একটু বেশি হবে। পুবের জানলায় কিছুক্ষণ আগেই আমি আলো জ্বলতে দেখেছি তাই মন বলল এটা নিশ্চয়ই দেবারতি ফোন করেছে। আমার আন্দাজটা যে ঠিক সেটা অভিকের মুখের ভাবটা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি। অভিক ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিতেই আমি ফোনটা তুলে বারান্দায় চলে এলাম। ওরা দুজনে নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতে উঠল।

-“কি বিরক্ত করলাম নাকি!!?”

-“আরে না না তেমন কিছু না। ওই একটু হুইস্কি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম।“

-“তাহলে তো পার্টির মাঝে ডিস্টার্ব করলাম।“

-“আরে না না। শেষ হয়ে গেছে তা বল আজকের দিনটা কেমন গেল!!?”

-“ভালই। তোমার!!?”

-“ওই মোটামুটি।“

-“আচ্ছা ড্রিঙ্কসটা কি রোজই কর নাকি!!?”

-“না ঠিক রোজ নয় তবে মাঝে মাঝেই হয়ে যায়। ব্যাচেলার লাইফে ওই একটাইতো এঞ্জয়মেন্ট।“

পুবের জানলায় আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে দেবারতি তার চোখের চাহুনিতে কীসের যেন একটা তীব্র বাসনা রয়েছে। আমিও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছি। চারিদিকে নিস্তব্ধতা দুজনের মাঝে কোন কথা নেই কেবল দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি আচমকা পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে বললাম “কিছু কি বলবে নাকি!!?”

-“না মানে কালকে ফ্রি আছো সন্ধ্যের দিকে একটা সিনেমায় যাব ভাবছিলাম।“

-“ডেটে ডাকছ!!?”

-“এই মোটেও ডেট নয়। জাস্ট একটা ফিল্মের ইনভিটেশন দিলাম। আসতে না চাইলে না বলে দাও।“

-“তোমার মতো সঙ্গীর সাথে ফিল্মে যাওয়ার সুযোগ কেউ ছাড়ে। তবে একটা শর্ত আছে।“

-“কি শর্ত!!?”

-“টিকিটের দামটা কিন্তু আমি দেব।“

-“এই না না আমি ইনভাইট করলাম আর টিকিটের দাম দেবে তুমি তা হবে না।“

-“তাহলে কিন্তু আমি যাব না।“

-“আচ্ছা তাহলে অন্য একদিন তুমি আমাকে ফিল্ম দেখিয়ে দিও তাহলেই হল। কালকের দিনটা আমার থাক প্লিজ।“

আমি আর আপত্তি করতে পারলাম না।

-“তাহলে কালকে সন্ধ্যে সাতটায় দেখা হচ্ছে। গুড নাইট।“

-“গুড নাইট।“

আমি ফোনটা রেখে ঘরে ঢুকে দেখি দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। অভিক বলল “তিনদিনের আলাপে সোজা সিনেমা বাবা প্রেম যে ঝড়ের গতিতে এগোচ্ছে।“

হিমাংশু বলল “আরে ধুর ধুর ওইসব ঝড়-টর নয় এটা হল রকেটের গতিবেগ।“

-“তোরা আবার বাজে বকতে শুরু করলি।“

অভিক বলল “সেই সেই আজকাল আমরা বাজে বকি আর আমাদের মদের আসর ছেড়ে তুই প্রেম করছিস তার বেলা দোষ নেই।“

হিমাংশু বলল “ ছাড় ছাড় ভাই প্রথম প্রথম এইরকম হয়।“

-“তোরা আমার পিছনে না লেগে রাতের ডিনারটা কি হবে সেই নিয়ে ভাব।“

হিমাংশু বলল “এই যা রান্না কিছুই করা হয়নি। আজকে রাতটা ম্যাগি খেয়ে কাটিয়ে দি চল।“

অভিক আমার দিকে তাকিয়ে বলল “তাহলে সেটা তুই বানাবি।“

-“এই আমি কেন!!?”

দুজনে একসাথে চেঁচিয়ে বলল “আজকের এটাই তোমার শাস্তি। বন্ধু ছেড়ে প্রেমিকা সাথে খুনসুটি ভালো নয়।“  

                                                           ৫

সেইদিন কথা মতো আমি সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আধা ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে কিন্তু তার দেখা নেই।অফিস থেকে বেরানোর সময় আমার সাথে কথা হয়েছিল এতক্ষণ সময় লাগার কথা নয়। আমি বার বার ফোন করছি কিন্তু ফোনটা ওর সুইচ অফ বলছে। ওর কোনো বন্ধু কিংবা অফিস কলিগের সাথে আমার পরিচয় নেই। তাই অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। একটা ফুলের বুকে কিনেছি দেবারতিকে দেব বলে। বার বার সেই বুকের দিকে আর সামনের রাস্তায় গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছি। অনেক ওলা ,ট্যাক্সি এসে গেটের সামনে দাঁড়াচ্ছে কিন্তু দেবারতির কোনো পাত্তা নেই। আবার ফোনটা বার করে ওর নম্বরটা ডায়াল করলাম সেই একই সুইচ অফ। ঘণ্টাদুয়েক অপেক্ষার পড়ে আমি ফুলের বুকেটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে বাড়ি ফিরে এলাম। আমি বাড়িতে গম্ভীর মুখে ফিরেছি দেখে অভিক বলল “কিরে কিছু হয়েছে নাকি!!?”

-“না আসলে দেবারতি আজকে আসেনি। ফোনটা সুইচ অফ।“

-“মানে!!? এই যে তখন বললি অফিস থেকে বেরিয়ে তোকে ফোন করেছিল।“

-“হ্যাঁ করেছিল তো কিন্তু তারপর আর এলো না কেন কে জানে!!?”

-“ওর অফিসে একবার খোঁজ করে দেখতে পারতিস।“

-“পার্কস্ট্রিটে কোথায় অফিস সেটা জানি না।“

-“তিনদিন ধরে কথা বলছিস বেসিক ইনফরমেশনটা রাখিস না কেন!!?”

-“আরে তিনদিনের আলাপে আর কত ইনফরমেশন পাওয়া যায় বলতো……।“

আমি অন্ধকার জানলাটার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বার করে  আবার ওর নম্বরটা ডায়াল করলাম। ফোনটা এখনো সুইচ অফ। আমার রাগটা এবার দুশ্চিন্তার রুপ ধারন করছে। আমার মুখের ভাবটা দেখে হিমাংশু বলল “একটু শান্ত থাকার চেষ্টা কর। নিশ্চই কিছু হয়েছে নাহলে এইভাবে……………।“

-“নিজেই ইনভাইট করে আসল না। এখন ফোনটাও তুলছে না আমার কেমন জানি টেনশন হচ্ছে।“

অভিক বলল “আচ্ছা চল একবার ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে একটু খোঁজখবর করে দেখি।“

তিনজনে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তা ধরে এগিয়ে সামনের গলিটা ধরে শর্টকাটে দেবারতির ফ্ল্যাটের নীচে পৌঁছলাম। ওয়াচম্যান আমাদের দেখে এগিয়ে আসতেই অভিক বলল “দেবারতি ম্যাডাম বাড়ি ফিরেছেন!!?”

ওয়াচম্যান নেপালি তাই হিন্দিতে বলল “কউন দেবারতি ম্যাডাম সাব!!?”

আমি বললাম “আরে ওই থার্ড ফ্লোরের পিছনের কামরায় নুতন ভাড়া এসেছেন।“

-“ও নুতন ম্যাডাম সাবজি। উ তো সুভা নিকলা থা আভিতক  ঘর বাওপাস নেহি আয়া।“

-“আচ্ছা ফিরলে বলবে অনির্বাণ বাবু এসেছিল।“

-“জি সাব।“

আমার রাতে ঘুম হল না। বার বার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছি আর পুবের জানলার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। কিন্তু আজ গভীর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি। মনের অন্দরে অনেক অজানা আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে কিন্তু বার বার মনটাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমার মনের অবস্থা খারাপ দেখে হিমাংশু আর অভিক পালা করে আমার সাথে জেগে রয়েছে। কিন্তু আশা আশঙ্কার মাঝে কখন যে বারন্দায় চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমার খেয়াল নেই। ভোরের দিকে পাখির ডাক শুনেছিলাম তারপর শরীরটা আর মনের সাথে পেরে ওঠেনি তাই নিজের অজান্তেই চোখটা লেগে গেছিল। চোখ খুলেই দেখি অভিক আর হিমাংশু কফির কাপ হাতে নিয়ে বসে রয়েছে।

আমার দিকে ফিরে হিমাংশু বলল “সকালে খোঁজ করেছি দেবারতি কালকে রাতে বাড়ি ফেরেনি।“

-“সে তো জানি নাহলে রাতের বেলা একবার হলেও ঘরে আলো জ্বলতে দেখতাম।“

অভিকের মুখটা বেশ ম্লান দেখে আমি বললাম “ওই কি হয়েছে!!?”

অভিক বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “আরে কিছু না। সকালে খবরের কাগজে একটা এক্সিডেন্টের খবর পড়লাম। পার্কস্ট্রিটের কাছাকাছি একটা ওলাতে একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়েছে। একটি মহিলা এবং ড্রাইভার স্পট ডেড। ড্রাইভারের পরিচয় জানা গেলেও মহিলার জানা যাইনি।“

কথাগুলো শুনে বুকের ভিতরটা আমার কেমন যেন ছ্যাদ করে উঠল। মনে মনে নিজেকে অনেক সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই মনটা আমার শান্ত হচ্ছে না। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে মনে মনে পুলিশ ষ্টেশনে যাব ঠিক করেছি এমন সময় দরজায় বেলটা বেজে উঠল। দরজাটা অভিক খুলতেই আগুন্তুকের মুখে শুনতে পেলাম “আমি ভিতরে আসতে পারি!!?” আমার চেনা গলার আওয়াজ শুনে আমি পাশের ঘর থেকে সেইদিকে এসে দেখলাম  দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেবারতি। আমি ছুটে গিয়ে নিজের অজান্তেই তাকে আলিঙ্গন করে বসলাম।

-“কালকে কোথায় ছিলে তুমি সারারাত!!? ফোনটা সুইচ অফ আসছে বার বার আমি কত টেনশনে ছিলাম যান তুমি।“

-“সরি আসলে আমি তোমাকে ফোনটা করার পড়ে আমার ফোনের ব্যাটারি ডেড হয়ে যায়। আমার এক অফিস কলিগের কালকে বাবা হঠ্যাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আমরা একসাথেই ছিলাম ওলাতে তাই তখন ওর সাথে চলে যাই তারপর হসপিটালেই কালকে সারারাত কেটেছে। আসলে তোমার নম্বরটা আমার মুখস্থ ছিল না তাই ফোনটা করতে পারিনি।“

আমার প্রানে যেন প্রান ফিরে এসেছে। আমি এবার নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম “আচ্ছা এখন কেমন আছেন তিনি!!?”

-“এখন স্টেবেল আছেন। আমি তাহলে এখন যাই। পড়ে দেখা হবে।“

অভিক বলল “কাল থেকে অনেক ধকল গেছে খাওয়াদাওয়া কিছু করেননি বলেই মনে হচ্ছে আমাদের বাড়িতে প্রথম এলেন ব্রেকফাস্টটা অন্তত সেরে যান।“

-“আরে না না। আমি এখনো বাড়ি ঢুকিনি। ওয়াচম্যানের কাছে তোমাদের খবর শুনে আগেই এখানে এলাম।“

আমাদের তিনজনের পিড়াপিড়িতে  দুপুরের লাঞ্চটা আমাদের একইসাথে করতে দেবারতি রাজি হল। যাওয়ার সময় ব্যাগ থেকে একটা কাকাবাবু সমগ্র আমাকে দিয়ে বলল “পড়ে দেখ ভেবেছিলাম কালকে দেব কিন্তু তারপর যা হল।“ আমি হাসিমুখে সেটা হাতে নিয়ে দরজা অব্ধি ওকে এগিয়ে দিলাম। সে চলে গেলে পড়ে হিমাংশু বলল “যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কালকে রাতে আমাদেরও কম ধকল যায়নি।“

অভিক বলল “তা ভাই বৌদিকে তো একদম অপ্সরীর মতো দেখতে। তোর কপাল খুলে গেল।“

আমি বললাম “ধুর প্রেম হোল না এখনো আর তোরা বৌদি বৌদি করে চেঁচাচ্ছিস।“

হিমাংশু বলল “শালা কাল রাত থেকে দেখছি চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠছিস। আজকে দেখতে পেয়েই যেভাবে জড়িয়ে ধরলি তাতেই বোঝা যাই তুই কতটা ভালোবেসে ফেলেছিস ওকে।“

আমি খানিক চুপ করে থেকে বললাম “আরে না একটা মানুষ আসবে বলে এলো না , ফোন তুলছে না , সারারাত বাড়ি ফেরেনি চিন্তা হয় না।“

অভিক বলল “হ্যাঁ তা হয় কিন্তু এই চিন্তা যে শুধুই চিন্তার গণ্ডিতে আটকে আছে আমার তেমনটা মনে হয় না।“

আমি কোন কথা না বলে ফ্রেস হওয়ার জন্য চলে গেলাম। দুপুরে আমরা চারজনে একটা রেস্তরায় গেলাম। সেখানে খাওয়ার সাথে সাথে বেশ আড্ডা জমে উঠল। অভিক এবং হিমাংশুর সাথে দেবারতির আলাপ করিয়ে দিতেই তিনজনে মিলে গল্পের আসরটা জমিয়ে তুলল।

-“আমরা তিনজনেই প্রায় এক বয়েসি তাই অনির্বাণের মতো তোমাদের দুজনকেও আমি তুমিই বলছি।“

অভিক বলল “আমারও মনে হয় তুমি তা বেশি প্রেফারেবেল।“

-“তোমরা দুজনে কোথায় চাকরী কর!!?”

আমি বললাম “অভিক ধর্মতলায় ফুড ডিপার্টমেন্ট আর হিমাংশু সেন্ট্রাল এভিনিউতে একটা প্রায়ভেট ফার্মে চাকরি করে।“

-“আচ্ছা বেশ ভালো। আমি কলকাতায় এসেছি কিছুদিন হল কিন্তু তার আগে আমাদের জামসেদপুরে  চাকরী করতাম।“

অভিক প্রশ্ন করল “তা ওখান থেকে কলকাতা এলে কেন!!?”

-“না আমার এক বন্ধু নিজের কোম্পানি খুলেছে তাই ভাবলাম এখানেই জয়েন করি।বন্ধুর কোম্পানি তাছাড়া বাড়ি থেকে বাইরে থাকলে একটু বেশি ফ্রিডম পাওয়া যায় তাই আরকি।“

-“ওহ আচ্ছা। তা তুমি কি একাই নাকি কোনো দিদি বা বোন আছে!!?” প্রশ্নটা করল হিমাংশু।

-“আছে। কিন্তু কেন বলুন তো!!?”

-“না মানে ওই আরকি এমনই জিজ্ঞেস করলাম।“

-“দিদি আছে। দিদির বিয়ে হয়েছে তিন বছর এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকে।“  

অভিক বলল “বাঃ বেশ ভালো ব্যাপার। আমারও বিয়ের পড়ে ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করার ইচ্ছা আছে।“

-‘কবে তোমার বিয়ে!!?”

-“ওই সামনের বছরে জানুয়ারিতে। তোমাকেও আসতে হবে কিন্তু।“

-“আসব আসব কিন্তু ততদিনে যে আমার একজন সঙ্গী থাকবে তাকেও ইনভাইট করতে হবে কিন্তু!!”

আমি হতচকিত হয়ে দেবারতির দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে বলল “তোমাকে বলা হয়নি নভেম্বরে আমার বিয়ে।আমাদের সেই কলেজ থেকে প্রেম আগের বছরই বিয়েটা হয়ে যেত কিন্তু ওর বাবা মানে আমার হবু শ্বশুর মশাই স্ট্রোকে মারা গেলেন।“

কথাটা শুনে আমার মনটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে হিমাংশু বলল “তা কি করে তোমার হবু বর!!?”

-“ইঞ্জিনিয়ার। আমার কলেজের সিনিয়র ছিল আমি ম্যানেজমেন্ট পরছি আর ও তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার।“

আমি আচমকা নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে বলে বসলাম “আমাকে আগে বলনি কেন!!?”

-“এইতো কদিন আমাদের আলাপ হল আর আগে বলিনি এখন বললাম তাতে কি আছে।“

আমি আর কোন উত্তর দিলাম না। হিমাংশু আর অভিক ব্যাপারটাকে অন্য আলোচনার দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে তখনকার মত ব্যাপারটা ম্যানেজ করে দিল। দেবারতি ওর অফিস কলিগের বাবাকে দেখতে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সে চলে যেতে আমার মনের হালটা বুঝতে পেরে ওরা দুজনে আমাকে রক ক্লাবে নিয়ে এলো।  

                                                          ৬

বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে হিমাংশু বলল “দেখ তিনদিনের আলাপে ভালো লেগেছিল আমি বুঝেছি কিন্তু কি আর করা যাবে তোর আর আমার পোড়া কপাল।“

অভিক বলল “দেখ ভাই তুই তো ওকে জাস্ট পছন্দ করতিস ভালো তো বাসিস নি তাছাড়া এতো আল্পদিনের আলাপে সত্যিটা বেরিয়ে গেছে একদিক থেকে ভালই হয়েছে।“

আমি তখনও চুপ করে বসে আছি। বিয়ারের গ্লাসে বার তিনেক চুমুক দিয়ে বললাম “চল বাইরে চল সিগারেট খেয়ে আসি।“

আমরা বিল মিটিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছে। একটা শেডের নীচে দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিনজন। আমি সিগারেটের লম্বা একটা ধোঁয়া ছেড়ে বললাম “তোরা বলেছিলি না ভালোবাসা নাকি এক পলকে হয় আমি সেদিন মানতে চাইনি। সত্যি বলছি ভাই সেদিন রাতের বেলা ওই পুবের জানলায় ওকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।“

আমার মুখের দিকে দুজনে তাকিয়ে রয়েছে। আমি আবার একটা টান দিয়ে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বললাম “সেদিন বুঝিনি আজ বুঝলাম। শালা আজ বুঝলাম অমিতের দুঃখটা।“

হিমাংশু বলল “এই শালা অমিতটা আবার কে!!?”  

-“শেষের কবিতা” পড়েছিস শালা জানোয়ার কোনোদিন!!?  বাংলা সাহিত্য পরেনা শালা ইংরেজের অবৈধ সন্তান।“

আমার কথাগুলো শুনে হিমাংশু নিজেই হেসে ফেলল।

-“জানিস রবি ঠাকুরকে ইংরেজরাও মেনেছিল। শালা এই তোদের মতো বাঙ্গালিগুলো হল শালা ওই ফসলের কিটের মতো।“

-“এই তোর চরে গেছে অনি এবার থাম রাস্তায় সিন ক্রিয়েট করিস না।“

-“আমি সিন ক্রিয়েট করছি আর ও যে আজকে সিনটা শেষ করে দিল তার বেলা!!”

অভিক বলল “অনি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর। মেয়েটি তোকে ভালোবাসি বলে কোনো চিট কিন্তু করেনি।“

-“বুঝেছি বুঝেছি এখন আমাকে এইসব বলছিস আগে কি বলেছিলি!! বৌদি বৌদি করে শালা আমারও বৌদি বানিয়ে দিলি।“

হিমাংশু বলল “এবার তুই একটু বেশি ওভার রিয়াক্ট করছিস অনি। আমার কথা ভাব চার বছরে দুটো গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে চলে গেছে তোর তো তাও ভাল শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেছে।“

-“তুই হলি আমার ভাই ওই তখন বললি না আমাদের সত্যি পোড়া কপাল। অভিক তুই শালা ভালো আছিস।“

অভিক একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলল “সেই উপরেই ভালো আছি।“

-“শালা ভালো আছিস সেটাকে একসেপ্ট করতে শেখ। আমাদের কি তোর উপর জ্বলন হচ্ছে ভাবছিস!! শালা তুই খুশি থাকলে আমরাও খুশি। রে তুই হলি ভাই আমাদের বুঝলি।“

অভিক বলল “আরে না রে। আমার বিয়ের জন্য বাড়ির জমিটা বন্ধক দিয়েছে বাবা এখনো বোনের বিয়েটা বাকি তাই মাঝে মাঝে ভাবি বিয়েটা করে আমি নিজের জীবনটা গোড়ে নিয়ে কি আমার বোনের জীবনটা অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছি!!”

-“কেন আমরা কি শালা মরে গেছি। তোর বোনের বিয়ে আমরা দেব। তোর বোন কি আমাদের বোন নয়!!“

অভিক আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

-“এই দ্যাখ সেন্টি করছে রে শালা। ভাই ভুলটা আমার আমিই বেশি ভেবে ফেলেছিলাম।“  

অভিক বলল “ না রে অনি ভুলটা আমাদের সবার। আমরাই বেশি ভেবে ফেলেছিলাম।“

হিমাংশু বলল “দেবারতি তোর সাথে ভালো বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল আমরাই তোকে বার বার বলে প্রেমের দিকে ঠেলে দিলাম।“

-“রে তোরা আমার মনের অবস্থাটা জেনে এটা করেছিস। ভুল তো আমার আমি নিজে মিশেছি নিজে যদি বুঝতে না পারি সেই মুর্খামির ফল আমাকেই ভোগ করতে হবে।“

 আমরা তিনজনে একসাথে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর ফাঁকা রাস্তা ধরে তিনজনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চললাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তা ফাঁকা অচেনা কুকুরের দল ছাড়া চারিদিকে কেউ নেই। দূরে একটা রিক্সায় গান বাজছে।  আপন মনে সেই গানের সাথে তাল  মিলিয়ে গান গাইতে গাইতে আমরা চলেছি এমন সময় হোঁচট খেয়ে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। তারপর সবই অন্ধকার। কেবল দূরের রিক্সাটা আমাদের কাছাকছি এসে থেমেছিল সেটা গানের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে টের পেয়েছিলাম বাকি কিছুই আমার মনে নেই।

সকালে চোখ খুলে দেখলাম হিমাংশু আর অভিক কফির কাপ হাতে আমার বিছানার সামনে বসে রয়েছে। আমি উঠে বসে বললাম “কালকে রাতে বেশি চরে গেছিল রে সরি বেশি ডিস্টাব করিনি তো!!?”

হিমাংশু হাসতে হাসতে বলল “বল কালকে রাতে নয় পরশু রাতে।“

আমি হতভম্বের মতো তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম “মানে!!?”

অভিক বলল “শালা পরশু আমাদের সাথে বং খেয়ে সেই যে আউট হলি দুদিন পড়ে আজকে উঠেছিস।“

হিমাংশু বলল “কালকে ডাক্তার ডেকে এনেছিলাম উনি বললেন ভয়ের কিছু নেই। তখন একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।“

আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। মনের কোণে অনেক অনেক প্রশ্ন জমে উঠছে। আমি গাঁজা!! দুদিন ঘুম!! দেবারতি!! পার্কস্ট্রিট!! পুবের জানলা!! মাথায় তখন আমার যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। এক একটা প্রশ্ন বজ্রপাতের সমান মনে হচ্ছে। আমার অসস্তির ভাবটা লক্ষ্য করে অভিক বলল “অনি কি হয়েছে!!? শরীর এখনো খারাপ লাগছে!!?”

আমি তারতারি উঠে গিয়ে বারান্দায় ছুটে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি পুবের জানলায় কোন পর্দা নেই যেমন আগে থাকতো তেমনি রয়েছে।  

অভিক বলল “কি হয়েছে আমাদের বলবি প্লিজ!!?”

আমি মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে গল্পটা বলতে লাগলাম  “ওই ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে এসেছিল আমার সাথে আলাপ হল…………………।“

অভিক আর হিমাংশু আমার দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগল গল্পটা তারপর হাসতে হাসতে বলল “শালা হ্যালুসিনেশনে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলি। ওই ফ্ল্যাটটা ফাঁকা ছিল এখনো আছে। আমাদের দুজনের কথা বিশ্বাস না হলে নিজে গিয়ে দেখে নে।“

-“তাহলে আমার চাকরীর ব্যাপারটা মেল ওটা কিন্তু সত্ত্যি পেয়েছি।“

হিমাংশু বলল “তোর চাকরীর মেলের কথাটা আমাদের সেদিন রাতেই তুই বলেছিলি। কাল দেখা করার কথা ছিল তোর । জয়েন্তদাকে বলে ওটা ম্যানেজ করিয়ে রেখেছি কাল গিয়ে দেখা করে নিস।“

অভিক বলল “এই জন্য সেদিন বলেছিলাম বং খাব না। তা না নিজেই কোথা থেকে জোগাড় করে আনলি। বললি আর্টিকেল লিখতে নাকি আইডিয়া আসে , নে একেবারে গোটা একটা গল্পের প্লট চলে এলো এবার লিখে ফ্যাল।“  

আমি তখনো ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলাম না। ফোনের কল লিস্টে বিগত তিন দিনে কোন ফোন আসেনি কিংবা যায়নি , এমনকি দেবারতির কোন নম্বরও আমার ফোনে নেই।  কিন্তু সব প্রমান হাতের সামনে দেখে আমাকে ব্যাপারটা হ্যালুসিনেসন বলেই মেনে নিতে হল।

হিমাংশু বলল “দেখ গ্যাঁজার নেশায় ওইরকম একটু হয়। আজকের দিনটা রেস্ট নে সব ঠিক হয়ে যাবে।“

আমি হঠ্যাৎ আমার স্টাডি টেবিলের উপর একটা বই দেখতে পেয়ে সেইদিকে ছুটে গিয়ে দেখলাম দেবারতির দেওয়া কাকাবাবু সমগ্র আমার ল্যাপটপের পাশে রাখা রয়েছে। আমাদের তিনজনের মুখে তখন বিস্ময় দূর থেকে কানে ভেসে এলো দেবারতির গলার স্বর “কি ফেলু মিত্তিরকে কেমন টেক্কা দিলাম!!?“   

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post চক্রব্যূহ| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | অমিত দত্ত| Bengali Story for Matured
Next post সাইকো এবং সাইকো| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | আশিস চক্রবর্তী| Bengali Story for Matured