মোহর গড়ের বিভীষিকা| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Stories for Matured
0 (0)

প্রবীর শিক্ষক পদে সদ্য চাকরি পেয়েছে বাঁকুড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। স্থানটির নাম মোহরগড়। মা শুনে বললেন “সারাজীবন কলকাতায় কাটিয়ে ওরকম একটা জায়গায় গিয়ে থাকতে পারবি? তাও আবার আমাদের ছেড়ে?” প্রবীর মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে “কি করবো বলো এখানে থেকে যাতায়াত করা তো সম্ভব নয়। অগত্যা, তুমি চিন্তা করোনা হেড স্যার এর সাথে কথা হয়েছে। তিনি আমার জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে রাখবেন বলেছেন। স্ত্রী ও ছেলে কেও রেখে যেতে হচ্ছে নেহাতই গ্রামাঞ্চল সেখানে শিশুপুত্রকে নিয়ে যাওয়া উচিত হবেনা। আমায় নিয়ে ভেবোনা আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। তোমাদের নিয়েই চিন্তা, কিভাবে যে তোমরা থাকবে?” নিমরাজি হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের মঙ্গলের কথা ভেবে পিতামাতা মত দিতে বাধ্যই হলেন একপ্রকার । পরদিন সকালে রওনা হলো সে। স্ত্রী ,মা বাবা সবাই ভীষণ কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু সে নিরুপায় এই বাজারে চাকরি পাওয়া খুবই মুশকিল। তাই তাকে জয়েন করতেই হবে।

সকাল ৬.৪৫ এ ট্রেন, জানলার ধারেই জায়গা পেয়েছে সে। ঠান্ডা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে, বেশ মনোরম পরিবেশে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে কখন সে যেন ঘুমিয়ে পড়ে।  রাতে ঘুম হয়নি তার চিন্তায়। আচমকা ঘুমটা ভেঙে যায় ট্রেন থামার শব্দে। “দাদা এটা কি মোহরগড় স্টেশন” ধড়মড়  করে উঠে প্রশ্ন করে সে? এক সহযাত্রী বলে “না ,এটা তো বানপুর পরের স্টেশন মোহরগড় ।“ নিশ্চিন্ত হয় প্রবীর। নামার প্রস্তুতি নেয় সে। অনেক জিনিস নিয়ে আসতে হয়েছে, মা সব গুছিয়ে পাঠিয়েছে।

সূর্য্য তখন মধ্যগগনে। নেমে দেখে স্টেশনটা বেশ ছোট, তবে গোছানো ও ছিমছাম। দূরে ছোট ছোট টিলার মত পাহাড়। চারিদিকে বিভিন্ন পাখির কলতান। শহরে এসব শোনাই যায়না। ছোট্ট গ্রাম এই মোহরগড়I দিনে মোট ৪টি মতো ট্রেন আসে এখানে। বাইরে এসে দেখে অটো বা রিকশা কিছুই নেই। অগত্যা ভ্যান রিকশা ভরসা।

একটা ভ্যানে উঠে সে বললো “মোহরগড় উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে চলো।”

“আপনি নতুন মাস্টারবাবু বুঝি ওই স্কুলের?” চালক হঠাৎ জিগ্যেস করে।

“হ্যাঁ ঠিক এ বলেছো কিন্তু তুমি কি করে জানলে?”

“ট্রেন থেকে নেমেই ইস্কুলে যাবে বললেন আর এত মালপত্র এনেছেন তাই …. “

“ঠিক আছে তাড়াতাড়ি চলো।“

যাত্রাপথের ধকলে ক্লান্ত বোধ করছিলো সে। যথাসময়ে সে স্কুলে পৌঁছল। প্রাথমিক পরিচয় মিটে গেলে হেডস্যার বললেন 

“প্রবীর আজ রাতটা আমার বাড়িতেই কাটিয়ে নাও, এখানে তো হোটেল পাবেনা। কাল আমি তোমায় থাকার ব্যবস্থা করে দেব । একজনই সাথে কথাও বলা আছে চিন্তা করোনা। তুমি ওখানেই থাকতে পারো।“

প্রবীর ভাবলো স্কুলটা ভাল করে ঘুরে একটু দেখে নিই। টিফিন টাইম চলছে হই-হুল্লোড়, খেলা, খাওয়া এসবের মজাই আলাদা। ছাত্র জীবনে বোধ হয় এই সময়টাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য। নিজের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে যায় তার। কিন্তু সবাই যেন তাকে ঘুরে ঘুরে বারবার দেখছে। কি ব্যাপার ঠিক বোধগম্য হচ্ছেনা। হয়তো এই অঞ্চলের লোক নয় বলে শহরের লোক ভেবে দেখছে। যদিও তার ভারি অস্বস্তি হয়। সেই যে তাদের নতুন ইতিহাস শিক্ষক তারা কি বুঝতে পেরেছে? অবাক হয় সে। টিফিনের ঘন্টা বাজতে যে যার ক্লাস এ ফিরে যায়। স্কুলটা পুরোনো আমলের তিনতলা বিল্ডিং। অনেক জায়গায় চুন পলেস্তারা খসে পড়ছে রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে। ঘুপচি ঘুপছি ঘর গুলো, গ্রামের স্কুল যেমন হয়I একদিকে বিরাট একটা খেলার মাঠ। পেছনের দিকে একটি বড় পুকুর আছে ভারী সুন্দর দৃশ্য দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। অবাক হয়ে এসব প্রত্যক্ষ করছিল সে। তার শহুরে জীবনে এসব বিশেষ দেখা যায় না। হেডস্যার সোমনাথবাবুর কথায় ঘোর কাটে তার।

“প্রবীর এবার চলো আমরা বাড়ি চলে যাই, ভ্যান বলাই আছে তুমি যা এনেছ তা গুছিয়ে নাও I” ভ্যানে  চড়ে তারা হেডস্যার সোমনাথবাবুর বাড়ির দিকে রওনা হলো।

সোমনাথবাবু ও তার স্ত্রী একাই থাকেন তাদের কোনো সন্তান নেই। তাই প্রবীরের সেরকম কোনো অসুবিধা হলোনা। নির্বিঘ্নে তার রাত কেটে যায়। স্যার এর স্ত্রী তাকে খুব আদর যত্ন করলেন। পরদিন সকালে সোমনাথবাবু বললেন “চলো তোমায় বাড়ি তা দেখিয়ে দি।“

বাড়ির মালিকের নাম বিলাসবাবু। হেডস্যার জানান ওনার সাথে আগেই কথা গেছে।

“উনি তোমায় বাড়ি ভাড়া দিতে চান। আগের যে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন উনিও ওখানেই থাকতেন।  বিশেষ কারণে হঠাৎ ওনাকে চলে যেতে হয়। তারপরেই তোমাকে তার জায়গায় বিকল্প হিসেবে আনা হয়েছে।”

“ওঃ আচ্ছা উনিও কি ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন? কোথায় ট্রান্সফার হলো ওনার?” হেড মাস্টার মশায় কোনো উত্তর দিলেন না ।। আম কাঁঠালের ঘন জঙ্গলের পথ দিয়ে হাটতে হাটতে অন্য প্রসঙ্গে চলে যান তিনি। বেশ কিছটা হেটে তবে বিলাস বাবুর বাড়ি।

“আসলে কি জানো।” খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন সোমনাথবাবু, “ওই শিক্ষক হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কাউকে কিছু না বলেই। চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করা যায়নি। “সে কি ? অদ্ভুত ব্যাপার তো , আপনারা খোঁজ করেননি? “প্রবীর আশ্চর্য হয়ে যায়।”করেছিলাম তার সন্ধ্যান পাওয়া সম্ভব হয়নি।।এস,

এই যে পৌঁছে গিয়েছি।”

বেশ বড় জমিদার আমলের বাড়ি  এককালে প্রবল প্রতিপত্তি শালী  জমিদার ছিলেন দেখেই বোঝা যায়।তবে রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে ভেঙে পড়েছে। চেয়ে চেয়ে দ্যাখে প্রবীর। একপাশে বিলাসবাবু তার পরিবারের সাথে থাকেন আর বাইরের বাগানের অন্যপাশে একটি দুকামরার ঘর রয়েছে যেটি ভাড়া দেওয়া হয়। ইহার অবস্থাও তথৈবচ। ছাদ থেকে বট অশ্বত্থ এর চারা বেরিয়েছে। তবে  সোমমনাথবাবু আগেই বলেছেন গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ বাড়ি খড়ের ছাওয়া বা টালির চাল তাই এর চেয়ে ভালো বাড়ি পাওয়া সত্যিই মুশকিল। বর্ষাকালে অসুবিধা হবে।

বাড়ির মালিক বিলাসবাবু তাকে  জিজ্ঞেস করলেন বাড়িতে কে কে আছেন, সে বিবাহিত কিনা এসব খুঁটিনাটি। বাড়ির সমস্যা গুলি উনি আগেই বলে দিলেন তারপর জিগ্যেস করলেন প্রবীর কি এখানেই থাকতে চায় ?  ইচ্ছা না থাকলেও প্রবীর কে মেনে নিতে হলো অগত্যা। বাড়িতে ঢোকার মূল ফটক একটাই। বাড়িওলার দিকে অবশ্য একটা আলাদা দরজা আছে  ।ওনারা অন্য পাশে থাকেন তাই কোনো অসুবিধা হবেনা মনে হয়। নিরিবিলিতে থাকা যাবে, এসব ভেবে প্রবীর রাজি হয়ে গেল। বিদেশ বিভূঁই জায়গায় বেশি খুতখুতানি না করাই ভালো।।

হেডস্যার বললেন “আজ আর তোমায় স্কুলে  আসতে হবেনা, তুমি সব গুছিয়ে নাও I মোড়ের গলিতে দোকান আছে কিছু দরকার হলে বিকালে নিয়ে এসো। তবে আজ রান্না কোরোনা আমি খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।“ বলে হেডসার বিদায় নিলেন। প্রবীর ও বিলাস বাবুর থেকে চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ঘরের ভেতর তা বেশ স্যাঁতস্যাঁতে, আলো কম আসে। বড় বড় গরাদ দেওয়া দুটি জানলা রয়েছে। তবে প্রচুর গাছগাছালি থাকায় হওয়া আসছে প্রচুর। একটা পুরোনো আমলের ফ্যান, হলুদ বাল্ব দেওয়া। একটা পুরোনো পালঙ্ক, আলমারি ও সাথে একটা গ্রামোফোন রেকর্ডও রয়েছে । প্রবীর সুটকেস খুলে মোটামুটি সব গুছিয়ে নিল। মা বাবাকে ফোন করে বিস্তারিত জানালো সে। তারা তো ভেবেই, অস্থির সে একা কিভাবে থাকবে ভেবে। হেডমাস্টার ও বিলাসবাবুর আত্মীয়তার কথা জেনে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হলেন তারা। স্যর এর বাড়ি থেকে দুপুরে খাবার এসেছিল খেয়ে সে ভাৱল একটু জিরিয়ে নিই।

নিঝুম অলস দুপুর, দূরে কোথাও ঘুঘু পাখি ডাকছে, কোথাও নাম না জানা অচেনা ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছে। অজান্তে প্রবীরের চোখে ঘুম নেমে আসে ক্লান্তিতে।

কোথাও শঙ্খ ও কাঁসর ধ্বনির শব্দে ঘুম ভাঙে তার। বাড়ির পেছনের দিকে একটি জরাজীর্ণ মন্দির রয়েছে সেখানেই আরতি হচ্ছে মনে হয়। বড় মনরম পরিবেশ। সন্ধ্যে হতেই চারপাশ আরো সুনসান হয়ে গেল। প্রবীর তৈরি হয়ে নিয়ে বেরোলো সামনের মোড়ের মুদির দোকানের উদ্দেশে। কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য। ছোট্ট একটা মাটির বাড়ি মাথায় টালির চাল, ভেতরে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন।

“আপনি বুঝি বিলাস বাবুর বাড়ি নতুন ভাড়া এসেছেন? সকালে আপনাকে দেখলাম হেডস্যার এর সাথে।“

“হ্যাঁ আজই এলাম, আমি এখানে হাইস্কুলের নতুন শিক্ষক।“

“তা আপনি আর বাড়ি পেলেন না? না গরিবের টালির বাড়ি আপনার চলবে না ?”

“না সেরকম কিছুনা, আসলে হেডস্যার এর চেনা তাই আর কি …আমি তো এখানে কিছুই চিনি না উনি যা বললেন তাই। কেন বলুন তো কিছু অসুবিধা আছে কি ?”

“না না এমনিই জিগেস করছি আসলে ওদিক তা একদম নিরিবিলি তো ….. মানে গ্রামের শেষ প্রান্ত বলতে পারেন। তাই আর কি …..“

ভদ্রলোক কিছু একটা বলে গিয়ে যেন চেপে গেলেনI দোকানদার কি নিজের ঘর ভাড়া দিতে চাইছিলেন নাকি? প্রবীর আর কথা না বাড়িয়ে জিনিষ পত্র নিয়ে পা বাড়ালো। রাতে বাড়িতে কথা বলে নিয়ে ঘুমোতে গেল। পরদিন সকালে প্রথম ক্লাস, তাই বেশ উত্তেজনা নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালেও উঠে রেডি হয়ে সোজা স্কুল চলে গেল । যাবার আগে নিজেই সেদ্ধ ভাত বানিয়ে নিয়েছিল। মা ভাগ্য ভালো সব গুছিয়ে পাঠিয়ে ছিল নাহলে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে সমস্যায় পড়তে হত।

প্রবীর স্কুলে নতুন ক্লাস করতে শুরু করলো। স্টুডেন্টরা ভালোই তবে কিছু যেন একটা খটকা লাগছে তার। সেটা যে ঠিক কি তা বুঝতে না পারলেও সবাই তাকে দেখে সবাই যেন কেমন একটা অদ্ভুত ব্যবহার করছে। কখনো মনে হচ্ছে নতুন স্যার আসতে তারা বেশ অবাক নাহলে বিরক্ত। কখনো মনে হচ্ছে তার থেকে সবাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছে। সহজভাবে মেলামেশা করছেনা এবং কিছু লুকোচ্ছে।

সে ভাবলো নতুন জায়গা সেও শহর থেকে নতুন এসেছে তাই হয়তো ওরা এমন করছে। দিন অতিক্রান্ত হতে থাকে আস্তে আস্তে সব কিছুর সাথে মানিয়ে নেয় সে।

সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটলেও সন্ধ্যে তা যেন আর কাটেনা। অখন্ড অবসর। রাস্তায় লোকজন প্রায় নেয় বললেই চলে I ওই মায়ের ও স্ত্রীয়ের সাথে ফোনে গল্প করে, কোনোদিন শখে রান্না বান্না, লেখালিখি করতে করতে সময় কাটাতে হয়। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে সে।

সেদিন বিকালে স্কুল থেকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিল প্রবীর I হঠাৎ ভীষণ গরম লেগে ঘুম থেকে উঠে দেখে কারেন্ট অফ, বাইরে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে I বাইরে বেরিয়ে দেখে প্রবল জোরে হাওয়া শুরু হয়েছে। কালবৈশাখী ঝড়। চারিদিকে প্রায় আঁধার হয়ে এসেছে। গাছপালাগুলি উথালপাথাল করছে। ঝড়ের তান্ডব দেখে তার বেশ ভয় করতে লাগলো, প্রাচীন জরাজীর্ণ বাড়ি ভেঙে না পড়ে! বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। প্রবল বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গর্জন শুরু হয়।

হঠাৎ সে খেয়াল করলো স্বল্প বসনা এক মহিলা তার বাড়ির পেছনে জঙ্গলের রাস্তা ধরে যেদিকে সেদিকে মন্দির আছে সেদিকে যাচ্ছে। পরনে শুধুমাত্র একটি সাদা শাড়ি। অস্পষ্ট অবয়ব দেখে অল্পবয়েসী মেয়ে বলেই মনে হলো প্রবীরের। মোড় ঘোরার সময়ে চোখাচখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল সেI  অচেনা নারীর দিকে এভাবে তাকানো তার ঠিক হয়নি। এমনিও বাড়ির মালিকের সাথে তার তেমন কোনো পরিচয় নেই। তবে মহিলাটি কে এবং এরকম ঝড়জলের মধ্যে একাকী সে  সন্ধ্যে বেলায় কিভাবে ও কি কারণে ভীষণ জঙ্গলের পথে যাচ্ছে তা ভেবে পেলোনা প্রবীর।  বাড়িতে কে আছেন সেও তার জানা নেই। মালিক সেভাবে তার সাথে মেশেন না। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া বিশেষ কথা বলেন না। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। মার ফোন, ধরতে ভিতরে যায় সে।

বেশ কিছুক্ষণ পর কথা বলে বেরিয়ে এসে দেখে ঝড় থেমে গেছে, হালকা বৃষ্টি হচ্ছে, প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। চারিদিকে অদ্ভুত একটা সোঁদা গন্ধ, দূরে জঙ্গলে ঝিঝি ডাকছেI গুমোট গরমের পরে ঠান্ডা মনোরম পরিবেশে মশগুল হয়ে যায় প্রবীর। ভাবলো একবার হেটে চারপাশটা ঘুরে আসলে ভালোই হয়। মৃদু মন্দ বাতাস বইছে।  বাদলা হাওয়াতে গা টা কেমন শিরশির করে উঠলো তার। পেছনের দিকটায় তেমন কেউ আসেনা I এই অংশে রয়েছে বিশাল বাগান, কি গাছ তাতে নেই? বাগানের একদম ঈশান কোণের দিকে একপ্রান্তে সেই ভাঙা মন্দির যেখানে, সেখানে সেই মহিলা মনে হয় সন্ধ্যা আরতি করতে আসে। তারই কাঁসর ও শঙ্খধ্বনি কানে আসে রোজ I এই ঝড় জলের সন্ধ্যে বেলা কে আর এইমুখো হবে?

মাঝে মাঝে এখনো আকাশ বক্ষ বিদীর্ণ করে বিদ্যুৎ এর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। প্রবীর ভাবলো মন্দিরে একটা প্রণাম করে আসি গিয়ে। ভাঙা সিঁড়ি ধরে ওপরে ওঠে সে I পুরোনো জরাজীর্ণ ভগ্নপ্রায় মন্দির। তারমধ্যে অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হচ্ছে না।

সন্ধ্যে বেলা, কিন্তু মন্দিরে কোথাও কোনো আলো জ্বলছেনা। অদ্ভুত ব্যাপার তো! আলো আঁধারিতে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে দেখে আদৌ সেখানে কোনো দেবদেবীর মূর্তির অস্তিত্ব নেই। পুরো অংশটাই ফাঁকা। কিন্তু আগের দিন ও তো সে সন্ধ্যাআরতির আওয়াজ পেয়েছে। কিছুয় বোধগম্য হয়না তার I এ বাড়ির সব কিছুই যেন কেমন রহস্যময়। দ্রুতপায়ে সে বাড়ির দিকে হেঁটে চলেI

হঠাৎ মন্দিরের পেছনের অংশ থেকে সেই স্বল্প বসনা মহিলা যাকে একটু আগে এদিকে আসতে  দেখেছিল তার দেখা পায়I আধো অন্ধকারে এক ঝলক দেখেই প্রবীর ঠাওর করে নারীটি অপূর্ব সুন্দরীI এক অদ্ভুত আকর্ষণে চোখ ফেরাতে পারেনা প্রবীরI বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে যাওয়ায় সিক্ত বসনে তাকে আরো মোহময়ী লাগছে। সম্বিৎ ফিরে এলে সে বলে “অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত। আমি আপনাদের পূজ্য দেবতার একটিবার দর্শনের উদ্দেশ্যে এসেছিলাম। না জানিয়ে আসায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। বিগ্রহ কোথায় দেখিয়ে দেবেন?”

“আপনি এই মুহূর্তে এই অঞ্চল থেকে চলে যান আর ফিরে আসবেননা।” অত্যন্ত কঠিন এবং চাপা স্বরে কথা গুলো বলে মহিলা অন্দর মহলের দিকে চলে গেল। প্রবীর স্বভাবতই ভীষণ অবাক হলো। লজ্জিতও হলো I সে শুধুমাত্র দেব মূর্তি দর্শন করার উদ্দেশে সেখানে গেছিল। কোনো দুরভিসন্ধি তার ছিলোনা।

আহত হয়ে সে ফিরে আসে নিজের ঘরে সে I এমন কি  অপরাধ করেছে বুঝতে পারেনা। খুব অপমানিত মনে হয় নিজেকে। অন্য ব্যক্তি হলে বিনা কারণে অপমান সে মেতে নিতো না। কিন্তু মহিলাটিকে দেখে সে এতোই মোহগ্রস্ত হয়েছিল যে কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারেনি।

হেডস্যার কে পরের দিন সে সব ঘটনা জানায় কিনতু স্যার সব শুনে তাকে ওদের বাড়ির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে বলেন। কেমন একটা খটকা লাগে প্রবীরের। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এত চাপানোতরের কারণ তার বোধগম্য হয়না।

দুদিন বেশ নির্বিঘ্নে কেটে গেলো। সেদিনের ঘটনার পর থেকে স্কুল ছাড়া আর কোথাও বেরোয়নি প্রবীর। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে সবে সে ফিরেছে হঠাৎ দরজায় দেখলেন বিলাসবাবু এসেছেন আর পেছনে সেই অপরিচিতা মহিলা নতোমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে।

“সেদিনের ঘটনায় কিছু মনে করোনা প্রবীর, আসলে আমরা আমাদের কুলদেবতা খুবই জাগ্রত আমরা অন্যদের ওনাকে দর্শন করতে দিই না, এটা অনাদের বংশের রীতি। তুমি বাগানে ঘোরো ঠিক আছে, কিন্তু ওদিকে যেও না।“ বিলাসবাবু বলেনI

“না না ঠিক আছে আমার আপনাদের অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল আমি দুঃখিত।” পাশের নারীটির দিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ চলে যায় প্রবীরের। বিলাস বাবু তা লক্ষ্য করে গতকালের সেই পরম সুন্দরী মহিলার দিকে ইশারা করে বিলাসবাবু বললেন “ওর নাম কামিনী। ও আমাদের আশ্রিতা। ওর কাছেই শুনলাম ঘটনাটা।” রমণীটি তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ পরনে সাধারণ গ্রামীণ পোশাক I হাতে একটি রেকাবিতে কাটা ফল আর গ্লাসে সরবত জাতীয় কিছু। “এগুলো আপনি খেয়ে নিন। আমায় মাফ করবেন।” বলে যমুনা বিদায় নিল । বিলাসবাবু ও বললেন  আমি আসি প্রবীর।

খুবই আশ্চর্যের বিষয়। এরা কোনো খোজ খবরই রাখেনা হঠাৎ আজ খাবার নিয়ে এলো? যাক ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল ঢোক ঢোক করে শরবত টা খেয়ে নিল সে। তারপর ফল খেয়ে শুয়ে শুতেই হালকা তন্দ্রা মতো এসেছিল।

হঠাৎ তার মনে হলো ঘরের ভেতরে কে যেন প্রবেশ করেছে…

এ কি কামিনী এখানে কি করছে?! সে দেখলো কামিনী তার কাছে এগিয়ে এসে তার বিছানার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ….

“একি করছেন আপনি” বলেই ধড়মড় করে উঠে বসে সে।

উঠে দেখে কোথায় কি? অন্ধকার… দূরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে I “তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম?” মনে মনে কেমন যেন লজ্জিত হলো সে I

পরের দিন আবার স্কুলI সত্যি বলতে গ্রামে থাকার ভালোলাগা তার এর মধ্যেই উবে গেছে। বদ্ধ জলার মতো জীবনযাত্রা তার মনে বেশ প্রভাব ফেলছে। তার পেশা-দায়িত্বের প্রতি কোনো টান সে অজ্ঞাত কোনো কারণে আর অনুভব করতে পারছেনা। ভালো না লাগার কারণটা সে নিজেই জানে না। সেই রোজকার একঘেয়ে রুটিন ইদানিং আর ভাল লাগছে না তার। ভাবছে এবার ট্রান্সফার এর জন্য দরখাস্ত করবে। এই গ্রামেগঞ্জে কতদিন এভাবে থাকা যায়? বাড়ির লোককেও কেও কতদিন দেখেনি সে। একদিন হেডস্যারকে খুলে বলে সে। মাস্টারমশাই গম্ভীর হয়ে তাকে ইস্তফা দিতে নিষেধ করেন এবং শিক্ষকদের নীতি ও দায়িত্ব সম্পর্কে একটি বড়োসড়ো জ্ঞান দিয়ে বসলেন I আরো মুষড়ে পড়ে প্রবীর।

স্কুল থেকে ফিরে কিছুক্ষন শুয়ে থাকে সে I ভীষণ গরম আজ I হঠাৎ দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ I দরজা খুলতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় প্রবীরের। সামনেই পরমাসুন্দরী কামিনী দাঁড়িয়ে। একা এসেছে আজ ,হাতে আজও সেই সরবতের গ্লাস।

ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে সে বলে “প্রবীর বাবু সরবত এনেছি আপনার জন্য খেয়ে নিন।“

“না না সেকি রোজ রোজ আপনাকে কষ্ট করতে হবেনা।“

“কষ্ট কি আপনি একা থাকেন তাই আর কি …”

বলে প্রবীরের বিছানার উপর বসে পড়ল সে। নানা কথা বার্তার মাধ্যমে প্রবীরের সাথে আলাপ জমাতে শুরু করলোI সত্যি বলতে এভাবে একাকী প্রবীরেরও ভালো লাগেনা I তাই কামিনীর সঙ্গ বেশ ভালোই লাগছিলো।    মিষ্টি সরবত নিয়ে  তা পান করার পর শরীরে যেন এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। অনেক গল্প করে সে । প্রবীরও নানা কথা জানায়। মেয়েটি বড়োই মিশুকে ও হাসিখুশি। প্রথম দিনের আলাপের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিমেষেই ভুলে গেলো প্রবীর।

একদিন এসে শুয়ে আছে আজ আর কামিনীর দেখা নেই। কি শরীর খারাপ হল নাকি?

অনেক্ষন পায়চারি করে সে। কামিনী এলোনা I রাগও হয় দুঃখও হয়। যমুনা যে মাত্র কয়েকদিনের আলাপে এতো আপন হয়ে উঠেছিল তা প্রবীর আন্দাজ করতে পারেনি। অনেক্ষন ছটফট করার পর ক্লান্ত থাকায় সে শুয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

কিছুক্ষণ পরে কিছু একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ খুলতেই সে দেখতে পায় কামিনীর  মুখ। তার দিকে চেয়ে কি যেন দেখছে সে। জলদি উঠে দেখে তার চোখের ঠিক উপরে ঝুকে তার চোখের দিকে দেখছে আছে কামিনী ! একি আবার কি স্বপ্ন দেখছে এসব?

কিন্তু স্বপ্ন তো নয়। এতোটাই নিকটে কামিনী যে সে তার নিঃশ্বাস এর শব্দ, হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। কামিনীর সুন্দর মায়াময় চোখ দুটি নিয়ে তার দিকে তাকে আছে। তার গায়ের একটা মিষ্টি গন্ধ পাগল করে দেয় তাকে।নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনা প্রবীর। কেমন একটা আছন্ন ভাব যেন গ্রাস করেI কামিনী কে নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে প্রবীরের। বাঁধভাঙা উচ্ছাসে সে নিজেকে সপেঁ দেয় তার আলিঙ্গনে I কামিনী নিজেও যেন এই মুহূর্তের অপেক্ষা করছিল I কোনো ভাবে অতৃপ্ত রাখেনা সে প্রবীরকে। নিজের ঠোঁট  এর সাথে প্রবীরের ঠোঁট মিলিয়ে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত আসে I মধ্যরাতের পর আলুথালু বেশে কামিনী ফিরে যায় তার ঘরে।

প্রবীর যেন স্বর্গসুখ লাভ করে। অনেকদিন সে এই পরম আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিল। মনটা একটু খুত খুত করলেও নিজের সুখস্মৃতি কে সে অস্বীকার করতে পারেনা। কামিনীর সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টিভেজা স্বল্পবসনা মূর্তি তার হৃদয়ে আঁকা ছিলই। সেই সুন্দরী নারী তাকে ভালোবেসেছে? এই অনুভবটাই প্রবীরকে পুলকিত করে তুলে সব অপরাধবোধ সরিয়ে ফ্যালে।

হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের বিবাহিত স্ত্রীর কথা ভুলে একে অপরের সাথে বারবার গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা। কোনোদিন গভীর রাতে  বা পড়ন্ত বিকেলে কামিনী ও প্রবীর নতুনভাবে নিজেদের আবিষ্কার করে I এভাবেই দিন অতিবাহিত হতে থাকে।

বাড়িতে ও আজকাল বেশি ফোনে করা হয়না প্রবীরের । যমুনা তাকে যেন সব টান ভুলিয়ে দিছে । প্রবীরের একঘেয়েমি জীবনও প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে। রোজ বিকালে অথবা রাতে একটা মিষ্টি শরবত নিয়ে আসে তার জন্য একদিন ও ভোলেনা। তারপর তারা নিমজ্জিত হয় ভালোবাসার সুখসাগরে….

একদিন সকালে সে স্কুলে যাবে বলে তৈরি হচ্ছে, হঠাৎ করে বিলাস বাবু এসে হাজির। তিনি বললেন তার একজন বিশেষ আত্মীয় মারা গেছে তাই বাড়িশুদ্ধ সবাইকে যেতে হচ্ছে কাল ফিরে আসবেন। সে যেন ফিরে বাইরের গেট এ চাবি দিয়ে দেয়। কামিনী থাকবে কোনো অসুবিধা হলে তাকে যেন জানায়। চাবি প্রবীরকে দিয়ে ওনারা বেরিয়ে গেলেন।

সেদিন শনিবার, হাফ ডে I প্রবীর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলো। গেটে চাবি বন্ধ করে দিলো। এসে একটু বিশ্রাম নেবে ভাবলো কিন্তু পারলোনা I রোজকারের মতন কামিনী  আজ সময়মত এলোনা। এখনো কেন এলোনা এটা ভেবেই কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো সে। একবার ভেতরে গিয়ে দেখবে কোথায় সে? কোনোদিন সে অন্দরমহলে যায়না আজ তো কেউ নেই গিয়ে তাই যাওয়া যেতেই পারে একবার।কামিনীকে ছেড়ে সে আর থাকতে পারেনা। ধীর পায়ে রওনা হয় প্রবীর।

অজ্ঞাত জায়গা আবিষ্কারের উত্তেজনা মনে এসে জমা হয় তার I একটা বড় দরজা পেরিয়ে বিলাসবাবুর অংশে ঢুকতে হয়। দরজা ভেজানো ছিল অনায়াসে ভেতরে প্রবেশ করল সে। দোতলা পুরোনো বাড়ি, সারি সারি দরজা, পুরোনো বড় থাম, সেকেলে কড়িকাঠ। এতবড় বাড়ি! কেমন গা ছমছম করে উঠলো তার। অযত্নে সবই নষ্ট হতে বসেছে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায় সেI যমুনাতো বলেছিলো সে এখানেই থাকে। কিন্তু দেখে তো মনে হয়েছে এখানে কয়েক বছর কেউ থাকেনি। “কামিনী ,কামিনী” বলে ডাকতে থাকে প্রবীর। সব দরজায় তালা বন্ধ। সে কোথায় গেল? খুব রহস্যময়ী তো।

অনেক্ষন ঘোরাঘুরি করেও কামিনীর দেখা পেলোনা সে। হতাশ হয়ে সে ভাবলো না এবার ফেরা যাক । হঠাৎ মনে হলো মন্দিরে যায়নি তো? নিশ্চয়ই  সে পুজো করছে তাই ব্যাস্ত আছে। ওকে না দেখলে কেমন লাগে। একবার ঘুরে আসি I কিন্তু বিলাসবাবু তো বারণ করেছিলেন। আজ তো কেউ নেই একবার দেখেই চলে আসার সিন্ধান্ত নেয় সে I

বাগানের মধ্যে দিয়ে একবারে শেষ প্রান্তে উপস্থিত হলো সে। মন্দিরের দরজা বন্ধ তবে তালা দেওয়া নেই। প্রাচীন পোড়ো মন্দির I যাওয়া উচিত হবে কি? দেখেই আসি একবার, ভাবলো প্রবীর।

ভেতরে ঘুপচি মতো, জরাজীর্ণ গর্ভগৃহে সে একা। কিন্তু পুজোর কোনো উপকরণ বা বিগ্রহ কিছু নেই সেখানে। দেবমূর্তি কোথায়? প্রবীর হতবাক হয়ে যায় তাহলে এরা কিসের পূজা করে?

হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটা কুলুঙ্গি সেখানে একটা ছোট মূর্তিই কোনো জন্তুর হবে। কৌতূহলবশত প্রবীর সেটাকে হাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দেওয়ালের সাথে গেঁথে থাকায় সেটা হাতে না এসে কিছুটা স্থান পরিবর্তন করে মূর্তিটা ঘুরে যায়। প্রবীর সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘরঘর আওয়াজ শুনতে পায়।

একি! মন্দিরের এক দিকের দেওয়াল সরে গিয়ে একটা অংশ ফাঁক হয়ে গিয়েছে। নীচে একটা ঘোরানো সিড়ি অন্ধকারে নেমে গিয়েছে…

তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে, সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। সে হকচকিয়ে যায়। এখন এই সন্ধেবেলায় কি নীচে যাওয়া উচিত হবে? নিজের কৌতূহল দমন করতো না পেরে, মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জেলে নীচে নামবে স্থির করে প্রবীর। ভিতরে জমাট অন্ধকার। কিছু সেরম বোঝা যাচ্ছেনা। বেশ কিছটা নামার পর একটা চাতাল মত জায়গায় এসে উপস্থিত হয় সে । টর্চ ঘুরিয়ে দেখে একটা মশাল রয়েছে I নিজের লাইটার দিয়ে মশালটা জ্বালিয়ে কিছুটা অন্ধকার দূর হলো। সে কোথায় এসে পড়ল কিছুই বোধগম্য হয় না তার।

একটু জায়গাটা আলোকিত হতে সে কিছুটা ধাতস্থ হলো। মশালের রাসয়নিকটি বেশ তাজা, তার মানে তারা এখানে নিত্য যাতায়াত করে। কক্ষটি স্যাতস্যাতে ও ঘুপচি হলেও বেশ পরিষ্কার।  নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। একটু এগিয়ে যেতে সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো।  একটি বড়ো বেদি এবং তার ওপরে স্বয়ং এক দেবতার প্রস্তর মূর্তি দন্ডায়মান। কম করে উচ্চতা দশ ফুট হবে।  হিন্দুশাস্ত্রে এরকম কোনো দেবতার কথা সে শুনেছে বা দেখেছে বলে তার মনে পড়লোনা।  বিকট মূর্তিটির সামনে একটি প্রদীপ জ্বলছে তাতে অন্ধকার দূর হবার বদলে আরো বেড়ে যাচ্ছে।  তাহলে কি এরা গোপনে কোনো অন্য দেবতা বা শক্তির উপাসক? এরা করা? এবার তার ভয় করতে শুরু করে প্রবীরের। এই নির্জন অদ্ভুত পুরীতে তাকে রাত্রিবাস করতে হবে ভেবেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার।  তাড়াতাড়ি এই পাতাল পুরী থেকে বেরোনোর উদ্যোগ নেয় সে।

হঠাৎ কোথাও একটা দরজা খোলার শব্দ তার কানে এলো। পেছনে ফিরতে তার চোখে পরে উত্তর দিকের দেয়াল থেকে একটি দরজা খুলে গিয়ে বেরিয়ে আসছেন বিলাসবাবু। তার সঙ্গে একটি পুরোহিত গোছের লোক। তার পেছনে আরেকজন বল্লমধারী আদিবাসী পোশাকের ষণ্ডা মতো লোক। গমগম করে ওঠে বিলাস বাবুর গলা,  “তোমার কৌতূহল তাহলে আজ মিটল?

“তুমি নিশ্চই আমাদের উপাস্য দেবতা দেখেছো ?”

“হ্যা কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না এটা কার মূর্তি আর আপনারা কেন বাইরের মন্দির ছেড়ে এই গুপ্ত কক্ষতে এনার পূজা করেন। আর আপনি তো বললেন আজ থাকবেন না তাহলে হঠাৎ এখানে কিভাবে এলেন?” প্রবীর উত্তর দেয়।

অল্প হেসে বিলাস বাবু বলেন, “তাহলে শোনো আমরা এই মোহরগড় অঞ্চলের প্রাচীন উপজাতি।  বহু প্রাচীনকালে গহীন জঙ্গলে আমাদের জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। আমরা ‘ডাহুল ‘সম্প্রদায়ের মানুষরা আমাদের এই প্রাচীন কূলদেবতাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে উপসনা করে থাকি। ইনি অত্যন্ত জাগ্রত দেবতা এবং এনাকে আমরা ‘আগমবালী’ নামে ডাকি। আমাদের পূর্বপুরুষরা বহু যুগ আগে এখানকার অত্যাচারী জমিদারকে সরিয়ে এই বাড়ি দখল করে।। দেবমূর্তিকে মন্দিরের গর্ভগৃহে না রেখে এই গোপন পাতালপুরী তে মূর্তিটি  স্থাপন করি আমরা। আমাদের সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোনো মানুষের পূজা ইনি গ্রহণ করেননা। পূজা পদ্ধতিও সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের বংশ বর্তমানে কালের অভিশাপে ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে চলেছে। তবে তাই বলে এনার উপাসনায় কোনো প্রকার অবহেলা করা সম্ভব নয়। এনাকে আমরা কোনো ভাবেই অসন্তুষ্ট করতে পারবোনা, বুঝতে পারছো কি বলছি?” প্রবীরের ততক্ষনে বিস্ময়ে ও ভয়ে বাকরুদ্ধ হবার উপক্রম। আমতা আমতা করে সে জানায়

“হ্যাঁ কিন্তু মানে শেষের দিকটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।”

মুচকি হাসেন বিলাস বাবু।। “আসলে কি জানো প্রবীর, আমাদের এই দেবতাকে বিশেষ উপায়ে পূজা করা হয়ে থাকে। তিনি অসন্তুষ্ট হলে গ্রামে নেমে আসবে খরা,বন্যা,দুর্ভিক্ষ,মহামারীর মতো অভিশাপ।  ভালো করে দেখ ইনি আমাদের প্রকৃতির দেবতা।“ 

দেবতার দিকে তাকিয়ে সেই কথাই মনে হলো প্রবীরের। প্রকান্ড আস্ত প্রস্তর খন্ডের ওপর খোদাই করে তৈরী মূর্তিটির চক্ষু রক্তবর্ণ, অত্যন্ত ক্রূর দৃষ্টি, চারহাতের একটিতে খড়গ, একহাতে শস্যদানা, একটিতে একটি নরমুণ্ড ও আরেক হাতে কোনো শিঙবিশিষ্ট জন্তুর কাটা মাথা। কোনো অশুভ শক্তির প্রতীক বলেই মনে হয়। মাথা উঁচু করে কিছুক্ষন দেখার পরেই প্রবীরের যেন হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠলো। সেই ক্রূর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা অত্যন্ত কঠিন।

হিসহিসে স্বরে বিলাস বাবু বলে চলেন, “আমার আসলে নাম বিলাস নয়, মোরান। মোরান ভালি।আমরা এভাবে অনেকেই ছদ্মনাম নিয়ে কয়েক বছর ধরে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লুকিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসবাস করে আসছি।”

“কিন্তু এভাবে লুকিয়ে থাকার কি কারণ ?” প্রবীর জানতে চায়।  “আপনার আসল পরিচয় দিতে  আমাকে কি সমস্যা ছিল? আর সেই প্রাচীন জমিদারকে সরিয়েই কেন আপনাদের এই বাড়ি দখল করতে হলো?”

“অর্বাচীনের মতো কথা বোলোনা !” ধমকে ওঠেন বিলাসবাবু। “ইনিই এই অঞ্চলের প্রকৃত অধীশ্বর ও আমরা এনার সেবায়েত। কোনো জমিদার, রাজা, সরকারের ধার আমরা আগমবালী ভক্তেরা ধারিনা। এই অঞ্চলে ডাহুলদের ছাড়া কারোর রাজত্ত্ব চলবেনা। সেই অত্যাচারী জমিদার ও তার পুরো পরিবারের কি করুণ পরিণতি হয়েছিল জানো?” একটু অদ্ভুত পৈশাচিক হাসি খেলে যায় বিলাসবাবুর মুখে। “এই দেবতার পূজা না করলে দেবতার অভিশাপে  এই অঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে কেউ আটকাতে পারবেনা। অনেকেই প্রতিবাদ করেছিল আমাদের এই নিয়মের।  সকলকেই চরম মূল্য চোকাতে হয়েছে।

প্রবীর আর থাকতে পারেনা, উত্তেজিত হয়ে জানতে  চায়, “কি হয়েছিল তাদের? সেই জমিদারেরই বা কি হয়েছিল শেষে?”

হাহাহা শব্দে অট্টহাসি করে ওঠেন বিলাসবাবু। বদ্ধপুরীতে তার গলার আওয়াজ গমগম করে উঠলো। “আজ অমাবস্যাও বটে। এই দিনে আমরা আমাদের মহান দেবতার পায়ে একজন মানুষকে নিবেদন করে থাকি। মানুষের তাজা রক্তে আগমবালী খুশি হন। নর রক্ত ছাড়া কোনো নৈবেদ্য তিনি  গ্রহণ করেন না।” প্রবীরের বুকে ভয়ের স্রোত নেমে যায়। তার মাথা ঘুরে ওঠে, গা গুলিয়ে ওঠে। প্রাচীন গুপ্ত কক্ষের চাপা স্যাতস্যাতে গন্ধটা হঠাৎ যেন রক্তের গন্ধে রূপান্তরিত হয়ে পূতিগন্ধের ন্যায় বয়ে চলতে থাকে।

কানে আসতে থাকে বিলাসবাবুর কথা,  “জমিদার বাবুর সমগ্র পরিবার  কে এই বাড়ির চোরা কুঠুরিতে তে আমার পূর্বপুরুষরা লুকিয়ে রেখেছিলো যথাসময়ে তাদের অর্ঘ্য স্বরূপ আগমবালিকে তাদের অর্পণ করে হয়”তোমার আগের এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কোথায় বদলি হয়েছিল জানতে চাওনি তো?! সবাই জানে তিনি হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আসল ঘটনাটা বলতে আর দ্বিধা নেই।  ঠিক এক বছর আগে তার রক্তেও আমাদের আরাধ্য দেবতা প্রসন্ন হয়েছিলেন।  তাই এবারে আমাদের ফসলের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। ভদ্রলোক খুবই সুলক্ষণ ছিলেন, সেবার অসুবিধা হয়নি এবারের মতন। তিনি আগে থেকেই চিহ্নিত ছিলেন। এবারে চিহ্নিত করতেই  সময় লেগে গেলো। আমাদের মহান আগমবালী খুবই  পিপাসার্ত।” 

“তাহলে এ বছরের চিহ্নিত ব্যক্তিটি কে ?” কাঁপা গলায় প্রবীর বলে ওঠে। 

তিনজনের একসাথে অট্টহাসির শব্দে পাতালপুরীতে কেঁপে ওঠে। “মূর্খ! এখনো এই প্রশ্ন?!” বিলাসবাবু ব্যঙ্গ করে বলে ওঠেন। ভয়ে রাগে অসহায়তায় মরিয়া হয়ে প্রবীর চিৎকার করে ওঠে, “আপনারা খুনি। আমি বাইরের সবাইকে জানিয়ে দেব। স্কুলে জানাবো,পুলিশে যাবো। আপনারা মানুষ নন,নর পিশাচ। কত মানুষের সর্বনাশ করেছেন পূজার নাম করে।” বলেই ছুটতে শুরু করে প্রবীর। এই মৃত্যু পুরী থেকে শয়তানগুলোর হাত ছাড়িয়ে তাকে পালাতেই হবে। তাকে হত্যা করা সহজ নয়। এদের সবাইকে শাস্তি দেয়া দরকার। দৌড়াতে দৌড়াতে সিঁড়ির নাগাল পেয়েই সে চটপট ওপরে উঠতে থাকে। তাড়াহুড়োয় হোঁচট লেগে রক্তারক্তি হলেও সে কিছুর পরোয়া না করে পাগলের মতো রাস্তা হাতড়ে এগোতে থাকে। কোনোরকমে ওপরে পৌঁছানোর পর সে দরজা খুঁজে পায়। দরজায় টান দিতেই সে বুঝতে পারে দরজা পেছন থেকে বন্ধ । পাগলের মতো সে দরজা খুলতে চেষ্টা করতে থাকে। বাঁচাও বাঁচাও শব্দে দরজায় ধাক্কা লাথি মারার আওয়াজে সে জানতেও পারেনা কখন তার পেছনে বিলাসবাবু ও তার সঙ্গীরা এসে চাতালে  দাঁড়িয়েছে। 

গম্ভীর শব্দে বিলাসবাবু বলেন “নেমে আসুন প্রবীর ওই দরজা একবার খুললে ওদিকে  আর খুলবেনা।  আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়।  আপনার বেরোনোর আর কোনো পথ নেই। আপনাকে এমনিতেও আর ছেড়ে দেয়া সম্ভব নয় কারণ আমাদের গোষ্ঠীর পবিত্র কিন্তু  রক্তাক্ত ইতিহাস আপনি জেনে গেছেন।  আপনার অতিরিক্ত কৌতহলই আপনার কাল হয়ে দাঁড়ালো। যদিও আপনাকে ধরে আনার ব্যবস্থাও আমাদের অনেক আগেই করা ছিল।  আমাদের কাজও সহজ করে দিলেন।  যেদিন এখানে আপনি প্রথম আসেন ও আপনাকে দেখি সেদিন থেকেই আপনি চিহ্নিত, আপনার কপালের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি আপনি অতি সুলক্ষণ মানব ও সঠিক লগ্নে আপনার জন্ম।”

বিস্ফোরিত চোখে নিরুপায় প্রবীর বিলাসবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখে তার জলের ধারা।  ধীরে ধীরে সে মাটিতে বসে পরে।  এ কোন নরককুন্ডে সে এসে পড়েছে ? তাহলে কি আর এদের হাত থেকে বেরোনোর কোনো উপায়ই নেই?  হে ভগবান রক্ষা করো…. সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যমদূতের মতো তিন মানুষের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকতে তার মনে হতে থাকে সবাই তাকে আসতেই সাবধান করেছিল। স্পষ্ট ইঙ্গিত না করলেও চাপা ভাষায় সবাই তাকে মোহরগড়ের  বিভীষিকার থেকে দূরে থাকতে বলেছিলো। নির্বোধ, আধুনিক মনোভাবী, মোহান্ধ প্রবীরের কিছুই চোখে পড়েনি। তার জানা ছিলোনা পৃথিবীর  অনেক প্রান্তেই এখনো সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি। মানুষের মতো মুখোশ পরে থাকলেও কিছু মানুষ আজও প্রকৃতির আদিম মন্ত্রে দীক্ষিত ও পিশাচের মতো তারা নিষ্ঠুর, হিংসুক। বর্তমানের আধুনিকতাবাদ সেখানে খাটেনা।

“আপনার এখানে অনেক পরিচিতই এই ঘটনা জানেন, এমনকি হেডমাস্টার মশাইও।  কিন্তু কেউ এ কথা কখনো প্রকাশ করবেনা। তাহলে তার ওপর  আগমবালীর অভিশাপ বর্ষিত হবে ও তার পরবর্তী বলি হিসাবে বেঁচে নেয়া হবে তারই বাড়ির কোনো সদস্যকে।  আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষ বাইরের কোনো ব্যক্তির সাথে আত্মীয়তা রাখিনা তাই তাদের প্রতি আমাদের কোনো মাথা ব্যাথাও নেই।  আপনাকে আরো জানিয়ে রাখি আপনার শিক্ষা, সভ্যতার আইনের দম্ভ এখানে খাটেনা।  প্রশাসনের লোকের মধ্যেও আমাদের লোক আছে ও তারা সবই জানে।  তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর স্পর্ধা কখনো করবেনা আর আমরাও ঘটনাগুলিকে নিরুদ্দেশ বা অপঘাতে মৃত্যু বলে চালিয়ে দেব।” বিলাস বাবুর সব কথা প্রবীরের কানে ঢোকেনা কারণ তার  মনে মা, বাবা,স্ত্রী ও সন্তানের সাথে কাটানো মিষ্টি স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই ছিলোনা।

হঠাৎ কিসের আওয়াজে চমকে উঠে সে দেখে পেছনের দরজা দিয়ে আবার বেশ কিছু লোক জন এসে দাঁড়িয়েছে চাতালে। এরকম বহু গোপন দরজা রয়েছে যা শুধু তারাই খুলতে পারে। বাকি লোকেদের সবচেয়ে পেছনে দূরে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে  লাস্যময়ী কামিনী ।। সে প্রবীরের কাছে এগিয়ে এসে বললো

“কি হলো আপনি না ভদ্রলোক! বাড়িতে স্ত্রী পুত্র রেখে অন্য স্ত্রীলোকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে লজ্জা করেনা?”

উপস্থিত সকলের অট্টহাসিতে পাতালপুরী মুখরিত হয়ে ওঠে। হাসি দেখে কামিনীর মুখেও ফুটে ওঠে গর্বের হাসি।

বিলাস বাবু বললেন , ” ও আমার পালিতা কন্যা ওর  আসল নাম ‘ইবিষা’। ওর ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণই। আমাদের দেবতা আগমবালীর একনিষ্ঠ উপাসক।ও রোজ দুইবেলা আমাদের মহান আগমবালীর আরাধনা করে।।

 ও আমাদের নির্দেশ মতই ও তোমাকে নিজের বশে রেখে ছিল, যাতে তুমি কিছু বুঝে পালাতে না পারো। বিলাস বাবু বলল কামিনী শরীরের মাদকতায় সে অন্য পুরুষ কে অবশ করে রাখে।।শহরের বহু মানুষ এভাবেই কামিনীর শিকার হয়ে আগমবালীর তৃষ্ণা নিবারণ করেছে।।

প্রবীর মনে মনে ভাবল এই কালনাগিনীর সাংঘাতিক ছোবলে তার মূল্যবান জীবন টা বিনষ্ট হয়ে গেল।। আমাদের দেবতা কোনো নিরপরাধ মানুষের বলি নেন না। সে কোনো পাপের ভাগিদার হলে তবেই দেবতা তাকে গ্রাস করবেন । তুমি যা পাপী তাতে তোমার কোনো ক্ষমা নেই, প্রবীর তুমি ব্যভিচারী, বাড়িতে স্ত্রী -পুত্র থাকা সত্ত্বেও তুমি সবার অলক্ষ্যে পরকীয়াতে লিপ্ত হয়েছ।”

“তুমি পাপী ,তুমি পাপী, তুমি পাপী, ” এই বলে সবাই তাকে তিরস্কার করতে শুরু করে। কামিনী তার দিকে তাকিয়ে ক্রূর হাসি হাসতে থাকে।

 প্রবীরের দম বন্ধ হয়ে আসে। এ কোথায় এসে পড়ল সে তার পাপের শাস্তি এত ভয়ানক হতে পারে? কিভাবে সে এই ঘৃন্যতম ঘটনা ঘটালো? কেন সে অচেনা অজানা কামিনীর সাথে সম্পর্কে জড়ালো? হয়তো এরা কোনো ভাবে তাকে বশ করে রেখেছিল ….”

হঠাৎ তার সেই মিষ্টি সুগন্ধি সরবতের কথা মনে পড়লো যা যমুনা রোজ তার জন্য নিয়ে আসত।  তাতে নিশ্চয় কিছু মাদক বা উত্তেজক দ্রব্য মিশিয়ে আনত। হায় এ কি নিয়তির পরিহাস! প্রবীর কে তারা কাঠের পুতুলের মতো ব্যাবহার করেছে ঘুণাক্ষরেও সে কিছু বুঝতে পারেনি।

বিলাসবাবুর নির্দেশে ষন্ডা মতোন আদিবাসী লোকটি প্রবীরকে টানতে টানতে পূজার বেদীর কাছে নিয়ে আসে। বাধা দেবার মতো সাহস প্রবীর আর সঞ্চয় করতে পারলোনা। চলচিত্রের মতো তার সামনে দৃশ্যাবলী ঘটে যেতে থাকে ও তার সাক্ষী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও থাকেনা। এতক্ষনে প্রবীর লক্ষ্য করে বেদীর বাঁ পাশে অন্ধকারে একটি হাড়িকাঠ বসানো রয়েছে। লোকটি অমানুষিক শক্তিতে প্রবীরকে সেই হাড়িকাঠের কাছে নিয়ে আসে। পুরোহিত অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্রউচ্চারণ করতে শুরু করেছে। কোনো এক আদিম অপার্থিব উপজাতির পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে।  তার মধ্যে কানে আসে বিলাসবাবুর কণ্ঠ, “আজ শনিবার, কৃষ্ণপক্ষ, তিথি অমাবস্যা, কালরাত্রি তিথি তিন প্রহর, এমন পবিত্র দিন শুভ লগ্ন খুব কম দিনই আসে। আমাদের অর্ঘ গ্রহণ করো হে মহান আগমবালী! আমাদের ধন্য করো ” বলেই গলা ফাটিয়ে হা হাহা শব্দে তিনি হেসে ওঠেন।  হাসির শব্দের প্রতিধ্বনিতে পাতালপুরী মুখরিত হয়ে ওঠে।  বাকি উপস্থিত সকলে অদ্ভুত শব্দে হাসতে শুরু করে… হাসির শব্দে ও অদ্ভুত মন্ত্রের আওয়াজে প্রবীরের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। দুহাতে কান বন্ধ করে রাখে সে। অচেনা ধূপধুনার গন্ধে ও ধোঁয়ায় সেই স্থানে নিঃশাস বন্ধ হয়ে আসে। আবছা আলোয় চোখে পরে আদিবাসী লোকটির হাতে চকচকে  বিশাল খড়গটি।  ধীরে ধীরে প্রবীরের হাড়িকাঠে আটকে থাকা ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়ায় সে।  মূর্তিটিকে দেখে মনে হয় কোনো অন্ধকার যুগের করাল মৃত্যুর গহ্বর থেকে আজ স্বয়ং মৃত্যু তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রবীরের আর কোনো উপায় নেই। নিজের ভাগ্যের ওপর নিজেই উপহাস করতে থাকে প্রবীর…

 “হা ঈশ্বর, আমার নিয়তিই কি আমাকে এখানে আজ টেনে নিয়ে আসলো ?”

ঘাড়ের কাছে লোকটির হাত অনুভব করে প্রবীর। শক্ত হাতে তার ঘাড়টি ঘুরিয়ে দেয়া হয় দেবতার দিকে। শেষ বারের মতো তার চোখ চলে যায় তার বিকট দর্শন সেই মূর্তিটির দিকে। তার চোখ থেকে যেন আগুন বেরিয়ে আসছে ও প্রবীরকে যেন গিলে খেতে চাইছে। মূর্তিটির চোখের মনি হতে একটি লাল আলো যেন দপদপ করে জ্বলতে জ্বলতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। যেন নরকের আগুন থেকে উঠে আসা কোনো প্রাণীর রক্তের তৃষ্ণায় তার শিকারের দিকে পিচ্ছিল  সরীসৃপের মতো বুভুক্ষু দৃষ্টিতে এগিয়ে আসছে ও চরম প্রাপ্তির আশায় যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে….

 শানিত খড়গের আঘাতে প্রবীরের মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে ভূলুণ্ঠিত হয়। ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা তাজা রক্তের ধারায় আদিম উপজাতির মহান দেবতা আগমবালির মূর্তিটি ও  মাটি  সিক্ত হয়ে ওঠে।সেখানে উপস্থিত  উন্মত্ত ও উল্লসিত জনতা  আগমবালীর জয়ধ্বনি দিতে থাকে। আদিম উপজাতির বহুদিনের পিপাসার্ত নৃশংস দেবতার রক্ততৃষ্ণা মেটে….

                       সমাপ্ত

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post প্রেম প্রতিক্রিয়া| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | দীপঙ্কর পড়্যা| Bengali Stories for Matured
Next post মৌলিক ছায়া| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | গোপাল পৈলান| Bengali Stories for Matured