নয়নের আলো| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | অনির্বাণ সরকার| Bengali Stories for Matured
0 (0)

রাজভবনের সাউথ ব্লকে অশোকা কন্ডোমিনিয়াম হলের ডায়াস থেকে যখন সুবিখ্যাত ঘোষিকা বৈজয়ন্তী মৈত্র এবছরের ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কারপ্রাপকের নাম ঘোষণা করলেন, তখন সারা হল করতালির অনবরত কল্লোলে যেন ফেটে পড়ল !

রাজ্যের বিদগ্ধ মন্ত্রীমণ্ডল, আমলা ও অন্যান্য বিশিষ্ট অতিথিবর্গের মধ্যে দিয়ে এস্‌কর্ট করে ডায়াস অবধি নিয়ে আসা হল হুইলচেয়ারে আসীন স্বনামধন্য মনোবিদ ডঃ অঞ্জন চক্রবর্তীকে, তারপর র‍্যাম্পের সাহায্যে ডায়াসে তুলে তাঁকে আনা হল মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয়ের সম্মুখে । চারিদিক থেকে সহস্র জ্যোতিষ্কের আলোর ঝলকানির মত প্রেসের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠতে লাগল মুহুর্মুহু – ভি.আই.পি. লাউঞ্জ থেকে হুইলচেয়ারে বসে তাঁর চলা আরম্ভ করামাত্র যা শুরু হয়েছিল, মাননীয় রাজ্যপালের হাত থেকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মানের পুরস্কার গ্রহণ করার সময় তা যেন আরও বহুগুণ বেড়ে গেল !

প্যারাসাইকোলজির প্রচ্ছন্ন ও প্রায়ান্ধকার দিকগুলো নিয়ে তাঁর মৌলিক গবেষণামূলক কাজের জন্য লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের এই সাম্মানিক পুরস্কার ও সংবর্ধনা । পুরস্কারগ্রহণ পর্ব শেষে গার্ড অফ্‌ অনার দিয়ে আবার ভি.আই.পি. লাউঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হল ডঃ চক্রবর্তীকে । বিরামহীন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ এবং করতালির দামামা তখনও চলছে ।

এতক্ষণ ধরে দর্শকাসনে বসে অন্যান্যদের সাথে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত করতালি বাজিয়েছে আলো, সঙ্গে তার স্বামী নয়ন ও তাদের একমাত্র পুত্র অভিনন্দন । ডঃ চক্রবর্তী ভি.আই.পি. লাউঞ্জে ফিরে আসার পর তাঁর এই অতিপ্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীটি তার স্বামী-পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে হাসিমুখে উঠে চলে এল তাঁর কাছে, ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল । প্রেসের ক্যামেরায় বন্দী হল ওঁদের যুগল বেষ্টনী । চূড়ান্ত খুশীর চমক ফুটে বেরচ্ছে ওঁদের চোখে-মুখে ।

তবে নয়ন জানে, আজ এখানে সবচেয়ে বেশী আনন্দিত যদি কেউ হয়ে থাকে, সেটা তার স্ত্রী আলোই । সে তার জীবনযুদ্ধে এমনভাবে জয়ী হয়েছে, যা আর কেউ কখনও হয়নি ; তার কাকাবাবুর এই সম্মানপ্রাপ্তি বুঝি সেই লড়াইয়ে তার জয়েরই স্বীকৃতি !

অনুষ্ঠান শেষে মধ্যাহ্নভোজন । সেখানে আলাপ হল সমাজের নামী-দামী আরও বহু মানুষের সঙ্গে । প্রত্যেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ডঃ চক্রবর্তীকে, পরিচয় করছেন ওদেরও সাথে । কেউ কেউ আবার উৎসুক নজরে দূর থেকে নয়ন ও আলোকে দেখছে, তারপর নিজেদের মধ্যে সুপ্ত আলোচনায় ন্যস্ত হয়ে পড়ছে ।

ওরা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে । এমনটা যে হতে পারে, তা ওরা আগেই জানত । সেইভাবে মানসিক প্রস্তুতিও নিয়ে এসেছে আজ ।

একফাঁকে বৈজয়ন্তী মৈত্র এসে ওদের সাথে আলাপ করে গেলেন । উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আলোকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনিই আলোকিতা চক্রবর্তী ? আপনার জীবন সংগ্রামের কাহিনী আমরা সবাই জানি । সে-কাহিনী তো মনস্তত্ত্বে এক অত্যাশ্চর্য কেস-স্টাডি হিসেবে পড়ানো হয় !’

‘জীবন সংগ্রাম বলা বোধ হয় ঠিক হবে না,’ সৌজন্যমূলক উত্তরে বলল আলো, ‘নিজের একটি ভুলের সংশোধন বলতে পারেন ।’

আলোর কথায় নয়ন তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল । সত্যিই তো, তার জন্য আলো যে পরিমাণে আত্মত্যাগ করেছে, অচেনা অন্ধকার পথে যতখানি একলা হেঁটে এগিয়েছে, কঠোর মনের জোর দিয়ে সব বাধা অতিক্রম করেছে, তেমনটা হয়ত সে নিজেও করতে পারত না আলোর ক্ষেত্রে ! সেজন্য সে তার কাছে চিরঋণী থাকবে । আর, সেই অগ্নিপরীক্ষায় নিরলসভাবে প্রতি পদক্ষেপে তাকে সাহায্য করেছেন তার পরম শ্রদ্ধেয় কাকাবাবু । আজকের এই অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটি প্রায় সাতাশ বছর আগে আলোর জন্য যে পথের উদ্ভাবন করেছিলেন, সেই পথ অনুসরণ করেই তো ওরা এতদিন ধরে সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করে চলেছে । তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই নয়নের ।

খাওয়া-দাওয়ার পর আরেক দফা সপরিবারে প্রেসের সম্মুখীন হলেন পুরস্কারপ্রাপকরা । সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পর্বও একসময় শেষ হল । এরপর অভিবাদন ও সংবর্ধনার পালা চলল বেশ কিছুক্ষণ, অবশেষে সিকিউরিটি কর্ডনের মধ্যে দিয়ে সকল পুরস্কারপ্রাপক ও তাঁদের পরিবারবর্গকে নিয়ে আসা হল রাজভবনের মূল অংশে । সেখান থেকে সকলে একে-একে বিদায় নিতে পারবেন ।

নয়ন ও আলো ডঃ চক্রবর্তীকে নিয়ে রাজভবনের দক্ষিণের অলিন্দে চলে এল । এদিকটা একটু নিরিবিলি, সিকিউরিটি ছাড়া অন্য কারও বিশেষ আনাগোনা নেই । বাইরে ফুলের বাগান, পাশে পিচ-ঢালা রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে দক্ষিণের গেট পর্যন্ত, গেটের সামনে হর্স্‌-মাউন্টেড পুলিশ প্রহরায় রত । গেটের বাইরে শহরের রাস্তায় অসংখ্য গাড়ির অবিরাম গতিপথের ফাঁক দিয়ে ইডেন গার্ডেনের গ্যালারির একটা অংশ উঁকি দিচ্ছে ।

ডঃ চক্রবর্তী বার্ধক্যজনিত কারণে আজ প্রায় চার বছর হুইলচেয়ারের অধীন । ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙের জন্য দু’হাতের প্রতিটি ফুলে ওঠা শিরা-ধমনীর বিন্যাস স্পষ্ট দেখা যায় । অশক্ত ন্যুব্জ শরীরটা যেন হুইলচেয়ারে একদম সেঁটে গেছে ! তা সত্ত্বেও কাঁপা-কাঁপা হাতে সবার সাথে করমর্দন করার সময় সোনালী ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে তাঁর উজ্জ্বল দু’চোখের দৃষ্টি ও ভুবনভোলানো হাসি তাঁর ব্যক্তিত্ব আরও ভালভাবে ফুটিয়ে তুলছিল ।

অভিনন্দন গিয়েছে ওদের গাড়িটা পার্কিং লট থেকে নিয়ে আসতে । সেইটুকু অবসরে ওরা ডঃ চক্রবর্তীকে নিয়ে রাজভবন চত্বরটা ঘুরে দেখছে । একদা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেলদের বাসস্থান, অধুনা এই রাজ্যের রাজ্যপালের বাসভবন এই বৈভবসম্পন্ন অট্টালিকা এবং তৎসংলগ্ন পরিসরটি অসামান্য স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন ! বিকেলের পড়ন্ত রোদের আলোয় এই শ্বেতপ্রাসাদ গোলাপীবর্ণ ধারণ করেছে তখন ।

ডঃ চক্রবর্তীর হুইলচেয়ারের দুই হাতল ধরে ওঁকে নিয়ে খুশীমনে হাঁটছে আলো, পাশে তার নয়ন । আর ওদের দু’জনকে ঐভাবে হাঁটতে দেখে ডঃ চক্রবর্তীর মুখে ফুটে উঠেছে প্রশান্তির হাসি, পরম আত্মতৃপ্তির ঝিলিক । এই দৃশ্য যেন তাঁর চিকিৎসক জীবনের সবচেয়ে দামী পুরস্কার, যার মূল্য তাঁর কাছে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট হিসেবে পাওয়া বঙ্গবিভূষণের চেয়েও বেশী ! শুধু তা-ই নয়, নয়ন ও আলোর সম্পর্ক থেকে তাঁর আরেক প্রাপ্তি হল দৌহিত্র অভিনন্দন – তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা উপহার । তিনি অকৃতদার, ওরাই ওঁর পরিবার ।

নয়ন হাঁটার মাঝেই আলোর দিকে আড়চোখে বারকয়েক তাকিয়েছে । আজকের আলোর চুলে পাক ধরেছে, চোখে হাই-পাওয়ারের চশমা উঠেছে, মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে, সেই সুডৌল দেহের গড়ন আর নেই, হাত-পায়ের আঙুলগুলোও তার আসন্ন বার্ধক্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে ! অথচ সে যেদিন বিয়ের জন্য আলোকে প্রথম দেখতে গিয়েছিল, সেদিন একুশ বছরের এক অসামান্য সুন্দরী যুবতীর রূপে ও দেহসৌষ্ঠবে বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সে । তার নামটাও গেঁথে গিয়েছিল তার মনে – “আলোকিতা”, দীপ্তিময়ী নারী !

ভাবনার অন্তরালে নয়ন স্মৃতির পথ ধরে তিরিশ বছর পিছনে চলে গেল ।

সেই ঘটনার বছরদুয়েক আগেই সে ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকেছিল । অফিসার র‍্যাঙ্ক, ভাল মাইনে, কলকাতায় পোস্টিং, সাথে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধে । দুই বাড়ি থেকে দেখে-শুনে ওদের বিয়ে পাকা হয়ে গেল ।

বিয়ের মণ্ডপে ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময় জোড়া পানপাতার আড়াল থেকে যখন আলোর সুগভীর চোখদু’টো নয়নের দিকে চাইল, সে কেমন একটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল ! সাত পাক, সিঁদুরদান, বাসি বিয়ের পর এল বাড়ি ফেরার পালা । আলোর কান্নাকাটির বহর দেখে সেদিন নয়ন সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল ।

আলোদের ভবানীপুরের বাড়ি থেকে নয়নদের যাদবপুরের বাড়ি পৌঁছনোর সময় গাড়ির মধ্যেই আলো বারে বারে ডুকরে কেঁদে উঠছিল । নয়ন ভেবেছিল, বাবা-মাকে ছেড়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে নতুন সংসারে চলেছে বলেই কাঁদছে সে । তার মন হালকা হবে – এই ভেবে সে আর তাকে কাঁদতে বাধা দেয়নি সেদিন ।

সে তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, আলোর ঐ কান্না ছিল চরম আক্ষেপ ও চূড়ান্ত হতাশার কান্না ! কারও জীবনে ভয়ঙ্কর ব্যর্থতা এসে যখন সমস্ত দ্বাররুদ্ধ করে দিয়ে তাকে তার অনিচ্ছার পথে চলতে নিতান্ত বাধ্য করে দেয়, সেসময় মানুষের পক্ষে এইরকম কান্না ছাড়া দুঃখপ্রকাশের আর রাস্তা থাকে না ।

এরপর কালরাত্রি কোনওমতে কাটিয়েই পরদিন বাড়িতে বউভাতের অনুষ্ঠান, তাদের ফুলশয্যার রাত ! অজস্র কামনা-বাসনা মনের ভিতরে চেপে রেখে নয়ন দেখল, সবার সাথে হাসিমুখে দৃষ্টি-বিনিময় করে আলাপচারিতা করছে আলো, নিরীহ গৃহবধূর মত নম্র স্বভাবে অনুষ্ঠানের আচারাদি পালন করছে, নিমন্ত্রিত পরিজনদেরকে সম্মান ও আপ্যায়ন করছে ।

সে তার নববধূর ভূমিকাপালনে অভিভূত হয়ে গেল ; একদিকে আলো যেমন নিজের বাড়িতে শেখা সংস্কারের মান রেখেছে, অন্যদিকে তেমনি শ্বশুরবাড়ির লোকেদেরও যথোচিত সম্মান করেছে ।

কিন্তু ফুলশয্যার রাতে নয়ন জানতে পারল, আলোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে হওয়া তাদের এই বিয়েটা সে মেনে নিতে পারেনি ! নয়নকে অপছন্দ না হলেও এত তাড়াতাড়ি বিয়ে-থা করে সংসার করার প্রবৃত্তি ছিল না তার । বরাবরের ভাল ছাত্রী আলো গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরি করতে চেয়েছিল । তার ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল নিজে অর্থ উপার্জন করে জীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার ।

তবে তার স্বাবলম্বনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সমকালীন সমাজের রক্ষণশীলতা । মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের শিক্ষিত হওয়ার পরও একটাই গতি থাকে – বিয়ে করে গৃহবধূ হওয়া, আপন ইচ্ছা-অনিচ্ছার বলি দিয়ে পরনির্ভরশীল বৈবাহিক জীবন কাটানো, অবশেষে সন্তান উৎপাদন ও তাদের লালনপালন ! সুতরাং সে-ই বা এ-নিয়মের ব্যতিক্রম কেন হবে ?

আলো সমাজের এই প্রথাগত রীতি-নীতির পরিপন্থী ছিল । তার বিশ্বাস ছিল, সামর্থ্য ও যোগ্যতা থাকলে মেয়েদেরও আত্মনির্ভর হয়ে ইচ্ছেমত বাঁচার অধিকার থাকে । লেখাপড়া শিখেও কেন একটি মেয়ে কেবলমাত্র সমাজের রীতি পালন করার জন্য নিজের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেবে ? সেও তো জীবনের আরও অন্যান্য দিকগুলোকে অন্বেষণ করতে পারে !

কিন্তু আচার-বিচার ও ধর্মীয় সংস্কারের চোখরাঙানি তাকে বাধ্য করেছিল এই বিয়েতে রাজি হতে । তার সমস্ত ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল বিয়েটা হওয়ার ফলে । প্রচণ্ড আঘাত পেল সে, বুঝে গেল, মনের ক্ষোভ-দুঃখ মনেই চেপে রেখে হাসিমুখে থাকার অভিনয় করে যেতে হবে সারাজীবন !

নয়ন বিষয়গুলো নিয়ে কখনও সেভাবে ভাবেনি । বাড়িতে মা-কাকিমাদের কিংবা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে দেখেছে, মেয়েরা শিক্ষিত হলেও গৃহবধূই হয়, নিজের স্বামীর উপরই সবকিছুর জন্য তাদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় ; ‘মেয়ে’ থেকে ‘বধূ’ হয়ে মাতৃত্ব অবধি সেই রাস্তায় এমন কোনও অবলম্বন নেই, যার সাহায্যে তারা ‘নারী’ হয়ে উঠতে পারে ! এই ধারণা ও পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা নয়নেরও চাহিদা ছিল, আলো যেন তার স্ত্রী হয়েই থাকে, তার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এক গৃহবধূ ।

সে আলোর নারীত্ব চেয়েছে শুধু তারই জন্য – সকলের আড়ালে, রাতের অন্ধকারে, একান্ত বিছানায় ! তার ভিতরকার সেই নারীর সুবাস ও নির্যাস আহরণ করবে শুধুমাত্র সে । মোহময়ী ঐ নারীত্বের ছিটে-ফোঁটাও যেন আর কেউ দেখতে না পায় – এই ছিল নয়নের সাধ ।

আলোর প্রতি নয়নের অনুভূতিতে ভালবাসার সাথে পুরুষত্বের স্বাভাবিক কামনাগুলোও মিশ্রিত ছিল, যেগুলো একজন নারীকে শাঁখা-সিঁদুরের শৃঙ্খলে জড়িয়ে পুরুষের দমনের অধীন করে রাখে !

অন্যদিকে, আলোর মনের ইচ্ছেগুলোর অপূর্ণতা যেমন নয়নের প্রতি তার স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসা ফুটে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি তা সমাজে প্রচলিত বিবাহ-বন্ধনের তথাকথিত প্রথা-পদ্ধতির দ্বারা কোনওরকম দমন-বাঁধনের প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে !

আলোর কথায় ও ব্যবহারে অন্তরে আঘাত নয়নও পেয়েছিল ভীষণ । সে যতবারই নানাভাবে চেষ্টা করত আলোকে স্ত্রী হিসেবে পেতে, ততবারই আলো তাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিত ! লোকলজ্জার ভয়ে সে গৃহবধূর আচরণবিধি মেনে চলত ঠিকই, কিন্তু স্ত্রীর ভূমিকা থেকে বিরত থাকত সবসময় । নিজেকে সে আরও গুটিয়ে নিয়েছিল নিজের মধ্যেই । সে ছিল একজন আদর্শ গৃহবধূ, কিন্তু নয়নের স্ত্রী হয়নি কখনওই !

ওদিকে, ক্রমাগত প্রত্যাখ্যাত হতে হতে নয়নও এই সম্পর্ক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে আরম্ভ করল । সেও লোকলজ্জার ভয়ে সংসারধর্ম ও স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যে কোনও ঘাটতি রাখত না, তবুও বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে প্রাপ্য চাহিদাগুলো সে আপসে বুজিয়ে ফেলেছিল । নিজে এতটা অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগতে শুরু করেছিল যে, শেষে তার মনে হত বুঝি আলোকে কয়েদী বানিয়ে রেখেছে সে !

আস্তে আস্তে ওদের মধ্যে এক গভীর ব্যবধান গড়ে উঠেছিল ।

দু’জনের চিন্তাধারার ভিন্নতা ওদেরকে সেসময় এক হতে দেয়নি । ফলে ওদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর ভিতরকার বৈবাহিক রসায়ন তৈরীই হয়নি ! লোকসমাজে সম্মানরক্ষার তাগিদেই কেবলমাত্র ওরা ভালভাবে থাকবার একরকম অভিনয় করে যেত । এতে বাইরের কেউ বুঝতে পারত না তাদের সম্পর্কের দূরত্ব, অথচ ওরা নিজেদের থেকে ক্রমে শত আলোকবর্ষ দূরে চলে যেতে লাগল ।

তবে সেই অভিনয় ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়াও ওদের পক্ষে ভীষণ অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিল । ওরা দু’জনেই এর থেকে স্থায়ীভাবে নিস্তার পেতে চাইছিল ।

আজও নয়নের চোখের সামনে ছায়াছবির মতই ভাসে দিনগুলি ।

নয়নের তখন অফিসের কাজের চাপ প্রচুর । দেশের রাজনৈতিক ও নানাবিধ আর্থ-সামাজিক উত্থান-পতনের ফলে ব্যাঙ্কিং ইনডাস্ট্রিতে ব্যাপক রদবদল শুরু হয়েছিল । পরিকাঠামোয় ও নতুন আঙ্গিকে ব্যাঙ্কিং ইনডাস্ট্রিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছিল । সেসময় প্রায়ই তার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত ।

এদিকে শহর কলকাতাও বহুল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল । দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালানোর প্রস্তুতি আরম্ভ হল, গঙ্গা পারাপারের জন্য দ্বিতীয় হুগলী সেতু তৈরীর কাজ জোরকদমে এগিয়ে চলল, আরও কিছু ফ্লাইওভার ও হাই-রাইজ়ের আড়ালে ঢেকে যেতে শুরু করল কলকাতার জলছবি ।

এরইসঙ্গে শিল্পসমাজ বড় বড় লোনের জন্য পুঁজিপতিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে ব্যাঙ্কের কাছে হাত পাততে আরম্ভ করল । ফলে ভারতীয় ব্যাঙ্কিং-এ পুনর্বিন্যাস ও বিপ্লবের সূচনা হল ।

এরকমই একটা সময়ে এক ব্যস্ত বুধবারের সন্ধ্যায় নয়ন অফিসে নিজের ডেস্কে বসে নিবিষ্টমনে কাজ করছিল । জুনমাসের ভ্যাপসা গরমের হাত থেকে শেষবিকেলের একপশলা বৃষ্টিটা খানিক রেহাই দিয়ে এইমাত্র থামল ! বাজ পড়ার শব্দে চমকে উঠে সে পিছনের জানলাদু’টো বন্ধ করে দিয়েছিল, বৃষ্টি থামার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে সে-দু’টোকে আবার খুলে দিল । একরাশ বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা হাওয়া ঝির্‌ঝির করে এসে তার মুখে-চোখে হাত বুলিয়ে দিল, সাথে কিছুটা জলীয় বাষ্প তার শরীরের উন্মুক্ত অংশগুলোতে স্নিগ্ধ শীতল স্পর্শ করে গেল ।

এখান থেকে বাইরে তাকালে গঙ্গা দেখা যায় । সন্ধ্যার আবছা আলোয় গঙ্গাবক্ষে অজস্র নৌকা ও স্টীমার নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে । তাদের টিম্‌টিমে বাতিগুলি যেন অন্ধকার আকাশে তারাদের মেলা ! বাবুঘাটের জেটিতে দাঁড়িয়ে প্রমোদতরী ‘ময়ূরপঙ্খী’ তার জৌলুস বিকিরণ করছে । ভাঙাচোড়া স্ট্র্যান্ড রোড ধরে একের-পর এক গাড়ি বৃষ্টিভেজা রাস্তায় জমা জল দু’পাশে ফোয়ারার মত ছিটিয়ে হর্নের ধমক দিতে দিতে ছুটে চলেছে নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ।

অফিসের অন্যান্যরা বাড়ি চলে গেছে, সারা অফিসে নয়ন শুধু একা ! একটা সিগারেট ধরাল সে । কাজ থেকে বিরামের ফাঁকে এই ধূমপানটা অনেকটা ধনাত্মক অনুঘটকের কাজ করে । অবিশ্যি চারমিনারের এই ফিল্টারলেস সিগারেটের ফ্লেভারটা সত্যিই চিরকালীন ! কলেজজীবনে স্বল্পসঞ্চয়ে বিড়ি খাওয়ার ফাঁকে মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সাথে সেও বিখ্যাত ‘উলঙ্গ চারু’ খেয়েছে, তখন থেকেই এটাই তার প্রিয় সিগারেট ।

আজ একটা বড় অঙ্কের লোনের ফাইল প্রসেস্‌ করতে পেরেছে নয়ন । ক্লায়েন্ট কলকাতায় অ্যালুমিনিয়াম ও কপারের ব্যবসা আরম্ভ করবে, সেজন্য তাদের ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়েছে । এতে তার বস্‌ তার উপর বেশ প্রসন্ন হয়েছেন, হয়ত এবারেই তার পদোন্নতিটা পাকা হয়ে যাবে । মাইনেও সেই অনুপাতে বেড়ে যাবে ।

কিন্তু কী লাভ এসবে ? তার বিবাহিত জীবন তো তছনছ হয়ে গেছে ! যাকে নিয়ে নিজের পরিবার গড়ে তুলতে চেয়েছিল, সে তো তার হয়ইনি আজ পর্যন্ত ! বিছানার চাদরে কেবল দু’টি মানুষের পাশাপাশি ঘুমিয়ে থাকার ভাঁজ, তাদের শারীরিক সংসর্গের কোনও চিহ্নমাত্র নেই । আলোর কাছে সে শুধুমাত্র সামাজিকভাবে স্বীকৃত স্বামী, তার আপনজন নয় । ভালবাসা দিলে যদি তা পাওয়াও যায়, তবে সে কেন এখনও আলোর ভালবাসা পেল না ? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে নারী-স্বাধীনতার আন্দোলনে ওরা যেন দুই বিপক্ষ যোদ্ধা ! নারীদেরকে পুরুষরা যে এতদিন ধরে দমিয়ে রেখেছে, সেটার জন্য তো আর নয়ন দায়ী নয় । অথচ তার সাথেই এমনটা হতে হল !

জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে এসবই চিন্তা করছিল নয়ন । এটা এমন অদ্ভুত সমস্যা, এরকম একটা দুঃখ যে, মন খুলে কাউকে বলাও যায় না, আবার প্রাণখুলে কাঁদাও যায় না ! দৈনন্দিন জীবনে যে তাকে সুখী থাকার এমন অভিনয় করে যেতে হবে, সেটা সে কখনও ভাবেইনি । বাড়িতে বোধ করি কেউ জানেও না তাদের ব্যাপারটা, অন্ততঃ মা-বাবা কিংবা দাদা-বৌঠানের হাবেভাবে তো সেরকম মনে হয় না । আর, বোন-ভগ্নীপতিকে এসব কথা বলে ওদের সুখী দাম্পত্যজীবনে নতুন কোনও ধাঁধার সূত্রপাত না ঘটানোই ভাল ।

একবার সে ভাবল, আলোর বাবা-মাকে গোটা ব্যাপারটা খোলসা করে জানাবে ; তাঁদের মেয়েকে তাঁরাই বুঝে নিন । পরক্ষণেই তার মনে হল, ওঁরা তো আলোকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছেন, উপযুক্ত সংস্কারের তালিম দিয়েছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, বাবা-মা হিসেবে নিজেদের কর্তব্য যথার্থ পালন করেছেন । সুতরাং সেই বাবা-মায়ের ‘সন্তান’ আলো আজ ‘ব্যক্তি’ আলোতে পরিণত হয়েছে, তার নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা থাকাটা স্বাভাবিক । সে এখন তার স্ত্রী, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন তারই ; সেই মানুষটার শুধু সৌন্দর্যটুকু আপন করলেই তো চলবে না, তার অন্তরের ক্ষোভ-দুঃখ-চাহিদা-আকাঙ্ক্ষাগুলোকেও তো নিজের বলে ভাবতে হবে ! তাই পিছিয়ে আসে নয়ন ।

কিন্তু এভাবেই বা দিনের-পর দিন থাকা যায় নাকি ? এত কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা যে তার নেই ! মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া অপরাধ নয়, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সার্থক হয়নি বলে স্ত্রী হিসেবে নিজের উপর স্বামীর স্বাভাবিক অধিকারটুকু না দেওয়া গার্হস্থ্য অপরাধ তো বটেই ! দিনের প্রতিটা মুহূর্ত, রাতের প্রতিটা ক্ষণ এই একই বিষয় তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে । একই ভাবনা, একই দুশ্চিন্তা, একইরকম প্রত্যাখ্যানের অনুভূতি নয়নকে কুড়ে কুড়ে খায় । অফিসেও তো তার পরেও অনেকে বিয়ে করেছে, কই তারা তো দিব্যি সুখেই আছে, ঘুরতে যাচ্ছে, দু’-একজনের তো বাচ্চাও হয়ে গেছে । কারওর স্ত্রীর মানসিকতা তো আলোর মত নয় !

মাথার দু’পাশটা আবার দপদপ করছে । মনের উপর বেশী চাপ পড়লেই ব্যথাটা শুরু হয় । মাসতিনেক ধরে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে নয়ন । একবার তো জ্ঞান হারিয়ে অফিসের বাথরুমে প্রায় পড়েই গিয়েছিল সে ! কলিগরা মিলে ধরাধরি করে তাকে পাখার নীচে চেয়ারে বসিয়ে জল-টল খাইয়ে হাওয়া করে কোনওমতে সুস্থ করে তোলে । অবশেষে ব্যাঙ্কের ডাক্তারবাবুকে ডাকা হলে তিনি ওষুধ দিয়ে তাকে সারিয়ে তোলার ব্যবস্থা করেন ।

চোখের চশমাটা ঠিক করে নাকের উপর বসিয়ে আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত চারমিনারে একটা বড় টান দিয়ে বুক ভরে ধোঁয়াটা নিজের ফুসফুসের ভিতর নিল নয়ন, তারপর আয়েশ করে বাইরে ছাড়তেই হঠাৎ পিছন থেকে কীসের একটা শব্দে চমকে ঘুরে তাকাল সে ।

ফাঁকা অফিসের হলঘর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা টেব্‌লের উপর ফাইলপত্রের স্তূপ আর দেওয়াল বরাবর আলমারীর সারি । মাথার উপর পাখাটা বনবন করে ঘুরছে । জ্বলন্ত টিউবলাইটের ফ্রেমটার ফাঁকফোকর দিয়ে কয়েকটা টিকটিকি দেওয়াল বেয়ে এদিক-ওদিক চলাফেরা করছে ।

নয়ন সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে টেব্‌লে রাখা অ্যাশ-ট্রেতে সেটা ঘষে কৌতূহলভরে হলঘরের মাঝখানটায় এসে দাঁড়াল । শব্দটা কীসের, সে বুঝতে পারেনি, তবে সে নিশ্চিতভাবেই শুনেছে শব্দটা । অলক্ষ্যে কিছু একটা কাছাকাছির মধ্যে দিয়ে গেলে অনেকটা সেরকম শব্দ হয় !

সে টেব্‌ল-চেয়ারগুলোর নীচে ও চারপাশে, আলমারীর ফাঁকায়, ঘরের আনাচে-কানাচে ভাল করে দেখল । নাঃ, এদিকটায় তো কিছু মনে হচ্ছে না, তা’হলে শব্দটা কীসের ? হলঘরের বাইরে করিডোর ও বাথরুমে গিয়ে কি দেখবে একবার, কিংবা বসের ঘরে ?

শব্দের উৎস সন্ধানে সে এবার অদম্য এক কৌতূহল অনুভব করতে লাগল । তার মাথাব্যথা, তার কাজ, তার ব্যক্তিগত দুঃখ ও সমস্যার কথা ভুলে এখন শুধু শব্দটার স্বনক খোঁজবার তাগিদ তার মনে ।

ঐ যে, আবার হল শব্দটা, তবে ঘরের বাইরে থেকে সেটা এসেছে ।

অত্যন্ত ব্যাকুলচিত্তে নয়ন করিডোরে বেরিয়ে এল । কিন্তু এখানেও সন্দেহজনক কিছু নেই ।

চরম উত্তেজনা অনুভব করছে সে ; শব্দটার উৎস খুঁজে বের করতেই হবে, নইলে যে তার মনে শান্তি আসবে না ! একটা অদ্ভুত দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে কোন অজানার উদ্দেশ্যে যেন টেনে নিয়ে চলেছে, তার আর নিজের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই ।

করিডোরে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছে সে, হঠাৎ তার মনে হল, সিঁড়ির দিকটায় কিছু একটা চলেফিরে বেড়াচ্ছে, তার শব্দ আসছে !

উৎকণ্ঠার সাথে সে প্রায় দৌড়ে সেদিকটায় চলে এল ।

চারপাকে ঘোরানো সিঁড়ি, মাঝখানে লিফ্‌ট । এখন অবিশ্যি লিফ্‌ট বন্ধ আছে, সন্ধ্যে ছ’টার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় ।

নয়ন সিঁড়ি বরাবর নীচের দিকে তাকাল । একজন মহিলা সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নেমে যাচ্ছে ! সিঁড়ির আলোতেই দেখা গেল, লম্বাগড়নের সেই মহিলার পরনে কারুকার্য-খচিত কালো শাড়ি, মাথায় লম্বা চুলের বিনুনি, হাতে সোনার চুরি, ডানকাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ । আন্দাজে তাকে যুবতীই মনে হচ্ছে, বেশ দ্রুতপায়ে হাঁটছে সে ।

নয়ন একবার তাকে ‘এই যে ম্যাডাম, শুনছেন ?’ বলে ডাকল, কিন্তু সেই মহিলা সে-ডাকে কোনও সাড়া দিল না । অগত্যা সে তার পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করল । সে যতই জোরপায়ে নামে, ততই সেই মহিলাও তর্‌তর করে নামতে থাকে !

সিঁড়ির একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে নয়ন সিকিউরিটি গার্ডকে সতর্ক করার জন্য চেঁচিয়ে ডাকল । তার এই ডাকে বুঝি সেই মহিলা একবার থেমে তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েই আবার দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল । সে ভীষণ চমকে উঠল ঐ মহিলার মুখখানা দেখে – একদম আলোর মতই যেন দেখতে সে !

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নয়ন ।

হতভম্ব হয়ে গেছে সে । সে কি সত্যিই তার স্ত্রীকেই দেখল এখানে, নাকি কোনও সদৃশ নারী, অথবা তার দেখার ভুল ? তবে যাকে মনে-প্রাণে ভালবেসেছে, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, যার সাথে সে ঘর করছে, সেই নারীকে চিনতে তো ভুল হওয়ার কথা নয় । কিন্তু আলো এই বাদলাদিনে ভর সন্ধ্যেবেলায় তার অফিসে কী করতেই বা আসবে ? এও যে অসম্ভব !

সিকিউরিটি গার্ড তার চিৎকারে ছুটে চলে এসেছে । বিনম্রগলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে সাহেব ?’

নয়ন উত্তেজিতস্বরে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘ঐ মহিলা কে ছিল, যে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল ?’

সিকিউরিটি গার্ড অবাক-কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আমি তো কাউকেই নামতে দেখিনি সাহেব !’ তার কথায় বোঝা গেল, অফিস ছুটি হলে সবাই এই বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর কেউ ঢোকেওনি বা বেরও হয়নি ।

বিস্ময়ে নয়ন হতবাক হয়ে গেছে । ধন্দে পড়ে গেল সে – নিজের চোখকে বিশ্বাস করবে, না নিজের কানকে ? মাথার দু’পাশের ব্যথাটা আবার জেগে উঠেছে । শরীরটাও খুব একটা ভাল লাগছে না । আর নয়, এবার বাড়ি ফেরা যাক ।

সেদিন বাড়ি ফিরে সে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল । অফিসে সন্ধ্যের ঘটনাটা নিয়ে আলোর সাথে আর কথা বলা হয়নি তার । তাকে বলে আর কী হবে ?

তবে সেইরকম ব্যাপার এরপর থেকে তার সাথে মাঝে মাঝেই ঘটতে লাগল ।

প্রথম দু’-একবার বেশ বিচলিত হতে হয়েছে নয়নকে । অফিসে কাজের ব্যস্ততার মাঝে, বাসে-ট্রামে যাতায়াতের পথে কিংবা বাজারের মধ্যে হঠাৎ মাথায় দপদপ, তারপরই একটা শিহরণ-জাগানো অনুভূতি, সেইসঙ্গে খুব কাছ দিয়ে যেন কোনও চেনা মানুষের হেঁটে চলে যাওয়া – বিচিত্র সেই ব্যাপারগুলো কাউকে বলে বোঝানো যাবে না ।

ক্রমে সে লক্ষ্য করল, যখনই সে একা থাকে, বৈবাহিক জীবনের না-পাওয়াগুলোর বেদনা তার মননে কাঁটার মত বিঁধতে শুরু করে কিংবা অফিসে কাজের পাহাড়ের তলায় সে চাপা পড়ে যায়, তখনই হঠাৎ মাথার দু’পাশের ব্যথাটা কোত্থেকে যেন উদয় হয় ! তারপরই অদ্ভুত সব অনুভূতি হতে থাকে ; কখনও মনে হয়, কেউ তাকে দেখা না দিয়েই খুব কাছ দিয়ে হেঁটে চলে গেল, আবার কখনও যেন চোখে দেখতে পাওয়া ও কানে শুনতে পাওয়া প্রত্যক্ষ এই বাস্তব জগৎটাকে ভীষণ অচেনা মনে হয় । এক-এক সময় তার এমনটাও মনে হয়েছে, আলো বুঝি তার আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে, বাড়িতে অন্যরকমভাবে থাকলেও আসলে সে তাকে ভালই বাসে, সেজন্য তাকে সবসময় লক্ষ্য করে ! বিহ্বলতা, উদ্বেলতা, সংশয় – সবকিছু মিলে-মিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল তার ।

নয়ন নিজেকে ভীষণ অসহায় বোধ করতে লাগল এবার । সবসময় একটা অস্থির ভাব, একটা অন্যমনস্কতার অনুভূতি তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে ! সবকিছু করছে সে, অথচ কোনওকিছুতেই বুঝি তার উপস্থিতি নেই । নিজের দুঃখের কথা কোনওদিন সে কারও কাছে বলতে পারেনি, এবার এই অসহায়তার ব্যাখ্যাও সে কাউকে দিতে পারছে না । আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনযাপনের আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলতে লাগল সে, নিস্তেজ হয়ে পড়ল । ক্রমে সে নিজেকে একটা মানসিক আবরণের ভিতর পুরোপুরি লুকিয়ে ফেলল ।

এভাবেই কয়েকমাস কেটে গেল । ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লীতে তাঁর নিজ বাসভবনে দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হলেন । এই ঘটনায় শোকপালনের জন্য নয়নদের অফিসে নভেম্বরের কোনও এক সকালে দু’মিনিটের নীরবতা পালন চলছিল । পুরো অফিসে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য – মেঝেতে একটা আলপিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে !

এমন সময় নয়ন হঠাৎ মাথার দু’পাশে আবার সেই ব্যথাটা অনুভব করল । প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই করিডোর থেকে খুব চেনা কোনও নারীকণ্ঠের গলাখাঁকারি শুনতে পেল সে ! খুব স্পষ্ট সেই শব্দে এমন এক অমোঘ আকর্ষণ ছিল যে, সে তৎক্ষণাৎ বাইরে বেরিয়ে এল ।

করিডোরের শেষপ্রান্তে সশরীরে দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী । পরনে আগেরদিনের মতই সেই কারুকার্যময় কালো শাড়ি, লম্বা ঘন কালো চুলের বিনুনি কোমরের নীচ অবধি গেছে, দু’হাতে সোনার চুরি, ডানকাঁধে ঝুলছে একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ ।

নয়নের শিরদাঁড়া বেয়ে চমকের শিহরণ খেলে গেল, অভিভূত হয়ে গেল সে আলোকে দেখে – যেন পরমাসুন্দরী কোনও অপ্সরা হাসিমুখে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ! টানা-টানা দু’টি পটলচেরা চোখে কাজল, সিঁথিতে সিঁদুর, গৌরবর্ণ দেহাঙ্গের সুঠাম গড়নে আজ আলোকে সত্যিই ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে ।

নয়নও হাসিমুখে এগিয়ে গেল তার দিকে, কাছে গিয়ে বিস্মিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এখানে ?’

মিষ্টিস্বরে আলো জবাব দিল, ‘তোমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছিল, তাই চলে এলাম ।’

এ কী শুনছে নয়ন ? নিজের কানকে যে বিশ্বাসই হচ্ছে না তার ! আলো তার সাথে দেখা করতে তার অফিসে চলে আসবে – এমনটা সে স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি ।

আলো এবার অভিযোগের সুরে বলল, ‘বাড়িতে তো তুমি আমার সাথে কথাই বলো না !’

নয়ন এ-কথার কোনও জবাব দিল না, হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলল, ‘ভিতরে এসো ।’

আলো সামান্য মাথা নাড়িয়ে অনুরোধের সাথে বলল, ‘চলো না, কোথাও ঘুরে আসি !’

নয়ন দ্বিধাভরা গলায় বলল, ‘এখন তো আমার কাজ আছে অফিসে । এখন কীভাবে বের হই ?’

আলো উত্তরে কিছু বলল না, কেবল দু’চোখে করুণ চাহিদা নিয়ে নয়নের দিকে তাকিয়ে রইল ।

প্রেম-ভালবাসার সম্পর্কে অধিকাংশ সময়ই কথার চেয়ে চোখের দৃষ্টি অনেক বেশী বাঙ্ময় ও জোরালো হয় । আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে নয়নও সেই জোরটা অনুভব করল । সেইসঙ্গে বহুকাঙ্ক্ষিত ভালবাসার দাবিপূরণের সুযোগ পেয়ে অল্পক্ষণ ভেবে নিয়েই সে সিদ্ধান্ত নিল অফিস থেকে আধবেলা ছুটি নেওয়ার ।

নয়নের ভাব-ভঙ্গি দেখে তার অফিসের লোকেরা অবাক হয়ে গেছে, বেশ ঘাবড়েও গেছে । এত ভাল ও সুদক্ষ একজন কর্মী আচমকা এহেন আচরণ করলে নামী সংস্থার ক্ষেত্রে তা অনেক সময় বদনামের কারণ হয় । যদিও এই অফিসটা তাদের ব্যাঙ্কের একটি প্রশাসনিক কার্যালয়, এবং এখানে টাকা-পয়সা লেনদেন বা গ্রাহক পরিষেবার কাজ খুবই কম হয়, তবুও সে-সম্পর্কিত একটা ঝুঁকি থেকেই যায় ।

নয়নের অফিস থেকে বেরিয়ে ওরা দু’জন প্রথমেই বাবুঘাটে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে বসল । শীতের সকালের আমেজ তখনও গঙ্গাবক্ষে ভাসমান নৌকাগুলিকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে । জলের তির্‌তিরে ঢেউয়ের উপর টুকরো টুকরো রোদের ঝিলিক সোনার কণার মত ছড়িয়ে রয়েছে । গঙ্গার ওপারে হাওড়ার কলকারখানাগুলোর কালো ধোঁয়া, হাওড়া স্টেশনের আড়াল থেকে রেলগাড়ির স্টীম ইঞ্জিনের সাদা ধোঁয়া আর গঙ্গার জলের উপর ছেয়ে থাকা কুয়াশার হালকা হয়ে যাওয়া আবরণ মিলে এক মায়াবী দৃশ্যালোক সৃষ্টি করেছে !

ভাঁড়ের গরম চায়ে চুমুক দিয়ে নয়ন বলল, ‘কীসে এলে ?’

আলোও তার ভাঁড়ে একচুমুক দিয়ে উত্তরে বলল, ‘তুমি যেভাবে আসো, অনেকটা সেভাবেই ।’

নয়ন আলোর কৌতুকে বহুদিন পর প্রাণখুলে হাসল । আলোও তার সাথে ছন্দ মিলিয়ে নিজের মুক্তঝরানো হাসি যেন চারিদিকে বিলিয়ে দিল !

আলোর সাথে গল্প করতে খুব ভাল লাগছে নয়নের । আলোও বেশ খুশীমনে তার সাথে কথা বলছে । ‘এতদিন এই আনন্দটা থেকে কেন বঞ্চিত করে রেখেছিলে, ভগবান –’, মনে মনে প্রশ্ন করল নয়ন । চা খাওয়া শেষ হলে গল্প করতে করতেই ওরা হাঁটা শুরু করল ময়দানের উদ্দেশে । তারপর সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া ঘুরে ধর্মতলার এক রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়া সেরে আলোকে যাদবপুরের বাসে তুলে দিয়ে নয়ন আবার তার অফিসে ফিরে এল ।

অনেক জমানো কথা একে-অপরের কাছে উজাড় করে দেওয়ার মাধ্যমে সেদিন ওরা যেন নতুন করে নিজেদের ভিতরকার প্রচ্ছন্ন ভালবাসাকে খুঁজে পেয়েছিল !

মনে একরাশ ভাললাগা মাখিয়ে কাজের ফাঁকেও নয়ন আলোর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলির কথাই চিন্তা করছিল । তবে একটা বিষয় ওরা লক্ষ্য করেছে – শহরে ঘোরাঘুরি করার সময় রাস্তায় মানুষজন ওদের দেখে অবাকদৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছিল । নয়ন ভেবে দেখল, প্রকাশ্যে কোনও প্রেমিক-যুগলকে দেখে লোকেরা ঐরকমভাবেই তাকিয়ে থাকে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই । দেখুক গে, তাই বলে তো আর জনে-জনে বোঝানো সম্ভব নয় যে ওরা স্বামী-স্ত্রী, কোনও অবৈধ সম্পর্ক বা পরকীয়ায় জড়িত নয় !

সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরে সে আরেকটি চমকের সম্মুখীন হল । খুশীর রেশ নিয়েই সে আলোকে তার সাথে শহর ঘুরতে কেমন লেগেছে তা জিজ্ঞাসা করল । তার অভিলাষ ছিল, আলো খুব ভাল কোনও বিশেষণ প্রয়োগ করবে নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ।

কিন্তু সে মুখ হাঁ করে হতবাক হয়ে নয়নের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর জানাল, তার অফিসে যাওয়া তো দূর অস্ত, সে আজ সারাদিনে বাড়ি থেকেই বের হয়নি !

সে যতবারই তার স্ত্রীকে বাবুঘাট-ময়দান-ভিক্টোরিয়া-ধর্মতলার কাহিনী শোনায়, ততবারই আলো দৃঢ়তার সাথে সেসব জায়গায় নয়নের সঙ্গে নিজের উপস্থিতি অস্বীকার করতে থাকে ।

এমন অপ্রত্যাশিত চমকের জন্য নয়ন প্রস্তুত ছিল না । তার মনে হল, এতদিন ধরে আলো নিজেকে ঘিরে যে ব্যক্তিসত্তার আবরণ তৈরী করেছে, সেটা ভেঙে বেরিয়ে আসার কোনও প্রবৃত্তি তার নেই ।

ওদিকে নিজের জীবনে অসুখী আলোর নয়নের ঐ কল্পনাকে নিছকই সস্তা ও মনগড়া মনে হল । তার স্বামীর ছেলেমানুষির জন্য আপনমনেই সেও অপ্রস্তুত বোধ করল ।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেদিন ওদের বাগবিতণ্ডা চলেছিল সত্য-অসত্যের বেড়াজাল নিয়ে, যা অবশেষে তাদের মনোমালিন্য আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিল । নয়নের আচরণে ও কথার অবাস্তবতায় আলো অপমানিত বোধ করল । আর, আলোর কথার দৃঢ়তা নয়নের মনে উদ্রেক করল অসম্মান ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এক অদ্ভুত মিশ্রণ ।

কিন্তু বাস্তব যা-ই হোক, এরপর থেকে প্রায়ই নয়নের কাছে আলো এসেছে সেই একই বেশভূষায় ! প্রতিবারই তার অভিমান ভেঙে আলো তার সাথে খোলামনে মেলামেশা করেছে, অজস্র গল্প করেছে, ঘুরেছে শহরের পথে পথে । অন্যদিকে, বাড়িতে আলোর সম্পূর্ণ বিপরীত রূপ নয়নের হৃদয়ে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে তার অন্তরকে ।

একসময় নয়ন এই আনন্দ ও আঘাতের অনুভূতির ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল । মনের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই করে পরিশেষে সে মেনে নিল একই আলোর দুই ভিন্ন রূপ – একদিকে মন খুলে গল্প-হাসি-মজা করা প্রাণের বন্ধু, অন্যদিকে রাশভারী মিতভাষী বিবাহিত স্ত্রী । তার কাছে তখন বাড়ির বাইরের আলো অনেকটা গুমোট আবহাওয়ায় খোলা হাওয়ার মত ; যথারীতি সেই আলোকেই তার পছন্দ ছিল । ঘরের আলো তার বড়ই অপছন্দের ! তাকে সে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা শুরু করল ।

এরপর থেকে ওরা বাড়ির বাইরে দেদার আনন্দ-ফূর্তি করত, অথচ বাড়িতে একে-অপরের সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলত না ! সংসারের রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের একেবারে চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল ওরা ।

তথাপি একটা গোটা বস্তু দু’টুকরো হয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার সামান্য কিছু বাকি ছিল তখনও ।

আলো বাইরের বাগান থেকে মুখ ফিরিয়ে নয়নের দিকে একঝলক দেখল । হুইলচেয়ারে আসীন তার কাকাবাবুকে নিয়ে তারই সাথে তাল মিলিয়ে সেও হেঁটে চলেছে রাজভবনের অলিন্দে । আজ সে পরে এসেছে আলোর দেওয়া বেইজ রঙের স্যুট-কোট ও গাঢ় নীল শার্ট, চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে । মাথার ঢেউখেলানো সাদা চুলের বাহার ও দাড়ি-গোঁফ কামানো মুখের কোঁচকানো চামড়ার সমান্তরাল ভাঁজগুলোও সেই সাজের সঙ্গে মানিয়ে গেছে । বার্ধক্য তাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলেও রিমলেস্‌ চশমার আড়ালে তার দু’চোখের প্রগল্‌ভতার মুগ্ধতায় আলো আজও মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় !

বিয়ের আগে সে তার দিদির হাতে একবারই নয়নের ছবি দেখেছিল, তবে সেই সাদা-কালো ছবিতে একজন স্মিতহাস্যময় যুবকের চোখদু’টিই তাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করেছিল । নামটা একদম যথাযথ – “নয়ন”, গভীর ভরাট চোখ ! পাত্রপক্ষের সামনে মাথানত করে যখন সে বসেছিল, বহু যত্নে মনের উদ্দীপনা সংবরণ করে সে তার দৃষ্টির পরিধি বাড়িয়ে নয়নকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল । হয়ত সেটাই ছিল ভালবাসা, নইলে নিজের জীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে সে এ-বিয়েতে রাজি হয়েছিল কেন ?

ঐ যোগসূত্রটুকুই আলোকে সামাজিক নিয়মের বাঁধনে নয়নের স্ত্রী হিসেবে মান্যতা দিয়েছিল, একজন স্বাধীনচেতা নারীর সমাজের বিরুদ্ধে খেলাফৎ করার আস্পর্ধা থেকে বিরত রেখে তাকে সমাজের রোষ থেকেও বাঁচিয়েছিল । শুধু তা-ই নয়, নয়নের পরিবারের ভালবাসা তাকে “আলোকিতা চক্রবর্তী” থেকে “আলোকিতা দত্ত” হতে বাধ্য করেনি কোনওদিন, বান্ধবীদের সাথে মেলামেশায়ও তার প্রতিবন্ধকতা ছিল না এই বাড়িতে । সেইসময় মধ্যবিত্ত যৌথ বাঙালী পরিবারের গৃহবধূরা এতটা স্বাধীনতা পেত না, যতটা আলো পেয়েছিল তার শ্বশুরবাড়িতে ।

কিন্তু ছোট থেকে বাড়িতে মাকে এবং বড় হয়ে দিদিকে তার শ্বশুরবাড়িতে যেসমস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেখেছে সে, তার থেকেই নয়নের প্রতি নিজের ভালবাসাকে চাপা দিয়ে বিবাহিত স্বামীর বিরুদ্ধে তার ভিতরকার বিদ্রোহিনী নারী সাংসারিক কর্তব্যের আড়ালে নিজের প্রভাব ফেলতে লাগল । ফলে সেও আপন আবরণে জড়সড় হয়ে গেল, নিজেকে পেঁচিয়ে তৈরী করল এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর, যেন নিজের ঘরেরই এক অন্ধকার কোণে লুকিয়ে পড়ল তার অবয়ব !

গার্হস্থ্যজীবনে অভিনয় চলে না ; হয় মন দিয়ে সংসার করতে হয়, নতুবা বিবাহ-বন্ধন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয় । কিন্তু আলো মনের জটিলতাকে অন্তরালে রেখে সমাজের চোখে সুখে সংসার করার অভিনয় করেছে, নয়নকে তার স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে, নয়নের প্রতি তার ভালবাসাকে সমাধিস্থ করেছে, সুখী সংসার পেয়েও সে তার অদ্ভুত অযাচিত ধারণা ও পুরুষসমাজের প্রতি ছদ্ম-বিতৃষ্ণার বশবর্তী হয়ে সেসবের মর্যাদা রাখেনি ।

ফলস্বরূপ, একটা সময় এমন এল, যখন নয়ন তার থেকে দূরে চলে যেতে আরম্ভ করল । ওদের মন-কষাকষি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে গেল যে, ওদের মধ্যে কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গেল । একই সংসারে থেকে এক বিছানায় শুয়েও ওরা যেন স্বামী-স্ত্রী নয়, দু’টি গুটিপোকা – নিজ নিজ আবরণের ভিতরে থেকে কেবল দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে চলেছে, সেইসঙ্গে নিজেদেরকে একে-অপরের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে লেগেছে !

এদিকে সমাজ তাদের সন্তান-সম্ভাবনার প্রতি উন্মুখ হতে আরম্ভ করল । ঘরে-বাইরে পরিজন-প্রতিবেশীদের প্রশ্নের তাড়নায় এবং আড়ালে বন্ধ্যাত্বের তকমা পেয়ে আলো যারপরনাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল ।

এই পরিস্থিতিতে তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন তার শ্বশুর-শাশুড়ি । সকল প্রশ্ন ও কৌতূহলী নজরকে জবাব তাঁরা দিলেন – ওরা যখন সময় বুঝবে, তখন ঠিক সন্তান নিয়ে নেবে, তাদের ব্যাপারে বাইরের লোকের এত আগ্রহী হওয়ার কোনও দরকার নেই ।

সেদিন আলোর চোখে জল এসে গিয়েছিল । যে পরিবারকে সে পুরোপুরি আপন করেনি, সেই পরিবারই তাকে রক্ষা করল ! সেই পরিবারের মানুষগুলিকে তার হঠাৎ ভীষণ আপন বলে মনে হতে লাগল । এতদিন ধরে পুষে রাখা তার মনোভাব এবার তাকে প্রায়শ্চিত্তের দিকে ঠেলে দিল । সে অনুভব করতে লাগল, তার ভিতরের সেই বিদ্রোহিনী নারীকে পরাস্ত করে একজন গৃহবধূ জেগে উঠছে ! নয়নের প্রতি তার সুপ্ত ভালবাসা ক্রমে মাথাচাড়া দিচ্ছে, এমন সময় একদিন অফিস থেকে ফিরে নয়ন দাবি করল, আলো নাকি সেদিন তার অফিসে গিয়েছিল !

নয়নের এমন দাবি আলোকে যথেষ্ট বিচলিত করল । অনেক না-বলা কথা ঝগড়ার আকারে বেরিয়ে এল । তাদের মনোমালিন্য আরও কয়েক ধাপ বেড়ে গেল ।

প্রথমদিকে নয়নের অমন দাবি আলোর মনে অপমানের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল । তার অন্তরের অনুতাপ থেকে স্বামীর প্রতি ভালবাসা জেগে উঠতে শুরু করলেও মনগড়া কথা বলে তাকে মিথ্যেবাদী প্রতিপন্ন করে তার আত্মসম্মানকে তো নয়ন ক্ষুণ্ণ করতে পারে না!

কিন্তু যত দিন এগোল, সে অনুধাবন করতে লাগল, নয়ন অন্য কোনও নারীর সংস্পর্শে আসতে শুরু করেছে ! বিবাহ-বহির্ভূত ঐ সম্পর্কের কথা নিশ্চিতভাবেই সে স্বীকার করবে না, জানে আলো । সবচেয়ে সন্দেহজনক বিষয়টি হল, নয়ন দাবি করে, তার সেই অন্য নারী আসলে আলো নিজেই ; সে বাড়িতে হয়ত লোকলজ্জার ভয়ে নিজেকে খোলসে আবৃত রাখে, তবে বাইরে সে উন্মুক্ত জলপ্রপাত !

নয়নের কথাবার্তা আলোকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলল । এই দুর্ভাবনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার রাস্তা খুঁজতে গিয়ে দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে গেল সে ! অবশেষে সেই ভাবনায় দিশা এল মহাকরণে কর্মরতা তার এক বান্ধবীর কথায়, যার কাছ থেকে সে জানতে পারল, নয়নকে সে কফি হাউজ়ে দু’কাপ কফি নিয়ে একা-একা বসে কথা বলতে দেখেছে !

বান্ধবীর কথায় হতভম্ব হয়ে গেল আলো । এ কী শুনছে সে ? এতদিন ধরে নয়নের প্রতি তার বিরূপ আচরণ যে তার বিরুদ্ধে এইভাবে আত্মপ্রকাশ করবে, সেটা সে কক্ষনো ভাবেনি । নয়ন নির্জনে একা-একা কথা বলছিল – এ তো পাগলের কীর্তিকলাপ ! মনে আঘাত পেয়ে শেষে সে কি উন্মাদ হয়ে গেল ?

এদিকে, সে নিজেই নয়নকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার পথ খোলা রাখেনি । অভিনয়ে তো এরকমই হয় – মঞ্চে প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রীর নির্দিষ্ট ভূমিকা ও সংলাপ, কিন্তু তার বাইরে সবাই সেই বুনট থেকে মুক্ত !

আলোর এই উভয়সঙ্কটে তাকে সঠিক রাস্তা দেখাতে পারেন একজনই, তিনি তার কাকাবাবু, বিখ্যাত মনোবিদ ডঃ অঞ্জন চক্রবর্তী । সে বাধ্য হয়ে অবশেষে তাঁরই শরণাপন্ন হল ।

আলো চোখের জল নিয়ে তাঁর কাছে নিজের দোষ সব স্বীকার করল, বলল, ‘কাকাবাবু, আমার সংসারের সর্বনাশ আমি নিজে হাতে করেছি !’

ডঃ চক্রবর্তী তাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘নয়নের প্রতি যদি তোর মনে ভালবাসা থাকেই, তা’হলে ওকে আপন করে নে । তোর ধারণায় কোনও ভুল নেই, ভুল ছিল তোর আচরণে । এতদিন তুই শুধু ছিলি আমাদের বাড়ির মেয়ে, এখন তুই তোর শ্বশুরবাড়ির ছোটবউ, এরপর একদিন তুই কারও মা হবি ; তোর পরিচয় আস্তে আস্তে কত বড় হয়ে যাবে, ভেবেছিস কখনও ? নারীরা ভাবে, তারা পরাধীন, কিন্তু আসলে নারীরাই একটি পরিবারকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে । এটা পরাধীনতা নয়, সামাজিক অনুশাসন ।’

আলোকে হতদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি আরও বললেন, ‘স্বাবলম্বী হওয়া মানে কি শুধু অর্থ উপার্জন করা ? সামাজিক নিয়মে সংসারধর্ম পালন করে একটা পরিবারকে চালানো কি স্বাবলম্বন নয় ? নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রেখে সুখী দাম্পত্যজীবনের অভিনয় করে কোন স্বাবলম্বনের দিকে তুই এগোচ্ছিস ?’

অল্প থেমে তিনি আবার বললেন, ‘বিয়ের পর নিজেদের মধ্যে গল্প-খুনসুটি করা, হাসাহাসি করা, এমনকি ঝগড়া করারও প্রয়োজন আছে । মাঝে মাঝে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, বাইরে খাওয়া, এসবও দরকার । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সবসময় থাকা দরকার একটা স্বতঃস্ফূর্ত মানসিক যোগাযোগ । আর দরকার একটা সুস্থ শারীরিক সম্পর্ক ।’

কাকাবাবুর থেকে পাওয়া উপদেশগুলি আলোকে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করল । তাঁর এমন সুন্দর পথ-প্রদর্শন তার মধ্যে নিজের সংসারকে ছন্দে ফেরানোর উৎসাহ যোগাল । তাঁরই মন্ত্রণায় আলো এরপর একদিন দুপুর নাগাদ নয়নের অফিসে গিয়ে হাজির হল ।

তাকে দেখে নয়ন প্রথমে ভীষণ খুশী হল, তার চোখ দু’টো চকচক করে উঠল আনন্দে । পরমুহূর্তেই সে হঠাৎ থমকে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল । আলোর পরনে আজ হালকা লাল রঙের শাড়ি, আর সাজগোজেও বিশেষ যত্ন নেই, কেমন একটা চিন্তাগ্রস্ত উদ্‌ভ্রান্ত ভাব !

নয়নের সহকর্মীরা আলোকে ‘বৌদি, ভাল আছেন ?’ বলে সসম্মানে অভিবাদন করল । আলোও তাদেরকে হাসিমুখে পাল্টা নমস্কার জানিয়ে নয়নের টেব্‌লের সামনে রাখা চেয়ারে এসে বসল ।

নয়ন তার সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়ায় অবাক হয়ে গেল । তারা এতদিন তো আলোকে দেখে এরকমভাবে সম্বোধন করেনি ; যখনই আলো এসেছে তার সাথে দেখা করতে, সকলে নিজের নিজের টেব্‌লে বসে কাজে ব্যস্ত থেকেছে, ভাবটা এমন যেন তারা তাকে দেখতেই পায়নি ! তবে আলো বেশীরভাগ সময়ই তার সাথে বাইরের সিঁড়ির কাছে দেখা করেছে, তার টেব্‌ল অবধি সে আগে বোধ হয় একবারই এসেছিল ; সেদিন আবার পরিবহন ধর্মঘট থাকায় অনেকেই অফিসে আসেনি ।

নয়ন দ্বিধাভরা স্বরে আলোকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ তোমার কালো শাড়িটা পরনি ?’

মুহূর্তে চমকে উঠল আলো । তার তো কোনও কালো শাড়ি নেই !

পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আজ কোথাও বেরবে না ?’

নয়ন একমুহূর্ত চুপ থেকে শেষে উত্তর দিল, ‘নাঃ, আজ থাক, শরীর ভাল নেই । তবে মাথার যন্ত্রণাটা করছে না আজ ।’

চমকের পর চমক আলোকে স্তম্ভিত করে দিচ্ছে । নয়নের মাথার যন্ত্রণার ব্যাপারটা তার জানা ছিল না ।

আরও খানিকক্ষণ নয়নের অফিসে ছিল আলো । চা খেল, তারপর দু’জনে বিল্ডিং-এর বাইরে ফুটপাথে এসে দাঁড়াল । একটা সিগারেট ধরাল নয়ন । প্রথমদিকে স্বতঃস্ফূর্তি থাকলেও সে এখন খানিক স্তিমিত হয়ে গিয়েছে । আলোর কথায় বিরতি ও জড়তা থেকে সে বুঝতে পারল, আজ তার ঘরের আলোই এসেছে তার কাছে ! তার সাথে ঘুরতে যাওয়ার সেই চেনা-পরিচিত উৎসাহটা সে আজ অনুভব করছে না ।

তবে আলো এসেছিল নয়নের মনের প্রকৃত অবস্থা বোঝার উদ্দেশ্য নিয়ে । কিছু নিস্পৃহ কথাবার্তা, কয়েকটি দৃষ্টি-বিনিময়ের মুহূর্ত এবং শরীরী ভাষা ওদেরকে বুঝিয়ে দিল, ওদের মধ্যেকার ভালবাসা এখনও অবিকৃত রয়েছে, তৈরী হয়েছে কেবল মানসিক দূরত্ব । অবশেষে আলো বুঝতে পারল, নয়ন মনে মনে ভীষণ একলা হয়ে গিয়েছে তারই মত । ওরা একে-অন্যের সঙ্গী হলে তবেই দু’জনেরই একাকীত্ব কেটে যাবে ।

বাড়ি ফেরার পথে সে আবার গেল তার কাকাবাবুর কাছে । তাঁকে তার অভিজ্ঞতার কথা বিস্তারিত জানাল ।

সব শুনে ডঃ চক্রবর্তী বললেন, নয়নের ব্যাপারে তাঁর সন্দেহটা সম্ভবতঃ সঠিক, তবে তাকে সরেজমিনে পরীক্ষা করা দরকার । এর বেশী তিনি আর কিছু বললেন না তাকে ।

মাথার যন্ত্রণার চিকিৎসার বাহানায় আলো নয়নকে পরদিনই ডঃ চক্রবর্তীর কাছে নিয়ে এল ।

প্রাথমিক কুশল বিনিময় ও সৌজন্যের পর তিনি নয়নকে তার মাথাব্যথার বিষয়টা এমনভাবে জিজ্ঞাসা করলেন যে, নয়ন তাঁর কথার ভাঁজে পড়ে গিয়ে শুরু থেকে সব বলে ফেলল – বিয়ের পর আলোর ব্যবহারে আকস্মিক পরিবর্তন, এতদিন যাবৎ লোকের চোখে তাদের সুখী থাকার অভিনয়, তার মনের ও মাথার যন্ত্রণা, আলোর দুই ভিন্ন রূপের কথা ।

নয়নের কথা শুনে আলো দুঃখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘর থেকে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এল । উফ্‌, নিজের অজান্তে সে তাকে কত আঘাত করে ফেলেছে ! এতদিন ধরে নয়ন তার জন্য কত কষ্ট পেয়েছে, অথচ মনের কথা সে কাউকে বলতে পারেনি । আলোও কখনও তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেনি ! একটা ধারণার ভুল ব্যাখ্যা মাথায় নিয়ে সে তার ভালবাসার সম্পর্কটাকেই পুরোপুরি নষ্ট করতে বসেছিল । এই অনুতাপের কোনও ক্ষমা হয় না ।

নয়ন আলোকে ঐভাবে কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে যেতে দেখে বিমর্ষ হয়ে গেল । ডঃ চক্রবর্তীকে বলল, ‘কাকাবাবু, আমাদের মধ্যে ভালবাসাটা ছিলই, কেবল বোঝাপড়াটা হয়নি ।’ একটু থেমে সে সংকোচের সঙ্গে আবার বলল, ‘আমি জানি, যে আলোর সঙ্গে আমি সময় কাটাতে পছন্দ করি, ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি, যার সঙ্গ ভীষণ উপভোগ করি, বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্বই নেই, সে শুধু আমার কল্পনা ! আমার স্ত্রী এতটাও মিথ্যেবাদী নয় যে, আমার সঙ্গে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর কথা অস্বীকার করবে শুধুমাত্র সমাজের লজ্জার চোখ এড়াতে ।’

ডঃ চক্রবর্তী হতবাক হয়ে গেলেন নয়নের কথা শুনে । তাঁর অনুমান যে অভ্রান্ত, সেটা হাতে-নাতে প্রমাণ হয়ে গেল । তার কথাবার্তা ও আচরণ তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে চলেছেন এরই ফাঁকে ।

কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা ভেঙে অবশেষে তিনিই মুখ খুললেন, ‘নয়ন, তুমি যখন নিজেই নিজের সমস্যা ধরতে পেরেছ, তখন তোমার কাছে কিছু লুকোবার মানে হয় না । আমার ধারণা, তুমি প্যারাফ্রেনিয়ায় ভুগছ ।’

ওঁর কথা শুনে নয়ন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল । হতাশ গলায় বলল, ‘এটা নিশ্চয়ই কোনও মানসিক রোগ, তাই না কাকাবাবু ? খুব সম্ভবতঃ এ-রোগের কোনও চিকিৎসা হয় না ।’

‘আরে না-না,’ হেসে উঠলেন ডঃ চক্রবর্তী, ‘তুমি তো সিনেমার মত কথা বলছ !’ তারপর আবার বললেন, ‘তোমার এই সমস্যা এখন অধিকাংশের মধ্যেই দেখা যায় । দেখছই তো, আমাদের দেশ ও চারপাশের পরিবেশ কী ভয়ঙ্কর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ! খুন-ধর্ষণ-হিংসা-রাহাজানি-নাশকতা দিনের-পর দিন বেড়েই চলেছে । এরইমধ্যে আবার চীনের সাথে ঝামেলা শুরু হয়েছে । দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, বাড়ছে ধনী-গরীবের ভেদাভেদ । মানুষ খুব অস্থিরমতি হয়ে উঠছে দিন-দিন । বহু লোক নানা কারণে মানসিক অবসাদে ভুগছে আজকাল । সাধ্যের চেয়ে চাহিদা যেখানে বেশী, সেখানেই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে !’

নয়ন মন দিয়ে তাঁর কথা শুনছিল, এবার প্রশ্ন করল, ‘তা’হলে কি আমাকেও এমন বিকারগ্রস্ত হয়েই জীবন কাটাতে হবে ?’

ডঃ চক্রবর্তী তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘তোমার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হলেও অবশ্যই নিরাময়সাধ্য ।’ তারপর একটু ভেবে নিয়ে তিনি তাঁর টেব্‌লের দেরাজ খুলে একটা ইঞ্চিতিনেক লম্বা কাচের শিশি বার করে নয়নের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই বড়িগুলো প্রতিদিন রাতে ঘুমনোর আগে একটা করে খেয়ে শোবে, দেখবে, তোমার মাথার যন্ত্রণা উবে গেছে, আর মনটাও অনেক ধীর-স্থির হয়েছে । আর, আলোকে নিয়ে মাঝে-মধ্যেই এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়বে । তোমার মন যা ভাল বোঝে, তা-ই করবে । কোনও চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ।’

নয়ন ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে আলোর পাশে দাঁড়াল । তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে নরমসুরে তাকে ডাকল । আলো চোখের জল মুছে ঘুরে তাকাল নয়নের দিকে । কান্নাকাটি করে বেচারি দু’চোখ লাল করে ফেলেছে !

নয়ন তাকে সান্ত্বনাসূচক কিছু বলল না, শুধু জানাল, তার কাকাবাবু তাকে ভিতরে যেতে বলেছেন । ডঃ চক্রবর্তীর দেওয়া ওষুধের শিশিটা সে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিল বলে আলো সেটা দেখতে পায়নি । সে আবার ভিতরে চলে গেল ।

নয়নের মনে গ্লানি ও শান্তি মেশানো একটা অদ্ভুত অনুভূতি দেখা দিচ্ছে ! নিজের মানসিক অসুখের কথা বুঝে একাধারে অক্ষমতার গ্লানি তার মনকে ছেঁকে ধরেছে । আবার আলোর চোখে অনুতাপের অশ্রু দেখে তার ভালবাসা শান্তি পেয়েছে এবার । আগামী মাসে তাদের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী । দেখতে দেখতে চারবছর হয়ে গেল তাদের বিয়ের, তাদের ব্যবধানের ! গার্হস্থ্যজীবনের অম্লতা আজ অবধি কোনও মধুর স্মৃতি তৈরী হতে দেয়নি ; জানা নেই, ভবিষ্যৎ জীবনেও সুখের কোনও পদাঙ্ক অপেক্ষা করছে কিনা ওদের জন্য ।

আলো ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতেই ডঃ চক্রবর্তী শাসনের সুরে তাকে বললেন, ‘কী করেছিস ছেলেটার অবস্থা, বুঝতে পারছিস ?’

আলো অনুশোচনাসিক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমার বড় ভুল হয়ে গেছে, কাকাবাবু ! এই ভুল ক্ষমারও অযোগ্য ।’ তারপর খানিক থেমে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওর কী হয়েছে ?’

চশমার মধ্যে দিয়ে রুষ্ট চোখে তাকিয়ে কঠিনস্বরে জবাব দিলেন ডঃ চক্রবর্তী, ‘শোনবার ক্ষমতা আছে তোর ? তা’হলে শোন । নয়নের “প্যারাফ্রেনিয়া” নামক এক দুরারোগ্য মানসিক অসুখ হয়েছে !’

আলো একথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল, তার মুখে কথা সরছে না । সে অনুভব করল, আবার তার গাল বেয়ে দু’চোখের জলের ধারা নেমে এসেছে । নিজেকে চূড়ান্ত অসহায় মনে হচ্ছে তার, মাথা ঝিমঝিম করছে । কম্পমান দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ক্ষীণস্বরে বেরিয়ে এল বিস্ময়সূচক একটি ছোট্ট শব্দ, ‘কী ?’

‘এখন কেঁদে কী হবে,’ বললেন ডঃ চক্রবর্তী, ‘যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে !’

আবার কিছুক্ষণের স্তব্ধতা ঘরে এক হিমশীতল নৈঃশব্দ্য নামিয়ে আনল । চৈত্রের দাবদাহে মাথার উপরে সশব্দে ঘুর্ণায়মান পাখাটাই কেবলমাত্র পার্থিব জগতের প্রতিনিধি হিসেবে আলোকে যেন সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে !

সেই স্তব্ধতাকে খান-খান করে দিয়ে রাগত ভাবটা কমিয়ে ডঃ চক্রবর্তী গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এই রোগটা ভীষণই অদ্ভুত, প্রায় অসংজ্ঞাত । আমি ইদানীং এটা নিয়েই গবেষণা করছি । এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অবচেতন মনে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর মাধ্যমে কিছু বিশ্বাস বা ধারণা তৈরী হয়, যেগুলোকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যায় না । কারণ, সে যা বিশ্বাস করছে, সেগুলোর যেমন প্রমাণ হয় না, তেমনি তার বিশ্বাসটা যে ভুল, সেটারও কোনও প্রমাণ দেওয়া যায় না !’

আলোর মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি দেখে তিনি তার অব্যক্ত প্রশ্নটা বুঝে নিয়ে বললেন, ‘শোন আলো, আজকের তারিখে নয়নের এই অসুখের কোনও ওষুধ নেই । আসলে এই রোগটা বয়সকালে দেখা দেয়, আর বংশগতি, শিক্ষা-দীক্ষা, শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার ইত্যাদি কোনওকিছুর উপর নির্ভর করে হয় না । তবে একটা ব্যাপারে চিন্তা নেই – ওর বুদ্ধিমত্তা বা ব্যক্তিত্বের কোনও অবনতি এতে হবে না । তবুও মানসিক শান্তি পাবে বলে ওকে স্নায়ু শিথিল করার একটা ওষুধ দিয়েছি, মনে করে খাওয়াস ।’

আলো এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল ।

ডঃ চক্রবর্তী তার কাছে এসে তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘এভাবে ভেঙে পড়িস না, তোকে তোর ভালবাসা ফিরে পাওয়ার পন্থা আমি বলে দিচ্ছি । বড়ই কঠিন সে-পথ, তবে দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে চললে শেষ অবধি তুইই জিতবি ।’

আলো তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকাল । চোখে-মুখে দৃঢ় সংকল্পের ছাপ নিয়ে সে বলল, ‘তুমি বলো সে-উপায়, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যত কঠিনই হোক, আমি ঠিক নয়নকে সারিয়ে তুলব ।’

মনে মনে খুশী হলেন ডঃ চক্রবর্তী, তাঁর সেই দুষ্টু-মিষ্টি আদরের ভাইঝি কত বড় হয়ে গেছে !

ঘরের ভিতরে পায়চারি করতে করতে তিনি ভেবে নিলেন সেই রাস্তাটা, তারপর নিজের চেয়ারে বসে স্থিরদৃষ্টিতে আলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নয়ন আলোকে ভালবাসে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে । কিন্তু আলোর ভালবাসা থেকে সে বঞ্চিত । সেজন্য তার অবচেতন মন জন্ম দেয় এক অন্য আলোর, যে একদম তার মনের মত হবে, তাকে ভালবাসবে, তার বন্ধু হয়ে উঠবে !’

আলোর ঘন ঘন পলক ফেলাতে তার উৎকণ্ঠা ফুটে বেরচ্ছে ।

ডঃ চক্রবর্তী জোরে শ্বাস নিয়ে ফের বললেন, ‘তোকে সেই ভূমিকা পালন করতে হবে, নয়নের স্ত্রী নয়, তার বন্ধু হতে হবে ! যে জিনিসের অভাব নয়নের অন্তরে অমন অদ্ভুত অনুভূতি তৈরী করেছে, সেই জিনিস তার বাস্তব জীবনে ভরপুর দিতে হবে তোকে ।’

চাপা উত্তেজনায় আলোর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে । সে মন দিয়ে শুনছে তাঁর উপদেশ ।

আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডঃ চক্রবর্তী । আলোর কাছাকাছি এসে বললেন, ‘মনে রাখবি, বাস্তবের আলোর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বলেই নয়ন তার কল্পনার আলোকে তৈরী করেছে । সুতরাং, বাস্তবের আলো যদি তাকে আপন করে কাছে টেনে নেয়, তার বন্ধু হয়ে ওঠে, তা’হলেই তার কল্পনার আলোকে আর প্রয়োজন পড়বে না !’

আলো উদ্দীপনার চোটে উঠে দাঁড়িয়েছে, দরদর করে ঘামছে, চোখের জল এখনও শুকায়নি । কান্নাভেজা গলায় সে বলল, ‘আমি আজ থেকেই নয়নের বন্ধু হয়ে যাব ।’

‘অত সহজ নয় এতদিন মনের ব্যবধানে থেকে হঠাৎ কারও বন্ধু হয়ে যাওয়া,’ বললেন ডঃ চক্রবর্তী, ‘তোদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে, আগে সেটা কমাতে হবে, কথাবার্তা বলতে হবে নিজেদের মধ্যে, হাসি-খুশী থাকতে হবে, তবেই না বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে !’

আলো কান্না থামিয়ে বলল, ‘তুমি যেভাবে বলবে, আমি সেভাবেই চলব । আমি শুধু আমার নয়নকে ফিরে পেতে চাই ।’

সে এবার ডঃ চক্রবর্তীর পায়ে ঝুঁকে প্রণাম করে বলল, ‘কাকাবাবু, আশীর্বাদ কোরো, আমি যেন আমার এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারি ।’

ডঃ চক্রবর্তী আলোর মাথায় হাত রেখে চিন্তান্বিত কণ্ঠে বললেন, ‘নারীদেরকে এরকম কঠিন পরীক্ষা দিতেই হয় জীবনে, আর তোর পরীক্ষা তো অগ্নিপরীক্ষার মতই । শত্রু আড়ালে থাকলেও বাস্তবের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই অনেক সহজ ; কিন্তু তোর লড়াই তো নয়নের কল্পনার সাথে ! এ লড়াই যথেষ্ট কঠিন হবে তোর ক্ষেত্রে ।’ তারপর হাসিমুখে তাকে আশীর্বাদ করলেন, ‘তুই অবশ্যই তোর যুদ্ধে জয়লাভ করবি, শুধু সংকল্পটা হারাস না কখনও ।’

এরপর দেখতে দেখতে সাতাশটা বছর কীভাবে কেটে গেল, ওরা বুঝতেও পারল না । ধীরে ধীরে নয়ন ও আলো বন্ধুত্বের গণ্ডী পেরিয়ে সুখী দাম্পত্যজীবনের আস্বাদ গ্রহণ করল । তারপর একদিন ওরা বাবা-মা হল, নতুন দায়িত্ব এল সন্তানের রূপে । রেলগাড়ির মত জীবন এগিয়ে চলল, রঙ্গমঞ্চে আলো-আঁধারির আড়ালে দৃশ্যপট বদলানোর মত ওদের জীবনেও অনেক পরিবর্তন এল, কিছু আপনজন সহযাত্রীর মতই নিজ নিজ গন্তব্যে এসে রেলগাড়ি থেকে নেমে গেল, আবার নতুন কিছু সহযাত্রী উঠে এল রেলগাড়িতে ! সুখ-দুঃখের মধ্য দিয়ে জীবনের ভাঙাগড়ার খেলা চলতে লাগল আপন খেয়ালে, নিজের নিয়মে ।

আজও বার্ধক্যের উপকণ্ঠে এসেও পিছন ফিরে তাকালেই ওরা সেই পুরনো জীবন ও তার হলদে পাতাগুলোকে মসৃণ সমতল দর্পণে প্রতিবিম্বের মতই দেখতে পায় ।

আলো আজ একজন সৎ স্ত্রী, সফল গৃহবধূ, সার্থক মা । এতগুলো ভূমিকাপালনের ব্যস্ততায় সে মশগুল !

নয়ন তার আলোকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে ভালবাসার পূর্ণ মর্যাদাসহ মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছে, হৃত আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে, একজন গর্বিত বাবার ভূমিকায় সেও আজ উন্নীত ।

তবে তার কল্পনার আলো আজও মাঝে মাঝে নিভৃতে তাকে দেখা দিয়ে যায় ! প্রায় বছরপঁচিশেক আগে ডঃ চক্রবর্তী তাকে একান্তে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী চলে সে আজ তার কল্পনার আলোকে উপেক্ষা করতে শিখে গিয়েছে । তাই সে যেমন অজান্তেই আসে, তেমনি আড়ালেই চলেও যায় ।

অভিনন্দন পার্কিং লট থেকে তাদের গাঢ় লাল রঙের হোন্ডা অ্যামেজ়টা নিয়ে এসেছে রাজভবনের দক্ষিণের অলিন্দের মূল ফটকের সামনেটায় । আলো তার কাকাবাবুর হুইলচেয়ারের হাতলদু’টো নয়নকে ধরিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরের সীট ঠিক করার জন্য এগিয়ে গেল সেদিকে ।

নয়ন তাঁর পায়ের কাছের লিভারগুলো খুলে দেওয়ার জন্য নীচু হতেই ডঃ চক্রবর্তী দু’চোখে কৌতুক মাখিয়ে হঠাৎ তাকে ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নয়নের আলো কেমন আছে ?’

নয়ন এ-প্রশ্নে সামান্য হেসে উত্তর দিল, ‘ভাল ।’

আলো ও অভিনন্দন এসে পড়েছে ওঁদের কাছে । ওরা ডঃ চক্রবর্তীকে ধরাধরি করে গাড়ির পিছনের সীটে বসিয়ে দিল, আলো তাঁর পাশে বসল, গাড়ি ড্রাইভ করবে অভিনন্দন । নয়ন সামনের দরজাটা খুলে গাড়িতে বসতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল । একবার পিছন ফিরে একঝলক বাগানের দিকে তাকাল সে, তারপর একটা সংক্ষিপ্ত হাসি হেসে ছেলের পাশের সীটটায় বসে পড়ল । গাড়ি এগিয়ে চলল দক্ষিণের গেটের উদ্দেশ্যে ।

বাগানে তখন সাজানো-গোছানো সযত্নে লালিত পাতাবাহারের ঝোপগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলো – পরনে কারুকার্যময় কালো শাড়ি, লম্বা ঘন কালো চুলের বিনুনি কোমরের নীচ অবধি গেছে, দু’হাতে সোনার চুরি, ডানকাঁধে ঝুলছে একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ ! সূর্যাস্তের রক্তিম আভায় সারা আকাশটা ছেয়ে গেছে, সেই ক্যানভাসের রঙের ছটায় আলোকে আজও একইরকম সুন্দর দেখাচ্ছে । সে এখন অনন্তযৌবনা, চিররূপসী এক নারী, যে শুধু নয়নের হৃদয়েরই কোনও এক অচিন কোণে বিরাজ করছে – নয়নের আলো হয়েই ।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post কাঙ্গানা | কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Stories for Matured
Next post মৃত্যুর শব্দ| পলক-ফেলা-নিষেধ | শতরূপা ভট্টাচার্য্য| Bengali Thriller Story