(১)
লেক কালীবাড়ি থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই “বোধিধার্মা একাডেমী” তার প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সব মিলিয়ে পাঁচতলা। বিশাল অঞ্চল নিয়েই নির্মিত এই সংরক্ষণাগার। রাস্তার মাঝ বরাবর একটা শহুরে কলকব্জা মিশ্রিত বাগান। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব -এর শ্বেতকায় একটি মূর্তি বিরাজ করছে। মূর্তিটি কাঁচের বড় বাক্সে রাখা। বাগান তবে সেভাবে পরিষ্কার করা হয় না। নিয়মিত গাড়ির ধোঁয়া, সিগারেটের গন্ধ এবং আরও সব দূষিত বায়ুর প্রকোপে গাছপালার বেহাল দশা। এই বাগানের একপাশে এই একাডেমী এবং অন্যদিকে লেক। সেখানে সকাল বিকেল লোকে অতিরিক্ত ভ্রমণের মধ্য দিয়ে শরীরের বাড়তি মেদের ষষ্ঠীপুজো করতে আসেন। কেউ কেউ উদম ছুটে ঘর্মাক্ত শরীরের দুর্গন্ধ ছড়া দিতে দিতে বেরিয়ে যায়।
একাডেমীর অন্যতম ডিরেক্টরের পদে আছেন বিশ্বেশ্বর মল্লিক। সাদা শার্ট ইন করে পরেছেন। গাঢ় নীল সঙ্কীর্ণ প্যান্ট। গলার নিচে আলগা হয়ে ঝুলছে একটা টাই। বেশ হন্তদন্ত হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন ফ্লোরে। কপালে ঘামের বিন্দু। চোখের চশমা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বলে বারবার সেটা খুলছেন আবার পরছেন। মি. মল্লিক-এর উচ্চতা প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি । ছাতি চওড়া। নাকটা ভোঁতা এবং চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। হাঁটাচলা দেখে বোঝা যাচ্ছে পায়ের তলার মাটি প্রতিনিয়ত কাঁপছে। কপালের অনেকটাই ময়দানের মত ফাঁকা। ফলে ঘর্মবিন্দুরা খেলা করতে পারছে। কুঁচকানো চুল তারপর শুরু হয়েছে। একবার হাঁক দিয়ে জনার্ধনকে ডাকলেন, “এ জনা, জারা ইধার আনা”।
জনার্ধনের বয়েস চল্লিশের কাছে। ছুটতে ছুটতে নিচ থেকে দৌড়ে ওপরে এলেন। বিস্কুট কালারের শার্ট আর প্যান্ট অগোছালো। জনার্ধন ঠিকই আছে। ওর কিছুই হয়নি। হয়েছে ওর স্যারের।
“হ্যাঁ মালিক, বলেন কি করব আমি!”
মল্লিক মশাই বললেন, “খানিক আমায় বিষ এনে দিতে পারিস! আমার মোটে বাঁচতে ইচ্ছে করছে না”। স্যারের কথা শুনে জনার্ধনের মাথা পাক খায়। স্যার, এসব কি বলছেন!
“সার, আপকা তাবিয়েৎ ঠিক হে না!”
মল্লিক মশাই নিজেকে সংযত করলেন। বুঝলেন, মাথার যন্ত্রণাটা এক একটা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে স্নায়ুযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে। তাই উনি ভুল বকছেন। হন্তদন্ত হয়েই গটগট করে নিচে নেমে গাড়িতে চড়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন।
(২)
“নমস্কার, আমার নাম পার্থপ্রতীম দাস। আমি এখন ভবানীভবনে ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিসার মি.ঘোষালের অধীন…” কথা শেষ হল না। স্যার বললেন, “দেখো প্যাঁকপ্যাঁক, ওসব ভদ্র ব্যবহার আমি করতে পারব না”।
আমি বললাম, “না না স্যার, চেষ্টা করেই দেখুন না। ওপর মহল থেকে অর্ডার দুদিন পরই চলে আসবে। আপনার তখন মাথা চারশো চল্লিশ ভোল্ট হয়ে যাবে”।
“কি অর্ডার আসবে শুনি! তোমার মুখে ফুল স্টপ মেরে দেব প্যাঁকপ্যাঁক!”
স্যারের পুরো নাম প্রদ্যুম্ন ঘোষাল। কি করেন সেটা আশা করি আর বলতে হবে না। সাদা রঙের একটা শার্ট, তার হাতা একদিকে মোড়া, একদিকে খোলা। মাথার চুল সুন্দর করে পেতে ছানা। নবরত্ন তেল মেখে এসছেন স্যার। মুখে তিনদিনের না কাটা দাড়ি। আমার স্যার অত্যন্ত কাজ পাগল মানুষ। কাজ না থাকলে উনি জলহীন মাছেদের মতই ছটফট করেন।
এই সময় বাইরে প্রচন্ড শব্দে একটা গাড়ির হর্ন শোনা গেল। মনে হল, কোনো কিছুতে গিয়ে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারল। সাথে সাথেই চড়াই পাখির মত লোকেদের কোলাহল।
আমি ছুটে গেলেও স্যার কিন্তু চেয়ারেই নিজের শরীরটাকে সীমাবদ্ধ রাখলেন। বললেন, “জলভাত, জলভাত প্যাঁকপ্যাঁক। এখানে আসতে চাইলে বাহির পথ দেখিয়ে দিও। তবে আমার মন কি বলছে জানো, এ আমাদের সুখের সংসারে জল ঢালবে”।
স্যার কখন যে কি বলে তার কোনো ঠিক নেই। যাই হোক, সিঁড়ি দিয়ে নেমে প্রায় ছুট দিলাম। দেখলাম, গেটের সামনে একটা ভিড়। দ্বাররক্ষীরা কাকে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করছে। রেলিং এর একটা দিক একেবারে দুরমুশ হয়ে গেছে। সকাল সকাল গোবিন্দ-র হোটেলের পটল আর চারাপোনার ঝোল আর সরু রেশনের চালের ভাত খেয়ে এসছিলাম। সেগুলোই এখন পেটে আর বুকে তিড়িংবিড়িং করে নাচছে।
লোকটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় টাক, বাঁ হাতে বেশ কতকটা আঙটি। পোশাক গোছানো। মনিব্যাগ চেক করে বুঝলাম বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের। মোটা রকমের অর্থ আছে। পরিবার আছে। ফ্যামিলি ম্যান হওয়া সত্ত্বেও দিনে দুপুরে নিজে ড্রাইভ করে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। স্যার তো দেখলেই বলবে, “ব্যাটার পেছনে আদিম মানুষের মত ল্যাজ গজিয়েছে!” এর অর্থ, ওনার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ উনি চরিত্রহীন এবং সেই টেনশনে ওনার এ অবস্থা!
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম স্যার পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দূরে একটা চাঁপাফুলের গাছ। তার দিকেই চেয়ে থাকতে থাকতে বললেন, “কেমন চড়া গন্ধ দেখেছো প্যাঁকপ্যাঁক! এই গন্ধ বলছে বোধিধার্মা একাডেমীতে না গেলেই নয়!”
আমি রৌদ্রে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার, একবার বললেন না, চলো প্যাঁকপ্যাঁক মানে পার্থপ্রতীম, এক কাপ কফি খেয়ে আসি! তখন থেকে শুধু ইয়ার্কি মারছেন। আমি বললাম, “ঢের হয়েছে স্যার। আমি চললাম পোদ্দার হাসপাতালে। ওখানেই আহত ব্যক্তি ভর্তি আছেন”।
স্যার তখুনি পকেট হাতড়ে সেলফোনটা বের করে দেখালেন। আমি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সদ্য ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার ছবিটা গুগল-এ চলে এসছে। রীতিমতো খবর লাইভ টেলিকাস্টে। স্যার বললেন, “চলো, আমিও যাই ঐ পদ না পোদ্দার হস্পিটালে। এবার বুঝলে তো, হেড কোয়ার্টারের সামনে মিডিয়া কেমন ক্যামেরা তাক করে রাখে! অত হম্বিতম্বি করো না। গোবিন্দ-র দোকানে বোয়াল বেগনের কোর্মা খাওয়া বন্ধ করো! নাহলে সেটাও লাইভ টেলিকাস্টে চলে আসবে!”
(৩)
ভদ্রলোক এখন বেশ স্বস্তি বোধ করছেন। মাথার কাছে খানিক চোট লেগেছে। ব্যান্ডেজ করা আছে। টেবিলে দুটো বাটার টোস্ট শুকিয়ে গেছে। ডিম সিদ্ধটা খেয়েছেন। তাছাড়া উনি বেডে শুয়ে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন। আমরা ডাক্তারের কাছে অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছি। একটা চেয়ারে স্যার বসেই গুন গুন করে গান গাইতে লাগলেন। চোখের দৃষ্টি সোজা ভদ্রলোকের মাথা, বুক, চোখ, ঠোঁটের কোণা বেয়ে পা অব্দি একবার চলে গেল। ভদ্রলোক উঠে বসে বললেন, “আমি আপনার কাছেই আসছিলাম মি. ঘোষাল। আর আপনি…কথা শেষ হল না। স্যার বলল, “ঠিক আছে। মিসডকল এসছিল কিন্তু তখনই আপনার গাড়িটা ধাক্কা মারে আর আপনি অবচেতন হয়ে পড়েন। তাই তো!” লোকটি আংশিক মাথা দোলাল।
স্যারের কাছেই শুনলাম উনি হলেন লেক কালীবাড়ির সন্নিকটে অবস্থিত ‘বোধিধার্মা একাডেমীর’ ডিরেক্টর, বিশ্বেশ্বর মল্লিক। এটা একটা মিউজিয়াম বলা চলে। এখানে প্রদর্শনী হয়। ইতিহাসের বুক থেকে পাথর সরিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যেসমস্ত মহা মূল্যবান দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা হয় এটা সেরকমই একটা স্থান। দেশ বিদেশের বিভিন্ন কলা কুশলীরা এখানে তাঁদের শিল্পকলা নিয়ে আসেন। অনেক সময় এখানেই সেগুলো উচ্চ মূল্যে কেনাবেচাও হয়। ফলে, ভারত সরকারকে বেশ কড়া নজরেই এই স্থানের দায়িত্ব নিতে হয়।
এর ঠিক এক মাস বাদে আমরা ওনার বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে আছেন ওনার স্ত্রী, সাত বছরের মেয়ে পুপে আর কাজের মেয়ে ঝুম্পা। এই ঝুম্পাকে দেখতে অনেকটা আদিবাসী রমণীদের মত। মেদহীন শরীরটা অনায়াসে সমস্ত কাজ দেখে নিচ্ছে। পেয়ারাগাছের গুঁড়ির মত সরু ছিপছিপে গরণ। চোখের দৃষ্টি যেন সর্বদাই কিছু অনুসন্ধান করে চলেছে। কচি কলাপাতা রঙের ওড়নাহীন কুর্তায় ঝুম্পা সর্বসম্মুখে প্রজ্জ্বলিত।
বাড়ির পোশাকেই বসেছেন বিশ্বেশ্বর মল্লিক। চা সহযোগে আমরা গল্প শুনছিলাম।
“ঘটনাটা শেষের সপ্তাহে ঘটে। আপনারা জানেন বোধিধার্মা একাডেমি আদতে একটা খাজনার ভান্ডার। ভারতের অমূল্য বৌদ্ধ পুঁথি, পাথর, বহুকষ্টে অর্জিত অশোকের তাম্রলিপি, জাহাঙ্গীরের আমলের দুষ্প্রাপ্য চিত্রের প্রদর্শনী ইত্যাদি হয়। মি.ঘোষাল, এগুলো ছাড়াও সেদিন এসেছিল একজোড়া কাঙ্গান! কি বলব, আমার বুকটা যেন কেঁপে উঠল মি.ঘোষাল! খুব চেনা অথচ মনে পড়ছে না। কোথা দিয়ে কাঙ্গান দুটি এল সেটাও বুঝতে পারছি না। সেই সংস্থায় ফোন করলাম। তারাও ঠিক বলতে পারল না”।
“আপনাদের এখানে কি আগেও এমন হয়েছে! না বলেই মাল এসে হাজির!”
স্যারের কথায় মল্লিকবাবু বললেন, “আসলে হিসেবের বাইরে কিছু জিনিস আসলে তা আমি জেনে যাই। কিন্তু কাঙ্গানের খবর কেউ দিতে পারছে না”।
“তা, কাঙ্গান কি বলছে! আপনি হাতে পরে দেখেছিলেন!”
স্যারের কথায় হেসে উঠলেন। কিন্তু হাসির মধ্য দিয়ে বিশ্বেশ্বর মল্লিক বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর এসব ইয়ার্কিতে কিছুই যায় আসে না। “আমার বড় বিপদ প্রদ্যুম্নবাবু! আমার স্ত্রী আর মেয়ে বাড়িতে নেই। তাই আপনাকে বলছি, এই কাঙ্গানের তদন্ত আপনিই করুন। তবে গোপনে”।
মল্লিকবাবুর বাড়িটা খাসা। পাশেই ছোট্ট বাগান। হরেকরকমের পাখির ক্যাঁচরম্যাচর শব্দ হচ্ছে। কয়েকটা লতানে পরজীবি আষ্টেপৃষ্টে দেওয়াল বেয়ে উঠছে। পুরনো দিনের বীমেরা শক্ত হস্তে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা চলে আসার পর বাড়ি আবার আগের মতই নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
“প্যাঁকপ্যাঁক, ফার্নান্দ ব্রঁদেলের নাম শুনেছো! ভদ্রলোকের মতে, এই শহরতলী হল রোমাঞ্চকর পরিবর্তনকামী এক যন্ত্রবিশেষ, যে আদতে প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনধারায় গতি আনছে, দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে এবং নিজের সাথে সাথে মানুষকেও এই পরিবর্তনের পথে ঠেলে দিচ্ছে”।
আমি বললাম, “কে! কার নাম বললেন! বোঁদে!”
স্যার সবে বলতে যাচ্ছিলেন, “কানে কি তুমি… আমি থামিয়ে বললাম, “ও ব্রঁদেল। হ্যাঁ, এবার বুঝতে পেরেছি”।
শহরতলীতে কেমন পরিবর্তন এসছে এবং সেটা যে কেমন তা বুঝতেই আমরা চলে আসলাম বোধিধার্মা একাডেমিতে। প্রদ্যুম্ন স্যার সিগারেট নিয়ে আশপাশটা ঘুরে দেখছিলেন। হঠাৎ কি একটা দেখে ওনার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আমিও দেখলাম মূর্তিটা। বিল্ডিং এর একেবারে শেষের দিকে। শেয়াল দেবতার স্তম্ভ। আন্দাজ ত্রিশ চল্লিশ ফুট উচ্চতার। দারোয়ান মানসিং ছাবড়া বলল, “বহুত দিন হো গেয়া সাভ! কই ইসে ইঁহা সে নেহি লে জাতা!” আমি আর স্যার ওদিকেই গেলাম। একপাশে বাগান। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। ঘাসের ডগায় জলবিন্দু আশ্রয় নিয়েছে। দুটো শালিক কিচির মিচির করছে। স্যার চড়াই বেয়ে একেবারে স্তম্ভের পায়ের কাছে উপস্থিত হলেন। আমি রইলাম নিচে। এখান থেকেই শেয়াল দেবতাকে হিংস্র বোধ হতে লাগল। মনে পড়ে গেল ইজিপ্টের কথা। “প্যাঁকপ্যাঁক, এদিকটা এসো”। স্যারের পাশে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। স্যার ঈশারায় বললেন, “পায়ের কাছের সিমেন্ট বোধয় কোনো কালে আঘাত পেয়েছিল। তাই রঙ খসে পড়ছে”। আমিও দেখলাম ব্যাপারটা। তারপর বললাম, “ওটা তো বাজেয়াপ্ত স্যার! হোমেও লাগবে না, যজ্ঞেও লাগবে না!”
একাডেমির সেকেন্ড ফ্লোরে আমাদের দেখা হল শিবশঙ্কর ব্যানার্জির সাথে। উনি, ইতিহাসের অধ্যাপক। হুগলির কোন কলেজে পড়ান। হলদে ডোরা কাটা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরেছেন। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছে। আমাদের দেখে বললেন, “কোন কলেজের! য়্যুনিভার্সিটি নাকি!”
স্যার নিজ ছন্দে বললেন, “প্রদ্যুম্ন ঘোষাল, ভুবনেশ্বরী কলেজ”।
কথায় কথায় জানা গেল উনি এখানে প্রায়ই আসেন। এবং বিশ্বেশ্বর মল্লিকের সাথে এই সূত্রে বেশ সখ্যতা জন্মেছে। তবে আজ ওনাকে না দেখতে পেয়ে বেশ আশ্চর্য হলেন। বললেন, “আসলে তামিল ল্যান্ডের দুটো কাঙ্গান সদ্য এসছে। ওটাই আলোচনার কেন্দ্র। উনি বলছিলেন, ও দুটো বেনামী”। তারপর নিজেই বললেন, “আসলে আমি ওদুটো ওঁর থেকে কিনে নিতাম। কিন্তু ও যখন অসুস্থ, তাহলে আর কিছুই করার নেই”।
বেশ খানিকটা কথা বলে, মানুষটাকে উপর নিচ জরিপ করেই স্যার বললেন, “আচ্ছা শিবশঙ্কর বাবু, কাঙ্গান দুটো কোনো অভিশপ্ত নারীর নয় তো! যা দেখে উনি অসুস্থ হয়ে গেলেন!”
লোকটা খানিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর, নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে, “আমার..আমার একটু কাজ আছে”, এই বলে দুরন্ত গতিতে বাইরে চলে গেলেন।
(৪)
ফোনটা এল বিকেলে। শনিবার বলে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলে পা তুলে দিবানিদ্রার আয়োজন করলেন স্যার। আমিও খানিক ঢুলু ঢুলু চোখে ঘড়ির দিকে তাকালাম। পৌনে চারটে। কিরিং কিরিং করে স্যারের ফোনটা বেজে উঠল। আমি ফোন তুললাম। ওপাশ দিয়ে, “আ..আমি, ঝু..ঝুম! ঘোষ আছেন। প্র…মদ ঘোষ”!
স্যার তখনও চুপ করেছিলেন। পরের কথাটা শুনে আমাদের নিস্তব্ধতার অবসান ঘটল। আন্দাজ কুড়ি মিনিটের মধ্যে হোয়াইট স্করপিও বেকার রোডে হাজির হল।
পামেলা অর্থাৎ বিশ্বেশ্বর মল্লিকের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “দেখুন, ওর জন্যে আমার মেয়েটার কি অবস্থা! সাপে কেটে শেষ হয়ে গেল পুপে…!” মেঝেতে ঝপ করে বসে পড়লেন। সামনে পড়ে রয়েছে পুপের দেহ। আমরা প্রায় বিস্মিত হয়ে গেলাম। ফ্রক পরে আছে পুপে। অতটুকু ফুটফুটে শিশুটার মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বেরিয়ে এসছে!
দেখলাম স্যারের চোখ সামনের বন্ধ দরজায় স্থির। এই সময় ঝুম্পা ছুটে এল। শোফার কোণটা ধরে বসে পড়ল। পামেলা, ফোঁপানি থামিয়ে দাঁত চিবিয়ে বলল, “ওরা দুজনে মিলে আমার মেয়েকে মেরেছে। আর তুই, ভিখিরি, যা এবার তোর লীলা খেলা শুরু কর!”
স্যার, সামনের বন্ধ দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ছিটকিনি খুলে ওমনি ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি গিয়ে দেখলাম, ঘরে একজন বসে আছেন। খুব সম্ভবত পড়া বা লেখার টেবিল। দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে আছেন বিশ্বেশ্বর মল্লিক। স্যার ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। তারপর ওঁনার উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনি কি বদ্ধ উন্মাদ মি.মল্লিক!” কিন্তু সামনে গিয়েই স্যার থতমত খেয়ে গেলেন। প্রদ্যুম্ন স্যারকে ইতিপূর্বে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে দেখিনি! এবার উনি আমার দিকে তাকিয়ে দুদিকে মাথা দোলালেন। বললেন, “হি ইস্ নো মোর!”
গোবিন্দ-র দোকানে সদ্য ভাজা বেগুনিতে কামড় দিয়ে বললাম, “স্যার, কিনারা হল কিছু!”
“প্যাঁকপ্যাঁক, তিনটে বিষয়ে ঘোর কাটছে না! এক, মল্লিকের মেজর হার্ট অ্যাটাক কি দেখে হল। দুই, যে সাপটা পুপেকে কামড়েছে সেটা কোথায় গেল এবং তিন, পামেলাদেবী অবেলায় ঘুমোচ্ছিলেন কেন! তাছাড়া ঝুম্পার কেসটা ক্লিয়ার নয়”। স্যার একবার তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাঝে কাঁচালঙ্কায় কামড় দিয়ে বললেন, ঝাল নেই রে গোবিন্দ!
পরের দিন সকালে কোয়ার্টারে বসে চা খাচ্ছি। সামনে খবরের কাগজ খোলা। কালের ঘটনার বৃত্তান্ত দেওয়া হয়েছে। অবাক হলাম এটা দেখে, পামেলাদেবীর বয়ান অনুযায়ী স্থানীয় থানা ঝুম্পাকে তুলে নিয়ে গেছে। এবং এখনো পর্যন্ত মেয়েটির মুখ থেকে পুলিশ কিছুই বার করতে পারেনি। শুনে বেশ স্তম্ভিত হলাম। কালকে আমাদের ঝুম্পাই ফোন করেছিল খুনের ব্যাপারে। নিজে খুন করে আসামি নিজেই ফোন করে বলবে! এটা কিরকম হল! স্থানীয় থানাও কি সেটা বুঝেছে! কি করা উচিত এটা ঠিক করছি ওমনি বাইরে গাড়ির শব্দে চমকে উঠলাম। বুঝলাম, তদন্ত আজ থেকেই শুরু। এটা প্রদ্যুম্ন ঘোষাল ছাড়া আর কেউ নয়।
স্যারকে দেখে মনে হল, সারা রাত ঘুম নেই। চিন্তা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। চুল অগোছালো। জামার দু-তিনটে বোতাম খোলা। বললেন, “পার্থ, এখুনি বেরোতে হবে। পামেলাদেবীর বয়ান নেওয়াটা জরুরী”। আমি শার্ট গলাতে গলাতে বললাম, “বুঝতে পারলেন নাকি কিছু! ঝুম্পাকে তো তুলে নিয়ে গেছে!”
“জানি প্যাঁকপ্যাঁক, তবে ঝুম আর ঝুম্পা অনেক দেরি। এদিক আগে না গোছালে মুশকিল হয়ে যাবে”। যাই হোক, আমরা গাড়ি করে চলে আসলাম। স্যার বলল, “ভালো করে সবকিছু লক্ষ্য রাখবে। আপাতত কেসটা আমরা দেখছি। নিজে হাভিলদার বলে আবার সবকিছু আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিও না। আর মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে নজর রেখো”।
কথাগুলো যেমন বলা তেমনই আমার কাজ। কালকের এ বাড়ির দৃশ্য আর আজ সম্পূর্ণ আলাদা। পামেলাদেবী একটা বাঘছাল অঙ্কিত পোশাক পরেছেন। মাথার চুল খোলা। সুগন্ধি ম ম করছে। হাতের নখ দেখে মনে হল এগুলো অকস্মাৎ গুহা ত্যাগ করে হিংস্র চোখে আমাদের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। স্যারকে দেখে বললেন, “আপনারা আবার কি করতে! আমার স্বামী আর মেয়ে দুজনেই মারা গেছেন। আপনারা কি এখনো তদন্ত করবেন!”
স্যার পাশ কাটিয়ে ঢুকে বললেন, “ঝুম্পাকে কই দেখছি না!”
“ওকে পুলিশ নিয়ে গেছে, আপনারা শোনেননি। তাছাড়া অন্যেরা এর তদন্ত করছে। আপনারা ওঁনার বন্ধু বলে যা খুশি তাই করতে নিশ্চয়ই পারেন না!”
“না সেটা নয়, তবে এক গেলাস জল তো খেতে পারি! এই পার্থ বসো। উনি জল নিয়ে আসুক”।
পামেলাদেবী জল আনতে গেলে আমরা ভালো করে চারপাশটা দেখে নিলাম। এখান থেকে ভেতরের ঘরটি দেখা যাচ্ছে। যেখানে বিশ্বেশ্বর বাবু বসেছিলেন। দূরে ডাইনিং টেবিলে অগোছালো প্লেট রাখা। একটা প্লেট হাতে নিয়ে সামান্য হেসে আবার যথাস্থানে সেটা রেখে দিলেন। ঘরের অধিকাংশ স্থান ফাঁকা। ঘরের কোণে বেশ অনেকদিনের ময়লা জমে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, ঝুম্পা নেই বলে এমন অবস্থা। বাড়ির পাশেই বাগানটা আজ নিস্তব্ধ। পুরো একটা শ্মশানে পরিণত হয়েছে জায়গাটা।
নারীর মন সত্যি বোঝা দায়! পামেলাদেবী এলেন বটে কিন্তু হাতে জলের গেলাস নয় বরং সরবত এনেছেন। কমলা গাঢ়, এমন গেলাসের গায়ে হালকা জলবিন্দু আশ্রয় নিয়েছে। বুঝলাম, ঠান্ডা জল। জল রাখতে গিয়ে স্যারের হাতে হাত লেগে গেল। স্যার একটু ইতস্তত করলেও পামেলাদেবী দিব্যি শোফায় বসে সরবতে চুমুক দিলেন।
“আচ্ছা, বিশ্বেশ্বর মল্লিকের সব সম্পত্তির মালকিন তো আপনিই হলেন। তাই তো!”
স্যারের কথায় বিচলিত না হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, সেটা তো ঠিক। তবে আমার সম্পত্তিতে লোভ নেই। ওসব আপনারা বুঝবেন”। “কেন, ওঁনার আত্মীয় পরিজন কেউ নেই!”
“না, উনি একা ছিলেন। আমাদের এই ছোট্ট সংসারে কেবল পুপে ছিল”।
বলতে বলতে চোখ মুছলেন পামেলা মল্লিক।
“একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব ম্যাডাম!”
“বলুন”।
“আপনার সাথে হাসবেন্ড এর সম্পর্ক কেমন ছিল!”
হাতদুটো বুকের কাছে সমান্তরাল রেখে বললেন, “পুপে আমাদের লিগাল সম্পর্কের পরিণতি। কিন্তু পুরুষ জাত তো! আপনাদের কাছ থেকে আর কিই বা আশা করা যায়!”
আমি এবার একটু বিরক্তি প্রকাশ করলাম। উনি হয়তো জানেন না, স্যার সরাসরি হেড কোয়ার্টার থেকেই এসছেন। তাছাড়া বর্তমানে এই কেসের ইনচার্জ। যা ইচ্ছে প্রশ্ন করতে পারেন। আর স্যার, ভুল কিছুই বলেননি। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু স্যার থামিয়ে বললেন, “আচ্ছা, আজ আমরা উঠি। আর হ্যাঁ, আপনি একটা খোঁজ দিতে পারেন!”
“কিসের খোঁজ বলুন, আমার ক্ষমতার মধ্যে থাকলে অবশ্যই সাহায্য করব। এখন আমি বড্ড একা। আপনি যখন ইচ্ছে আসতে পারেন”।
“স্যার একটু বিষম খেলেন। তারপর, উঠে পড়ে বললেন, এখানে আশেপাশে যদি কোনো ভালো থাকার জায়গা থাকে তো বলবেন। আমার এক আত্মীয় গ্রাম থেকে এসছেন। উনি থাকবেন। আর হ্যাঁ, এগারোটা বা বারোটার দিকে একটু দরজায় ভালো করে ছিটকিনি আঁটকে শোবেন। আপনার তো অবেলায় ঘুমানোর অভ্যেস আছে”।
শেষের কথাটায় কি পরিণতি হল, তা না দেখেই আমরা গটগটিয়ে বেরিয়ে আসলাম। সিঁড়ি নামার সময় সামনের মানুষটাকে দেখলাম। আমার স্যার, প্রদ্যুম্ন ঘোষালের হাত, পা আর দৈহিক চলন অন্য কথা বলছে। মাথা চলছে অন্যদিকে।
তবে আমরা যে ঠিক জায়গায় এসেছি তার প্রমাণ পেলাম হাতে নাতে। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দেখলাম একটা স্যুমো হুঁশ করে বেরিয়ে গেল। কে ছিল, কেউ কি নজর রাখছিল!— কিছুই বোঝা গেল না। স্যার খালি বললেন, “প্যাঁকপ্যাঁক, আমার তো বয়স হচ্ছে নাকি! পারলে না ধরতে গাড়িটা!”
আমি অবশ্য চেষ্টা করার আগেই সেটা সীমান্ত পেরিয়ে গেছে। বললাম, “স্যার, আমার আঠাশ চলছে। আর আপনার তো বত্রিশ। কোথায় আর বয়স হল!”
(৫)
শেষ কবে বাবুঘাটে এসেছি তা মনে নেই। ইচ্ছে ছিল প্রিন্সেপ ঘাটে যাওয়ার কিন্তু ওখানে যা রঙ্গ তামাশা হচ্ছে, তাতে নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে ছোলা বাদাম ভাজা খাওয়াই শ্রেয়। স্যার বলেন, “ছোলা বাদাম বিহারীরা খায়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফোকট লাল বলে এক গোয়ালা আসত। ওর আসল বাড়ি বিহারে। বলত, বাবু, এ জগতে মাথামোটা, বুদ্ধিমান সাব ঝুট বাথ! পরিস্থিতি মানুষকে গড়ে পিঠে নেয়। তুমি বরঞ্চ এই ছোলে আর বাদাম খাও”।
স্যার, রজনীকান্তের মত টকাস করে একটা ছোলা মুখে পুরে বললেন, “জীবনে যদি উন্নতি করতে চাও তবে নিজের চোখকে তালিম দিতে শেখো প্যাঁকপ্যাঁক! ভাবো, তোমার সামনে অন্ধকার। ঠিক কয়লাখনির মত। আলো নেই। তোমার চোখ তোমায় দিশা দেখাবে”।
গঙ্গার বুক থেকে পরিশ্রান্ত বাতাস আমাদের চুলে বিলি কেটে যাচ্ছে। এই হাওয়ার একটা ভাষা আছে। মনে হয়, সভ্য জগতের ইতিহাস শোনাতে চায়। যেখানে প্রকৃতি চরম দাসত্ব ভোগ করছে!
আমি বললাম, “আপনি আজ ঠিক কি কি দেখলেন! মানে আন্দাজ কিছু করলেন! আমার তো মনে হল ঘরের কোণে ময়লা জমেছে। ঝুম্পা বেচারি জেলে কি করছে কে জানে!”
“এবার বিয়েটা করে ফেল প্যাঁকপ্যাঁক! মানুষের মনেও ময়লা জন্মেছে। ওটা ঘরের কোণে ময়লা নয় বরং কয়েকদিন যাবৎ এই ঘরের সমস্ত জিনিস হাতিয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। পামেলাদেবী খুব বুদ্ধিমতী! পেছনে বা পাশে কে আছে বুঝতে দিলেন না। আমি ভেবেছিলাম, উনি কিছু হয়তো ফাঁস করবেন কিন্তু আসল সমস্যা কোথায় জান! সব মাটি করে দিল মি.মল্লিকের ইটালিয়ান মার্বেলে নির্মিত বিলাসবহুল বাথরুম!”
“কি! বাথরুম!”
“হ্যাঁ, কালকের সমস্ত ক্লান্তি, কারচুপি ঢাকতে পামেলাদেবী ভালো করে সুগন্ধি মেখে স্নান করেছেন। এক একটা হিমশৈল ওনার সমস্ত শরীর ছুঁয়ে চলেছে। ওখানেই উনি সমস্তটাই সাজিয়ে নেন”।
স্যারের কথা অবশ্য আমার বোধগম্য হল না। তারপর, কে আত্মীয় এসেছে জিজ্ঞেসা করায় বললেন, “ওটা একটা চাল। এখন বুঝবে না। শুধু ভাবো, কি থেকে মি.মল্লিকের হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কারা এসেছিল সেটাও জানতে সময় লাগবে”।
সারারাত ধরেই ভাবার চেষ্টা করলাম। মাঝে মাঝে গেলাসের জলে গলা ভেজাচ্ছিলাম। ঝিঝিপোকা আর ব্যাঙেদের গোঁঙানি ছাড়া মাথায় কিছুই এল না।
সকালে উঠে দেখি আমাদের দোতলায় একটা হালকা জমায়েত হয়েছে। ভিড় ঠেলে গুঁতো খেতে খেতে গিয়ে দেখি সর্বনাশ! এ যে ঋতব্রত ভৌমিক! আমাদের লেক থানার ইনচার্জ! দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন। নাকের তলায় রক্ত জমাট বেঁধেছে। হাত আর পা ওল্টানো দেখে মনে হল সারারাত ছটফট করেছে। তাছাড়া শরীরে আর কোথাও ক্ষতচিহ্নের অবকাশ নেই।
কাছেই একটা হাসপাতালে ওকে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়। ডাক্তার বললেন, “সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে স্নায়ুযন্ত্র থামিয়ে দিয়েছে। তারপর বললেন, ইটস্ আ রেয়ার কেস!”
অফিসে আজ সবারই মুড অফ। আমি এখনো ঋতব্রত-র মুখটা ভুলতে পারছি না। কাল রাতেই আমার সাথে দেখা হল। বললাম, বাড়ির সব কেমন। ও বলল, “মেয়েটাকে স্কুলে পড়াব না ভাবছি। ঘরেই যদি গৃহশিক্ষক দিয়ে… বুঝতেই তো পারছ। বর্তমান যা পরিস্থিতি!”
ব্যাস, তারপর আর কথা হয়নি। সকালে ওর মৃতদেহ দেখে কেবল ওর মেয়েটার কথাই মনে পড়ছিল। স্যার বললেন, “শহরে যখন বড় কোনো ক্রাইম হয় তখন ঝড় এভাবেই আসে। পুপেকে নিশ্চয়ই মনে আছে! ওর আর ঋতব্রত-র কেসটা হুবহু মিলে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি শরীরে বিষ কিভাবে ঢুকে পড়ে! কেউ তো ইচ্ছে করে খাবে না বিষ! তাহলে বিষ এল কোথা দিয়ে! সেটা জানতে হলে এই ছবিগুলো দেখতে হবে”।
আমি প্রায় স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। স্যার, কি ছবি বার করছেন ড্রয়ার দিয়ে! একটা ক্যাঁচ শব্দ করে ড্রয়ার খুলে গেল। দুটো ছবি। একটা পুপের এবং অন্যটা ঋতব্রত। স্যার কখন কিভাবে এগুলো সংগ্রহ করলেন তা জানি না। কিন্তু সত্যি অবাক করা কান্ড! পুপের গলার ঠিক নিচে একটা ক্ষত! অনেকটা আলপিন ফোটালে এবং সেটা যদি চেপে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তবেই এমন ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। ঋতব্রত-র কোমরের ঠিক নিচে একই রকম ক্ষতস্থান।
আমরা আরও কিছু কথা বলতাম কিন্তু স্যারের ফোন বেজে উঠল। স্যার খালি বললেন, “গো ট্যু দি কার পার্থ। ঝুম্পা পালিয়েছে!”
আমরা গাড়িতে চাতকপাখির মত রাস্তার দুদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। বেশিক্ষণ সময় নিল না। বেকার রোড থেকে কালীঘাটের দিকে যেতেই দেখলাম বাজপাখির ন্যায় ছুটছে মেয়েটা। দৌড়ানোর ধরন রুদ্ধশ্বাস! ওকে ধরা কারোর সাধ্যি নেই। স্যার জানলা দিয়ে মুখ বার করে চেল্লাতে থাকলেন, “কেউ সামনে আসবেন না। সরে যান। সরে যান”। কিন্তু আমাদের সতর্ক করার আগেই বিপদ ঘটে গেল। সামনে দিয়ে একটা চলন্ত ট্রাকের তলায় তলিয়ে গেল ঝুম্পা! সে দৃশ্য বর্ণনা করার নয়। খালি একটা মেয়ের শেষ আর্তনাদ শোনা গেল। দিনে দুপুরে শহর থমথমে হয়ে গেল।
(৬)
আমাদের থানায় যাওয়ার আগে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। আমাদের গাড়ীটাও একটা গাছে ধাক্কা মারে। স্যারের মাথা ঠুকে যায়। আমার হাতে ক্র্যাক আসে। ইলাস্ট্রিক রিস্ট ব্যান্ডেজ নিতে হল। সেদিন রাস্তায় ঝুম্পার সাথে সাথে একটা কাঠের হাতল পাওয়া যায়। কাস্টাডি থেকে ঝুম্পা যখন পালায় তখন একজনকে আহত করে। খাবার দিতে গিয়ে সে জখম হয়। স্যার বললেন, “শেষমেশ বিজ্ঞানের দানের এ পরিণতি!” দেখলাম, স্যারের হাতে সেই কাষ্ঠনির্মিত বন্দুকের মত দেখতে জিনিসটা। সাইবার ক্রাইমে যেতে সমস্তটাই খোলসা হল। স্পেশ্যালিস্ট বিবেক সাঁধুকা বললেন, “ বয়স্ক মানুষেরা যে লাঠি হাতে ধরে হাঁটেন এটা তার একটা ক্ষুদ্র অংশ। অনেকটা হাতলের মত দেখতে জিনিসটা আদতে একটা ছোট্ট বন্দুক যার ভেতরে ট্রিগার আছে। এবার, বুলেটের কথায় আসি। ১.৭ এমএম পেলেট ব্যুলেটে মাইক্রো হোল করে তাতে রাইসিন ঢেলে দেওয়া হয়। তারপর ওপরে মোমের পুরু আবরণ দেওয়া হয়। এবার ধরুন কেউ ফায়ার করল। ছোট্ট পেরেকের মত দেখতে জিনিসটা শরীরে ঢোকে, দেহের তাপমাত্রায় মোম গলে গিয়ে রাইসিন বেরিয়ে আসে। ভিক্টিমের মৃত্যু হবে তিনদিনের মধ্যে চিকিৎসা না করা হেতু। আর এই তিনদিনে স্নায়ুতন্ত্র বিকল, লিভার এবং শরীরের রোগ প্রতিরোগ ক্ষমতা নিস্ক্রিয় হওয়ার সাথে সাথে মারাত্মক ফল ঘনিয়ে আসতে পারে”।
“প্যাঁকপ্যাঁক, এই রাইসিন হল কাস্টর অয়েলের বীজ। অনেক আগেই এটা বেআইনী তকমা পেলেও ক্রাইম এর ওপর ভিত্তি করেই বেশ চলছে। তবে, ঝুম্পাকে পেলে খুব সুবিধে হত। আমার কি মনে হয় জানো, এই পুপে, আদতে মল্লিক দম্পতির মেয়েই নয়!”
গাড়িতে উঠতে গিয়েও থেমে গেলাম। বললাম, “স্যার, আপনি কিসের ভিত্তিতে এটা বলছেন! যেখানে পামেলাদেবী খুব আহত হয়েছেন। পুলিশ ঝুম্পাকে ধরে নিয়ে গেল সেখানে এরকম কি বলা যায়!”
“প্যাঁকপ্যাঁক, আপাতত আমরা অরিন্দম মুখার্জির রেসিডেন্টে যাচ্ছি। উনি ইওরোপ যাচ্ছেন কাল ভোরে। গাড়িতে সব বলছি”।
অরিন্দম মুখার্জি হলেন স্যারের ওপর মহল। আমার প্রপিতামহ! আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে ডিআইজি অরিন্দম মুখার্জি বললেন, “বসো প্রদ্যুম্ন, বসো। ওরে বাবা, সাথে করে আবার পাকোশ ট্যাঁঙরাকে এনেছো দেখছি!”
স্যার খানিক মুচকি হাসলেন। আমার অবশ্য এগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে। বাবা মা ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন পার্থপ্রতীম। সেখান থেকে হয়ে গেল প্যাঁকপ্যাঁক! এখন ইনি আবার বলছেন পাকোশ ট্যাঁঙরা! কালে কালে আমি যে কোথায় গিয়ে পড়বো তার ঠিক নেই!
অরিন্দম মুখার্জি একটা ডিপ ব্লু টিশার্ট এবং থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছেন। গোছগাছ হয়ে গিয়েছে। তবে শহর ছাড়ার আগে প্রদ্যুম্ন স্যারকে কিছু বলে যেতে চান।
“প্রদ্যুম্ন, তোমায় আমি একটা বিশেষ দরকারে ডেকেছি। বিগত কয়েক মাস ধরে শহরে কয়েকটা ক্রাইম হয়েছে যার পেছনে অভিযুক্ত কে, তা ধরা যাচ্ছে না। এমন পাঁচটা কেস আছে। এবার বলি এদের মিল কোথায়। ভিক্টিমেরা প্রায় সকলেই ভিটেমাটি চাঁটি করে এখানে এসেছিলেন এবং পেছনে কোনো আত্মীয় স্বজনের গল্প নেই। অথচ হিউজ ব্যাঙ্ক ব্যালান্স আছে। কিছু কিছু বাড়িতে আবার চুরির নিদর্শন আছে”। এরপর উনি কয়েকটা জেরক্স কপি দিলেন। ওগুলো সমস্ত অসমাপ্ত কেসের দলিল।
“স্যার, এদের পেছনে গ্যাং রোবারস্-রা থাকতে পারে। আমি এখুনি পার্থকে বলছিলাম সেকথা। তাছাড়া এই বিশ্বেশ্বর মল্লিকের কেসটাও সমাজের একটা কাঁটা হয়ে আছে। আমি লোক বলে রেখেছি, মল্লিকের স্ত্রী আপাতত গৃহবন্দী”।
এই সময় আমার ফোনে একটা মেসেজ ঢুকল। আমি ছিলাম স্যারের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে। উনি বসতে বলেছিলেন কিন্তু আমি বসিনি। এবং আলোচনা চলছে বলে ফোন সাইলেন্সে ছিল। দেখলাম, অপরিচিত নাম্বার। মেসেজটা পুরো পড়ার পর আমার অজানা কিছুই রইল না। মনে হল একটা অদৃশ্য বাঁধন আমাকে ঘিরে ফেলেছে। না পারছি গিলতে না পারছি ফেলতে! স্যারের দিকে তাকিয়ে মনে হল, কতদিন আর এভাবে ঘুরব! স্যার অবশ্যি সর্বদা বড় ভাইয়ের মত পাশে থেকেছেন কিন্তু আজ কেন আমি কথাটা ওঁনাকে বলতে পারলাম না, তার উত্তর আমার কাছে নেই।
আন্দাজ তিন ঘন্টা পর একটা সরকারি বাসে করে চলে আসলাম নিউ টাউন। একটা নামী কফিশপে আসলাম। আমি কোয়ার্টার হয়েই এসছি। স্যারের সাথে থাকলে পোশাকের দিকে তেমন নজর দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে আজ আমি একটা সাদা শার্ট ইন করে এবং ন্যারো জিন্স পরে আসলাম। পারফিউম দিয়েছি কারণ যিনি এসছেন তিনি যে সে মেয়ে নন। আর তার সামনে অপ্রস্তুত হলেই মুশকিল! আমি স্যারকে সত্যি সত্যিই অনেককিছুই বলিনি। বিগত এক মাস ধরে পামেলাদেবী আমায় রাতে ফোন করেন। ওনাকে বেশ টেনসড্ লাগে। ধীরে ধীরে আমিও কেমন ওনার কথাগুলোর সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। সেদিন উনি ফোনে বললেন, “আমি বড্ড একা পার্থ! এই একলা বাড়িতে যে কি কি সব হয় তা কি করে তোমায় বোঝাই। আমার সারা শরীরে ওরা এসে অত্যাচার করে যায়। আমি তবুও মুখ বুঝে সব সহ্য করি”। আমি তখন বললাম, “কে, মানে কারা অত্যাচার করে! আমার গলায় তখন একটা বিরক্তি ভাব। বললাম, আপনি যদি বলেন ফোর্স নিয়ে কাল সকালেই চলে যাই”। কিন্তু পামেলা বলল, “না না, আপনি এলেই হবে। প্রদ্যুম্ন বাবুকে দেখলে ভয় করে”।
রাতে যখন উনি ফোন করেন তখন বাজে একটা, দেড়টা, দুটো! ফলে আমার কিছুই করার থাকে না। সকালে যে ঘুরিয়ে ফোন করব তার সাহস থাকে না। তার ওপর স্যার সাথে আছেন।
আজ আমি কফি শপে এসেছি পামেলার সাথেই দেখা করতে। ও মেসেজে লিখল, “পার্থ, কাল রাতে আমি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারিনি। তাই ওরা আমায় মেরেছে খুব। তুমি এখুনি আমার কাছে এসো। আমি তোমায় আমার সারা শরীরের ক্ষত দেখাব!”
আমি তখনই ওকে কফি শপে ডাকি।
পামেলা আজ একটা হাল্কা গোলাপি মাখা শারি পরে এসছে। হাতকাটা ব্লাউজটা জ্বলজ্বল করছে। রঙটা গাঢ় সবুজ। মাথার চুল একপাশে টেনে বাঁধা। নাকের পরেছে পামেলা। কানে দুলটা দুলছিল ও যখন কথা বলছিল। কপালে একটা টিপ। আমি যে কোন পামেলাকে দেখছি তা নিজেই ভুলে গেলাম। সত্যিই, নারীজাতিকে বোঝার ক্ষমতা কার আছে!
“আপনি কিন্তু পাক্কা দেড় ঘন্টা দেরিতে এলেন! আমি না খেয়ে বসে আছি”।
আমি বললাম, “বিশ্বাস করুন, স্যারের সাথে এমন একটা জায়গায় ফেঁসে গেছিলাম…পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। কিসব বলছি, কার কাছে বলছি!”
পামেলা আমার ইতস্তত মুখ দেখে বলল, “থাক, আর বলতে হবে না। তারপর মাথা নিচু করে বলল, আমি তো পর, দুশ্চরিত্রা! আপনি আপনার মনের কথা আমার সাথে কিভাবে শেয়ার করবেন! আমারই ভুল”। এই বলে পামেলা ওঠার উপক্রম করছিল, আমি ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। শরীরে একটা ঝিলিক খেলে গেল। মনে হল কোনো জনহীন প্রান্তর থেকে আমি ছুটে আসছি। কোত্থাও কেউ নেই। দূরে বইছে খরস্রোতা নদী। হঠাৎ আমার হাতটা কে ধরে নিল। শক্ত আর দৃঢ়। চেয়ে দেখলাম প্রদ্যুম্ন ঘোষাল!
যাই হোক, নিজেকে উজানের বিপরীতে নিয়ে চললাম। কান্ডারী, পামেলা!
“আপনি যে এভাবে আমার বাড়িতে পা রাখবেন বুঝতে পারিনি। আসুন, লাঞ্চ তো আর খাওয়া হল না। ডিনারের তৈয়ারি দুই হাতে করি”।
পামেলা আর আমি ওর ঘরে রান্না করছিলাম। ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন। স্যারের ফোন এসছিল দুবার। তোলার সাহস হয়নি। ভাবলাম, যদি পামেলা কিছু বলে তবে স্যারকে আমি তক্ষুনি জানাব। সারা সন্ধ্যেটা হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে কাটালাম। আমাকে অবশ্য কিছুই করতে হয়নি। পামেলা সমস্তটাই করেছে। একবার শুধু রান্নার গ্যাসের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সব ভুলে যেতে চাই। জীবনটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেল। আমি এবার মুক্তি চাই!” কি বলতে কি করে ফেলে, আমি ওকে সরিয়ে নিলাম। খুন্তিটা নিজেই বার দুয়েক নেড়ে নিলাম।
বিছানায় আধ শোয়া অবস্থায় আমি রয়েছি। পামেলা রয়েছে ঠিক পাশে। খাটের হাতলটায় বাঁ হাত রেখে ও আমার কথা শুনছে। আমরা কয়েকটা রিসোর্টের ছবি দেখছিলাম। পামেলাই বলল, “আমি এসমস্ত জায়গা কোনো দিন ঘুরেই দেখিনি!” এভাবেই একটু একটু করে পামেলা আমার শরীরের খুব কাছে চলে আসল। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় দশটা। এখনই না বেরোলে আর গাড়ি পাব না। খাওয়া সেরে নিয়েছি তাড়াতাড়ি। উঠতে যাব কিন্তু হল না। পামেলা আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল। আমি ওরদিকে তাকালাম। কি নেশা ঐ চোখে। দেখলাম, অজান্তেই পামেলার আঁচল খসে পড়েছে। উন্মুক্ত গভীর বক্ষ বিভাজিকা। তারপর, ও আমার কপালে সশব্দে চুম্বন করল। আমিও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। বিশ্বের যে কোনো পুরুষই এই সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। অজান্তেই আমি ওপরে আর নিচে সাপের ন্যায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা পামেলার শরীর। ওর দুটো হাত খামচে আমার পিঠে বিলি কাটছে। দীর্ঘ উষ্ণতা প্রদানের পর পামেলা হাঁপিয়ে উঠল। আমিও ঘেমে গিয়েছি। ও কতকটা ফিসফিস করে বলল, “ভ্যালা মরঘালিস-এর মানে তোমার জানা আছে!” আমি মাথা নাড়ালাম। ও আমার কানে কানে বলল, “অল ম্যান স্যুড ডাই!” তারপর আর কিছুই মনে নেই। মাথায় প্রচন্ড শব্দে কে যেন মারল। ভারি কিছু। আমি ওরম ভাবেই পামেলার ওপর শুয়ে পড়লাম। মনে হল, ঘরে কারা যেন বিচরণ করছে! আর তাদের সাথেই পামেলা গলা মিলিয়ে বলছে, “ইটস্ ওভার মাই বয়!”
(৭)
চোখ খোলার সাথে সাথেই গা-টা কেমন করে উঠল। একটা শিরশির ভাব। শীতল ঘরের জানালায় একজন অনবরত কি লিখে চলেছেন! উঠে বসার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। নার্স বললেন, “শুয়ে থাকুন। লক্ষ্মী ছেলের মত অবাধ্য হবেন না!” নার্স চলে যেতে আমি স্যারের দিকে তাকালাম। উনি এবার বিছানার পাশে এসে বসলেন। জিজ্ঞেস করলাম, “আমার কি হয়েছিল স্যার! আর, পামেলা! ও ঠিক আছে তো!” স্যার খানিক ভেবে বললেন, “ঠিক আছে। স্বামীর সাথেই আছে। তোমাকে আর ভাবতে হবে না”। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম….স্যার আবার বললেন, “কলা খাবে নাকি বাটাম!”
অবাক হয়ে গেলাম। কলা বাটাম এসব কি বলছেন স্যার! অবাক হয়ে আছি দেখে স্যার বললেন, “তোমাকে আমরা কালীঘাট বেশ্যাখানায় খুঁজে পাই। ওরা তোমার আন্ডার ওয়্যার দিয়ে গুলতি বানিয়ে খেলছিল! একটা কথা কি জান প্যাঁকপ্যাঁক, আমাদের এই কাজের সাথে ইমোশান বস্তুটিকে সরিয়ে রাখতে হয়। যত সরিয়ে রাখতে পারবে তত তুমি স্বাধীন। দূর সীমান্ত থেকে তুমি ছুটে আসছিলে। সামনে খরস্রোতা নদী! আরেকটু হলেই তুমি তলিয়ে যাচ্ছিলে তাতে। আমি খপাৎ করে এভাবেই কলারটা ধরে নিলাম”। এই বলে স্যার সত্যি সত্যিই আমার গলার কাছটা চেপে ধরলেন। আমি প্রায় তারস্বরে চিল্লে উঠলাম।
এই কেসটা যে আর কিভাবে নিজের রঙ বদলাবে সেটা জানতেই আমরা চলে আসলাম পেলিং-এ। সিকিম হয়ে পেলিং ঢোকার পূর্বে গল্প অনেক আছে। আমি যখন অসুস্থ ছিলাম স্যার এই সমস্ত খবর পেয়েছেন। শুনতে খারাপ লাগলেও শুনতে তো হবেই!
আসল গল্পটা কিছুটা এই রকম। বোধিধার্মা একাডেমিতে যে দুটি কাঙ্গান আসে সেটা আদতে নকল! কিন্তু এই নকল জিনিসের মূল্য আকাশছোঁয়া। আদতে এই নকল কাঙ্গান দুটির মধ্যে ছিল হীরের অগুন্তি দানা। সব মিলিয়ে প্রায় কোটি টাকার খেলা। বিষয়টি প্রথম উপলব্ধি করেন বিশ্বেশ্বর মল্লিক। জানার পর থেকেই তাঁর চিন্তা বাড়ে। মাথার জট তো কাটেই না তার ওপর এটা শোনেন যে, এই দুটি বেনামি লটে এসছে। অর্থাৎ, এর আসল গ্রাহক খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ স্মাগলার বা বড় মাপের মাফিয়া হতে পারে। স্যার বলেন, “হতে পারে এর মাঝেই ইতিহাসের অধ্যাপক শিবশঙ্করের সাথে ওনার সাক্ষাৎ হয়। ব্যাস! শিকার শিকারী মুখোমুখি!”
এরপর, বিশ্বেশ্বর মল্লিক আমাদের ডাকেন। তবে উনি আমাদের সব খোলসা করলেন না। পেটে কিছু কথা রেখে দিলেন। যেমন, ওনার স্ত্রীর অবর্তমানে কাজের মেয়ে ঝুম্পার সাথে ওনার শরীরী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকি ঝুম্পা যখন মারা যায় তখন ও কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল! তাছাড়া, পুপে ওদের নিজেদের মেয়ে নয়। দত্তক নেওয়া কন্যা। অবশ্য নিজের প্রাণের ভয়ের কথাটা উনি বলেছিলেন। আমরা যখন পেলিং-এ আসি তখন দুজন মানুষের ওপর খটকা লাগে। এক, পূর্ণিমা সাংপো এবং প্রমূখ সাংপো! এরা দুজন সবে পেলিং-এ এসে থাকছেন। খুব শিগগির নেপাল হয়ে নর্থ ওয়েস্ট বা চীনে পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবছেন। অন্তত তাদের গতিবিধি তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আমরা যখন দার্জিলিং মেল-এ উঠলাম তখন রাত সাড়ে এগারোটা। ফোন রেখে স্যার বললেন, “মানসিং কিছু জানে না বলছে! তবে, শেয়াল দেবতার মূর্তিতে লুকোচুরির নিদর্শন পাওয়া গেছে!”
আমি বললাম, “স্যার, হেঁয়ালি করবেন না। বলে ফেলুন। এই যে পেলিং-এ যাচ্ছি, আদেও ফিরে আসব কিনা সন্দেহ!” আমি কিছুটা ভয়ে ভয়ে বললাম। একটা কেস নিয়ে যা চলছে। একটা জোড়ালো হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল।
“মনে আছে প্যাঁকপ্যাঁক, শেয়াল দেবতার মূর্তির গায়ে সেই ভাঙা সিমেন্টের খন্ডটা। তুমি বললে, ভেঙে গেছে কেউ রঙ করেছে! না, তা নয়। ওটা আদতে একটা ঘর। যার ভেতরে কয়েকটা ছেঁড়া পোশাক, নকল দাঁড়ি গোফ ছিল। মেয়েদের হাতের একটা আংটি পাওয়া গেছে। আপাতত ওবেলার ডাল ভাতে সন্তুষ্ট হও। পেঁয়াজ কলি রাতে খাবে। শুভরাত্রি”। এই বলে, স্যার নিজের স্লিপারে শুয়ে পড়লেন। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শুলেন। আমরা খেয়েই উঠেছিলাম। তাই ঘুম আসতে বেশিক্ষণ লাগল না।
পেলিং-এ গিয়ে আমরা ‘সুভাষ রেজেন্সিতে’ উঠলাম। নেপালি ভদ্রলোক চরণ সিং আমাদের ঘর দেখিয়ে দিলেন। অবশ্য তার আগে আমাদের পোশাকের বিবরণ জানিয়ে রাখা শ্রেয়। আমি পরলাম লাল আলখেল্লার মত পোশাক। কোমরে হলদে পাড়। মাথায় এমব্রয়ডারির টুপি। চোখে কাজল। হাতা ঢোলা ঢোলা। স্যার অবশ্য পশমের নকল চুল পরলেন। মুখে একটা পাইপ। অবশ্য স্যারের বহুদিনের ইচ্ছে, এই পাইপ খাওয়া। কোমরে সযত্নে রাখলেন রিভলবার। স্যারের কোর্টটা ময়ূরের পেখমের মত। জামার রঙ বিস্কুট কালার।
হাতে তিনদিন সময়। স্যার ছবি দেখালেন। বললেন, “তুমি শেষবার পামেলাকে দেখেছিলে। ভালো করে দেখো তো এদের কাউকে একই রকম দেখতে কিনা”। দেখলাম, একজন নেপালি গোছের পুরুষ আর মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে গোলাপের বাগান। পুরুষটিকে দেখে চেনার উপায় নেই। মাথায় বিশাল এক টুপি। মেয়েটির চোখ দেখাই যাচ্ছে না। আমি বললাম, “স্যার, এরা তো নেপালি! এদের কি আবার চিনব!”
স্যার এবার মেঝের দিকে চেয়ে বললেন, “ভাবতাম তুমি শুধু কানেই ঢুকিয়ে রেখেছো! এখন দেখছি কানের সাথে সাথে চোখেও তুমি… “ না না, দেখছি স্যার। আর এগোতে হবে না”। আবার ভালো করে দেখে একবার সেই রাতের কথা ভাবলাম। পামেলার চোখ, ঠোঁট, গলা— না, কিছুই মিলছে না।
সারা সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গেল। আমরা দূরে একটা রিসোর্টে ব্যলকনি থেকে বাইনোকুলার দিয়ে প্রত্যক্ষ করছিলাম। মনোরম পরিবেশ। মেঘেরা থেকে সমস্ত কিছুই আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। দূরে পাশবালিশের মত ঢিপি দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে থেকে থেকে। স্যার একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “প্যাঁকপ্যাঁক, তৈরি হও। আসামি আগত”। ঘুরে দেখি দরজা খুলে দম্পতি বের হলেন। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু স্যার, আমার হাত ধরে নিলেন। ওনার চোখ দাঁড়িয়ে গেছে। আমিও দেখলাম। দম্পতি কেবল একা আসেননি। ওদের পেছনে আছে একটি শিশু। বছর আষ্টেকের শিশুটার কাঁধে ব্যাগ। সে কেবলই তার মায়ের হাত ধরে টান দিচ্ছে। আমরা নিজেদের আর্মস গোপন করলাম। এমন কথা ছিল না! এই অবস্থায় ফায়ার করা সমীচীন হবে না। আমরা পিছু হটলাম। স্যারের চোখ তখনও ওদিকেই। ধীরে ধীরে নিজেদের কটেজ-এ ফিরলাম।
আমরা ফিরে আসার দশ মিনিটের মধ্যে সিঁড়িতে পায়ের শব্দে ঘুরে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। স্যার অবশ্য পায়ের ওপর পা তুলে আগন্তুকদের দিকে চেয়ে রইলেন। এসেছেন মোট দুজন। পূর্ণিমা সাংপো আর প্রমূখ সাংপো! স্যার চোখের কাজল মুছে বললেন, “বসুন। আমাদের বেকার এত দৌড় করালেন!” তখনও আমি স্তম্ভিত হয়ে আছি। আমাদের সামনে এত বড় মাপের দুজন আসামি দাঁড়িয়ে আছেন, আর স্যার হেঁয়ালি করে যাচ্ছেন।
স্যার কোমরে সবে হাত রেখেছেন… “খবরদার মি.ঘোষাল! পিস্তলে হাত দেওয়ার আগে আমাদের দিকে তাকাবেন একবার!” স্যার সামান্য হেসে চেয়ারে হেলান দিয়ে দীর্ঘস্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “নিচে যে বাচ্চা মেয়েটা খেলছে ও আপনাদের নিজেদের তাই না পামেলাদেবী! কি, শিবশঙ্কর ব্যানার্জি!”
এরপর ওরা ধীরে ধীরে নিজেদের পোশাক খুলে আসল রূপ দেখাল। আমিও দেখলাম, সেই রাতের পাগল করা চোখ, উষ্ণতা আজও ঝরে পড়ছে, পামেলা! শিবশঙ্কর বললেন, “আমি সেদিনই বুঝেছিলাম প্রদ্যুম্নবাবু! ভুবনেশ্বরী কলেজে অন্তত প্রদ্যুম্ন ঘোষাল বলে কোনো অধ্যাপক নেই। হ্যাঁ, তবে ভবানীভবন হেড কোয়ার্টারে ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার থাকলেও থাকতে পারেন”।
আমি তখন বাধ্য হয়ে বললাম, “আপনারা এভাবে পিস্তল দেখিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে পারেন না। আইন নিজের হাতে নেবেন না”। এবার পামেলা কথা বলল। “একটা কথা বলবেন আপনি। চুপ করে থাকবেন। আজ আপনাদের আমাদের কথা শুনতেই হবে”।
স্যার, আমায় হাত দেখিয়ে শান্ত হতে বললেন। তারপর বললেন, “আপনারা পিস্তল নামিয়ে যা বলার বলুন”।
শিবশঙ্কর ব্যানার্জি একটা চেয়ার দখল করে কোনো রকমে বসলেন। টেবিলে রাখা ঠান্ডা গেলাসের জল খেয়ে বললেন, “আপনারা সবকিছু না জেনেই তদন্তে নেমেছেন। আপনাদের জন্যেই আমরা প্রায় গৃহবন্দী হয়ে আছি। আমি আর আমার স্ত্রী পামেলা, এখন আমাদের সন্তান নিয়ে সুখে আছি”। কথাটা বলে একবার উনি পামেলার দিকে তাকালেন। আমিও বেশ অবাক হলাম। লোকটা কি বদ্ধ উন্মাদ! যাই হোক, উনি বলে যাচ্ছেন।
“আপনারা হয়তো তামিল গল্পগাথা সিলাপাদিকারাম এর কথা জানেন। কান্নাগি বলে একজন নারী চরিত্রের জয়গান আছে এই গল্পে। তার স্বামী কোভালান একসময় এক নর্তকীর প্রেমে পড়ে। এমনকি সে তার স্ত্রীকে পর্যন্ত ছাড়তে বাধ্য হয়। পরে অবশ্য মিথ্যে চুরির অপবাদে কোভালানের মুন্ডচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু কান্নাগি যখন জানতে পারে তখন সারা শহর জুড়ে ঝর ওঠে। কান্নাগি প্রমাণ করে, ঐ কাঙ্গান আদতে ওর নিজের। যেটা কোভালানের হাতে ছিল। অর্থাৎ রাণীর কাঙ্গান কোভালান চুরি করেনি। চুরি করেছে আদতে একজন স্বর্নকার! রাজা নিজের ভুল বুঝে মৃত্যুবরণ করে। কান্নাগি নিজের প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবাসার পাত্র নিজের স্বামীকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গেলেন। কোভালান এসছিল এই শহরে কাজ খুঁজতে। কিন্তু যখন প্রাণ রইল না আর কাজ! কান্নাগি গোটা শহরকে অভিশাপ দিলেন। নিজের বুক কেটে বলি দেন কান্নাগি! বর্তমানে খ্যাত হয়ে আছে কান্নাগি নামক নারীর এই রক্তক্ষয়ী বলিদান। দেবী হিসাবে তিনি পুজ্যিত। এই গল্প শোনানোর একটাই কারণ হল পামেলা! বুঝলেন মি.ঘোষাল!” স্যার আর আমি দুজনেই গল্প শুনছিলাম। শিবশঙ্কর বললেন, “বিশ্বেশ্বর মল্লিক ছিলেন বিপত্নীক কিন্তু ওর স্বভাব, চরিত্র ঠিক ছিল না। ছোটোবেলা থেকেই আমার সাথে ওর এই প্রতিযোগিতা! আমি কিছু চাইলেই ওর সেটা আগে দরকার। আমি আপনাকে মিথ্যে বলেছি মি.ঘোষাল। মল্লিককে আগে থেকেই আমি চিনতাম। ও একটা সময় টাকার জোরে আমার কাছ থেকে পামেলাকেও ছিনিয়ে নিল। লম্পট গোছের মানুষ ছিলেন একটা। কি না করেছেন। ঝুম্পাকেও ছাড়েনি! শেষে যখন জানতে পারল পামেলা অন্তঃসত্ত্বা তখন ওর মাথার ঠিক ছিল না। বোধয় পামেলাকে ও ভালোবেসে ফেলেছিল”।
স্যার এই সময় বললেন, “পামেলাদেবী যে প্রেগন্যান্ট তার প্রমাণ কি!”
পামেলা গান সরিয়ে একটা জিনিস আমার হাতে দিল। একটা মোটা থার্মোমিটারের মত দেখতে জিনিসটা। যা দিয়ে প্রেগন্যান্সি টেস্ট ঘরে বসেই করা যায়।
“আমি জিনিসটা আগেই সরিয়ে নিতে বলি পামেলাকে। সেদিন আমাদের প্ল্যান সব ঠিকই ছিল। ঝুম্পা ঘর মুছতে যাচ্ছিল। পামেলা বসে খবরের কাগজ পাতা ওল্টাচ্ছিল। দূরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে মল্লিক বসেছিলেন। বারান্দা দিয়ে ঢুকে ফায়ার করলাম। ছোট্ট প্যালেট ব্যুলেট সোজা যাচ্ছিল মল্লিকের দিকে কিন্তু পুপে হঠাৎ সামনে চলে আসে। মনে হবে, ছোট্ট পোকা মাকড় কামড়েছে। পুপে শুয়ে পড়ল। গলায় লাগার ফলে ওখানেই আমার হাতে শিশুটা মারা যায়। কিন্তু মল্লিক যে কখন মারা গিয়েছেন আমরা এখনো জানি না। খালি ওর হাতে এই যন্ত্রটা পামেলা পেয়েছিল। অন্য কারোর সাথে স্ত্রী-এর শারীরিক সম্পর্ক আছে, সেটা জেনেই ও মারা যায়। বোধিধার্মা একাডেমিতে আমি ওকে সাবধান করে দিই। বন্ধু হয়ে ও আমার যে ক্ষতি করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত ওকেই করতে হবে”।
স্যার বললেন, “এবার কি করবেন ভাবছেন! আর পামেলাদেবী, আপনি ছেলেটাকে এভাবে ব্যতিব্যস্ত নাই করতে পারতেন। প্যাঁকপ্যাঁক, আর কিছু কি জানার বাকি রইল!”
পামেলা বলল, “আমরা কিন্তু কারোর ক্ষতি করিনি। তবে, পুপেকে আমরা হারাতে চাইনি। ওটা আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল। এখনো ভুগছি তার জন্যে। নিজের মেয়ের কথা ভাবলেই পুপেকে সামনে দেখতে পাই”।
“কাঙ্গান দুটো কি দেখা যেতে পারে মি. ব্যানার্জি!” স্যারের কথায় শিবশঙ্কর জামার পকেট থেকে বের করে ওটা দিলেন। বললেন, “এতে হীরে টিরে কিছুই নেই মি.ঘোষাল! এটা সামান্য দুটি কাঙ্গান। এরা আমাদের মতই নির্দোষ। আমি যখন এগুলো মল্লিককে দিই, তখন তামিল গল্পগাথা শুনিয়ে ছিলাম। বলেছিলাম, তোর ওপর কান্নাগির অভিশাপ লাগবে”।
স্যার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন আর তখনই ‘গুড়ুম’ করে একটা শব্দ হল। আমরা প্রায় ঘরের মধ্যে অবচেতন হয়ে পড়লাম। স্যার উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। আমি দেখলাম, মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। শিবশঙ্কর ব্যানার্জি নিজের ওপর গুলি চালিয়েছেন। পুপের গলায় আঘাত লেগেছিল বলেই উনি নিজের গলায় শুট করলেন। অর্থাৎ সুইসাইড! মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। স্যার ঈশারায় পামেলাকে ধরতে বললেন। কিন্তু আমি যাওয়ার আগেই পামেলা নিজেই ঝপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। আমি যে কি করব বুঝতে পারছি না। পামেলার হাতেও গান। ও যদি আচমকা ফায়ার করে বসে! শিবশঙ্করের মুখে একবার হাত দিয়েই নিজেকেই গুলি করলেন পামেলা! ‘গুড়ুম’।
দেহগুলো সরিয়ে ফেলার পর পায়ে মনে হচ্ছিল কি একটা জড়িয়ে ধরেছে। আসলে পর পর দুটো হত্যা একেবারে আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছে। দেখলাম, সেই বাচ্চা মেয়েটি! ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। আমি কোলে তুলে নিলাম। নিরীহ শিশুটা কাঁধে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল।
স্যার বললেন, “সিলাপাদিকারাম! আগে যদি গল্পটা জানতাম তাহলে জল এতদূর আসত না। নব দম্পতি সবে সুখের ভাত খাচ্ছিলেন। আমরা এসে ঘি ঢেলে দিলাম। প্যাঁকপ্যাঁক আমরা মানুষের মধ্যে থেকেও কেমন যেন নেই। তুমি আবেগের বশবর্তী হলে আর আমি বড্ড দেরি করে ফেললাম! যাই হোক, সিলাপাদিকারাম আপাতত শেষ। তুমি কেসটা সাজিয়ে নিও”।
কথাখানি বলে স্যার এগিয়ে গেলেন। অন্ধকারেও স্যারের সাদা জামাটা জ্বলজ্বল করছে। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম। পামেলার কথা খুব মনে পড়ছে। ও আমাকে ঋণী করে গেল!
দু সপ্তাহ কেটে গেছে। গোবিন্দ-র হোটেলে বসে স্যার কাটলেট খাচ্ছেন। অফিসে এখন আবার ভাটা চলছে। পেলিং-এর ঠান্ডা আর এখানে গরম। শরীর বিগড়ে গেছে। আমাকে দেখে স্যার বললেন, “এসো প্যাঁকপ্যাঁক, মুচমুচে কাটলেট খেয়ে যাও”। আমি বললাম, “না স্যার, পিকুকে আগে স্কুলে ছেড়ে আসি। তারপর খাবো মজিয়ে”।
দেখলাম, স্যারের চোখ ছানাবড়া। আমার পাশে পিঠে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিকু। পামেলার অন্তিম নিদর্শন।